Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পরদিন সকালবেলা কেপুবাবু

পরদিন সকালবেলা কেপুবাবু খুবই সন্তর্পণে রাধাগোবিন্দর বাইরের ঘরে ঢুকে একটু গলাখাকারি দিলেন। আত্মজীবনী রচনায় মগ্ন রাধাগোবিন্দ আবশ্য সেই শব্দ শুনতে পেলেন না। কেপুবাবু ফের একটু জোরে গলাখাকারি দিয়ে মোলায়েম গলায় ডাকলেন, “রাধাদা!”

রাধাগোবিন্দ মুখ না তুলেই মাথা নেড়ে বললেন, “রাধা নেই, বাজারে গিয়েছে।”

একটু বিস্মিত কেপুবাবু বললেন, “আপনি যে বর্তমানে নেই তা বুঝতে পারছি! কিন্তু বাজারেই কি এখন আপনাকে পাওয়া সম্ভব?”

রাধাগোবিন্দ সম্পূর্ণ মগ্ন অবস্থাতেই বললেন, “অ তা আছে বোধ হয় কোথাও, ভিতরে দ্যাখোগে।”

কেপুবাবু বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, “কথাটা আপনার জানা দরকার। একটু কষ্ট করে অতীত থেকে যদি বর্তমানের দিকে আসেন, তা হলে ভাল হয়।”

‘দারোগার দীর্ঘশ্বাস’ লেখা থামিয়ে অগত্যা রাধাগোবিন্দ মুখ ফেরালেন। তারপর চিনতে পেরে বলে উঠলেন, “কেপুবাবু যে! তা কাকে খুঁজছিলেন যেন?”

“আপনাকেই।”

“আমাকে! কেন, আমি কোথাও গিয়েছিলুম নাকি?”

“তা তো বটেই। এখন আর তখনের মধ্যে আপনার নিত্যি যাতায়াত। তা যে কথাটা বলতে আসা। আপনি যে একজন

দারোগা ছিলেন, সেটা কি আপনার মনে আছে?”

“থাকবে না মানে? কত গুন্ডা-বদমাশ, চোর-চোট্টা, ডাকাত ছেলেধরা ঠান্ডা করেছি। রোমহর্ষক সব ঘটনা। বইটা বেরোলেই দেখবেন, কেমন ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়ে!”

“সে তো বটেই। কিন্তু এত বড় ডাকসাইটে দারোগা হওয়া সত্ত্বেও আপনাকে কেউ পুঁছছে কি? এই যে সব বিদঘুঁটে কাণ্ড নাকের ডগায় ঘটে যাচ্ছে, আপনার কি মনে হয় না, গায়ের লোকের আপনার কাছে এসে পরামর্শ নেওয়া উচিত ছিল?”

“বটেই তো! কিন্তু গায়ে হচ্ছেটা কী?”

“কী হচ্ছে না বলুন? পায়েসপুরে বহিরাগত উগ্রবাদী ঢুকে বহাল তবিয়তে বসবাস তো করছেই, সেইসঙ্গে ফুটবল খেলছে, মারদাঙ্গা করে বেড়াচ্ছে। সাধুর ছদ্মবেশে ডাকাত ঢুকে নগেনবাবুকে হুমকি দিয়ে গিয়েছে, আর গতকাল বটেশ্বরকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়েছে।”

অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে রাধাগোবিন্দ দাঁড়িয়ে পড়লেন, “ডাকাতি! মুক্তিপণ! ওরে শিগগির পিস্তলসমেত আমার ক্রস বেল্টটা নিয়ে আয়, আর ইউনিফর্মটাও দে।”

“আহা, অত তাড়া কীসের রাধাদা? স্থির হয়ে বসুন। এখন আপনি বর্তমানে আছেন, সেটা কি ভুলে গেলেন?”

রাধাগোবিন্দ একটু লজ্জিত হয়ে বললেন, “তাই তো! হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন? বটেশ্বর? তা কত মুক্তিপণ চেয়েছে?”

“এখনও চায়নি। তবে বটেশ্বরের বাবা করিতকর্মা লোক। আগে থেকেই কালেকশন তুলতে শুরু করেছে। আপনার বাড়িতেও এল বলে।”

“এ যে ঘোর অরাজকতা! এর তো বিহিত করা দরকার?”

“তা তো বটেই। আর সেই জন্যই তো আপনার কাছে আসা। দেশমাতৃকার তো এখন আপনার মতো সুসন্তানকেই দরকার। ঘাপটি মেরে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন বলে কেউ টের পায় না যে, আপনিও এই পায়েসপুরের গৌরব। এই যে হারাধন পায়েসপুরের এত সুখ্যাতি করে বেড়ায়, সে কি ভুলেও একবার নাম উচ্চারণ করে? অথচ আপনি কার চেয়ে কম বলুন তো? এই যে মদনপাগলা আপনাকে জানালা দিয়ে বক দেখায়, এই যে খগেন তপাদার সেদিন চণ্ডীমণ্ডপে বসে বলছিল, “ওহে রাধাগোবিন্দ যেমন দারোগার দীর্ঘশ্বাস নামে বই লিখছে, তেমনই কালুচোরও নাকি পালটা আর-একখানা পুঁথি লিখে ফেলেছে, নাম দিয়েছে ‘দারোগার নাভিশ্বাস। তা লিখবে না-ই বা কেন? কালুকে ধরতে গিয়ে নাকি রাধাগোবিন্দ একবার কুকুরের তাড়া খেয়ে পুকুরে পড়েছিল, আর-একবার নয়নপুরের জলায় কাদায় পড়ে চার ঘণ্টা আটকে থাকে। ভুল করে নসিবপুরের যাত্রার দলের প্রম্পটারকে কালু মনে করে পাকড়াও করায় পাবলিকের কাছে হেভি ঠ্যাঙানি খায়। শেষে লোকে তার নামই দিয়েছিল ‘গাধাগোবিন্দ’। শুনুন কথা! আপনি চোখ-কান বুজে থাকেন বলে এসব কথা আপনার কানে যায় না, আর লোকেও আশকারা পেয়ে যায়। তাই বলছি, একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বুক ফুলিয়ে গায়ে কয়েকটা চক্কর দিয়ে আসুন তো!”

রাধাগোবিন্দ হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, “বটে! আম্পর্দা তো বড় কম নয়!”

“আম্পদার কথা আরও শুনবেন? এই যে ভূপেনদারোগা এতবার করে গায়ে রোদ দিতে আসে, একটিবারও কি এসে আপনাকে সেলাম জানিয়ে যায়? সে কি জানে না যে, আপনি কত বড় একজন উঁদরেল দারোগা ছিলেন? লোকে তো শিখতেও আসে, না কি! তারপর ধরুন, এই যে নিধে হাজাম সেদিন আপনাকে খেউরি করে পয়সা নিয়ে গেল, সেটা কি তার উচিত হয়েছে? কে না জানে, পুলিশ-দারোগাদের সেবা করলে পুণ্যি হয়। খেউরির পয়সাটা সে তো ভেটই দিয়ে যেতে পারত! ওটুকু তো আপনার ন্যায্য পাওনার মধ্যেই পড়ে! ইশকুলের যে পুরস্কার বিতরণী সভা হয়ে গেল, তাতে গাঁয়ের সব ক’জন মান্যগণ্য লোককে ডাকা হল, শুধু আপনি বাদে। আমি নবীনমাস্টারকে যখন বললাম, ‘কাজটা কি ঠিক হল হে নবীন? রাধাগোবিন্দবাবুও তো একজন কেষ্টবিষ্ট লোক!” শুনে নবীন কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে চোখ কুঁচকে বলল, ‘কে, কার কথা বলছেন? রাধাগোবিন্দটা আবার কে? শুনুন কথা! সেই যে আপনার কনস্টেবল নিকুঞ্জ বৈরাগী, তার শ্বশুরবাড়ি তো এই পায়েসপুরেই। গত জামাইষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ি এসেছিল, আমি গিয়ে বললাম, ‘ওহে নিকুঞ্জ, একবারটি তোমার বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করে যাবে না?” নিকুঞ্জ কাঁঠাল খাচ্ছিল, খেতে-খেতেই হিহি হেসে বলল, ‘রাধাবাবুর কথা আর কবেন না কর্তা! ওঁর সামনে গেলে আমি হেসেই মরে যাব! আমি বেআদবটাকে বললাম, কেন? রাধাদাকে দেখে তো মোটেই হাসি পায় না?’ তখন বলল কী জানেন? বলল, ‘রাধাবাবু এমনই নিষ্কর্মা দারোগা ছিলেন যে, তাঁর আমলেই থানায় ডাকাতি হয়েছিল। আর রাধাবাবু ডাকাতের ভয়ে ইউনিফর্ম ছেড়ে আন্ডারওয়্যার পরে লকআপে কয়েদি সেজে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন। তাই দেখে ডাকাতদের সে কী হাসি! লুটপাট করে যাওয়ার আগে তারা রাধাবাবুকে সাত হাত নাকে খত দিইয়েছিল।

মশাই, রাধাবাবুকে দেখলেই ফের হেসেটেসে ফেলব। রাধাগোবিন্দ বিস্ফারিত লোচনে কিছুক্ষণ কেপুবাবুর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ তার সমস্ত উত্তেজনা আর রাগ অন্তর্হিত হল। চোখদুটো আস্তে-আস্তে ছোট হয়ে এল এবং গোলাকার মুখটা হঠাৎ যেন চৌকোমতো হয়ে গেল। কেপুবাবু খুব তীক্ষ্ণ চোখে রাধাগোবিন্দবাবুর পরিবর্তনটা দেখছিলেন। এমনিতেই খুব লম্বা-চওড়া চেহারার রাধাগোবিন্দর শরীরটাও যেন হঠাৎ টনটনে শক্তপোক্ত হয়ে উঠল। নিকুঞ্জ বৈরাগী জনান্তিকে কেপুবাবুকে এই লক্ষণটার কথাই বলেছিল বটে! বলেছিল, ‘রাধাবাবু এমনিতে শান্তশিষ্ট হলে কী হয়, যখন এই লক্ষণগুলো দেখবেন, তখনই বুঝবেন যে, ওঁর ভিতরে একটা খ্যাপা ষাঁড় জেগে উঠেছে। তখন স্বয়ং যমও ওঁর সামনে দাঁড়াতে পারে না। বন্ধুডাকাতকে এই ভাবেই তো কাত করেছিলেন উনি। ঠিকমতো খেপিয়ে তুললে ওরকম ডাকাবুকো লোক ভূভারতে পাবেন না।

কেপুবাবুর দিকে স্থির চোখে চেয়ে হিমশীতল গলায় রাধাগোবিন্দ প্রশ্ন করলেন, “নিকুঞ্জ বৈরাগী কোথায়?”

কেপুবাবু তটস্থ হয়ে বললেন, “আহা, সে কি আর হাতের নাগালে বসে আছে দাদা? কোন থানায় ডিউটি দিচ্ছে কে জানে!”

“খগেন তপাদার কোথায়?”

কেপুবাবু মাথা নাড়া দিয়ে বললেন, “সেও গাঁয়ে নেই। তবে তাকেও সময়মতো ঠিকই পাওয়া যাবে।”

“ভূপেনদারোগা কোথায়?”

“তার কি আর নাওয়া-খাওয়ার সময় আছে দাদা? পাঁচটা গ্রাম রোদ দিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। চুরি-ডাকাতি যা বেড়েছে, কহতব্য নয়।”

“নবীনমাস্টার কোথায়?”

“এখন ইশকুলে কীসের যেন ছুটি চলছে, তাই নবীন বুঝি গত পরশুই মামাবাড়ি গেল!”

“মদনপাগলা কোথায়?”

“সে পাগলছাগল মানুষ, কোন আলায়বালায় ঘুরছে কে জানে? আমি বলি কী, সব কটাকে একসঙ্গে ঢিট করতে গেলে একটু ভজঘট্ট লেগে যাবে। আপনি বিচক্ষণ মানুষ, নিশ্চয়ই জানেন যে, প্রায়োরিটি বুঝে একটা-একটা করে কাজ সেরে ফেলতে হয়। সবক’টা একসঙ্গে নয়। তাই বলছিলাম, এখন সবচেয়ে জরুরি হল, সেই ছেলেধরা সাধুটার হাত থেকে আমাদের বটেশ্বরকে উদ্ধার করা।”

“সাধু কোথায়?”

“প্রতাপগড়ের জঙ্গলে। সে বড় ভয়ংকর জায়গা। দিনেদুপুরে লোক ঢুকতে সাহস পায় না।”

“প্রতাপগড়ের জঙ্গল কোথায়?”

“উত্তর দিকে। তা বলে হুট করে রওনা হয়ে পড়বেন না। সাধু হোক, ছেলেধরা হোক, সে সোজা পাত্র নয়। আমাদের পালোয়ান বটেশ্বরকে নেংটি ইঁদুরের মতো তুলে নিয়ে গিয়েছে। সুতরাং তার মোকাবিলার জন্য প্রিপারেশন দরকার। সঙ্গে একটা অস্ত্রট থাকলে ভাল হয়। অন্তত একটা লাঠি।”

রাধাগোবিন্দ ভারী অবাক হয়ে বললেন, “অস্ত্র! অস্ত্রের কী দরকার? এই দুটো হাতই যথেষ্ট!”

এই বলে রাধাগোবিন্দ দড়াম করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।

০৩.

গদাইয়ের হল কষ্টের কপাল। তা কেষ্ট পেতে গেলে কষ্ট তো কপালে আছেই। কিন্তু গদাই কেষ্ট চায় না, এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস, কেষ্টও তাকে চায় না। তাই গদাইয়ের হল কেষ্টহীন কষ্টের জীবন। যে কাজটা মানুষের এক লহমায় হয়, গদাইয়ের হতে লাগে সাত দিন। এই যে কষ্ট করে-করে আদাড়েপাদাড়ে ঘুরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে সাপ ধরে বিষ আদায় করে নেয়, তার বদলে পায় ক’টাই বা পয়সা? অথচ সে শুনেছে, দশ-বিশ গ্রাম সাপের বিষের নাকি লাখো টাকা দাম। কিন্তু সীতেশবাবুকে কে বোঝাবে সে কথা? কখনও পঞ্চাশ, কখনও একশো টাকা ঠেকিয়ে বিদেয় করে দেন। তারপর ধনেশ পাখির তেল, মৃগনাভি, বাঘের দাঁত, চমরি গোরুর লেজ, পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ, দক্ষিণাবর্ত শাখ, এসবেরও কি আর বাজার আছে? শুনলে লোকে নাক সিটকোয়। কাউকে গছাতে পারলেও নগদ দাম পাওয়া যায় না, সব বাকির খদ্দের। অনেকে আবার ভেজাল জিনিস মনে করে দুর-দুর করে তাড়িয়েও দেয়। এসব জিনিসের সমঝদার নেই মোটে।

দিনকাল যখন খুবই খারাপ যাচ্ছে, তখনই ঘটনা। সে প্রতাপগড়ের জঙ্গলে বিরল গাছগাছড়ার খোঁজে সারাদিন ঘুরে-ঘুরে হয়রান হয়ে ভাঙা কেল্লার লাগোয়া পুরনো শিবমন্দিরের চাতালে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। গরিবের তো ভয়ডর, শীত-গ্রীষ্ম, আরাম-আয়েশের ব্যাপার নেই। ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে!

বুকে একটা খোঁচা খেয়ে ঘুম ভাঙল শেষ রাত্তিরে। চোখ চেয়ে দ্যাখে, সামনে এক বিভীষণ সাধু হাতে মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে। অন্য হাতে এক প্রকাণ্ড ত্রিশূল তার বুকে চেপে ধরে আছে। গদাইয়ের আত্মারাম তখন বুকের মধ্যে পাখা ঝাঁপটাচ্ছে। তবে বিপদআপদ নিয়েই বাস। তাই তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, “পেন্নাম হই মহারাজ।”

“তুই কে?”

“আজ্ঞে, আপনার শ্রীচরণের দাস বলেই মনে করুন। লোক তেমন খারাপ নই, তবে বড় অনটন যাচ্ছে। মন্তর নিলে কি কিছু সুবিধে হবে বাবা?”

ভেবেছিল কুপিত সাধু বোধ হয় ত্রিশূলটা তার বুকে ঢুকিয়েই দেবে। অতটা অবশ্য করল না। ত্রিশুলটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “তোর কীসের অনটন?”

গদাই তড়াক করে উঠে সাধুর পায়ে সাষ্টাঙ্গে একটা প্রণাম সেরে নিয়ে বলল, “আজ্ঞে, কিসের অনটন নয় বলুন বাবা! চাল, ডাল, নুন, তেল, কাপড়চোপড়, গাডু-গামছা, ঘরদোর, যার নাম করবেন তারই অনটন। সাপখোপ ধরে আর জড়িবুটি বেচে মোটেই চলছে না বাবা!”

সাধু জুলজুল করে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে বলল, “তোর হাতে ওটা কীসের বালা রে?”

“আজ্ঞে, এটা লোহার বালা। এক ফকির দিয়েছিল।”

“দে ব্যাটা, ওটা খুলে দে।” সাধু তার ঝোলা থেকে একখানা পাথর বের করে বালায় ঠেকাতেই সেটায় যেন দপ করে আগুন ধরে গেল। প্রথমটায় আগুন বলেই ভ্রম হয়েছিল বটে গদাইয়ের। ভাল করে চোখ কচলে দেখল, আগুনটাগুন নয়, লোহার বালা এক লম্ফে ডবল প্রমোশন পেয়ে সোনা হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ বাক্যি ছিল না মুখে, চোখের পাতাও পড়েনি তার।

সাধু তার হাতে বালাটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “যা ব্যাটা, এটা বেচে যা টাকা পাবি তাতে তোর অনটন খানিক ঘুচবে।”

গদাই ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ফের কাটা কলাগাছের মতো পড়ে সাধুর পায়ে দণ্ডবৎ হয়ে বলল, “দিলেনই যদি বাবা, তবে মুঠিটা আরও একটু খুলুন। কেল্লার লোহার ফটকটা পড়ে আছে। ওটাতেও একটু ঠেকিয়ে দিন, তা হলে দুঃখু একেবারে ঘুচে যায়। দেড়-দু’ মন সোনা পেলে বাকি জীবনটা হেসেখেলে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।”

সাধু দু পা পিছিয়ে গিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, “বেশি লোভ করলে শূলে গেঁথে প্রাণবায়ু বের করে দেব হারামজাদা! কিছু দিলেই দেখছি তোদের লোভ বেড়ে যায়। দুর হয়ে যা আমার সুমুখ থেকে। বেশি লোভ করলে বিপরীত পাথর ঠেকিয়ে দেব, সোনা ফের লোহা হয়ে যাবে।”

গদাই ভয় পেয়ে উঠে বসল। চোখের জল মুছে একগাল হেসে বলল, “মারুন, কাটুন আর যাই করুন, আমি আপনার সঙ্গ ছাড়ছি না।”

তা সেই থেকে গদাই সাধুর সঙ্গে-সঙ্গে আছে। পুরনো শিবমন্দিরের ভিতরটা যেমন ভাঙাচোরা, তেমনই নোংরা।

চামচিকে, বাদুড়, সাপ আর বিছের আস্তানা। গদাই সেটাই যথাসাধ্য সাফসুতরো করে দিল। সাধুর ঠেক। ধুনি জ্বেলে সাধু সাধন-ভজন করে আর পাশেই গদগদ হয়ে গদাই বসে থাকে। লোকটা যে খুব উচ্চ কোটির সাধু, তাতে কোনও সন্দেহ নেই গদাইয়ের। কিন্তু বয়সটা বড্ড বেশিই ঠেকছে। গায়ের চামড়া এমন ঝুলে পড়েছে যে, সেই বাড়তি চামড়ায় আর-একটা লোককে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। জটাজুট এতই বিশাল যে, পাকালে জাহাজ বাঁধার দড়ি হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বুড়ো বয়সের যা দোষ, সেই ভীমরতিও একটু ধরেছে বলে গদাইয়ের ধারণা। মাঝে-মাঝেই সাধু জিজ্ঞেস করে, “এটা কোন জায়গা রে?”

“আজ্ঞে, এ হল প্রতাপগড়ের জঙ্গল।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেছিলি বটে! পঁচাত্তর বছর আগে এরই কাছেপিঠে কোন গায়ে যেন এসেছিলাম, মনে পড়ছে না। আশপাশের গাগুলোর নাম জানিস?”

“তা আর জানব না বাবা! এই তো উত্তরে প্রতাপগড়, পুবে হল গে হবিবপুর, পশ্চিমে পটলডাঙা আর দক্ষিণে পায়েসপুর।”

“পায়েসপুর! হা হা, পায়েসপুরই তো সেই গায়ের নাম! সেখানে কী এক সর্বাধিকারী আছে না?”

“আজ্ঞে, আছে বইকী। নগেন সর্বাধিকারী। হাড়কঞ্জুস লোক। গতবার আমার কাছ থেকে বাতের তেল কিনে আজ অবধি দাম দেননি।”

“না না, নগেন নয়। অন্য নাম।”

“নগেনের বাবা ছিলেন বিশ্বেশ্বর। পঁচাত্তর বছর আগের কথা যখন বলছেন তখন উনিই হবেন।”

সাধুর চোখ ধক করে উঠল। বলল, “সে-ই। তাকেই আমি সেই পিদিম দিয়ে গিয়েছিলাম।”

“কীসের পিদিম বাবা?”

“সে খুব সাংঘাতিক পিদিম। যে ব্যবহার না জানে তার সর্বনাশ হয়ে যায়। আমি সেই পিদিম ফেরত নিতে এসেছি।”

সাধুর পদসেবা করতে-করতে গদাই জিজ্ঞেস করল, “তা বাবা, আপনার বয়স এখন কত হল? শতখানেক হবে না?”

“দুর! শতখানেক কী রে? ঠিক হিসেব নেই বটে, তবে পাঁচশো ছাড়িয়েছি।”

“ওরে বাবা!”

খুব মন দিয়েই সাধুর পদসেবা করে গদাই। দেখেশুনে তার মনে হচ্ছে পাঁচশো বছর বয়সি সাধু আর বেশি দিন নেই। ভীমরতিও একটু ধরেছে, ভুলভাল হচ্ছে। এসব লক্ষণ সে চেনে। সাধুর ভালমন্দ কিছু হয়ে গেলে সাধুর জিনিসপত্র তারই হাতে এসে যাবে। তখন আর তাকে পায় কে?

একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গদাই দেখল, সাধুবাবা চিতপাত হয়ে অঘোরে ঘুমে। নাকও ডাকছে। বড্ড ইচ্ছে হল, সেই পাথরটা বের করে পাথরের কেরানিটা একটু নিজেই পরখ করে দ্যাখে। না, সে পাথরটা চুরিটুরি করবে না। ততটা আহাম্মক সে নয়। এই একটু দেখবে আরকী। সোনাদানা তো আর বিশেষ দেখেনি। এই মনে করে সে বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে গিয়ে সন্তর্পণে ঝোলার মুখটা ফাঁক করে হাতটা ঢোকাতে যাবে, ঠিক সেই সময় ঘুমন্ত সাধুর মুখ থেকে একটা বজ্রনির্ঘোষ বেরিয়ে এল, “উঁহু!”

‘উঁহু’ শব্দটা যে এত উঁচু পরদায় বাঁধা যায় তা তার ধারণাই ছিল না। আঁতকে উঠে সভয়ে ফের সাধুর পায়ের দিকটায় গিয়ে

গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল সে।

সকালে সাধু জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে বজ্রগম্ভীর স্বরে বলল, “ঝোলায় হাত দিয়েছিলি কেন?”

তাড়াতাড়ি সাধুর পা চেপে ধরে গদাই বলল, “আর হবে না। আপনি যে চোখ বুজেও দেখতে পান, সেটা খেয়াল ছিল না বাবা! পাপী মন তো?”

কিন্তু কৌতূহল এক সাংঘাতিক জিনিস। পরশপাথরের গল্প শোনা আছে বটে, কিন্তু চাক্ষুষ করেনি। একটু নেড়েঘেঁটে দেখার ইচ্ছেটা বড় আঁকুপাঁকু করছে মনের মধ্যে। সোনার বালাটা সে প্রতাপগড়ের বিধু স্যাকরাকে এক ফাঁকে দেখিয়ে এনেছে। কষ্টিপাথরে ভাল করে যাচাই করে স্যাকরা বলেছে, ‘জিনিসটা তো খাঁটিই দেখছি! তা কোথায় পেলি? চুরিটুরি করিসনি তো বাপু?

চুরি যে করেনি সেটা বলে লাভ নেই। গরিবের কথা কে আর বিশ্বাস করে? তবে গরিব নাম ঘোচাতে পারলে সব ব্যাটা কথার দাম দেবে।

সাধুর ভয়ে ঝোলাটার দিকে কয়েকদিন আর নজর দেয়নি গদাই। তা একদিন সাধু ঝোলা রেখে চান করতে মন্দিরের পিছনে পুকুরে গিয়েছে, তখন অনেক চেষ্টাতেও নিজেকে সামলাতে পারল না গদাই। ঝটিতি গিয়ে ঝোলার মুখটা ফাঁক করেছে কি করেনি, অমনই ঝোলার ভিতর থেকে সেই বজ্রনির্ঘোষটা বেরিয়ে এল, “উঁহু!”

আঁতকে উঠে লম্ফ দিয়ে সরে এল গদাই। ই কী রে বাবা! ঝোলার ভিতর থেকে কে কথা কয়? ভূত নাকি রে ভাই?

সাধু স্নান সেরে এসে তার দিকে রক্তচক্ষুতে চেয়ে বলল, “ফের ঝোলায় হাত দিয়েছিলি নিমকহারাম?”

“তখন কি জানতাম যে আপনি না থাকলেও আপনার ওই বিটকেল ‘উঁহু’টাকে পাহারায় রেখে যাবেন! ঘাট হয়েছে বাবা, আর নয়!”

“মনে থাকে যেন!”

একদিন রাতে সাধুর পা দাবাতে-দাবাতে গদাই জিজ্ঞেস করল, “তা বাবা, পায়েসপুরে ফিরে আসতে আপনার পঁচাত্তর বছর লাগল কেন? পঁচাত্তর বছর যে বড্ড লম্বা সময়।”

সাধু গম্ভীর গলায় বলল, “সে তোদের কাছে। আমার তো শুধু পায়েসপুর নিয়ে কাজকারবার নয়। সারা দুনিয়াময় চক্কর কাটতে হয়। সাধন-ভজন আছে। তীর্থদর্শন আছে। পরিক্রমা আছে। ওসব তুই বুঝবি না। তবে এবার সব গুটিয়ে ফেলতে হবে। আয়ু আর বেশি দিন নয়। জিনিসপত্র সবই প্রায় উদ্ধার করে ফেলেছি। পিদিমখানা উদ্ধার হলেই কাজ একরকম শেষ।”

“তা সে পিদিমখানায় কী আছে বাবা?”

“ওঃ, সে বড় সাংঘাতিক জিনিস। অপাত্রে পড়লে দুনিয়া ছারখার হয়ে যাবে।”

“তা সেই সাংঘাতিক জিনিসটা হাতছাড়া করলেন কেন ঠাকুর?”

“সব জিনিসেরই ভালও আছে, মন্দও আছে। পিদিমখানা যাকে দিয়ে গিয়েছিলুম, সে দুঃখী মানুষ হলেও ভাল লোক। কিন্তু তার অবর্তমানে বেওয়ারিশ জিনিসটা কার হাতে পড়বে তার ঠিক কী?”

জিনিস ফিরি করে একদিন দিনান্তে আস্তানায় ফিরে মশালের আলোয় গদাই দেখতে পেল, একটা বেশ পেল্লায় চেহারার ছোঁকরাকে লতাপাতা দিয়ে চাতালে ফেলে রেখে সাধু গম্ভীর মুখে বসে সিদ্ধি গুলছে। মশালের আবছা আলোতেও ছোঁকরাকে চেনা-চেনা ঠেকল গদাইয়ের।

সে অবাক হয়ে বলল, “এ কাকে ধরে এনেছেন বাবা?”

সাধু থমথমে মুখে বলল, “এটাই সেই দানো। পিদিমের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকার কথা। কোন অপাত্রের হাতে পড়ে ছাড়া পেয়ে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দেখতে পেয়ে ধরে এনেছি। ওর অসাধ্য তো কিছু নেই। তাই লতাপাতা দিয়ে বেঁধে রেখেছি। গভীর রাতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মন্তর দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেব। ঘুমোক ব্যাটা কয়েক হাজার বছর।”

“সেটা কি আলাদিনের সেই পিদিম নাকি বাবা? উরেব্বাস রে? সেই পিদিম যে পাবে সে তো রাজা!”

সিদ্ধি ঘুটতে-ঘুটতে সাধু গম্ভীর হয়ে বলল, “পাপীরা তাই ভাবে বটে! সুখ-সম্ভোগের জন্য হেঁদিয়ে মরছিস মায়াবদ্ধ জীব। পরমার্থ খুঁজলি না!”

“যে আজ্ঞে, সেও বড় জব্বর জিনিস। তবে কিনা আগে একটু সুখসম্ভোগ করে নিলে পরমার্থটা জমে ভাল। সোয়াদটা বেশি পাওয়া যায়। এই যেমন নিম-বেগুন বা উচ্ছে হলে পরে পঞ্চব্যঞ্জনের সোয়াদটা বেশ খোলে তো বাবা? দত্যিটাকে যদি ঘুম পাড়িয়ে রাখেন তা হলে পিদিমটা যে ফেকলু হয়ে যাবে?”

“তা তো বটেই।”

“সেটা কি ভাল হবে বাবা? বরং দত্যিটাকে একটু ছেড়ে দিন, ঘুমনোর আগে কয়েকটা কাজ করিয়ে নিই।”

“কী কাজ?”

“কুপিত হবেন না বাবা, বেশি কিছু নয়। এই গা-হাত-পা একটু টিপে দিল, মাথা মালিশ করল, ছোটমতো একটা বাড়ি করে দিল, একটু চাল-ডাল-নুন-তেল আর কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করে নিয়ে এল, দু’-পাঁচখানা মোহর…”

সাধু হুংকার দিয়ে বলল, “পাপিষ্ঠ, নরাধম, ইষ্ট নষ্ট করতে চাস রে আহাম্মক? খাল কেটে কুমির আনবি বেল্লিক? মায়ালতায় বেঁধে রেখেছি বলে, নইলে এই রাক্ষস এতক্ষণে চারদিক লণ্ডভণ্ড করে দিত, তা জানিস?”

গদাই ভয় খেয়ে বলল, “ওরে বাপ রে! তা হলে বাঁধন খুলে দরকার নেই বাবা! যেমন বাঁধা আছে তেমনই বরং থাক। কিন্তু প্রভু, দানোটা অনেকক্ষণ ধরে চিচি করে কী যেন বলার চেষ্টা করছে, ভাল বোঝা যাচ্ছে না।”

ঘটি তুলে খানিক সিদ্ধি ঢকঢক করে খেয়ে সাধু একটা উদগার তুলে রক্তচক্ষুতে চেয়ে বলল, “বলছে নাকি?”

“বলছে বাবা।”

সাধু মাথা নেড়ে বলল, “কানে আজকাল ভাল শুনতে পাই না। ভোঁ ভোঁ শব্দ হয়। ইন্দ্রিয়াদির ক্ষমতা ক্রমে কমে আসছে। এবার কাজকারবার সব গুটিয়ে ফেলতে হবে রে।”

“সেই কথাই ভাল বাবা। পাথরটাথর, পিদিমটিদিম যা আছে তা ভক্তদের বিলি করে দিয়ে আপনি বরং নিশ্চিন্তে শেষ জীবনটা সাধন-ভজন নিয়ে থাকুন। আমি বরং এদিকটা সামাল দেব।”

“কোন দিকটা?”

“এই টাকাপয়সা, সোনাদানা, পাপতাপ এই সব আরকী।”

“তোর চোখে লোভ জ্বলজ্বল করছে। সেবার ঘুঘুডাঙার একটা দুঃখী লোককে দেখে বড় দয়া হয়েছিল। তাকে একখানা অক্ষয় থালা দিয়ে বলেছিলুম, ‘বাপু, এই থালা সামনে রেখে যা খেতে চাইবে তাই পেয়ে যাবে। কিন্তু ‘রয়েসয়ে খেয়ো’ তা ব্যাটা এমন খাওয়া খেল যে, দম নিতে পারে না। শেষে ওই দম আটকেই প্রাণপাখি বেরিয়ে গেল। ভেবে দেখিস, তুই কিছু খারাপ নেই। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে এই যে পাঁচটা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস, কষ্টের রোজগারে দু’টো খাচ্ছিস, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? ফাঁকতালে ভোগ করার ফিকির যদি খুঁজিস তবে টসকে যাবি!”

মাথা চুলকে গদাই বলল, “আজ্ঞে, ভাল-ভাল কথাগুলো যখন শুনি বাবা, তখন পাপী মনটার জন্য ভারী লজ্জা হয়। কিন্তু মাঝে মাঝেই লোভটাও বড্ড ফোঁস করে ওঠে। এই যে কথাগুলো শুনলুম, ইচ্ছে হচ্ছে এখন থেকে ব্যোমভোলা ভাল লোক হয়ে যাই। মনটার মধ্যে বেশ একটা আঁকুপাঁকু হচ্ছে কিন্তু। যেন কাদায় পড়া মোষ কাদা ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। তা আপনি যদি টেনে তোলেন তা হলে পাপ-পঙ্ক ছেড়ে পাপী মন একদিন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়বে’খন।”

ভীমরতি আর কাকে বলে? পরদিন আলায়বালায় ঘুরে গদাই দিনান্তে আস্তানায় ফিরে দ্যাখে, সাধুজি যথারীতি সিদ্ধি ঘুটতে লেগেছে। কিন্তু চাতালের উপর আজ আগের দানোটার পাশে আরও একটা লোক পড়ে আছে। এটারও হাত-পা সব লতাপাতায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।

গদাই অবাক হয়ে বলল, “উটি আবার কে বাবা?”

সাধু গম্ভীর হয়ে বলল, “এটাও দানো!”

গদাই ভারী ভাবিত হয়ে বলল, “কোথাও গোলমাল হচ্ছে না তো বাবা? একটা পিদিমের মধ্যে কি দু-দু’টো দত্যি সেঁধিয়ে ছিল? কিন্তু তেমনটা তো শুনেছি বলে মনে হয় না।”

সাধুও একটু দোনামোনা করে বলল, “সেটাও একটা কথা। পিদিমে একটা দৈত্যই ছিল বটে!”

গদাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “নাঃ, আপনাকে এবার ভীমরতিতেই ধরেছে দেখছি বাবা! তা ইটিকে পেলেন কোথায়?”

সাধু গলায় সিদ্ধি ঢেলে বিরাট দূগা তুলে বলল, “দুপুরের দিকে একটু গড়াচ্ছিলুম। হঠাৎ দেখি, দানোটা গাছপালা ভেঙে পাগলা হাতির মতো ধেয়ে এসে আমার চুল-দাড়ি ধরে টানাটানি। কিল ঘুসোও দিচ্ছিল। মনে হল, এটাই আসল দানোর পিদিমের মালিক হয়তো আমাকে ঢিট করতে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমাকে ঢিট করা কি সোজা! ওই দ্যাখ, মায়ালতায় বেঁধে ফেলে রেখেছি। কিন্তু মুশিকল কী জানিস, কোনটা আসল দানো তা বুঝে উঠতে পারছি। না। বড্ড বুড়ো হয়ে গিয়েছি তো! আজকাল একটুআধটু ভুলভাল হয়।”

“কিন্তু বাবা, এদের তো মানুষেরই আকার দেখছি। একটু লম্বাই চওড়াই চেহারা বই তো নয়! ধরুন যদি দানো না হয়ে মানুষই হয়, তা হলে যে এভাবে ফেলে রাখলে খিদে-তেষ্টায় মরে যাবে। তখন যে মহাপাতক!”

সাধু ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল, “সে ভয় নেই। বিশল্যকরণীর সঙ্গে সঞ্জীবনী আরক আর সিদ্ধি খুঁটে খাইয়ে দিয়েছি। মরার উপায় নেই। কিন্তু পিদিম উদ্ধার না হলে দানো নিয়ে গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠবে। তুই কালই গাঁয়ে গিয়ে যত লম্বা-চওড়া লোক আছে সব ক’টাকে ভাল করে চিনে আসিস তো?”

গদাই সভয়ে বলল, “মহারাজ, এই পায়েসপুর গায়ে লম্বা চওড়া নোক যে মেলা। সব কটাকে আনলে যে গায়ে হুলস্থুল পড়ে যাবে?”

সাধু চিন্তিত মুখে বলল, “তা বটে। কিন্তু পিদিমটা উদ্ধার না হলে যে এ ছাড়া উপায় নেই? একটা পরিবার নির্বংশ হবে। কোন বদমাশের হাতে পড়ে পিদিম কী কাণ্ড ঘটাবে তা কে জানে?”

“তা আপনি তো ত্রিকালদর্শী, এত সাধন-ভজন করেছেন, ধ্যানের চোখে পিদিমটার হদিশ দিতে পারেন না?”

সাধু দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “ঊর্ধ্বনেত্র আর সুরত চড়াই হওয়ার পর থেকে আর হঠযোগের ক্ষমতা থাকে না। আমি তো আর সিদ্ধাই নই, আমার ধ্যানে ওসব ছোটখাটো জিনিস আসে না। তবে পিদিম যে পায়েসপুরেই আছে তা টের পাচ্ছি।”

“হুঁকুম দেন তো, আপনার শ্রীচরণের আশীর্বাদে আমি একটু সুলুকসন্ধান করে দেখি।”

“তোর চোখে এখনও লোভ চকচক করছে যে?”

গদাই হাত জোড় করে বলল, “তা পাপীতাপী মানুষ বাবা, লোভলালসা নিয়েই তো বেঁচে থাকা। তবে লোভ থাকে থাক, সঙ্গে তো আপনার ‘উঁহু’-ও আছে বাবা!”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress