Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মাস দেড়েক পর।

মশায় এবং সেতাব দাবায় বসেছেন। ভাদ্র মাস-আকাশ এরই মধ্যে এবার নির্মেঘ নীল; অনাবৃষ্টির বর্ষা শেষ হয়েছে প্রায় সপ্তাহখানেক আগে এবং এই এক সপ্তাহের মধ্যেই মাঝশরতের আবহাওয়া ফুটে উঠেছে আকাশে মাটিতে। আজ দাবা খেলার আসরও জমজমাট। শতরঞ্জির পাশে দুখানা থালা নামানো রয়েছে, চায়ের বাটি রয়েছে। জন্মাষ্টমী গিয়েছে—আতরবউ আজ তালের বড়া করেছেন, একটু ক্ষীরও করেছেন—সেইসব সহযোগে চা পান করে দাবায় বসেছেন। মশায় অবশ্য খান নি। অসময়ে তিনি কোনো কালেই এক চা ছাড়া কিছু খান না। ডাক্তারি শেখার সময় রঙলাল ডাক্তারের ওখানে ওটা অভ্যাস করেছিলেন। লোককে কিছু খেয়ে চা খেতে উপদেশ দিলেও নিজে বিকেলবেলা খালি পেটেই চা খেয়ে থাকেন। খেতে তার বেলা যায়, ক্ষিদে থাকে না—এ একটা কারণ বটে, কিন্তু আসল কারণ অন্য। সন্ধ্যার পর অর্থাৎ দাবা খেলা অন্তেসে সাতটাই হোক আর আটটাই হোক আর বারটাই হোক, মুখহাত ধুয়ে কাপড়চোপড় ছেড়ে ইষ্ট স্মরণ করে তবে আহার করেন। পরমানন্দ মাধব!

আতর-বউয়ের মেজাজ আজ ভাল আছে। গতকাল জন্মাষ্টমীর উপবাস করেছিল—আজ সেতাবকে নিমন্ত্রণ করে দুপুরে ব্রাহ্মণভোজন করিয়েছে; বিকেলে জলযোগ করিয়েছে। এবং সেতাবের ভোজন-বিলাসিনী স্ত্রীর জন্য তালের বড়া ক্ষীর বেঁধে দিয়ে খুব খুশিমনেই আছে। শুধু ব্রাহ্মণভোজন নয়, দম্পতিভোজন করানো হয়ে গেল। ব্ৰত উপবাস করলে আতর-বউ ভাল থাকে। বোধ করি, পরলোকের কল্পনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আয়োজনও ভাল ছিল। অভিযোগ। করতে পায় নি আতর-বউ। মশায়ের পরমভক্ত পরান খাঁকে ডাক্তার কয়েকটি ভাল তালের কথা বলেছিলেন, খা একঝুড়ি খুব ভাল এবং বড় তাল পাঠিয়ে দিয়েছিল। এবং রামহরি লেটের বাড়ি থেকে এসেছিল একটি ভাল সিধে—মিহি চাল, ময়দা, কিছু গাওয়া ঘি, কিছু দালদা, তেল, তরিতরকারি এবং একটা মাছ। রামহরি সেই মরণাপন্ন অবস্থা থেকে বেশ একটু সেরে উঠেছে। এবং রামহরির পুত্রবধূ পৌত্র ফিরে এসেছে, তারাই এখন সেবা-শুশ্ৰুষা করছে। মশায়ের কাছে তাদের আর কৃতজ্ঞতার অন্ত নাই। রামহরির নতুন বউ তার ভাইকে নিয়ে পালিয়েছে। রামহরির মেজাজ অবশ্য খুবই খিটখিটে—শশীর উপরে শব্দভেদী বাণের মত কটুবাক্য প্রয়োগ করে। পুত্রবধূ পৌত্রকেও অবিরাম বিদ্ধ করছে। কিন্তু এই খিটখিটে মেজাজের মধ্যেও রামহরি মশায়কে দেখে সজল চোখে বলে—বাবা, আর জন্যে আপনি আমার বাপ ছিলেন। সেইদিন থেকে ক্রমান্বয়ে কুড়ি দিন তিনি নিত্যই রামহরিকে দেখে এসেছেন।

সিধেটা বোধ করি সেই সম্বন্ধ ধরেই পাঠিয়েছে রামহরি। নইলে একালে চিকিৎসককে উপটৌকন কি সিধে পাঠানো উঠে গিয়েছে। একালে নগদ কারবার। বুড়ো রামহরি পূর্বজন্মের বাপের বন্দনা করছে। একদিন মশায় হেসে রামহরিকে বলেছিলেন–শশী তা হলে কাকা ছিল–না কী বলি? তোকে তো পথে বসিয়েছিল! অ্যাঁ!

রামহরিও হেসেছিল। মশায় বলেছিলেনদেখ, তোর আর জন্মের বাবা হয়ে যদি তোর উপর আমার এত মায়া—তবে তোর এই জন্মের বেটার ছেলের উপর কি এত বিরূপ হওয়া ভাল? তবে একটা কথা বলব বাবা। তুমি সেরে এখন উঠলে কিন্তু এ রোগ তোমার একেবারে ভাল হবে না। সাবধানে থাকবে। বুঝেছ! উইলটুইল যদি কর—তবে করে ফেলে। আর একটি কথা, যে মেয়েটিকে তুমি শেষে মালাচন্দন করেছ তাকেও বঞ্চিত কোরো না।

রামহরির এই তরুণী স্ত্রীটিও এর মধ্যে খিড়কির পথে আতর-বউয়ের কাছে এসে ধরনা দিয়েছিল। পরামর্শ যে শশীর তাতে মশায়ের সন্দেহ নাই। বোধহয় কিছু প্রণামীও দিয়ে গিয়ে থাকবে। বোধহয় নয়, আতর-বউ যখন ওকালতি করেছে তার জন্য তখন ফি নিশ্চয় নিয়েছে। মশায় এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কিন্তু কোনো প্রশ্ন করেন নি। তিনি নিজেই রামহরিকে এ কথা বলেছেন। আতর-বউ যা করেছে তার দায়িত্ব নিজের। তবে স্বামীকে যদি স্ত্রীর পাপের ভাগ নিতে হয় নেবেন; ইহলোকে আতর-বউয়ের অগ্নিদাহের জ্বালার উত্তাপ জীবনভোর সইতে পারলেন, পরলোকে আর পাপের ভাগের বোঝা বইতে পারবেন না?

খুব পারবেন!।

ডাক্তারেরা বলছে বিপিন ভাল আছে। হিকা তার আর হয় নাই। সেখানেও নিত্য যেতে হয়। তিনি নাড়ি না দেখলে রতনবাবুর তৃপ্তি হয় না। প্রদ্যোত ডাক্তারও আসে। সে আসে তার পরে। কোনো কোনো দিন দেখা হয়ে যায়। দু-একটা কথাও হয়। সে শুধু নমস্কার-বিনিময় মাত্র। তিনি হাত দেখেই চলে আসেন। বলে আসেন ভালই আছে। এর বেশি কিছু না। মনের মধ্যে সেই কথাগুলিই ঘুরে বেড়ায়, মহান্তের তিরোধানের দিনে যে কথাগুলি তিনি হরেনকে বলেছিলেন।

হুঁকোটা হাতে ধরেই সেতাব চাল ভাবছিল।

মশায় বললেন–ও বাবা, ন হরি ব্ৰহ্মা ন চ শঙ্কর। ওর নিদান হেঁকে দিয়েছি মানিক। তিন চাল। তিন চালেই তোমার মন্ত্ৰী অকস্মাৎ গজের মুখে পড়ে কাত।

মশায় সেতাবের মন্ত্রীকে নিজের গজের মুখে চাপা দি য় রেখেছেন। এদিকে কিস্তি দিয়েছেন। সেতাব ভাবছে।

মশায় সেতাবের হুঁকো থেকে কল্কেটা ছাড়িয়ে নিয়ে টানতে শুরু করলেন। তামাকটা কেন পোড়ে মিছিমিছি! সেতাব বল ফেলে দিয়ে কল্কের দিকে হাত বাড়িয়ে বললে–দে! তোর পড়তা ভাল আজ।

মিথ্যে বলে নি সেতাব! মশায় আজ পর পর দু বাজি জিতলেন। সেতাব কঠিন খেলোয়াড়। ওর সঙ্গে জেতা কঠিন। প্রায়ই চটে যায় বাজি। একশো বাজির দ্বুই বাজি চটে যায়—দশ বাজিতে হারজিত হয়! সে-ও সমান সমান।

কঠিন রোগী থাকলে মশায় অনেক সময় খেলতে বসবার আগে সেকালের জুয়ার বাজির মত ভাবেন-আজ যদি সেতাব হারে তবে রোগকে হারতে হবে; সেরে উঠবে রোগী। সঙ্গে সঙ্গেই হাসেন। নাড়ি দেখার অনুভূতি মনে পড়ে যায়। ও মিথ্যা হয় না। হবার নয়। রোগের কথাই মাথায় ঘুরতে থাকে। যন্ত্রচালিতের মত খেলে যান, সেতাব একসময় বলে ওঠে-মাত।

সেতাব তামাক খেয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে কথাটার পুনরাবৃত্তি করলে—তোর পড়তা ভাল, সত্যিই ভাল জীবন। রামহরিকে তুই যা বাঁচালি! খুব বাঁচিয়েছিস!

জীবনমশায় বললেন– পরমায়ু পরম ঔষধ সেতাব। রামহরির আয়ু ছিল। সারাটা জীবন কুস্তিকসরত করেছে—সেও এক ধরনের যোগ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এদের তফাত আছে। ওর সহ্যশক্তি কত! সেইটেই বিচার করেছিলাম আমি। শক্তিই হল আয়ুর বড় কথা। রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে কি ওষুধ? করে জীবনীশক্তি, আয়ু।

সেতাব হেসে বললো, তা হলেও হাতশটা তো তোমার বটে। সে তোমার চিরকাল আছে। নতুন ছক সাজাতে লাগল সেতাব। সাজাতে সাজাতে বললে—শশীর কথা শুনেছিল?

শুনেছেন, তাও শুনেছেন।

ঘুটি সাজাতে সাজাতেই ডাক্তার হাসলেন। পরমুহূর্তেই তার কপালের দুপাশে রগের শিরা দুটো মোটা হয়ে ফুলে উঠল। ক্ষোভে থমথমে হয়ে উঠল স্থবির মুখখানা।

সেই প্রথম দিনই শশী রামহরির ওখান থেকে একরকম পালিয়ে এসে মদ্যপান করে সারা নবগ্রামের প্রতি ডাক্তারখানায় চিৎকার করে বেড়িয়েছে আমি তো তবু কম্পাউন্ডার। বর্ধমানে রীতিমত পাস করে এসেছি। ওটা যে হাতুড়ে! পুঁজি তোে রঙলাল ডাক্তারের খানকতক প্রেসক্রিপশন আর বাপ-পিতামহের মুষ্টিযোগের খাতা! আর নাড়ি ধরে চোখ উলটে-খানিকক্ষণ আঙুল তুলে টিপে তারপর বায়ু পিত্ত ক! মনে হচ্ছে দশ দিন। না হয় ঘাড় নেড়ে তাই তো, এই বলা। রামহরিকে বাঁচাবে! কই বাঁচাক দেখি! তাও তো গ্লুকোজ ইনজেকশন দিতে হরেন ডাক্তারকে ডাকতে হয়েছে! আসল কথা রামহরির টাকা—বিষয়! সব, সব বুঝি বাবা, সব বুঝি। রামহরি তো হরে হরে করবে, এখন বাঁচবে বাঁচবে রব তুলে ইনজেকশন, ওষুধ, ফি, গাড়ি-ভাড়া, হেনো তেনো গোলযোগ বাঁধিয়ে পঞ্চাশ একশো দেড়শো যা মেলে—তাই বুড়োর লাভ। এ আর কে না বুঝবে! আমার নামে তো যা তা বলেছে; কিন্তু গোসাইকেচণ্ডীতলার গোঁসাইকে কে মারলে? উনি নন? আগের দিন রাত্রে এক ডোজ ওষুধে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। সকালে ভাল রইল। উনি গিয়ে ফুসমন্তর দিয়ে এলেন—সন্ধেতে যাবেন। ওষুধবিষুধ আর খাবেন। না। সারাদিন ওষুধ না পড়ে বিকেলে আবার দাস্ত হল। হবেই তো। ব্যস, নিদান সার্থক হয়ে গেল।

প্রদ্যোত ডাক্তারও তাই বলে।

বলে—সন্ন্যাসী মরেছে, তার জন্যে কারই বা মাথাব্যথা! কিন্তু ওই লোকটির জীবনের মূল্যে জীবনমশায় নিজেকে নাড়িজ্ঞানে অভ্রান্ত বলে প্রমাণ করেছেন। কিন্তু আমি বলব উনি তো ওকে মেরেছেন। ইয়েস, ইন দি টু সেন্স অব দি টার্ম। ওষুধ দিলে এবং ওইভাবে ঘর থেকে টেনে বের না করলে সন্ন্যাসী আরও দু-এক দিন অন্তত আরও ঘণ্টাকয়েক বাঁচত—এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নাই। এ তো নিজের নিদান সত্য করবার জন্য টেনেহেঁচড়ে, খোল করলে রোগীকে চমকে দিয়ে উত্তেজিত করে মেরে ফেলেছে।

কথাগুলি মনে পড়লেই রগের শিরা দপদপ করে ওঠে।

কথাটা উঠতেই এমন মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন জীবনমশায় যে, এ দানটায় হেরেই গেলেন তিনি। খপ করে দাবাটাই মেরে বসল সেতাব! বললে—এইবার!

তাই বটে। এইবারই বটে। বাঁকা পায়ে আড়াইপদ আড়ালে অবস্থিত একটা ঘোড়ার জোরে একটা বড়ের অগ্রগমন সম্ভাবনা তিনি লক্ষ্য করেন নি।

সেতাব হেসে বললে—দেখবি নাকি?

ছকের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে মশায় বললেন–না। সবটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তুই ও কথা তুলে মনটা চঞ্চল করে দিলি। নন্দ রে, তামাক দে তো বাবা!

—আর একবার চা করতে বল। খেয়ে উঠি। দেরি হলে সে বুড়ি আবার পঞ্চ-উপচার সাজিয়ে বসবে।

অর্থাৎ রাত্রের খাওয়ার ব্যবস্থা শুরু করবে। গৃহিণীর খাওয়ার আয়োজন সেতাবের পক্ষে প্রায় বিভীষিকা। যাবার পথে তাঁকে দোকান থেকে দালদা কিনে নিয়ে যেতে হয়। যা হোক কিছু রসনাতৃপ্তিকর তৈরি করেন তিনি। সেতাব উপলক্ষ। নিজেই সেতার মধ্যে মধ্যে বলে বুঝলি জীবন, এ সেই ষোল কইয়ের ব্যাপার! সেই যে একজন জোলা ষোলটা কই মাছ কিনে এনে বউকে বলেছিল-ভাল করে রান্না কর, বেশ পেঁয়াজ গরমমসলা দিয়ে খোমাখো করে ঝোল রেখে, লঙ্কাবাটা দিয়ে–যেন জিভে দিলেই পরাটা জুড়িয়ে যায়। বউ রান্না করতে লাগল—জোলা মাকু ঠেলতে বসল ঘরে। একটি করে ছাক শব্দ উঠল আর ভোলা একটি করে দাগ কাটলে মাটিতে। তারপর ছক শেষ হতেই উঠে গিয়ে বলল—দে খেতে। বউ খেতে দিলে কিন্তু একটি কই মাছ।

—এ কী, আর গেল কোথায়?

–একটা মাছ বেড়ালে খেয়ে গেল।

–তা হলেও তো পনেরটা থাকে।

–খপ করে গর্ত থেকে একটা ইঁদুর বেরিয়ে একটা নিয়ে গেল।

–দুটো গেল। বাকি থাকে চোদ্দটা।

–ভূতে নিয়েছে দুটো। ওই শেওড়া গাছের ভূত মাছের গন্ধে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে—

–তাই গেল, তবু থাকে বারটা।

–ভয়ে নড়ে বসতে গিয়ে হাতের ধাক্কায় দুটো পড়ল আগুনে।

সেতাব হাসেন আর বলেন—বুঝলি, এইভাবে জোলার বউ হিসেব দিলে পনেরটা কই মাছের। সেগুলি উনোনশালে রান্না করতে করতে গুবগুব করে তিনি ভক্ষণ করেছেন। তারপর পনেরটা মাছের যথাবিহিত হিসেব দিয়ে তিনি চেপে বসে বললেন–

আমি যাই ভালমানুষের ঝি–
তাই এত হিসেব দি।
তুই যদি ভালমানুষের পো—
তবে ন্যাজাটা মুড়োটা খেয়ে মাঝখানটা থো।

বলে পরম কৌতুকে সেতাব হা-হা করে আসেন।


বাইরে থেকে কে ডাকলে—মশায়? কই? কোথায়?

মশায় একটু চকিতভাবেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন; কিশোরের গলা। কিশোর কলকাতায় গিয়েছিল; ফিরেছে তা হলে। বোধহয় কিছু নিয়ে এসেছে। সে কলকাতায় গেলেই তার জন্য কিছু না কিছু আনে। একা তার জন্য নয়, অনেকের জন্য। আবালবৃদ্ধবনিতারই প্রিয়জন কিশোর। ছেলেদের জন্য পেন্সিল, বই; মেয়েদের জন্য সেলুয়ের সরঞ্জাম; দুঃস্থ মধ্যবিত্ত ছেলেদের জন্য জামা, প্যান্ট নিয়ে আসে। তাকে চার-পাঁচবার ফাউন্টেন পেন এনে দিয়েছে, প্রেসক্রিপশন লিখতে। সব হারিয়েছে। মধ্যে মধ্যে জুতো এনে দেয়। যেবার ওসব কিছু আনে না সেবার অন্তত কিছু ফল। কিশোর চিরদিন নবীন কিশোর দুলাল হয়েই রইল। তিনি সাড়া। দিলেন–কিশোর!

—কোথায়? বেরিয়ে আসুন; অনেক লোক আমার সঙ্গে।

মশায় বেরিয়ে এলেন, কিশোর কোন দায় এনে ফেললে কে জানে? কোনো গ্রামে মহামারীর। দায়, কোনোখানে হাঙ্গামার দায়—সব দায়েই মাথা পাতা ওর স্বভাব।

বেরিয়ে এসে মশায় বিস্মিত হয়ে গেলেন, কিছু বুঝতে পারলেন না তিনি। এ যে সম্ৰান্ত নাগরিকের দল। কোট-প্যান্ট-পরা, মার্জিতকান্তি, শিক্ষা-ও বুদ্ধিদীপ্ত-দৃষ্টি বিশিষ্ট ব্যক্তি সব। থানার দারোগা সঙ্গে; আরও কজন এখানকার সরকারি কর্মচারীও রয়েছে; প্রদ্যোত ডাক্তারও রয়েছে; নবগ্রামের ধনী ব্রজলালবাবুর উত্তরাধিকারীরা এখন সদর শহরে বাস করে, ব্রজলালবাবুর বড় নাতিও রয়েছে। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট রয়েছে। তারা এখানে? তার দরজায়?

তবে কি প্রদ্যোত ডাক্তার সেই দরখাস্ত করেছে? হৃদয়হীন মূৰ্খ হাতুড়ে নিদান হেঁকে রোগগ্ৰস্তকে অকালে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। মহান্তকে তিনি কয়েক দিন—অন্তত কয়েক ঘণ্টা আগেও মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছেন।

রগের শিরা দুটো তাঁর দাঁড়িয়ে উঠল। তিনি কিছু বলবার আগেই কিশোর ভদ্রলোকদের লক্ষ্য করে বললে–ইনিই আমাদের মশায়। তিন পুরুষ ধরে এখানকার আতুরের মিত্র। আতুরস্য ভিষমিত্রং। এই ভাঙা আরোগ্য-নিকেতনই একশো বছরের কাছাকাছি আমাদের হেলথ সেন্টার ছিল।

দলের বিশিষ্ট ব্যক্তিগুলির মুখে স্মিত হাস্যরেখা দেখা দিল। তার কতকটা যে কৃত্রিম তাতে সন্দেহ ছিল না। তারা নমস্কার করলেন মশায়কে। তিনিও প্রতিনমস্কার করলেন।

কিশোর তার হয়ে ওকালতি করছে। এককালে কত করেছেন—সেই কথা বলে একালের অপরাধ মার্জনা করতে বলছে। প্রদ্যোত গম্ভীরমুখে মাটির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর একজন কোট-প্যান্ট-পরা তরুণ মৃদুস্বরে তাকে কী বলছে। হরেনও রয়েছে একপাশে।

কিশোর বললে—আর এঁরা হলেন আমাদের নতুন পশ্চিম বাঙলা গড়বার কর্তাব্যক্তি সব। বিশ্বকৰ্মার দল। কমিউনিটি প্রজেক্টের কথা শুনেছেন তো? একশোখানা গ্রাম নিয়ে নতুন আমলের দেশ তৈরি হবে। এখানেও আমাদের একটা প্রজেক্ট হচ্ছে। নবগ্রাম হবে সেন্টার। নতুন রাস্তা ঘাট, স্কুল-হাসপাতাল-ইলেকট্রিক অনেক ব্যাপার। সেই জন্যে এ অঞ্চল দেখতে এসেছেন। পথে আপনার আরোগ্য-নিকেতনের সাইনবোর্ড দেখে জিজ্ঞাসা করলেন। তাই বললাম আরোগ্য-নিকেতন ভেঙেছে, কিন্তু তার প্রাণ এখনও আছে, মশায় এখনও আছেন। তাকে না। দেখলে এখানকার প্রাণের কী দাম কী শক্তি তা বুঝতে পারবেন না।

অকস্মাৎ মশায়ের মনে হল—শুষ্ক সমুদ্রের বালুরাশির মত তাঁর অন্তরে কোনো গভীর অন্তরতল থেকে উথলে বেরিয়ে আসছে উচ্ছ্বসিত লবণাক্ত জলরাশি। ঠোঁট দুটি তার থরথর করে কেঁপে উঠতে চাইছে। কঠিন দৃঢ়তার সঙ্গে চোয়ালে চোয়ালে চেপে নিৰ্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।

কিশোর বললে—আপনার নাড়িজ্ঞানের কথা বলছিলাম। সেই ডাঃ সেনগুপ্ত এসেছিলেন। কলকাতা থেকে ব্রজলালবাবুর নাতিকে দেখতে। মশায় পাঁচ দিনের দিন প্রথম রোগী দেখেছিলেন। রোগী দেখে বেরিয়ে এলেন। আমিও এলাম; আমিও ছিলাম সেখানে। তখন আমি আমাদের সেবাসঙ্গের সেক্রেটারি; আমি নার্সিং করছিলাম। মশায়ের সঙ্গে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলাম–


সে অনেক দিনের কথা। অনেক দিন।

টাইফয়েডের ওষুধ হিসেবে ফাজ তখন এদেশে সবে ব্যবহার আরম্ভ হয়েছে।

ব্রজলালবাবুর নাতির অসুখেই মশায় এই ফাজের ব্যবহার দেখেছিলেন। কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তার সেনগুপ্ত এসে ব্যবহার করেছিলেন ফাজ। মহাশয় মহাপ্রাণ ধার্মিক লোক এই ডাক্তারটি।

জীবনমশায় তখন এ অঞ্চলের ধন্বন্তরি। ব্রজলালবাবু লক্ষপতি মানুষ, কীর্তিমান মহাপুরুষ, উইলিয়মস চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির প্রতিষ্ঠাতা। তিনিও তাঁকে স্নেহ করতেন—শুধু স্নেহই নয় তার সঙ্গে সম্ভ্রমও। তিনি মশায়কে আধুনিক সাজে সাজিয়েছিলেন। দেখা হলেই হেসে বলতেনজীবন, এত বড় চিকিৎসক তুমি-তুমি ভাল পোশাক কর। জান, একবার কলকাতায় থিয়েটার দেখলাম। তাতে এক হালফ্যাশানের বাড়িতে এক বড় ডাক্তার দেখতে এল রোগী। তা সে রোগী বলেওর পায়ে মোজা নেই, ও কেমন ডাক্তার? চার টাকা ফি ওকে কক্ষনো দিতে পাবে না। পালাটি চমৎকার। তা কথাটিও সত্যি হে, ভেক চাই।

জীবনমশায় বলতেন আজ্ঞে কর্তাবাবু, ওসব যদি এ জন্মেই গায়ে দিয়ে শেষ করে শখ। মিটিয়ে যাব তবে আসছে জন্মে এসে শখ মেটাব কিসে?

কর্তাবাবু হা-হা করে হেসে বলতেন—কোট-প্যান্ট পরবে মশায়, বিলেত-ফেরত সাহেব ডাক্তার হবে।

জীবনমশায়ও হটতেন না, বলতেন—সে ডবল প্রমোশন হবে, কর্তাবাবু, সামলাতে পারব। না। শেষে বলতেনকর্তাবাবু আপনার কথা আলাদা। আপনার যুক্তি কর্মযোগে। বাড়িতে কাশী প্রতিষ্ঠা করেছেন, বৃন্দাবন তৈরি করেছেন—ভগবানকে বেঁধেছেন, স্কুল দিয়েছেন, চিকিৎসালয় দিয়েছেন, মুক্তি আপনার করতলগত। আমরা সাধারণ মানুষ, ভক্তিটক্তি করে ত্ৰাণ পাব। ওসব

জামাকাপড়-পোশাকের গরমে ভক্তি উপে যায়, থাকে না। ওসব আমাদের নয়।

কর্তাবাবু কিন্তু এতেও মানেন নি। তার সেবার কলকাতার কাকড়া খেয়ে খেয়ে হয়েছিল আমাশয়, সেই আমাশয় মশায় ভাল করেছিলেন। তখন শীতকাল। ভাল হয়ে উঠে ব্রজলালবাবু দরজি পাঠিয়ে মশায়ের গায়ের মাপ নিয়ে কলকাতা থেকে দামি চায়না কোট তৈরি করে এনে তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ব্রজলালবাবুর বাড়িতে অসুখ একটু বেশি হলেই তার ডাক পড়ত। সাধারণত দেখত তাঁর চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির ডাক্তার। তাঁর ডিসপেনসারির ডাক্তারকে তিনি বাড়িতে না ডাকলে অন্য লোকে ডাকবে কেন?

ব্রজলালবাবুর নাতি—তার দৌহিত্রের অসুখ। একজ্বরী জ্বর। কলকাতা থেকে মাতামহের বাড়ি এসে জ্বরে পড়েছে। ডিসপেনসারিতে এসেছে তখন একজন তরুণ ডাক্তার। হরিশ প্রায় বছর আষ্টেক আগে চলে গেছে। তারপর দুজন এসেছে, দুজনই পার না হওয়ায় চলে গেছে। তারপর এই তরুণটি, চক্রধারী। যে চক্রধারী এখন চিকিৎসা ছেড়ে প্রায় সন্ন্যাসী। চক্রধারী তার ছেলে বনবিহারীর বন্ধু। চক্রধারীই দেখছিল, পাঁচ দিনেও জ্বরের বৃদ্ধিমুখ কম না পড়ায় তাকে ডেকেছিলেন ব্রজলালবাবু। অবশ্য উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ ঘটে নি তখন। তবু ধনী মানুষ, দৌহিত্র এসেছে কলকাতা থেকে তাই তাকে ডেকে একজনের স্থলে দুজন ডাক্তার দেখানো। শীতকালের দিনে জীবনমশায় চায়না কোটটি গায়ে দিয়েই দেখতে গিয়েছিলেন। কর্তাবাবু রসিকতা করেছিলেন—কোট গায়ে দিয়েছ জীবন? ভক্তিকে উপিয়ে দিলে নাকি?

মশায় বলেছিলেন আজ্ঞে, ভক্তিকে এ জন্মের মত শিকেয় তুলে রাখলাম কর্তাবাবু। সে যা হয় আসছে জন্মে হবে। তা ভক্তিই যখন শিকেয় তুললাম তখন কোট গায়ে দিতে দোষ কী বলুন।

ছেলেটির নাড়ি দেখবার আগে তার কানে এসেছিল কয়েকটি মৃদুস্বরের কথা। কলকাতারই কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে পাশের ঘরে বলছিল—এসব কী করছেন এঁরা। হাতুড়ে ডেকে হাত দেখানো—এগুলো ভাল নয়!

জীবন মশায়ের পায়ের ডগা থেকে রক্তস্রোত বইতে শুরু করেছিল মাথার দিকে। প্রাণপণে নিজেকে সংযত করে হাত দেখতে বসেছিলেন।

তাঁর বাবা বলেছিলেন-ধ্যানযোগে নাড়ি পরীক্ষা করতে হয়। সেদিন সেই যোগ যেন মুহূর্তে সিদ্ধিযোগে পরিণতি লাভ করেছিল। সেই ধ্যানযোগে তিনি অনুভব করেছিলেন কঠিন সান্নিপাতিক-দোষদুষ্ট নাড়ি!

নাড়ি ছেড়ে উঠে বাইরে এসে হাত ধুয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন ছেলেটির জ্বর সান্নিপাতিক, মানে টাইফয়েড, কর্তাবাবু। এবং

–কী জীবন?

–বেশ শক্ত ধরনের টাইফয়েড। ভাল চিকিৎসা চাই। সদর থেকে কাউকে এনে দেখান।

ওই পাশের ঘরের কথা তাঁর কানে না গেলে হয়ত এমনভাবে তিনি বলতেন না। একটু ঘুরিয়ে বলতেন।

সদরের ডাক্তার এসে দেখে বলেছিলেন যিনি বলেছেন তিনি বোধহয় একটু বাড়িয়ে বলেছেন। টাইফয়েড বটে তবে কঠিন কিছু নয়। সেরে যাবে।

জীবনমশায় তার সামনেই ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন-আজ্ঞে না। আমার জ্ঞানে রোগ কঠিন। তবে যদি বলেন আমি হাতুড়ে, সে অন্য কথা।

কিশোর তখন তরুণ। সে বাইরে তাঁর সঙ্গে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন–কী দেখলেন ডাক্তারবাবু? খুব শক্ত?

মশায় তাকে বলেছিলেন–ব্যাপারটা জটিল বাবা কিশোর। সদরের ডাক্তার বুঝতেই পারছে। না। জিভের দাগ, পেটের ফাপ, দুবার জ্বর ওঠানামা, জ্বরের ডিগ্রি দেখে ও বিচার করছে। আমি নাড়ি দেখেছি। ত্ৰিদোষদুষ্ট নাড়ি। এবং—হুঁ। তুমি বোলোনা কিশোর, এ রোগ আর ব্ৰহ্মা-বিষ্ণুর হাতে নাই! এক শিব—যিনি নাকি মৃত্যুর অধীশ্বর, তিনি যদি রাখেন তো সে আলাদা কথা।

দশ দিনের পর থেকে রোগ হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠল। শহরের ডাক্তার আবার এসে বললেন–হ্যাঁ, দ্বিতীয় সপ্তাহে এ রোগ বাড়ে। তাই বেড়েছে। তা হোক, ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি আমি। কমে যাবে এতেই।

তের দিনের দিন রোগ হয়ে উঠল কঠিনতর।

কিশোরকে মশায় বললেন–বিকার আসছে কিশোর। আঠার দিন অথবা একুশ দিনে ছেলেটি মারা যাবে। মনে হচ্ছে তার আগে সান্নিপাত দোষে একটি অঙ্গ পঙ্গু হয়ে যাবে। কিশোর, আমি দেখতে পাচ্ছি। সান্নিপাতিক জ্বর এমন পূর্ণমাত্রায় আমি আর দেখি নি বাবা।

চোদ্দ দিনের দিন ছেলে অজ্ঞান হয়ে গেল। মেনিনজাইটিস যোগ দিলে। কলকাতায় লোক গেল, বড় ডাক্তার চাই। যা লাগে।

জীবনমশায় বললেন–তা হলে অবিলম্বে কর্তাবাবু। আজই। নইলে আক্ষেপ করতে হবে। রোগ বড় কঠিন কর্তাবাবু।

সে মুহূর্তেই চোখ পড়েছিল কলকাতার সেই আত্মীয়টির দিকে। একটু হেসে বলেছিলেন আমার অবিশ্যি হাত দেখে মনে হচ্ছে রোগ অত্যন্ত কঠিন।

কলকাতা থেকে বড় ডাক্তার এসেছিলেন, এম. ডি; অল্প বয়স হলেও বিচক্ষণ চিকিৎসক। জাতিতে বৈদ্য; নাড়ি দেখার অধিকার রাখেন; ধীর স্থির মিষ্টভাষী। ডাক্তার সেনগুপ্ত সত্যকারের চিকিৎসক।

তিনি রোগের বিবরণ শুনে ফাজ নিয়ে এসেছিলেন। ফাজ সেই প্রথম ব্যবহার হল এ অঞ্চলে।

জীবন মশায়ের সঙ্গে তিনি পরামর্শ করেছিলেন। নাড়ি দেখে অনুমানের কথা শুনে বলেছিলেন আপনার অনুমানই বোধহয় ঠিক। তবু আমাকে চেষ্টা করতে হবে। শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। কৰ্তব্য করে যেতে হবে। কী করব?

আঠার দিনের দিনই ব্রজলালবাবুর দৌহিত্র মারা গিয়েছিল। আঠার দিনের সকালবেলা বাম অঙ্গ পড়ে গিয়েছিল, বা চোখটি পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

চারদিকে জীবন মশায়ের নাড়িজ্ঞানের খ্যাতি রটে গিয়েছিল এরপর।

কিশোর বলে চলেছিল—সেকালের জীবন মশায়ের কথা।

শুধু খ্যাতিই নয়—একটা দৃষ্টিও তার খুলে গিয়েছিল এরপর থেকে। তিনি বুঝতে পারতেন। সে আসছে কি না আসছে, নাড়ি ধরলে অনুভব করতে পারতেন অনায়াসে। এবং সে কথা ক্ষেত্রবিশেষে অর্থাৎ রোগী প্রবীণ হলে স্পষ্টই বলতেন; মণি চাটুজ্জের মায়ের বেলা বলেছিলেন বাবাজী, এবার বুঝি মাথা কামাতে হয় গো!

মণি চাটুজ্জের চুলের শখ ছিল অসাধারণ।

রাম মিত্তিরকে তার বাপের অসুখে প্রথম দিন দেখেই বলেছিলেন রাম, বাবার কাছে যা জানবার শুনবার জেনেশুনে নিয়ো। উনি বোধহয় এ যাত্রা আর উঠবেন না।

রোগী অল্পবয়সী হলে ইঙ্গিতে বলতেন—তাই তো হে, রোগটি বাঁকা ধরনের, তুমি বরং ভাল ডাক্তার এনে দেখাও।

কাউকে অন্যভাবে জানাতেন।

এরই মধ্যে একদিন সুরেনের ছেলে শশাঙ্কের বড় ভাই এসে বললে—মশায়কাকা, একবার শশাঙ্ককে দেখে আসবেন।

–কী হয়েছে শশাঙ্কের?

–জ্বর হয়েছে আজ দিন চারেক।

–আচ্ছা যাব। কাল সকালে যাব বাবা। আজ বনু এল কলকাতা থেকে। বাঁশি, বায়াতবলা এনেছে; গান-বাজনা হবে। একটু খাওয়াদাওয়াও হবে। আসিস বাবা তুই। আমি কাল। সকালেই যাব।

বনবিহারীর বন্ধু শশাঙ্ক। বছরখানেকের ছোট। জমিদারি সেরেস্তার হিসাবনবিস তাঁর সেই বাল্যবন্ধু সুরেনের ছোট ছেলে। বাল্যকালেই মাতৃবিয়োগ হয়েছিল। সুরেন বেঁচে থাকতেই তার বিয়ে দিয়ে সংসারী করে দিয়ে গেছে। ভাল ছেলে, মিষ্টভাষী ছেলে শশাঙ্ক। কী হল ছেলেটার?


পরের দিন সকালেই গিয়েছিলেন শশাঙ্ককে দেখতে।

সুরেনের গৃহিণীহীন সংসারে বধূরাই আপন আপন স্বামী নিয়ে স্বাধীনা। তরুণী বধূটিই শশাঙ্কের শিয়রে বসে ছিল। সম্ভবত শশাঙ্কের জ্বরোত্তপ্ত কপালে নিজের মুখখানি রেখেই শুয়ে ছিল। মশায়ের জুতার শব্দে উঠে বসেছে।

শশাঙ্কের কপালে সিঁদুরের ছাপ লেগে রয়েছে। একটু হাসলেন ডাক্তার। মেয়েটি ছেলেটি দুজনেই তাঁর স্নেহাস্পদ। বধূটিও তার জানাশোনা ঘরের মেয়ে, বাল্যকাল থেকেই দেখে। এসেছেন। স্নেহের বশেই মশায় মেয়েটির দিকে চাইলেন। চোখ তার জুড়িয়ে গেল। লালপাড়শাড়ি-পরা ওই গৌরতনু বধূটির নতুন রূপ তার চোখে পড়ল। একটি অপরূপ ছবি দেখলেন যেন। তাকে দেখে মেয়েটির মুখখানি রাঙা হয়ে উঠল। মাথায় ঘোমটা টেনে সে সরে বসল। মনে হল মেয়েটির এই বন্ধুরূপেই তার সকল রূপের চরম প্রকাশ।

ডাক্তার বসে শশাঙ্কের হাত ধরলেন। তাঁর নিজের হাত কেঁপে উঠল, চোখ দুটি চকিতে যেন খুলে গেল, একবার বধূটির দিকে তাকালেন। আবার চোখ বুজলেন। এ কী? আজ তৃতীয় দিন। এরই মধ্যে এত স্পষ্ট লক্ষণ! আবার দেখলেন। না, ভ্রান্তি তো নয়! ভ্ৰান্তি নয়। এই বধূটির এমন অপরূপ রূপ মুছে দিয়ে শশাঙ্ককে যেতে হবে? দু সপ্তাহ?

হ্যাঁ তাই! ভ্ৰান্তি নয়, তিনি বিমূঢ় নন, অন্যমনস্ক তিনি হন নাই। শশাঙ্ককে যেতে হবে। এমন স্পষ্ট মৃত্যুলক্ষণ তিনি কদাচিৎ প্রত্যক্ষ করেছেন নাড়িতে। শেষ রাত্রের পাণ্ডুর আকাশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণাংশে অগ্নিকোণে শুক্রাচার্যের প্রদীপ্ত স্পন্দিত উদয় যেমন রাত্রি-শেষ ঘোষণা করে—এমনকি দণ্ড পলে উদয়কালের বিলম্বটুকু পর্যন্ত পরিমাপ করে দেয়, তেমনিভাবে ঠিক তেমনিভাবে-নাড়ি-লক্ষণ বলছে দু সপ্তাহ! চোদ্দ দিন।

মনে আর অশান্তির সীমা ছিল না। বেদনার আর অন্ত ছিল না। শশাঙ্ক বনবিহারীর বয়সী, কিছু ছোট। মাতৃহীন ছেলেটা তাঁর ডাক্তারখানার সামনে খেলে বেড়াত। তার চোখের সামনে বড় হল। আর এই বধূটি? লালপাড় শাড়িতে শাখায় রুলিতে, সিথিতে সিঁদুরের রেখায় সুন্দর ছোট কপালখানির মাঝখানে সিঁদুরের টিপে লক্ষ্মী ঠাকরুনের মত এই মেয়েটি?

এই সমস্ত শোভার সবকিছু মুছে যাবে? থান কাপড়, নিরাভরণা মূর্তিকল্পনা করতে পারেন নি জীবনমশায়। মনে পড়েছে মেয়েটির বাল্যকালের কথা। পাশের গায়ের মেয়ে। এ অঞ্চলে জাগ্ৰত কালী ঠাকুরের সেবায়েতের মেয়ে। বড় সমাদরের কন্যা। মেয়েটিকে ছেলেবয়সে বাপমায়ে বলত—বিল্লী। পুষি।

ওই আদর-কাঙালিপনার জন্য আর আমিষে রুচির জন্য। একখানি ড়ুরে কাপড় পরে কালীস্থানের যাত্রীদের কাছে সিঁদুরের টিপ দিয়ে বেড়াত আর পয়সা আদায় করে পেঁয়াজবড়া কিনে খেত। অন্তরটা বেদনায় টনটন করে উঠল।

দুদিন পর শশাঙ্কের নাড়ি দেখে তিনি একেবারে আর্ত হয়ে উঠলেন। স্থির জেনেছেন–শশাঙ্ককে যেতে হবে। নাড়িতে যেন পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন, সে আসছে। ওষুধ ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।

সেই আৰ্ত মানসিকতার আবেগে একটা কল্পনা করে আতর-বউকে ডেকে বললেন–দেখ, কাল রাত্রে আমি স্বপ্ন দেখেছি—মা-কালীকে ভোগ দিচ্ছি, মা যেন সেই ভোগ নিজে হাত পেতে নিচ্ছেন। আর আশ্চর্য কী জান? কালী-মা যেন আমাদের শশাঙ্কের বউ।

আতর-বউ বলেছিলেন—তা আর আশ্চর্য কী; শশাঙ্কের বউ কালীমায়ের দেবাংশীর মেয়ে। হয়ত–।

—এক কাজ কর আতর-বউ, শশাঙ্কের বউকে কাল নেমন্তন্ন করে খাওয়াও।

–বেশ তো।

আমিষের নানা আয়োজন করে এই বধূটিকে খাওয়াতে চেয়েছিলেন। বড় একটা মাছের মুড়ো তার পাতে দিতে বলেছিলেন। শশাঙ্কের তখন ছদিন জ্বর। জ্বরটা শুধু বেড়েছে; অন্য কোনো উপসর্গ দেখা দেয় নি। বাকুলের কালীবাড়ি থেকে প্রসাদী মাংসও আনিয়েছিলেন। কী যে ভ্রান্তি তার হয়েছিল। মাছের মুড়োটা নামিয়ে দিতেই বধূটি চমকে উঠেছিল।

স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সমস্ত আয়োজনের দিকে তাকিয়ে হাত গুটিয়ে উঠে পড়েছিল। আতর-বউ ব্যস্ত হয়ে উঠে বলেছিলেন-কী হল? কী হল?

স্থির কণ্ঠে মেয়েটি বলেছিল—আমার শরীর কেমন করছে। আমি বাড়ি যাচ্ছি।

সন্ধ্যায় ডাক্তার শশাঙ্ককে দেখে বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। মৃত্যুলক্ষণ নাড়িতে উত্তরোত্তর স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবলার বোলে—ঠিক মাঝখানে এসেছে। সেই গতিতে বাজছে। কাল সপ্তাহ শেষ—আর এক সপ্তাহ একদিন, অষ্টাহ।

বাড়ির মুখেই একটা গলি।

ডাক্তারের ভারী পা আরও ভারী হয়ে উঠেছে। পিছন থেকে ডাক শুনলেন দাঁড়ান। ডাক্তার ফিরে দাঁড়ালেন। দেখলেন একটি কেরোসিনের ডিবে হাতে দাঁড়িয়ে আছে শশাঙ্কের বউ। ডিবের আলো তার মুখের উপর পড়েছে, গৌরবর্ণ মুখের উপর রক্তাভ আলো। সিঁথিতে সিঁদুর ডগমগ করছে। চোখে তার স্থির দৃষ্টি। তাতে প্রশ্ন। মশায়েরও সে দৃষ্টি অসহ্য মনে হল; চোখ নামিয়ে নিলেন তিনি।

বললেন––কিছু বলছ?

—ও বাঁচবে না? লুকোবেন না আমার কাছে। আশ্চর্য ধীরতা তার কণ্ঠস্বরে।

প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না ডাক্তার।

মেয়েটি বললে–না যদি বাঁচে তো কী করব; আপনিই বা কী করবেন? কিন্তু এমনি করে আপনার নিজের ছেলের মৃত্যু জেনে—তাকে মাছের মুড়ো, মাংস খাওয়াতে পারবেন? সেই কথা মনে পড়ছে মশায়ের।

অবশ্য সেদিন তিনি এতে বিচলিত হন নি। সেদিনের জীবনমশায় অন্য মানুষ ছিলেন। গরলাভরণ নীলকণ্ঠের মত দৃকপাতহীন। লোকে বলত, মশায় সত্য কথা বলবেই, সে ভালই হোক আর ম-ই হোক। অনেকে বলত, ডাক্তার-কবিরাজেরা মৃত্যু দেখে দেখে এমনিই হয়ে পড়ে। ঘাটা পড়ে যায় মনে। অনেকে বলত, পসার বাড়ায় জীবনমশায় পালটে গিয়েছে—দাম্ভিক হয়েছে খানিকটা।

কারও কথাই মিথ্যে নয়। সবার কথাই সত্য। তবে এগুলি উপরের সত্য—ফুলের পাপড়ির মত। মাঝখানে যেখানে থাকে মৰ্মকোষ সেখানকার সত্য কেউ জানে না। সেখানে একদিকে ছিল বিষ অন্যদিকে অমৃত। সংসার-জীবনের অশান্তি-আতর-বউয়ের উত্তাপমঞ্জরীর অভিশাপ-বনবিহারীর মধ্যে ফলেছিল সে অভিশাপ; তিনি জানতে পেরেছিলেন, এ বংশের মহাশয়ত্ব বনবিহারীর মধ্যেই হবে ধূলিসাৎ এবং বনবিহারী যে দীর্ঘজীবী হবে না সেও তিনি জানতেন। অন্যদিকে হয়েছিল ধ্যানযোগে নাড়িজ্ঞানের অদ্ভুত বিকাশ। দুইয়ে মিলে তার সে এক বিচিত্র অবস্থা। কখনও আধুনিকদের ব্যঙ্গে বলে ফেলতেন নিষ্ঠুর সত্য। কখনও করুণায়। আত্মহারা হয়ে বলে ফেলতেন।

জীবনমশায় একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মেয়েটিকে বলেছিলেন—মা, শশাঙ্ককে যদি বাঁচাতে পারি তবেই এর উপযুক্ত উত্তর হয়। কিন্তু–

কথাটা পালটে নিয়েছিলেন–আমার ছেলের কথা বললে মা! শশাঙ্ক আর বনবিহারী একসঙ্গে খেলা করেছে, পড়েছে—সে সবই তুমি জান। শশাঙ্কও আমার ছেলের মতই। আজ তার কথাই যখন বলতে পারলাম ইঙ্গিতে, তখন বনবিহারীকে যদি অকালে যেতে হয়—আর আমি যদি জানতে পারি—তবে শশাঙ্কের বেলা যেমন জানিয়ে দিলাম তেমনিভাবেই জানা, রকমটা একটু আলাদা হবে। তোমাকে তো ইঙ্গিতে জানিয়েছি। বনুর বেলা—তোমার কথাই যদি ফলে মা, তবে আতর-বউকে স্পষ্ট বলব–বনুর বউকেও স্পষ্ট বলব–বনু বাঁচবে না। এবং তার যদি কোনো সাধ থাকে তাও মিটিয়ে নিতে বলব। আমার উপর মিথ্যে ক্ৰোধ করলে মা। মৃত্যুর কাছে আমরা বড় অসহায়।

অন্য কেউ বললে নূতন কালের পাশ্চাত্যবিজ্ঞান-প্রভাবিত ব্যক্তিগুলি বিশ্বাস তো করতেনই না—উটে ব্যঙ্গ-হাস্য করতেন। কিন্তু কিশোর গোটা বাংলাদেশে পণ্ডিত এবং কর্মী হিসেবে সুপরিচিত, শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়াও আর একটি মহৎ গুণের সে অধিকারী। সে সত্যবাদী। পৃথিবীতে কোন গুরুতর প্রয়োজনেও সে মিথ্যা বলে না এবং কারও মনোরঞ্জনের জন্যও সত্যকে সে অতিরঞ্জিত করে না।

গল্প দুটি শুনে সকলের মুখেই প্রশংসা-প্রসন্ন বিস্ময় ফুটে উঠল। একজন বললেন–সত্যই অদ্ভুত।

কিশোর হেসে বললে–কী করছিলেন? দাবা খেলছিলেন বুঝি? এরই মধ্যে সেতাব ঘর থেকে উঠে এসে জীবন মশায়ের পিছনে দাঁড়িয়েছে। ধোঁয়া দেখে আগুন অনুমানের মত কিশোর অভ্রান্ত অনুমান করেছে।

মশায় আজ ছোট ছেলের মত লজ্জিত হলেন। মাথা হেঁট করে হেসে বললেন– বৃদ্ধ বয়সে অবলম্বন তো একটা চাই! কী করি বল? তুমিও তো শুনেছি এখনও ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে যাও। অবিশ্যি-তুমি নামেও কিশোর কাজেও চিরকিশোর। লোকে বলে কিশোরবাবু আর সাবালক হল না, চিরকাল নাবালকই থেকে গেল। তাই থেকো বাবা চিরদিন যেন তুমি তাই থেকো।

বলতে বলতেই তাঁর চোখ দিয়ে দুটি জলের ধারা গড়িয়ে এল। দীর্ঘকাল পর, সুদীর্ঘকাল পর, কতকাল পর তার হিসেব নাই। হিসেব নাই।

মশায়ের চোখে জল দেখে কিশোর একটু অভিভূত হয়েই বললে, আচ্ছা চলি। এঁদের সব দেখিয়ে আনি।

রওনা হয়ে গেলেন তারা। সকলেই যেন কেমন হয়ে গেছেন, নিঃশব্দে অগ্রসর হয়ে গেলেন। কথা যেন হারিয়ে গেছে। দাঁড়াল শুধু হরেন। হরেন এসে বললে—একটা ভাল খবর আছে। বিপিনবাবুর আজ আবার ইউরিন রিপোর্ট এসেছে। দোষ খুব কমে গিয়েছে। ওবেলা যাবেন তো বিপিনবাবুকে দেখতে? আজ আমরা যখন যাব তখনই যদি যান তত ভাল হয়। আজ একবার সকলে মিলে ভাল করে দেখব।

অন্যমনস্কের মত মশায় বললেন– সকলে মিলে দেখবে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress