৪. স্তব্ধতা ভেঙে
অনেকক্ষণ পরে ইন্দ্রনাথই স্তব্ধতা ভেঙে ধীরে ধীরে বলে, একটু আগে তোমাকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম কমলা, এখন নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছি। ভাবছি, আমরা কত অল্পেই মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাই, শ্রদ্ধা হারাই। কার্যকারণ বিচার করি না, কোন্ অবস্থায় পড়লে কী করতে বাধ্য হতে পারে মানুষ, তা ভাবি না, নীচতাই যে মানুষের সত্যকার স্বভাব নয়, এসব কিছু না ভেবে বলে উঠিছি ছি ছি।…তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি কমলা।
কমলা যেন ক্রমশ অভিভূত হতেও ভুলে যাচ্ছে। তাই শান্ত স্তিমিত স্বরে বলে, না না, ক্ষমা কিসের? আমি কি জানি না আমি কত জঘন্য, কত নীচ, কত ইতর? তবু-তবু আরও নরকের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আর কোনও উপায় আমি পাইনি!
ইন্দ্রনাথ প্রশান্তভাবে বলে, তোমার পরামর্শদাতার বুদ্ধিটাই অদ্ভুত বাঁকা। ওর চাইতে ভাল কোন উপায় সে আবিষ্কার করতে পারলে না? আশ্চর্য!
কমলাও মৃদুস্বরে জবাব দেয়, আশ্চর্য হবারও কিছু নেই। সেই বা ওর চাইতে ভালর সন্ধান পাবে কোথা থেকে? জীবনে ভাল সে দেখতে পেল কবে? পৃথিবীর কুৎসিত কুশ্রী দিকটাই দেখল, তার কাছে ভাল জিনিসের আশা করব কী করে? তবু তো আমার যা কিছু জ্ঞানের আলো, যা কিছু বুদ্ধি চৈতন্য তার কাছ থেকেই পাওয়া। নিজের কত টানাটানি, তবু আমাকে লাইব্রেরি থেকে না কোথা থেকে বই এনে পড়ায়, কোথা থেকে না কোথা থেকে জোগাড় করে এনে দেয়।
ইন্দ্রনাথ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে, কিন্তু কমলা, তুমি তো তাকে শ্রদ্ধাই করো, ভালও বাসো অবশ্যই, তবে তাকে বিয়ে করতে বাধা কী?
সে কথা বলতে পারব না।…তবু বলব বাধা আছে। সে আর হয় না।…কিন্তু বিয়েতে দরকারই বা কী? একটা জীবন এমনি কেটে যেতে পারে না? আমি তো দেখেছি আপনাকে, দেখেছি আপনার সঙ্রে কাজ, দেখে বিশ্বাস এসেছে হয়তো চেষ্টা করলে আর একটা পথ খুঁজে পাব। সৎ পথসভ্য পথ। কিন্তু আমার ভাগ্যই আমার বৈরী!
ভাগ্য কারো চিরদিন বৈরী থাকে না কমলা। ইন্দ্রনাথ আন্দাজে কমলার কাঁধে একটা হাত রেখে গাঢ়স্বরে বলে, এবার আমার ভাগ্যের সঙ্গে তোমার ভাগ্যকে বেঁধে নেব, দেখি এরপর সে আর বৈরিতা সাধন করতে পারে কিনা!
কী বললেন?…কী বললেন আপনি? কমলা যেন ছটফটিয়ে ছিটকে ওঠে, এমন পাগলের মত খামখেয়ালী কথা বলবেন না!
কথাটা পাগলের মত কিনা জানি না–ইন্দ্রনাথ মৃদু হেসে বলে, কিন্তু খামখেয়ালী খেয়ালের নয়।…এ আমার ইচ্ছে, বাসনা। হয়তো কয়েক ঘণ্টা আগেই তোমাকে একথা বলতাম আমি, যদি না মাঝখানে এতটা সময় এই গোলমালে নষ্ট হত।
সে আলাদা কথা। কমলা তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মত বলে, তখন কি আপনি আমার পরিচয় জানতেন?…জানতেন আমি কী?
না, কমলা তা জানতাম না সত্যি-ইন্দ্রনাথ বলে, তাই তখন ছিল শুধু ভালবাসা। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হল শ্রদ্ধা। আজ যাই, যত তাড়াতাড়ি পারি তোমাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাব। তবে
ইন্দ্রনাথ হেসে ওঠে সহজ প্রসন্ন হাসি, সেখানে আবার ওই পিসিমা! কী করব বল, মাসি পিসি ভাগ্যটা তোমার সুবিধের নয়!
না, না, না!…কমলা আবার আর্তনাদ করছে, এ হয় না! এ অসম্ভব!
হয় কমলা। ইন্দ্রনাথ দৃঢ়স্বরে বলে, জগতে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। পাঁক থেকে পদ্ম তুলে দেবতার চরণে দেওয়া যায়, জানো তো? কেন যায় জানো? পদ্মের গায়ে পাক লাগে না বলে!
কিন্তু আপনি বুঝছেন না। আমি কোন মুখে আবার আপনাদের বাড়িতে–না, না, না!…এমন ভয়ঙ্কর আদেশ আপনি আমায় করবেন না!
আদেশই যদি বলছ তো–ইন্দ্রনাথ ফের হাসে–না হয় বলে শাস্তি, ভয়ঙ্কর দোষ করেছ, তার শাস্তিটাও ভয়ঙ্কর হোক। কিন্তু আজ যাই, অন্ধকার হয়ে গেছে, অস্বস্তি হচ্ছে। কোনখান দিয়ে গেলে তোমার ওই মাসির সামনে পড়তে হবে না বলে দিকি, সেই পথ দিয়ে যাই। উঃ, কী সাংঘাতিক!
মৃদু হেসে চলে গিয়ে ইন্দ্রনাথ আবার কী ভেবে ফিরে এসে বলে, কিন্তু কমলা, সেই ভাড়া করা ছেলেটাকে একবার দেখাতে পার আমায়?
কমলা ভীতকণ্ঠে বলে, কেন?
একবার দেখতাম। শুনেছিলাম নাকি অবিকল আমার মত দেখতে।
কমলা নিশ্চিন্ত হয়ে হাসে, ওটা পিসিমার মনের ভ্রম। আপনার মত ফরসা তাই।
ইন্দ্রনাথ চলে যায়।
কমলা সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে দেবার কথা বিস্মৃত হয়ে বসে থাকে পুতুলের মত।
.
এ কী হল! এ কী হল!
কমলার ভাগ্যদেবতা কমলার সঙ্গে এ কী নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের খেলা খেলতে চাইছেন! তবু সমস্ত আবেগ উত্তেজনা, ভয় আতঙ্কের দুরন্ত আলোড়ন ছাপিয়ে, কাঁধের উপর মৃদু একটি স্পর্শের অনুভূতি মৃদু একটি সৌরভের মত জড়িয়ে থাকে সমস্ত সত্তাকে, সমস্ত চেতনাকে।
আশ্চর্য! আশ্চর্য! এখনো কমলা বেঁচে আছে? সেই অসহ্য সুখে মরে যায়নি সেই মুহূর্তে?
তখন ছিল শুধু ভালবাসা, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হল শ্রদ্ধা।–একথা কার জন্যে উচ্চারিত হল? কমলার জন্যে?
কিন্তু… কিন্তু এত সুখ কি মানুষের সহ্য হয়?..বন্যার জলে কি তৃষ্ণা মেটে?..দাবানলে কি শীত ভাঙে?…না না, এত সুখ সহ্য করতে পারবে না কমলা!
যুদ্ধে পরাজিত সেনাপতির মত ফিরে এলেন নীহারকণা। এতখানি অপমানিত অপদস্থ জীবনে কখনো হননি বললেও কিছুই বলা হয় না। এ যেন মরেই গেছেন তিনি। সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে, হয়তো বা গোড়া থেকে আজ পর্যন্ত সবটাই কোন গভীর ষড়যন্ত্র। নইলে যে ছেলেটা খবর দিয়ে নিয়ে এল হাতে-নাতে ধরিয়ে দিতে, সে হঠাৎ পালালো কেন?
আর ইন্দ্র? অপরাধী কখনো অতখানি বুকের পাটা দেখাতে পারে? কিন্তু মেয়েটা…? সে যে সেই সেদিনের মেয়েটা তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। একেই তো রীতিমত মনে রাখবার মত মুখ চোখ, তাছাড়া নীহারকণার বুকের ফলকে আগুনের অক্ষরে আঁকা আছে যে সে মুখ। তার ওপর আবার প্রধান সন্দেহজনক–বেগতিক দেখে মূৰ্ছা যাওয়া।
তবে? অঙ্কগুলো ঠিক দেখাচ্ছে, যোগফল মিলছে না। আরো তার মর্মান্তিক দুঃখ, চন্দ্রনাথ যে কার পক্ষে বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছে, নীহারকণাকেই যেন মনে মনে দোষী করছেন তিনি। যেন নীহারকণার সেই দোষ বুঝেও নীরব হয়ে আছেন শুধু ধিক্কারে। তা মুখ ফুটে কেন বলুক না চন্দ্র, দিদি, তোমার ভুল হয়েছে! তাও বলবে না, শুধু কেমন একরকম নীরেট পাথরের মত মুখ করে বসে থাকবে। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে নীহারকণার।
ওঃ, এই জন্যেই বলে পরের ছেলের ওপর বেশি মায়া ঢালতে নেই। স্বয়ং মা যশোদাই যে বলেছেন, কাকের বাসায় কোকিল থাকে যতদিন না উড়তে শেখে, উড়তে শিখে ধর্ম রেখে চলে যায় সে অন্যবন।–পর কখনো হয় কি রে আপন?
এত বড় একটা দৃষ্টান্ত চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও কেনই যে মানুষের শিক্ষা হয় না! গুম হয়ে বসে থাকলেন নীহারকণা অনেকক্ষণ, তারপর হঠাৎ সংকল্প স্থির করে ফেললেন। হেস্তনেস্ত একটা করা দরকার। স্পষ্টাস্পষ্টি জিগ্যেস করবেন চন্দ্রনাথকে–কী সে চায়? যদি বলে যে নীহারকণাই যত নষ্টের গোড়া, তা বলুক–বেশ, চলে যাবেন নীহারকণা। আর কিছু না হোক, বাবা বিশ্বনাথের কাশী তো কোথাও পালিয়ে যায়নি?
থাকুক চন্দ্র যেমনভাবে থাকতে ইচ্ছে। ছেলের পায়ে ধরে ডেকে আনুক, আনুক তার সেই মায়াবিনী ছলনাময়ীকে, সংসারকে আস্তাকুঁড় করে বাস করুক সুখে-স্বচ্ছন্দে।
.
চন্দ্র! এসে বসলেন নীহারকণা চন্দ্রনাথের ঘরে।
কী দিদি?
বলি, তুই যে একেবারে মৌনব্রত নিলি, এর মানে?
তাছাড়া একটু হাসলেনই চন্দ্রনাথ, আর কী করব?
এতবড় একটা কাণ্ড চোখের ওপর দেখে এলি, সে বিষয়ে কী বুঝলি না বুঝলি একটা আলোচনা করবি তো?
চন্দ্রনাথ মৃদুস্বরে বলেন, সব কথাই কি আলোচনার উপযুক্ত?
বেশ, তোর মনের কথাটা তো খুলে বলতে পারিস? মনের কথা চেপে গুম হয়ে বসে থাকাই জগতের যত অনর্থের মূল তা জানিস?–হতে পারে তোরা বাপবেটা খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু জগতের সবাই তো তোদের মত এতবড় বুদ্ধিওলা নয়; তারা যদি তোদের ইচ্ছে অনিচ্ছে রুচি পছন্দর দিশে না পায়? জগতের এই সব কমবুদ্ধি লোকেদের জন্যে কিছু সহজ ব্যবস্থা না রাখলে চলবে কেন?
তুমি কি বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না দিদি! বলতে আমি কিছু চাইছি না চন্দর, তুমি বল তাই শুনতে চাইছি। আজকের ঘটনাটা দেখে কী মনে হল তোমার বল শুনি।
মনে? যদি মনে কিছু হয়ে থাকে তো এই হল আমরা স্বচক্ষে দেখার যুক্তি দিয়ে কতই না বড়াই করি! আমাদের এই চোখে দেখার সীমানার বাইরে আর একটা যে অদেখা জগৎ আছে সে কথাটা ভুলেই থাকি। স্বচক্ষে দেখাটাও একটা বিরাট ফাঁকি হতে পারে
দ্যাখ চন্দর, গোলমেলে কথা রাখ। আমি হচ্ছি খাঁটি কথার মানুষ। স্পষ্ট করে বল, ইন্দ্রর সঙ্গে ওই মেয়েটার কোন দুষ্য সম্পর্ক আছে কি নেই? কী তোর বিশ্বাস?
ইন্দ্রর সঙ্গে কারুর কোন দুষ্য সম্পর্ক থাকতে পারে, একথা আমার পক্ষে বিশ্বাস করা অসম্ভব দিদি।
তা হলে বল, আর কি?…লুকিয়ে সে ওকে বিয়ে করেছে?
বিয়ে করলে সে লুকিয়ে করত না।
তবে কথাটা কী দাঁড়াচ্ছে চন্দর? সেদিন থেকে আজ অবধি এই যে ঘটনাটা ঘটল সমস্তই বাজিকরের ভোজবাজি?
এমন অদ্ভুত কথা আমি বলি না দিদি, শুধু এটা অনুভব করছি কোথাও কোনখানে একটা কিছু ষড়যন্ত্র চলছে।
তাই যদি তো ইন্দুরই খুলে বললে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়? সব সরল হয়ে যায় তাহলে!
বলতে ওর ধিক্কার আসে দিদি। আমরা যে তাকে অবিশ্বাস করেছি, এইটাই তো আমাদের পক্ষে ভয়ঙ্কর একটা লজ্জার কথা। সে আবার কোন্ লজ্জায়–
থাম তুই চন্দর, সংসার চলে সাধারণ মানুষ দিয়ে। অত কাব্যি কথা সবাই বোঝে না। আমি বুড়ো-হাবড়া মুখ মেয়েমানুষ, আমি যদি একটা গোলকধাঁধায় পড়ে দিশেহারা হই-বুঝিয়ে দিতে হবে না আমায়?
চন্দ্রনাথ বলেন, গোলকধাঁধায়ও পড়তে হত না, আর দিশেহারাও হতে হত না দিদি, শুধু যদি ইন্দ্রর ওপর বিশ্বাস রাখতে পারতে।
বেশ নীহারকণা থমথমে মুখে বলেন, আমি পারিনি, তুমি তো পেরেছ? ফয়সালা একটা কর!
জোর করে ঠেলেঠুলে কিছু করা যায় না দিদি, যখন সময় আসে সমস্ত জটিলতার জাল আপনিই খুলে পড়ে, সমস্ত ভুল ধারণা ভুল বলে ধরা পড়ে। ঠিক সময়টি আসার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়।
অপেক্ষা করতে হয়? ও! নীহারকণা তীব্রস্বরে বলেন, মানুষ বোধ করি অমর বর নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে, তাই সব কিছুর জন্যে অপেক্ষা করবার সাধনা করবে। আমি তোমাকে এই বলে রাখছি চন্দর, ইন্দুর কাছে আমি যাব। সেই মেয়েকে আমি আর একবার দেখব, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করব–বল, তোদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কী? দেখি কী উত্তর দেয়? –বেগতিক দেখে মূৰ্ছা গিয়ে বসতে পারলেই কি সব সময় পার পাওয়া যায়?
অপেক্ষা! অপেক্ষা! বলতে পারলিও তো! অপেক্ষা করবারও একটা মাত্রা আছে! ছেলেটা আজ এই এতদিন বাড়িছাড়া, কোন মায়াবিনী যে তাকে
সহসা বিদ্যুৎগতিতে বাচ্চা চাকরটা এসে বিদ্যুৎবেগেই খবর দেয়, পিসিমা, দাদাবাবু!
দাদাবাবু! কী দাদাবাবু?
দাদাবাবু এয়েছে।
এ্যাঁ, কী বললি? নীহারকণা পরনের থানের আঁচল লুটোতে লুটোতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে পাগলের মত, বলেন, কোথায়? কোথায় সে মুখপোড়া হতচ্ছাড়া ছেলে! বাইরে এসে চাকর দিয়ে খবর পাঠিয়েছে?…চন্দর, তুই বসে রইলি?..ভাইকে ধিক্কার দিয়ে ছুটে নিচে নামতে গিয়ে বাধা পান নীহারকণা।
ইন্দ্রনাথ ওপরে উঠছে।
.
আসছিলেন পাগলের মত, কিন্তু যে মুহূর্তে দেখা, চট করে নিজেকে সামলে নিলেন নীহারকণা, গম্ভীর হয়ে গেলেন, বললেন ওঃ ইন্দ্রনাথবাবু! হঠাৎ এ বাড়িতে যে?
ইন্দ্রনাথ বোধ করি বর্মাবৃত চিত্তেই এসেছে, তাই প্রসন্নহাস্যে বলে, এলাম, কথা আছে।
কথা? নীহারকণা ভুরু কুঁচকে বলেন, আমার সঙ্গে কিসের কথা?
আছে আছে। চল না। পিসিকে প্রায় বেষ্টন করে ঠেলতে ঠেলতে ওপরে ওঠে ইন্দ্রনাথ।
প্রাণটা জুড়িয়ে যায় নীহারকণার। তবু স্বভাব যায় না মলে, তাই অমায়িক মুখে বলেন, তা সে মেয়েটির খবর কী? মূর্ছা ভেঙেছে?
ইন্দ্রনাথ বিচলিত হবে না। তাই সহজ সপ্রতিভ কণ্ঠে বলে, আপাতত ভেঙেছে।–এখন চল সব শুনবে। শুনে তুমিই হয়তো আবার মূৰ্ছা যাবে।
আমাদের অত মোমে-গড়া শরীর নয় খোকা যে মূর্ছা যাব! তা কথাটা কী?
বাঃ, মস্ত একটা দামী খবর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনে নেবে? তা হবে না। রীতিমত আসনে বসে হাতে সুপুরি নিয়ে শুনতে হবে।
ঢং রাখ খোকা! বল আমায়–তোর এ ঘূর্তির মানে বুঝছি না। দেখি কী বার্তা এনেছিস!
হ্যাঁ শুনলেন, স্থির হয়েই শুনলেন সব।
.
ব্যঙ্গ করে ইন্দ্রনাথকে বলেছিলেন নীহারকণা, শুনি, কী বার্তা? কিন্তু সত্যিই কি ভাবতে পেরেছিলেন সে বার্তা এত ভয়ঙ্কর হবে? ভাবা সম্ভব?
আশ্চর্য! আশ্চর্য!…বলতে একটু বাধল না?.মায়াবিনী জাদুকরী এমন জাদুই করল।
চন্দ্রবাবুর যে বড় লম্বাচওড়া কথা হচ্ছিল, স্বচক্ষে দেখাটাও কিছু নয়, বরং নিজের চোখকে অবিশ্বাস কোরো তবু বিশ্বাসভাজনকে অবিশ্বাস কোরো না। নাও এখন শোনো এসে?
উঃ, কী ভয়ঙ্কর।
এসে আর শুনতে হয় না চন্দ্রনাথকে, নীহারকণা নিজেই গিয়ে শুনিয়ে আসেন। সবিস্তারেই শোনান, এখন বুঝতে পারছ ব্যাপার? হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়ে বাছা এখন এক আষাঢ়ে গল্প কেঁদে সুয়ো হতে এলেন! নাও তোমরা এখন সেই ঘর-ঘরকন্না করা বৌকে নতুন করে সিঁথিমৌর পরিয়ে দুধে-আলতার পাথরে এনে দাঁড় করাও! তোমার খাঁটিছেলে আবদার নিয়েছেন –আস্তাকুঁড়ের জঞ্জাল এনে লক্ষ্মীর চৌকিতে তুলবেন, তুমি সে গোড়ে গোড় দাও দিয়ে–উঃ, আমি শুধু ভাবছি চন্দর কী ডাকিনীদের খপ্পরে গিয়েই পড়েছিল বাছা, তাই অমন সরল সদানন্দ ছেলে এমন হয়ে যায়! এত প্যাচোয়া বুদ্ধি ওকে দিচ্ছে কে? ওই শয়তানীরা ছাড়া?
বলা বাহুল্য চন্দ্রনাথ নীরব।
বলি চুপ করে রইলি যে?
বলবার আর কিছু নেই দিদি।
তোর কী মনে হচ্ছে? ইন্দুর সব কথা সত্যি? আমায় তো তখন খুব হেয় দিলি-বলি, এখন সেই সর্বনাশীদের মন্ত্রণা নিয়ে এসেছে কিনা ইন্দু? নইলে যে ছেলে কাল অত তেজ দেখিয়ে মুখের সামনে দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল, আজ সে একগাল হাসি নিয়ে বিয়ে দাও আমার বলে আবদার করতে আসে?
সহসা উঠে দাঁড়ান চন্দ্রনাথ। ক্লান্তস্বরে বলেন, তোমার কথাই বোধ হয় ঠিক দিদি।
যাক তবু মানলি! কিন্তু ও যা চাইছে তার কী?
চন্দ্রনাথ আর একবার ক্লান্ত দৃষ্টি মেলে বলেন, কী চাইছে?
এই দেখ! সপ্তকাণ্ড রামায়ণ শুনে বলে কি না সীতা কার পিতা! ও যে বলছে এইখান থেকে আমরা ওকে ওই ছুঁড়ির সঙ্গে নেয্যমত বিয়ে দিই!
চন্দ্রনাথ ধীরস্বরে বলেন, যা হয় না তা হওয়ানো যায় না দিদি।
যা হয় না! নীহারকণা একবার বিচলিত দৃষ্টিতে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকান, বোধ করি বুঝতে চেষ্টা করেন চন্দ্রনাথের এ কথাটা ঠিক কোন পর্যায়ের! নীহারকণাকে ব্যঙ্গ?…নাকি ছেলের এই সব দুষ্টু প্যাচালো বুদ্ধিতে এসে গেছে বিরূপতা?
তাই মনে হচ্ছে..বিয়ের কথা উড়িয়ে দিতে চাইছে।
সহসা নীহারকণা ভয়ানক একটা উল্টোপাল্টা কথা কয়ে বসলেন–যা হয় না তা হবে না বলে দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে তো চলবে না চন্দর। ছেলের বিয়ে দিতেই হবে। আর ছেলে যদি রাস্তার ভিখিরীর মেয়েটাকেও বিয়ে করতে চায় তো তাই দিতে হবে। যেমন যুগ পড়েছে। –আমি এই চললাম পুরুতকে খবর দিতে।
বলে মেদিনী কাঁপিয়ে চলে যান নীহারকণা। বোধ করি তদ্দণ্ডেই পুরুতকে খবর দিতে।
.
এই স্বভাব নীহারকণার। যে কোন ব্যাপারে অপরের বিরুদ্ধতা তিনি করবেনই। তাতে প্রতিপদে পরস্পরবিরোধী কথা বলতে হয় বলবেন, দ্বিধামাত্র না রেখে সজোরেই বলবেন। যতক্ষণ চন্দ্রনাথ ছেলের সমর্থন করছিলেন ততক্ষণ নীহারকণা সেই একান্ত স্নেহপাত্রের উপরও খড়গহস্তের ভূমিকা নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন। যেই দেখা গেল চন্দ্রনাথ ছেলের ব্যাপারে হতাশ হচ্ছেন, সেই মুহূর্তে নীহারকণা তার দিকেই হাল ধরলেন।
হয়তো একা নীহারকণাই নয়, সংসারে এমন লোক আরো অনেক আছে। অপরের মত খণ্ডন করবার দুর্নিবার বাসনায় অহরহ তারা নিজের মত খণ্ডন করে। অপরের সমর্থিত নীতিকে নিস্যাৎ করবার জন্য সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য বলতে লেশমাত্র দ্বিধা করে না।
.
নীহারকণা এমনিই।
তবু নীহারকণার স্নেহটা মিথ্যা নয়। ইন্দ্রনাথের অভাবে যে শূন্য মন অবিরাম হাহাকার করছিল, সে মন ইন্দ্রনাথের জন্য বড় একটা কিছু করতে চাইছিল। হয়তো অবচেতনে, হয়তো অবচেতনেরও অগোচরে। চন্দ্রনাথের সঙ্গে বিরুদ্ধতার পথ ধরে সেই বাসনাটা মেটবার পথ হল।
তাছাড়া অনেকদিনের সঞ্চিত সেই নিরুদ্ধ বাসনা। যে বাসনাকে ইন্দ্রনাথ তার ছাই-পাঁশ দেশের কাজের ছুতোয় বিকশিত হতে দেয়নি।…এতটা কর্মক্ষমতা, এতটা এনার্জি সমস্তই আজীবন বরবাদ হয়ে চলেছে। এত স্তিমিত জীবন ভাল লাগে মানুষের?
ইন্দুর বিয়ে হলে নীহারকণা অন্তত এই স্তিমিত জীবনের হাত থেকে রেহাই পান।
.
অবিশ্যি বিয়ে করছে এমন ঘরে যে, লোকের কাছে বলবার নয়, নিজেরও ঘেন্না আসছে, কারণ যা কিছুই বলুক ইন্দ্রনাথ, সে মেয়েকে তিনি জীবনেও বিশ্বাস করতে পারবেন না।
সেদিনের সেই ভাবে-ঢলঢল চোখছলছল মেয়েটি তো? সে তো পাকা অভিনেত্রী। ইন্দু এখন তার আষাঢ়ে গল্প শুনে মোহিত হতে পারে নীহারকণা হবেন না।
তা ছাড়া সেই ছেলেটা? তাকে কী করে মন থেকে মুছে ফেলবেন নীহারকণা? ছেলেটা যে ওই মেয়েটার তাতে কোনও সন্দেহ নেই নীহারকণার, তবে হ্যাঁ, ইন্দ্রর সন্তান নাও হতে পারে। জোচ্চোর মেয়েমানুষ দুটো উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে কিছু হাতাতে এসেছিল।
হায় ভগবান! দিলে দিলে, এমন কুৎসিত এমন বিকৃত জিনিসটা দিলে কেন নীহারকণাকে? এর চাইতে একটা ভদ্রঘরের কালো কুৎসিত মেয়েও যদি
তবু এ বিয়েতে কোমর বাঁধবেন নীহারকণা। মনকে তিনি প্রস্তুত করে নিচ্ছেন।
যেমন যুগ পড়েছে, এই তাঁর সান্ত্বনা। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো জাত অজাত কিছু মানছে না, সত্যিকার থিয়েটার বায়স্কোপের মেয়েছেলেদের বিয়ে করে পরমার্থ লাভ করছে! একটা বিয়ে ভেঙে তক্ষুনি আর একটা বিয়ে করছে, আরও কী করছে আর কী না করছে!
কন্দর্প যে অন্ধ, এ সত্যটা এ যুগে বড় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অতএব মেনেই নিচ্ছেন তিনি।
কী আর করবেন! বৌটাকে একবার গঙ্গায় চুবিয়ে আনবেন, জগন্নাথের মহাপ্রসাদ খাইয়ে দেবেন, আর নিত্য শিবপূজো ধরাবেন!
দস্যু রত্নাকরের পাপ কেটেছিল, বিল্বমঙ্গলের পাপ কেটেছিল, আরও আরও কত মেয়ে পুরুষেরই এমন মহাপাপ কেটে যাওয়ার উদাহরণ বেদে পুরাণে আছে, আর একটা বিশবাইশ বছরের মেয়ের পাপ কাটানো যাবে না?
তবে হ্যাঁ, বাড়ির চৌকাঠের ওধারে পা-টি ফেলতে দেবেন না তাকে। বাঁচালতা বেহায়াপনা সব ঢিট করবেন। সেই মা না মাসি মাগী–তাকে ত্রিসীমানায় আসতে দেবেন না।..বৌকে আরও কী কী করতে দেবেন আর দেবেন না, তার কল্পনায় বিভোর হতে থাকেন নীহারকণা।
এটাও কম পুলকজনক নয়। বেয়াড়া একটা কিছু ঢিট করতে পারার মত সুখ কটা-ই বা আছে জগতে?
.
তাছাড়া আপাততও রয়েছে কাজ।
বিয়ের ঘটা বাদে
আত্মীয়-স্বজনের কাছে মুখ রাখবার জন্যে গল্প বানানো। রেখে ঢেকে বানিয়ে গুছিয়ে বলতে হবে তো! হবে বলতে-মা বাপ মরা গরিবের মেয়ে, পয়সার অভাবে বিয়ে হচ্ছিল না, তাই ইন্দুর আমার দয়ার শরীর, কথা দিয়ে বসেছে..।
আমি কি ওই ডোমের চুপড়ি-ধোওয়া মেয়েকে ঘরে আনতে সহজে মত দিয়েছি? ওই নিয়ে ছেলের মান অভিমান, বাড়ি ছেড়ে কোথায় না কোথায় গিয়ে পড়ে থাকা! সেখানে বাছার হাড়ির হাল একেবারে! আর শক্ত হয়ে থাকতে পারলাম না, মত দিয়ে মরলাম–বলি থাকগে মরুক গে, গয়নাগাঁটি তত্ত্বতাবাস না হয় নাই হলো, ইন্দুর আমার অভাব কী?
আষাঢ়ে গল্পে কেউ কম যায় না। অনর্গল বানাতে থাকবেন নীহারকণা, কাহিনীকে জোরালো করবার জন্যে নতুন নতুন সংযোজনা করেন। ইন্দু যে বাড়ি ফিরেছে, নিজের ঘরে ও নিজের থালায় ভাত খাচ্ছে, এই কৃতার্থতায় সব কিছুই করতে প্রস্তুত নীহারকণা।
.
এদিকে এই নাটক চলছে, ওদিকে কুরুক্ষেত্র চলছে কেষ্টমোহিনীর সংসারে।
কমলা চলে গেছে।
ওদের তাঁত-স্কুলেরই এক ছাত্রীর বাড়িতে থাকতে গেছে। বয়সে অনেক বড় সে, তা হোক, বন্ধু হয়ে গেছে। বাড়িতে অশান্তি বলে কয়েকদিনের আশ্রয় চেয়েছে।
সেখানে এই কদিন ধরে শুধু ভাবছে কমলা। আকাশ-পাতাল ভাবছে।
সেই ভাবনা-সমুদ্রের জলে কি তৃষ্ণা মেটে?
.
ওদিকে কেষ্টমোহিনী বুক চাপড়াচ্ছে। দুধকলা দিয়ে কালসাপ পোর নজির তুলে অনবরত শাপশাপান্ত করছে কমলাকে!
ছি ছি, এতদিনের ঋণের এই শোধ? বিয়ে করে ড্যাং ড্যাং করে বরের ঘরে গিয়ে উঠবি?
পড়শীরা সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ওলো কেষ্ট, অত ফুঁসে মরছিস কেন? ভালই তো হলো, বুড়ো বয়সে আর উঞ্ছবৃত্তি করতে হবে না, বড়মানুষ জামাই মাসোহারা দেবে!
কেষ্টমোহিনী সতেজে বলে, ঝাটা মারি অমন মাসোহারায়। কেষ্ট বোষ্টমী ভিক্ষের ভাত খায় না।
.
কেষ্টমোহিনীদের অনেকেরই হয়তো এই জীবনদর্শন। হাত তুলে কেউ কিছু দিলে সে প্রাপ্তি তাদের কাছে জোলো বিস্বাদ, ঠকিয়ে আদায় করে আনার মধ্যে অনেক রোমাঞ্চ। আর জীবনের শুরু থেকে উপার্জনের যে পথ দেখেছে, সেই তাদের কাছে সিধে সহজ স্বাভাবিক।
তাই বিয়েতে এদের বিরক্তি! বিয়ে হওয়া মানেই তো ফুরিয়ে যাওয়া!
.
ফটোর জন্যে ডার্করুম নয়। এমনি সন্ধ্যার পর আলো নিভিয়ে চুপচাপ নিজের খোপটুকুতে শুয়েছিল ননী।
দূর সম্পর্কে এক দিদির বাসায় খরচ দিয়ে থাকে সে। একক এই ঘরটুকু সেই দিদির বদান্যতা। আগে এ ঘরে শুধুই কাঠ খুঁটে আর সংসারের সব আবর্জনা থাকত, ননী আসার পর থেকে আবর্জনাগুলোকে কোণঠাসা করে ননীও থাকে।
তবু এটুকুকেই স্বর্গ বলে মানে ননী। তবু তো একেবারে নিজস্ব। দরজাটায় খিল লাগিয়ে শুয়ে পড়লে তো সম্পূর্ণ একা হবার অপূর্ব সুখটুকু আছে। রাতে কারুর কাঠ খুঁটে দরকার হবে না।
দিদি বলেছিল গোড়ায়, তুই এখানে এই দালানের একপাশে শুবি।
দালান মানে যেখানে দিদির সমগ্র সংসার। তাছাড়া ওই দালানের একপাশে দিদির বড় ছেলে দুটো শোয় দুখানা চৌকি পেতে। দিদি জামাইবাবু আর দিদির আরও গোটাপাঁচেক ছেলেমেয়ে রাত্রে না হক দশবার ওঠে, আর ওই দালান দিয়েই আনাগোনা করে।
বাবাঃ! মানুষের থেকে অনেক ভাল কাঠ খুঁটে!
এই ঘর, ফটোগ্রাফের দোকান, আর কমলাদের বাসা–এই তিন জায়গায় টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল একরকম করে,যদিও কিসে আরও দুপয়সা রোজগার করা যাবে, কী করে কমলাকে উদ্ধার করা যাবে, এই চিন্তায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে থাকত, তবুও তার মধ্যে বাঁধন ছিল। কিন্তু সহসা এ কী হল, অলক্ষিতে কে কোথায় বসে ননীর প্রাণের সব বাঁধনগুলো এমন করে কেটে দিলে!
সুতোকাটা ঘুড়ির মত লক্ষ্যহীন ননী আজকাল বেশির ভাগ সময় এই ঘরেই পড়ে থাকে। অসময়ে খায়, অসময়ে ঘুমোয়, অসময়ে কাজে যায়।..ময়লা জামাকাপড় পরতে ভালবাসত না, কদিন তাই-ই পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেন কিছুর জন্যে আর কিছু দায় নেই ননীর।
আচ্ছা, তবে আর ননীর এখানে পড়ে থাকার দরকার কী? কী দরকার স্টুডিওর মালিকের আর দূর সম্পর্কের দিদির খোশামোদে করবার? সব ছেড়েছুঁড়ে বেরিয়ে গেলেই তো আপদ চুকে যায়!
ধর, কাল ভোরেই যদি কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়ে ননী?…কী হবে? কিছুই না। কারুরই কিছু এসে যাবে না।
আর ননীর?… তারই বা এসে যাবে কী? জীবনে যদি আর কোনও উদ্দেশ্য না রইল, যন্ত্রণা কোথায়? একটা পেট–চালিয়ে নেওয়া এমন কিছু শক্ত নয়। আর যদিই বা না চলে, ননী মারা পড়লেই বা জগতে কার কী ক্ষতি?
ননীর মত লোকেদের জন্মানই ভুল। অতএব যত তাড়াতাড়ি সে ভুলের পরিসমাপ্তি হয়, ভালই। পৃথিবীর কিছু অন্ন বাঁচবে
.
ঘরের দরজায় হঠাৎ টোকা পড়ল।
চমকে উঠে বসল ননী। দরজায় টোকা দেয় কে?
টোকা দিয়ে মৃদু পদ্ধতিতে ডাকবার লোক তার কে আছে? খাবার টাইম হলে রান্নাঘর থেকে দিদির কাংস্যকণ্ঠ ধ্বনিত হয়,–এই ননী আসবি, না সমস্ত রাত হাঁড়ি আগলে বসে থাকব? ফি রোজ বাবুকে ডেকে ডেকে তবে খানা-ঘরে আনতে হবে, কোনদিন নিজে থেকে ঠাইটা করে জলের গ্লাসটা নিয়ে বসতে নেই? কটা দাসী বাঁদী আছে তোর?
কথাগুলো শুনতে যত কটু, তত গুরু নয়। দিদির কথাই ওই রকম। গুরুত্ব কেউ দেয় না ওর কথায়।
ভগ্নীপতি যেদিন তখনও আহার-নিরত থাকেন, মৃদু হাস্যে বলেন, তা সেটা তো তোমারই দেখা দরকার। ওর নিজস্ব একটা বাঁদী জোগাড় করে দেওয়া তো তোমারই
এ ধরনের কথা বললে অবশ্য কথা আর শেষ করতে হয় না তাকে। দিদি ফোঁস করে ওঠেন, কী! কী বললে?..বাঁদী? পরিবারকে তোমরা তাই ভাবো বটে!
লেগে যায় ঝমাঝম।..ছেলেমেয়েগুলো হি হি করে হাসে।
কাজেই এ বাড়িতে এমন সূক্ষ্মবৃত্তির চাষ কোথাও নেই যে মৃদু টোকা দিয়ে দরজা খোলাতে চাইবে। তাছাড়া দরজা তো বন্ধ নেই, শুধু ভেজানো।
.
উঠে দরজা খোলবার আগেই ভেজানো দরজা খুলে যে মানুষটা ঢুকল, তাকে দেখে পাথর হয়ে গেল ননী।
দেখতে যে পেল, সে শুধু দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে কিঞ্চিৎ আলো ঢোকায়।…দেখতে পেল, তবু না করল কোন প্রশ্ন, না করল অভ্যর্থনা, শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।
কী ননীদা, বাক্যি হরে গেল নাকি? কমলা!
হ্যাঁ। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? চিমটি কেটে দেখবে?
চিমটির দরকার নেই, তবে বিশ্বাস করতে একটু দেরি হচ্ছে। তুমি এখানে! এ সময়ে!
হ্যাঁ আমি, এ সময়ে। দরকার পড়লে কি আর সময় অসময়ের জ্ঞান থাকে ননীদা? সব বলছি, কিন্তু আগে আলো জ্বালো।
আলো? কী হবে? কে জানে কোথায় বাতি কোথায় দেশলাই!
কী আশ্চর্য। সে কী কথা? ঘরে একটা আলোর ব্যবস্থা নেই?
না। দরকারই বা কী? তুমি তো আমার ডার্করুমই দেখতে চেয়েছিলে!
কিন্তু আজ আর তা চাইছি না ননীদা, আজ আলোর দরকার, ভয়ানক দরকার।
ননী হাতড়ে হাতড়ে একটা দেশলাই খুঁজে জানলার নিচে পড়ে থাকা একটা আধ-ক্ষওয়া বাতি জোগাড় করে জ্বেলে বলে, তুমি এলে কী করে তাই বল?
এলাম।…চলে এলাম।
তুমি কি এ বাড়ি চিনতে?
নাই বা চিনলাম, ইচ্ছে থাকলে আর চেষ্টা থাকলে ঠিকানা একটা খুঁজে বার করা এমন কিছুই নয়।
কিন্তু দিদি?
দিদি!
হ্যাঁ, আমার দিদি। তোমাকে ঢুকতে দেখে বললেন না কিছু?
আমাকে,–না তো–আমি তো তাকে দেখিনি!
ভালই হয়েছে। কিন্তু আমি যে এ ঘরে আছি সেকথা—
একটা বাচ্ছা ছেলে বলল-ননীমামা ওই ঘরে পড়ে আছে।
পড়ে আছে শুনে আশ্চর্য হতে বলল–রাতদিন তো পড়েই থাকে।
খুব ভুল বলেনি।
কেন–আগে তো খুব ব্যস্ত দেখতাম!
সে তো আগে। জীবনের সব ব্যস্ততা যখন নিয়েই নিল ভগবান, আর
কী মুশকিল, ভগবান আবার তোমার কী নিতে এল! যাক একটু বসতে বলবে, দাঁড়িয়েই থাকব?
ননী একটু ক্ষুব্ধ হাসি হাসে–বসতে বলতে সাহস হচ্ছে কই? তোমার উপযুক্ত আসন এখানে কোথায়?
বাঃ চমঙ্কার কথা বলতে শিখেছ তো! তুমিও গল্পের বই পড়া ধরেছ নাকি?
ধরতে হয় না, নিজেরাই তো এক একটা গল্প। যাক বসবে তো বোসো। এছাড়া তো আর জায়গা নেই।
কমলা বসে পড়ে। বসবার পরেই কিন্তু চুপ হয়ে যায়। চেষ্টা-যত্ন করে অনেকখানি সপ্রতিভতা নিয়ে এসেছিল, প্রথম ধাক্কায় খরচ হয়ে গেছে সেটুকু। এখন বোবা।
ননী একটু অপেক্ষা করে বলে, দাঁড়াও তোমার জন্যে একটু চায়ের চেষ্টা দেখিগে।
তুমির দূরত্বটা অজ্ঞাতে কখন থেকে যে এসে পড়েছে।
না না, থাক ননীদা, কোন দরকার নেই।
ননী একটু থেমে বলে, চা খাবার দরকার নেই সত্যি, কিন্তু দিদিকে একটু জানিয়ে আসা ভাল। নয়তো হঠাৎ দেখে কী না কী ভেবে বসবেন!
এবার একটা কথার বিষয় পেয়ে বলে কমলা, কী বলবে?
বলব? গোঁজামিল করে বুঝিয়ে দেব যা হয়–বলব আমার মনিববাড়ির একটি মেয়ে এসেছে ফটোর তাগাদা দিতে!
আমাকে তোমার মনিববাড়ির মেয়ে বলে বিশ্বাস করবে?
বিশ্বাস! ননী সহসা আবেগরুদ্ধ স্বরে বলে, আমার মনিব তো সামান্য। তার চাইতে তো অনেক উঁচুডালের ফুল হয়ে যাচ্ছ! তাতেই কি বেমানান দেখাচ্ছে?…রাজার রানী বললেও তোমায় কেউ অবিশ্বাস করতে পারবে না কমলা! বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ননী। মোমবাতির আলোয় ওর মুখ দেখা গেল না, শুধু কণ্ঠস্বরটা বেচারার অবোধ হৃদয়ের বেদনাকে যেন ঘরের সমস্ত বাতাসে ছড়িয়ে দিল।
একটু পরেই একটা মোটা কাপে এক পেয়ালা চা নিয়ে ঢোকে ননী–তোমার ভাগ্য ভাল কমলা, চা একেবারে মজুত ছিল! দিদির তো অনেক প্রস্থ হয়!
দাও। হাত বাড়িয়ে কাপটা নিয়ে আস্তে আস্তে চা-টা খেতে থাকে কমলা। যেন এই জন্যেই এসেছে।
ননী একটু পরে বলে–কিন্তু আজ তুমি এভাবে এলে কেন তাই ভাবছি। বিয়ের নেমন্তন্ন করতে, না ধিক্কার দিতে?…তাই দাও। যত পারো দাও। শুধু কথা দিয়ে যদি না কুলোয় রাস্তার ধুলো এনে গায়ে দাও। বোধহয় তাতেও হবে না। যে জানোয়ারের মত কাজ আমি করেছি সেদিন, তার শাস্তি হচ্ছে চাবুক।
জানোয়ারের মত! কমলা হেসে উঠে বলে, না ননীদা, তুমি ঠিক মানুষের মতই কাজ করেছ। এমন ক্ষেত্রে মানুষ মাত্রেই এ কাজ করে। শুধু মানুষ কেন, দেবতারাও ক্ষেপে ওঠে এ জায়গায়।
কিন্তু কমলা, আমি নিজেকে নিজে কখনো ক্ষমা করতে পারব না। যখনি ভাবব হিংসেয় অন্ধ হয়ে কী ভীষণ ক্ষতিটাই তোমার করতে চলেছিলাম!..ভগবান তোমার সহায় হল, তাই হল না– নইলে
আমি বলছি তোমার কিছু দোষ হয়নি ননীদা, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর কী যে সেদিন হল কিছুই জানতে পারলাম না। মোটা ভদ্রমহিলা কী বললেন তোমায়?
আমায়?–আমি কি সেখানে তিষ্ঠোতে পেরেছি কমলা, কাপুরুষের মতন পালিয়ে এসেছি।
পালিয়ে এসেছিলে?
হ্যাঁ কমলা, পালিয়েই এসেছিলাম। তোমাকে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে
তুমি আমাকে পরের মতন তুমি তুমি করছ কেন ননীদা? শুনতে ভাল লাগছে না।
ভাল লাগছে না?
কিন্তু যে মস্ত এক বড়ঘরের বৌ হতে যাচ্ছে, তাকে একটা রাস্তার ভ্যাগাবন্ড তুই বললেই বা ভাল শোনাবে কেন কমলা?
শুনব তো আমি!
কমলা!
উঁহু, কমলি?
কমলি, কমলি–কেন আর একমুঠো ভিক্ষে দিয়ে মায়া দেখতে এসেছিস? এর থেকে তুই আমায় লাঞ্ছনা করলেই আমার ছিল ভাল। বুঝতাম তবুও যে অনেক উঁচুতে উঠে যাসনি তুই…। সেদিনের জন্যে আমি তোর কাছে ক্ষমা চাইতেও চাই না কমলি, তুই খুব লাঞ্ছনা কর আমায়।
কেন তা করব? কমলা বলে, যা করেছিলে ঠিকই করেছিলে। বার-বার তো বলছি, তুমি ভেবেছিলে বড়লোকের হাত থেকে উদ্ধার করবে। আমরা হয়তো ধিক্কার দিতাম, যদি তুমি অসহায়ের মত কোন চেষ্টা না করে আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে।
কিন্তু তা যদি দিসনি, কী বলতে তাহলে এসেছিস? ননী বলে।
কী বলতে?…কমলা অদ্ভুত একটা হাসির সুরে বলে, বলছি। ননীদা,–আমায় নিয়ে পালাতে পারো?
তোকে নিয়ে পালাতে! যন্ত্রের মত উচ্চারণ করে ননী।
হ্যাঁ ননীদা। অনেক অনেক দূরে! আমার বড় বিপদ!
কেন বল্ তো? ননী উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, বিপদ কিসের? তবে কি যা শুনেছি তা ভুল? ওরা কি তোকে পুলিসে দিতে চায়?
পুলিসে?–না ননীদা, তার চাইতেও অনেক বেশি। কমলা ননীর দিকে চোখ তুলে তাকায়।
তার চাইতেও বেশি!–আবার যন্ত্রের মত উচ্চারণ করে ননী।
হ্যাঁ তার চাইতেও বেশি, তার চাইতেও ভয়ের।
ব্যাপার কী?…হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে ননী,..কী, করতে চায় কী?…লোক লাগিয়ে খুন করতে চায়?
লোক লাগিয়ে নয় ননীদা, নিজেই। কমলা কেমন এক অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে বলে, তোমার আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। তোমার শোনার ভুল হয়নি। তোমাদের লেকচারবাবু সত্যি সত্যিই আমাকে বিয়ে করতে চায়। তুমি আমাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার কর ননীদা, আমাকে নিয়ে পালাও।
ননী ধীরে ধীরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, তুই কি বাড়ি বয়ে আমাকে ঠাট্টা করতে এলি কমলা?
ঠাট্টা নয় ননীদা, বিশ্বাস কর। যে যার যুগ্যি নয়, তাকে তা দিতে গেলে সেটা বিপদ ছাড়া আর কী? তোমায় যদি কেউ রাজা করে সিংহাসনে বসিয়ে দিতে চায়, সেটাকে তোমার কী মনে হবে-বিপদ না সম্পদ?
পালিয়ে তোকে নিয়ে গিয়ে আমি রাখব কোথায়? ননী হঠাৎ নিজস্ব ভঙ্গিতে খিঁচিয়ে উঠে বলে, এখানে তো তবু এই খেলাঘরের মত একটু ঘর আছে, আর কোথাও পালিয়ে গেলে এটুকুই বা জুটবে কী করে?
কমলা আস্তে একখানা হাত ননীর হাতের ওপর রাখে। মৃদু রহস্যময় একটা হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে,-নতুন খেলাঘর আমরা বাঁধব, ননীদা।
কমলা! ননী ওর ধরা-হাতটা একবার চেপে ধরেই হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে তীব্র স্বরে বলে ওঃ দয়া! দয়া করতে এসেছিস?
না, ধরা দিতে এসেছি। কমলা মিষ্টি একটু হাসে, নিজের মনের কাছে ধরা পড়ে গেছি আজ।
.
কাঠ ঘুঁটের ঘর থেকে ওরা বেরিয়ে এসেছে। এসে বসেছে পার্কের একটা বেঞ্চে।
অনেক কথা বলবার ছিল কমলার, সব কথা বলা যায় না সেই খুবরিতে বসে, কে কী ভাবছের-উৎকণ্ঠা নিয়ে। ভাগ্যিস এই পার্কগুলো আছে পৃথিবীতে, আছে পার্কে বেঞ্চ পাতার প্রথা, পুষ্পধনুর একটা আসন হয়েছে। পৃথিবীতে যদি পার্কের বেঞ্চ না থাকত, এত প্রেমই কি জন্মাতো?
তা প্রেমের সেই পীঠস্থানেই এসে বসেছে ওরাননী আর কমলা।
কমলা এতক্ষণ ধরে বলেছে তার এই কদিনের চিন্তা আর ঘটনা। বলেছে কেমন করে হঠাৎ তার সমস্ত ভয়ের বন্ধন খুলে গেল, কেমন করে কেষ্টমোহিনীর নাকের সামনে দিয়ে চলে এল একবস্ত্রে শুধু ননীর দেওয়া কয়েকটা বই হাতে করে। কেমন করে আশ্রয় পেল সহকর্মিণী প্রিয়তার কাছে।
বুঝলে ননীদা, হঠাৎ যেন চোখ থেকে কী একটা কুয়াশার পর্দা সরে গেল! কমলা বলে, মনে হল এত ভয় কেন করি আমি? কেন করব?…ভয় দেখিয়ে একজন আমাকে দিয়ে যত ইচ্ছে মন্দ কাজ করিয়ে নেবে কেন? পালিয়ে গেলে রুখছে কে?…পালাতে চাইলে মাসি কি আমাকে আটকাতে পারত?…কখনো না। আমার সে খেয়ালই আসেনি। পরদা-ঢাকা চোখে ঘোরে পড়েছিলাম যে। হঠাৎ দেখলাম কিসের বন্ধনে বন্দী আমি।…একমুঠো ভাত আর একটা আশ্রয়, এই তো! এতবড় পৃথিবীতে জুটবে না তা? সৎ থাকব এই চেষ্টার বিনিময়ে পাব না সেটুকু? সত্যিই কি পৃথিবী এত নিষ্ঠুর? তুমিও এই ভুলই করেছিলে ননীদা। এত পরামর্শ দিতে পেরেছিলে আমায়, এত খেটেছিলে আমার জন্যে, তবু সাহস করে বলতে পারনি, চল কমলি আমরা পালাই। কিছু না পারি দুজনে কুলি খেটেও দুটো পেটের ভাত জুটিয়ে নিতে পারব!
আসল কথা, চট করে কুলিগিরির পথে নামতে আমরা পারি না, তাই আমাদের প্রতি পদে বন্ধন, প্রতি কাজে ভয়! ভদ্র পোশাকের মধ্যে নিজেকে ঢেকে যতদূর নয় ততদূর অভদ্রতা করব, যত রকম দুর্নীতি আছে তাতে স্বীকার পাব, স্বীকার পাব না শুধু সেই ভদ্রলোকের পোশাকটা ছাড়বার! এতদিন ধরে এত ছোটমি করতে হত না ননীদা যদি এ বুদ্ধি আমার আগে আসত, যদি এ বুদ্ধি তোমার থাকত! যাক তবু এই ভাল যে এখনও এল। প্রিয়লতার বাসায় আশ্রয় পেলাম। কত সমাদরে রাখল, বলল না তুই নীচ নোংরা-বলল তুই প্রণম্য। ও আবার একটু কবি কবি তো! দেখতে অবিশ্যি একেবারে বিপরীত! হেসে ওঠে কমলা।
.
ননী মাথা হেঁট করে বসে সব শুনল।
কমলার আক্ষেপ, কমলার উপদেশ। শুনল ইন্দ্রনাথ কিভাবে প্রিয়লতার মাধ্যমে কমলাকে ভাবী স্ত্রীর উপযুক্ত যৌতুক পাঠাচ্ছে। অর্থাৎ কিছুতেই যেন কমলা আর এতটুকু কষ্ট না পায়। বিয়ের ঘাঁটিও হবে ওই প্রিয়লতার বাড়ি। যদিও সে দুঃখী, কিন্তু বাড়িটা ভাল। বাড়িটা তার বাবার আমলের। দাদারা পৃথক হয়ে রয়েছে পার্টিশন দেওয়াল না তুলেই; প্রিয়লতা মাকে নিয়ে একাংশে আছে। অল্প বয়সে বিধবা নিঃসন্তান প্রিয়লতার মা ছাড়া আর গতি কোথা?
কিন্তু বেশি বয়সে বিধবা, সন্তান সমাকুলা প্রিয়লতার মায়ের-ই বা মেয়ে ছাড়া গতি হল কই?
এ যুগের এ ধর্ম বলেছে প্রিয়লতা। ছেলেরা আর বিধবা মায়ের দায়িত্ব নিতে রাজী নয়, তাদের যুগলজীবনে মা বস্তুটা একেবারে অবান্তর। অতএব মেয়েরাই নিচ্ছে কাছে টেনে।
নিচ্ছে, বেশ করছে, উত্তম করছে, তারাও তো সন্তান। এখন রাখ তোর প্রিয়তার কথা। আমি শুধু ভাবছি কমলি ইন্দ্রনাথবাবুর কথা। তিনি যখন টের পাবেন তুই পালিয়েছিস–
তখন?
কমলা শান্ত বরফ-জমানো গলায় বলে, তখন বুঝবেন তিনি দীঘি ভেবে ডোবার জল খেয়ে আসছিলেন!
তিনি তাই ভাববেন, এটা তুই সহ্য করতে পারবি?
কী করব? একটা কিছু তো করতেই হবে?
কিন্তু কমলি, ঝোঁকের মাথায় এতবড় একটা সৌভাগ্য ঠেলে ফেলে দিয়ে শেষকালে আপসোস করে মরতে হবে!
না–ননীদা আপসোস আমি করব না। করব না বলেই এই কদিন ধরে চব্বিশ ঘণ্টা শুধু ভেবেছি আর ভেবেছি। প্রিয়লতা বলত–ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাবি তুই। তবু নিজেকে সবরকম অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখেছি, দেখে দেখে তবে না বুঝেছি ইন্দ্রের জন্যে দরকার শচীদেবীর। বিধাতাপুরুষ মানুষকে পাঠাবার আগেই রাজার জন্যে রানী আর ঘেসেড়ার জন্যে ঘেসেড়ানী ঠিক করে রাখেন। তোমার মতন বাউণ্ডুলের জন্যে এই বাউণ্ডুলীকে তৈরি করেছেন।
কমলি! তবু ভাল করে ভেবে দেখ।
দেখেছি–ননীদা দেখেছি।
আমি বলছি ইন্দ্রবাবু তোকে শুধু দয়াই করছে না, ভালবেসেও মরেছে।
কমলা ঘাড় ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, এই কথাটাই খাঁটি বলেছ ননীদা, ভালবেসে মরেছে! কিন্তু ওঁকে মরতে দিলে তো চলবে না, অতবড় অপরাধের বোঝা বয়ে বেড়াতে পারব না। ওঁকে বাঁচাব এই পণ নিয়ে নিজেকে ঠিক করে নিয়েছি।
কিন্তু এত ক্ষমতা তুই পেলি কোথায় কমলি? অভিভূত ভাবে বলে ননী।
কমলা বিষণ্ণ হাসি হেসে বলে, মুখ মানুষ, মনের কথা ভাল করে বোঝাতে জানি না, তবু বলি ননীদা, অনেকখানি পেলেই বুঝি অনেকখানি ছাড়া যায়। বাকী জীবনটা সুখে দুঃখে যেমন করেই কাটুক মনের মধ্যে এই আলোর আঁচড়টুকু জ্বলজ্বল করবে চিরকালের মতন, সেই আমার মস্ত ঐশ্বর্য।
আমার সারামাসের রোজগারের চাইতে বেশি টাকায় ইন্দ্রবাবু তোকে একটা পাউডার এনে দিত কমলি! নিঃশ্বাস ফেলে ননী।
কমলা মৃদু হাসির সঙ্গে বলে, আর সেই পাউডার মাখতে মাখতে আমার মনে পড়ত ননীদার সারা মাসের রোজগার এই কৌটোটার দামের চাইতে কম!
তখন আমাকে তোর মনেই থাকত না।
মেয়েমানুষকে তোমরা তাই ভাব ননীদা, কেমন? নিষ্ঠুর অকৃতজ্ঞ হৃদয়হীন বলে–তাই না? কিন্তু এই তোমায় বলছি ননীদা, মেয়েমানুষ যদি রানীর সিংহাসনেও বসে, সে ভুলতে পারে না তার ছেলেকে, ভুলতে পারে না তার প্রথম ভালবাসার লোককে।
.
ইন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরেছে। বাড়িতেই খায়দায়। কিন্তু সঙ্রে অফিসেই কাটছে তার বেশির ভাগ সময়। সম্প্রসারণ চলছে একটা অবৈতনিক স্কুলের।
ওদিকে নীহারকণা স্যাকরা, বেনারসীওলা, হালুইকর, ডেকরেটার, বাড়তি ঝি চাকর ইত্যাদির সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছেন, আর ইন্দ্রনাথকে হাতের কাছে পেলেই একহাত নিচ্ছেন।
হয়তো বাড়ির ওই সমারোহটা ভারি অস্বস্তিকর লাগছে ইন্দ্রনাথের, তাই ঠিক এই সময় এই ছুতোটা করেছে। স্কুলের বৃদ্ধি আর কটা দিন পরে করলেও চলত।
কিন্তু সঙ্ঘে বুঝি আর সে সম্ভ্রম নেই ইন্দ্রনাথের। সকলেই বাঁকাচোখে তাকাচ্ছে, আর কৌতুকছলে বাঁকা বাঁকা কথা বলছে।
আশপাশ থেকে এমন কথাও কানে আসছে,যারা ডুবে ডুবে জল খায় তারা ভাবে শিবের বাবাও টের পাচ্ছে না, কিন্তু টের সবাই পায়। এতদিন ধরে সবাই সব টের পেয়ে এসেছে।
অর্থাৎ চরিত্রগত দুর্বলতা ইন্দ্রনাথের বরাবরই ছিল, সকলেই তলে তলে জানতও। এবার নিশ্চয়ই নিতান্ত বেসামাল অবস্থায় পড়ে গেছেন চালাকঠাকুর, তাই এই বিয়ের ব্যবস্থা। তাই এত লোক-জানাজানি।
.
বাদল ওদের দলে নয়।
বাদল ইন্দ্রনাথকে বড্ড বেশি ভালবাসে, তাই যখন তখন কড়া কথা বলছে। আজ এইমাত্র অনেক ঝগড়া করে গেল, অনেক যাচ্ছেতাই করে গেল। বললে, সঙ্ঘের এবার বারোটা বাজল ইন্দ্রদা, সঙ্রে মেরুদণ্ডে ঘুণ ধরেছে!
ইন্দ্র হেসে বললে, এর উল্টোও তো হতে পারে? মেরুদণ্ডে অন্য শক্তির সঞ্চয় হয়ে আরও ভালও হতে পারে?
না, পারে না। বাদল ক্রুদ্ধ হয়ে বললে, যা হতে পারে না, তার কল্পনায় সুখ থাকতে পারে, ফসল ওঠে না। তুমি এখন একটা ভাবের ঝেকে আছ ইন্দ্রদা, তাই বুঝতে পারছ না তোমার এটা দয়া নয়, মোহ।…নির্জলা দয়া হলে মোটা খরচপত্র করে মেয়েটার একটা ভাল বিয়ে দিতে পারতে তুমি, তার জন্যে তাকে বিয়ে করবার দরকার হত না। পৃথিবীতে দুঃখী অসহায় মেয়ের সংখ্যা একটা নয়, কজনকে বিয়ে করবে তুমি?
ইন্দ্রনাথ ওর রাগ আর যুক্তি দেখে হেসে ফেলে বলেছিল, দয়া এ কথাই বা ভাবিস কেন? দয়া ছাড়া আরও তো কিছু হতে পারে!
না, পারে না। তীব্র প্রতিবাদ করে উঠেছিল বাদল, ভালবাসা হয় সমানে সমানে। অসমান ভালবাসা শেষ পর্যন্ত টেকে না, তাকে টিকিয়ে রাখবার চেষ্টা করতে করতে জীবন বিকিয়ে যায়। এই মোহ ভাঙলে সে কথা টের পাবে।
অসমানকে কি সমান করে নেওয়া যায় না বাদল?
না, যায় না। যাকে নিলে বা নিয়েছ বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করলে, শেষ পর্যন্ত সে-ই হয়ে ওঠে একটা বিরুদ্ধ শক্তি। এতটা পাওয়া বহন করতে যে শক্তি থাকা দরকার, সে শক্তি কজনের থাকে?
তুই এত কথা জানলি কোথা থেকে বাদল?
পৃথিবীতে চোখ কান খুলে চরে বেড়ালেই বোঝা যায় ইন্দ্রদা! তোমাদের কি জানো, রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছ, চিরটা দিন ভাবের ঘোরেই কাটিয়ে দিলে! জগৎকে দেখতে এসেছ পরোপকারীর উচ্চাসন থেকে, তাকে জানবার সুযোগই পাওনি, আমাদের তো তা নয়!
.
আরও কত কথা বলে গেল বাদল।
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ইন্দ্রনাথ। মনের গভীরে তলিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে বাদলের কথাই কি সত্যি?..শুধুই মোহ?
কিন্তু কিসের মোহ?…রূপের?…রূপ কি আর আগে কখনো দেখেনি ইন্দ্রনাথ? এর থেকে অনেক রূপসী মেয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নীহারকণা কি ভাইপোকে বিয়েয় প্ররোচিত করতে চাননি? তবে…?
ভালবাসা…? তাই কি? সেদিন যখন সেই ভয়ঙ্কর সত্যটা প্রকাশ হয়ে পড়ল, তখন কি সারা মন কেবলমাত্র ঘৃণায় বিষিয়ে ওঠেনি? ভালবাসার বাষ্পও কি ছিল আর তখন?
কমলা যদি শুধু লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকত, অমন করে নিজের জীবনের নিরুপায়তার কথা না বলত, ইন্দ্রনাথ কি তাকে চিরতরে ত্যাগ করে চলে আসত না? ভিতরের ভালবাসা কি তাকে ক্ষমা করতে শেখাত?
তবে?
ভালবাসার সৃষ্টি তখন কি হয়েছিল? হয়তো শুধু একটা আকর্ষণ। রূপের নয়, বুদ্ধির। সরলতার, সরল বুদ্ধির, লাবণ্যের। সেই লাবণ্যবতীর অশ্রুসজল জীবনকাহিনী এনে দিল ভালবাসার জোয়ার। সেটা কি দয়ারই নামান্তর নয়…?
দয়া করুণা–এর থেকে ভালবাসার উদ্ভব হয়, কিন্তু সেটা কি সারা জীবনের সম্বল হতে পারে?
.
এমন করে বুঝি নিজেকে বিশ্লেষণ করে দেখেনি ইন্দ্রনাথ এই কদিন। বাদল তাকে বড্ড ভাবিয়ে গেল।
বাদল বলে গেল, যার অতীতটা তোমার পরিবেশের সঙ্গে আকাশপাতাল তফাত, সে কী করে তোমার কাছে সহজ হতে পারবে, বলতে পার ইন্দ্রদা? তুমি বলছ স্ত্রীরত্ন দুষ্কুলাদপি –শাস্ত্রের বচন, মানলাম। কিন্তু সে কোনকালের কথা জানো? যে কালে স্ত্রীকে কেবলমাত্র স্ত্রীলোক বলে ভাবা হত, নট জীবনসঙ্গিনী, এ সেই কালের কথা! একালে ও শাস্ত্র অচল। একালে রূপ থাক না থাক, কুল-টা দরকার। দরকার বুদ্ধি আর রুচির সমতা!
কিন্তু কমলার কি বুদ্ধি নেই…? কমলার কি রুচি নেই…?
.
দাদা?
চমকে উঠে দরজার দিকে মুখ ফেরালো ইন্দ্রনাথ, দাদা বলে ডাকল কে?
কে এই ছেলেটা? কোথায় যেন ওকে দেখেছে না ইন্দ্রনাথ? চকিতের জন্যে একবার যেন…
দাদা, সাহসে ভর করে আপনার কাছে এলাম।
কিন্তু আমি তো আপনাকে–
আপনি নয়, আপনি নয়–তুমি। আমাকে আপনি চিনবেন না দাদা, চেনবার যোগ্য মানুষও আমি নই, একজন এসেছে সঙ্গে তাকে আপনি চেনেন।
কে? চমকে ওঠে ইন্দ্রনাথ।
এই যে! এসো কমলা, দাদার সামনে এসে দাঁড়ানো, এইটাই হোক তোমার সমস্ত অপরাধের শাস্তি।
দাদা…আপনার অক্ষম ছোট বোনটাকে ক্ষমা করুন। অস্ফুটে কথাটা উচ্চারণ করে মাথাটা ইন্দ্রনাথের পায়ে লুটিয়ে দিয়ে সে আর সেই লুটোনো মাথাটা কিছুতেই তুলতে পারে না।
ইন্দ্রনাথ, ধীরে ধীরে তার সেই নত মাথার উপর আলতো একটু হাতের স্পর্শ রেখে বলে, থাক থাক, ওঠো।
কমলা ওঠে, কিন্তু মুখ তোলে না।
কিছুক্ষণ নিঝুম নীরবতা।
.
ইন্দ্ৰনাথ শান্ত স্বরে বলে, তোমারই নাম বোধ হয় ননী, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ননী মাথা চুলকে বলে নামটা জানেন দেখছি।
তা জানতাম। খুশী হলাম তোমাকে দেখে …ওঠো কমলা..বুঝতে পারছি–এই ঠিক হল।
দাদা!
থাক কমলা, বেশি চেষ্টায় দরকার নেই…আস্তে আস্তে হয়ে যাবে। সত্যিই খুসী হচ্ছি তোমাদের দেখে।
বাচাল আর বকাটে ননী বলে ওঠে, দেখলে তো কমলা, বলেছিলে না বরং মরা সহজ তো ওঁকে মুখ দেখানো সহজ নয়!…পেলে না ক্ষমা? আমি বললাম দাদা-দেবতার কাছে আবার দাঁড়াতে পারা না পারার কথা কী? সব আমিত্ব ছেড়ে গিয়ে পায়ে পড়লেই হলো।
ইন্দ্রনাথ তাকিয়ে দেখল ওই নির্বোধ শ্যামলা মুখের উজ্জ্বল স্বর্ণাভা, দেখল ওই গোলগাল মাথা খাটো ছেলেটার পাশাপাশি কমলার বেতগাছের মত ঋজু একহারা দীর্ঘ সতেজ দেহখানি।
দেখতে দেখতে অদ্ভুত একটা কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল ইন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণধীমণ্ডিত মুখে।
.
কী লজ্জা! কী লজ্জা!
কী হাস্যকর পাগলামিতেই পেয়েছিল ইন্দ্রনাথকে! ওর সঙ্গে প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা!
মৃদু হাসি হেসে বলে, কিন্তু অপরাধটা কার, শাস্তি দেবার মালিক বা কে–কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
আপনি আর বুঝতে পারছেন না দাদা? ননী পরম সপ্রতিভভাবে বলে, তবে কিনা আপনি মহিমময়, তাই
বাঃ তুমি তো বেশ ভাল বাংলা জানো দেখছি। কিন্তু আমার ক্ষমার কি সত্যিই দরকার আছে তোমাদের? হয়তো প্রশ্নটা কমলাকেই, ননী উপলক্ষ।
তবু উত্তরটা ননী ই দেয়–আছে বৈকি দাদা, আপনার আশীর্বাদ, আপনার ক্ষমা, এই সম্বল করেই তো আমাদের জীবনযাত্রার শুরু হবে।
হুঁ। আর একবার কৌতুকের হাসি হেসে ওঠে ইন্দ্রনাথ, এত ভাল ভাল কথা জানো, আর উপার্জনের জন্য মানুষ জাল করা ছাড়া আর কিছু ভাল মাথায় আসেনি কেন?
এই কান মলছি দাদা, আর কখনো ওদিকেও যাব না।
কিন্তু একটা ব্যাপারে ভারী খটকা লাগছে আমার কমলা! কমলার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে বলে ইন্দ্রনাথ, জাল অরুণাকে ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তোমার এই ননীদার উৎসাহই প্রবল দেখেছিলাম না?…গাড়িতে তো সেদিন…
কমলাও এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর মৃদুস্বরে বলে, বুদ্ধিহীনেরা ওই রকম কাজই করে দাদা, মনের যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে
.
আরও একবার মনে হল ইন্দ্রনাথের কী লজ্জা, কী লজ্জা! এর সঙ্গে প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা!
আর কমলা…? জীবনসঙ্গী হিসেবে ওকেই উপযুক্ত বলে বেছে নিল তাহলে?
বাদলের কথাই তবে ঠিক। পরিবেশের প্রভাব কাটিয়ে ওঠা সহজ নয়।
যাক, ঈশ্বর রক্ষা করেছেন ইন্দ্রনাথকে। কোথা থেকে যেন কী এক মুক্তির হাওয়া এসে গায়ে লাগে। বারবার মনে বাজতে থাকে–এই ভাল হল এই ভাল হল!
কিন্তু কমলার ওই চোখদুটো?
ও কি শুধু সেই পরিবেশের প্রভাবের কথাই জানাচ্ছে? তবে ও চোখের দৃষ্টি অত গভীর, অত অতলস্পর্শী কেন?
.
ধীরে ধীরে স্নিগ্ধ একটা প্রসন্নতা ফুটে ওঠে ইন্দ্রনাথের মুখে।
কমলা বুদ্ধিমতী। কমলা হৃদয়বতী।
ইন্দ্রনাথের জীবনে কলঙ্করেখা হয়ে দাঁড়াতে চায় না ও। পারে না ওই সরল অবোধ ছেলেটার জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিতে।
বড় ভাইয়ের মতই প্রসন্ন আশীর্বাদের স্বর উচ্চারিত হল–যদি মানুষের আশীর্বাদের কোন মূল্য থাকে তো আশীর্বাদ করছি সুখী হও তোমরা, সুখী হও।