আরোগ্য নিকেতন – 22
মাঠের পথেই গাড়ি ভাল।
জীবনমশায় এবার একটু দেহ এলিয়ে শুয়ে পড়লেন। শশী বললে—তাই গড়ান একটু। আমি হেঁটেই চলি। আঃ! এ সময় একটু বিশ্রাম না করলে চলবে না। এ সময়টায় জীবনে বোধ করি কখনই তিনি বের হন নি। কোনো ডাক্তারই যায় না। ডাক্তারেরাও তো মানুষ।
অনাবৃষ্টির শেষ শ্রাবণের দুপুরবেলা; মেঘাচ্ছন্নতা রয়েছে, বৃষ্টি নাই। মাঠ শুকনো না হোক, অনাবাদি পড়ে রয়েছে। ফসল নাই কিন্তু আগাছা বেড়েছে। মাঠের এখানে ওখানে বাঁশ উঁচু হয়ে রয়েছে। পুকুর থেকে দুনি করে জল তুলে চাষ করছে উদ্যোগী চাষীরা। একেবারে সব থেকে নিচু মাঠে চাষ চলছে। সেখানে মানুষ গরুর মেলা বসে গেছে, গাড়িখানা চলেছে উঁচু মাঠের মাঝখান দিয়ে, দু-চার জন চাষী এখানে কায়ক্লেশে কাজ চালাচ্ছে। দেশে শস্য নাই, আকাশে মেঘ দুর্লভ, মেঘ যদি আসে তাতে বৃষ্টি আরও সুদুর্লভ। বৃষ্টি হলে রোগটা কম হয়। এ তিনি ভাল করে লক্ষ্য করেছেন—যেবার বৃষ্টি ভাল হয়—সেবার ম্যালেরিয়া অন্তত কম হবেই। কত আবিষ্কার হল; মশা ম্যালেরিয়ার বীজ বয়ে নিয়ে বেড়ায়; কলেরার বীজাণু জলের মধ্যে বাড়ে, খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানুষকে আক্রমণ করে মাছিতে বয়ে নিয়ে বেড়ায়, ছড়ায়; কলেরার টিকা আবিষ্কার হল; কালাজ্বরের চেহারা ধরা পড়ল; কত কত রোগ আবিষ্কার। হ্যাঁ, দেখে গেলেন। বটে। সাধ অবশ্য মিটল না; বড় একজন চিকিৎসক হয়ে এর তত্ত্ব-তথ্য পুরো দেখা এবং বুঝে ওঠা ঘটল না, শুনলেন বিশ্বাস করে গেলেন—কার্য-কারণের রহস্য দেখবার দিব্যদৃষ্টি লাভ হল না এ জন্মে—তবুও অনেক, অনেক দেখে গেলেন। একটি সাধ হয় মধ্যে মধ্যে—অণুবীক্ষণ যন্ত্রে বীজাণুগুলিকে চোখে দেখা যায় তাদের বিচিত্র চেহারা বিচিত্র ভঙ্গি—সেই দেখবার ইচ্ছা হয়, আর ইচ্ছে হয় এক্স-রে করানো যখন হয় তখনকার ব্যাপারটা। মানুষের রূপময় দেহ অদৃশ্য হয়ে যায় দেখা যায় কঙ্কাল-অন্ত্রপাতির ক্ষত। মতির মায়ের পায়ের এক্স-রের প্লেটটা একবার দেখতে তার ইচ্ছে হয়।
হঠাৎ জীবন মশায়ের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। শশী হাত নেড়ে ও কী করছে?
কাকে ও যেন ইশারা করছে। কে? কাকে?
—কে রে শশী?
–আজ্ঞে?
–কাকে কী বলছিস হাত নেড়ে?
–পুতকী আর মাছির বাচ্ছা গো। অ্যাঁকের মত উড়ছে মুখের চারিপাশে। বর্ষাতে বৃষ্টিবাদলের নাম নাই, এ বেটাদের পঙ্গপাল ঠিক আছে, বেড়েছে—এ বছর বেড়েছে। শশী বার বার শূন্যমণ্ডলে হস্ততাড়না শুরু করলে।
—গাড়িতে উঠে আয়।
–এই তো—আর এসে পড়েছি। সামনেই তো ডাঙাটা। ডাঙাতে এ আপদ থাকবে না।
সামনেই মস্ত বড় উঁচু টিলা। টিলার ওপারেই ঢালের উপর গলাইচণ্ডী ঢুকবার মুখেই রামহরির বাড়ি। এখন আখড়া। সিধে লাল রাস্তা চলে গিয়ে বেঁকেছে। একজন সাইকেল আরোহী চলেছে। পাড়ার্গায়েও আজ সাইকেল হয়েছে। দু-চারখানা পাওয়া যাবেই; মশায়ের জীবনে একসময় দুটো ঘোড়া এসেছিল—তারপর গরুরগাড়িতেই যাত্রা শেষ করলেন।
প্রদ্যোতের সঙ্গে পারবার তাঁর কথা নয়। হাসলেন ডাক্তার। প্রদ্যোত ডাক্তার নাকি মোটর কিনবে। অন্ততপক্ষে মোটর সাইকেল। চার ঘণ্টায় বিশ মাইল পথ সদর গিয়ে আবার ঘুরে আসবে।
লোক ছুটে আসছে। গাড়ি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললে—শিগগির আসুন।
রামহরির বাড়ির দরজায় কজন শুকমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
জীবন ডাক্তার দেখে বা শুনে চকিত হন নি। হার্টফেল করে মৃত্যু হয়ে থাকবে। বিস্মিত হবার কী আছে? ভিতরে শশী তার পিছনে বসে ছিল; সে সচকিত হয়ে প্রশ্ন করলে–কী হল? বলি–হ্যাঁ হে?
–আপনি যাওয়ার পর বার দুই দাস্ত করে কেমন করছে ডাক্তারবাবু।
মশায় উঠে বসলেন। তাঁর কলবাক্সটায় হাত দিয়ে ভেবে নিলেন। এ অবস্থায় রোগীর একটা দুটো ইনজেকশন হলে ভাল হয়। তাঁর মকরধ্বজ, মৃগণাভি আছে, কিন্তু ইনজেকশন বেশি ফলপ্রদ, শশী এসব বিষয়ে নিধিরাম সর্দার। ইনজেকশন দেয় বটে, একটা সিরিঞ্জ তার আছে, কিন্তু সুচগুলো তার নিজের বেশভূষা শরীরের মতই অপরিচ্ছন্ন। যে পকেটে তামাক-টিকা থাকে—সে পকেটেও সময়ে সময়ে বাক্স রাখতে শশী দ্বিধা করে না। তার ওপর ওষুধ শশীর থাকে না। ওষুধ না থাকলে শশী একটা শিশি থেকে অ্যাকোয়া নিয়ে অম্লান বদনে ইনজেকশন দিয়ে দেয়।
থাক ইনজেকশন। যা হয় মকরধ্বজেই হবে। রামহরি যখন এতটাই প্রস্তুত তখন ইনজেকশন দিয়ে মৃত্যু খানিকটা বিলম্বিত করেই বা হবে কী? জ্ঞানগঙ্গা? নাই বা হল।
মৃত্যু স্থির জেনে তাকে বরণ করতে চাওয়ার মত মনটাই সবচেয়ে বড়! নেহাতই যদি আয়োজন হয়, তবে মধুর অভাবে গুড় দিয়েই কাজ চলবে। তীর্থপুণ্য-বিশ্বাসী, নামপুণ্য-বিশ্বাসী রামহরির চোখের সামনে দেবতার মূর্তি এবং নাম-কীৰ্তন তীর্থের অভাব অনেকটা পূরণ করবে। তা ছাড়া জ্ঞানগঙ্গায় মুক্তির কথা মানতে গেলে ভাগ্যের কথাটাও তো ভাবতে হবে, মানতে হবে। রামহরির সে ভাগ্য হবে কী করে?
সঙ্কল্প প্রায় স্থির করেই ঘরে ঢুকলেন জীবন ডাক্তার। রামহরিকে কী বলবেন তার খসড়াও মনে মনে করে নিলেন। কিন্তু ঘরে ঢুকে রোগীকে দেখেই তিনি ভ্র কুঞ্চিত করে উঠলেন। এ কী? একখানা তক্তাপোশের উপর রামহরি শুয়ে আছে—নিস্পন্দের মত। বিবর্ণ পাণ্ডুর দেহবর্ণ। চোখের পাতায় যেন আকাশ-ভাঙা মোহ। দুৰ্বলতার ঘোর তার পাণ্ডুর দৃষ্টিতে। ক্ষণে ক্ষণে চোখের পাতা নেমে আসছে। আবার সে মেলছে। মেললেও সে দৃষ্টিতে ঔৎসুক্য নাই, প্রশ্ন নাই, কিছু চাওয়া নাই। এ কী অবস্থা? সমস্ত মিলিয়ে এই অবস্থা তো কয়েকটা দাস্তের ফলে সম্ভবপর নয়। তাঁর বহু-অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে এক নজরেই যে বুঝতে পারছেন—এ রোগী তিলে তিলে এই অবস্থায় উপনীত হয়েছে। ঘরের গন্ধে, রোগীর আকৃতিতে এবং লক্ষণে রোগ যে পুরাতন অজীর্ণ অতিসার—তাতে আর তার সন্দেহ নাই। অ্যালোপ্যাথরা আজকাল একে বলবেন ইনটেস্টাইন্যাল টিউবারকিউলোসিস্। অণুবীক্ষণিক পরীক্ষায় ক্ষয়রোগের বীজও পাওয়া যাবে। ক্ষয়রোগধীরে ধীরে ক্ষয় করে মানুষকে। এ অবস্থা আকস্মিক নয়। অন্তত দুদিন-তিন দিন থেকে এই অবস্থাতেই আছে, তিলে তিলে বেড়ে আজ এই অবস্থায় এসেছে।
শশী নিজেই একটা মোড়া বিছানার পাশে রেখে রামহরির মুখের কাছে ঝুঁকে ডেকে বললরাম, রাম! ডাক্তারবাবু এসেছেন। রাম!
—থাক, শশী। ওর সাড়া দিতে কষ্ট হবে। সরে আয়-আমি দেখি।
শশী উঠল—উঠেই আবার হেঁট হয়ে বললে—এখন আবার দলিলপত্র কেন রে বাপু। একখানা দলিল সে তুলে নিলে বিছানা থেকে। দলিলটা বিছানায় পড়ে ছিল।
এবার এগিয়ে এল রামহরির তরুণী পত্নীর ভাইটি। উচ্চবর্ণের বিধবা ভগ্নী রামহরিকে বরণ করে তাদের সঙ্গে সকল সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে থাকলেও রামহরির এই অসুখে ভগ্নীর বিপদের সময় না এসে পারে নাই। পনের-কুড়ি দিন হল এখানে এসে রয়েছে। সে বললে—উইল ওটা। ওর ইচ্ছে ছিল ডাক্তারবাবু এলে তার সামনে টিপছাপ দেবে, ডাক্তারবাবুকে সাক্ষী করবে, তা হঠাৎ এই রকম অবস্থা হলে বললে—কী জানি, যদি ডাক্তারবাবু আসবার আগেই কিছু হয়! বলা তো যায় না! বলে নিজে উইল নিয়ে বুড়ো আঙুলের টিপ দিলে, সাক্ষীদের সই করালে; তারপর দেখতে দেখতে এই রকম।
মাথার কাছে একটি তরুণী মেয়ে বেশ ঘোমটা টেনে বসে ছিল। সে গুনগুন করে কেঁদে উঠল। ডাক্তার তার দিকে চাইলেন একবার, তারপর নাড়ি ধরে চোখ দুটি বন্ধ করলেন। ক্ষীণ নাড়ি, রোগীর মতই দুর্বল—মন্দ গতিতে বয়ে চলেছে, যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ ওকে চলতেই হবে। থামবার অবকাশ নাই, অধিকার নাই, উপায় নাই। মধ্যে মধ্যে যেন কাঁপছে; চন্দ্ৰে গ্ৰহণ লাগলে চাঁদ যেমন কাপে—তেমনি কম্পন। মৃদু এবং অতি সূক্ষ্ম অনুভূতিসাপেক্ষ। অন্ত্রের মধ্যে যে ক্ষয়রোগের কীট গ্রাস করে চলেছে, রেশমকীটের উঁত পাতা খাওয়ার মত—তাতে আর সন্দেহ নেই। তবে আপাত মৃত্যুলক্ষণ তিনি অনুভব করতে পারলেন না।
স্টেথোসকোপ দিয়ে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন অনুভব করলেন। এ অবস্থায় কোনোমতেই আকস্মিক পরিণতি হতে পারে না। নাড়ির গতির সঙ্গে হৃৎপিণ্ডের সঙ্গতি—ঠিক যেন মিত্ৰভাবাপন্ন যন্ত্রী ও বাদকের মত! দুর্বল হলেও সঙ্গত তো ব্যাহত হচ্ছে না!
ওদিকে শশী অনর্গল বকছিল, এসব হল খলব্যাধি! হঠাৎ দাস্ত হল, বাস্ নাড়ি গেল। রোগী চোখ মুদল। আমি আজ সাত দিন থেকে বলছিওরে বাপু, যা ব্যবস্থা করবার করে ফেল। গঙ্গাতীর যাবি তো চলে যা। ডাক্তারবাবুকে দেখাবি তো ডাকি। তা রোজই বলে—কাল। নিত্য কালের মরণ নাই, ও আর আসে না। ভদ্রলোকের এক কথা-কাল। নে, হল তো?
মেয়েটি আবার কাঁদতে লাগল।
শশী আবার বকতে শুরু করলে হবে কেন? ভাগ্যে থাকলে তো হবে। কর্মফল কেমন দেখতে হবে! গঙ্গায় সজ্ঞানে মৃত্যু, এর জন্যে তেমনি কর্ম চাই। আমাদের শাস্ত্রে বলে–চিকিৎসকেই বা কী করবে—হোক না কেন ধন্বন্তরিনীলরতনবাবু কি ডাক্তার রায়; আর ওষুধই বা কী করবেসে হোক না কেন সুধা-আর দশ-বিশ টাকা দামের টাটকা তাজা ওষুধ; আয়ু। না থাকলে কিছুতেই কিছু না। এও তেমনি ভাগ্যকর্ম। সুমতি হলে কী হবে, মতিভ্ৰম ঠিক। সময়ে এসে সুমতির ব্যবস্থা সব পালটে দেবে।
মশায় উঠলেন। দেখা তাঁর শেষ হয়েছে।
এবার মেয়েটি এসে পায়ে আছড়ে পড়লওগো ডাক্তারবাবু গো! আমার কী হবে গো!
মশায় একবার সবারই মুখের দিকে চাইলেন। তারপর বললেন– ভয় নাই, ওঠ তুমি, ওঠ; ওঠ।
শশী ব্যস্ত হয়ে বলল–ওঠ, ওঠ। উনি যখন বলছেন ভয় নাই তখন কাঁদছ কেন? উনি দু কথার মানুষ নন! ওই হয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। সর সর। ওঠ!
বাইরে এলেন মশায়। এবার তাঁর সর্বাগ্রে চোখে পড়ল—সাইকেলখানা।
মশায় ডাকলেন শশী।
শশী বকছিল–হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই হবে, ওঁর মত মানুষ, উনি কি দেখবেন যে ওই অবলাটা ভেসে যাবে? ভাল ঘরের মেয়ে, সৎ জাতের কন্যা, মুনিনাঞ্চ মতিভ্ৰম—মতিভ্রমের বশে যা করেছে তার ফল শাস্তি সে ভগবান দেবেন। আমরা মানুষ—আমরা ওকে ভেসে যেতে দেব না। ব্যস্।
ডাকবার আগেই ক্রমশ তার স্বর নিস্তেজ হয়ে আসছিল। এবার স্তব্ধ হয়ে গেল।
–ওকে মেরেই ফেলেছিস শশী? ইচ্ছে করে? না জানিস নে, বুঝতে পারিস নি?
–আজ্ঞে?
–এ অবস্থা তো আজ তিন দিন থেকে হয়েছে। বুঝতে পারলি নে তো ডাকলি নে কেন?
–আজ্ঞে না। মা-কালীর দিব্যি!
–শশী! ধমক দিয়ে উঠলেন জীবন ডাক্তার।
–মাইরি বলছি, ঈশ্বরের দিব্যি, গুরুর দিব্যি—
এবার মৃদুস্বরে মশায় বললেন– তোদর কজনকে পুলিশে দেওয়া উচিত। থাম-চেঁচাস। নে। যাক এখন শোন, ওই যে ছোকরা সাইকেল চেপে আমাদের গাড়ি দেখতে গিয়েছিল, সে কই? এই যে! ওহে ছোকরা, শোন। কই দোয়াত-কলম দেখি। আমি লিখে দিচ্ছি ওষুধ। যাও। নিয়ে এস বিনয়ের দোকান থেকে। আর বাজারের ডাক্তার হরেনবাবুকে এই চিঠি দেবে। বুঝেছ? জলদি যাবে আর আসবে।
শশীকে দমানো যায় না। শশী ওই শক্তিতেই বেঁচে আছে। সে ছোকরার হাত থেকে প্রেসক্রিপশন এবং চিঠি দুই নিয়ে দেখলে। বললে, গ্লুকোজ ইনজেকশন দেবেন? ইনট্রাভেনাস?
–হ্যাঁ। হলেই কিছুটা ঘোর কাটবে। তার আগে মকরধ্বজ দেব আমি।
–ঘোর কাটবে?
–হ্যাঁ। রামহরির রোগটা মৃত্যু-রোগই বটে। এতেই যাবে। তবে মৃত্যুলক্ষণ এখনও হয় নি।
–হয় নি? আপনি ইনজেকশন দেবেন তো?
–হরেন ডাক্তারকে আসতে লিখলাম। সে দেবে। না আসে আমিই দেব।
–যদি মরে যায়?
—সে আমি বুঝব শশী। আমার মনে হচ্ছে রামহরি এখন বাঁচবে। অন্তত মাস কয়েক। তখন উইলটুইল যা করবার করবে। আমি বরং সাক্ষী হব। উইলটার জন্যেই রামহরির মাথা তুলে দাঁড়ানো দরকার।
শশী চুপ করলে এবার।
মশায় আবার বললেন–উইলে কী আছে জানি না। এই শেষ পরিবারকেই এক রকম দানপত্র করেছে সব—এই তো?
একটু চুপ করে ঘাড় নেড়ে বললেন–সে তো হবে না শশী। রামহরির অভিপ্রায় জানতে হবে আমাকে। তার প্রথম পক্ষের ছেলে ছিল—সে মারা গেছে। কিন্তু তার ছেলে রামহরির নাতি আছে, পুত্রবধূ আছে। সে তো হবে না। বাঁচবেই মনে হচ্ছে। কিন্তু তার জন্যও চিকিৎসা প্রয়োজন। চেষ্টা করতে হবে। সে আমি করব।
রামহরি এই জ্ঞানগঙ্গা যেতে চেয়েছিল? রামহরির ছটা রিপুই বোধ করি ঐকতান তুলে মৃত্যুকে ডাক দিচ্ছে আজীবন। স্থির মৃত্যুর দিকে সহজ ছন্দে এগিয়ে যেতে জীবন ভয় পায় না। ভয় পায় মৃত্যু যখন নিজে এগিয়ে আসে। তখন সে ভয়ে আর্তনাদ করে। সে কি জ্ঞানগঙ্গা যেতে পারে? বনবিহারী পারে নি। দাঁতু পারবে না। রামহরিও পারে না। রামহরির ক্লান্ত জীর্ণ দেহ, ক্ষীণ কণ্ঠ, মুহূৰ্তে মুহূর্তে চোখে আচ্ছন্নতার ঘোর নেমে আসছে; দু-একবার চোখ মেলছে, তার মধ্যেই দৃষ্টিতে কী আতঙ্ক কী আকুতি!
হরেন ডাক্তার আসা পর্যন্ত বসে রইলেন মশায়। মাঝখানে আর-একবার নাড়ি দেখলেন। নাড়ির গতি ঈষৎ সবল হয়েছে; ছন্দ এসেছে। মুখ প্ৰসন্ন হয়ে উঠল। হরেন এসে পৌঁছতেই তিনি তাকে সব বলে বললেন–একটা গ্লুকোজ ইনজেকশন তুমি দাও। আমি বলছি—তুমি দাও। আমি দায়ী হব হে। ভয় নাই তোমার।
হাতখানা আর-একবার দেখেছিলেন মকরধ্বজের উষ্ণতা এবং শক্তি তখন নাড়িতে এবং শরীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হাত নামিয়ে বললেন–দাও তুমি।
ইনজেকশন শেষ করে হরেন হাত ধুয়ে রোগীর অবস্থা দেখে হাসিমুখেই বললে–এটি আপনার অদ্ভুত মশায়! অদ্ভুত!
জীবনমশায় হাসলেন। আর কী করবেন? এ কথার উত্তরই বা কী দেবেন।
হরেন বললে—আর একটা সুখবর দিই, বিপিনবাবুর হিক্কা থেমে গেছে। এই আসবার আগে খবর পেলাম। উঃ, ভদ্রলোকের হিক্কা দেখে আমি তো আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আজ চার রাত্রি ঘুমুতে পারেন নি, পেটে খাদ্য থাকে নি। আমি আসবার আগে দেখে এলাম ভদ্ৰলোক ঘুমুচ্ছেন। আপনাকে ওরা ডেকেছিল সকলের আগে, খবর দিয়েছিল কিন্তু তখন আপনি বেরিয়ে এসেছেন। বুড়ো রতনবাবু যে কী কৃতজ্ঞ হয়েছেন সে কী বলব! প্রদ্যোত ডাক্তারও এসেছিল। সে বেশ একটু আশ্চর্য হয়েছে। গম্ভীর হয়ে বললে—এ বিষয়ে এখনি কিছু বলতে পারি নে। আবার আরম্ভ হতে পারে, এবং এ ওষুধের রিঅ্যাকশনও আছে; তবে এখন অবশ্য ক্রাইসিসটা কাটল বটে। বেশ আশ্চর্য হয়েছে প্রদ্যোত ডাক্তার। আসতে আসতে পথে বললে—বৃদ্ধের ব্যাপার ঠিক আমি বুঝি নে। এ ব্যাপারটায় আমার সন্দেহ হচ্ছে কেন জানেন? আজ আবার একটা ডিসপেপসিয়ার রোগী অবশ্য একটু শক্ত ধরনের বটে—তাকে বলেছে তুই আর বাঁচবি নে। কত দিনের মধ্যে যেন মরবে বলেছে। হরেন এবার মশায়ের দিকে তাকিয়ে তাকেই প্রশ্ন করলে–তাই বলেছেন নাকি?
জীবনমশায় হরেনের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়স্বরেই বললেন–আমি ভুল বলি নি বাবা হরেন। দাঁতু এই রোগেই মরবে। তবে কোনো সময় আমি নির্দিষ্ট করে বলি নি। এই রোগই ওর মৃত্যুরোগ হয়ে উঠবে। এতে আমি নিশ্চিত। গম্ভীর এবং গভীর স্বরে বললেন–তুর এ রোগের সঙ্গে ওর প্রধান রিপুর যোগাযোগ হয়েছে। ঘরে আগুন লাগলেই সব ঘরটা পুড়বে, তার মানে নাই, জল ঢাললে নিভতে পারে, নেভেও। কিন্তু আগুনের সঙ্গে বাতাস যদি সহায় হয় বাবা, তবে জলের কলসি ঢাললে নেভে না, বাতাসের সাহায্যে আগুন অ্যাঁচের ঝাপটায় ভিজে চাল শুকিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে ছাড়ে। দতুর রোগ উদরাময়তার সঙ্গে ওর লোভ রিপু হয়েছে। সহায় সহায় কেন? ওটা এখন রোগের অঙ্গ উপসর্গে পরিণত হয়েছে। আমার বাবা বলতেন—
জগৎমশায় বলতেন-বাবা, সংসারে মানুষ সন্ন্যাসীদের মত শক্তি না পেলেও, সব রিপুগুলিকে জয় করতে না পারলেও গোটা কয়েককে জয় করে। কেউ দুটো কেউ তিনটে কেউ কেউ পাঁচটা পর্যন্তও জয় করে। কিন্তু একটা–।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন—পারে না। একটা থেকে যায়! ওইটেই হল দুর্বল প্রবেশপথ। মৃত্যুবাহিনী ওই দ্বারপথেই মানুষের দেহে প্রবেশ করে। তার ওপর বাবা যে দরজার রক্ষক সে যদি সেধে দরজা খুলে ডাকে তবে কি আর রক্ষা থাকে হরেন? রক্ষক তখন রিপু। প্রবৃত্তি তো খারাপ নয় বাবা। সংসারে প্রবৃত্তিই তো রুচি। প্রবৃত্তি যতক্ষণ সুরুচি-ততক্ষণ কুখাদ্য খায় না, পেট ভরে গেলে সুরুচি তখন বলে—আর না। তৃপ্তিতে তার নিবৃত্তি আসে। আর প্রবৃত্তি যখন কুরুচি হয়—তখন সে-ই শক্ত, সে-ই রিপু। তখন তৃপ্তি তার হয় না; নিবৃত্তি তখন পালায়। তাই রিপুর যোগাযোগে যে রোগ হয়, সে রোগ অনিবার্যরূপে মৃত্যুরোগ।
কথা হচ্ছিল ফেরবার পথে। মশায় পায়ে হেঁটেই ফিরছিলেন। শশী অদৃশ্য হয়েছে। গাড়িখানাও আর পান নি। হরেনও অগত্যা সাইকেল ধরে তাঁর সঙ্গেই হাঁটছিল। হরেন ডাক্তার চুপ করে শুনেই যাচ্ছিল। মাটির দিকে চোখ রেখে পথ চলছিল। কথাগুলি শুনতে মন্দ নয়। অস্পষ্ট বা ভাবালু-মেশানো যুক্তি হলেও অসঙ্গত মনে হচ্ছিল না। কিন্তু এত বড় বিজ্ঞান পড়ে এসে এসব কি পুরো মানা যায়? তবুও পাড়াগাঁয়ের ছেলে সে, বাল্যকালের সংস্কারে ঠিক এরই একটা চাপাপড়া স্রোত ভিতরে ভিতরে আছে; সেই মজাখাতের চোরাবালিতে এই ভাবধারা। বেমালুম শুষে যাচ্ছিল মিশে যাচ্ছিল। এবং জীবন মশায়ের মত প্রবীণ ব্যক্তির সঙ্গে তর্ক করতেও তার অভিপ্রায় ছিল না।
হরেনের নীরবতায় কিন্তু জীবনমশায় উৎসাহিত বোধ করছিলেন। তিনি বলে চললেন ওই দেখ না বাবা, রানা পাঠককে। এত বড় শক্তি! একটা দৈত্য। রিপু হল কাম। বুঝেছ, ওর প্রমেহে চিকিৎসা করেছি, উপদংশ হয়েছে কয়েকবার, আমি কাটোয়ায় মণিবাবু ডাক্তারের কাছে। পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি—এবার যক্ষ্মা হয়েছে। বললে, একটি মেয়েছেলের কাছ থেকে ধরিয়েছে। তার মানে মেয়েটাকে যক্ষ্মারোগী জেনেও নিজেকে সংবরণ করতে পারে নি।
এবার হরেন মৃদু হাসলে।
জীবনমশায় কিন্তু বলেই চললেন—তোমরা দেখ নি–নাম নিশ্চয় শুনেছ। মস্ত বড় কীৰ্তন-গাইয়ে। সুন্দর দাস গো! নামেও সুন্দর, কাজেও সুন্দর, রূপে সুন্দর, গানে সুন্দর লোকটিকে দেখলে মানুষের চোখ জুড়োত, মন সুন্দর হয়ে উঠত। লোকে বলত–সাধক। তা সাধনা লোকটার ছিল। নির্লোভ, অক্ৰোধ, মিষ্টভাষী, বিনয়ী—মোহ মাৎস এও ছিল না; শুধু কাম। কামকে জয় করতে পারেন নি। শেষ জীবনে তিনি উন্মাদ হয়ে গেলেন পঙ্গু হলেন। লোকে বললে—কোনো সাধনা করতে গিয়ে এমনটা হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস ছিল তাই। কিন্তু গুরু রঙলাল ডাক্তারের কাছে যখন ডাক্তারি শিখছি তখন একদিন যে কথা তোমাকে বললাম সেই কথাই বললেন– রঙলাল ডাক্তার। যেন আমার পিতৃপুরুষের কথার প্রতিধ্বনি করেই বললেন––জীবন, কথাটা তুমি হয়ত সত্যিই বলেছ হে। সুন্দর দাসকে দেখতে গিয়েছিলাম। মারা গেছে এই তো কিছুদিন। কিন্তু কথাটা প্রায়ই মনে হয়। কখনও ওই বোষ্টম-কীৰ্তনীয়দের উপর রাগ হয়—কখনও কিছু। লোকটা অসহায়ভাবে রিপুর হাতে মরেছে হে। ও পাগল। হয়েছিল—উপদংশ-বিষে, প্রমেহ-বিষে।
মশায় আবার একটু থেমে বলেছিলেনদেখ না বাবা, রতনবাবুর ছেলে বিপিনের কেস। বাবা, এখানেও সেই রিপুর যোগাযোগ। প্রতিষ্ঠার মদও এক রিপু বাবা। আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রবৃত্তি যার নাই সে কি মানুষ? কিন্তু সে যখন রিপু হয় তখন কী হয় দেখ!
চকিত হয়ে হরেন প্রশ্ন করেছিল—তা হলে বিপিনবাবু সম্পর্কে আপনি–?
প্রশ্নটা সে সম্পূর্ণ উচ্চারণ করতে পারে নি।
—না। সেকথা ঠিক বলি নি আমি। তবে বাবা, অত্যন্ত কঠিন—অত্যন্ত কঠিন।
–আজ তো ভালই আছেন। আমার ভালই লাগল। হিকাটা থেমে গেছে। সুস্থ হয়েছেন ঘুমুচ্ছেন।
—ভালই থাক। ভাল হয়েই উঠুক। কিন্তু ভাল হয়ে উঠেও তো ভাল থাকতে পারবে না। ও, হরেন। আবার পড়বে। প্রবৃত্তি রিপু হয়ে দাঁড়ালে তাকে সংবরণ করা বড় কঠিন।
–এ যাত্রা তা হলে উঠতে পারেন বলছেন?
—তাও বলতে পারছি না বাবা। মাত্র তো দুদিন দেখছি। তার উপর মন চঞ্চল হচ্ছে। রতনকে দেখছি। বিপিনের ছেলেকে দেখছি, বুঝেছ, ওই ছেলেটিকে দেখে বনবিহারীর ছেলেকে। মনে পড়ে গেল।
মশায় দীর্ঘনিশ্বাসও ফেললেন আবার হাসলেনও। এবং হঠাৎ বললেন–চণ্ডীতলায় যাব একবার। আসবে নাকি? মহান্ত আজ যাবেন। একবার দেখে যাই। আজ রাত্রেই যাবেন।
মহান্ত তখন আবার বার তিনেক দাস্ত গিয়ে অবসন্ন হয়ে পড়েছেন, আঙুলের ডগাগুলি ঠাণ্ডা হয়েছে, চোখের পাতা নেমে এসেছে একটা গভীর আচ্ছন্নতার ভাবে। মধ্যে মধ্যে মুখ বিকৃত করছেন—একটা যেন যন্ত্রণা হচ্ছে, নিষ্ঠুর যন্ত্ৰণা।
হরেন বললে—বলেন তো একটা ইনজেকশন দিই।
মশায় বললেন– চিকিৎসক হয়ে আমি নিষেধ করতে পারি? দেবে, দাও।
মহান্তের শিষ্য বললে—বাবার নিষেধ আছে। তিনি বার বার নিষেধ করেছেন—সুই কি কোনো ইলাজ যেন না দেওয়া হয়। মশায় বলেছে আজ ছুটি মিলবে। ছুটি চাই আমার। ইয়ে শরীর বিলকুল রদ্দি হো গয়া!
শ্রদ্ধার প্রসন্নতায় মশায়ের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি এবার হরেনের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন–থাক হরেন।
হরেন স্তব্ধ হয়ে মহান্তের প্রায়-নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে রইল। হরেন এই গ্রামের ছেলে। ডাক্তার সে হয়েছে, কিন্তু এই ধরনের মৃত্যুর অনেক গল্প সে শুনেছে। আজও এখানে মৃত্যুকালে ওষুধ পাশে সরিয়ে রেখে মুখে দুধ গঙ্গাজল দেয়। আগেকার কালের আরও অনেক বিচিত্র গল্প সে শুনেছে। তবু আজকের এ মৃত্যুদৃশ্য তার কাছে নতুন এবং বিস্ময়কর।
দীর্ঘকায় কঙ্কালসার মানুষটি নিথর হয়ে পড়ে আছে। শ্বাস হচ্ছে যেন। তার গতি অবশ্য মৃদু। হঠাৎ মনে হল অত্যন্ত ক্ষীণভাবে ঠোঁট দুটি নড়ছে।
ইঙ্গিত করে সে মশায়কে দেখালে।
মশায় বললেন– ইষ্টমন্ত্র জপ করছেন। ভিতরে জ্ঞান রয়েছে। গ্ৰহণীর রোগীর জ্ঞান শেষ, পর্যন্ত থাকে।
হরেন তর্ক করলে না। কিন্তু তর্ক আছে।
মশায় বললেন– হাতের দিকে দেখ।
মহান্তের হাতের আঙুল করপের ভঙ্গিতে ধরা রয়েছে।
শিষ্য ভোলানাথ এসে বললে—তা হলে বের করি মশায়?
–হ্যাঁ বের করবে বৈকি। দেহ ছাড়বেন, এখন ঘর কেন?—আকাশের তলায়, মায়ের আঙিনায়।
বাইরে তখন অনেক লোক। সকালবেলা মশায়ের নিদান কথা শুনে মহান্ত শিষ্য ভোলাকে বলেছিলেন দু-তিন গাঁওয়ের হরিনামকে দলকে খবর ভেজো রে ভোলা। বহেমকো আজ ছুটি মিলবে। যায়েগা হম। তুম লোক ভাই, দল লেকে আও। নাম করো। ওহি শুনতে শুনতে হম যায়েগা। বন্ধন টুটেগা। ভরোসা মিলেগা।
মশাই নিজেই বেরিয়ে এসে বললেন– হরিবোল, হরিবোল! ধর, ধর নাম ধর। জয় গোবিন্দ।
বেজে উঠল খোল করতাল। মশায় নিজেই এসে দাঁড়ালেন সর্বাগ্ৰে—নামের তরী বাধা ঘাটে-হরি বলে ভাসাও তরী।
সন্তৰ্পণে বহন করে এনে আকাশের তলায় দেবীর পাটঅঙ্গনে মহান্তকে শুইয়ে দিলে সকলে। শ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে।
হরেন অভিভূতের মত দাঁড়িয়ে রইল। চিকিৎসক হিসেবে তার চলে আসবার কথা মনে হল না। মনটা যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। বিচিত্র।