Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আমার সাইন্টিস মামা || Muhammad Zafar Iqbal » Page 11

আমার সাইন্টিস মামা || Muhammad Zafar Iqbal

আমি আর মাহবুব চুপচাপ মামার মাইক্রোবাসটাতে বসে আছি। ডোরিন আর টনি এসেছিল, অনেকক্ষণ আমাদের সাথে কথা বলে একটু আগে তাদের রুমে ফিরে গেছে। খাবারের প্যাকেট নিয়ে এসেছিল আমরা চারজন বসে সেগুলো খেয়েছি। খুবই মজার খাবার দাবার, মনমেজাজ ভালো থাকলে খাবারগুলো মজা করে খেতাম, কিন্তু এখন শুধু খাওয়ার জন্য খেয়েছি। মজাটা টের পাই নাই, পেটটা শুধু ভরেছে।

ডোরিন আর টনি চলে যাবার পর আমি তার মাহবুব আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। দেখলাম আস্তে আস্তে রিসোর্টটার লাইটগুলো একটা একটা করে নিভতে শুরু করেছে। যখন পুরো রিসোর্টটা মোটামুটি অন্ধকার হয়ে গেল তখন আমি আর মাহবুব আমাদের মাইক্রোবাস থেকে বের হলাম।

আমার ব্যাকপেকটা ঝেড়ে পরিষ্কার করেছি। সেখানে কয়েকটা জিনিস নিয়েছি, একটা টর্চলাইট, একটা চাকু, আমার ডাইরিটা (সেখানে যে পুলিশের এস পিকে আমরা গাড়ি একসিডেন্টের পরে উদ্ধার করেছিলাম তার ভিজিটিং কার্ডটা স্কচ টেপ দিয়ে লাগানো আছে)। তারপর খুব সাবধানে মামার গোপন বাক্সটা খুলে সেখানে থেকে মামার পিস্তলটা নিয়েছি। পিস্তলের ভিতরে একটা ম্যাগাজিন ভর্তি গুলি আর একটা বাড়তি ম্যাগাজিন। পিস্তলটা একটা তোয়ালে দিয়ে পেরিয়ে নিয়েছি। তারপর দুইজন খুব সাবধানে মাইক্রোবাস থেকে নেমে পা টিপে টিপে মনি কাঞ্চনের দেয়াল শেষে ঝোঁপ বাড়ের ভিতর দিয়ে প্রায় গুঁড়ি মেরে হেঁটে যেতে লাগলাম। মনি কাঞ্চনের পিছনে গিয়ে ঝোঁপ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে আমরা খুব সাবধানে সেই গোপন সিঁড়িটার কাছে পৌঁছালাম। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ঢাকনাটা বের করে আমরা সেটা টেনে তুলে ভিতরে ঢুকে গেলাম।

আমি আর মাহবুব তারপর সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলাম। আমি ব্যাকপেকটা খুলে মামার পিস্তলটা বের করে কোমরে গুঁজে নিলাম। সিনেমার সিক্রেট এজেন্টরা এইভাবে পিস্তল নেয়, কিন্তু এখন আমার আসলে সেই সব মাথায় নাই। ভয়ের চোটে রীতিমতো বাথরুম পেয়ে গেছে কিন্তু সেই কথাটা তো আর মাহবুবকে বলা যায় না। আমি ফিসফিস করে বললাম, “প্রথমে আমি ঢুকব, যদি আমি ধরা পড়ে যাই তাহলে তুমি আর ভিতরে ঢুকবে না।”

মাহবুব বলল, “প্রথমে আমিও ঢুকতে পারি।”

“না। প্রথমে আমি।” যদি ধরা পড়ে যাই তুমি বের হয়ে আমার ডাইরিটার শেষ পৃষ্ঠায় একটা ভিজিটিং কার্ড আছে। সেই কার্ডের মানুষটাকে ফোন করে সবকিছু বলবে।”

মাহবুব ফিসফিস করে বলল, “মানুষটা কে?”

“একজন পুলিশ অফিসার। তার পুরো ফ্যামিলিকে আমরা একসিডেন্ট থেকে বাঁচিয়েছিলাম।”

“ঠিক আছে।”

“তবে একটা কথা।”

“কি কথা?”

“তুমি ডাইরিটার কিছু পড়তে পারবে না। একটা শব্দও না। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“বল খোদার কসম।”

মাহবুব মনে হয় একটু অবাক হলো, তারপর বলল, “খোদার কসম।”

“ঠিক আছে। আমি তাহলে গেলাম।”

মাহবুব বলল, “যাও।”

আমি তখন খুব সাবধানে দরজাটা ফাঁক করে ভিতরে উঁকি দিলাম। আশেপাশে কেউ নেই। আমি তখন সাবধানে ভিতের ঢুকে মাত্র এক পা সামনে এগিয়েছে তখন হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি বিশাল পাহাড়ের মতো একটা মানুষ হুংকার দিয়ে বলল, “হু ইজ দ্যাট?”

আমি চমকে উঠলাম। এতো বড় একটা মানুষকে আমি দেখতে পেলাম না কেন? তখন অবশ্য এতো কিছু চিন্তা করার সময় নাই, আমি জানটা হাতে নিয়ে একটা দৌড় দিলাম।

পাহাড়ের মতো মানুষটা একটা লাফ দিয়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করল, একটুর জন্য তার হাত ফসকে গেল। কোথায় যাচ্ছি কোনদিকে যাচ্ছি আমি কিছুই জানি না শুধু নিজের জান বাঁচানোর জন্য ছুটে যাচ্ছি, কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলাম না। পাহাড়ের মতো মানুষটা আরেকটা লাফ দিয়ে আমাকে ধরে ফেলল। তার লোহার মতো আঙুল মনে হলো আমার শরীরের মাংস কেটে ভিতরে ঢুকে হাড় পর্যন্ত গুড়ো করে ফেলল।

মানুষটা আমাকে একটা ময়লা ত্যানার মতো ধরে উপরে তুলে আছাড় দিয়ে নিচে নামালোলা। আমি কোনোমতে আমার কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তলটা ধরে রাখলাম যেন বের হয়ে না যায় কিংবা মানুষটা দেখে না ফেলে।

মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “ইউ লিটল রাসকেল।”

চোখগুলো ভাটার মতো জ্বলছে মুখে বিকট গন্ধ মনে হচ্ছে এক্ষুণি আমার ঘাড় মটকে খেয়ে ফেলবে।

আমার হাতে সময় বেশি নাই, আমি বাঁচার শেষ চেষ্টা করলাম, ব্যাটা ছেলেদের যে জায়গায় মারলে সবচেয়ে বেশি ব্যথা লাগে আমি আমার ডান পা দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেখানে মারলাম। মানুষটা কোক করে করে একটা শব্দ করল তার বড় বড় চোখ দুটো মনি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে পুরো চোখটা কেমন যেন সাদা হয়ে গেল, দাঁতগুলো বের হয়ে তাকে একটা ডাইনোসরের মতো দেখতে লাগল। (আমি ডাইনোসর কখনো দেখি নাই। কিন্তু দেখতে নিশ্চয়ই এরকম হবে।)

আমার লাথি খেয়ে মানুষটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে তার দুই হাত দিয়ে ব্যথা পাওয়া জায়গাটা চেপে ধরে একটা গগন বিদারী চিৎকার দিল। আমি তখন আবার আমার জান নিয়ে ছুটে পালালাম। সামনে একটা ঘর, ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে দেখি বের হওয়ার কোনো জায়গা নেই, তাই যত তাড়াতাড়ি ঢুকেছিলাম তার থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম পাহাড়ের মতো মানুষটা উঠে দাঁড়িয়ে আবার আমার পিছনে পিছনে ছুটে আসছে।

আমি দৌড়ে আরেকটা ঘরে ঢুকে যত তাড়াতাড়ি পারি ছিটকানি লাগিয়ে দিয়ে পালানোর একটা রাস্তা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। কী করব যখন চিন্তা করছি ততক্ষণে মানুষটা এসে দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করছে। তার প্রচণ্ড ধাক্কায় পুরো দরজা ভেঙে যাবার অবস্থা হলো। মানুষটা মনে হয় একটু দূরে গিয়ে ছুটে এসে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। এর পরের বার ধাক্কা দেওয়ার সাথে সাথে আমি ছিটকানিটা খুলে ফেলে একটু সরে দাঁড়ালাম। মানুষটা এবারে যখন ছুটে এসে দরজা ধাক্কা দিল সাথে সাথে সে ভিতরে হুড়মুড় করে আছাড় খেয়ে পড়ে আবার একটা গগন বিদারী চিৎকার দিল। সেই ফাঁকে আমি লাফ দিয়ে বের হয়ে আবার জান নিয়ে দৌড়াতে লাগলাম।

মানুষটার চিৎকার এবং হইচই শুনে অনেক মানুষ বের হয়ে এসেছে। তারা এখনো বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে আমি তার মাঝে ছুটে যেতে লাগলাম। অন্য একজন মানুষ আমাকে ধরার চেষ্টা করল, ধরতে পারল না। আমি তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে একটা ঘরে ঢুকে ছিটকানি লাগিয়ে দিলাম। ঘরটা একটা ল্যাবরেটরি, ভিতরে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। আমি টেবিল থেকে ধাক্কা দিয়ে মূল্যবান যন্ত্রপাতি নিচে ফেলে দিয়ে হাতে নেওয়ার মতো একটা কিন্তু খুঁজতে লাগলাম। শেষ পর্যন্ত একটা চকচকে সিলিন্ডার পেয়ে গেলাম। সেটা দুই হাতে ধরে আমি গায়ের জোরে কিছু যন্ত্রপাতি গুড়ো করে দিলাম। কেন দিলাম কে জানে। মনে হয় কোনো কারণে আমার অনেক রাগ উঠে গেছে।

তারপর ঘরের বাতি নিভিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম ভেতরে কেউ ঢুকলেই তাকে মেরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। ইতস্তত ছোটাছুটি করার কারণে কোনদিকে কী আছে আর বুঝতে পারছি না, চেষ্টা করতে হবে যেদিক দিয়ে ঢুকেছি সেদিক দিয়ে বের হয়ে যেতে।

বাইরে কিছু মানুষের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনতে পেলাম। এবারে মানুষগুলো আর ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে না। তারা চাবি এনে চাবি দিয়ে দরজার তালা খোলার চেষ্টা করছে। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না, তার মাঝে হঠাৎ করে তালা খুলে ভিতরে কয়েকজন মানুষ ঢুকে গেল। আমি অন্ধকারে তাদের ধাক্কা দিয়ে বের হয়ে যেতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না। মানুষগুলো আমাকে জাপটে ধরে ফেলল, আমি তার ভেতরেই হাতের সিলিন্ডার ঘুরিয়ে কয়েকজনের নাক মুখ মোটামুটি থ্যাতলে দিলাম।

শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে ধরে ফেলল, ঘরের লাইট জ্বালিয়ে তারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি দেখলাম আমার সিলিন্ডারের আঘাতে একজনের নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে আরেকজনের বাম চোখটা প্রায় বুজে এসেছে।

মানুষগুলো সবই বিদেশি। হড়হড় করে কিছু একটা বলছে, কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন দেখলাম একজন বাঙালি মানুষ দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। কাছে এসে সে আমাকে দেখে তোতলাতে তোতলাতে বললম, “তু-তু-তুমি? আবার?”

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “হ্যাঁ। আমি আবার।”

“কেন?”

আমি বললাম, “বুঝেন নাই কেন? আমার মামা কোথায়?”

মানুষটা বলল, “তোমার মামা এখানে নাই।” যদি সত্যি আমার মামা এখানে না থাকতো কিংবা মামার কথা না জানতো তাহলে মানুষটা অবাক হয়ে বলতো, মামা? কোন মামা? কার মামা? কিন্তু মানুষটা আমার মামার কথা খুব ভালো করে জানে।

আমি বললাম, “মিথ্যা কথা বলেন কেন? আমার মামাকে ধরে এনেছেন কেন?”

“আমরা তোমার মামাকে ধরে আনব কেন?” মানুষটা তার কথাগুলো খুব জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করল কিন্তু কথাটার মাঝে বেশি জোর বোঝা গেল না। বোঝাই গেল সে মিথ্যা কথা বলছে।

আমি বললাম, “আমি বলব কেন আপনারা আমাকে ধরে এনেছেন? বলব?”

মানুষটা মিনমিন করে বলল, “বল।”

“তার কারণ হচ্ছে আপনারা যে থ্রি স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরি বানাচ্ছেন সেটা ভূয়া। পুরোপুরি ভূয়া।”

“ভূয়া?”

“হ্যাঁ। আসলে এটা হচ্ছে একটা ইউরেনিয়ামের খনি।”

এবারে সবগুলো মানুষের চোয়াল এক সাথে ঝুলে পড়ল। আমার একেবারে মনে হলো কটাশ করে একটা শব্দ হলো। আমি এতোক্ষণ বাংলায় যে কথাগুলো বলছিলাম তার কিছুই বিদেশিগুলো বুঝে নাই কিন্তু তারা থ্রি স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আর ইউরেনিয়াম এই দুটা কথা বুঝতে পারছে এবং এক সাথে সবাই ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠেছে।

আমি দেখলাম সবগুলো মানুষের চোয়াল একবার বন্ধ হচ্ছে আরেকবার খুলছে, কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর যে বিদেশিটার চোখ প্রায় বুজে গিয়েছে সে আমতা আমতা করে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, “হাউ ডু ইউ নো?”

আমি মুখের মাঝে খুবই উঁচু ধরনের ভাব ফুটিয়ে বললাম, “গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি।”

মানুষটার চোয়াল আবার ঝুলে পড়ল। বলল, “গা-গা-গা–” পুরো গামা রে স্পেকট্রোস্কাপি বলতে পারল না। আমি মুখে আরো বেশি ভাব ফুটিয়ে বললাম, “সোডিয়াম আয়োডাইড ক্রিস্টাল উইথ ফটোমাল্টিপ্লায়ার।”

মানুষটার চোয়াল এবারে বন্ধ হয়ে গেল। আমি সিনেমার ভিলেনদের মতো মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করলাম, “ইউ ওয়ান্ট দিস সিক্রেট সো ইউ হাইজ্যাক মাই সাইন্টিস মামা।” তোমরা এটা গোপন রাখতে চাও সেইজন্য মামাকে হাইজ্যাক করে এনেছ। ইংরেজিটা পুরোপুরি মনে হয় ঠিক হয় নাই কিন্তু মানুষগুলো আমার কথাগুলো ঠিকই বুঝতে পারল। তাদের লাল মুখ কালো না হয়ে কেমন যেন বেগুনি হয়ে গেল।

এরা নিজেরা নিজেরা কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর বাঙালি মানুষটাকে কিছু একটা বলে মুখ ভোলা করে দাঁড়িয়ে রইল।

বাঙালি মানুষটাকে কেমন যেন নার্ভাস মনে হলো। সে আমার হাত ধরে বলল, “আস।” তার ঠিক পিছনে লাল মুখের একটা মানুষ বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভঙ্গীটা খুবই স্পষ্ট, আমি যদি একটু খানি উল্টাপাল্টা কিছু করি তাহলে সে আমার মাথাটা টেনে ধর থেকে আলাদা করে ফেলবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়?”

“সব কথা তোমাকে বলতে হবে কেন?”

“কারণ আপনি তো বিদেশি না–আপনি এই দেশের।”

“তাতে কী হয়েছে?”

“বিদেশিদের পা চাটতে হয় না। খুব লজ্জার ব্যাপার।”

আমার কথা শুনে মানুষটা কেমন যেন লাল হয়ে উঠে। লজ্জায় না রাগে বুঝতে পারলাম না।

আমি ইচ্ছা করলেই ঝটকা মেরে নিজের হাত ছুটিয়ে নিতে পারি। পাহাড়ের মতো মানুষটার অসুবিধার জায়গায় যেভাবে কষে একটা লাথি দিয়েছিলাম ঠিক সেভাবে এই মানুষটাকেও অচল করে দিতে পারি। ঠিক কী কারণ জানি না হঠাৎ করে আমার সব ভয় ডর চলে গেছে, আমার মনে হতে থাকে যে এই মুহূর্তে কিছু করার দরকার নাই। দেখি কী করে। আমি এখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। মনে হয় পেটের কাছে প্যান্টের ভিতর মামার পিস্তলটা খুঁজে রেখেছি সেইজন্য। শুধু তাই না পকেটে বুলেট ভরা একটা ম্যাগাজিনও আছে। সাথে পিস্তল আর বুলেট থাকলে মনে হয় ভয়। লাগে না।

বাঙালি মানুষটা আমাকে টেনে নিতে থাকে, পিছন পিছন লাল মুখের মানুষটা থপ থপ করে পা ফেলে ফেলে আসতে থাকে। হেঁটে হেঁটে একটা ঘুরে ঢুকে সেখানে একটা আলমারির সামনে মানুষটা দাঁড়িয়ে গেল। তখন লাল মুখের মানুষটা ধাক্কা দিয়ে আলমারিটা সরাতেই পিছনে একটা দরজা দেখা গেল। বাঙালি মানুষটা দরজা খুলে আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। ঘরের ভিতর দেওয়ালে হেলান দিয়ে একজন মানুষ বসে আছে, মানুষটির চেহারা না দেখেই আমি বুঝতে পারলাম, এটি আমার মামা।

আমি চিৎকার করে উঠলাম, “মামা!”

মামা ঘুরে আমার দিকে তাকালো, আমি তখন বুঝতে পারলাম, মামার হাত দুটো পিছনে বাঁধা শুধু তাই না আমি বুঝতে পারলাম মামাকে এই জানোয়ারগুলো মেরেছে। হঠাৎ করে আমার ভিতরে অসহ্য রাগ পাক খেয়ে উঠল, মনে হলো আমি বুঝি সবার চোখ খাবলে তুলে নিতে পারব।

মামা দুর্বল গলায় বলল, “তোকেও ধরে এনেছে!”

“হ্যাঁ মামা।”

“কী আশ্চর্য। তুই না একটা বাচ্চা ছেলে। দশ বছর বয়স।”

“বারো।”

“একই কথা।”

বাঙালি মানুষটা আমার গলায় ধাক্কা দিয়ে সামনে ঠেলে দিল। লাল মুখের মানুষটা তখন আমাকে খপ করে ধরে আমার হাত দুটো পিছনে নিয়ে বেঁধে ফেলে। তারপর আমাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলল, “গো টু হেল। জাহান্নামে যাও।”

আমি মেঝেতে পড়ে থেকে সেই অবস্থায় চি চি করে বললাম, “ইউ গো টু হেল।” তুমি জাহান্নামে যাও।

মানুষটা আমার দিকে এগিয়ে এলো, রাগে তার মুখটা থম থম করছে। বুট পরে থাকা পা দিয়ে মানুষটা আমার পাঁজরে একটা লাথি দিল এবং আমি সেই লাথি খেয়ে প্রায় দশ হাত দূরে ছিটকে পড়লাম। আমার প্রথম মনে হলো আমি মরে গেছি। নিঃশ্বাস আটকে ছিল, অনেক কষ্টে বুক থেকে বের করে মনে হলো এখনো মরিনি কিন্তু আর দুই মিনিটের মাঝে মরে যাব। দুই মিনিট পরে মনে হলো এবারের মতো বেঁচে যেতে পারি। তখন চোখ খুলে তাকালাম। দেখলাম ঘরটা খালি, শুধু মামা আমার উপর ঝুঁকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি চোখ খোলার পর মামা আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল, বলল, “অনেক ব্যথা লেগেছে?”

আমি বললাম, “মোটামুটি।”

“জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নে। তারপর উল্টো দিক দিয়ে একশো থেকে এক পর্যন্ত গুণে আয়।”

আমি হাসার মতো ভঙ্গী করে বললাম, “আমি এক থেকে একশ পর্যন্ত সোজা দিকেই কখনো গুণি নাই!”

মামা একটু নড়েচড়ে পিছনে সরে দেয়াল হেলান দিয়ে বসল। বলল, “তোকে আমার সাথে আনাটা ঠিক হয় নাই। অনেক বড় গাধামো হয়েছে।”

“না মামা, গাধামো কেন হবে?”

“হয়েছে। এরা খারাপ মানুষ। খুব খারাপ। দেখলি না তোর মতো বাচ্চা ছেলেকে কীভাবে মারল। অনেক ব্যথা লেগেছিল?”

“হ্যাঁ মামা। এখন ঠিক হয়ে যাচ্ছে।”

“ভয় পাস না, ঠিক হয়ে যাবে।”

মামাকে এখনো বলিনি যে আমি তার পিস্তলটা নিয়ে এসেছি। সেটা ব্যবহার করতে চাইলে তো আগে হাতের বাঁধন খুলতে হবে। সেটা আমার না, মামার দায়িত্ব। আমি মামাকে ডাকলাম, “মামা।”

“কী টোপন?”

“আমি তোমার জন্য একটা গিফট এনেছি।”

“কী গিফট? একটা নেইল কাটার?”

“না মামা। তোমার পিস্তলটা।”

মামা দেওয়ালে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে ছিল, আমার কথা শুনে হাত বাধা অবস্থায় প্রায় লাফ দিয়ে উঠে বসে গেল। প্রায় চিৎকার করে বলল, “কী বললি? পিস্তল? আমার পিস্তল?”

“হ্যাঁ মামা।” আমার প্যান্টে গুঁজে রেখেছি। পকেটে এক্সট্রা ম্যাগাজিন।”

“কিন্তু সেইটা ছিল সেফটি বক্সে। পাসওয়ার্ড দেওয়া সেফটি বক্সে।”

“হ্যাঁ মামা।”

“তুই তুই তুই আমার পাসওয়ার্ড জানিস?”

“না জানার কী আছে? তুমি যেভাবে পাসওয়ার্ড ঢোকাও সেইটা জানতে না চাইলেও আমি জেনে যাই।”

মামা খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল, “তুই আসলেই একটা মিচকি শয়তান।”

“কিন্তু মামা, তুমি পিস্তলটা ব্যবহার করবে কেমন করে? হাতগুলো যে বাঁধা।”

“হাতের বাঁধা খোলা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু তার আগে তোকে একটা জোক বলতে হবে।”

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “এখন তুমি জোক বলবে? আগে হাতের বাঁধা খুলে ফেলি।”

“এইটা কী কঠিন? তুই গড়িয়ে গড়িয়ে আমার কাছে আয়। আমার পিছনে তোর হাতগুলো দে, আমি তোর হাত খুলে দেই। তারপর তুই আমারটা খুলে দিবি।”

“এতো সোজা!”

“হ্যাঁ, এত সোজা। শুধু এর মাঝে কেউ চলে না আসলেই হলো।”

আমি তখন গড়িয়ে গড়িয়ে মামার কাছে চলে এসে মামার হাতের কাছে আমার হাতগুলো রাখলাম। মামা আমার হাতের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, “এবারে জোকটা শোন। এই মাথা মোটা মানুষগুলোর কাজ কর্ম দেখে আমার জোকটা মনে পড়ল। একবার একটা মানুষের বাসায় চোর এসেছে। মানুষটা চোরটাকে ধরে ফেলে তার খাটের সাথে বেঁধে গেছে থানায়, পুলিশ ডেকে আনতে। পুলিশ জিজ্ঞেস করল চোরটাকে ঠিক করে বেঁধেছ তো? মানুষটা বলল, হ্যাঁ খুব ভালো করে খাটের সাথে চোরের পা টা বেঁধে রেখেছি। পুলিশ চোখ কপালে তুলে বলল, শুধু পা? হাত বাঁধা নাই? মানুষটা, বলল, না হাতটাতো বাঁধি নাই। পুলিশ বলল তাহলে চোরটা এতক্ষণে তার হাত দিয়ে পায়ের বাঁধা খুলে পালিয়ে গেছে। মানুষটা কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল, মনে হয় পালায় নাই। চোরটা আমার মতো পাকিস্তানী! আমার মাথায় যখন এই বুদ্ধিটা আসে নাই, চোরের মাথায়ও আসবে না, সে নিশ্চয় পা বাঁধা নিয়ে বসে আছে–” মামা তার জোক শেষ করে হা হা করে হাসতে লাগল। নিজের জোক শুনে কাউকে আমি কখনো এভাবে হাসতে দেখি নাই।

আমিও হাসলাম। মামা হাসি থামিয়ে বলল, এই বিদেশি গুলির বুদ্ধি পাকিস্তানীদের মতো! যখন দুইজন মানুষের হাত বেঁধে একটা ঘরে রাখা হয় তখন তাদের একজন যে আরেকজনের বাঁধা খুলে ফেলতে পারে সেইটা তাদের মাথায় আসে নাই!”

মামা ততক্ষণে আমার হাত খুলে দিয়েছে, আমি হাত দুইটা একটু নাড়লাম তারপর মামার হাতের বাঁধনটা খুলে দিতে দিতে বললাম, “মামা, পাকিস্তানিরা কী আসলেই এত বোকা?”

“এরা একাত্তর সালে আমাদের অনেক জ্বালিয়েছে তাই পৃথিবীর যত খারাপ গল্প, বোকামীর গল্প, গাধামির গল্প সব তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

আমি পিস্তলটা নিয়ে আসার কারণে মামার মেজাজটা অনেক ভালো। মামা মনের খুশিতে বকবক করতে থাকে। বিদেশিটার লাথির কারণে বুকের মাঝে এখনো টন টন করছে তারপরেও আমার মেজাজটাও অনেক ভালো। আমিও মামার বকবকানী শুনতে লাগলাম।

শেষ পর্যন্ত মামার হাতের বাঁধনটা খুলে ফেলতে পারলাম। মামা তার হাত দুইটা কিছুক্ষণ ডলে ডলে রক্ত চলাচল করালো তারপর দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা ইংরেজি গালি দিল। মামাকে আগে কখনো কাউকে গালি দিতে শুনি নাই, তবে এখন মামা গালি দিতেই পারে। আমাকেই যখন এতো খারাপভাবে মেরেছে তখন মামাকে না জানি কত খারাপভাবে মেরেছে। আমি পিস্তলটা মামার কাছে দিলাম। মামা পিস্তলটাকে চুমু দিয়ে ছোট বাচ্চার মতো আদর করল। পিস্তলকে যে আদর করা যায় আমি সেটাও জানতাম না।

আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামা, আমরা এখন কী করব?”

বাইরে তো অনেকগুলো মানুষ এখনই বের হওয়া ঠিক হবে না। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করি, দুই চারজন আসুক, সেগুলোকে বেঁধে ফেলি তারপর বাইরে যাব।”

“কেমন করে বাঁধবে?”

“কেন? যে নাইলনের দড়ি দিয়ে আমাদের বেঁধেছে সেইটা দিয়ে।”

“কিন্তু আগে ধরতে হবে না?”

“ধরব। আমার হাতে একটা পিস্তল, আমার হাতের টিপ মারাত্মক। শুটিংয়ে গোল্ড মেডেল পেয়েছি!”

“আসলেই গুলি করবে?”

“মনে হয় করতে হবে না। ভয় দেখিয়েই কাজ করে ফেলা যাবে।”

“কেউ কী আসবে?”

“আসবে। আসবে। নিশ্চয়ই আসবে।” মামা তারপর ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে গুনগুন করে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে লাগল, “যদি তার ডাক শুনে কেউ না আসে…”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *