আরোগ্য নিকেতন – 37
পরের দিন সকালে।
জীবনমশায় আরোগ্য-নিকেতনের দাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাসপাতালের ডাক্তারের বাড়ি যাবেন। হঠাৎ প্রদ্যোত ডাক্তার নিজেই সাইকেল চড়ে এসে রোয়াকে পা দিয়েই সাইকেলটার গতিরোধ করলেন; নামলেন না। হাঁপাচ্ছেন।
—মশায়, আজ জ্বর নাইন্টিনাইনে নেমেছে।
–নেমেছে?
–হ্যাঁ। নাইন্টিনাইন পয়েন্ট দুই। ভোরবেলা থেকেই মঞ্জু কথা বলছে—সহজ কথা। বলছে ভাল আছি।
–ভগবানের দয়া আর আপনার অদ্ভুত সাহস, আর দৃঢ়তা!
তরুণ ডাক্তারটি কোনো প্রতিবাদ করলেন না এ প্রশংসার। নিঃসঙ্কোচে হাসিমুখে গ্রহণ করলেন, শুধু বললেন– আপনার নাড়িজ্ঞানের সাহায্য না পেলে এতটা সাহস পেতাম না মশায়। আচ্ছা, আমি যাই। মনের খুশিতে ছুটে এসেছি।
ঘুরল সাইকেল; ডাক্তার দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল। সকালের বাতাসে তার রুক্ষ চুলগুলি উড়ছে।
পরমানন্দ মাধব! পরমানন্দ মাধব হে! পরমানন্দ–! কলিটা অসমাপ্ত রেখেই ডাক্তার একসঙ্গে হাসলেন এবং দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।
পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ সুখীদের মধ্যে এই লোকটি একজন। ওই মেয়েটিকে সে জীবন ভরে পেয়েছে। ছেলেটি আর মেয়েটিতে মিলে মানস সরোবর।
কিশোর সেদিন বলেছিল—এই পাওয়াই শ্ৰেষ্ঠ পাওয়া। এ পাওয়া যে পায় তার সব পাওয়া হয়ে যায় ডাক্তারবাবু। সৃষ্টি হয় মানস সরোবরের।
কিশোরকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন বিয়ে করছ শুনলাম, কিন্তু কী হল?
সে বলেছিল–ভয় হল মশায়!
–বিয়ে করলে বউ পাওয়া যায় মশায়, কিন্তু যা পাওয়ার জন্যে বিয়ে করে মানুষ–তা পাওয়া যায় না। নারী আর প্রকৃতি ও দুই সত্যই এক। দুদিন পরেই বুকে পা দিয়ে দলে আপনার পথে চলে যায়। কখনও নিজের মুণ্ড কেটে নিজেই রক্তস্নান করে, কখনও নিজে স্বামীকে গ্রাস করে ধূমাবতী সাজে, কখনও আবার নিজের বাপের মুখে স্বামীনিন্দা শুনে দেহত্যাগ করে। কদাচিৎ পুরুষের প্রেমে পূর্ণ পরিতৃপ্তিতে শান্ত অঞ্চল হয়ে ধরা দেয়। যাদের ভাগ্যে এই পাওয়া ঘটে, তাদের আর কিছু প্রয়োজন নাই। প্রতিষ্ঠা প্রশংসা সাম্রাজ্য—এমনকি মুক্তিও না। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর নাই। এ কেউ পায় না। ভয়ে পা বাড়িয়ে পিছিয়ে নিলাম। কে জানে–কী ফাঁকি আছে আমাদের দুজনের মধ্যে। ফাঁক থাকলে তো রক্ষে নাই। নারী তখন নদীর মত ছুটবে আর আমি তীরের মত বাহু বাড়িয়ে সাগরের কূল পর্যন্ত ছুটেও তাকে পাব না। ও থাকে বাহুবন্ধনের মধ্যে, ধরা পড়লেই ওরা মানস সরোবর।
কথাটা সত্য। ভুল নাই। মনে মনে বার বার বললেন– জীবনমশায়। হাসপাতালের ডাক্তারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, সন্ধ্যাবেলায় আরও ভাল করে এই সত্যটি অনুভব করলেন। সন্ধ্যার দিকে রোগিণীর জ্বর ধীরে ধীরে ছেড়ে এসেছে এখন।
সীতা স্মিতমুখ ডাক্তার-গৃহিণীর মুখখানি মুছিয়ে দিয়ে বললে—যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
-–তোমায় খুব খাটতে হয়েছে, না? শীর্ণ হাসি ফুটে উঠল ডাক্তারের বউয়ের মুখে!
ডাক্তার ছেলেমানুষের মত ছুটে গিয়ে কম্পাউন্ডারকে বলে এলেন। নার্সদের ওদিকে। গেলেন। হাসপাতালের রান্নাশালায় ঝাড়ুদার মতিয়া জমাদারকে বলে এলেনওরে জ্বর ছেড়ে গেছে। জীবন মশায়ের উপস্থিতিও ভুলে গেছেন ডাক্তার।
রোগীর ঘরে ডাক্তারের শাশুড়ি প্রবেশ করলেন-যে ভয় তুই ধরিয়েছিলি মঞ্জু! সে কী বলব!
—কে জানে! তিন-চার দিনের কথা আমার কিছুই মনে নেই।
—থাকবে কী? একেবারে বেশ। মা–মা বলে চেঁচিয়েছি, আমি ডাকলাম—এই যে আমি। তা একবার ফিরেও তাকালি না।
—তুমি কবে কখন এসেছ—আমি কিছুই জানি না।
—তোর এই অবস্থা, ওদিকে জামাইয়ের সে কী মুখ! মুখ দেখে আমার কান্না উপে গেল। মনে হল, মঞ্জুর যদি কিছু হয় তবে জামাই আমার পাগল হয়ে যাবে।
–পাগল হত না। তবে সন্ন্যাসী হত, নয়ত আত্মহত্যা করত।
জীবনমশায় বারান্দায় দাঁড়িয়েই মনশ্চক্ষে দেখলেন—রোগিণীর শীর্ণ ক্লান্ত শুষ্ক অধরে স্মিত হাস্যরেখা ফুটে উঠেছে, কৃষ্ণাচতুর্দশীর শেষরাত্রের এককলা চন্দ্ৰোদয়ের মত সে হাসির রূপ। এবং মেয়েটি এই হাসিতে কোনো লজ্জা অনুভব করছে না। সগৌরবে পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে পুষ্পবিকাশের মতই অকুণ্ঠ প্ৰকাশে হাসিমুখে বিকশিত হয়ে উঠেছে।
পরমানন্দ মাধব হে!
ডাক্তার ফিরছেন। পদক্ষেপে উল্লাস ফুটে উঠছে।
—ধরা! ধরিত্রী! শুনছিস?
ডাক্তারের শাশুড়িকে ডাকছেন তার সঙ্গের সেই মেয়েটি। এই কদিনই এই কণ্ঠস্বর তিনি শুনেছেন। ভিতরের দিকে বারান্দা থেকে এই ডাক ডাকেন। আবছা চোখে পড়েছে একটি দীর্ঘাঙ্গী প্ৰৌঢ়া বিধবা শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে চুপ করে বসে থাকেন। গালে একটি হাত, মাটির উপরে একটি হাত, বসেই থাকেন। মধ্যে মধ্যে ডাকেন—ধরা, ধরিত্রী।
এদিক থেকে সাড়া দিত না কেউ—রোগীর শিয়রে বসে সাড়াই বা দেবে কী করে? চুপ করে যেতেন ভদ্রমহিলা। মহিলাটিকে দেখে মনে হয় একদিন জীবনে তাঁর জীবন-মহিমা ছিল। কিছুক্ষণ পর আবার ডাকতেন—ধরা! ধরিত্রী! অ-ধরিত্রী! হা লা, মেয়ে তোর রয়েছে কেমন? বল্? ঘরে ঢুকতে বারণ করেছিস–ঢুকি নে। তবু খবরটা বল!
সাড়া এতেই বা কে দেবে? তিনি চুপ করতেন।
আজও সেই তিনিই ডাকছেন। সেই ডাক। আজ ধরিত্রী সাড়া দিলেন-–বল! কী চাই?
কী চাইব? হ্যাঁ লা তুই নাতনী–মেয়ের মেয়ে, মঞ্জু তোর মেয়ে, তার এখানে এসেছি–সেই তো বড় লজ্জা! এর পর আবার চাইব কী?
—তবে? কী বলছ?
—বলছি, মঞ্জু তো ভাল রয়েছে—একবার যাই না ওঘরে, ওকে দেখি! চোখে তো দেখব না, একবার মুখে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।
–একটু ওডিকলন মাখাব না? এ কণ্ঠস্বর মঞ্জুর। সে হেসে উঠল, দুর্বল কিন্তু সশব্দ হাসি।
—তা ভাই দিস যদি মাখব। কদিন এখানে এসেছি–মাথায় তেল দিই নি। নারকেল তেল দেয় নামিয়ে। ও তো ভাই মাখতে পারি নে, কী করব। রুক্ষু মাথাতেই চান করি। ওডিকলন নয়, একটু গন্ধতেল দিস।
—চুপ কর, জামাই আসছেন—দিদিমা, চুপ কর।
ডাক্তার আসছেন—মঞ্জুর মা দেখতে পেয়েছেন। তিনি সতর্ক করে দিচ্ছেন বৃদ্ধাকে।
একটু বেদনা অনুভব না করে পারলেন না জীবনমশায়।
-কই তোর জামাই, কই? একবার ডেকে দে না আমার কাছে। আমি আজ না হয় পথের ধুলোর অধম হয়েছি, ঘরে গেলে ঘর নোংরা হয়; ছুঁলে হাত ময়লা হয়। কিন্তু চিরদিন তো এমন ছিলাম না! আমারও রূপ যৌবন ছিল। আদর সম্ভ্রম ছিল। তার ওপর আমি মঞ্জুর মায়ের মা। সেদিক থেকেও তো আমার সঙ্গে কথা বলতে হয়!
-কী? কী বলছেন? ডাক্তার শুনতে পেয়েছেন কথাগুলি। বারান্দায় উঠেই থমকে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। এ অবস্থায় মঞ্জুর মায়েরও দিদিমাকে সাবধান করার উপায় ছিল না। ডাক্তারের মন পরম প্রসন্নতায় ভরা। তিনি হেসেই উত্তর দিলেন–নিশ্চয়; কথা বলব বৈকি। আপনি গুরুজন। তবে মঞ্জুর অসুখ নিয়ে
—হ্যাঁ–হ্যাঁ ভাই। তা বটে। যে লজ্জা, যে ভয় হয়েছিল আমার। ভেবেছি—কেন এলাম? আমি সর্বস্বখাগী। স্বামী খেয়েছি, তাকে খেয়ে গেলাম মেয়ের ঘরে, সেখানে মেয়েকে খেলাম। তোমার শাশুড়িকে মানুষ করলাম—সেই জামাইয়ের ঘর, তার অন্ন খেয়ে। মেয়ের সতীন এল–তার কথা শুনে সেখানে রইলাম; তারপর ধরার বিয়ে হল। ধরার বাড়ি এলাম, ধরা বিধবা হল। আবার এখানে–এখানে কেন এলাম? তা যার জন্যে এসেছি—সে জান তো? আমার চোখ দুটি ভাল করে দাও। বড় ডাক্তার তুমি!
–আচ্ছা, আচ্ছা। কালই আমি ওষুধ দোব।
–ওষুধ নয়, অপারেশন করে দাও।
–অপারেশন কি হবে? ছানি তো না!
–উঁহুঁ, অপারেশন না করলে ভাল হবে না। অপারেশন করলেই ভাল হবে। কতজনের। ভাল হল।
–আচ্ছা, দেখব কাল ভাল করে। তা হলে আমি বাইরে যাই। আপনার কোনো কষ্টটষ্ট হচ্ছে না তো?
–হচ্ছে ভাই। মাথায় একটু ভাল তেল চাই। আর কাপড়গুলি বড় পুরনো হয়েছে।
ঘরের ভিতর থেকে ডাক্তারের লজ্জিতা শাশুড়ি বললেন–করবে কী? উপায় কী বল? কাপড়ের কন্ট্রোল-বিশ্বযুদ্ধ লোক কাপড়ের অভাবে ছেঁড়া পরে দিন কাটাচ্ছে।
–তা বটে, তা বটে ভাই। তবু মঞ্জুর দুখানা আধপুরনো শাড়ি দিস। তাই পরব।
মঞ্জু হেসে উঠল।–রঙিন ড়ুরে শাড়ি–
—তাই পরব। তবু ছেঁড়া ন্যাকড়ার মত কাপড় পরতে পারি না।
ডাক্তার বারান্দায় জীবন মশায়কে দেখে একটু লজ্জা পেলেন। তাঁর মনেই ছিল না জীবন মশায়ের অস্তিত্বের কথা। মনের উল্লাসে ভুলেই গেছেন।
–আমার দেরি হয়ে গেল মশায়।
–তা হোক।
–ও ভাই–ও মঞ্জুর বর! শুনছ!
কী বিপদ! প্রদ্যোত ডাক্তার এবার বিরক্ত হয়ে উঠল। হয়ত বা ওই মহিলাটির কথা জীবনমশায় শুনেছেন বুঝে মনে মনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। মহিলাটির উপর তো বটেই—হয়ত জীবন মশায়ের উপরেও বিরক্ত হয়েছে। জীবন মশায়ের শোনা উচিত হয় নি, চলে যাওয়া উচিত ছিল।
জীবনমশায় বললেন–আমি আজ যাই।
—বসবেন না একটু?
–না, আবার কাল আসব।
–আচ্ছা। মঞ্জু যেদিন পথ্য পাবে সেদিন একটা খাওয়াদাওয়া করব।
–বেশ তো।
–পথ্যের দিন নির্ণয় কিন্তু আপনি করবেন। ক্লোরোমাইসেটিনে জ্বর ছাড়ে, কিন্তু আবার রিল্যান্স করার একটা ভয় আছে। আপনি যেদিন বলবেন নাড়ি নির্দোষ হয়েছে–এবার পথ্য দেওয়া যেতে পারে, তখন দেব। রক্তদাস্ত যখন হয়েছে, তখন ইনটেস্টাইনে পারফোরেশন হয়েছে নিশ্চয়। পথ্য খুব হিসেব করে দিতে হবে।
ওদিকে সরিক্ত দীনাতিদীন মহিলাটি ডেকেই চলেছেন—অ-ভাই! শুনছ! একটু অপেক্ষা করে আবার ডাকছেন—মঞ্জুর বর! আবার ডাকছেন-অ-ডাক্তার সায়েব!
মঞ্জুর মা একবার চাপা গলায় বললেন–থাম দিদিমা। কথা বলছেন জামাই মশায়ের সঙ্গে।
—মশায়ের সঙ্গে? সে কে?
–যিনি খুব ভাল নাড়ি দেখেন, এখানকার প্রবীণ বৈদ্য। চুপ করলেন মঞ্জুর মা।
–তা। বলেই স্তব্ধ হয়ে যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন বৃদ্ধা।
কয়েক মুহূর্ত পর হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলেন এবং ডাকলেন—ধরা, কথা শেষ হল? আমি একটি কথা বলছিলাম।
এবার প্রদ্যোত ডাক্তার বোধহয় ক্ষেপে উঠবে। মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে—বলেছি তত কাল চোখ কেটে দেব। যা হয় হবে আপনার।
–না। তা বলি নি ভাই।
–তবে? কাপড়? তাও এনে দেব।
–না–না।
–তবে কী?
–ওই যে মশায় না কী যিনি নাড়ি দেখেন ভাল—
–হ্যাঁ—তিনি কী করবেন? তিনি তো অপারেশন করেন না!
–না—না। তাঁকে একবার হাত দেখাব।
–হাতে কী হল আবার? বেশ তো শক্ত রয়েছেন। এখন তো কোনো অসুখ নেই।
—অসুখ অনেক আমার, তোমরা ধরতে পার না। ওইসব পুরনো লোকে ঠিক ধরতে পারবে। তুমি ওকে বলেই দেখ না। তোমাদের কাছে তো আমি নগণ্য লোক। ওকে বল–কাদীর জমিদার অমুক বোসের স্ত্রী। অমুক বোসকে চেনে না—এমন লোক এ চাকলায় নাই। তা ছাড়া এসব তো আমাদেরই জমিদারি ছিল গো। বলে দেখ, কত খাতির করে দেখবে। তা ছাড়া আমার বাবার।
প্রদ্যোত এবার ধৈর্য হারিয়ে সত্য সত্যই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, কিন্তু কী বলবে খুঁজে পেলে না।—মশায় বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন।
মঞ্জুর মা বৃদ্ধার হাত ধরে চাপ দিয়ে বললে—দিদিমা–চুপ কর। দিদিমা!
মশায় বাইরে থেকে ডাকলেন–প্রদ্যোতবাবু!
প্রদ্যোত বেরিয়ে এল, এবং সর্বাগ্রে হাতজোড় করে বললে–আপনি কিছু মনে করবেন না ওঁর কথায়। উনি সেই সেকালের জমিদারের বউ। মাথা খারাপ হয়ে গেছে–
হেসে বাধা দিয়ে মশায় বললেন—না–না-না। আপনি এমন সঙ্কুচিত হচ্ছেন কেন? উনি হাত দেখাতে চাচ্ছেন–চলুন হাত দেখি। দেখলেই তো খুশি হবেন। কাঁদীর কাদের বাড়ির বউ? কার স্ত্রী?
–ভূপেন বোস। লোকে বলত ভূপী বোস। যত অমিতাচারী তত অমিতব্যয়ী—সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন, তবু মদ ছাড়তে পারেন নি।
–হাত দেখাব, শুনেছি নাকি হাত দেখে নিদান হাঁকতে পারেন। কবে মরব, সেইটে জানব। তুমি ওঁকে বল, মঞ্জরী–মঞ্জরীর হাত দেখতে হবে। ওঁর মাস্টারের মেয়ে মঞ্জরী আমি। কাঁদীর অমুক বোসের স্ত্রী মঞ্জরী। উনি চিনবেন।
জ্যৈষ্ঠ রাত্রির রুক্ষ নির্মেঘ নক্ষত্র-ঝলমল আকাশ অকস্মাৎ কোমল নীলাভ দীপ্তিতে ভরে গিয়ে একটা উল্কা খসে গেল বুঝি। জীবনমশায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
—মঞ্জরী।
হাসপাতালের ডাক্তার বললেন–চিনতেন তাকে?
–চিনি, খুব চিনি। আপনার আপত্তি না থাকলে ওঁকে আমি দেখব!
–বেশ তো। আজই দেখবেন।
–ক্ষতি কী! দেখি।
প্রদ্যোত বললেন–বহু রোগ ওঁর শরীরে। স্বামীই দিয়ে গেছেন অনেক বিষ। বললাম তো তার কথা। আর আপনি জানেন বলছেন।
—জানি।
—তাঁর অমিতাচারের বিষ আছে রক্তে। নিজের রসনার ললাভের ফলে—স্টমাক-ইন্টেস্টাইন হয়েছে ব্যাধিগ্রস্ত, পুষ্টির অভাবে দেহকোষ হয়েছে দুর্বল। মনের অশান্তি–তাও ক্রিয়া করেছে। চোখ গেছে। কানেও একটু খাটো। কোলাইটিস লেগেই আছে, শীতে হাঁপানি হয়, শিরঃপীড়া আছে, মধ্যে মধ্যে জ্বর হয়। আশ্চর্য শক্ত দেহ, সব সহ্য করেই বেঁচে রয়েছেন। চুরি করে খান–।
থেমে গেল ডাক্তার। মনে হল আর বলা অন্যায় হবে।
মঞ্জরী চুরি করে খায়, চুরি করে গন্ধদ্রব্য মাখে, হাতে অনুভব করে যার হোক খরখরে দেখে পরিচ্ছন্ন বুঝে কাপড় টেনে নিয়ে পরে।
সেসব তথ্য একদিন ওঁদের কথাবার্তা থেকে জেনেছেন।
মশায় প্রদ্যোত ডাক্তারকে বললেন– চলুন।
প্রদ্যোত বলল—সেদিন ওঁকে আমি মতির মায়ের গল্প বলেছি। আপনি যা বলেছিলেন–তাও বলেছি, কিন্তু কাকে বললাম–কে শুনবে? বললেন– মঞ্জুর একটি ছেলে দেখি–তারপর ভাই, তারপর। আর মরলেই তো ফুরিয়ে গেল ভাই।
মঞ্জরীর সামনে দাঁড়িয়ে মশায় কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন; কপালে সারি সারি রেখা জেগে উঠল, চোখে ফুটে উঠল অদ্ভুত দৃষ্টি! পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে পরলেন তিনি। ভাল করে দেখলেন। দূর থেকে কয়েকদিনই বৃদ্ধাকে দেখেছেন তিনি, আজ চশমা চোখে কাছ থেকে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলেন। পেলেন না কোথাও তার বিন্দুমাত্র অবশেষ নাই।
–দেখি আপনার হাতখানি।
জ্বর লেগেই আছে নাড়িতে। ব্যাধিজর্জর অভ্যন্তর। উদ্বেগকাতর চিত্ত নাড়ির স্পন্দনে স্পন্দনে বলছে। দেহকোষে-কোষে, আকাশের নক্ষত্রমালার মত যে জীবনশিখাগুলি অহরহ প্ৰাণদেবতার আরতি করে জ্বলে, প্রাণকে মধুময় উত্তাপে অভিষিক্ত করে জাগ্রত করে রাখে। জীবদেহে, সেগুলি স্তিমিতদ্যুতি, অনেকগুলি নিভেই গিয়েছে। প্রাণদেবতার চারিদিকে ছায়া জেগে উঠছে, ছায়ায় হিমস্পর্শ ছড়াচ্ছে; শেষ সীমারেখায় উপনীত হতে আর অল্প পথই বাকি। নাড়ির স্পন্দনে জাগে যে জীবনসঙ্গীত—তা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে বিলম্বিত ছন্দে সমাপ্তির অবিলম্বতা ঘোষণা করছে।
হাতখানি নামিয়ে রেখে বললেন–ও হাতখানি দেখি।
সেই একই কথা—একই ছন্দ একই ধ্বনি।
–কী দেখলেন গো? চোখ-কান পাব? ভাল করতে পারবেন?
–না।
–মাথার যন্ত্রণা? শিরঃপীড়া?
–ভাল হবে না, তবে এখন অনেক ভাল ওষুধ উঠেছে খাবেন, যন্ত্রণা কমে যাবে। আমি একটা টোটকা বলে দেব–ব্যবহার করলে কমবে খানিকটা, তবে একেবারে ভাল হবে না।
–পেটের গোলমাল?
–ওই তো আপনার আসল রোগ।
–ভাল করে দেন।
–ভাল?
–হ্যাঁ। মঞ্জুর একটি খোকা দেখি।
—জন্মান্তরে তো বিশ্বাস করেন। মঞ্জুর কোলে খুকি হয়ে আপনিই ফিরে আসবেন, সে তো আরও ভাল হবে।
একটু চুপ করে থেকে বৃদ্ধা বললেন–তা হলে এবারের মত যেতে বলছেন। আর বাঁচব না? কিন্তু! কিন্তু ভারি যে ভয় লাগে গো!
–ভয় কিসের? এ তো মুক্তি।
–মুক্তি?
–হ্যাঁ। তা ছাড়া আর কী? সেখানে আপনার স্বামী, মা, বাপ, ভাই, মেয়ে, জামাই আপনার জন্যে অপেক্ষা করে রয়েছেন।
বৃদ্ধার মুখ প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। দৃষ্টিহীন চোখে সামনের দিকে চেয়ে আত্মমগ্ন হয়ে বসে রইলেন।
মশায় উঠলেন। বৃদ্ধা সচেতন হয়ে উঠলেন চেয়ার ঠেলার শব্দে। বললেন–তা হলে আমাকে যেতে হবে বলছেন? কতদিনের মধ্যে যেতে হবে?
প্রদ্যোত ডাক্তারের অস্তিত্ব ভুলে গেলেন জীবনমশায়, নিদান সম্পর্কে তার আপত্তির কথাও তার মনে হল না, তিনি আবার একবার বসে-বৃদ্ধার হাতখানি ধরে ভাল করে দেখে বললেন, তিন মাস থেকে ছ মাস। এর মধ্যেই মুক্তি পাবেন আপনি। তবে একালের ওষুধ খেলে হয়ত আরও কিছুদিন দুর্ভোগ ভোগ করতে হবে। একালের ওষুধ বড় শক্তিশালী।
–নাঃ। তা আর খাব না। আপনি আমাকে ভাল কথা মনে করে দিয়েছেন–তিনি আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছেন। যত শিগগির মুক্তি আসে ততই ভাল। এই কথাটি কেউ এমন করে আমাকে বলে নাই। ওঃ, কতকাল তারা আমার পথ চেয়ে আছে। আর আমি–।
বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর কাঁপতে লাগল। দৃষ্টিহীন চোখ দুটি নির্নিমেষ হয়ে গেল। এবার জল গড়াবে।
চোখ ফিরিয়ে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে গিয়ে তিনি চমকে গেলেন; সামনের আয়নাতে তাঁর নিজের প্রতিবিম্ব পড়েছে। শুভ্ৰ কেশ, রেখাঙ্কিত ললাট, পাণ্ডুর মুখ, এক স্থবির দাঁড়িয়ে আছে। মনে পড়ে গেল একটি কথা। তাঁর বাবার কথা বলেছিলেন জন্মমাত্রেই মৃত্যু সঙ্গ নেয়; দিনে দিনে সে বাড়ে, সেই বৃদ্ধির মধ্যেই সে তার ক্ষয়ের ক্রিয়া করে যায়, ঠেলে নিয়ে যায় তার পথে; জীবন-যুদ্ধ করে মানুষ যেদিন ক্লান্ত হয়—সেদিন আসে জরা, তারপর আসে শেষ। বলতে গেলে আজকের আমি জন্মাই সূর্যোদয়ে, মরি নিদ্রার সঙ্গে দিনান্তে রাত্রির অন্ধকারে, আবার জন্যই নূতন প্রভাতে জন্মান্তরে।
প্রদ্যোত ডাক্তার মশায়ের এই নিবিষ্ট একাগ্র দৃষ্টিতে দেখা দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। চেয়ারখানা একটু সরিয়ে দিয়ে বলল—বসুন।
মশায়ের রুদ্ধ দীর্ঘনিশ্বাসটি এতক্ষণে ঝরে পড়ল। তিনি মুখ ফিরিয়ে চেয়ারখানা দেখে নিয়ে বললেন– কী কষ্ট আপনার?
বৃদ্ধা বললেন– আপনি জীবনমশায়? নবগ্রাম দেবীপুরের জীবন দত্ত? আমি মঞ্জরী। কাঁদীর বঙ্কিমের বোন, মাস্টার নবকৃষ্ণ সিংহীর মেয়ে।
একটু হেসে মশায় বললেন– হ্যাঁ। শুনেই চিনেছি আমি। অনেক কালের কথা, আবছা আবছা মনে পড়ে।
–ঠিক বলেছেন। আবছা আবছা। সব ঝাপসা। এখানে এসে শুনি জীবনমশায়, জীবনমশায়। নবগ্রাম। মনে হয় চেনা-চেনা। নাম শোনা। তারপরেতে, আপনার কথা শুনে–ওই ঝোঁক দিয়ে কথা বলা শুনে মনে হল আপনিই তিনি। তাঁরাও তো মশায় ছিলেন। বাড়িও নবগ্রাম ছিল। তা মাথার গোলমাল তো, এই মনে পড়ে, আবার গোলমাল হয়ে যায়। শেষে বলি, তিনিই হোন আর যিনিই হোন, এত বড় বৈদ্যহাতটা দেখাই না কেন—যদি ভাল হই!
মশায় নীরবে উঠে বেরিয়ে এলেন।
হাসপাতাল থেকেই বেরিয়ে এলেন তিনি। প্রদ্যোত ডাক্তার ফটকের মুখ পর্যন্ত এসেছিল, সে বললে, মশায়, এই আপনাদের নিদান হাঁকা?
জীবনমশায় শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন তার দিকে, কথাটা তাঁর মাথায় ঢুকল না। প্রদ্যোত বললে—এ আপনার কাছে আমার শিখতে ইচ্ছে করছে।
মশায়ের মনের মধ্যে ঘুরছিল সেই পিঙ্গলবৰ্ণা কন্যার কথা। পিঙ্গলবর্ণা, পিঙ্গলকেশিনী, পিঙ্গলচক্ষু কন্যা–কৌষেয়বাসিনী, সর্বাঙ্গে পদ্মবীজের ভূষণ; অন্ধ বধির! অহরহই সে সঙ্গে রয়েছে, কায়ার সঙ্গে ছায়ার মত। শ্রমের সঙ্গে বিশ্রামের মত, শব্দের সঙ্গে স্তব্ধতার মত; সঙ্গীতের সঙ্গে সমাপ্তির মত; গতির সঙ্গে পতনের মত; চেতনার সঙ্গে নিদ্রার মত। মৃত্যুদূত তার কাছে পৌঁছে দেয়, অন্ধবধির কন্যা, অমৃতস্পৰ্শ বুলিয়ে দেন তার সর্বাঙ্গে। অনন্ত অলান্ত শান্তিতে জীবন জুড়িয়ে যায়। তেমনি করে জুড়িয়ে যায় যেন মঞ্জরী। মৃত্যুদূত সে যেন আসে ভূপীর রূপ ধরে।
পরমানন্দ মাধব! তোমার মাধুরীতে সৃষ্টিতে ছড়ানো মধু, মৃত্যুর মধ্যে অমৃত।
নিজের হাতখানা ধরলেন। রক্তস্রোত আজ দ্রুত চলেছে, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বেড়েছে। দেহের রোমকূপের মুখগুলি স্বেদাক্ত হয়ে উঠেছে। দীর্ঘকাল এমন উত্তেজনা তিনি অনুভব করেন নি। তিনি কী—তাঁর কী? কিন্তু তাঁর মৃত্যুদৃত কোন্ রূপে আসবে? মঞ্জরী নয়। মঞ্জরী জীবনে ভ্রান্তি। মিথ্যা। আতর-বউয়ের রূপে? তাঁর বাবা জগৎ মশায়ের রূপ ধরে? গুরু রঙলালের মূর্তিতে? অথবা নীরন্ধ্র অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়ে সে থাকবে–তাকে দেখা যাবে না? সে বনবিহারী?
–কে? আরোগ্য-নিকেতনের সামনে এসে পড়েছিলেন তিনি। একটি আলো জ্বলছে।
–কে বসে রয়েছে! ভ্রূ কুঞ্চিত করে তিনি প্রশ্ন করলেন–কে?
–মশায় বাবা! আমি প্ৰভু, আমি মরি।
মরি বোষ্টুমি! এত রাত্রে?–কী রে মরি?
আজ যে সাবিত্রীচতুর্দশী বাবা! অভয়া মা বললেন–কৃষাণ মান্দেরকে কী করে পাঠাব মরি? ওদের কাউকে সঙ্গে নিয়ে তুমি যাও।
আজ সাবিত্রীচতুর্দশী! একদিন বৈধব্যের দুঃখ কল্পনা করে তিনি বাপের মত স্নেহে অভয়াকে খাইয়েছিলেন, সে তাকে অভিসম্পাত দিয়েছিল। আজ অবৈধব্য ব্ৰত উপলক্ষে তাকে খাওয়াবে। কন্যার মত শ্রদ্ধা করেই নিমন্ত্রণ করেছে।
কুঞ্চিত করে তির্যক ভঙ্গিতে সেই অন্ধকারের মধ্যেই তিনি তাকালেন একবার। বোধ করি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলেন। আর-একবার বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের মণিবন্ধ চেপে ধরলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিলেন। বললেন–চল।