Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ইটের বদলে পাটকেল || Shaktipada Rajguru

ইটের বদলে পাটকেল || Shaktipada Rajguru

আজকেল ঝালমুড়িটা বেশ জমেছে। ভকতরাম নতুন কি এক মশলা বের করেছে সামান্য আমচুর দিয়ে, তাতে মুড়ির কদরও বেড়ে যায়। পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের মাঠে বসে পটলার পয়সায় ঝালমুড়ি খাচ্ছি। ওদিকে দরজায় বেড়া দেওয়া ক্লাবঘর, সাইনবোর্ডটার একদিক ভেঙে গিয়ে নড়বড় করে ঝুলছে—যে কোন মুহূর্তেই ওটা ছিটকে পড়বে। অবশ্য আমাদের ক্লাবের অবস্থাও তেমনি। কবছর এই মরে সেই মরে করে করুণভাবে টিকে আছে।

দরমার ঘরে ফটিক হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইছে, মেরে সঁইয়া-আ, পার লাগাদে নাইয়া । বিগত পাঁচ বছর ধরে হতভাগাটা ওই এক গানই গেয়ে চলেছে, নৌকা পারে লাগানোর গান ।

গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়েছে। এবার ক্লাব ফান্ডের অবস্থা খুবই টাইট, নইলে প্রতিবারই এ সময় দল বেঁধে বেড়াতে বের হই। ক্যাশিয়ার অবশ্য পটলাই। টাকা কড়ি ওই ম্যানেজ করত বাড়ি থেকে। এবার সেই টাকার উৎস অর্থাৎ ঠাকুমা কেদার বদরি গেছে। বাবা কাকারা মস্ত বড়লোক পটলার, কিন্তু পুরুষগুলো মহাচিপ্পুস। মাপা টাকা ছাড়া একস্ট্রা টু পাইস দেবে না । হঠাৎ এমনি দিনে এসে পড়ে পটলার মাসতুতো ভাই নন্দ। নন্দদুলালকে আমরা চিনি পটলার সুবাদেই। বর্ধমানে ওদের বিরাট বাড়ি, বাবাও নামকরা উকিল।

নন্দ বলে—ছোড়দির বিয়ে সামনের ২৬ বৈশাখ, আর শহরে নয়—পাত্রের মামা দেশের বাড়িতে থাকেন, উনি চান আমাদের দেশের বাড়ি থেকে বিয়ে হবে।

নন্দ আরও বলে,—দূর গ্রামে বিয়ে, এতবড় করে, সেখানে তো বিশেষ যাই না তাই কাজের লোকজন ম্যানেজ করার জন্য তোদেরও যেতে বলেছেন বাবা।

ফটিক বলে,—ওরে বাবাঃ, সেই অজপাড়াগাঁয়ে যেতে হবে !

পটলা বলে—না গেলে ওরা বিপদে পড়বে, তাই পাঠিয়েছেন নন্দদাকে মেসোমশাই। চল না—গরমের ছুটিতে বেড়ানোও হবে।

হোঁৎকা কি ভাবছে। বলে সে এবার—তয় পরোপকার—যারে কয় সমাজসেবাও হইব। চল্ যাই গিয়া ।

নন্দদাও খুশি। বলে—তাহলে ক্লাবের রবীন্দ্রজয়ন্তী ২৫শে সেরে পরদিনই বের হয়ে পড়বি, আমাদের বর্ধমানে পাবি না, সাতদিন আগেই চলে যাব গ্রামে, তো—পথের হদিস সব বলে দেব। তোদের গাড়ি ভাড়াও রেখে যাচ্ছি পটলার কাছে। নিশ্চয়ই যাবি কিন্তু।

হোঁৎকা তো পা বাড়িয়ে আছে সোৎসাহে মাথা নাড়ে—ঠাকমা এখানে নাই—এবার রবীন্দ্র জয়ন্তী তেমন জোর হইব না। ক্যাশকড়ি নাই মোটে। অক্ পঁচিশে বৈশাখ রাতেই স্টার্ট করুম। কী বলিস তোরা?

গোবরা, আমি, ফটিক, পটলা আর হোঁৎকা এবার যাবার প্ল্যান নিয়ে ব্যস্ত। পটলার এমার্জেন্সি ক্যাশ থেকে সাংশন করা হয়েছে পঞ্চাশ টাকা।

—কী করবি?

পটলার কথায়, হোঁৎকা বলে,—কলকাতা থনে যাইত্যাছি ওই অজগ্রামে, বিয়া বইলা কথা । কলকাতার স্যাম্পল বানাইমু না? তুবড়ি—বোম না হলে বিয়াবাড়ি মানায়? দে ট্যাকাটা, তাক লাগাইয়া দিমু!

এটা ঠিকই, হোঁৎকা বোম, পটকা—তুবড়ি বানাতে ওস্তাদ। শতরূপা’ ‘আমরা কজন’ এই এলাকার সব ক্লাবেরই তুবড়ি কমপিটিশনে হোঁৎকার ফার্স্ট প্রাইজ বরাবর বাঁধা।

প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হয়েছি পাঁচমূর্তি। হোঁৎকার পরনে হাফপ্যান্ট, শার্ট, মাথায় টুপি, গলায় ঝোলানো হুইসিল, পিঠে ব্যাগ। আমাদের সকলেরই প্রায় এক পোশাক। শুধু ফটিক শিল্পীমানুষ তাই কোঁচনো ধুতি, কারুকাজ করা পাঞ্জাবি পরেছে, মালপত্র নিয়ে উঠে বসেছি। তখন রাত্রি গভীর।

ট্রেনটা বর্ধমানে এসে থেমেছে। এইখানে নামতে হবে আমাদের। স্টেশনের ওদিকে মৃদু আলোয় দেখা যায় ছোট লাইনের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। ভোর চারটেতে ছাড়বে। এখনও ঘণ্টা দুয়েক দেরি।

হোঁৎকা হুইসিল বাজিয়ে পুরো দল দিয়ে লাইন টপকে এসেছে ছোট গাড়ির কাছে। আবছা অন্ধকারে গাড়িটা দাঁড়িয়ে। গোবরা আয়েসি গোছের, বলে—উঠে শুয়ে পড় রাত অনেক বাকি।

দরজাগুলো কোনটা খোলা কোনটা বন্ধ। আগে যাচ্ছে পটলা—তারপরই কাণ্ডটা বেঁধে যায়।

একটা বিকট শব্দে পটলা গোঁৎ খেয়ে পড়ে—তারপরই দুটো সুঁচলো মত কি আমার হাঁটুতে ঠেকে আর পিছনে ছিটকে পড়েছে গোবরা। তার সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে। আর ফটিকও ‘বু-বু-বু’ শব্দ করে চোখ কপালে তুলে লাফ দিয়ে দৌড়তে যায়, হোঁৎকা ততক্ষণে টর্চ জ্বেলে ব্যাপারটা দেখে বলে–এ্যাই ভূত ফুত নয়, থাম্ দ্যাখ না। দেখা যায়, একটা ইয়া দাড়িওলা বেওয়ারিশ পাঁঠা ধরাশায়ী গোবরার গায়ে নির্লিপ্তভাবে জল ছেড়েছে। সরকারি গাড়িতে ব্যাটা আরাম করে রোজই ঘুমোয়। আমাদের এসে শান্তিভঙ্গ করতে দেখে প্রথমে আঘাত—পদাঘাত তারপর জলবিয়োগ করে সামনের দু পা তুলে শিংসমেত অ্যাটাক করার চেষ্টা করছে গোবরাকে।

হোঁৎকা টর্চের ঘা মারতেই আপাতত রণে ভঙ্গ দিয়ে অন্য কামরায় উঠল হতভাগাটা । অন্ধকার কামরা, পটলা বলে,—ভ-ভালো করে দ্যাখ হোঁৎকা, আর কোন জানোয়ার আছে কিনা। উঃ, পড়ে গিয়ে ক-কপালে যা লাগছে ।

ভোরের মুখেই ট্রেন ছাড়ল, ছোট হলে কী হয় এর হাঁকডাক আর লম্ফ ঝম্ফ কম নয়। কামরার ভিতরে আমরা ক’জন। বাকি যাত্রীরা তো ছাদে, নামবে সূর্য উঠলে।

খালি কামরায় খোলার ভাজা খই-এর মত ছিটকে ছাটকে চলতে পৌঁছলাম বলগনা । সর্বাঙ্গে কয়লার গুঁড়ো, ভূতের মত চেহারা, গায়ে হাতেপায়ে প্রচুর ব্যথা।

গ্রীষ্মের দিন। পটলা বলে—এখানে চাটা খেয়ে নিয়ে টেম্পো ধরে মাথাভাঙ্গার মোড়ে চল, সেখানে ছোট্ট নদীর ধারে বসে টি-টি-টিফিন করা যাবে।

সুতরাং আবার যাত্রা। ছাগলগরুর মত গাদাগাদি টেম্পোতে তিনটাকা করে খসিয়ে পৌঁছলাম মাথাভাঙ্গা। শরীর তখন একেবারে অবসন্ন। এমন যাত্রাযন্ত্রণা জানলে মরতে কে আসত?

সামনের মাঠে প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। ওদিকে লম্বা ইস্কুলবাড়ি। এখন গ্রীষ্মের ছুটি, তাই বন্ধ। ওখানেই বরযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।

নন্দদার বাবা হরিশবাবু শুধু ব্যস্ত। বাড়িতে এলাহিকাণ্ড চলেছে। ভিয়েন বসেছে, পুকুরের ইয়া বড় বড় মাছ গাদা করা হয়েছে।

কয়েকটা পাঁঠাখাসিও বাঁধা। ওদের কাটা হবে।

হরিশবাবু আমাদের দেখে বলেন—সব কাজকর্ম বুঝে নাও বাবারা। যেন কোন ঝামেলা না হয়। তোমরা এসে পড়েছো বাঁচলাম।

নন্দদাই বলে,—বরপক্ষ নাকি কড়া মেজাজের লোক। বর থাকে কলকাতায়, কোন্ অফিসে কাজ করে। তার মামাই সব। খুব কঠিন লোক। বর টাকার দাবিই করেনি। মামাই বরের অমতে কুড়ি হাজার টাকা ক্যাশ নিচ্ছে।

নন্দদা আরও বলে,এছাড়াও এ গ্রামে মুখুজ্যে বাঁড়ুজ্যেদের দুটো দল আছে। আমাদের দিকে মুখুজ্যের দল। বিয়েতে বাড়ুজ্যেরা গোলমাল করতে পারে ।

তাহলে তো কেস্ গড়বড়।

হোঁৎকা মালপত্র রেখে বলে—চল, গ্রামখান ঘুইরা আসি।

এ্যাই ছোকরা শোনো। —গ্রামের পথে চলেছি, এটাই বাঁড়ুজ্যেপাড়া। পথের ধারে একটা বটগাছের নীচটা বাঁধানো, কোন দেবস্থান হবে। সেই চাতালে বসে তামাক খাচ্ছিল কয়েকজন, নীচেও দু-চারজন রয়েছে। ইয়া গোঁফওয়ালা বয়স্ক লোকটা ডাকছে আমাদের। কাছে যেতে খ্যানখ্যানে গলায় আওয়াজ তোলে, – নিবাস ?

আমরা দেখছি ওদের। অনুমানে বুঝতে পারি শত্রুপক্ষের ব্যূহের মাঝখানে এসে পড়েছি। জানাই—কলকাতা ।

ওই ঘেসো উকিলের বাড়িতে আসা হয়েছে? কন্যাযাত্রী ?

হোঁৎকা দেখছে ওদের। পটলাকে মুখ খুলতে দিই না। আমি জানাই — হ্যাঁ ।

ভদ্রলোক বলে—এ গাঁয়ের নাম কি জানো? হাড়ভাঙ্গা বসন্তপুর।

আমি শুধোই—আপনার নাম?

তার জবাব দেবার আগেই দু-তিনজন চামচা উঠে পড়ে। আমাদের কাছে এসে বলে—কংস বাঁড়ুজ্যেকে চেন না? তোমার নাম কী ?

হোঁৎকা বলে,—ওর নাম কিষ্ট নারায়ণ মুখুজ্যে। কিষ্টারে চেনেন তো। কংসরে যিনি বধ কইরাছিলেন। আয় চইলা আয়।

সকাল থেকেই বাড়িতে ব্যস্ততা পড়ে যায়। বিয়ের ছাদনাতলা হয়েছে বাড়ির সদরের উঠানে। চারিদিকে বারান্দা, মাঝখানে উঠান।

পটলা আর আমি ওই বিয়ের ছাদনাতলার ব্যবস্থা করছি। পুরোনো বাড়ি। লোকজন অন্যসময় বিশেষ থাকে না। ওদিকে বিরাট একটা বুনো মৌমাছির চাক।

পটলা বলে,—আরি ঝাপ্।

আমি বলি,—ওদের না খোঁচালে ওরা কিছু বলবে না। যাসনে ওদিকে, ছাদনাতলা হয়ে গেছে।

বিকেলেই এসে পড়েছে তেইশখানা গরুর গাড়ি। আকণ্ঠ বোঝাই হয়ে, বরযাত্রীর দল। গরুর গাড়ি যেন কাফেলা, আসছে তো আসছেই।

আর বর আসছে পালকিতে।

সারা মাঠ ভরে গেছে ওদের ভিড়ে। বরকে বসানো হয়েছে। এবার মাথা জোড়া টাক-বলিষ্ঠ মুগুরের মত গোল চেহারার মামাবাবু হুঙ্কার ছাড়ে,–জলখাবার দেন ছেলেদের। তারপর আমাকেই বলেন,–বেইমশায়কে ডাকো।

হরিশবাবু বংশবদের মত এসে হাজির,—ডাকছেন।

মামাবাবু বলেন—চলুন হিসাবটা চুকিয়ে নিতে হবেক বিয়ার আগেই ।

বরযাত্রীদের জলযোগপর্ব শুরু হয়েছে। হোঁৎকা, গোবরা, নন্দদা কয়েকজনকে নিয়ে ওদের প্লেটে জলখাবার দিচ্ছে রাধাবল্লভী, আলুরদম, সিঙাড়া, রাজভোগ, সন্দেশ, আম। প্রথম থেকেই দেখি গোলাপী জামাপড়া এক চ্যাংড়া বরযাত্রী তার দলবল নিয়ে কারণে অকারণে হৈ চৈ বাধাচ্ছে। আর সেই-ই আলুর দম মুখে দিয়ে বলে—ইটা কি হইছে হে?

হোঁৎকা বলে, কেন, আলুর দম।

ছোকরা চটে উঠে এক থাবড়া কাইসমেত আলুর দম নিয়ে হোঁৎকার মুখে, গালে, জামায় থ্যাপ করে লাগিয়ে বলে–খেয়ে দ্যাখো তো! ঝালনুন নাই।

হোঁৎকার মুখে আলুর দম দেখে বরযাত্রীদের অনেকেই ঠা ঠা করে হেসে ওঠে। একজন রসিকতা করে বলে টু কাটন রসগোল্লার রসও মাখিয়ে দে।

হোঁৎকাকে চেনে না ওরা। কি করে বসে ঠিক নেই। রাগে ফুলছে সে। আমি, নন্দদা গিয়ে থামাই। নন্দদা বলে-বরযাত্রীদের অত্যাচার সইতে হবে কনেপক্ষের লোকদের। সরে আয়। ওদিকে গানের আসর বসে গেছে। বরযাত্রীদের দু-একজন খ্যামটা ঝুমুর গেয়ে থেমেছে, এবার ফটিক বসেছে। ওদের তুলনায় ফটিক অনেক ভালো গায়। কিন্তু গোলাপী জামা চিৎকার করে—গাভিরাগিণী নাকি হে ভাই! দলের কে বলে-কলকাতার গাভি ।

গোবরা পান সাপ্লাই করছিল, বলে—আপনাদের দেখে স্বজাতি ভেবে তাই গাইছে। ব্যস্! ওরা চিৎকার করে ওঠে—আমরা গাভি, গাধা, এতবড় অপমান। ওঠ সবাই, এখানে কভি নেহি, বর তুলে নিয়ে চল। মামাবাবুকে খবর দে।

মামাবাবুও এসে পড়ে—সত্যিই তো, খুব অন্যায়।

হরিশবাবু হাত জোড় করেন, শেষ অবধি গোবরাই ক্ষমা চাইল। ওরা থামল। আরও থামল, কারণ খাবার ডাক পড়েছে।

সব অপমান মুখ বুজে সইছি। খেতে বসেছে ওরা। হ্যাজাক জ্বলছে, পরিবেশন যারা করছে তারাও হিমশিম খেয়ে যায়। মাছ, মাংস পাতে পড়ছে, আর নেই, রাজভোগ ছানাবড়ারও সেই অবস্থা ।

কি সন্দেহ হতে অন্ধকারে পিছন দিক দিয়ে গিয়ে দেখি, বরযাত্রীর দল পাতা থেকে মাছ, মাংস, রাজভোগ নিচ্ছে আর তুলে তুলে পিছনে ফেলছে।

শেষ অবধি মাছ, মাংস দিয়ে রাজভোগ দিয়ে সামনে দাঁড়াই। ফেলা আর হয় না তবে যথেষ্টভাবে পাতে ফেলেই উঠল নবাবের দল।

হোঁৎকা বলে,—চুপ মাইরা থাক। বিয়াটা হইতে দে। পরে দেখুম।

বিয়েতে বসতে যাবে, হরিশবাবুও তাই চান। এমনসময় গোলমালটা বাধে । বাঁড়ুজ্যেপাড়ার মাতব্বর সেই কংস বাঁড়ুজ্যে দলবল নিয়ে হাজির। তাদের দাবি—গ্রাম দেবতাকে হাজার একটাকা প্রণামী দিতে হবে না হলে বিয়ে হবে না। গ্রাম দেবতার হাজার এক, গ্রামসভার হাজার এক টাকা চাই। আর হরিশবাবুকে হাতজোড় করে মাপ চাইতে হবে কেন তাদের নেমন্তন্ন করা হয়নি।

সে কে বিচিত্র পরিস্থিতি। মুখুজ্যে পার্টিও বলে, এ টাকা তাদের প্রাপ্য।

দুই দলের চুলোচুলি বাধার উপক্রম। বর কনে তখনও আসেনি, বাইরের বাড়িতে তখন চুলোচুলি চলেছে। কপাল চাপড়াচ্ছেন হরিশবাবু। অন্দরে কান্নাকাটি পড়েছে। বিয়েটাই বোধহয় ভেস্তে যাবে এদের জন্যে ।

মামাবাবু বলে,–এ ঝঞ্ঝাট সইব না। বর তুলে নিয়ে যাব।

তার বিশ হাজার টাকাও হাতে এসে গেছে ।

আমাদের মধ্যে গোবরা আর হোঁৎকা নেই। অন্ধকারে হঠাৎ গ্রাম কাঁপিয়ে দুম্ দাম্ শব্দ ! বোম ফাটছে। দূরে কোথায় চিৎকার ওঠে,—ডাকাত! ডাকাত! ডাকাত পড়েছে বাঁড়ুজ্যে পাড়ায় ৷

আর আমিও এই ফাঁকে সেই পুরোনো মৌমাছির বিশাল চাকে পর পর কয়েকটা আধলা ইট মেরে সোজা বাইরে পালিয়েছি।

মুহূর্তে শুরু হয়ে যায় ধুন্ধুমার কাণ্ড। ইটের চোটে ভেঙে পড়া চাক থেকে এবার মৌমাছির পাল ওই উঠোনে বাঁড়ুজ্যে ভার্সাস মুখুজ্যের দলকে ঘিরে ধরে ক্রুদ্ধ হয়ে হুল ফোটাতে শুরু করেছে। মামাবাবু তখন বর তুলতে যাচ্ছে। তার টাক থেকে শুরু করে সারাদেহে বসেছে ডজন কয়েক মৌমাছি। আর গোলাপী জামার দল ছিল ওদিকেই। ওইখানেই মৌমাছির দল বেপরোয়া অ্যাটাক শুরু করেছে।

লাফাচ্ছে দাপাচ্ছে উপস্থিত জনতার দল। কেউ গড়াগড়ি দিচ্ছে।

আর বোমার শব্দে বাঁড়ুজ্যের লিডার দলবল নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে গড়াগড়ি দেওয়া বরযাত্রীদলকে মাড়িয়ে দৌড়াল, কে জানে কি সর্বনাশ হয়েছে! মুখুজ্যের দলও দৌড়াচ্ছে অন্ধকারে। শুধু উঠানে গড়াগড়ি দিচ্ছে, লম্ফঝম্ফ করছে মৌমাছির আক্রমণে আটকে পড়া বরযাত্রীর দল। মামাবাবুর টাকসহ মুখখানা ফুলে পাঁচ নম্বর ফুটবল।

এর মধ্যে হোঁৎকা গোবরাও এসে পড়ে। তাড়াতাড়ি ধোঁয়া টোয়া দিতে মৌমাছির দল রণে ভঙ্গ দেয়। ক্রমশ শান্তি নামে, ততক্ষণ অবশ্য বরযাত্রীর দল মায় মামাবাবু প্রায় বাহ্যজ্ঞানরহিত। অবশ্য বর কনে ও অন্যান্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা ছিল বাড়ির ওদিকের মহলে। তাদের উপর তেমন হামলা কিছু হয়নি। তবে বরযাত্রীদের কাতরানির শব্দ বেশ শোনা গেছিল।

এবার বিয়েও শুরু হল। আর নির্বিঘ্নে শেষও হল বিয়ে।

মুখুজ্যে বাঁড়ুজ্যের দলবলও আর ফিরে এল না। তারা তখন ঘর পাহারা দিতে ব্যস্ত। ডাকাতদল নাকি এসেছিল, পালিয়েছে। আবার আসতে কতক্ষণ!

পরদিন সকালে বাসি বিয়েও নির্বিঘ্নেই সারা হয়। বরযাত্রী দল বিদায় হল। এসেছিল সব গাড়িতে বসে লাটসাহেবের মত হৈ চৈ করতে করতে, ঘণ্টা কয়েক যা খুশি তাই করেও ছিল, কিন্তু ফেরার সময়? সাতিশয় ভদ্র, শুধু উঃ আঃ ছাড়া মুখে বাক্যটি নেই।

হরিশবাবুর মুখে এতক্ষণে উজ্জ্বল হাসি। সব ভালোয় ভালোয় চুকেছে। তবু আমাদের কাছে এসে বলেন—কাল এত বোম ফাটল গাঁয়ে—সত্যিই কি ডাকাত এসেছিল নাকি?

হোঁৎকা বলে–অভয় দ্যান তো কই। তারপর ব্যাগ থেকে দু তিনটে বাকি বোমা বের করে বলে—ওদের ওখানে বোমা ফাটাইয়া ডাকাত বইল্যা চেল্লাইতেই না ওরা সব ছাইড়া দৌড়াল। নয় কী হইত কে জানে। আর ওই শয়তান বরযাত্রীর পাল খুব ইনসাল্ট করতিছিল, তাই আমরা ওই মৌমাছির চাকখানায় আধলা ইট মাইরা একটু সমান কইরা দিচ্ছি।

হরিশবাবু এবার হাসিতে ফেটে পড়েন,—হাঃ হাঃ হাঃ—ওফ! তাই বল্! না তোমাদের বুদ্ধি তো সাংঘাতিক। তবে বুদ্ধিটা একটু বদ।

হোঁৎকাও হেসে বলে,—বদমাইসদের সিদা করতি বদবুদ্ধিই লাগে মেসোমশাই। ইট মারলে পাটকেল খাওনের লাগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *