Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

শুভকর্মে বিলম্ব করতে নাই এবং কর্মহীন মানুষের মনের মধ্যে মরে হাতছানি অহরহ ইশারা জানিয়ে ডাকে। জগদ্বন্ধু মশায় অবিলম্বে ফাল্লুনের শেষেই, জীবনের হাতে ব্যাকরণ তুলে দিয়ে। পাঠ দিয়েছিলেন। আয়ুর্বেদ-পঞ্চম বেদ। চতুর্বেদের মতই স্বয়ং প্রজাপতির সৃষ্টি। দেবভাষায় কথিত, দেবভাষায় লিখিত। সুতরাং দেবভাষায় অধিকার লাভ করতে হবে প্রথম। ব্যাকরণ কিন্তু। জীবনের খুব ভাল লাগে নাই, নরঃ নরৌ নরাঃ থেকে আগাগোড়া ব্যাকরণ মুখস্থ কি সোজা কথা! তবে ভাল লাগল অন্য দিকটা। সকালবেলা জগদ্বন্ধু মশায় যখন রোগী দেখতে বসতেন তখন ছেলেকে কাছে বসাতেন। তাঁর আয়ুর্বেদ-ভবনের ওষুধ তৈরির কাজে জীবনকে কিছু কিছু কাজ দিতেন। গাছ-গাছড়া মূল-ফুল চেনাতেন। সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছিল তার নাড়ি-পরীক্ষা বিদ্যা। অদ্ভুত বিস্ময়কর এ বিদ্যা! কবিরাজের ঘরের ছেলে, কিশোর বয়সেই অল্পস্বল্প নাড়ি পরীক্ষা করতে জানতেন। জ্বর হয়েছে কিনা, জ্বর ছেড়েছে কিনা, এগুলি তিনি নাড়ি দেখে বলতে পারতেন। জগদ্বন্ধু মশায় যখন তাঁকে নাড়ি-পরীক্ষার প্রথম পাঠ দিলেন সেদিন ওই পাঠ শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলেন। আজও মনে পড়ছে।

দেবতাকে প্রণাম করে জগদ্বন্ধু মশায় বলেছিলেন—রোগ নির্ণয়ে সর্বাগ্রে সংগ্রহ করবে বিবরণ, তারপর রোগীর ঘরে ঢুকে গন্ধ অনুভব করবে, তারপর রোগীকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করবে। তারপর প্রশ্ন করবে রোগীকে তার কষ্টের কথা। তাই থেকে পাবে উপসর্গ। এরপর প্রত্যক্ষ পরীক্ষার প্রথম এবং প্রধান পরীক্ষা নাড়ি-পরীক্ষা। তারপর জিহ্বাগ্র, মূত্র ইত্যাদি। পাকস্থলী মলস্থলী অনুভব করবে। সর্বাগ্রে নাড়ি।

আদৌ সর্বেষু রোগেষু নাড়ি জিহ্বাগ্রে সম্ভবাম।
পরীক্ষাং কারয়েদ্বৈদ্যং পশ্চাদ্রোগং চিকিৎসয়েৎ।।

অতি সুকঠিন এ পরীক্ষা। বিশেষ করে নাড়ি-পরীক্ষা। রোগ হয়েছে—রোগদুষ্ট নাড়ি–সুস্থ নাড়ি এ অবশ্য বোঝা বিশেষ কঠিন নয়। তুমিও দেখ দেখেছি।

হাসলেন জগদ্বন্ধু মশায়। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু যে বোধে রোগ নির্ণয়, তার ভোগকাল নির্ণয়, মৃত্যুরোগাক্রান্ত হলে মৃত্যুকাল নির্ণয় পর্যন্ত করা যায়, সে অতিসূক্ষ্ম জ্ঞানসাপেক্ষ; জ্ঞান নয়, বোধ। তার জন্য সর্বাগ্রে চাই ধ্যানযেগ। আমরা যে চোখ বন্ধ করে নাড়ি দেখি তার কারণ নাড়ির গতি অনুভবে ধ্যানযোগে মগ্ন হয়ে গতি নির্ণয় করি। পারিপার্শ্বিকের কোনো কিছুতে আকৃষ্ট হয়ে আমার মন যেন যোগ থেকে ভ্রষ্ট না হয়। ইন্দ্রিয়ের অগোচর শক্তি এবং রহস্য,যা নাকি জগতের নিগূঢ় অন্তরে প্রবহমাণ প্রকাশমাণ—সেই শক্তি, সেই রহস্য যেমন ধ্যানযোগে যোগীর অনুভূতির গোচরীভূত হয়, ঠিক তেমনিভাবেই আয়ুর্বেদজ্ঞ যখন রোগীর নাড়ি পরীক্ষা করেন, তখন দেহের অভ্যন্তরে চক্ষু-অগোচরে রোগশক্তির ক্রিয়া, তার রূপ আয়ুর্বেদজ্ঞের ধ্যানযোগে যথাযথভাবে গোচরীভূত হয়। বায়ু, পিত্ত, কফ-এই তিনের যেটি বা যেগুলি কুপিত হয়ে দুষ্ট হয়ে রোগীর রক্তধারায় ক্রিয়া করছে, নাড়িতে তার গতি, তার বেগ কতখানি—সব একেবারে নির্ভুল অঙ্কফলের মত নির্ণীত হয়। আর

জগদ্বন্ধু মশায়ের কণ্ঠস্বর গভীর হয়ে উঠল। তিনি বললেন––জ্ঞানযোগে নাড়িবোধে আর মনঃসংযোগে ধ্যানযোগে যদি অনুভূতিতে সিদ্ধ হতে পার, তবে বুঝতে পারবে রোগের অন্তরালে কেউ আছে বা নেই।

জগদ্বন্ধু মশায় ছেলের মুখের দিকে দৃষ্টি তুলে বলেছিলেন—আমার বাবা বলতেন—এক সন্ন্যাসী তাকে বলেছিলেন, তিনি তাকে সাপের বিষের ওষুধ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন সর্পদংশনে বিষক্রিয়ার ওষুধ আছে; কিন্তু যে সাপ কালের আজ্ঞা বহন করে আসে, তার দংশনে মৃত্যুই ধ্ৰুব; তার ওষুধ হয় না। ঠিক তেমনি, রোগের ওষুধও আছে, চিকিৎসাও আছে, কিন্তু কালকে আশ্রয় করে যে রোগ আসে, তার ওষুধও নাই, চিকিৎসাও নাই। আমরা বৈদ্য, আমরা চিকিৎসাজীবী—আমাদের চিকিৎসা করতেই হয়, কিন্তু ফল হয় না। এই নাড়িবোধের দ্বারা বুঝতে পারা যায়—রোগ তার দেহে নির্দিষ্টকাল ভোগ করেই ক্ষান্ত হবে অথবা রোগের অন্তে কাল তাকে গ্রহণ করবে।

জীবন মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। শুনতে শুনতে সব যেন তার ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। সত্যই ওলটপালট।

সেকালে জীবন দত্তের চোখের সামনে ছিল রঙলাল ডাক্তারের প্রতিষ্ঠাতার গরদের কোট পেন্টালুন, সোনার চেন-সাদা ঘোড়া—আরও অনেক কিছু অর্থ, সম্পদ, প্রতিষ্ঠা। যার জন্য ডাক্তারি পড়াই ছিল স্বপ্ন। কিন্তু এ কথা তিনি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন যে, সেদিন শাস্ত্ৰতত্ত্ব শুনতে শুনতে এ সব তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। এক অপরূপ জ্ঞানলোকের সিংহদ্বারে তাঁকে তাঁর পিতা তার গুরু এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওই দরজা খুলে প্রবেশ করতে পারলে অমৃতের সন্ধান পাবে। তিনি যেন তার আভাসও পেয়েছিলেন।

তার বাবা বলতেন, তিনিও মানেন—কোনো শাস্ত্ৰ জানা আর সে শাস্ত্ৰে জ্ঞানলাভ, দুটো আলাদা জিনিস। বলতেন-বাবা, আমাদের শাস্ত্রে বলে, গুরুর কৃপা না হলে জ্ঞান হয় না। শিক্ষা হয়ত হয়। মুখস্থ অবশ্য করতে পার। কিন্তু সে শিক্ষা যখন জ্ঞানে পরিণত হয়, তখন পৃথিবীর রূপ পালটে যায়; চক্ষুর অগোচর প্রত্যক্ষ হয়, স্পর্শের অগোচর অনুভূতিতে ধরা দেয়। নাড়িপরীক্ষা-বিদ্যা জ্ঞানে পরিণত হলে তুমি জীবনের মধ্যে মৃত্যুকে অনুভব করতে পারবে।

সে কথা সত্য। জীবন দত্ত উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করে বলতে পারেন—সত্য, এ সত্য, এ সত্য।

এই সুদীর্ঘকালে কত দেখলেন—পৃথিবীর আয়তন জম্বুদ্বীপ থেকে প্রসারিত হয়ে পশ্চিম গোলার্ধ, পূর্ব গোলাৰ্ধ, উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত হল, প্রাচীনকালে যাকে সত্য বলে মেনেছে মানুষ, তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হল, নতুন সত্যকে গ্রহণ করতে হল, কিন্তু এই সত্য মিথ্যা হয় নি। এ চিরসত্য।

একালে পড়েছেন ড়ুবুরীর কথা। সমুদ্রে নামে—আধুনিক যন্ত্রপাতি-সংযুক্ত পোশাক পরে মুক্তা আহরণ করে, তারা সেখানে গিয়ে সমুদ্রের তলদেশের বিচিত্র সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলেও যায় মুক্তা আহরণের কথা। ঠিক তেমনিভাবেই সেদিন জীবন দত্ত সব ভুলে গিয়েছিলেন; প্রতিষ্ঠার কথা, সম্পদের কথা, সম্মানের কথা—সব ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। সেদিন এই প্রসঙ্গে জগদ্বন্ধু মশায় তাঁকে এক বিচিত্র পুরাণ-কাহিনী শুনিয়েছিলেন। মৃত্যু কে? ব্যাধি কী? মৃত্যুর সঙ্গে ব্যাধির কী সম্পর্ক? সেই সব নিয়ে—সে কাহিনী বিচিত্র।

জগদ্বন্ধু মশায় ভাগবত-কথকের মত দক্ষ কথক ছিলেন। তার নিপুণ গভীর বাগবিন্যাসে জীবন দত্ত অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।

বলেছিলেন—অবশ্য রোগমাত্রেই মৃত্যুস্পর্শ বহন করে। মহাভারতে আছে, ভগবান প্রজাপতি মনের আনন্দে সৃষ্টি করে চলেছেন, সৃষ্টির পর সৃষ্টি। বিচিত্র থেকে বিচিত্ৰতর। তখন পৃথিবীতে শুধু সৃষ্টিই আছে, লয় বা মৃত্যু নাই। এমন সময় তাঁর কানে এল যেন কার ক্ষীণ কাতর কণ্ঠস্বর। তিনি উৎকর্ণ হলেন। এবার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল যেন অস্বাচ্ছন্দ্যকর কোনো গন্ধ। এবার সৃষ্টির দিকে তিনি দৃষ্টিপাত করলেন। দেখে চকিত হয়ে উঠলেন। এ কী? তার সৃষ্টির একটি বৃহৎ অংশ জীর্ণ, মলিন, স্থবির, কর্কশ হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর বুক বহু জীবে পরিব্যাপ্ত। স্বভাবে উচ্ছঙ্খল অথচ উচ্ছাসবিহীন—স্তিমিত। বিপুলভারে ক্লিষ্ট পৃথিবী করছেন কাতর আর্তনাদ। আর ওই যে অস্বাচ্ছন্দ্যকর গন্ধ? ও গন্ধের সৃষ্টি হয়েছে ওই জীর্ণ সৃষ্টির জরাগ্রস্ত দেহ থেকে।

উপায় চিন্তায় নিমগ্ন হলেন প্রজাপতি ব্ৰহ্মা ললাটে চিন্তার কুঞ্চনরেখা দেখা দিল। অকস্মাৎ এই চিন্তামগ্নতার মধ্যে তার মুখমণ্ডল অকারণে কুটিল হয়ে উঠল। ভ্ৰকুটি জেগে উঠল প্ৰসন্ন ললাটে। হাস্যস্মিত মুখে অপ্রসন্নতা ফুটে উঠল। প্ৰসন্ন নীল আকাশে যেন মেঘ উঠে এল দিগন্ত থেকে। সঙ্গে সঙ্গে তার অঙ্গ থেকে ছায়ার মত কী যেন বেরিয়ে এল; ক্ৰমে সে ছায়া কায়া গ্ৰহণ করল—একটি নারীমূর্তি তার সামনে দাঁড়াল কৃতাঞ্জলি হয়ে। পিঙ্গলকেশা, পিঙ্গলনেত্ৰা, পিঙ্গলবৰ্ণ; গলদেশে ও মণিবন্ধে পদ্ম-বীজের ভূষণ, অঙ্গে গৈরিক কাষায়; সেই নারীমূর্তি প্ৰণাম করে ভগবানকে প্রশ্ন করলেন পিতা, আমি কে? কী আমার কর্ম? কী হেতু আমাকে আপনি সৃষ্টি করলেন?

ভগবান প্রজাপতি বললেন–তুমি আমার কন্যা। তুমি মৃত্যু। সৃষ্টিতে সংহারকর্মের জন্য তোমার সৃষ্টি হয়েছে। সেই তোমার কর্ম।

চমকে উঠলেন মৃত্যু–অর্থাৎ সেই নারীমূর্তি; আর্তস্বরে বললেন– পিতা হয়ে তুমি এ কী। কুটিল কঠিন কর্মে আমাকে নিযুক্ত করছ? এ কি নারীর কর্ম? আমার নারী-হৃদয়—নারী-ধর্ম এ সহ্য করবে কী করে?

ভগবান হেসে বললেন–কী করব? উপায় নাই। সৃষ্টি যখন করেছি, তখন ওই কৰ্মই করতে হবে।

মৃত্যু বললেন–পারব না।

–পারতে হবে।

মৃত্যু তপস্যা শুরু করলেন। কঠোর তপস্যা করলেন। ভগবান এলেন–বললেন–বর চাও।

মৃত্যু বর চাইলেন—এই কঠিন নিষ্ঠুর কর্ম থেকে আমাকে অব্যাহতি দিন।

ফিরে গেলেন ভগবান–না।

আবার তপস্যা করলেন মৃত্যু, এবারের তপস্যা পূর্বের তপস্যার চেয়েও কঠোর।

আবার এলেন প্রজাপতি। আবার ওই বর চাইলেন মৃত্যু—এই নিষ্ঠুরতম কর্ম থেকে কন্যাকে অব্যাহতি দিন পিতা।

প্রজাপতি নীরবে ধীরভাবে ঘাড় নাড়লেন, জানালেন–না। সে হয় না। এবং মুহূর্তে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

কন্যারূপিণী মৃত্যু দীর্ঘক্ষণ আকাশমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর আবার আসন গ্ৰহণ করলেন।

তৃতীয়বার তপস্যামগ্ন হলেন মৃত্যু। এবার যে তপস্যা করলেন, তার চেয়ে কঠোরতর তপস্যা কেউ কখনও করে নি। আবার ভগবান ব্ৰহ্মাকে আসতে হল। আবার মৃত্যু ওই বর চাইলেন। বর প্রার্থনা করতে গিয়ে এবার তার ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠল। চোখ দিয়ে অনর্গল ধারায় জল গড়িয়ে এল। ব্ৰহ্মা ব্যস্ত হয়ে নিজে অঞ্জলি বন্ধ করে সেই প্রসারিত অঞ্জলিতে অবিন্দুগুলি ধরলেন। বললেন–মা, তোমার চোখের জল এ সৃষ্টিতে পড়বামাত্র এর উত্তাপে সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে।

দেখতে দেখতে সেই অশ্রুবিন্দুগুলি হতে এক-একটি কুটিল মূর্তির আবির্ভাব হল। ভগবান বললেন–এরা হল রোগ; এরা তোমারই সৃষ্টি; এরাই তোমার সহচর।

মৃত্যু বললেন–কিন্তু আমি নারী হয়ে পত্নীর পার্শ্ব থেকে পতিকে গ্রহণ করব কী করে? মায়ের বুক থেকে তার বত্রিশনাড়ি-ছেঁড়া সন্তানকে গ্রহণ করব, এই নিষ্ঠুর কর্মের পাপ–

বাধা দিয়ে ভগবান বললেন–সব পাপ-পুণ্যের ঊর্ধ্বে তুমি। পাপ তোমাকে স্পর্শ করবে না। তা ছাড়া তাদের কর্মফল তোমাকে আহ্বান করবে এই রোগেদের মাধ্যমে। অনাচার, অমিতাচার, ব্যভিচারের ফলে রোগাক্রান্ত হবে মানুষ। তুমি তাদের দেবে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি, জ্বালা থেকে শান্তি, পুরাতন জন্ম থেকে নব জন্মান্তর।

কিন্তু মৃত্যু আকুল হয়ে বললেন–শোকাতুরা স্ত্রী পুত্ৰ মাতা পিতা মাটিতে লুটিয়ে পড়বে, বুক চাপড়াবে, মাথা কুটবে, সে দৃশ্য আমি দেখব কী করে?

ভগবান বললেন–তুমি অন্ধ হলে, দৃষ্টি তোমার বিলুপ্ত হল। দেখতে তোমাকে হবে না।

মৃত্যু বললেন–তার ক্ৰন্দন? নারীকন্ঠের আর্তবিলাপ কি—

বাধা দিয়ে ভগবান বললেন–তুমি বধির হলে। কোনো ধ্বনি তোমার কানে যাবে না।

জগদ্বন্ধু মশায় বলেছিলেন–মৃত্যু অন্ধ, মৃত্যু বধির। রোগই তার সন্তানের মত নিয়ত তার হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে নিয়ম-কাল। যার কাল পূর্ণ হয়, তাকে যেতে হয়। অকালমৃত্যুও আছে। নিজের পাপে মানুষ নিজের আয়ুক্ষয় করে কালকে অকালে আহ্বান করে। আমাদের যে পঞ্চম বেদ আয়ুর্বেদ তার শক্তি হল, কাল যেখানে সহায়ক নয় রোগের, সেখানে রোগকে প্রতিহত করা। রোগ এমন ক্ষেত্রে ফিরে যায়, তার সঙ্গে অন্ধ-বধির মৃত্যুও ফিরে যায়। কিন্তু কাল যেখানে পূর্ণ হয়েছে, সেখানে আক্রমণের বেগে নাড়িতে যে স্পন্দন।–বৈলক্ষণ দেখা দেয় তা থেকে বুঝতে পারা যায়, মৃত্যু এখানে কালের পোষকতায় অগ্রসর হচ্ছে। এমনকি কতক্ষণ, কয় প্রহর, কয় দিন, কয় সপ্তাহ, পক্ষ বা মাসে সে গ্রহণ-কর্ম শেষ করবে, তাও বলা যায় এই নাড়ি পরীক্ষা করে।

এই মুহূর্তটিতে সেদিন ঘরের কোণে একটা টিকটিকি টক টক শব্দে ডেকে উঠেছিল। মাটিতে আঙুলের টোকা দিয়ে জগদ্বন্ধু মশায় টিকটিকিটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিলেন ওই দেখ।

জীবন প্রথমটা ভেবেছিল—বাবা বলছেন-টিকটিকি তাঁর কথাকে সত্য বলে সমর্থন করছে। কিন্তু না। সেদিকে তাকিয়ে জীবন দেখেছিলেন, ডাক দিয়েই টিকটিকিটা লাফিয়ে ধরেছে একটা ফড়িংকে। ফড়িংটা ঝটপট করছে।

মশায় বলেছিলেন—অনুরূপ অবস্থায় মানে ধর যদি কোনো মানুষকে কুমির ধরেছে কি কোনো দুটো কঠিন জিনিসের মধ্যে চাপা পড়েছে—পিষ্ট হচ্ছে, এমন অবস্থায় তার নাড়ি যদি পরীক্ষা করা যায় তবে নাড়ির মধ্যে জীবনের আর্তনাদ অনুভব করতে পারবে। একেবারে প্রত্যক্ষ করতে পারবে, মনে হবে চোখে দেখছ।

নাড়িবিজ্ঞানে নিদান হকার প্রথম অভিজ্ঞতার গল্প বলেছিলেন জগদ্বন্ধু মশায়। বলেছিলেন গিরিশবাবুর মা—এই নবগ্রামের গিরিশবাবু, তাঁর মা-বর্ষার সময় বাধানন ঘাটের চাতালে পা পিছলে পড়ে গেলেন। পড়েই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বাবা তখন দেহ রেখেছেন—আমার বয়স তখন কম। গেলাম। নাড়ি দেখে শঙ্কিত হলাম। কিন্তু সঠিক কিছু বুঝতে পারলাম না। দেখলাম আঘাতের ফলে যেমন নাড়ি স্পন্দনহীন হয়, তাই হয়েছে। সেক্ষেত্রে নাড়ি অসাধ্য নয়। তবু কেমন যেন সন্দেহ হল। বললাম প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে মৃত্যু হতেও পারে—না হতেও পারে। আপনারা আরও বিচক্ষণ কবিরাজ এনে দেখান। পারুলিয়ার বৃদ্ধ কবিরাজ মশায় এলেন সন্ধ্যায়। তিনি দেখলেন। বললেন–এ অবস্থায় তিন দিন উত্তীর্ণ হলে এ যাত্রা রক্ষা পেলেন। তবে–

আবার নাড়ি দেখলেন, বাহুমূলে কণ্ঠে, নাড়ি পরীক্ষা করে বললেন– রক্ষা পেলেও এক বৎসর মধ্যেই ওঁর দেহান্ত ঘটবে এবং দেহান্তের পূর্বে যেখানে আঘাত পেয়েছেন আজ, সেইখানে তীব্ৰ বেদনা অনুভব করবেন। যেন নূতন করে সেদিন আঘাতটা পেলেন—এমনি মনে হবে।

গিরিশবাবু দ্বিতীয় দিনেই মাকে পালকি করে গঙ্গাতীরে নিয়ে গেলেন। সকলেই সন্দেহ করলেন তিন দিনের মধ্যেই দেহান্ত ঘটবে। গঙ্গাতীরে দেহরক্ষায় মায়ের একান্ত বাসনা ছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে চতুর্থ দিনের প্রভাতে বৃদ্ধার জ্ঞান হল। ধীরে ধীরে সেরেও উঠলেন। দেহরক্ষার সঙ্কল্প নিয়ে গঙ্গাতীরে গিয়ে ফেরার নিয়ম নয়। গঙ্গাতীরেই থাকলেন তিনি। ঠিক বৎসরের শেষে এক সপ্তাহ আগে, হঠাৎ একদিন তিনি যন্ত্রণা অনুভব করলেন আঘাতের স্থানে। যন্ত্রণা ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। চব্বিশ ঘণ্টা সেই যন্ত্ৰণা ভোগ করে তিনি অচেতন হয়ে গেলেন। তারপর আরও বার ঘণ্টা পরে ঘটল তার দেহান্ত।

এ আমার প্রত্যক্ষ প্রথম অভিজ্ঞতা। তারপর নিজেই অনেক দেখলাম। তুমিও দেখবে। এ ঠিক বুঝিয়ে দেবার নয়, ব্যাখ্যা করে ফল নাই। উপলব্ধি করবার শক্তি ভাগ্যের উপর নির্ভর করে বাবা। তোমার যদি সে ভাগ্য থাকে, সে শক্তি যদি অর্জন করতে পার, তবে তুমিও বুঝতে পারবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress