Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সমস্ত রাত্রি জীবন মশায়ের ঘুম হল না। মনের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে গেল সর্বক্ষণ। শশাঙ্ক, শশাঙ্কের স্ত্রী, বনবিহারী, বনবিহারীর স্ত্রী, আতর-বউ, বিপিন, বিপিনের স্ত্রী, রতনবাবু যেন তাঁর শয্যা ঘিরে বসে ছিল। রতনবাবু, বিপিন, বিপিনের স্ত্রী তাকে বার বার প্রশ্ন করেছে—বলুন, আপনি বলুন। শশাঙ্ক, বনবিহারী, ওদের স্ত্রী, আতর-বউ ভ্রূ কুঞ্চিত করে ইশারা করেছে, নানা-না।

নিজেকেও তিনি বার বার বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। মনে পড়ছে—তাঁর বাবা বলেছিলেন নিদান দেবার সময় সর্বাগ্রে অন্তরে অনুভব করতে হয় পরমানন্দ মাধবকে। তার প্ৰসাদে জন্মমৃত্যু জীবনমরণ হয়ে ওঠে দিবা এবং রাত্রির মত কালো এবং আলোর খেলা, পরমানন্দময়ের লীলা। তখন সেই মন নিয়ে বুঝতেও পারবে নাড়ির তত্ত্ব এবং বলতেও পারবে অসঙ্কোচে। জিজ্ঞাসিত না হয়ে এ কথা বলার বিধি নয়—তবে ক্ষেত্র আছে, যেক্ষেত্রে জিজ্ঞাসিত না হয়েও নিজে থেকেই তোমাকে বলতে হবে। পরমার্থ-সন্ধানী বৃদ্ধকে বলতে হবে, বলতে হবে বিশ্বাসবশে মুক্তির অভিপ্ৰায়ে বা আপনার বৈরাগ্যকে পরিপূর্ণ করে তুলবার জন্য যদি কোনো কাম্যতীর্থে যাবার বাসনা থাকে তবে চলে যান। কোনো গুপ্ত কথা যদি গোপন। দুশ্চিন্তার মত অন্তরে আবদ্ধ থাকে তাকে ব্যক্ত করে নিশ্চিন্ত হোন। কোনো ভোগবাসনা বা মমতাসংক্রান্ত বাসনা যদি মনে অতৃপ্তির আকারে নিদ্রার মধ্যে স্বপ্নের ছলনায় আপনাকে ছলিত করে—তবে তা পূর্ণ করে পূর্ণ তৃপ্তি সঞ্চয় করে নিন।

আর-এক ক্ষেত্রে নিজে থেকে বলতে হবে রোগীর আত্মীয়কে-স্বজনকে। সেক্ষেত্রে রোগী বৃদ্ধ না হলেও, পরমার্থ-সন্ধানী না হলেও বলতে হবে। কর্মী সম্পদশালী রোগী—যিনি সংসারে, সমাজে বহু কর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, জড়িত, যার উপর বহুজন নির্ভর করে, তার ক্ষেত্রে অবশ্যই বলতে হবে তোমাকে। তাঁর আত্মীয়স্বজনকে বলবে; কারণ ওই মানুষটির মৃত্যুতে বহুকর্ম বহুজন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক্ষেত্রে পূর্বাহ্নে জানতে পেরে তার যতটুকু প্রতিকার সম্ভব হতে পারবে।

আর এক ক্ষেত্রে বলতে হবে। যে ক্ষেত্রে রোগী প্রবৃত্তিকে রিপুতে পরিণত করে মৃত্যুকে আহ্বান করে নিয়ে আসছে—সেই ক্ষেত্রে তাকে সাবধান করবার জন্য জানিয়ে দেবে, প্রবৃত্তিকে

সংযত কর বাপু!

প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই পরমানন্দ মাধবকে অনুভব করা প্রয়োজন। কিন্তু সে মাধবকে এ জীবনে তার পাওয়া হল না। তিনি কী করে রতনকে বলবেন? না, সে তিনি পারবেন না। মমতার সংসারে আশ্বাসই আশ্ৰয়, আশাই অসহায় মানুষের একমাত্র সুখনিদ্রা; জ্ঞানের চৈতন্যের কোনো প্ৰয়োজন নাই।

কালই তিনি হরেনকে বলে আসবেন। এ তিনি পারবেন না! রনবাবুকে সে যেন বলে। দেয়—জীবন মশায়ের মতিভ্রংশ হয়েছে, তিনি আর কিছু বুঝতে পারেন না। বড় ভুল হয়ে যায়। গতকালের নাড়ির অবস্থা পরদিন মনে থাকে না। অনেক বিবেচনা করেই তিনি বলেছেন তিনি আর আসবেন না।

ভোরবেলাতেই বিছানা থেকে উঠলেন তিনি।

না, আর না। বিপিন আরোগ্যলাভ করুক। মতির মা সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক। দাঁতু বেঁচে উঠুক। তাঁর সব উপলব্ধি, সব দর্শন ভ্রান্ত মিথ্যা হয়ে থাক।

নিচে নেমে প্রাতঃকৃত্য সেরে দাওয়ায় এসে বসলেন। সমস্যা এক জঁ বিকার। তা চলে যাবে।

উপার্জন অনেক করেছেন। জীবনে লক্ষ টাকার বেশি উপার্জন করেছেন—সব খরচ করে দিয়েছেন। ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকার মত ওষুধের দাম বাকি পড়ে শেষ পর্যন্ত আদায় হয় নি। মেয়েদের বিয়েতে দেনা করেছিলেন, যাদের বাড়িতে দেনা—তাদে, বাড়ি চিকিৎসা করে ফিজ নেন। নি। আশা করেছিলেন—সুদটা ওতেই কাটান যাবে। কিন্তু তা যায় নি, তারা দেন নি। সুদে আসলে নালিশ, ডিক্রি করে সম্পত্তি নিলাম করে নিয়েছেন। কোনো আক্ষেপ নাই তাতে। তবে হ্যাঁ, যতটুকু জীবনে প্রয়োজন—ততটুকু থাকলে ভাল হত। রাখা উচিত ছিল। তা তিনি রাখতে পারেন নি। সংসারে হিসেবি বিষয়ী লোক তিনি হতে পারলেন না। লোকে বলে, জগদ্বন্ধু মশায়ের ঘরে দুধেভাতে জন্ম, নিজে দু হাতে রোজগার করেছে। নাড়ি টিপে পয়সা। হিসেব শিখবেই বা কখন–করবেই বা কেন? ভেবেছিল চিরকাল এমনিই যাবে। দু হাতে রোজগার করে চার হাতে খরচ করেছে।

তাও খানিকটা সত্য বটে বৈকি। কিন্তু ওইটাই সব নয়। না–তা নয়।

আতর-বউ বলেন—এ সংসারে মনই কোনোদিন উঠল না মশায়ের। তেতো, বিষ লাগল চিরদিন। আমি যে তেতো, আমি যে বিষয় হত সে, অমৃত হত সব। তখন দেখতে সে অর্থাৎ মঞ্জরী! কথা শেষ করে হাসেন আতর-বউ, সে যে কী হাসিসে কেউ বুঝতে পারবে না; তাঁর সামনে ছাড়া তো ও হাসি আর কারও সামনে হাসেন না।

এও খানিকটা সত্য। মশায়ও দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হাসেন, মনে মনে বলেন-সংসারকে তোমরা তেত করে দিয়েছ তাতে সন্দেহ নেই। তুমি, বনবিহারী, মেয়ে, জামাই সকলে; সকলে মিলে। তবে তোমার বদলে মঞ্জরী হলেও সংসার অমৃতময় হত না। এবং তাতেও তার সংসারে আসক্তি হত না। না। হত না।

তাঁর মনের একটা কোণ তোমরা কোনোদিন দেখতে পাও নি। মনের সে কোণে তার জীবনের শ্মশান-সাধনার আয়োজন। সেখানে অমাবস্যার অন্ধকারে নিজেকে ঢেকে রেখেছেন। আজীবন। অহরহ সেখানে মধ্যরাত্রি। মৃত্যু, মৃত্যু আর মৃত্যু। এই নামেই সেখানে জপ করে গেলেন আজীবন। মৃত্যু অমৃতময়ী হয়ে দেখা দেয়, বলেছিলেন তাঁর বাবা। সেই রূপ দেখবার যার সাধনা সে বিষয়ের হিসেব, বস্তুর যত্ন করবে কখন? নইলে যে রোজগারটা জীবনে তিনি করেছিলেন—তাতে কি তোমাকে পালকিতে চড়িয়ে নিজে সাদা ঘোড়ায় চেপে কাঁদী ঘুরে আসতে পারতেন না! সাদা ঘোড়া তো হয়েছিল। গহনাও তোমার কম হয় নি; পালকি বেহারার খরচ আর কত? তুমি তো জান না, রোগীর মৃত্যুশয্যার পাশ থেকে উঠে চলে আসবার সময় রোগীর আপনজনেরা যখন ডাকত একটু দাঁড়ান মশায়, আপনার ফি। হাত পেতে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আসতেন সেই বিচিত্র রূপিণীকে; আজও আসেন। এই পরিণাম মহাপরিণাম। অনিবার্য অমোঘ। বার বার প্রশ্ন করেছেন-কী রূপ? কেমন? বর্ণে গন্ধে স্পর্শে স্বাদে সে কেমন? কেমন তার কণ্ঠস্বর? বাবার বলা কাহিনীর রূপও এ সময়ে মনকে পরিতুষ্ট করতে পারে না।

হঠাৎ ধূমকেতুর মত শশী এসে উপস্থিত হল। এই আশ্বিন মাসেই শশী তার ছেড়া ওভারকোট চড়িয়েছে। হাতে কো। এই সকালেই চোখ দুটো লাল। নেশা করেছে, কিন্তু মদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না, গাঁজার গন্ধও না, বোধহয় ক্যানাবিসিন্ডিকা খেয়েছে। বিনা ভূমিকায় বললে রামহরে বেটা আজ উইল রেজেস্ট্রি করতে আসছে। আপনাকে সাক্ষী করবে। রামহরের এই শেষ বউকে কিছু দেওয়াতে হবে আপনাকে। আর আমার ফিয়ের অনেক টাকা বাকি, তা ঝকমারুকগে গোটা বিশেক টাকা আমাকে দেওয়াবেন।

শশী বসল চেপে।

শশীকে কী বলবেন—তাই ভাবছিলেন তিনি। হঠাৎ বাইসিক্লের ঘণ্টার শব্দে আকৃষ্ট হয়ে মুখ ফেরালেন তিনি। বাইসিক্ল আজকাল অতি সাধারণ যান, আশপাশে গ্রামের চাষীর ছেলেরাও আজকাল বাইসিক্ল কিনেছে। তবু ওর ঘণ্টার একটা আকৰ্ষণ আছে। এ গ্রামে বনুই প্রথম বাইসি কিনেছিল।

বাইসিক্ল দুখানা। প্রদ্যোত ডাক্তার আর তার বন্ধু দুজনে চলেছে। এদিকে এত সকালে কোথায় যাবে?

প্রদ্যোত ডাক্তার নেমে পড়ল সাইক্ল থেকে। বন্ধুটি একটু এগিয়ে গিয়ে নামল। প্রদ্যোতবাবু হঠাৎ নেমেছে বোধহয়।

–নমস্কার!

প্রত্যাশা করেন নি মশায়। একটু যেন চমকে উঠেই প্রতিনমস্কার করলেন–নমস্কার!

অহীন্দ্র সরকারের বাড়িটা কোথায় বলুন তো? বলে এল—আপনার বাড়ির কাছাকাছি।

—অহীনের বাড়ি? এই তো, এই গলিটা ধরে যেতে হবে। ওদের বাড়ি যাবেন?

–হ্যাঁ। একটু হাসলেন প্রদ্যোত ডাক্তার। অহীনবাবুর জামাই আমার ক্লাসফ্রেন্ড। একসঙ্গে আই. এস. সি. পড়েছিলাম। তার ছেলের অসুখ।

অহীনের জামাইয়ের ছেলে? দৌহিত্র? অতসীর ছেলে তা হলে? মতির মাকে যেদিন দেখে গঙ্গাতীর যাবার কথা বলেছিলেন সেদিন ফিরবার পথে মদনের ছেলে বদনের সঙ্গে জল ঘেঁটে খেলা করছিল একটি ছোট ছেলে—চোখ-জুড়ানো—যশোদা দুলালের মত ফুটফুটে ছেলেটি, সেই ছেলেটি? তার অসুখ? তিনি এই বাড়ির দোরে রয়েছেন—তাকে ডাকে নি, দেখায় নি? কী অসুখ?

ততক্ষণে গলির মধ্যে ঢুকে গেছে প্রদ্যোত এবং তার বন্ধু।

—আজকাল লোকের খুব পয়সা হয়েছে, বুঝলেন মশায়। মেলা পয়সা। আপনাকে আমাকে। দেখাবে কেন? অথচ অহি সরকারের বাবার কত্তাবাবার আমল থেকে আপনারা চিরকাল বিনা পয়সায় দেখে এসেছেন।

মশায় অকস্মাৎ দাওয়া থেকে পথের উপর নেমে পড়লেন। ধরলেন ওই গলিপথ। অহি সরকারের বাড়ির দিকে।


শশী অবাক হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সে বলে উঠল—এরই নাম মতিচ্ছন্ন। দেবে, প্রদ্যোত ডাক্তার ঘাড় ধরে বের করে দেবে।

বছর চারেকের শিশু। জ্বরে আচ্ছনের মত পড়ে আছে। এদিকের কৰ্ণমূল থেকে ওদিকের কৰ্ণমূল পর্যন্ত গোটা চিবুকটা ফুলেছে, সিঁদুরের মত টকটকে লাল।

প্রদ্যোত ডাক্তার দেখছে। বন্ধুটিও দেখছে। মা বসে আছে শিয়রে, অহি এবং একটি প্রিয়দর্শন যুবা দাঁড়িয়ে আছে পাশে। মশায় গিয়ে ঘরে ঢুকলেন। নীরবে পিছনে দাঁড়িয়ে রইলেন।

একটা বিষম যন্ত্রণা চলছে রোগীর দেহে, রোগীর অনুভবশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। চেতনা বোধ। করি বিলুপ্তির মুখে।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মশায়। কোনো ছায়া পড়েছে কি? বুঝতে পারছেন না। দৃষ্টিশক্তি তারও ক্ষীণ হয়ে এসেছে।

প্রদ্যোত দেখা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। মুখ গম্ভীর, চিন্তান্বিত। তার চোখ পড়ল মশায়ের উপর।

—আপনি!

–আমি একবার দেখব।

তিনি এগিয়ে এলেন রোগীর দিকে। বিছানায় বসে পড়লেন।

অপ্রস্তুত হল অহি সরকার। অতসীও হল। শশী মিথ্যা বলে না। আজ তিন পুরুষ ধরে মশায়দের প্রীতির জন্য সরকারদের চিকিৎসা খরচ ছিল না। আজ তাকে উপেক্ষা করে–।

অহি বললে—দেখুন না, কোথা থেকে কী হয়। কাল সকালে জামাই এল। ছেলেটা কোলে নিলে, বললছোট একটা ফুসকুড়ি হয়েছে, একটু চুন লাগিয়ে দাও। সন্ধেবেলা কাঁদতে লাগল-বড় ব্যথা করছে। ফুসকুড়িটা মুড়ো ফোড়ার মত মুখটুক নাই—একটু বেড়েছে। দেখলাম। তারপর সারারাত ছটফট করেছে, জ্বর এসেছে। সকালবেলায় দেখি মুখ ফুলেছে আর জ্বর, শ-চেতন নাই। আমি আপনাকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম, তা জামাই বললে—এ তো ফোড়াটোড়ার জ্বর, হয়ত কাটতে হবে, কি আর কিছু করতে হবে। এতে ওঁকে ডেকে কী করবেন? তা কথাটা মিথ্যেও বলে নি। তার ওপর হাসপাতালের ডাক্তারবাবু জামাইয়ের ক্লাসফ্রেন্ড। তা আমি বললাম—তোমার ধন-তুমি যাকে খুশি দেখাও বাপু। আমার কী দায় এতে কথা বলতে!

মশায় ছেলেটিকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। প্রদ্যোত ডাক্তার ততক্ষণে বেরিয়ে চলে গিয়েছে। বাইসিক্লে চড়েই চলে গিয়েছে ওষুধ আনতে। ইনজেকশন দেবে। পেনিসিলিন ইনজেকশন।

ছেলেটির মা অতসী ব্যথভাবে বলে উঠল—কেমন দেখলে মশায়দাদু? আমার ছেলে কেমন আছে? কী হয়েছে?

হেসে মশায় বললেন–গাল-গলা ফুলে জ্বর হয়েছে ভাই! ভয় কী? ডাক্তারবাবুরা রয়েছেন আজকাল ভাল ভাল ইনজেকশন উঠেছে। ভাল হয়ে যাবে।

চলে এলেন তিনি; যেমনভাবে এসেছিলেন ঠিক তেমনিভাবেই বের হয়ে এলেন। অহি। সরকার পিছনে পিছনে এসে রাস্তায় নেমে ডাকলে—কাকা!

–অহি?

–কী দেখলেন?

—নাড়ি দেখে আর কতটা বুঝব বল? তবে জ্বরটা বাড়বে।

–এখনই তো—

সে বলবার আগেই মশায় বললেন–দুই হবে-একটু ওপরেই। কম নয়।

–হ্যাঁ, দুই পয়েন্ট দুই। আরও বাড়বে?

–বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে, বাবা।

–গাল-গলা ফোলা? এমন লাল হয়ে উঠেছে। সামান্য ফোড়া!

–এঁরা তো রক্ত পরীক্ষা করছেন। দেখ। নাড়ি দেখে বলে যে বেকুব হতে হবে বাবা!

চলে এলেন তিনি, আর দাঁড়ালেন না। বাড়ির দোরে তখন দুখানি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একখানা পরান খাঁয়ের, অন্যখানা রামহরি লেটের। রামহরি উইলে সাক্ষী করাতে এসেছে।

শশী পালিয়েছে রামহরিকে দেখে।


পরানের স্ত্রী অন্তর্বত্নী। পরান খুশি হয়েছে। একটু লজ্জিতও যেন, সেইটুকু ভাল লাগল মশায়ের। মনটা ভাল থাকলে হয়ত একটু রসিকতাও করতেন। অন্তত মসজিদে-দরগায়দেবস্থানে মানত মানতে বলতেন; বলতেন—তা হলে একদিন খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা কর পরান। এবার সন্তান হয়ে বাঁচবে। বুঝেছ? আর বিবিরও সব অসুখ সেরে যাবে। কিন্তু মনটা বিমর্ষ হয়ে আছে। চৈতন্য এবং অচৈতন্যের মাঝখানে বিহ্বল অবস্থার মধ্যে উপনীত অতসীর ওই ছেলেটির কথাই তাঁর মনকে বিষণ্ণ করে রেখেছে। এখানে রিপু নাই, প্রবৃত্তির অপরাধ নাই–প্রতিষ্ঠা, সম্পদ, লালসা, লোভ-কোনোটার বিশেষ আকর্ষণে বাঁচবার বাসনা উদগ্র নয়। নবীন জীবন বাড়বার, পূর্ণ হবার জন্য বাঁচতে চায় প্রকৃতির প্রেরণায়। কী প্রাণপণ কঠোর যুদ্ধ! নিজের দাবিতে সে যুদ্ধ করছে। প্রচণ্ড দাবি। প্রচণ্ডতম। নিষ্ঠুর ব্যাধিটা দেখা দিয়েছে কালবৈশাখী ঝড়ের মত। একবিন্দু কালো মেঘে যার আবির্ভাবসে কিছুকালের মধ্যেই ফুলে ফেঁপে ছেয়ে ফেলবে, ফেলতে শুরু করেছে। তাণ্ডব এখনও শুরু হয় নি। তবে খুব দেরি নাই। দেরি নাই। নাড়ি ধরে তিনি বাতাসের শো শে ডাকের মত সে ডাক যেন অনুভব করেছেন। দূরের প্রচণ্ড শব্দের ধ্বনি যেমন মাটিতে অনুভব করা যায়, ঘরের দরজা জানালায় হাত দিয়ে স্পর্শে অনুভব করা যায়, তেমনিভাবেই অনুভব করেছেন। এ ছাড়া আর উপমা নাই। বিষজর্জরতার মত একটা জর্জরতা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। গতি তার উত্তরোত্তর বাড়বে—ঝড়ের সঙ্গে মেঘের মত জ্বরের সঙ্গে বিষজর্জরতাও বাড়বে।

গাড়ি এসে থামল আরোগ্য-নিকেতনের সামনে। কে বসে আছে? শশী? আর ওটা? বিনয়? নবগ্রামের বি-কে স্টোর্সের মালিক! কাল ও আসবে বলেছিল বটে।

শশী তাঁকে দেখবামাত্র উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।—আজ আমি ছাড়ব না, পায়ের ধুলো নোব। জয় গুরুদেব। অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরং-তৎপদং দৰ্শিতং যেন তস্মৈ শ্ৰীগুরুবে নমঃ।

রামহরির উইলে মশায় তার শেষ স্ত্রীকে পাঁচ বিঘে জমি দিতে রামহরিকে রাজি করিয়েছেন। রামহরি শশীকেও পনেরটা টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। মশায় তাকে বাঁচিয়েছেন তিনি তাঁর পূর্বজন্মের বাপ-তার আজ্ঞা সে কি লঙ্ন করতে পারে? রামহরিরা বিচিত্র। ওরা সারা জীবনটাই পাপ করে যায়, কোনো নীতিধৰ্মই মানে না, কিন্তু দুটি একটি নীতি যা মানে তা কোনো কালে লঙ্ঘন করে না।

–তারপর? বিনয়কুমার, তোমার সংবাদ? বিনয় চুপ করেই বসে আছে। মুখর মানুষ সে। জীবনের সাফল্যের উল্লাস অহরহই যেন ভেসে বেড়ায় দুরন্ত হাওয়ার মত। দুরন্ত কিন্তু উত্তপ্ত হাওয়া নয় বিনয়; সার্থক ব্যবসাদার মানুষ, বর্ষার জলভরা মেঘের স্পর্শে সজল এবং শীতল। বিনয় মিষ্টভাষী মানুষ।

বিনয় বললে—আমার মশায়, অনেক কথা। সংসারে মানুষ দু রকম, এক কমবক্তা আর এক উদ্বক্তা। আমি একেই উক্তা, তার উপর অনেক কথা। শশী ডাক্তারের হোক, তারপর বলছি আমি।

–কথা অনেক থাকলে কাল আসিস বিনয়। আজ আমার মনটা ভাল নয়।

–কী হল?

–বোস। আসছি আমি।

বেরিয়ে এলেন মশায়। অতসীর ছেলেটি কেমন আছে? ছেলেটির সেই ফুটফুটে মুখখানি চোখের উপর ভাসছে। তার আজকের রোগক্লিষ্ট অর্থ-চেতনাহীন বিহ্বল দৃষ্টি মনে পড়ছে। তার চিবুক থেকে কৰ্ণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত রক্তরাঙা স্ফীতিটাকালবৈশাখীর মেঘ কতটা ছড়াল? ঝড় কতটা বাড়ল?

বেরিয়ে এসেও থমকে দাঁড়ালেন। যাবেন তিনি? উচিত হবে?

কে বেরিয়ে আসছে? প্রদ্যোত ডাক্তারের সেই বন্ধুটি নয়? হ্যাঁ, সেই তো!

মশায়ই আজ নমস্কার করলেন-নমস্কার। আবার ওখানে গিয়েছিলেন কি?

–নমস্কার। হ্যাঁ, ছেলেটির রক্ত নিলাম, পরীক্ষা করে দেখব।

–কিন্তু সে তো সদরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করবেন। ফল অন্তত কাল না হলে এখানে জানতে পারবেন না।

–হ্যাঁ। কিন্তু তা ছাড়া তো উপায় নাই। তবে পেনিসিলিন দেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছেস্ট্রেপ্টোককাস ইনফেকশন হয়েছে। হবেও তাই। দেখি।

—স্ট্রেপ্টোককাস ইনফেকশন?

–হ্যাঁ। আপনারা যাকে বলেন সান্নিপাতিক। গলার ভিতরে ঘা দাঁড়াবে ছোট ছোট মটরের মত।

—খানিকটা ডাক্তারি পড়েছিলাম-বাড়িতে। স্ট্রেপ্টোককাস শুনেছি। গলায় ঘা দেখেছি। অবিশ্যি সাধারণ লোকে ওকে সান্নিপাতিক বলে। আসলে সান্নিপাতিক ভিন্ন ব্যাপার। সে খুব কঠিন। কিন্তু–

–কিন্তু কী? আপনার মতে কী?

–জ্বর এখন কত দেখে এলেন?

–একশো তিন। কিছু কম। পেনিসিলিন পড়েছে, পেনিসিলিনের জন্যেও জ্বর একটু বাড়বে।

–না। এ জ্বর ওর রোজই বাড়ছে ডাক্তারবাবু। আমি পাস করা ডাক্তার নই, তবে চিকিৎসা অনেক করেছি। এর মেয়াদ চব্বিশ ঘণ্টা। একটা প্রচণ্ড বিষ ঢুকেছে রক্তে। ফুলো কতটা

বেড়েছে?

অরুণেন্দ্র ডাক্তার অভিভূত হয়ে গিয়েছিল এই বৃদ্ধের কথার আন্তরিকতায়। জ্ঞানের, অনুভূতির আভাসও সে অনুভব করছিল। মনে মনে চিন্তা করতে করতেই অরুণেন্দ্ৰ উত্তর দিলে অনেকটা বেড়েছে। বাড়ছে। আমাদের ধারণা স্ট্রেপ্টোককাস ইনফেকশন হয়েছে খুব বেশি। বিকেল পর্যন্ত গলায় ঘা দেখা দেবে। আপনি বলছেন–

—আমি বলছি—আমার আমলের চিকিৎসায় এ রোগের আক্রমণ যা প্রবল তাতে সারবার। নয় ডাক্তারবাবু। আমি পারি না। আপনারা ভাগ্যবান—এ আমলে অদ্ভুত ওষুধের সাহায্য পেয়েছেন। যা করবার সময়ে করুন। ঝড়ের মতন আসছে রোগের বৃদ্ধি। টেকাতে পারলেন তো থাকল, নইলে—। আমার এই কথাটা বিশ্বাস করুন।

—আমি বিশ্বাস করি মশায়। আমি বিশ্বাস করি। প্রদ্যোত অবশ্য একটু উগ্র। ছেলেও ও ভাল ছিল আমার চেয়ে। আমি ওকে গিয়ে বলছি।

সাইকেল চেপে সে চলে গেল।

কী হল গুরুদেব? আবার কী হল প্রদ্যোতের সঙ্গে? মশায়ের ঘন পাকা ভুরু দুটি কুঞ্চিত হয়ে উঠল। শশী? এখনও রয়েছি? আজ বাড়ি যা। আজ বাড়ি যা।

—বাড়ি যাব; এই বিনয়ের সঙ্গে যাব।

বিনয় যাবে পরে। তুই যা। তোর কাজ তো হয়ে গিয়েছে।

বিনয় হেসে বললে—শশী ডাক্তার যাবে কী? সঙ্গ নইলে যেতে পারবে না। একা পথ হাঁটলেই ওর মা পাশে পাশে ফিরবে।

—কে?

—ওর মা গো! মরেও বেচারি ছেলের মায়া ভুলতে পারছে না। শশী কোথায় নালায় পড়বে, কোথায় কোন গাছতলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বে—তাই সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। জিজ্ঞেস করুন না শশীকে!

শশী নাকি বলে—তার মরা-মা তার আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাকে পাহারা দেয়। লোক থাকলে অবশ্য থাকে না। কিন্তু শশী একলা পথ চললে তখনই বুঝতে পারে যে তার মাও সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। সে নাকি তার কথাও শুনতে পায়! পথ ভুল হলে, কি খানা-খন্দ থাকলে তাকে সাবধান করে দেয়—দেঁখিস পঁড়ে যাঁবি।

বিনয় হাসলে। জীবনমশায় কিন্তু হাসলেন না।

শশীর মাকে ওরা জানে না যে। তিনি জানেন। এমন মা আর হয় না। সন্তানকে স্নেহ করে কোন মা? কিন্তু শশীর মায়ের মত স্নেহ তিনি দেখেন নি।।

শশীকে শুধু শশী বলে আশ মিটত না, বলতেন—শশীচাঁদ! আমার পাগল গো! একটু আধটু মদ খায়, নেশা করে—তা ধরে ফেলেছে—করবে কী বল?

যৌবনে শশী দুর্দান্ত মাতাল হয়ে উঠেছিল। দেশে ম্যালেরিয়া লাগল। শশী চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির কম্পাউন্ডার। চার আনা আট আনা ফি। কুইনিন আর ম্যাগসাল ওষুধ—ওই ডিসপেনসারি থেকেই নিয়ে আসে। রােজগার অনেক। তখন শশী চিকিৎসাও খারাপ করত না। ডিসপেনসারির কাজ সেরে শশী প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে বের হত। সর্বপ্রথম খেয়ে নিত আউন্স দুয়েক মদ। তার আগে ডিসপেনসারিতেও আউন্স দুয়েক হত। খেয়ে বােতলে জল মিশিয়ে রেখে দিত। জিনিসটা না থাকলে খানিকটা রেকটিফায়েড স্পিরিটেই জল মিশিয়ে খেত। রােগী দেখা শেষ করে শশী ফিরবার পথে ঢুকত সাহাদের দোকানে। তারপর শুয়ে পড়ত, হয়। সেখানেই, নয়তো পথের ধারে কোনোখানে কোনো গাছতলায়। শশীর মা দাড়িয়ে থাকতেন বাড়ির গলির মুখে পথের ধারে। ক্রমে এক-পা এক-পা করে এগিয়ে, শেষে এসে উঠতেন সাহাদের দোকানে। শশীর প্রতি স্নেহের কাছে লজ্জা তার হার মানত। এসে ডাকতেন—সাহা!

—কে? মাঠাকরুন! এই, এই আছেন শশীবাবু আছেন।

—একটু ডেকে চেতন করিয়ে দাও বাবা।

মায়ের ডাকে শশী টলতে টলতে উঠে আসত। মা নিয়ে আসতেন তার জামা হুঁকো কল্কে স্টেথোসকোপ! শশী বলত—ওগুলো নে।।

বৈশাখের ঝা-ঝ-করা দুপুরে গামছা মাথায় দিয়ে শশীর মায়ের ছেলের সন্ধানে বের হওয়ার একটি স্মৃতি তার মনে আছে। জীবনমশায় কল থেকে ফিরছেন গরুর গাড়িতে। পৃথিবী যেন পুড়ে যাচ্ছে। রাস্তায় জনমানব নাই, জন্তু-জানোয়ার নাই, কাকপক্ষীর সাড়া নাই, অস্তিত্ব নাই। এরই মধ্যে শশীর গৌরবর্ণা মোটাসোটা মা আসছিলেন, মধ্যে মধ্যে দাঁড়াচ্ছিলেন, এদিকওদিক দেখছিলেন। সাহাদের দোকানে সেদিন ছেলের সন্ধান পান নি। সাহা বলেছে, শশীবাবু আজ বাইরে কোথা খেয়ে এসেছেন; দোকানে ঢােকেন নি। গিয়েছেন এই পথ ধরে। মা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন; তা হলে নিশ্চয় রাস্তায় কোথাও পড়ে আছে।

পড়েই ছিল শশী, পথের ধারে একটা বটগাছতলার ছায়ায় শুয়ে বমি করে জামায় কাপড়ে মুখে মেখে পড়ে আছে; পাশে বসে একটা কুকুর পরম পরিতোষের সঙ্গে তার মুখ লেহন করে উগীরিত মাদক-মেশানো খাদ্য খেয়ে মৌজ করছে। মা তাকে ডেকে তুলতে চেষ্টা করে তুলতে পারেন নি। জীবনমশায় তার গাড়ােয়ানকে দিয়ে শশীকে তুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

মত্ত শশী উঠে জীবন মশায়কে দেখে বলেছিল—কথাটা আজও মনে আছে জীবন মশায়ের। বলেছিল—মশায়বাবু গুরুদেব, চলে যান আপনি! মা ছুঁয়েছে—আমি ঠিক হয়ে গিয়েছি; আমার। মায়ের একবিন্দু চোখের জল পৃথিবী ড়ুবিয়ে দিতে পারে মহাশয়! ইয়েস, পারে। আলেকজান্ডার দি গ্রেটের কথা স্যার! অ্যান্টিবোডাস ডাজ নট নো-অ্যান্টিবোডাস জানে না আমার মায়ের একবিন্দু চোখের জল—!

জীবনমশায় ধমক দিয়ে বলেছিলেন—যা—যা, বাড়ি যায়।

—যাব, নিশ্চয় যাব! নিজেই যাব! কারুর ধমক খাই না আমি।

খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার বলেছিল–হু ইজ টু অ্যাভিসিয়েট মাই মেরিটস? মাই মাদার! মাই মাদার।

মা লজ্জিত হয়ে শুধু একটি কথাই বার বার বলেছিলেন-বাড়ি চল শশী। বাড়ি চল! বাড়ি চল!

সেই মা যদি মরণেও শশীর মত ছেলের চিন্তা ছাড়তে না পেরে থাকেন তাতে। আর পরলোক মিথ্যাই যদি হয়, তবে শশী, শশী তার মাকে ভুলতে না পেরে অসুস্থ মস্তিষ্কে যদি এমনি কল্পনা রচনা করে থাকে, অসুস্থ দৃষ্টিতে যদি মায়াকে কায়া ধরতে দেখে থাকে তবে আশ্চর্য কী?

কত রাত্রে তিনি আতর-বউকে দেখেন বনবিহারীর ঘরে ঊকি মারছেন। তিনি নিজে? কখনও কখনও চেয়েছেন বৈকি!

এই অতসীর ছেলেটি যদি–।

মশায় বললেন–কাল, কাল আসিস বিনয়। কাল। কাল। ছত্রিশ ঘণ্টার আঠার ঘণ্টা গিয়েছে। আরও আঠার ঘণ্টা। ঠিক মধ্যস্থলে।

কে আসছে? অহি?

জ্বর বাড়ছে কাকা। ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। ফুললা বাড়ছে। মুখখানা এমন ফুলেছে—

—অহির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।–আপনি একবার–

–না। তুমি ডাক্তারের কাছে যাও। যদি পারে তো ওরাই পারবে বাঁচাতে। আমি জানি না। আমাদের আমলে এ ছিল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress