আরোগ্য নিকেতন – 36
অপ্রত্যাশিত না হলেও সংবাদটা এল যেন হঠাৎ। আরও মাসখানেক পর। বৈশাখের শেষ সপ্তাহে।
রানা পাঠক মরেছে।
সংবাদটা নিয়ে এল কিশোর। কিশোর গিয়েছিল সেখানে। রানাই তাকে সংবাদ পাঠিয়েছিল। নবগ্রামের জেলেরা গিয়েছিল নদীতে মাছ ধরতে, তাদেরই একজনকে বলেছিল-কিশোরবাবুকে একবার আসবার জন্য বলিস। আমি বোধহয় আর দু-এক দিন আছি, বুঝলি!
শেষ কিছুদিন রানা গ্রাম ছেড়ে নদীর ঘাটে একখানা কুঁড়ে তৈরি করে সেইখানেই থাকত। নদীর ঘাট, নদীর জলকর তার ইজারা নেওয়া ছিল। নদীর ঘাটটি তার অত্যন্ত প্রিয় স্থানও ছিল। ওই নদীর ঘাটেই সে জীবনের শ্ৰেষ্ঠ আনন্দ উল্লাস ভোগ করেছে। নদীতে ঝাঁপ খেয়ে পড়ে সাঁতার কেটেছে, রাত্রে খেয়াঘাটের চালায় অথবা নৌকায় বসে মদ্যপান করেছে, নারী নিয়ে উল্লাস করেছে, খাওয়াদাওয়া অনেক কিছু করেছে। আবার বসে মোটা গলায় প্রাণ খুলে কালীনাম করেছে। ইদানীং সে সন্ন্যাসী হয়েছিল। ওখানে সন্ন্যাসীর মতই বাস করত। গেরুয়া কাপড় পরত, দাড়ি-গোঁফ রেখেছিল, খুব আচারেই থাকত। দেবস্থানের ওষুধই ব্যবহার করত। কিন্তু রানার গোঁড়ামি, রানার বিশ্বাস অদ্ভুত। ওকে টলানো যায় না। মৃত্যুশয্যাতেও স্বীকার করে নাই। বলেছে–এই আমার অদৃষ্ট তার দেবতা কী করবে?
কিশোরকেই বলেছে। কিশোর যখন পৌঁছেছিল, তখন তার শেষ অবস্থা। ঘণ্টা কয়েক বেঁচেছিল। কিশোর ডাক্তার-বৈদ্য ডাকতে চেয়েছিল—তারই উত্তরে ওই কথা বলে বলেছিল, ডাক্তার-বদ্যির জন্য তোমাকে ডাকি নাই কিশোরবাবু। শোন, তোমাকে যার জন্যে ডেকেছি। মনে হচ্ছে, আজই হয়ত মরব। বড়জোর কাল। এখন রাত্রে একজন লোক চাই, কাছে থাকবে। জল চাইলে জল দেবে আর এই শেয়াল এলে তাড়াবে। বুঝেছ, নদীর ধারের মড়াখেকো শেয়াল তো, বেটারা ভারি হিংস্র। আজ দিন দু-তিন থেকে ওরা আশেপাশে ঘুরছে রাত্রে। তাতে লাঠি ঠুকে, ধমক দিয়ে কালও তাড়িয়েছি। আজ আর পারব না। তা ছাড়া
বলতে গিয়ে থেমে রানা একটু হেসেছিল। হেসে বলেছিল—মরণের আগে সব আসে তো। ভয় রানা পাবে না। তা পাবে না। ক্ষমতা থাকলে বলতাম আয়রে বাবা, লড়ি এক হাত। তা ক্ষমতা নাই। একজন লোক থাকলে ভাল হয়। এই এক নম্বর। দু নম্বর হল—মরে গেলে দেহটার একটা ব্যবস্থা চাই। গায়ের লোক ভয়ে যক্ষ্মারোগীর দেহ ছোবে না। তার একটা ব্যবস্থা কোরো। তিন নম্বর হল, ছেলে-মেয়ে। মামরা ছেলে-বাবাও যাবে। তুমি এখানকার ভাল লোক, ক্ষমতাও রাখ, পার তো ওদের দেখো একটু। আর চার নম্বর হল—মশায় আমার কাছে চিকিৎসার দরুন কিছু পাবে। তা মশায়কে বোলো-ওটা আমাকে মাফ দিতে। ব্যস।
বিনয়ের দোকানে বসে শুনলেন মশায়। শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। দু ফোঁটা জল তাঁর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে; দীর্ঘ দাড়ির মধ্যে পড়ে হারিয়ে গেল শিবের জটার গঙ্গার মত। অনেকক্ষণ পর তিনি ডেকে উঠলেন গোবিন্দ গোবিন্দ।
ডাক শুনেই মশায় বুঝতে পারলেন-মরি বোষ্টুমি এসেছে। কিন্তু এই অবেলায়? মরি সাধারণত আসে সকালে; ভিক্ষেয় বের হয়ে তার বাড়িতে আরোগ্য-নিকেতনে এসে অভয়ার পাঠানো প্রসাদী মিষ্টান্ন তাকে দিয়ে ভিক্ষায় বেরিয়ে যায়। অবেলায় এই সন্ধ্যায় বিনয়ের দোকানে সে কোথা থেকে এল? অভয়ার কি আবার অসুখ করেছে? রানার শেষকৃত্য করে ক্লান্ত কিশোর ওপাশের চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে গিয়েছে। মশায় নির্জন অবসরে নিজের নাড়ি ধরে বসে ছিলেন। ওটা একটা অভ্যাসেই দাঁড়িয়ে গিয়েছে। মরির কণ্ঠস্বর শুনে তিনি হাত ছেড়ে দিয়ে ডাকলেন-মরি!
–প্ৰণাম বাবা!
–তুই এই অসময়ে?
মরি হেসে বললে—আজ ফিরবার পথে বাবা। ঝুলি থেকে পাঁচটি আম বের করে নামিয়ে দিলে।
হেসে বললে–মায়ের গাছের আম প্রথম পেকেছে। মা-কালীর জন্যে সব্বাগ্যে কটি তুলে রেখে পাঁচটি আপনার তরে দিয়ে বললে—দিয়ে এসো মরি। তা আজ আবার আমাদের গুপীনাথপুর আখড়াতে অষ্টপ্রহরের ধুলোট ছিল। বৈষ্ণবসেবার রান্নাবান্নার কাজ করে হাত ধন্যি করতে গিয়েছিলাম। ফল জিনিস তো দিবসের মধ্যে নষ্ট হবে না; বরং মজে মিষ্ট হবে, খাবার উপযুক্ত হবে।
বোষ্টুমি মরিদের কথাবার্তার এই ধরনটি আজ বিরল হয়ে এসেছে; কথার ও কণ্ঠস্বরের মিষ্টতা মাধুর্য চিরকালই দুর্লভ; মরির মধ্যে দুই-ই আছে; মশায় ভারি তৃপ্তি পান।
মরি বললে–সেখান থেকেই ফিরছি। সায়ংকালে আজকাল আপনি এইখানে অধিষ্ঠান করেন আমি জানি তো! তাই এইখানে দিয়ে গেলাম।
আঁটির গাছের দেশী আম। কিন্তু শ্রদ্ধার ও কৃতজ্ঞতার মিষ্টতায় ও মাধুর্যে অমৃতফল। মুহূর্তপূর্বের বৈরাগ্য-গৈরিক উদাসীন পৃথিবী যেন এক মুহূর্তে গাঢ় মমতার সবুজে কোমল হয়ে উঠল।
মরি বললে–আর-একটি কথা বলেছেন মা।
–কী কথা?
–এই জ্যৈষ্ঠি মাসে মায়ের সাবিত্রী চতুকদশীর ব্রেতো। সেদিন আপনাকে নেমন্তন্ন করেছে।
মনে পড়ে গেল, শশাঙ্কের মৃত্যু ধ্রুব জেনে তিনি অভয়াকে নিমন্ত্রণ করে পরিপাটি করে আমিষ খাওয়াতে চেয়েছিলেন। মনে পড়ল, গলির মুখে প্রদীপ হাতে ধরে দাঁড়ানো অভয়ার সেই ছবি; আলোর ছটা পড়েছে সিঁথির সিঁদুরের উপর, চোখের তারা দুটির মধ্যে ভাসছে তার প্রতিবিম্ব। শিউরে উঠলেন মশায়! চোখ বুজলেন তিনি। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন– সাবিত্রী চতুর্দশীর ব্ৰতের খাওয়ান রাত্রে। এই বুড়ো বয়সে রাত্রে তো যেতে পারব না মরি!
মরি বললে—সেকথা আমি বলেছিলাম বাবামশায়। তা অভয়া মা বললে–তা তো বুঝি। মরি, কিন্তু আমার ভারি ইচ্ছে হয়। তুই বলে একবার দেখিস। আর একটি কথা বলেছে!
–বল।
–কিছু মাছের জন্যে বলেছে। এবারে ওদের পুকুরে মাছ একেবারে নাই।
মশায় খুশি হয়ে উঠলেন–মাছ! মাছ চেয়েছে অভয়া? তা দেব। পাঠিয়ে দেব।
—আম কটি কিন্তু খাবেন বাবা।
–নিশ্চয় খাব।
পৃথিবীকে মধুর করে দিয়ে চলে গেল মরি।
আবার তিনি ডাকলেন মরিকে—মরি! ওরে মরি!
–বাবা! ফিরল মরি।
–বলিস আমি যাব। সাবিত্রীব্রতে যাব। চলে যাব, ইন্দিরকে সঙ্গে নিয়ে চলে যাব। পৃথিবীতে আজ সব সঙ্কোচ ঘুচে গিয়েছে, সব তিক্ততা মুছে গিয়েছে। তিনি যাবেন।
মনের মধ্যে গান গুনগুন করছিল। নামগান। রাত বেশ হয়েছে। নবগ্রামের লেনদেনের বাজারের আলোগুলোও ঝিমিয়ে পড়েছে। লণ্ঠনের কাছে কালি পড়েছে, পলতেতে মামড়ি জমেছে। শিখাগুলো কোনোেটা দুভাগ হয়ে জ্বলছে, কোনোটার একটা কোণ ঘেঁয়াটে শিখা তুলে লম্বা হয়ে উঠেছে। ডেলাইট পেট্রোম্যাক্সগুলোরও সেই দশা, ম্যান্টেল লালচে হয়েছে, খানিকটা বা কালো, কোনোেটা বা মধ্যে মধ্যে দপদপ করছে। অধিকাংশ ক্যাশবাক্সে চাবি পড়েছে; বাক্সের উপর খেরোবাধা খাতাগুলো থাকবন্দি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ জল ছিটিয়ে ধুনো দিচ্ছে, তালাচাবি হাতে লোক দাঁড়িয়ে আছে, দোকান বন্ধ করবে। ঋজু দত্তের বড় দোকান–ওখানে এখনও থাকবন্দি সিকি-আধুলি সাজানো রয়েছে, নোটর থাক গুনতি হচ্ছে। দোকানটার পাশে একটা ভোলা জায়গায় খানকয়েক গরুর গাড়ি অ্যাঁট লাগিয়েছে, গাড়ির তলায় খড় বিছিয়ে বিছানা পেতেছে। চৌমাথার মোড়ে চায়ের দোকানটায় এখনও জনচারেক আড্ডা জমাতে বসে আছে। ওপাশে সাধুখাদের নূতন একতলা বাড়িটার বারান্দায় চারুবাবু আর প্রদ্যোত বসে রয়েছে। এইটেই ডাক্তারদের কো-অপারেটিভ মেডিক্যাল স্টোর্স। এদের হ্যাজাক-আলো নতুন, এখনও সমান তেজে জ্বলছে।
প্রদ্যোত ডাক্তার কবে ফিরল?
সেই মতির ছেলের মৃত্যুর পর প্রদ্যোত হঠাৎ ছুটি নিয়ে সস্ত্রীক কলকাতা চলে গিয়েছিল। লোকে গুজব করেছিল—প্রদ্যোত ডাক্তার মতির ছেলের মৃত্যুর ওই ব্যাপারটায় মনে মনে খুব ঘা খেয়েছে। সেই লজ্জায় এখান থেকে ট্রান্সফারের জন্য চেষ্টা করতে ছুটি নিয়ে কলকাতা চলে গেল।
সীতা বলেছিল–না। উনি কলকাতায় গেলেন এখানকার ক্লিনিকের জন্যে। বিপিনবাবু পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেলেন, ওই টাকাটা গভর্নমেন্টের হাতে দিয়ে, আরও কিছু স্যাংশন করিয়ে যাতে তাড়াতাড়ি হয় তারই চেষ্টা করতে গিয়েছেন। কলকাতার অ্যাসেম্বলির কোনো মেম্বারকে ধরে চিফ মিনিস্টার ডাঃ রায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। বলে গেছেন—অন্তত যে টাকাটা হাতে পেয়েছেন তা দিয়ে যতটুকু হয়—সেসব কিনে তিনি ফিরবেন।
প্রদ্যোত ডাক্তার শক্ত লোক; তা হলে সে যন্ত্রপাতি নিয়েই ফিরেছে।
সীতা আরও বলেছিল—তবে ডাক্তারবাবু মনমরা একটু হয়েছেন বটে। আপনাকে উনি মুখে যাই বলে থাকুন মনে মনে আপনার ওপর বেশি চটেছেন।
তাই কি? সে কথা মশায়ের ঠিক মনে হয় না। সীতার কথার কঠিন প্রতিবাদ করতে পারেন নি কিন্তু মৃদু প্রতিবাদ করেছেন। বলেছেন নানা। তুমি ভাই, ভুল করেছ।
সীতা ঘাড় নেড়ে প্রতিবাদ করেছে—উঁহুঁ। ভদ্রলোককে আপনি ঠিক জানেন না দাদু। একটি কথা ভুলে যান না উনি। আর অত্যন্ত হামবড়া লোক! এখানকার কোনো ডাক্তারকেই ভাল বলেন না উনি। আপনাকে আমি দাদু বলি, আপনার বাড়ি আসি বলে আমার উপরেও মনে মনে চটা।
দুঃখ পেয়েছিলেন শুনে।
একটি অতি সাধারণ মেয়ে—তার জীবনের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ, শুধু কৃতজ্ঞ এইটুকু মাত্র। এর জন্যে রাগ? সামান্য মানুষ! তার কৃতজ্ঞতা তার প্রশংসা—তার কতটুকু মূল্য? তবে বিচিত্র! কতকাল আগে ওর নিতান্ত শৈশবে মেয়েটিকে বাঁচিয়েছিলেন। সে কথা তিনি নিজেই ভুলে গিয়েছিলেন। মনে করিয়ে দিয়েছিল ওই মেয়েটিই।
উনিশশো তিরিশ সাল। এখানকার সবরেজিস্ট্রি আপিসে এসেছিল এক হেডক্লার্ক। রামলোচন সরকার। একমাত্র বিধবা মেয়ে, স্ত্রী আর বিধবা মেয়ের কোলে একটি শিশু মেয়ে নিয়ে এসে মশায়দের গ্রামেই বাসা নিয়েছিল। এখানে ছিল মাত্র মাস আষ্টেক। ওর মা সরকারের বিধবা মেয়েটির খুব অসুখ নিয়েই এসেছিল। বাঁচবে বলে কেউ আশা করে নি, মশায়ই চিকিৎসা করে বাঁচিয়েছিলেন। এ মেয়েটি তখন কঙ্কালসার শিশু। একত্রিশ সালের আশ্বিনে যে মারাত্মক ম্যালেরিয়ায় শিশুমড়ক হয়েছিল সেই ম্যালেরিয়ায় এ মেয়েটিও যায়যায় হয়, তাকেও তিনিই নাকি বাঁচিয়েছিলেন। সেদিন বাড়িতে এসে পরিচয় দিয়ে ও যখন এসব কথা বললে, তখনও তিনি চিনতে পারেন নিচিনেছিলেন আতর-বউ। বললেন–সেই হাড়জিরজিরে মেয়েটা তুই? এমন হয়েছিস? আমি যে তোকে কত কোলে করে তেল মাখিয়ে রোদে ভেজেছি। তখন তাঁর ধীরে ধীরে মনে পড়েছিল। অত্যন্ত মধুর মনে হয়েছিল। অকস্মাৎ যেন রৌদ্রদগ্ধ আকাশ থেকে একবিন্দু মধু ছিটিয়ে দিয়েছিলেন বিধাতা। পৃথিবীতে এ দুর্লভ কিন্তু মূল্য তো এর কিছু নাই! মধ্যে মধ্যে মনে হয় চিকিৎসক-জীবনে নিদান হকার পাওনা বিধাতা মিটিয়েছেন শশাঙ্কের বউয়ের অভিশাপে, আর মানুষ বাঁচানোর পাওনা মিটিয়েছেন এই সীতা মেয়েটির কৃতজ্ঞতায়। মেয়েটার জ্ঞানও ছিল না তখন, মায়ের কাছে শুনে মনে রেখেছে।
—মশায় নাকি?
আলোকোজ্জ্বল চৌমাথাটায় আত্মগোপন করে যাওয়া যায় না। চারুবাবু ডাক্তার দেখতে পেয়েছেন। দাঁড়াতে হল। মশায় ফিরে দাঁড়িয়ে বললে—হ্যাঁ। বসে আছেন? তারপর প্রদ্যোতবাবু, কবে ফিরলেন? নমস্কার!
প্রতি-নমস্কার করে প্রদ্যোত বললে–আজ চার দিন হয়ে গেল।
—চার দিন? তা হবে। আজ কয়েক দিনই সীতা আসে নি। দেখা হয় নি।
–একবার আসুন গো এখানে। আপনার জন্যেই আমরা বসে আছি। ডাকলেন চারুবাবু।
–আমার জন্যে?
শঙ্কিত হলেন মশায়। আবার কোন অভিযোগ? কী হল? কী করেছেন তিনি? মনের মধ্যে অনেক সন্ধান করলেন। কই কারুর নিদান তো তিনি হাঁকেন নি! তবে কি রানার কথা? এঁরা কি বলবেন যে তিনি আশা দেন নি বলেই হতাশাতে রানা দেবস্থলে চিকিৎসার নামে অচিকিৎসায় মারা গেল? অথবা বলবেন—দেবস্থলে যেতে তিনিই তাকে উৎসাহিত করেছিলেন?
চারুবাবু বললেন– প্রদ্যোতবাবুর স্ত্রীর জ্বর। একবার দেখতে হবে।
–প্রদ্যোতবাবুর স্ত্রীর জ্বর, আমাকে দেখতে হবে?
–হ্যাঁ। কলকাতা থেকেই জ্বর নিয়ে এসেছেন। জ্বরটা যেন কেমন লাগছে–। এন্টেরিক তো বটেই। টাইফয়েডের লক্ষণ রয়েছে। আর চার দিন না গেলে তো রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়বে না। আপনি একবার নাড়িটা দেখুন। টাইফয়েড হলে খুব ভীরু লেন্ট টাইপ; চার দিন আজ, ফার্স্ট উইক এরই মধ্যে জ্বর তিন ছাড়াচ্ছে। প্রদ্যোতবাবু আমাকে ডেকেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে বলতে আমি পারব না। আপনি পারেন। নাড়ি দেখে আপনি পারেন—সে আমি উঁচু গলা করে বলি। ওঁকেও বলেছি। প্রদ্যোতকে দেখিয়ে দিলেন চারুবাবু।
এতক্ষণে প্রদ্যোত কথা বললে–ডায়াগনসিস আপনার অদ্ভুত। আপনি শুধু বলে দেবেন। টাইফয়েড কি না।
একটু হেসে মুখ তুলে ওদের দিকে তাকালেন, এতক্ষণ মাটির দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। মুখ তুলে প্রদ্যোতের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন– চলুন।
লাবণ্যবতী দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটি নেতিয়ে পড়েছে। মুখখানি জ্বরোত্তাপে ঈষৎ রক্তাভ এবং ভারী হয়ে উঠেছে। ভ্রমরের মত কোঁকড়ানো রুক্ষ চুল বালিশের নিচে খোলা রয়েছে, কপালের উপর কতকগুলি উড়ছে। কপালে জলের পটি রয়েছে। চোখ বুজে শুয়ে আছে। স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। ঘরে একটি বিচিত্ৰ গন্ধ উঠছে। ধূপকাঠি, ওডিকোলন, ফিনাইল, ওষুধ—এইসবের একটা মিশ্রিত গন্ধ। মাথার শিয়রে বসে রয়েছে নার্স। সীতা! হ্যাঁ, সীতাই বসে রয়েছে।
বাবা তাঁর নাড়ি-পরীক্ষা বিদ্যার গুরু। তাকে স্মরণ করে তিনি মেয়েটির হাতখানি তুলে নিলেন। সেখানি রেখে আর একখানি। সেখানিও পরীক্ষা করে রেখে দিলেন। জ্বর অনেকটা–সাড়ে তিনের বেশি মনে হচ্ছে। চারের কাছে।
সীতা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতীক্ষা করছে কী বলবেন। প্রদ্যোত ডাক্তার স্ত্রীর মাথার কাছে ঝুঁকে মৃদুস্বরে সস্নেহে ডাকলেন—মঞ্জু!
ভুরু দুটি ঈষৎ উপরের দিকে তুলে চোখ বুজে মেয়েটি সাড়া দিলে–উঁ।
–এখানকার জীবনমশায় এসেছেন তোমাকে দেখতে।
মেয়েটি চোখ খুললে, বড় বড় দুটি চোখ, এদিক থেকে ওদিক চোখ বুলিয়ে মশায়কে দেখে আবার চোখ বন্ধ করলে।
প্রদ্যোত ডাক্তার বললেন–তোমার জিভটা দেখাও তো!
মেয়েটি জিভ দেখালে।
চারুবাবু সীতাকে বললে–থার্মোমিটার দাও।
জীবনমশায় বললেন–থাক। এর আগে কত ছিল?
ডাক্তার একখানা খাতা এনে চোখের সামনে ধরলেন। একশো তিন পয়েন্ট চার।
মশায় ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন–আর কিছু বেড়েছে। আধ ডিগ্রি।
প্রদ্যোত এসে তার কাছে দাঁড়াল, মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলে-টাইফয়েড?
জীবনমশায় একটু দ্বিধা করলেন। বললেন– আজ ঠিক বলতে পারব না। কাল সকালে দেখে বলব। আজ আমার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে।
কিন্তু আমি যে ক্লোরোমাইসেটিন দেব ভাবছি। প্রথম সপ্তাহে জ্বর–বলেই ঘরের দিকে ফিরে বললেন–সীতা, কত দেখলে জ্বরঃ।
সীতা থার্মোমিটার হাতে বেরিয়ে এল, প্রদ্যোত ডাক্তারের হাতে দিয়ে নীরবেই চলে গেল। কিন্তু একটি স্মিতহাস্যে মুখখানি তার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কারণ থার্মোমিটারে কালো দাগটি একশো চারের দাগের এক সুতো পিছনে এসে থেমে রয়েছে। প্রদ্যোত ডাক্তার দেখে বললে–চারই বটে।
জীবনমশায় বললেন–আর আজ বাড়বে না। আমি কাল সকালেই আসব।
–আমি ক্লোরোমাইসেটিন আনিয়েছি। আজ দিতে পারলে–
–কাল। কাল সকালে। এ রোগে আট ঘণ্টায় কিছু যাবে আসবে না। আর–হাসলেন জীবনমশায়। রাগ করবেন না তো?
–না। বলুন।
–আপনি উতলা হয়েছেন। আপনার চিকিৎসা করা তো উচিত হবে না।
–নাঃ! আমি ঠিক আছি। আর আমি তো চিকিৎসা করছি না। চারুবাবু চিকিৎসা করছেন।
পরদিন সকালে জীবনমশায় নাড়ি ধরে দীর্ঘসময় প্রায় ধ্যানস্থের মত বসে রইলেন।
সকালবেলা। প্রসন্ন সূর্যালোকে ঘর ভরে উঠেছে। দরজা জানালা খোলা, ঘরখানিকে ইতিমধ্যেই জীবাণুনাশক ওষুধ-মেশানো জল দিয়ে ধুয়ে মুছে ফেলা হয়েছে। এক কোণে ধূপকাঠি জ্বলছে। বিছনা চাদর পরিচ্ছন্ন। খাটের পাশে টি-পয়ের ওপর ওষুধের শিশি, ফিডিং কাপ, কয়েকটা কমলালেবু, টেম্পারেচার চার্ট। রোগিণী এখন অপেক্ষাকৃত সুস্থ। জ্বর কমেছে। ঠোঁট দুটি শুকিয়ে রয়েছে। আচ্ছন্ন ভাবটা কম। তবু চোখ বুজেই রয়েছে। মধ্যে মধ্যে মেলছে, কিন্তু আবার নেমে পড়ছে চোখের পাতা। কপালে এখন জলের পটি নাই, কপাল মুখ রক্তাভ শুষ্ক। পরিপূর্ণ আলোর প্রসন্নতা এবং বৈশাখের প্রভাতের স্নিগ্ধতার মধ্যেও রোগিণীর যেন স্বস্তি নাই, মধ্যে মধ্যে নাক খুঁটছে।
নাড়ির গতি তিনি অনুভব করলেন, ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল :
মন্দং মন্দং শিথিলং শিথিলং ব্যাকুলং ব্যাকুলং বা–
অতি মন্থর ভারাক্রান্ত পদক্ষেপ স্থলাতিতে চলছে—অসহায় আকুলতার প্রকাশ রয়েছে। তার মধ্যে। যেন যেন ব্যাকুল জীবনস্পন্দন ত্রস্ত হয়ে কোনো আশ্ৰয় খুঁজছে। সান্নিপাতিক। জ্বরের সমস্ত লক্ষণ সুপরিস্ফুট। ত্ৰিদোষের প্রকোপ তীব্ৰ। মনে হচ্ছে–। যাক সে কথা। জীবনমশায় চোখ খুলে তাকালেন হাসপাতালের ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার তারই মুখের দিকে চেয়ে রয়েছেন। সন্তৰ্পণে জীবনমশায় হাতখানি নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন। চাকর দাঁড়িয়ে ছিল সাবান জল তোয়ালে নিয়ে। হাত ধুয়ে মশায় তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বললেন– রোগ টাইফয়েড। নিঃসন্দেহে টাইফয়েডের চিকিৎসা চলতে পারে।
হাসপাতালের ডাক্তার বললেন–সন্দেহ আমারও হয়েছিল। কিন্তু মঞ্জুই আমাকে ধোঁকা ধরিয়েছে; আমরা নিয়মিতভাবে টাইফয়েডের টিকে নিয়ে থাকি। চার মাস আগে ও একবার কলকাতা গিয়েছিল। ছিল মাসখানেক। এই সময়েই আমাদের নতুন ইনঅকুলেশনের সময়টা পার হয়েছে। আমি এখানে ইনঅকুলেশন নিয়ে কে লিখেছিলাম কলকাতায় রয়েছে, নিশ্চয় যেন টি-এ-বি-সি নেবে। ও লিখেছিল—নিলাম। আমি বিশ্বাস করেছিলাম। এখানে ফিরলে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম ভ্যাকসিন নিয়েছ? বলেছিল—নিয়েছি। এবার জ্বর হতে প্রথম দিন থেকে জিজ্ঞাসা করেছিভ্যাকসিন নিয়েছিলে তো? ও বলেছে—নিয়েছি। আজ সকালে স্বীকার করলে, নেয় নি। আমি বললাম—মশায় আমাকে বলে গেছেন টাইফয়েড। তখন বললে–না, নিই নি। যাক এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ক্লোরোমাইসেটিন দেব। চারুবাবু, হরেনবাবু দুই জনেই আসছেন। ওঁরা আসুন—একবার জিজ্ঞেস করে নিই।
সীতা এসে ঘরে ঢুকল। সে স্নান করে সঞ্জীবিত হয়ে এসেছে যেন। সে বড় প্রসন্ন আজ বোধ করি, প্রদ্যোত ডাক্তারের এই স্বীকৃতিতে সে উল্লসিত হয়ে উঠেছে।
চারুবাবুরা এসে পৌঁছুলেন। মশায়কে দেখে বললেন–ব্যস, প্রদ্যোতবাবু, উনি বলছেন তো! তা হলে দিন ক্লোরোমাইসেটিন। নিশ্চিন্তে দিয়ে দিন।
ক্লোরোমাইসেটিন। নূতন যুগের আবিষ্কার। এ নাকি অদ্ভুত ওষুধ।
দুঃসাধ্য টাইফয়েড; সাক্ষাৎ মৃত্যু-সহচরী সান্নিপাতিক; তার গতিবেগ বর্ষার পাহাড়িয়া নদীর প্রচণ্ড বন্যার মত—যাকে ফেরানো যায় না, বাঁধা যায় না। আপন বেগে প্রবাহিত হয়ে বন্যার মতই নিজেকে নিঃশেষ করে তবে ক্ষান্ত হয়। সেই শেষ হওয়ার পর যদি জীবন থাকে। তো রোগী বাঁচে। তাও বাঁচে বন্যাপ্লাবনে মাটি-খুলে-যাওয়া, সমস্ত উর্বরাশক্তি ধুয়ে রিক্ত হয়ে যাওয়া পুদ্যোনের মত। শীর্ণ-ঊষর ভূমিখণ্ডের মত তার অবস্থা হয়।
ব্রজলালবাবুর দৌহিত্রের টাইফয়েডে ব্যাকটিরিওফাজ দেখেছিলেন। সেক্ষেত্রে কাজ করে। নাই। কিন্তু পরে ফাজ ব্যবহারে ফল দেখেছেন। ক্লোরোমাইসেটিন নাকি অমোঘ। সান্নিপাতাশ্রয়ী মৃত্যুকে নাকি তৰ্জনীহেলনে অগ্রগমনে নিষেধ করবার মত শক্তিশালিনী। বৃদ্ধ জীবনমশায় বসে রইলেন উদ্গ্রীব হয়ে, তিনি দেখবেন। শিশি তিনি দেখেছেন বিনয়ের ওখানে আছে কয়েক শিশি। তিন শিশি বোধহয়। একটা কেসে ওই তিন শিশিই যথেষ্ট। কাল থেকেই নাকি জ্বর কমবে। তৃতীয় দিনে জ্বর ছাড়বে। বিস্ময় বৈকি!
প্রদ্যোত ডাক্তার ডাকলে—মঞ্জু! মঞ্জু! হাঁ কর। ট্যাবলেট।
সীতা জল তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে মুখে জল ঢেলে দিলে। চারুবাবু ক্যাপসুলটা মুখে ফেলে দিলেন।
সন্ধ্যায় আবার গেলেন জীবনমশায়। নাড়ি ধরে দেখলেন জ্বর বেড়েছে। আজ বোধহয় সাড়ে চার–মাথার শিয়রে বসে আছে আজ অন্য নার্স। সীতাকে বোধহয় ছুটি দিয়েছে।
পরদিন সকালেও জ্বর কমল না। আগের দিনের থেকে বেশি।
রোগীর আচ্ছন্নতাও বেশি। পেটের ফাঁপ বেশি।
তৃতীয় দিন। আজ জ্বর উপশম হওয়ার কথা। ছাড়ার কথা। কিন্তু কোথায়? মশায় গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কই, ভেষজের ক্রিয়া কই?
হাসপাতালের ডাক্তার–চারুবাবু, হরেন সকলেই চিন্তিত হয়ে উঠলেন—তাই তো! তবে কি?
জীবনমশায় দৃঢ়স্বরে বললেন–রোগ টাইফয়েড। নাড়িতে রোগ অত্যন্ত প্রবল। এইটুকু আমি বলতে পারি।
প্রৌঢ় চারুবাবু অল্পেতেই ভড়কান, এবং অল্পেই উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। তিনি দমে গেছেন।–তাই তো। সংসারে মুনিরও মতিভ্ৰম হয় যে!
জীবনমশায় দৃঢ়ভাবে ঘাড় নাড়লেন–না। ভ্ৰম তার হয় নি।
প্রদ্যোত ডাক্তারের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। বললে—আবার ক্লোরোমাইসেটিন দিন চারুবাবু। নিজের হাতে খুললে শিশি। তুলে দিলে তাঁর হাতে।
সন্ধ্যায় জীবনমশায় দেখলেন প্রদ্যোত ডাক্তার বারান্দায় দু হাতে দুটো রগ ধরে বসে আছে। রোগিণীর মাথার শিয়রে বসে সীতা। সীতাই বললে–রক্তদাস্ত হয়েছে। জ্বর সমান।
জীবনমশায় আজ নিজেই ঘরে ঢুকে রোগীর পাশে বসে হাত তুলে নিলেন। বেরিয়ে এসে প্রদ্যোতের কাঁধের উপর হাত রাখলেন।
প্রদ্যোত মুখ তুললে–মশায়?
–হ্যাঁ। আপনি মুষড়ে পড়বেন না। রক্তদাস্ত হোক। এ রোগে ও তো হয়। এবং হয়েও বাঁচে। রোগীর নাড়ি আমি ভাল দেখলাম। ত্ৰিদোষপ্রকোপের মাত্রা কমেছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন—আমার ভুল হয় নি।
ডাক্তার স্থির দৃষ্টিতে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। জীবনমশায় বললেন– আমি আপনাকে মিথ্যা প্ৰবোধ দিই নি। দীর্ঘক্ষণ বসে রইলেন তিনি।
স্টেশন থেকে একখানা গরুর গাড়ি এসে ঢুকল। দুটি মহিলা নামলেন। দুজনেই বিধবা, একজন অতিবৃদ্ধা। ডাক্তার এগিয়ে গেল।–মা!
—মঞ্জু কেমন আছে বাবা?
—অসুখেই আছে। কিন্তু—ওঁকে আনলেন কেন? ডাক্তার বিরক্ত হয়েছেন। বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করে কথাটা বললেন।
—কোথায় ফেলে দেব বাবা? ও তো আমায় ছাড়বে না।
–কিন্তু কোথায় ওঁকে রাখি? কী করি?
–একপাশে থাকবে পড়ে। এখন আর উপদ্রব করে না। কেমন হয়ে গেছে কিছুদিন থেকে। চুপ করেই থাকে। নইলে আনতাম না।
—আসুন।
জীবন মশায়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন–বসুন ডাক্তারবাবু, যাবেন না। আমি আসছি। ইনিই আমার শাশুড়ির সেই দিদিমা। এই রোগের ঝঞ্ঝাটের উপর উনি হবেন বড় ঝঞ্ঝাট।
বসে রইলেন জীবন ডাক্তার।
বৈশাখের আকাশ। গতকাল দুপুরের দিকে সামান্য একটু ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। আকাশে আজ ধূলিমালিন্য নাই। নক্ষত্রমালা আজ ঝলমল করছে। সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন জীবনমশায়। এমন অবস্থায় মন যেন ফাঁকা হয়ে যায়। কোনো কিছুতে দৃষ্টি আবদ্ধ করে না। রাখলে মন ছুটতে শুরু করবে। কী করলে কী হবে? হাজার প্রশ্ন জাগবে। কোথায় কী হল? কোন ত্রুটি? জীবন হাঁপিয়ে উঠবে। ছুটতে পারে না তবু ছুটবে—ছুটতে হবে।
আকাশের ঝলমলানির মধ্যে মন হারিয়ে যাবার সুযোগ পেয়ে বেঁচেছে।
–মাঃ! মাঃ!
–এই যে মা! মঞ্জু! আমি এসেছি মা।
–মাঃ!
–কী বলছিস? কোথায় যন্ত্রণা? কী হচ্ছে? মঞ্জু?
–আঁঃ! মাঃ!
–কী বলছিস?
–বাবাঃ! আঁ!
জীবনমশায় হাসলেন।
মা! মা বলছেন—এই যে আমি। তবু রোগী ডাকছে—হয়ত বা পাশ ফিরে শুয়ে ডাকছে–মা মা! সুদীর্ঘ চিকিৎসকের জীবনে এ কত দেখে এলেন। হায় রে মানুষ! সে মা কি তুমি? সে মা—আরোগ্যরূপিণী যিনি—তিনি। তাঁর সর্বাঙ্গে অমৃতোর স্পর্শে স্নিগ্ধ হবে রোগীর দেহের রোগজর্জরতা; উত্তাপ কমে আসবে; অশান্ত অধীরতা শান্ত হয়ে আসবে; আচ্ছন্নতার ঘোর কাটিয়ে জাগবে চৈতন্য; জীবকোষে-কোষে জীবনবহ্নির দাবদাহের প্রজ্বলন সংবৃত হয়ে স্নিগ্ধ হয়ে জ্বলবে প্রদীপের মত। সকলযন্ত্রণাহরা সর্বসন্তাপহরা আরোগ্যরূপিণী তিনিই মা; কে তিনি জানেন না। কিন্তু তিনি অমৃতরূপিণী অভয়া; মৃত্যু তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে নমস্কার করে চলে যায়। মুহূর্তের জন্য চঞ্চল হলেন মশায়। মনে হল মৃত্যু এসে যেন দাঁড়িয়েছে ঘরের মধ্যে। কোনো কোণে সে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে রয়েছে। রোগিণী বোধ করি তারই আভাস অনুভব করে ডাকছে, সেই অমৃতরূপিণীকে। সতর্ক হয়ে তিনি রোগিণীর দিকে চেয়ে রইলেন।