Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আশ্চর্য প্রদীপ || Samaresh Majumdar

আশ্চর্য প্রদীপ || Samaresh Majumdar

ঠা-ঠা রোদ্দুরে ছেলেটা হাঁটছিল। শামবাটির খাল পেরিয়ে রাস্তাটা দু-দিকে চিরে গেছে। লাল ধুলো এখন উড়ছে না, এইসময় বাতাস বড় দুর্বল থাকে। তেলে গন্ধ-ওঠা গামছাটা মাথা থেকে খুলে ও শরীরের ঘাম মুছল। এটা ও কখনই করতে চায় না, কারণ শরীরের ঘাম কাপড়ে মুছলে সেটা কালো হবেই আর ঘামে শরীরের রং থাকে। বাবুদের বেলায় ঠিক উলটোটা হয়। ওর এক-এক সময় ইচ্ছে করে এই গামছায় কোনও বাবু তার গায়ের ঘাম মুছুক, এটা খানিক ফরসা হোক। কিন্তু যা গন্ধ, বাবুরা নেবে কেন? মা বলে বাবুদের গায়ে নাকি ফুলের সুবাস থাকে, বোতলে বিক্রি হয়।

এক হাতে টিনের ক্যানটা নিয়ে অন্য হাতে কপাল ঘষতে-ঘষতে সে মোড়টায় এসে দাঁড়াল। কোন দিকে ওরা? আজ সকালে মা-কে বাপ বলেছিল যে ট্যুরিস্ট লজে শুটিং পার্টি এসেছে, জোর পান বিক্রি হচ্ছে। তারা নাকি এদিকটায় মাঠঘাটে শুটিং করে বেড়াচ্ছে। এর আগে একবার পৌষালির সামনে শুটিং দেখেছিল সে মায়ের সঙ্গে। ফরসা-ফরসা বাবুরা মেয়েদের সঙ্গে কেমন কথা বলছিল আর সেসব কথা ক্যামেরা দিয়ে লোকজন ছবি করে নিচ্ছিল। মা বলে, সেগুলোন। নাকি সিনেমা হলে বই হয়ে আসবে। মা-র সিনেমা দেখার বড় শখ, বাপ পয়সা দিতে চায় না। বলে মেয়েছেলের হাতে পয়সা দিলেই সংসারে সব্বোনাশ হয়। মা বলে, তার বাকিটা কি থাকল –কোনওরকমে দু-বেলা ভাত গেলা ছাড়া এ সংসারে আর নতুন কিছু হল না। বাপ বলে, তাই। পায় কজন! এই যে আমি ঘরে বসে ফুর্তি করি তা কি নিজের পয়সায়? তালতোড়ের গগনখুড়ো দেয় বলেই তো খাই! খেয়ে ঘরে থাকি! মা বলে, ছেলে পাশ দিয়ে দুই কেলাসে উঠল–তার বইটই কেননা অন্তত। বাপ বলে, কত বড় মানুষ কিনতে পারছে না আমি তো ছার। ছাপা নেই বই –ছাপা হয় যেখানে সেখানে হরতাল। তা তোমার ছেলে একা নাকি–দুনিয়াসুষ্ঠু পড়াশুনা হবে না এখন।

তাই ও বালাই নেই। পড়তে ভালোও লাগে না তার। তার চেয়ে শামবাটির পুকুরে মাছ ধরা ভালো কিংবা ডিয়ার পার্কে ঘুরে বেড়ানো। এখন তাই মোড়ে দাঁড়িয়ে গোঁড়ালি উঁচু করে ও দু পাশে তাকাল। শুটিং পার্টি গেল কোথায়! তারা মানেই তো ভিড় আর একটা গাড়ি। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না তো। বাপটা সত্যি বলল তো? ডানদিকে প্রান্তিকের রাস্তাটা ধরলেই হয়, রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানটায় জমি বেশ উঁচু, আশেপাশের অনেকটা তল্লাট দেখা যায়। চোখ আড়াল করে সূর্যটা দেখল ও। তিনটের পর গগনখুড়ো আর ভাঁটিতে থাকে না। তখন যাওয়া। মানে শূন্য হাতে ফিরে আসা। ক্যান খালি মানে বাপ বাখারি ভাঙবে তার পিঠে–আর কী কী হবে। ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠে ও সোজা বাঁদিকের রাস্তাটা ধরল। মদ না খেলে বাপটা মাইরি দু:শাসন হয়ে যায়। যাত্রায় দেখেছে সে, বোলপুরের গণেশ মুদি খুব ভালো দু:শাসন সাজে, ইয়া বড় গোঁফ। বাপটার অবশ্য গোঁফ নেই, এই যা।

গোয়ালপাড়ার পথটা ধরে এগিয়ে চলল সে। খালি গা, দড়ি দিয়ে হাফপ্যান্ট বাঁধা, হাতে টিনের ক্যান। লাল ধুলো পথ ছেড়ে হাঁটু অবধি রাঙিয়ে দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে ইটখোলায় লরি যায় এ পথ দিয়ে। তখন বাতাস দেখে পালাও, পালাও। লাল মেঘ হাত-পা নেড়ে তেড়ে আসে যেন। ডানদিকে ধেনো জমির ফাটল দিয়ে গরম নিশ্বাস উঠছে। মা-লক্ষ্মী পাতালে বন্দি হয়ে কাঁদছেন এখন। শুখনো মাটি শুধু ফাটছে আর ফাটছে। ভুলেও কেউ জমি মাড়ায় না এখন, একটা দেশলাই কম করে জ্বেলে দাও আর সঙ্গে-সঙ্গে খরগোশের মতো আগুনটা চারধারে শুখনো ঘাস বেয়ে দৌড় মারবে। বাঁ দিকে বাবলাগাছ আর বাঁজা তালের সরু ছায়া। ছেলেটা রোদে পুড়তে পুড়তে হাঁটছিল। পুজোর সময় বাপের মেজাজ ছিল রুক্ষ। শালা ভাটিখানা ভেসে গিয়েছিল। জলে। কোপাইটার কি গর্জন তখন। ওরা সব শামবাটির মুখটায় দাঁড়িয়ে হাঁ হয়ে দেখেছিল। এই গোয়ালপাড়া, তালতোড়, প্রান্তিক, ওই সৰ্পলেহনা–সব জলের তলায়। হুস-হুস করে জল উঠছে –এইসব ধুলোগুলেন তখন কোথায় হাওয়া। জলের কথায় সে রাস্তার ধারে সরে এল। তারপর একহাতে প্যান্ট সরিয়ে জলত্যাগ শুরু করল। যাঃবাবা, এখন মাটির খাইদ্যাখ, হাঘরের মতো সব শুষে নিচ্ছে–একটুও কাদা হতে দিচ্ছে না। শেষ হয়ে গেলে সেখানটায় একটা ভেজা দাগ। রয়ে গেল। সে থুতু ফেলে ঘুরে দাঁড়াতেই দূরে ধুলোর ঝড় দেখতে পেল।

পথ থেকে নেমে দাঁড়াতে হ্যাট-হ্যাট করে গরুর গাড়িটা সামনে এসে পড়ল। খালি গাড়ি যাচ্ছে বোলপুরে। গাড়োয়ানকে মুখে চেনে, চেঁচিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, শুটিং পার্টি কোথায়? গাড়োয়ান রা কাড়ল না, হাতের লাঠি মাঠের দিকে উঁচিয়ে ধরল। ছেলেটা সেদিক লক্ষ করে দেখল বুনো গাছ আর তালতোড় গ্রামের ঘরবাড়ির চাল ধানখেত শেষ হলে উঁকি মারছে। তাহলে কি শুটিংটা তালতোড়ে হচ্ছে? দ্রুত পা চালাল সে গোয়ালপাড়ার পথে।

জলে এই গ্রাম ভেসে গিয়েছিল। যেসব দেওয়াল সামান্য পলকা আর বয়সে পুরোনো সেগুলো ধুয়ে গিয়েছে। ঘর উঠেছে নতুন। এখন শধু গাছের ডাল দেখলে বোঝা যায় জল কীরকম ছিল। শুকনো চালের খড়গুলো গাছের ডালে লটকে দোল খাচ্ছে। ছেলেটা গ্রামে ঢুকল। একটা লাথি মার ব্যস সব শরীর লাল–এইসান ধুলো। সামনের চায়ের দোকান এখন বন্ধ। বাঁদিকে একটা দাওয়ায় বসে হরি হাজাম গাল কামাচ্ছে একজনের। বাড়িঘরের মধ্যে দিয়ে ও ডান পাশে ঘুরল। এক দাওয়ায় তালপাতার ওপর কুঁদে, তেলেভাজা আর শুকনো লেডিকেনি বিকোচ্ছে একটা। বুড়ো। ছেলেটা বাঁ পকেটে হাত দিল, পাঁচটা পয়সা মায়ের কাছ থেকে এনেছে সে। এখন খাবে কি খাবে না দোটানায় পড়ল সে। তিনটে মোটকা মাছি এসে বুদেগুলো চেটে খেল একবার। বুড়ো হাত নাড়তেই লেডিকেনিতে বসল। ইস, যদি মাছি হওয়া যেত–ছেলেটা জুলজুল করে। সেদিকে চাইতেই বুড়ো খনখনিয়ে বলে উঠল, ট্যাঁকে দশটা পয়সা আছে? ঘাড় নাড়ল সে, না। যা ভাগ, মাল নেগে যা। বুড়ো ভাগিয়ে দিল হাত নেড়ে। দশ পয়সা, দশ পয়সা আনতে হবে–তা সেটা পেলে এখানে আসবে কেন? বোলপুর বাজারে কত কী পাওয়া যায়। একবার মুখ ভেংচে সে হাঁটা দিল।

গ্রামের যেখানে প্রায় শেষ সেখানেই ভাটিখানা। একটা ড্রামের তলায় গনগনে উনুন জ্বলছে। সবসময়। দূর থেকেই গন্ধে মালুম হয়। প্রথম প্রথম বমি আসত ওর, এখন সহ্য হয়ে গিয়েছে, মা-র হয়নি। ওই একটা জায়গায় বাবা হার মানে। মদ খেলে বাপ ঘরে ঢুকতে পায় না। দাওয়ায় খাঁটিয়া পেতে চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকে। মা বলে মদের গন্ধ নাকি পেটের নাড়ি ছিঁড়ে ফেলে। ওর অতটা মনে হয় না তবে ঝাঁঝ লাগে বড়। উনুনের পাশেই চালাঘর। চালচুলো নেই লোকগুলো ভাঁড় নিয়ে মুখোমুখি বসে গিলছে তার তলায়। ওপাশে সিমেন্টের দাওয়া, তাতে ভদ্রলোক বসে! একপাশে তেলেভাজা বিক্রি হচ্ছে জোর। ওকে দেখে দাওয়া থেকে চিৎকারটা ভেসে এল, এই যে রামচন্দ্র, বড্ড দেরি করে ফেললে আজ। গগনখুড়ো ডাকছেন।

সঙ্গে-সঙ্গে আর একজন ঠা-ঠা করে হেসে উঠল, যা কয়েছেন। দশরথের পুত্র রামচন্দ্র। সত্য সত্য-সত্য। তার গলা শুনে ছেলেটা বুঝল এর নেশা হয়েছে। গগনখুড়োকে আজ অবধি নেশা করতে দ্যাখেনি সে। চুপচাপ বসে থাকেন আর লোকে টাকা চাইলে কাগজে সই নিয়ে দুই টাকা দিয়ে দেন। ওকে দেখলেই তিনি রামচন্দ্র বলে ডাকবেন। তার নাম মোটেই রাম নয়। কিন্তু ডাকটা শুনতে খারাপ লাগে না ওর।

দাও হে জগু, চার ভাঁড় ঢেলে দাও রামচন্দ্রের কমড়ুলুতে। গগনখুড়ো বলতেই জগুঁড়ি ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। মোদো মাতালদের পাশ কাটিয়ে সে তার কাছে এগিয়ে যেতে একটা। মাতাল চালাঘরে পা ছড়িয়ে বসে বলে উঠল, একিরে বাবা, দুধের ছেলেও মাল খায়! কলিকালে কী যে হল!

জগুঁড়ি ধমক দিল, এ্যাই চোপ!

চার ভাঁড় দিয়ে ক্যানের মুখটা বন্ধ করে দিতেই গগনখুড়ো ওকে ডাকল। ক্যানটা এখন ভারী হয়েছে বেশ। ও পায়ে-পায়ে সামনে এসে দাঁড়াতে গগনখুড়ো তার সরু কাঠি-কাঠি আঙুল দিয়ে ওর গালটা টিপে দিল। রোজই দেয়–বিশ্রী লাগে তখন। টিপেটিপে গগনখুড়ো বলল, দশরথকে বলবি, আজকের মালটা ভালো ছিল না। আমার সঙ্গে ফোরটুয়েন্টি করলে কি আর লাভ হবে! আমি তো আর মালে জল দিই না, কি বল জগু? তোর হল জলের নেশা আমার শুকনো নেশা। শহর থেকে আমদানি হয় বলেই তোকে খাতির করি। বলবি কিন্তু আমি কাল দেখা করব।

ও ঘাড় নেড়ে আস্তে-আস্তে চলে আসছিল, এমন সময় কে যেন বলে উঠল, ও খুড়ো, হিরোইনকে কেমন দেখলে? শুটিং হচ্ছে শুনলাম তোমার গাঁয়ে!

হিরোইন! গগনখুড়ো নাক ঝাড়লেন, একটা পাঁচিদাসীকে জুটিয়ে এনেছে–ও আবার হিরোইন নাকি! বুক পিঠ সব এক। হ্যাঁ সে ছিল কাননবালা-লীলা দেশাই, রাতে ঘুম আসত না।

তাড়াতাড়ি পা চালাল সে। তালতোড়ে শুটিং হচ্ছে তাহলে! এখন কোন পথে যায় সে? সেই শামবাটি হয়ে ঘুরে যেতে অনেকটা পথ। তার চেয়ে ডানদিকের কোপাই পেরিয়ে মাঠ ভেঙে ইটখোলার পাশ দিয়ে গেলে সময় বেশি লাগবে না। ও আর দেরি করল না।

কোপাই তখন শুকিয়ে মনে গুটিয়ে গিয়েছে। খানিকটা চড়া ফেলে একপাশে হাঁটুর তলায় জল নিয়ে কুলকুল করে বইছে। কে চিনবে পুজোর সময়কার নদীটাকে। জলে নামল সে। আঃ, বেশ ঠাণ্ডা–শরীর জুড়োয়। মজা করতে ও ক্যানের তলাটা জলের ওপর রাখতেই সেটাকে স্রোত সামান্য টানল। চট করে তুলে ধরল সে। বাপের মুখটা মনে পড়ল।

ভালো করে পা-হাত ধুয়ে এপারে উঠল ছেলেটা। আল ধরে হাঁটা ঠিক নয় এখন। তেনারা সব গরম সহ্য করতে না পেরে আলের পাশে ঘাসের নিচে শরীর লুকোন। একটু শব্দ পেলেই অন্ধের মতো ছোবল ছুড়বেন রাগে। রাগটা যার ওপরই হোক ছোবল খেলেই শুয়ে পড়তে হবে। বরং শুকনো মাঠ দেখে হাঁটা ভালো। একটা মরা গাছের ডাল ভেঙে নিল সে। তারপর একহাতে ক্যান ধরে ডালটাকে মাটিতে হাঁকড়াতে-হাঁকড়াতে চলল সে তালতোড়ের দিকে।

অনেক চড়াই উত্রাই ভেঙে সে উঁচু ডাঙাটায় উঠে এল। ওই তো তালতোড় গ্রাম। সামনে একগাদা বাবলা গাছের জঙ্গল, সেটা পেরোলেই হল। এই বিকেলের রোদ্দুরে কেউ বের হয়নি। মাঠে। শুটিং পার্টির বাবুদের রোদ লাগে না? অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল সে, হঠাৎ ফোঁসফোঁস শব্দ শুনে চমকে গেল পা-দুটো। সামনেই একটা বাবলা গাছের তলায় তিনি। তিনি নয়, ঠাওর করে। বুঝল তেনারা। দুটিতে জড়িয়ে-জড়িয়ে এক হয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। কী শব্দ, বাস। যেন রাগে এ ওকে খায়। কিন্তু খাচ্ছে না তো। চট করে তার মনে পড়ল সাপে যখন লীলা করে তখন এরকমটাই হয়। সে দৃশ্য নাকি পৃথিবী আর ভগবান দেখে। মানুষের পাপ চোখে নাকি এসব পড়ে না। তবে যদি কেউ সত্যি-সত্যি দেখে ফেলে তবে একটা নতুন কাপড় পেতে দিতে হয় তেনাদের জন্য। সেই কাপড়ে যদি তেনারা একবার গড়াগড়ি খান তাহলেই হয়ে গেল। যার কাপড় সে রাজা হয়ে যাবে। মাকে এ গল্প করেছে তার ঠাকমা। ঠাকমার বাপ নাকি বড় ওঝা ছিল। কিন্তু এখন নতুন কাপড় পাবে কোথায়? সে অসহায়ভাবে চারপাশে তাকাল। এখন দৌড়ে তালতোড়ে গিয়ে কারও কাছ থেকে চেয়ে এনে যদি দ্যাখে এনারা নেই, তবে? আর দৌড়োতে। গেলে পেছন তাড়া করতে পারেন বিরক্ত হয়ে। কীকরবে সে? একহাত দিয়ে মাথা চুলকোতে। গিয়ে আঙুলে গামছা ঠেকল। সঙ্গে-সঙ্গে গামছা খুলে নিল ও। কাপড় বলতে আছে প্যান্ট আর

এই গামছা। দুটোই ময়লা কালো। প্যান্টটা বাসি আর গামছা সকালে জল কাঁচা হয়েছিল। এটাই পেতে দিই তেনাদের জন্য কিছু তো উপকার হবে। তুলসীজল ছিটিয়ে দিতে বলবে না-হয় মা কে। ক্যানটা মাটিতে সন্তর্পণে রেখে সে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই সাপ দুটো নিথর হয়ে গেল। বুকের মধ্যে চুকচুক করছে, পা ভারী, কোনওরকমে ওদের পাশে গামছা বিছিয়ে সে পায়ে-পায়ে সরে এল ক্যানের কাছে। সাপদুটো চুপচাপ ওকে দেখছে, ওর মতলব বোঝার চেষ্টা করছে। দূরে সরে এসে বুক হালকা করে ও বাতাস ছাড়ল। রাগ কোরো না মা মনসা, আমার মনে কোনও অন্যায় নাই–বিড়বিড় করে আওড়াতে লাগল সে। কাজ হল যেন, সাপদুটো আবার নড়ছে। ল্যাজদুটো পরস্পরকে আঘাত করে মাটিতে আছাড় খাচ্ছে এখন। আর একটু হেল–আর একটু হেল–যাঃ, সরে গেল। গামছাটার কাছ ঘেঁষে এসেও সরে গেল সাপদুটো। ও মা মনসা, রাজা। করে দাও গো, ও মা মনসা। চোখ বন্ধ করে সে মনসাকে ডাকতে লাগল। এক মিনিট পার করে দিয়ে সে চোখ খুলতেই স্থির হয়ে গেল। তেনারা একদম গামছার মধ্যিখানে এসে গেছেন। মা মনসার প্রতি কৃতজ্ঞতায় সে কেঁদে ফেলল।

তারপর একসময় তেনাদের লীলা শেষ হয়ে যেতেই তেনারা দৌড়ে যে-যার থানে চলে গেলেন। চুপচাপ চারধার, শুধু একটা ঘুঘু কোথাও ডাকছে। সে রোমাঞ্চিত শরীর টেনে পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসে গামছাটা তুলে নিয়ে মাথায় ঠেকাল। আঃ, সে রাজা হয়ে যাবে এবার। রাজা না হোক, নতুন কাপড় নয় যখন তখন গগনখুড়োর মতো টাকা হবে নিশ্চয়ই। এটাকে এখন কোথায় রাখে! মাথায় রাখলে তো ঘাম লাগবে। তার চেয়ে শক্ত করে কোমরেই বাঁধা যাক। নিশ্চিন্তে ক্যানটা। নিয়ে সে তালতোড়ের দিকে হাঁটতে লাগল। পায়ের তলায় এখন যেন গরম গালচে বিছানো।

তালতোড়ের মুখটাতেই শলোকের ভিড়। সেই যেখানে বাইশটা তালগাছ গায়ে-গায়ে দাঁড়িয়ে ছায়া ফেলে রেখেছে জমিতে সেখানে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে। বেশ জোরে-জোরে পা ফেলে সে। রাস্তাটায় এসে দাঁড়াল। গাঁয়ের লোক একপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার মধ্যে এবং ওপাশে কয়েকটা প্যান্ট-পরা লোক মাথায় টোকা চাপিয়ে হাত-পা নেড়ে কীসব বলাবলি করছে। ওদের পেছনে কালো কাপড়ে মোড়া একটা যন্ত্র, তার পেছনে একটা মানুষ মাথা মুড়ে এক একবার কী দেখছে আর বেরিয়ে আসছে।

বড়-বড় চোখ মেলে সে রাস্তাটা পেরিয়ে গাঁয়ের লোকগুলোর দিকে যখন হাঁটতে শুরু করেছে তখন কাট-কাট বলে চিৎকারটা উঠল। আঃ, যতীন, তোমায় বললাম রাস্তাটা গার্ড দাও, দিলে নষ্ট করে! সে অবাক হয়ে দেখলে কালো কাপড় থেকে মুখ বের করে একজন চেঁচামেচি করতে লাগল।

সে থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেই একজন এসে তার হাত ধরল ছুটে, এ্যাই ছোঁড়া, সরে যা সরে যা। খবরদার রাস্তা ক্ৰশকরবি না।

ঠিক সেই সময় ও একটা মোটা গলা শুনল, যতীন, ওকে নিয়ে এসো তো এখানে! কথাটা শেষ হতেই লোকটা ওর হাত ধরে টানতে-টানতে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল।

সেখানে যিনি একহাতে খাতা আর মাথায় টোকা পরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি ভালো করে ওকে দেখলেন। তারপর ঘাড় নেড়ে বললেন, গুড, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। সুনীলবাবু যখন গরুর গাড়িতে করে গ্রামে ঢুকলেন তখন এ, ধরা যাক গ্রামের ছেলে, গরুর গাড়ির পেছনটা ধরে দৌড়ে আসতে থাকবে। একদম ন্যাচারাল হবে, কি বলো?

সঙ্গে-সঙ্গে অনেকে দারুণ-দারুণ বলতে লাগল। হাতে-খাতা ভদ্রলোক ওর দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন। এ্যাই, তোর নাম কী?

শ্রীরবীন্দ্রনাথ–।

ওকে থামিয়ে দিয়ে তিনি হো-হো করে খানিকটা হেসে নিলেন, আরে বাস, শান্তিনিকেতনে এসে রবীন্দ্রনাথকে আর্টিস্ট হিসেবে পেয়ে গেলাম, বুঝলে হে! এইসব চাইল্ড ট্যালেন্টকে ট্রেইন্ড করাই হচ্ছে অ্যাকচুয়েল এফিসিয়েন্সি। কোন ক্লাশে পড়িস? পড়িস তো?

গলা শুকিয়ে গিয়েছিল তার, কোনওরকমে বলল, টু।

হুঁ। অ্যাকটিং করবি সিনেমায়? তোর বাড়ি কোথায়?

সেন্ট্রাল অফিসের কাছে।

দৌড়োতে পারবি?

সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড় নাড়ল সে। এটুকু ও বুঝতে পারছিল, সিনেমার যে ছবি এখন ইনারা তুলবেন সেখানে তার ছবি থাকবে। তাকে দৌড়াতে হবে। সঙ্গে-সঙ্গে সে খালিহাতে গামছাটা চেপে। ধরল। আঃমা গো, তুমি যদি দেখতে! ততক্ষণে কোথা থেকে একটা গরুর গাড়ি এসে পড়েছে। সামনে। তাতে একজন সুন্দর চেহারার পুরুষ বসে আছেন। গাড়োয়ানকে বলা হল গাড়িটা জোরে চালাতে আর তাকে ওরা বলল, গাড়ির পেছনটা ধরে সেই তালে ছুটতে। এটা তো একটা মজার খেলা, ওরা কত করে আর তখন গাড়োয়ানরা কি চেঁচায়! একহাতে ক্যানটা নিয়ে সে গাড়ির পেছনটা ধরতেই কয়েকজন হাঁ-হাঁ করে এগিয়ে এল, এই এটা রেখে দে, এটা নিয়ে ছুটবি কি রে! একজন এসে প্রায় জোর করে তার হাত থেকে ক্যানটা ছিনিয়ে নিল, কী আছে এতে?

মদ। কোনওরকমে বলল সে।

মদ! কে খায়–কার মদ?

বাপ খায়–গোয়ালপাড়ার ভাঁটিখানা থেকে আনলাম।

আরে বাস। ও যতীনদা, বাপের জন্য ছেলে এই রোদ্দুরে মদ নিয়ে যাচ্ছে। এরকম তো বাপের জন্মে শুনিনি দাদা। আঃ, বেশ গন্ধ তো! এ্যাই, ঠিক কথা বলছিস তুই?

হ্যাঁ। আমি রোজ আনি। গগনখুড়ো বিনি পয়সায় দেয়। প্রায় কেঁদে ফেলল সে।

বিনি পয়সায় মদ দেয়। তোর বাপ করে কী?

পানের দোকান আছে ট্যুরিস্ট লজের সামনে।

ওরে শালা, ওই বুড়োটা তোর বাপ?

এমন সময় খাতা-হাতে লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, রেডি, মনিটর।

সঙ্গে-সঙ্গে যতীন বলে মানুষটা বলল, নে ছোঁড়া, এটা আমার কাছে থাকল, ভয় নেই। যা-যা ছোট।

অগত্যা সে ছুটল। গাড়িটা হেট-হেট করে ছুটতেই সেই সুন্দরমতো পুরুষ শুয়ে পড়লেন। কী গায়ের রং তার, যেন সকালবেলার সূর্য। চোখ ভরে দেখতে-দেখতে খানিক দৌড়োল কারণ কিছুদূরে যেতেই পেছন থেকে চিৎকার করে তাদের থামতে বলা হল। এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে আবার আগের জায়গায় এসে ওদের ছুটে যেতে বলা হল। গাড়িও ছুটছে, সেও। ওকে বারবার করে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতে নিষেধ করা হয়েছিল, তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও সে দেখল না। কিন্তু এবার থামতেই ও পেছনে সেই কালো যন্ত্রটার দিকে তাকাল। নির্ঘাত ওখানে ছবি উঠছে তার।

কাছাকাছি ফিরে আসতেই একটা লোক ওর দিকে দুটো টাকা এগিয়ে ধরল, নে অ্যাকটিংকরলি, তার ফি। প্রায় জড়ভরতের মতো সে টাকাটা ধরল। আরে বাপ, শুধু সিনেমায় ছবিই উঠবে না আবার ওকে তারা টাকাও দিল! ও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে-না-উঠতেই সেই খাতা-হাতে লোকটা ওপাশের গাঁয়ের লোকদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, আমাদের কাজ শেষ। আপনাদের অনেক ধন্যবাদ! এখানে যদি ছবিটা আসে অবশ্যই দেখবেন। ছবিটার নাম–এর নাম সংসার। আপনাদের গাঁয়ের নাম ছবিতে থাকবে।

গাঁয়ের লোকেরা খুশি হল। ছেলেটা দেখল সেই সুবেশ পুরুষ গাড়ি থেকে নেমে মোটরগাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন। তিনি যখন ওর পাশ দিয়ে হাঁটছেন তখন যেন নাক বন্ধ হয়ে গেল ওর। মনে হল উত্তরায়ণে যখন গোলাপ, জুই, রজনীগন্ধা ফোটে তখনও এত সুন্দর সুবাস ছড়ায় না। ভীষণ লোভীর মতো বার বার নিশ্বাস নিল সে–আঃ, বুক ভরে যায় যেন। জিনিসপত্র গোটানো হয়ে গেলে সেই যতীন নামের লোকটা ওকে ক্যান ফিরিয়ে দিল। হাতে নিতে ও চমকে উঠল, বড় খালি-খালি ঠেকে! ক্যানের ঢাকনা খুলতেই ওর সামনের গাঁটা যেন ঘুরে গেল আচমকা, ক্যানটা খালি! মুখ তুলে সে দেখল যতীন মুচকি মুচকি হাসছে, চোখাচোখি হতেই একটা হাত আকাশে তুলে বলল, যা ভাগ!

মদ কোথায় মদ? চিৎকার করে উঠল সে।

আবার চেঁচায়? ধমকে উঠল যতীন।

আপনি আমার মদ নেছো–দেন, ফিরায় দেন।

প্রায় কেঁদে ফেলল ও। সঙ্গে-সঙ্গে ভিড় জমে গেল ওদের ঘিরে। খাতা-হাতে লোকটা এবার

এগিয়ে এল, কী হয়েছে?

কে একজন বলল, মদ নিয়ে যাচ্ছিল ছোঁড়া, যতীন ফেলে দিয়েছে।

মদ? তুই মদ নিয়ে যাচ্ছিলি?

হ্যাঁ।

কার জন্যে?

বাপের জন্য। বাপ আমার চামড়া খুলে নেবে–এঁ এঁ এঁ। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল ছেলেটা।

খাতা-হাতে লোকটা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না ব্যাপারটা, কীরকম বাপ ভাই, ছেলেকে এই রোদে মদ আনতে পাঠায়!

আমার মদ দেন–দেন বলছি। আপনার টাকা ফিরায় নেন। প্রায় পাগলের মতো চিৎকার করে যাচ্ছিল সে।

এমন সময় সেই সুন্দর পুরুষ গাড়ি থেকে নেমে এল, কী হয়েছে? খাতা-হাতে লোকটা ঘটনাটা বলে শেষ করল, যতীন মদটা ফেলে দিয়েছে। অবশ্যই ঠিক করেনি। কিন্তু আমি ভাবছি কতখানি পাষণ্ড হলে বাপ নিজের ছেলেকে মদ আনতে পাঠায়। অদ্ভুত ব্যাপার!

সুবেশ পুরুষ বলল, কিন্তু এটা ঠিক হয়নি। লোকাল লোককে চটিয়ে আমরা এখানে কাজ করতে পারব না। ওকে বরং মদের দামটা দিয়ে দিন।

খাতা-হাতে লোকটা যতীনকে বলল, এই, ওকে দশটা টাকা দিয়ে দাও।

সঙ্গে-সঙ্গে মাথা নাড়তে লাগল ছেলেটা, না, আমায় মদ দেন, টাকা নিয়ে কী করব! গগনখুড়ো না-হলে টাকা দিলেও আমায় মদ বেচবে না জগুঁড়ি। ঘ্যানর-ঘ্যানর কান্নায় ওরা ক্রমশ অতিষ্ঠ হয়ে উঠছিল। এদিকে ব্যাপার দেখতে দূরে দাঁড়ানো গাঁয়ের লোক ক্রমশ ওদের ঘিরে। দাঁড়িয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে খাতা-হাতে লোকটা ঘাবড়ে গেছে। সুন্দর পুরুষ ওর কাছে আসতেই ছেলেটা কান্নার ফাঁকে-ফাঁকে নাক টেনে গন্ধটা নিচ্ছিল সেটা সবাই নজর করেছিল।

সুন্দর পুরুষ ওর খালি কাঁধে হাত রাখল, মদ যখন ফেলেই দিয়েছে তখন আর কি করবি, দশটা টাকা দিচ্ছে সেটা রাখ, বাপকে আমার নাম করে দিবি, বুঝলি?

ছেলেটা আবার নাক টানল। তাই দেখে পুরুষটি বলল, গন্ধটা পছন্দ হয়েছে? নিবি তুই?

সঙ্গে-সঙ্গে মাথাটায় সব গোলমাল হয়ে গেল ছেলেটার। গন্ধটা তাকে দেবে বলছে। মার মুখটা মনে পড়ে যেতেই সে আস্তে-আস্তে ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

আমার ইন্টিমেটটা এনে দাও তো।

হুকুমটা হতেই একজন গাড়ি থেকে একটা বাক্স বের করে তা থেকে সুন্দর শিশি এনে তার হাতে দিল। পুরুষটি সেই শিশি ছেলেটির হাতে দিয়ে বলল, খুশি তো? এর মধ্যে কে যেন দশটা টাকা খুঁজে দিয়েছে হাতে। সে দেখল যেন বিরাট ফাঁড়া কেটে গেছে, এরকম ভঙ্গিতে ওরা দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে গেল জায়গাটা ছেড়ে। ছেলেটা এবার এগিয়ে আসা গাঁয়ের লোকদের দেখে কেমন থতমত হয়ে বুঝতে পারল এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। টাকাগুলো ক্যানের মধ্যে ফেলে অন্য হাতে শিশিটাকে নিয়ে সে শামবাটির দিকে দৌড়াতে লাগল।

পেছনের চিত্তার, হাসি দ্রুতপায়ে এড়িয়ে সে খালটার পাশে এসে দাঁড়াল। এখনও দূরের আকাশে ছুটে যাওয়া গাড়ি থেকে ওঠা ধুলোর ঝড় পাক খাচ্ছে। সে সন্তর্পণে হাতের মুঠো খুলল, একটা ছোট শিশির ভেতরে রঙিন তেল টলমল করছে। হাতটা মুখের কাছে নিয়ে এসে গন্ধটা নাক দিয়ে টানল সে–আঃ! কীসের সঙ্গে মেলে এটা। গোলাপ, উঁইউঁহু! বোতলের মুখটা শক্ত করে সাদা ছিপিতে আঁটা, তার গায়ে ছোট্ট একটা ফুটো। কৌতূহলী আঙুলে ছিপিটার মুখে জোরে চাপ দিতেই তিরের মতো সাদা ধোঁয়া আকাশের দিকে ছিটকে উঠল। সঙ্গে-সঙ্গে সমস্ত পৃথিবী। যেন সেই অপরূপ গন্ধে ভুরভুর করতে লাগল। এরকমটা হবে জানা ছিল না, ভয়ে চট করে সে হাত সরিয়ে নিতেই শিশিটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে সে হাত বাড়িয়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে। সেই গন্ধটা শরীরে মাখতে চাইল। আঃ। এখন এই মুহূর্তে ওর সামনে থেকে শেষ হয়ে আসা সূর্যটা, রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকা খোয়াই যেন মুছে গেছে। সমস্ত চরাচরে সে ছাড়া আর কেউ নেই।

শামবাটি পেরিয়ে গামছাটায় শিশিটা আচ্ছা করে বেঁধে সে হাঁটছিল। ডানদিকে উত্তরায়ণ শ্রীনিকেতনে যাবার রাস্তা, ওকে বাঁ-দিকের পথটায় যেতে হবে। হাঁটতে-হাঁটতে সে লক্ষ করছে যারাই ওর পাশ দিয়ে হাঁটছে তারাই অবাক হয়ে নাক টানছে। কিন্তু কেউ যেন অনুমান করতে পারছে না তার শরীর থেকেই গন্ধটা আসছে। ভীষণ মজা লাগছিল ওর, ঠিক লুকোচুরি খেলার মতন।

বাখারির দরজা ঠেলে সে যখন উঠোনে ঢুকল তখন সন্ধে হব-হব। ওদের ঘরের দাওয়ায়। খাঁটিয়াটা শূন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। আর সেদিকে তাকিয়েই ওর পেটটা কেমন চিনচিন করে উঠল। আটটা বাজলেই বাপ আসবে, এসে ওই খাঁটিয়ায় শোবে। হাতের ক্যানটার দিকে তাকাল সে। এতক্ষণ সেই শিশিটা হাতে পাবার পর থেকে যে ভয়টা উবে গিয়েছিল, সেটা যেন তাড়কা রাক্ষসীর মতো হা-হা করে ফিরে এল। মদ না পেলে বাপ বাখারি ধরবেই–এখন কী হবে?

মাটিতে পা ঘষে-ঘষে সাহস আনতে চাইল সে। মা মনসা তাকে যদি রাজা করে দেন, না-হোক গগনখুড়োর মতো টাকা দেন, তাহলে দিনরাত ভরপেট মদ খাওয়াবে সে বাপকে। তোমার আর পানের দোকান দিতে হবে না বাপ, ঘরে বসে দিনভরে মদ খাও। এই কথাটা সে কী করে বাপকে বোঝাবে?

এই সময় সে মা-কে দেখতে পেল। ঘর থেকে বাইরে পা দিয়ে তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, এ্যাই, কী হল তোর? মদ আনতে গিয়ে খেয়ে এলি নাকি? যেমন বাপ তেমন বেটা হবে না? আমার হাড়ে দুব্বো গজিয়ে গেল।

সে তবু নড়ে না। বাপ একবার মা-র গায়ে হাত তুলেছিল, তারপর তিনদিন ঘরে আসেনি। মা গিয়ে ফিরিয়ে এনেছিল। মা কি তার কথা শুনবে? ও অন্য কোনও উপায় পেল না, এক-পা এগিয়ে আবার খাড়া হয়ে দাঁড়াল সে, মা-র চোখ ঘুরছে।

কী ব্যাপার রে, অমন চোরের মতো তাকাস কেন? মা-র গলায় সন্দেহ। তারপর উঠোনে নেমে পড়ে তার দিকে দ্রুত আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল, দাঁড়িয়ে জোরে-জোরে নাক টেনে ঘ্রাণ নিল, কীসের গন্ধ রে, কী মদ এটা?

মদ নয়। শুকনো গলা থেকে আওয়াজটা কোনওরকমে বের হল।

ততক্ষণে মা কাছে এসে পড়েছে। দ্রুত নাকটা টানছে মা, তোর শরীর থেকে বের হয় যে কী মেখেছিস কোথায় পেলি? আলতো করে তার হাত ধরল মা।

শুটিং পার্টি দিল।

শুটিং পার্টি? তুই সেইসব দেখতে গেছিলি?

হুঁ। আমাকেও ছবিতে দেখা যাবে। ওরা আমার দৌড়োনোর ছবি তুলেছে।

ছেলেটা কথা শেষ করতেই মা ওকে জড়িয়ে ধরল, সত্যি?

মায়ের শরীরের কাছে বসে ও পুটুর-পুটুর করে সমস্ত ঘটনাটা বলল। সেই মা মনসার সাপদুটো তার গামছায় লীলা করেছে আর সুনীলবাবু নামে সুন্দর পুরুষটা তাকে শিশি দিয়েছে, সেই সঙ্গে বারো টাকা। বাপ আমাকে মেরে ফেলবে মা–মদ না পেলে বাপ–।

তার কথা থামিয়ে মা চিৎকার করে উঠল, চুপ কর। মদ খেয়ে সে তো নর্দমা হয়ে পড়ে থাকে–এরকম গন্ধ সে বাপের জন্মে এ বাড়িতে এনেছে? হ্যাঁরে, বইটার নাম কী?

ওরা বলল, এর নাম সংসার। লোকটা কী সুন্দর দেখতে!

এর নাম সংসার। মনে-মনে যেন মুখস্থ করল মা, তারপর বলল, তেনার ছবি দেখিছি রাস্তায়। তুই আমার রাজা হবি রে–তোর ছবি কত লোক দেখবে। ওকে জড়িয়ে ধরে মা যেন কী করবে বুঝতে পারছিল না।

গামছাটা খুলে সে মায়ের হাতে দিল। শিশিটা এখন তার হাতে। মা চোখ বন্ধ করে গামছাটা মাথায় ঠেকিয়ে দ্রুত উঠে গিয়ে ঘরে রেখে এল, দেখি-দেখি শিশিটা।

ও মাটিতে বসে মায়ের দিকে তাকাল। শিশিটা হাতে নিয়ে মা-র মুখ হাঁ হয়ে গেছে, ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে চোখের সামনে শিশিটা নিয়ে দেখছে। তারপর কাঁপা-কাঁপা হাতে সামান্য উপুড় করে দেখল। তেলটা বের হয় কিনা। শেষে হতাশ হয়ে ছেলের দিকে তাকাল। সে হেসে ফেলল। এখন। কায়দাটা তার জানা। মায়ের হাত থেকে শিশিটা নিয়ে সে ফুটোটা মায়ের দিকে করে ছিপিতে চাপ দিল। সঙ্গে-সঙ্গে ধোঁয়াটা ছিটকে গেল মায়ের শরীরে, আচমকা ঘাবড়ে গিয়ে মা উলটে পড়ে যাচ্ছিল, তার শুকনো মুখে এখন অপ্রস্তুত ভাব। সে আঙুল সরাতে ধোঁয়াটা বন্ধ হয়ে গেল। মা। উঠে এসে জোরে-জোরে নিজের শরীরের ঘ্রাণ নিতে-নিতে বলল, আঃ, দ্যাখ কী সুন্দর! অ রবি, তোকে পেটে ধরেছিলাম বলে এটা পেলাম রে! পাগলের মতো দুটো হাত মুখে ঘষতে লাগল মা।

ততক্ষণে ক্যানটার দিকে নজর গেল ছেলেটার। খুব সন্তর্পণে সে ক্যানের ঢাকনাটা খুলল। তলায় নোটদুটো পড়ে আছে। আঙুল দিয়ে সে দুটোকে তুলতেই দেখল গা-মাখা মদে নোট ভিজে একসা হয়ে আছে। মা-র নজর পড়েছিল এদিকে, হাত বাড়িয়ে ক্যানটা নিয়ে দেখল একটু তলানি রয়ে গেছে এখন। গন্ধটা যেন বমি এনে দিল মা-র, একটানে ছুঁড়ে দিল মা সেটাকে উঠোনের একপাশে। থু-থু-থু! নোট থেকেও গন্ধ বের হচ্ছে মদের। মা সেটাকে হাতে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছিল না প্রথমটায়। দশটাকা আর দুটাকা বারো টাকা। কাউকে দিবি না, ওই বইটা এলে তোতে আমাতে দেখব, বুঝলি?

মা-র কথা শেষ হতেই সে বলল, কিন্তু বড় মদের গন্ধ ছাড়ে যে!

সঙ্গে-সঙ্গে মা চিন্তা করে ফেলল, তারপর নোটদুটো দুই আঙুলে সামনে ধরে বলল, ওই গন্ধের ধোঁয়াটা এর ওপর ছাড় তো, মোদো গন্ধটা ঠিক পালিয়ে যাবে–ছাড়!

শক্ত করে শিশিটা হাতে ধরে ফুটোটা সেদিকে তাক করে সে ছিপিতে চাপ দিল। পিচকারির মতো ধোঁয়াটা একরাশ গোলাপ, জুই, রজনীগন্ধা নিয়ে নোটদুটো ভিজিয়ে দিল। মা-র মুখটা কী মিষ্টি দেখাচ্ছে এখন! মাকে এমন সুন্দর করে হাসতে সে জন্ম থেকে দ্যাখেনি।

হঠাৎ তার খেয়াল হল ধোঁয়াটা যত বের হচ্ছে তত শিশির তেল কমে আসছে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সে আঙুলটা সরিয়ে নিল, তারপর শিশিটা দেখে নিয়ে মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল, মা, এটা শেষ হয়ে গেলে আর গন্ধ বের হবে না যে।

হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে মা বলল, অর্ধেকটা আছে, তোর বাপের গায়ে একটুস হয় দিয়ে দিস। বাপের জন্মে সে এসব দ্যাখেনি তো!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress