চমকে উঠলাম
সুপ্রভাত।
আমি চমকে উঠলাম। কে কথা বলে? গম্ভীর গলা। গম্ভীর কিন্তু সুরেলা। স্বরের ভেতর কোথায় যেন সামান্য বিষাদ মাখা। শুনতে শুধু যে ভাল লাগে তাই না আরো শুনতে ইচ্ছা করে। আমি বিছানা থেকে নামলাম, চারদিকে তাকাচ্ছি। কোথাও কেউ নেই। কে কথা বলল?
T5LASO, আপনাকে সুপ্ৰভাত। আশা করছি আপনার সুদ্ৰিা হয়েছে।
কে কথা বলছেন?
মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার, সবাই আমাকে সিডিসি নামে ডাকে।
ও আচ্ছা তুমি।
বলেই আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম, সিডিসির মতো কম্পিউটারকে কি তুমি বলা উচিত হচ্ছে? সে রাগ করছে না তো? অন্যরা তাকে কিভাবে সম্বোধন করে? নিশ্চয়ই অনেক সম্মানের সঙ্গে। এতদিন পর সে আমার সঙ্গে কথা বলছেইবা কেন? আর আমিই-বা কী করে এত বড় বোকামি করলাম। প্রথমেই তুমি বলে তাকে রাগিয়ে দিলাম। আমার উচিত ছিল স্যার-স্যার করা।
আমি ব্ৰিত-ভঙ্গিতে বললাম, আপনাকে তুমি করে বলায় আপনি কি রাগ করলেন।
না রাগ করি নি। রাগ, বিস্ময়, ভয়, ভালবাসা-জাতীয় মানবিক আবেগ থেকে আমি মুক্ত।
অন্যরা আপনাকে কি বলে? আপনি বলে না তুমি বলে?
যারা আমার ক্ষমতা সম্পর্কে জানে তারা আপনি বলে। অনেকে জানে না, তারা আপনার মতো তুমি বললেও পরে নিজেকে শুধরে নেয়।
কিছু মনে করবেন না, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি খুব অহংকারী।
অহংকার একটি মানবিক ব্যাপার। আমার কথার ধরনে অহংকার প্রকাশ পেলেও আমি তা থেকে মুক্ত।
আপনি যে শেষপর্যন্ত আমার সঙ্গে কথা বলছেন আমি এতেই আনন্দিত। আমি ভেবেছিলাম…
থামলেন কেন কী ভেবেছিলেন বলুন।
এখন আর বলতে চাচ্ছি না।
ইচ্ছা না হলে বলতে হবে না।
আচ্ছা বলেই ফেলি, আমি ভেবেছিলাম কেউ আমার সঙ্গে কথা বলবে না। এই ছোট্ট গোলকঘরে বন্দি অবস্থায় আমার জীবন কাটবে। নিজেকে চিড়িয়াখানার জন্তু বলে মনে হচ্ছিল। যা-ই হোক আমি কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
অবশ্যই পারেন।
আমি কি আশা করতে পারি যে আপনি আমার প্রশ্নগুলির জবাব দেবেন।
না আশা করতে পারেন না। সব প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। তাছাড়া সব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।
আমার ধারণা ছিল আপনি সব প্রশ্নের উত্তর জানেন।
অসংখ্য প্রশ্ন আছে যার উত্তর আমার জানা নেই। যেমন ধরুন আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, বিগ বেং-এর আগে কী ছিল? আমি জবাব দিতে পারব না।
বিগ বেং-এর আগে কি ছিল এই জাতীয় প্রশ্ন আমি আপনাকে করব না। কারণ এইসব জটিল বিষয় নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি খুব সাধারণ কিছু বিষয় জানতে চাই।
জিজ্ঞেস করুন।
আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন এবং কেন নিয়ে যাচ্ছেন।
আপনাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি সেটা বলতে পারি। আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি সূর্যের সবচে কাছের নক্ষত্র প্রক্সিমা সেনচুরির একটি গ্রহের দিকে। গ্রহটির নাম রারা।
আমাকে কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা বলা সম্ভব হচ্ছে না কেন?
আগেই বলা হয়েছে আমি সব প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নই।
এই মহাকাশযানে আমি ছাড়া আর কে কে আছেন?
বত্রিশ জনের একটা দল আছে। আপনি জেনে অত্যন্ত আনন্দিত হবেন যে আমাদের সঙ্গে মহান পদার্থবিদ সুরা এবং লিলিয়ান যাচ্ছেন। অংকশাস্ত্রের মহান দিকপাল ফেমর যাচ্ছেন। চারজন মাইক্রোবায়োলজিস্ট যাচ্ছেন। যাদের পৃথিবীর মানুষ চেনে। তিনজন রেডিওলজিস্ট আছেন। এরা পৃথিবীর মানুষের কাছে তেমন পরিচিত না হলেও এদের মেধা তুলনাহীন। ছয়জন কম্পিউটার বিজ্ঞানী যাচ্ছেন। যাদের ভেতর আছেন মহামান্য কার। আরো যাচ্ছেন…
থাক আর শুনতে চাচ্ছি না। আমি এদের কাউকেই চিনি না। চিনতে চাচ্ছিও না। আমি যেখানে যাচ্ছি তারাও কি সেখানে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। যেখানে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে জায়গাটা পৃথিবী থেকে কত দূর?
প্রায় চার আলোকবর্ষ দূর। আলো চার বছরে যতদূর যাবে ততদূর। আলোর গতিবেগ আশা করি জানা আছে।
জ্বি না জানা নেই। আমি মোটামুটি মূখ বলতে পারেন।
আলোর গতিবেগ হল সেকেন্ডে ২৯৯,৭৯২,৪৫৮ কিলোমিটার। প্রক্সিমা সেনচুরির দূরত্ব ৪ x ১০১৩ কিলোমিটার। কাজেই আলোর গতিতে যাত্রা শুরু করলে আমরা গন্তব্যে পৌঁছব…
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আমরা কি আলোর গতিতে যাচ্ছি?
পদার্থবিদ্যার সূত্র অনুযায়ী আমরা আলোর গতিতে যেতে পারি না। যে বস্তু আলোর গতিতে যাবে তার ভর হবে অসীম। যা সম্ভব না। আমরা আলোর গতির চেয়ে অনেক কম, আলোর গতির তুলনায় প্রায় হাস্যকর গতিতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে আমাদের গতিবেগ ঘন্টায় মাত্র ৪০০,০০০কিলোমিটার। এই গতিবেগ বেড়ে হবে ঘণ্টায় ২০,০০০,০০০ কিলোমিটার। এই হল আমাদের সর্বশেষ গতিবেগ। এরচে বেশি গতিতে যাওয়া সম্ভব না।
আমার তো মনে হচ্ছে আমরা কোন কালেই প্রক্সিমা সেনচুরিতে পৌঁছতে পারব না?
পারব। হাইপার ডাইভ বলে একটি রহস্যময় ব্যাপার আছে। সর্বশেষ গতিসীমায় যাবার পর আমরা হাইপার ডাইভের সাহায্য নেব।
হাইপার ডাইভটা কী?
আগেই বলেছি হাইপার ডাইভ একটা রহস্যময় ব্যাপার। প্রক্সিমা সেনচুরির নিকটবর্তী গ্রহের অতি উন্নত কিছু প্রাণী হাইপার ডাইভ পদ্ধতি জানে। তারাই সাহায্য করে। আমরা অকল্পনীয় দূরত্ব অতিক্ৰম করি তাদের সাহায্যে।
এখন তারাই আমাদের সাহায্য করবে প্রক্সিমা সেনচুরির কাছে যেতে?
আশা করা যায় করবে। কারণ অতীতে সবসময় করেছে।
অতি উন্নত সেইসব প্রাণীরা দেখতে কেমন?
আমরা জানি না তারা দেখতে কেমন? তাদেরকে আমরা কখনো দেখি নি। তারা যে গ্রহে বাস করে সেই গ্রহে আমরা কখনো নামার অধিকার পাই নি। সম্ভবত এই প্রথম আমরা নামার অধিকার পাব। বিজ্ঞানীদের বিশাল দল সেই কারণেই যাচ্ছে।
আমি কোন বিজ্ঞানীও না, কিছুই না। আমি কেন যাচ্ছি?
আমি আগেই বলেছি, এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারছি না।
আপনি কি জবাবটা জানেন?
হ্যাঁ জানি।
আমার সঙ্গে যারা যাচ্ছেন তারা কি আমার কথা জানেন?
হ্যাঁ জানেন।
তারাও কি আমার মতো একটা ছোট্ট ঘরে বন্দি, না তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন?
তারা কথা বলতে পারছেন।
আমাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে কেন?
আপনার এই প্রশ্নের জবাব আমি দিচ্ছি না।
যারা আমার সঙ্গে যাচ্ছেন তাদের যে কোন একজনের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।
সেটা সম্ভব নয়।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমিও আর আপনার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী না। আপনি যেতে পারেন।
আমার কোথাও যাবার উপায় নেই। আমাকে কারোর পছন্দ হোক বা না হোক আমি এই মহাকাশযানের সবারই সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
আমার আরো কিছু প্রশ্ন করার ইচ্ছা ছিল। করতে ইচ্ছা করছে না। সিডিসির ওপর রাগ লাগছে। সিডিসি একটা যন্ত্র ছাড়া কিছুই না। যন্ত্রের উপর রাগ করার কোন অর্থ হয় না। কিন্তু আমার রাগ হচ্ছে এবং রাগটা ক্রমেই বাড়ছে। এটা আমার একটা সমস্যা। আমার রাগ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। একসময় মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। তখন ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে হয়। মহাকাশযানের আমার এই ঘর অন্ধকার করা যায় না। আর গেলেও আমি তা জানি না। সম্ভবত সিডিসি জানে, তাকে বললে সে হয়ত বাতিটাতি নিভিয়ে ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করতে পারবে।
সিডিসি আপনি কি আছেন?
হ্যাঁ আমি আছি।
আমি ঠিক করেছি আপনাকে তুমি করে বলব।
ইচ্ছা করলে বলবেন। সম্ভোধন কোন জরুরি বিষয় নয়।
অবশ্যই জরুরি বিষয়। সম্বোধন থেকে বোঝা যায় যাকে সম্বোধন করা হচ্ছে তার অবস্থানটা কী? তুমি মহাজ্ঞানী হলেও আমার কাছে তোমার অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ না। কারণ তুমি আমার কোন কাজে আসছ না।
তুমি রেগে যাচ্ছ।
আমাকে তুমি করে বলবে না। আমি কোন কম্পিউটার নই। আমি মানুষ। তুমি অবশ্যই আমাকে সম্মান করে কথা বলবে। এবং আরেকটা কথা শুনে যাও, আমার ধারণা তুমি জ্ঞান-গাধা।
ভাল কথা।
ভাল কথা কি মন্দ কথা তা জানি না। তবে তুমি অবশ্যই জ্ঞান-গাধা। আরেকটা কথা শোন, জ্ঞান-গাধাদের গাধামি কিন্তু বাড়তে থাকে। যত দিন যায় তত সে আরো বড় গাধা হতে থাকে। একটা সময় আসে যখন তার একমাত্র কাজ হয় জ্ঞানের বোঝা বয়ে বেড়াননা। জ্ঞানকে কাজে লাগানোর কোন ক্ষমতাই তার থাকে না। তুমি সেরকম হয়ে গেছ। তোমার গা থেকে গাধাদের মতো গন্ধও বের হচ্ছে। কেউ টের পাচ্ছে না, কিন্তু আমি পাচ্ছি।
তুমি গন্ধ পাচ্ছ?
খবৰ্দার তুমি করে বলবে না। খবর্দার।
আমার মাথায় যন্ত্রণা হতে শুরু করেছে। যন্ত্রণাটা বড়তে থাকবে। ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার করা দরকার।
জ্ঞান-গাধা তুমি কি এখনো আছ?
অবশ্যই আছি। আমার ঘরটা অন্ধকার করে দাও।
মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে?
হ্যাঁ হচ্ছে।
তোমার যখন মাথায় যন্ত্রণা হয় তখন কি তুমি খারাপ ধরনের কোন গন্ধ পাও?
হ্যাঁ পাই। এখন পাচ্ছি গাধার বোটকা গন্ধ। এবং আবারো বলছি আমাকে তুমি করে বলবে না।
সিডিসি বলল, আচ্ছা আপনি করেই বলছি। আপনি বলছেন মাথায় যখন যন্ত্ৰণা হয় তখন আপনি গাধার বোটকা গন্ধ পান। আমার ধারণা গন্ধ পেলেও আপনি অপরিচিত কোন গন্ধ পান? কারণ গাধা নামক প্রাণীর শরীরের গন্ধের সঙ্গে আপনি পরিচিত নন। প্রাচীনকালের এই প্রাণী এখন আর পৃথিবীতে নেই।
চুপ। আর কথা না। ঘর অন্ধকার করে দাও।
ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। খিদেও পেয়েছে। গরম কফি এককাপ খেতে পারলে হত। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না। আমাকে নিয়ে কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। বিরাট বড় বিজ্ঞানীদের একটা দল যাচ্ছে তাদের সঙ্গে আমিও যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি? আমি কি কোন গিনিপিগ? আমাকে নিয়ে বিজ্ঞানীরা গোপন কোন পরীক্ষা করবেন?
একসময় এধরনের পরীক্ষা অনেক হয়েছে। বিজ্ঞানীদের মাথায় ঢুকল তারা মানবিক আবেগসম্পন্ন রোবট তৈরি করবেন। বায়ো-রোবট। অর্ধেক রোবট অর্ধেক মানুষ। যে রোবটের ব্রেইনের একটা অংশ মানুষের মস্তিষ্ক থেকে নেয়া। তখন প্রচুর মানুষ মারা গেছে। আমাকে নিয়েও কি তারা তাই করবে? ব্রেইনটা শরীর থেকে বের করে নেবে। সেখানে নানা তার-টার ফিট করবে। আই সি বসাবে। তারপর আমাকে তারা জুড়ে দেবে কোন কম্পিউটারের সঙ্গে? কে জানে তারা হয়ত আমাকে সিডিসির সঙ্গে জুড়ে দেবে। তখন যদি সিডিসিকে কেউ গাধা বলে তাহলে রাগ করে সিডিসি ফুড-মেশিন বন্ধ করে দেবে। মহাকাশযানের কেউ আর খাবার পাবে না। তখন তাকে গাধা বললে উল্টা সেও গাধা বলবে।
তবে আমার মনে হচ্ছে না বিজ্ঞানীরা আমাকে নিয়ে কোন পরীক্ষা করবেন। মানুষ নিয়ে পরীক্ষা বিশেষ অধিকার আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং আমি মানুষ তো বটেই। টানেলে কাজ করি, কাজেই নিম্নস্তরের মানুষ। নিম্নস্তরের মানুষ হলেও মানুষ। আমার ডি এন এ প্রফাইল বিজ্ঞান কাউন্সিলে রাখা আছে। সব মানুষের থাকে। শুধু পশুদের থাকে না। বিশেষ অধিকার আইন বলছে—
যাদের ডি এন এ প্রফাইল বিজ্ঞান কাউন্সিলে রক্ষিত তাদের নিয়ে কোনরকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যাবে না।
বিশেষ আইন অবশ্যি মানুষ এবং পশুদের কথা আলাদা করে কিছু বলে নি। কারণ এমনও দিন আসতে পারে যখন পশুদের ডি এন এ প্রফাইলও বিজ্ঞান কাউন্সিলে রাখা হবে। তখন তাদের নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে মহাকাশযানের আইনকানুন হয়ত আলাদা। মহাকাশযানের জন্যে হয়ত আছে অন্যরকম আইন। এই আইনে যা ইচ্ছা তা করা যায়।
আবার এও হতে পারে প্রক্সিমা সেনচুরির গ্রহের অতি জ্ঞানী মানুষদের কাছে তারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে উপহার হিসেবে। উপহার প্রদান উপলক্ষে একটা উৎসবের মতো হবে। গলা কাঁপিয়ে আমাদের বিজ্ঞানীরা বলবেন, আজ একটা মহান দিন। এই দিনে উপহার আদান-প্রদানের মাধ্যমে দুটি জ্ঞানী সম্প্রদায় কাছাকাছি চলে এল। তাদের টিভি-ক্যামেরা ছবি তুলতে থাকবে। সেই ছবিতে বার-বার আমাকে দেখানো হবে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসব। পরের দিন তাদের সব পত্রিকায় আমার সম্পর্কে নানান খবর ছাপা হবে। এবং তারা তাদের চিড়িয়াখানায় আমাকে রেখে দেবে। যে খাচায় আমাকে রাখা হবে সেই খাচার বাইরে সাইনবোর্ডে লেখা থাকবে।
মানব
সৌর জগতের তৃতীয় গ্রহ পৃথিবীর
বুদ্ধিমান প্রাণী।
পুরুষ। বয়স ২৫। গড় আয়ু ৭০
এই প্রাণী নিরীহ। একই সঙ্গে তৃণভোজী এবং মাংসাশী।
সংগীত প্রেমিক এবং শিল্প রসিক।
শিশুদের অনুরোধ করা যাচ্ছে তারা যেন একে
খোঁচা না দেয়। একে বাইরের খাবারও না দেয়।
সেই গ্রহের অতি উন্নত প্রাণীর ছেলেমেয়েরা ছুটির দিনে দল বেঁধে মানুষ দেখতে আসবে। আমি লাফঝাঁপ দেব। আমার কাণ্ডকারখানা দেখে তারা মজা পেয়ে আসবে। আমাকে বাদামটাদাম খেতে দেবে। আমি মহানন্দে বাদাম খাব। আচ্ছা সেই গ্রহের বাদাম খেতে কেমন? নিশ্চয়ই মজাদার। বুদ্ধিমান প্রাণীর গ্রহের বুদ্ধিমান বাদাম। হা হা হা।
আমার হাসি পাচ্ছে এবং বুঝতে পারছি আমার মেজাজ ভাল হতে শুরু করেছে। আমার বাদাম খেতে ইচ্ছা করছে। খাবার-টেবিলে বসে গরম কফি এবং বাদাম খাওয়া যেতে পারে। আমি রাগ করে বা মন খারাপ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। আমার চরিত্রের এটা কি কোন গুণ না দোষ? সিডিসিকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে কি মনে করে। সে নিশ্চয়ই জ্ঞানীদের মতো কিছু বলবে।
কম্পিউটারকে কথা বলতে শেখানো উচিত হয় নি। কম্পিউটার থাকবে কম্পিউটারের মতো। সে কেন মানুষের মতো কথা বলবে?
আমি খাবার-টেবিলে বসলাম। মেয়ে-রোবটটা সঙ্গে সঙ্গে চলে এল। আমি আনন্দিত গলায় বললাম, কেমন আছ এলা?
তার নীল চোখ দুবার দপদপ করে উঠল। সে কি বিস্মিত হচ্ছে? এলা নামে তাকে কখনো ডাকা হয় নি।
তারপর তোমার খবর কী এলা? ভাল আছে?
আমি ভাল আছি। আপনি আমাকে যে নাম দিয়েছেন তার জন্যে ধন্যবাদ।
নাম পছন্দ হয়েছে?
পছন্দ হয়েছে। আপনি কী খাবেন?
কফি। আগুন-গরম কফি এবং বাদাম।
আগুন-গরম বলতে আপনি ঠিক কতটুকু গরম বোঝাচ্ছেন?
এমন গরম যে মুখে নেয়ামাত্র জিব পুড়ে যায়। কফির সঙ্গে তুমি আমাকে দেবে বাদাম। খোসাওয়ালা বাদাম। আমি খোসা ছাড়িয়ে খাব।
আপনাকে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ আমি আনন্দিত। আনন্দের কারণ জানতে চাও?
আমার কৌতূহল কম। তবে আপনি যদি আনন্দের কারণ বলতে চান, আমি শুনব।
আনন্দের প্রধান কারণ হচ্ছে আমি তোমাদের সিডিসিকে তার মুখের উপর গাধা বলে দিয়েছি।
গাধা বলাটা কি খুব অসম্মানসূচক?
অসম্মানসূচক তো বটেই।
অন্যকে অসম্মান করছেন, এটাই কি আপনার আনন্দের উৎস?
না আমার আনন্দের আরো উৎস আছে। শুনতে চাও?
আপনি বললে শুনব। তার আগে আপনি যদি আমাকে তিন মিনিট সময় দেন আমি আপনার কফি এবং বাদাম নিয়ে আসতে পারি। আগুন গরম কফির ব্যাপারটা আমি এখননা বুঝতে পারছি না। কফি মুখে নেয়ামাত্র যদি জিব পুড়ে যায় তাহলে সেই কফি খাবেন কিভাবে?
খাব না। কফির মগ হাতে নিয়ে বসে থাকব। খাবার হাতে নিয়ে বসে থাকার মধ্যেও আনন্দ আছে।
এলা কফি আনতে গেল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম আমার আনন্দ ক্ৰমেই বাড়ছে। কারণটা কী? আনন্দে অভিভূত হবার মতো তেমন কিছু আসলে ঘটে নি। তাহলে এত আনন্দিত হচ্ছি কেন? এলা কফির মগ এবং বাদাম এনে রাখল।
এলা!
বলুন।
আমি এত আনন্দিত কেন বুঝতে পারছি না।
যে সব কারণে মানুষ আনন্দিত হয়, সেই কারণগুলি এক এক করে বিবেচনা করে দেখুন।
এটা মন্দ বল নি। এস আমরা দুজন মিলে ভেবে দেখি, প্রথমত আমার অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয় নি। আগে যা ছিল এখনো তাই আছে।
এলা বলল, আপনি কোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, এখন সেই চিন্তা নেই।
এখানে তুমি ছোট্ট একটা ভুল করেছ এলা। আমি কখনোই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলাম না। তোমাকে একটা কথা বলা হয় নি, আমি মানুষ হিসেবে মোটামুটি সৌভাগ্যবান। ভয়াবহ বিপদ থেকেও আমি কিভাবে না কিভাবে রক্ষা পেয়ে গেছি।
শুনে আনন্দিত হলাম।
শুনে তুমি কিছুই হও নি। আনন্দিত বা দুঃখিত হবার ক্ষমতা তোমার নেই।
জ্বি ঠিক বলেছেন। কথার কথা বলেছি।
বলেছ ভাল করেছ। এখন আমার কথা শোন। একবার কি হল শোন–১৩২ নাম্বার টানেলে দুর্ঘটনা ঘটল। মোট কর্মী ছিল একুশ জন। সবাই মারা গেল বেঁচে রইলাম আমি। অদ্ভুত না?
হ্যাঁ।
আরো অদ্ভুত ব্যাপার আছে। আমরা যেখানে থাকি সেই ক্যাম্প–ক্যাম্প নাম্বার একুশে আগুন লেগে গেল। একমাত্র মানুষ যে বেঁচে রইল সে আমি।
অদ্ভুত।
কাজেই আমি নিশ্চিত—এ ধরনের বড় বিপদ আমি পার করতে পারব। তুমি কী বল?
আমি এই বিষয়ে কিছু বলছি না। ভাগ্য ব্যাপারটা আমাদের ধারণার বাইরে।
ভাগ্য তুমি বিশ্বাস কর না?
ভাগ্য বিশ্বাস করার কোন ব্যাপার না।
জ্ঞানী গাধাটাকে জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে সে বিশ্বাস করে কি-না। কিংবা মহাজ্ঞানী কোন পদার্থবিদ নাকি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে—সেই গাধাটাকেও জিজ্ঞেস করা যায়।
আপনি সবাইকে গাধা বলছেন কেন?
বুঝতে পারছি না কেন। তোমাকেও গাধা বলতে ইচ্ছা করছে।
ইচ্ছা করলে বলুন।
গাধা, গাধা, গাধা, মহিলা-গাধা।
আপনার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে।
বল।
আপনার ঘরের দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। এখন ইচ্ছা করলে আপনি ঘর থেকে বের হতে পারবেন। মহাকাশযানে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। কিংবা মহাজ্ঞানী পদার্থবিদ সুরাকে জিজ্ঞেস করতে পারবেন, উনি ভাগ্য বিশ্বাস করেন কি না।
এলা তুমি গাধা না, তুমি লক্ষ্মী একটি মেয়ে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
ঐদিন তুমি যে আমাকে মজাদার একটা ড্রিংক দিয়েছিলে তা কি আজ আরেকটু দিতে পার?
পারি। কিন্তু দেয়া ঠিক হবে না।
আমার ভাগ্যের এই হঠাৎ পরিবর্তনটা কেন হল তুমি কি কিছু বুঝতে পারছ?
না পারছি না।
কেন ভাগ্য পরিবর্তিত হয়েছে তা নিয়ে এই মুহূর্তে মাথা না ঘামালেও হবে। আনন্দ করার কথা, আনন্দ করে নেই। আমি চন্দ্রগীতিটা গাইবার চেষ্টা করলাম। গলায় সুর বসছে না। তাতে কী?