Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আমিই মিসির আলি || Humayun Ahmed » Page 3

আমিই মিসির আলি || Humayun Ahmed

লিলিকে দেখে মিসির আলি চিনতে পারলেন না। চিনতে পারার কথাও না-দরজা ধরে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আগের দিনের লিলি না, অন্য কেউ। মাথার চুল নীল রঙের স্কার্ফ দিয়ে ঢাকা। চোখে কালো চশমা। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। জাপানি কিমানের মতো একটা পোশাক পরেছে। তার রঙ দেখে চোখ ধাধিয়ে যায়। উঁচুহিলের জুতা পরেছে। বলে তাকে দেখাচ্ছেও অনেক লম্বা।

চাচাজী আমাকে চিনতে পারছেন না, আমি লিলি। মাহাবা বেগম।

মিসির আলি বিড়বিড় করে বললেন, ও আচ্ছা আচ্ছা।

সত্যি করে বলুন তো আমাকে চিনতে পেরেছিলেন?

না চিনতে পারি নি।

মানুষের চেহারা মনে রাখা কত কঠিন দেখলেন?

দেখলাম।

আমি কী করেছি। জানেন? লম্বা করে লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট লম্বা করেছি। মানুষকে চেনা যায় ঠোঁট দিয়ে আর চোখ দিয়ে। যে দুটা জিনিস দিয়ে চেনা যায়, সে দুটা জিনিস আমি বদলে দিয়েছি! চশমা দিয়ে চোখ ঢেকেছি। আর ঠোঁট বদলে দিয়েছি।

মিসির আলি বললেন, লিলি বোস! তোমাকে সুন্দর লাগছে।

সুন্দর দেখাবার জন্যে আমি সাজ করি নি। নিজেকে বদলে দেবার জন্যে করেছি। ভালো কথা চাচাজী, আপনি কি কেরোসিনের চুলা এইসব কিনে ফেলেছেন?

না কেনা হয় নি।

লিলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, বাঁচলাম। কারণ আমি সব কিনে ফেলেছি। এমন অনেক কিছু কিনেছি যা লিষ্টে ছিল না, যেমন হারিকেন, টর্চ, ব্যাটারি। হাফ কেজি সুতলি কিনেছি।

সুতলি কেন?

এখন আপনার কাছে মনে হচ্ছে সুতলি কী জন্যে? কিন্তু একা থাকতে গিয়ে দেখুন সুতলি কত কাজে লাগবে। মশারি খাটাবার জন্যে লাগবে। ভেজা জামা কাপড় শুকুতে দেবেন–তার জন্যে দড়ি টানাতে হবে। আরো অনেক কিছুর জন্যে লাগবে। শলার ঝাড়ুও কিনেছি।

কত টাকা খরচ হযেছে?

আপনার বাজেটের চেয়ে কম লেগেছে।

তুমি তো জানি না। আমার বাজেট কত?

বাজেট যতই হোক, তারচেয়ে কম। কারণ বাংলাদেশে আমার চেয়ে দরদরি আর কেউ করতে পারে না। চাচাজী শুনুন। এই যে বাজারটাজার করে ফেলেছি তার জন্যে রাগ করেন নি তো?

না।

প্লিজ রাগ করবেন না। আরেকটা কথা জিনিসগুলির দাম দেবারও চেষ্টা করবেন। না। কোনো লাভ হবে না। কারণ কিছুতেই দাম দিতে পারবেন না। আমার হাজবেন্ডের চিঠিটা পড়েছেন?

হ্যাঁ।

আপনি টোপ গেলেন নি। তাই না? আপনি নিশ্চয় সমুদ্র ফেলে তারা দেখতে যাচ্ছেন না? সমুদ্র হাত দিয়ে ছোয়া যায়। আকাশের তারা যত সুন্দরই হোক হাত দিয়ে ছোয়া

তারা দেখার ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারছি না। আমার এক ছাত্রের সঙ্গে সবকিছু ঠিক করা। সে আবার আমাকে অতিরিক্ত রকমের শ্রদ্ধাভক্তি করে। সে টেকনাফে এসে বসে থাকবে।

লিলি হাসিমুখে বলল, আপনাকে টেকনাফে না দেখলে তার মাথা খারাপের মতো হয়ে যাবে। সে ভাববে আমাদের স্যার তোলা টাইপ মানুষ, না জানি তার কী হয়েছে!

ঠিক বলেছ লিলি।

আমার কোনো ইএসপি ক্ষমতা নেই, কিন্তু আমি জানতাম। আপনি আমাদের এখানে আসবেন না। আমি আমার হাজবেন্ডকে সেটা বলেছি। সে বিশ্বাস করে নি। তার ধারণা সে এমন গুছিয়ে চিঠিটা লিখেছে যে চিঠি পড়েই আপনি হোণ্ড অল বেঁধে রওনা দিয়ে দেবেন। উত্তর দক্ষিণে তাকবেন না।

মিসির আলি বললেন, চিঠিটা খুবই গুছিয়ে লেখা।

লিলি বলল, আপনার জন্যে চিঠিটা গুছিয়ে লেখা না। আবেগ আছে এমন সব মানুষদের জন্যে চিঠিটা গুছিয়ে লেখা। আপনি তাদের দলে পড়েন না।

তোমার ধারণা আমার আবেগ নেই?

আছে তবে তা সাধারণ মানুষের আবেগ না। অন্য ধরনের আবেগ। আপনাকে যদি লেখা হত-আমি মহাবিপদে পড়েছি। মারা যাচ্ছি। একমাত্র আপনি আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাচাতে পারেন। তাহলে আপনি চলে যেতেন। কিন্তু সেটা তো আর লেখা যাবে না। কারণ ও মারা যাচ্ছে না!

মিসির আলি বললেন, লিলি তুমি এক কাজ করা! তোমাদের ঠিকানাটা লিখে রেখে যাও। সমুদ্র দেখা শেষ হলে তোমাদের ওখানে চলে যাব।

আপনি একা একা খুঁজে বের করতে পারবেন না। যাওয়াও খুব ঝামেলা, ট্রেন, বাস-রিকশা-হাঁটা।

একটু ঝামেলা না হয় করলাম।

লিলি হেসে ফেলে বলল, থাক দরকার নেই। চাচাজী শুনুন আমি কিন্তু আজও পঞ্চাশ মিনিট থাকব। আমাকে আগেভাগে বিদায় করে দিতে চাইলেও আমি যাব না। তবে আজ যে গতদিনের মতো শুধু বকবক করব তা না। আপনাকে কফি বানিয়ে খাওয়াব। আমি কফি নিয়ে এসেছি। আপনি কফি পছন্দ করেন তো?

করি।

মিসির আলি দেখলেন লিলি তার কাঁধে ঝোলানো পাটের ব্যাগ থেকে কফির কৌট, মগ, চায়ের চামচ এবং ফ্লাঙ্ক বের করছে। বোঝা যাচ্ছে কফি বানানো হবে। মেয়েটা কফির সব সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে এসেছে। গরম পানিও এনেছে। ফ্লাস্কে নিশ্চয়ই গরম পানি।

লিলি বলল, মেশিন ছাড়া এক্সপ্রেসো কফি বানানো যায় না, কিন্তু আমি বানাতে পারি। আপনাকে শিখিয়ে দিচ্ছি। আপনি প্রতিটি স্ট্রেপ খুব ভালোভাবে লক্ষ করুন। এই দেখুন কী করছি-এক চামচের চেয়ে সামান্য বেশি নিলাম কফি। চিনি নিলাম তিন চামচ। এখন চিনি আর কফি মিক্স করছি। চামচ দিয়ে ঘষে ঘষে মেশানো। এই মেশানোর কাজটা অনেকক্ষণ করতে হবে। যত ভালোমতো মেশাবেন কফি তত ভালো হবে।

এত যন্ত্রণা?

ফন্ত্রণ ভাবলে যন্ত্রণা। আমি কখনো যন্ত্রণা ভাবি না। যে লেখক লেখাকে যন্ত্রণা মনে করেন। তিনি কখনো লেখক হতে পারেন না। ঠিক তেমনি যে রাধুনি রান্নাকে যন্ত্রণা মনে করেন। তিনি রাঁধুনি হতে পারেন না। চাচাজী আপনার কাছে কি আলু আছে?

না।

থাকলে ভালো হত। আমি আপনাকে আলু ভাজা কী করে করতে হয় শিখিয়ে দিতাম। যেসব রান্না খুব সহজ মনে হয়। সেসব রান্না আসলে খুব কঠিন। আমার মতে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন রান্না হল চা বানানো, আর দ্বিতীয় কঠিন রান্না হল আলু ভাজা।

লিলি চিনির সঙ্গে কফি মিশিয়েই যাচ্ছে। ক্লান্তিহীন আঙুল নাড়াচাড়া করছে। তার মুখ উজ্জ্বল। যেন কোনো বিশেষ কারণে সে আনন্দিত। আনন্দ চেপে রাখতে পারছে না। মিসির আলি ভুরু কুঁচকালেন। সেই বিশেষ কারণটা কী? তিনি তাদের বাগানবাড়িতে যাচ্ছেন না এটাই কি বিশেষ কারণ?

লিলি বলল, চাচাজী আপনি কি লক্ষ করছেন কফির কাপ থেকে এখন চমৎকার কফির গন্ধ আসতে শুরু করেছে?

হ্যাঁ লক্ষ করছি।

তার মানে হল এখন আমরা তৈরি পানি ঢালার জন্যে। এখন আমি ওয়ান থার্ড কাপ পানি ঢেলে, চামচ নেড়ে নেড়ে ফেনা করব। ফেনায় যখন কাপ ভর্তি হয়ে যাবে তখন বাকি পানিটা ঢালব।

তৈরি হয়ে যাবে এক্সপ্রেসো কফি?

হ্যাঁ। আগে তো আর কফি বানানোর মেশিন ছিল না। এইভাবেই কফি বানানো হত। এখন আর কেউ কষ্ট করতে চায় না। ফন্ট করে মেশিন কিনে ফেলে।

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, লিলি তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব আনন্দিত। তোমার মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা ছিল। দুশ্চিন্তা হঠাৎ কেটে গেছে।

লিলি বলল, কফি বানাচ্ছি। তো এই জন্যেই আমাকে আনন্দিত মনে হচ্ছে। যে কোনো রান্নাবান্নার সময় আমি খুব আনন্দে থাকি।

মিসির আলি বললেন, ব্যাপারটা তা না! যেই মুহুর্তে আমি বললাম-আমি তোমাদের বাগানবাড়িতে যেতে পারছি না, সেই মুহুর্তেই তোমার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। কারণ ব্যাখ্যা করে তো।

আমি আমার হাজবোন্ডের সঙ্গে বাজি রেখেছিলাম যে আপনি যাবেন না। আপনি না। যাওয়াতে আমি বাজি জিতেছি, তো এই জন্যেই হয়তো আমার চোখেমুখে আনন্দ চলে এসেছে। পৃথিবীর সমস্ত স্ত্রীদের একটা চেষ্টা থাকে কোনো না কোনোভাবে তাদের স্বামীদের হারিয়ে দেওয়া। যেহেতু আপনি বিয়ে করেন নি-আপনি এই ব্যাপারটা জানেন না।

লিলির কফি বানানো শেষ হয়েছে। ফেনো-ওঠা কফির কাপ মিসির আলির সামনে রাখতে রাখতে সে বলল, চাচাজী চুমুক দিয়ে দেখুন। মিষ্টি একটু বেশি লাগবে। উপায়। নেই, এক্সপ্রেসো কফি কড়া মিষ্টি না হলে ভালো লাগে না।

মিসির আলি কফির কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, লিলি আমি সিদ্ধান্ত পাল্টেছি! তোমাদের বাগানবাড়িতে যাব। শেষ পর্যন্ত তুমি তোমার স্বামীর কাছে বাজিতে হারলে।

লিলি বলল, কফিতে চুমুক দিন। এত কষ্ট করে বানালাম আর আপনি কাপ হাতে নিয়ে বসে আছেন?

মিসির আলি কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, এখন যদি আমরা রওনা দেই। কতক্ষণে পৌঁছব?

পৌঁছতে পৌঁছতে রাত নটা দশটা বেজে যাবে।

তাতে কোনো সমস্যা নেই তো?

জি না সমস্যা নেই।

তাহলে চল কফি শেষ করে রওনা দিয়ে দেই।

কফি খেতে কেমন হয়েছে আপনি কিন্তু এখনো বলেন নি।

মিসির আলি নিচু গলায় বললেন, এত ভালো কফি আমি আমার জীবনে খেয়েছি বলে মনে পড়ে না।

লিলি ক্লান্ত গলায় বলল, থ্যাংক য়্যু।

সে তার মাথার নীল স্কার্ফ খুলে বিশেষ কায়দায় মাথা ঝাকি দিয়েছে। তার চুল ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। চেহারা আবার প্যান্টে গেছে।

মিসির আলির মনে হল মেয়েটা কখন কী করবে। সব আগে থেকে ঠিক করা। সে যে একটানে মাথা থেকে স্কার্ফ খুলে মাথা ঝাকাবে এটাও সে আগে থেকেই ঠিক করে এসেছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *