সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি
সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি যে মুষলধারে পড়ছে তা না, তবে বাতাস প্রবল বেগে বইছে। বাড়ির চারদিকে প্রচুর গাছপালা বলে ঝড়ের মতো শব্দ হচ্ছে। এমন ঝড়বৃষ্টির রাতে আকাশ দেখার প্রশ্নই আসে না। মিসির আলি দোতলায় তাঁর ঘরে আধশোয়া হয়ে আছেন। কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবারের পর্ব শেষ করে এসেছেন। বিছানা থেকে আর নামতে হবে না। এটা ভেবেই শান্তি শান্তি লাগছে। ঝড়বৃষ্টি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই আবহাওয়া শীতল হয়েছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই ঠাণ্ডা বাড়ছে। মিসির আলি তার গায়ে পাতলা চাঁদ র দিয়েছেন। কোলবালিশ আড়াআড়ি রেখে তার উপর পা তুলে দিয়েছেন। মোটামুটি আরামদায়ক অবস্থান। তাঁর মাথার কাছে টেবিলের উপর একটা হারিকেন এবং কেরোসিনের টেবিল ল্যাম্প। তাতেও ঘরে তেমন আলো হচ্ছে না। মিসির আলির হাতে অশ্বিনী কুমার বাবুর হাতে লেখা ডায়েরি। লেখা খুব স্পষ্ট নয় এবং যথেষ্ট পরিমাণে প্যাচানো। এই আলোয় পড়তে কষ্ট হচ্ছে তারপরেও স্বস্তির কারণ আছে–হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে ঘর অন্ধকার হবে না। ঢাকা শহরে ঝড়বৃষ্টি মানেই টেনশন-এই বুঝি ইলেকট্রসিটি চলে গেল!
বরকত এসে টেবিলে চায়ের ফ্লাস্ক এবং কাপ রেখে গেছে। দরজার ছিটিকিনি ঠিক করে দিয়ে গেছে। মিসির আলি বরকতের সঙ্গে টুকটাক আলাপ চালাবার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হয় নি। মিসির আলির ধারণা কোনো এক বিচিত্র কারণে বরকত তাকে পছন্দ করছে না।
ভালো দুৰ্যোগ শুরু হয়েছে। মিসির আলি গাছের ডাল ভাঙার শব্দ শুনলেন। ঝড়বৃষ্টির সময় গাছের পাখিরা কোনো ডাকাডাকি করে না। তারা একেবারেই চুপ হয়ে যায়। অথচ তাদেরই সবচেয়ে বেশি ডাকাডাকি করার কথা। কুকুররা মনে হয় প্রাকৃতিক দুৰ্যোগ পছন্দ করে না। মাঝে মাঝেই তাদের ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যাচ্ছে। তারা কেউ আলাদা আলাদা ডাকছে না, যখন ডাকছে তিনজন এক সঙ্গেই ডাকছে।
মিসির আলি খুব মন দিয়েই ডায়েরি পড়ার চেষ্টা করছেন। শুধু কুকুররা যখন ডেকে উঠছে তখন মনোসংযোগ কেটে যাচ্ছে। কেন জানি কুকুরের ডাকটা শুনতে ভালো লাগছে না।
অশ্বিনী কুমারের ডায়েরিটি ঠিক ডায়েরির আকারে লেখা না। অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস লেখা আছে। কিছু কিছু লেখাতে দিনক্ষণ স্থানকাল উল্লেখ করা। বেশির ভাগ লেখাতেই তারিখ নেই। বাজারের হিসাব আছে। চিঠির খসড়া আছে। আয়ুৰ্বেদ অষুধের বর্ণনা আছে। ডায়েরির শুরুই হয়েছে আয়ুৰ্বেদ অষুধের বর্ণনায়।
গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল এবং গৌর করিবার অব্যৰ্থ উপায়।
পুন্নাগের কচি ফল দিয়া ক্বাথ প্রস্তুত করিতে হইবে। উক্ত ক্বাথ জ্বাল দিয়া ভাসমান তৈল পাওয়া যাইবে। উক্ত তৈল সর্বাঙ্গে মাখিতে হয়। পুন্নাগের আরেক নাম রাজচম্পক।
রামায়ণ মহাকাব্যে পুন্নাগের সুন্দর বর্ণনা আছে। রাবণ সীতাকে হরণ করিবার পরের অংশে আছে, রাম ভ্রাতা লক্ষণকে নিয়া বিষন্ন মনে হাঁটিতেছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়িল পুন্নাগ পুষ্পের মেলা–
তিল্লকাশোক পুন্নাগ বকুলোদ্দাল কামিনীম্
রম্যোপবন সম্বাধীং পদ্মসম্পীড়িতো কাম।।
নোট : আমি পুন্নাগ তৈল প্ৰস্তৃত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। ক্বাথ জ্বাল দিলে তৈল প্ৰস্তুত হয় না। নিশ্চয়ই অন্য কোনো প্রক্রিয়া আছে।
বৈদ্যদের নথিতে গাত্ৰবৰ্ণ ঔজ্জ্বল্যের নিমিত্ত রক্তচন্দন, অনন্তমূল এবং মঞ্জিষ্ঠার উল্লেখ আছে। তবে পুন্নাগের সমকক্ষ কেহ নাই। ইহা বারংবার বলা হইয়াছে।
পুন্নাগ প্রসঙ্গে আরো কোনো কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য পাইলে লিপিবদ্ধ করা হইবে।
এই পর্যন্ত লেখার পর দুটি পাতা খালি। কিছুই লেখা নেই। তৃতীয় পাতায় দিনক্ষণ দিয়ে তারা দর্শনের বর্ণনা।
অদ্য ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ২০শে মে মধ্যরজনী।
বিভূতিবাবুর হিসাব অনুযায়ী অদ্য রজনী দশ ঘটিকায় সারমেয় যুগল মধ্যগগনে অবস্থান করিবে ; সারমেয় যুগল দর্শনের সমস্ত ব্যবস্থা সুসম্পন্ন করিয়াছি। কন্যাদের মাতাকে এই অপূর্ব দৃশ্য দেখিবার জন্যে বলিয়াছিলাম। তিনি শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত বলিয়া অপারগতা প্ৰদৰ্শন করিলেন। কিঞ্চিৎ ব্যথিত হইয়াছি। জগতের কোনো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য একা উপভোগ করা যায় না।
আকাশ পরিষ্কার আছে। সন্ধ্যাকালে মেঘ ছিল—এখন মেঘ দূরীভূত হইয়াছে। ঈশ্বরের অসীম কৃপা।
বিভূতিবাবুর পত্রানুযায়ী সারমেয় যুগলের একটির গলায় এই মণ্ডলের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল তারকাটি অবস্থিত। এই তারকাটির প্রভা তৃতীয় মাত্রার। তারকাটির নাম চার্লসের হৃদয়। সম্রাট প্রথম চার্লসের স্মৃতির উদ্দেশে এই নামকরণ।
সারমেয় যুগলের উল্লেখ বেদে আছে। ইহাদের বলা হইয়াছে যমের দুয়ারের প্রহরী। এই মণ্ডলের দুইটি উজ্জ্বল তারকার একটির ভারতীয় নাম জ্যেষ্ঠ কালকত্বজ্ঞ আরেকটির নাম কনিষ্ঠ কালকন্দ্র। জ্যেষ্ঠ কলকজ্ঞ একটি বিষম তারা এবং অত্যন্ত সৌন্দর্যমণ্ডিত। যে চারটি তারা দিয়া কন্যার হীরক নামক বিখ্যাত চিত্রটি গঠিত জ্যেষ্ঠ কলকজ্ঞ তার একটি।
আজ সারমেয় যুগল দেখিবার সৌভাগ্য যেন হয় তার জন্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করিয়াছি।
মিসির আলি দ্রুত পাতা উল্টালেন। ডায়েরিতে বিচিত্র সব বিষয়ে লেখা আছে। জ্যামিতিক চিহ্ন আছে। তার ব্যাখ্যা আছে। জায়গায় জায়গায় টকা-টিপ্লনি আছে।
যেমন জ্ঞান সম্পর্কে বলা হয়েছে—
জ্ঞান
জ্ঞান দুই প্রকার। পবিত্র জ্ঞান এবং অপবিত্র জ্ঞান। অপবিত্র জ্ঞান ঈশ্বর কর্তৃক অনুমোদিত। আদি মানব আদমের পতন হইয়াছিল ঈশ্বর কর্তৃক অনুমোদিত জ্ঞান আহরণের জন্যে। অনুমোদিত জ্ঞান অতীব রহস্যময় জ্ঞান। যদিও পরিত্যাগ লাভের জন্যে এই জ্ঞানের প্রয়োজন নাই।
পুন্নাগ ফুলের কথা কয়েক পাতা পরেই আবার পাওয়া গেল।
পুন্নাগ
সৌরভ্যং ভুবন এয়েহপি বিদিতং পুষ্পেষু লোকোত্তরং
কীৰ্ত্তিঃ কিঞ্চ দিগঙ্গনাঙ্গনগতা কিন্ত্বতদেকংশৃনু।
সর্বান্যেবা গুণানি যানিগিরতি পুন্নাগে তে সুন্দরান্
উজঝণ্ডি খলু কোটরেষু গরল জ্বালানদ্বিজিহ্বালী।
অর্থ : হে পুন্নাগ, তোমার সুগন্ধ ত্রিভুবন খ্যাত। তোমার যশ ও খ্যাতি দিগাঙ্গনারা নিজ অঙ্গনে ছাড়াইয়া রাখে। তবু তোমার একটি অখ্যাতি। তোমার শরীরের কোটরে বাস করে বিষধর সর্প।
নোট: পুন্নাগ বৃক্ষের কোটরে বিষধর সর্প বাস করে এই তথ্য জানা ছিল না। হায় এই বিপুল বসুধার কত অল্পই না। আমি জানি!
দরজায় খটখটি শব্দ হচ্ছে। বই নামিয়ে মিসির আলি বললেন, কে?
চাচাজী আমি লিলি। আপনার কিছু লাগবে?
না। আমার কিছু লাগবে না।
আপনার ঘরের ছিটিকিনি বরকতকে ঠিক করতে বলেছিলাম। বরকত কি ঠিক GKER?
ইয়া ঠিক করেছে।
ছিটিকিনি লাগিয়েছেন?
না।
ছিটিকিনি লাগিয়ে ঘুমুবেন। ভুলবেন না যেন। কুকুরগুলি মাঝে মাঝে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে। এই জন্যে বলছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যদি দেখেন আপনার মাথার কাছে এলশেশিয়ান তাহলে ভয়েই হার্টফেল করবেন।
অবশ্যই ছিটিকিনি লাগিয়ে ঘুমাব। তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি কেন? ভেতরে এস।
আপনি আসতে বলছেন না, এই জন্যে আসতে পারছি না। আমি আপনার জন্যে পান নিয়ে এসেছি।
এস ভেতরে এস।
লিলি পানের বাটা হাতে ঘরে ঢুকল। হাসিমুখে বলল, আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছে দূরবীনওয়ালা। আমার দায়িত্ব হল আপনাকে জাগিয়ে রাখা।
কেন কল তো?
দূরবীনওয়ালার ধারণা হয়েছে কিছুক্ষণ বৃষ্টি হবার পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন তারা দেখা যাবে। বৃষ্টির পর আকাশ নাকি ঝকঝকে হয়ে যায়। তখনই তারা দেখার আসল মজা।
ও আচ্ছা।
আপনি একবার ঘুমিয়ে পড়লে তো আর আপনাকে জাগানো ঠিক হবে না। তাই আপনাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা। এখন বলুন কী করলে আপনি জেগে থাকবেন?
জেগে থাকা আমার জন্যে কোনো সমস্যা না। আমি অনেক রাত জাগি। তুমি আমাকে জেগে থাকতে বলেছি। আমি জেগে থাকব।
অশ্বিনী বাবুর ডায়েরি পড়ছেন?
হুঁ।
মরা মানুষের ডায়েরি পড়ে লাভ কী বলুন তো? মানুষটা তো মরেই গেছে। এরচেয়ে জীবিত মানুষের ডায়েরি পড়া ভালো। আপনি এত আগ্রহ করে পুরোনো ডায়েরি পড়েন জানলে আমি ডায়েরি লেখার অভ্যাস করতাম। চাচাজী নিন পান খান।
মিসির আলি পান হাতে নিলেন। লিলি চেয়ার টেনে খাটের পাশে বসেছে। তাকে ক্লান্ত লাগছে। পরপর দুবার হাই তুলল। মিসির আলি বললেন, তোমার ঘুম পাচ্ছে তুমি ঘুমিয়ে পড়। সুলতানকে বলে রেখো বৃষ্টি কমলে যেন আমাকে খবর দেয়। আমি জেগে থাকব।
আমার সঙ্গে গল্প করতে আপনার ভালো লাগছে না। তাই না? আপনার মন পড়ে আছে অশ্বিনী বাবুর লেখাতে। ঠিক বলছি না চাচাজী?
মিসির আলি বললেন, ডায়েরিটা পড়ে শেষ করতে ইচ্ছা হচ্ছে এটা ঠিক। তার মানে এই না যে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। তুমি খুব গুছিয়ে কথা বল।
লিলি বলল, অশ্বিনী বাবুর ডায়েরি পড়ে কী তথ্য বের করলেন বলুন শুনি।
মাত্র তো পড়া শুরু করেছি।
যা পড়েছেন সেখান থেকে এখনো ইন্টারেস্টিং কিছু বের করতে পারেন নি?
পুন্নাগ ফুলের কথা লেখা আছে। খুব আগ্রহ করে লেখা। এই ফুল বেটে গায়ে মাখলে গায়ের রঙ উজ্জ্বল হয় বলে তিনি লিখেছেন। এর থেকে ধারণা করা যায় যে গায়ের রঙ নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত ছিলেন। আমার ধারণা তাঁর মেয়েগুলির গায়ের রঙ ছিল কালো। তিনি মন্দিরে কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন যে কালী হল গৌর কালী অর্থাৎ সেই কালীর গায়ের রঙও সাদা। তার মানে গায়ের রঙের প্রতি অশ্বিনী বাবুর মনে অবসেসন তৈরি হয়েছিল।
লিলি মুগ্ধ গলায় বলল, বাহ। আপনি তো চট করে একটা ব্যাপার ধরে ফেলেছেন!
মিসির আলি বললেন, আমি একটা হাইপোথিসিস দাড় করিয়েছি। হাইপোথিসিসটা সত্যি কি না তার এখনো প্রমাণ হয় নি।
লিলি একটু ঝুঁকে এসে গলা নামিয়ে বলল, আচ্ছা চাচাজী মাঝে মাঝে কিছু বাড়ি যে অভিশপ্ত হয়ে যায় এটা কি আপনি জানেন?
মিসির আলি সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, অভিশপ্ত বাড়ি বলে কিছু নেই। বাড়ি হল বাড়ি, ইট পাথরের একটা স্ট্রাকচার। এর বেশি কিছু না।
লিলি বলল, চাচাজী আমার কথা শুনুন, এমন অনেক বাড়ি আছে যেখানে বিশেষ কিছু ঘটনা বার বার ঘটতে থাকে। একটা চক্রের মতো ব্যাপার। চক্র ঘুরতে থাকে। এই বাড়িটাও সে রকম একটা বাড়ি।
তার মানে?
এই বাড়িটাও একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। আপনি এমন বুদ্ধিমান একজন মানুষ… আপনার চোখে চক্রটা পড়ছে না কেন?
মিসির আলি বললেন, চক্র বলে কিছু নেই লিলি।
লিলি চাপা গলায় বলল, চক্র অবশ্যই আছে। অশ্বিনী বাবু তাঁর বাড়িতে গৌর কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুলতানও কি তাই করে নিঃ মন্দিরে সে কি একটি মূর্তি রাখে নিঃ চাচাজী আমার ভালো লাগছে না। আমি যাচ্ছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আজ রাতে বৃষ্টি থামবে না। সারারাত বৃষ্টি হবে। কালও বৃষ্টি হবে। বিছানা থেকে নেমে ছিটিকিনি লাগান। শেষে দেখা যাবে ছিটিকিনি না লাগিয়েই আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। এ বাড়িতে কখনো ছিটিকিনি না লাগিয়ে ঘুমুবেন না। কখনো না।
মিসির আলি বিছানা থেকে নামলেন, দরজার ছিটিকিনি লাগালেন। বিছানায় এসে বসলেন। অশ্বিনী বাবুর ডায়েরি এখন আর তাঁর পড়তে ইচ্ছা করছে না। বৃষ্টির বেগ আরো বাড়ছে। গাছের পাতায় শো শো শব্দ হচ্ছে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তাঁর খুবই অস্থির লাগছে। চক্রের ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করতে পারছেন না। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে চক্ৰ তো আছেই। পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারদিকে। প্রতিবারই একই জায়গায় ঘুরে ঘুরে আসছে। ঘুরছে গ্যালাক্সি। অতি ক্ষুদ্র যে ইলেকট্রন সেও ঘুরপাক খাচ্ছে নিউক্লিয়াসের চারদিকে। পদার্থের সর্বশেষ অবস্থা ল্যাপটনস-এর ভর নেই, চার্জ নেই–অস্তিত্বই নেই, শুধু আছে ঘূর্ণন। স্পিন। জনের পর মৃত্যু-জীবন চক্র। বিগ ব্যাং-এ মহাবিশ্ব তৈরি হল। মহাবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো এক সময় আবার তা সংকুচিত হতে শুরু করবে। আবার এক বিন্দুতে মিলিত হবে। আবার বিগ ব্যাং—আবারো মহাবিশ্ব ছড়াবে–The expanding Universe …
মিসির আলি কখন ঘুমিয়ে পড়লেন নিজেই জানেন না।
তার ঘুম ভাঙল নিশ্বাসের শব্দে। কে যেন তাঁর গায়ে গরম নিশ্বাস ফেলছে! খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার। ঘরের দরজা বন্ধ। বাইরের কারো ঢ়োকার কোনো পথ নেই। মিসির আলি চোখ মেললেন-হারিকেনের আলোয় স্পষ্ট দেখলেন বিশাল একটা কুকুর। কুকুরটার মুখ তাঁর মাথার কাছে, তার গরম নিশ্বাস চোখেমুখে এসে লাগছে। পশুদের চোখ অন্ধকারে সবুজ দেখায়। এর চোখও সবুজ। এ তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। মিসির আলি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ব্যাপারটা স্বপ্ন তো বটেই। অত্যন্ত জটিল স্বপ্ন যা মস্তিষ্কের অতল গহবর থেকে উঠে এসেছে।
কুকুরটা চাপা শব্দ করছে। এই শব্দও স্বপ্নের অংশ। কুকুরটা এখন খাট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই তো এখন ফিরে আসছে। আবার যাচ্ছে। এখন সে খাটের চারদিকে পাক খেতে শুরু করেছে। কুকুরটা ঘুরছে চক্রাকারে। আবারো সেই চক্র চলে এল। চক্রের হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই। মিসির আলি চোখ মেললেন। অতি সাবধানে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন দরজার দিকে। দরজা খোলা। খোলা দরজা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। বাতাসও হচ্ছে না।
দরজা খুলল কীভাবে? বাইরে থেকে দরজা খোলার কোনো ব্যবস্থা কি আছে? এটা নিয়ে চিন্তা করার কোনো অর্থ আছে? কোনোই অর্থ নেই। স্বপ্নে বন্ধ দরজা, খোলা দরজা বলে কিছু নেই। স্বপ্নের লজিক খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন। রাত কত হয়েছে? টেবিলের উপর হাতঘড়িটা রাখা আছে। ঘড়ি দেখতে হলে তাঁকে উঠে বসতে হবে। তাতে শব্দ হবে। কুকুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। এই কাজটা এখন কিছুতেই করা যাবে না। ভয়ঙ্কর এলশেশিয়ান কুকুর। তার মনে কোনো রকম সন্দেহ উপস্থিত হলেই সে ঝাপ দিয়ে পড়বে। মিসির আলির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল। খুব পানির তৃষ্ণ হচ্ছে। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে।
এই তৃষ্ণবোধ মিথ্যা। কারণ পুরো ব্যাপারটাই মিথ্যা। তিনি স্বপ্ন দেখছেন। এর বেশি কিছু না। কুকুরটা যদি তার উপর ঝাঁপ দিয়েও পড়ে তাতে তাঁর কিছু হবে না। বরং লাভ হবে—দুঃস্বপ্ন ভেঙে যাবে। তিনি মিথ্যামিথ্যি জাগবেন না। সত্যিকার অর্থেই জাগবেন। তখনো যদি তৃষ্ণা থাকে তাহলে পানি খাবেন। তৃষ্ণা না থাকলে চা খাবেন। চা খাবার পর একটা সিগারেট।
মিসির আলি খুব সাবধানে বিছানায় উঠে বসলেন। কুকুরটা হাঁটা বন্ধ করে স্থির হয়ে গেল। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার লেজ নড়ছে। এর মানে কি এই যে সে বাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে? মিসির আলি এখন মনেপ্ৰাণে চাচ্ছেন কুকুরটা তার উপর ঝাপ দিয়ে পড়ুক। স্বপ্ন ভেঙে যাক। কুকুর ঝাপ দিচ্ছে না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা অশ্বিনী বাবুর কি কুকুর ছিল? জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।
দরজায় শব্দ হল। টিকটক করে মোর্সকোডের মতো শব্দ করছে। যেন কেউ কোনো সংকেত দিচ্ছে। মিসির আলি দরজার দিকে তাকালেন। খোলা দরজার ওপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তবে কেউ যে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। যে আছে তাকে মিসির আলি চেনেন না। কিন্তু কুকুরটা চেনে। সে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কুকুরটা সিঁড়ি বেয়ে নামছে। তার নেমে যাবার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
মিসির আলি দ্রুত বিছানা থেকে নামলেন। দরজা বন্ধ করে ছিটিকিনি টেনে দিলেন। টেবিলের কাছে এসে ঘড়ি দেখলেন। রাত তিনটা পঁচিশ। তিনি পরপর দুঃগ্লাস পানি খেলেন। তারপরেও তৃষ্ণ কমছে না। তিনি খুব যে নিশ্চিন্ত বোধ করছেন তাও না। স্বপ্নে যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। স্বপ্ন ফিজিক্সের সূত্র মেনে চলে না। হয়তো এক্ষুনি দেখা যাবে কুকুরটা বন্ধ দরজা ভেদ করে চলে এসেছে। সে একা আসে নি, সঙ্গী দুজনকেও নিয়ে এসেছে। মানুষের মতো কথা বলাও শুরু করতে পারে। না তা করবে না। স্বপ্ন ফিজিক্সের সূত্র না মানলেও সাধারণ কিছু নিয়ম মানে। আট ন বছরের বাচ্চা যদি কুকুর স্বপ্ন দেখে তাহলে সেই কুকুর তার সঙ্গে কথা বললেও বলতে পারে। মিসির আলি যে কুকুর দেখবেন সে কুকুর কথা বলবে না।
তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বিছানায় উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করবেন? নাকি হাটহাঁট করবেন? মিসির আলি জানালার কাছে চলে গেলেন। যদি কুকুরটাকে দেখা যায়। চেরী গাছের নিচে কেউ কি আছে? হ্যাঁ আছে তো বটেই। ঐ তো হুইল চেয়ারটা দেখা যাচ্ছে। হুইল চেয়ারের পেছনে আছে। বরকত। রাত তিনটা পঁচিশ মিনিটে ওরা দুজন কী করছে? তারা দেখার প্রস্তুতি?
হঠাৎ মিসির আলির বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন হুইল চেয়ারে বসা মানুষটা উঠে দাঁড়িয়েছে। এই তো হাঁটতে শুরু করেছে। মন্দিরের দিকে কি যাচ্ছে? হ্যাঁ ঐ দিকে যাচ্ছে। এখন সিগারেট ধরিয়েছে! আবার ফিরে আসছে। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট এখন ফেলে দিল। এই মানুষটা যে সুলতান তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে? না কোনো সন্দেহ নেই। মানুষটা আবার হাঁটতে শুরু করেছে। মিসির আলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। না মানুষটা মন্দিরের দিকে যাচ্ছে না। সে মন্দিরের পেছনে যাচ্ছে। মন্দিরের পেছনে আছে কুয়া। এখান থেকে কুয়া দেখা সম্ভব না। কিন্তু স্বপ্নে সম্ভব। মিসির আলি কুয়া দেখার জন্যে অপেক্ষা করছেন। কুয়া দেখা গেল না। মানুষটা চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন।
মিসির আলির মাথায় সমুদ্ৰ গৰ্জনের মতো শব্দ হচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও সমুদ্র আছে। বড় বড় ঢেউ উঠছে। ঢেউয়ের মাথায় সমুদ্র ফেনা। মাথা এলোমেলো লাগছে। কেউ কি ভরাট গলায় কবিতা আবৃত্তি করছে?
I let myself in at the kitchen door.
It is you, she said, I cant get up. Forgive me.
Not answering your knock. I can no more
Let people in than I can keep them out.
এটা কার কবিতা? মিসির আলি কিছুতেই মনে করতেন পারলেন না। ঘুমে তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মাথার ভেতর কবিতাটা ভাঙা রেকর্ডের গানের মতো বেজে যাচ্ছে–
I let myself in at the kitchen door.
It is you, she said, I cant get up. Forgive me.
আমাকে ক্ষমা কর, আমি উঠতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা কর, আমি উঠতে পারছি না। I can’t get up. Forgive me.