Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আমার ডেঞ্জারাস মামী || Muhammad Zafar Iqbal » Page 6

আমার ডেঞ্জারাস মামী || Muhammad Zafar Iqbal

আমরা ট্রেন থেকে নামলাম অনেক ভোরে। আমাদের কেবিনটা ছিল দুজনের, নিচে একজন, ওপরে বাংকে আরেকজন। ওপর থেকে গড়িয়ে নিচে না পড়ে যাই সেজন্য মামী আমাকে নিচে শুতে বলেছিলেন কিন্তু আমি রাজী হই নাই। কেবিনটা খুবই সুন্দর একেবারে বিদেশী ট্রেনের মতো, আমি অবশ্য বিদেশে কখনো যাই নাই, তাদের ট্রেনও কখনো দেখি নাই, খালি সিনেমায় দেখেছি। শোয়ার জায়গাটাও খুব আরামের, ভেবেছিলাম বুঝি খুব ভালো ঘুম হবে। কিন্তু ভালো ঘুম হয় নাই, একটু পরে পরে ঘুম ভেঙেছে। সারাক্ষণই মনে হয়েছে লোকজন কথা বলে ডিস্টার্ব করছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি আর মামী দুজনে দুটি ব্যাকপেক নিয়ে নেমেছি। আমি কায়দা করে মাথায় একটা ক্যাপ লাগিয়েছি, হাওয়াই মিঠাই রঙের ক্যাপ, মামীর পরনে শাড়ী পায়ে বুট জুতো লোকজন মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকায়, মামী একেবারে ড্যাম কেয়ার।

মামীর সাথে আমি দুই এক পা এগুতেই একটা ছেলে দৌড়ে এলো, মামীকে দেখে খুশী হয়ে গেল, বলল, “ম্যাডাম, এসে গেছেন? রাতে কোনো অসুবিধা হয় নাই তো?”

মামী বললেন, “না, কোনো অসুবিধা হয় নাই।”

“ব্যাগটা আমাকে দেবেন?”

মামী মাথা নাড়লেন, “তোমার ব্যস্ত হতে হবে না, এই ব্যাকপেক আমি নিতে পারব।”

ছেলেটা তখন আমার দিকে তাকাল, বলল, “এই বুঝি আপনার ভাগ্নে? আমি শুনেছিলাম আপনার ভাগ্নী আসবে।”

“ভাগ্নীরই আসার কথা ছিল, লাস্ট মোমেন্টে অ্যাকসিডেন্টে পা ভেঙে গেছে।”

ছেলেটা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “আহা! কী সর্বনাশ! এখন ভালো আছে তো?”

“আমার ভাগ্নী একজন বাঘের বাচ্চা। সে ভালো থাকবে।”

ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। নিশ্চয়ই বলতে চাইছিল, “আর এ বুঝি শেয়ালের বাচ্চা!”

আমরা হাঁটতে থাকলাম, ছেলেটা বলল, “ওয়েটিং রুমে থামবেন? একটু ফ্রেশ হবেন?”

“আমরা যথেষ্ট ফ্রেশ। জাহাজে চলে যাই। সেখানে গিয়ে ফ্রেশ হওয়া যাবে।”

“ঠিক আছে।” বলে ছেলেটা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। মামী মনে হয় আগে এখানে অনেকবার এসেছেন তাই পথ না দেখালেও কোনো সমস্যা ছিল না। একটু সামনেই নদীর ঘাট। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলাম, সেখানে অনেকগুলো ট্রলার। ছেলেটা লাফিয়ে একটা ট্রলারে উঠে বলল, “ম্যাডাম, এই যে এই ট্রলার।”

শাড়ী পরা অন্য যে কোনো মহিলা হলে তাকে হাতে ধরে ট্রলারে তুলতে হতো। মামীকে কারো সাহায্য করতে হলো না। মামী আমাকেও ধরে তোলার চেষ্টা করলেন না। আমি নিজেই উঠলাম।

মামী তার ব্যাকপেক নিচে রেখে ট্রলারের ছাদে উঠে পা দুলিয়ে বসলেন। মাঝির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “মাঝি ভাই আপনার নাম কী?”

“মুসলিম।”

“মুসলিম ভাই, কতক্ষণ লাগবে যেতে?”

“ভাটায় টান দিয়েছে, আধা ঘণ্টার বেশী লাগবে না।”

“গুড! তাহলে রওনা দিয়ে দিই।”

“আর কেউ যাবে না?”

“যাবে। তারা পরে আসবে। আমরা চলে যাই।”

ছেলেটা ট্রলার থেকে নেমে গেল। নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বলল, “ভালোয় ভালোয় ফিরে আসেন ম্যাডাম, তখন কিন্তু একদিন থাকতে হবে।”

“থাকব। নিশ্চয়ই থাকব।”

মামীর দেখাদেখি আমিও ব্যাকপেক নিচে রেখে মামীর পাশে বসলাম। এত সকাল তারপরেও চারপাশে কত রকম নৌকা কত রকম ট্রলার চলছে। নদীর ঘাটে কত মানুষ কত কিছু টানাটানি করছে।

ট্রলারটা একটু ঘুরিয়ে নেওয়ার পর আমাদের মাঝি মুসলিম ভাই ট্রলারের ইঞ্জিনটা চালু করে দিল। সাথে সাথে কী বিকট ভট ভট শব্দ। এখন মনে হয় আর কথাবার্তা বলা যাবে না, বলতে চাইলে চিৎকার করে বলতে হবে। কী মুশকিল!

মজার ব্যাপার একটু পরে এই বিকট ভট ভট শব্দেও আমার অভ্যাস হয়ে গেল, আমি পরিষ্কার শুনলাম মামী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “নৌকাগুলো কী সুন্দর দেখেছিস?”

আমি তখন নদীর মাঝে নৌকাগুলো দেখলাম। আমার কেন জানি ধারণা ছিল সিনেমার মাঝে যেরকম সাদা রাজহাঁসের মতো বিদেশী নৌকাগুলো দেখি, সাঁই সাঁই করে যেতে থাকে সেগুলো হচ্ছে সুন্দর। আমাদের নৌকা হচ্ছে কালো, কেমন যেন গেরাইম্যা।

মামী বললেন, “সারা পৃথিবীর মাঝে আমরা সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে ভালো নৌকা তৈরি করতে পারি। একসময় আমরা সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো জাহাজ তৈরি করতাম। আমাদের তৈরি জাহাজে আমাদের নাবিকেরা সারা পৃথিবীতে ব্যবসা বাণিজ্য করত, আমরা ছিলাম সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে উন্নত—”

মামী থেমে গেলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”

“তারপর ব্রিটিশরা এসে এই দেশকে কলোনী বানিয়ে ফেলল। আমাদের যা কিছু আছে সবকিছু একটা একটা করে ধ্বংস করল। পৃথিবীতে ব্রিটিশ থেকে খারাপ কোনো জাতি নাই–” বলে মামী ব্রিটিশদের একটা খুবই খারাপ গালি দিলেন। আমি আগে কোনো মহিলাকে এরকম খারাপ গালি দিতে শুনি নাই!

মামীর মুখটা কেমন যেন শক্ত হয়ে গেল, বললেন, “আজকাল ইউরোপ আমেরিকা বড়ো বড়ো কথা বলে, আমাদের উপদেশ দেয় অথচ তারা বড়ো হয়েছে আমাদের সম্পদ দিয়ে। চিন্তা করতে পারিস? বাংলাদেশ থেকেই কত ট্রিলিয়ন ডলার নিয়েছে জানিস?”

মামী আমার দিকে তাকালেন, এর আগে কেউ আমার সাথে এরকম সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথাও বলে নাই। আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না, একটু বেকুবের মতো মাথা নাড়লাম।

মামী মুখটা আরও শক্ত করে বললেন, “চার্চিল বেটার জন্য কত লক্ষ লোক না খেয়ে মারা গেছে জানিস? একদিন না দুইদিন না টানা দুইশ বছর আমাদের অত্যাচার করেছে।”

শুধু একজন কথা বললে আরেকজন শুনলে সেটা আলাপ হয় না, আলাপ করতে হলে দুজনকেই কথা বলতে হয়, আমি তাই বললাম, “এই দেশের মানুষ এতদিন সহ্য করল কেন?”

মামী আমার দিকে তাকালেন, মনে হয় একটু অবাকও হলেন। আমার কাছে এই কথা মনে হয় আশা করেন নাই। বললেন, “তুই ঠিকই বলেছিস। দোষ আমাদেরও আছে, আমরা কেন এতদিন কলোনী হয়ে থাকলাম? মেরুদণ্ডে জোর ছিল না?”

মামী চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগলেন, আমি আর বিরক্ত করলাম না।

ট্রলারটা প্রথমে একটা নদীর ভেতর দিয়ে গেল, তারপর মনে হলো একটা বড়ো মোহনায় এসে পড়ল, সেখানে বড়ো বড়ো ঢেউ। দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে, সেখানে ছোটো বড়ো জাহাজ নোঙর করা। তাদের কোনো একটা মনে হয় আমাদের জাহাজ। আমি বুকের ভেতর একধরনের উত্তেজনা আর আনন্দের কাঁপুনী টের পেলাম।

মামী হঠাৎ করে আমার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “সাঁতার জানিস?”

আমি মাথা নাড়লাম, “জানি।”

মামী জিজ্ঞেস করলেন, “সুইমিংপুলের লুতুপুতু সাঁতার নাকি খাল বিল পুকুরের আসল সাঁতার?”

এই প্রথম আমার একটু গর্ব হলো, বললাম, “খাল বিল পুকুরের আসল সাঁতার।”

গরমের সময় নানাবাড়ী গিয়ে আমি আর আপু পুকুরে অনেক সাঁতার কেটেছি। আপু কলাগাছের ভেলা বানাত। বাড়ির সামনে খালে একটা ছোটো নৌকাও ছিল সেটাও চালিয়েছি।

মামী বললেন, “গুড। বড়ো নদী আর সমুদ্রে পানিতে পড়ে গেলে কেউ সাঁতরে নদী সমুদ্র পার হয়ে যাবে তা না। কিন্তু যারা সাঁতার জানে তারা পানিটাকে সম্মান করতে শিখে আবার ভালোবাসতে শিখে। পানির ভয়টা কেটে যায় কিন্তু উলটা পালটা রিস্ক নেয় না।”

“আর না জানলে?”

“পানিকে অসম্ভব ভয় পায়। আবার না বুঝে অনেক কিছু করে ফেলে। নিজে বিপদে পড়ে, অন্যদেরও বিপদে ফেলে।”

আমি আর মামী এখন ট্রলারের ছাদে দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখছিলাম, আমি বললাম, “মামী এই জাহাজে উঠার আগে আমার কিছু জানতে হবে?”

“নাহ! জানার কী আছে! জাহাজের ওপর থেকে সমুদ্র দেখবি।”

“কোনো বিপদ?”

“বিপদ?” মামী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন, তারপর হেসে ফেললেন, “হ্যাঁ, একটা বিপদ হতে পারে।”

“কী বিপদ?”

“সি সিকনেস। জাহাজের দুলুনীতে শরীর খারাপ হয়ে যাওয়া। মাথা ঘুরে বমি করে পুরা দশদিন কেবিনে শুয়ে থাকবি। আছে তোর মোশান সিকনেস? গাড়ীতে কোথাও গেলে শরীর খারাপ লাগে? বমি করিস?”

“নাহ! আম্মুর মাঝে মাঝে হয়। আমার হয় না।”

“না হলেই ভালো।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “যদি হয়, তাহলে কী করতে হয় মামী?”

মামী বললেন, “গুড কোশ্চেন। জেনে রাখা ভালো। এক: কাছাকাছি কিছুর দিকে না তাকিয়ে দূরে তাকাবি, দিগন্তের দিকে। দুই: শুকনো ক্র্যাকার আর কোল্ড ড্রিংকস খাবি। তিন: চোখে মুখে বাতাস লাগাবি। চার চেষ্টা করবি এটা ভুলে থাকতে। অন্য কিছুতে মনোযোগ দিবি কিন্তু বই পড়ার চেষ্টা করিস না।”

আমি মাথা নাড়লাম, ভালো সময়েই আমি বই পড়ার চেষ্টা করি না, মাথা ঘোরানোর সময় কোন দুঃখে বই পড়ব?

মামী তারপর মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন, একটু হাসি হাসি মুখে বললেন, “পাঁচ নম্বরটা আমি জানি না আসলে কাজ করে কিনা, তবে লোকে বলে এটার কথা। এটা হচ্ছে টোটকা।”

“টোটকা?”

“হ্যাঁ। একু প্রেশার। পি সিক্সে চাপ দিয়ে ধরে রাখবি।”

আমি মামীর দিকে তাকালাম, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “পি সিক্স? সেটা কী?”

মামী দেখালেন হাতের তালুর একটু নিচে কবজির কাছাকাছি জায়গাটা। ডাক্তারেরা যেখানে হাত দিয়ে টিপে ধরে পালস দেখে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, “এখানে চাপ দিলে বমি বন্ধ হয়ে যায়?”

“লোকে বলে, সত্যি মিথ্যা জানি না।”

“এরকম কোনো জায়গা আছে যেখানে চাপ দিলে অঙ্ক করা যায়?”

মামী হেসে আমার মাথার পেছনে একটা চাটি মারলেন। বললেন, “নিশ্চয়ই আছে! খুঁজে বের কর।”

আমি মনে মনে সি সিকনেসের জন্য মামীর পাঁচটা পয়েন্ট মনে রাখার চেষ্টা করতে লাগলাম। জাহাজে উঠে সবার সামনে কারো ওপরে বমি করে দিয়ে বেইজ্জতি হতে চাই না।

শেষ পর্যন্ত আমাদের ট্রলারটা একটা জাহাজের কাছে এসে থামল। কী সুন্দর জাহাজ, দেখলেই টাস্কি লেগে যায়। জাহাজের পাশে লেখা এম ভি ফেনিল। নামটাও মনে হয় কবিতা থেকে নিয়েছে। জাহাজের ওপর থেকে একজন একটা মইয়ের মতো নামিয়ে দিল, এখানে পা দিয়ে উঠতে হবে। উপরে জাহাজের রেলিং ধরে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের একজন বলল, “ওয়েলকাম নীরা!”

একজন কমবয়সী ছেলেকেও দেখলাম, কলেজে পড়ার বয়স। ছেলেটার চেহারার মাঝে কেমন জানি সাজুগুজু ভাব, এই বয়সের ছেলেদের মাঝে যেটা সবসময় দেখা যায়। সবচেয়ে আজব তার চুলের স্টাইল, কানের কাছে চুল চেঁছে রেখেছে কিন্তু উপরে জঙ্গলের মতো। আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে কয়েকবার হাত দিয়ে তার চুলটা ঠিক করল। শুধু তাই না হাতের স্মার্টফোন দিয়ে ক্লিক করে নিজের সেলফি তুলে ফেলল। কী আজব!

আমি আর মামী সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম।

উপরে যারা ছিল তারা আমাদের ঘিরে দাঁড়াল, একজন বয়স্ক মানুষ বলল, “নীরা, ইউ আর লুকিং গ্রেট। এই বুঝি তোমার ভাগ্নে? তোমার ভাগ্নীর পায়ের অবস্থা কেমন?”

তার মানে এরা আপুর খবর পেয়ে গেছে। মামী বললেন, “ভালো। আমার ভাগ্নী খুব তেজী মেয়ে, পা ভেঙে তাকে থামিয়ে রাখা যাবে না।”

“ভেরি গুড। আর এই ভাগ্নে? সে কী রকম?”

মামী হাসলেন, বললেন, “এবার টেস্ট হবে। দেখি কী রকম।” তারপর আমার দিকে তাকালেন, বললেন, “কী বলিস টুলু?”

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে বোকার মতো একটু হাসলাম। বয়স্ক ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কি সমুদ্র ভ্রমণের জন্য রেডি?”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “জি, রেডি।”

“ভেরি গুড।” তারপর একটি মুচকি হেসে বললেন, “তোমার এই গোলাপী রঙের টুপিটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। মনে হয় দুই মাইল দূর থেকেও দেখা যাবে!”

মানুষটা ঠাট্টা করছে কিন্তু ঠাট্টাটা খারাপ না, মজা করে বলেছে। মানুষটাকে আমার পছন্দ হলো। আমি বললাম, “আমার এই টুপিটার রং আসলে হাওয়াই মিঠাই রং।”।

মানুষটার বুঝতে একটু দেরী হলো, হঠাৎ করে বুঝতে পারলেন তারপর হা হা করে হাসতে লাগলেন।

মামী জিজ্ঞেস করলেন, “এবারে আমার কোন কেবিন?”

“মনে হয় লাকী সেভেন।”

মামী বললেন, “কেবিনে জিনিসপত্র রেখে আসি।”

“যাও। রাত্রে ঘুমাতে পেরেছ কিনা জানি না, একটু রেস্ট নিয়ে নাও।”

আমি মামীর পেছনে পেছনে আমাদের লাকী সেভেন কেবিনে রওনা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “মামী, এই বুড়ো মানুষটা কে?”

মামী অবাক হয়ে বললেন, “বুড়ো মানুষ? বুড়ো মানুষ কোথায় দেখলি?”

“ঐ যে যার সাথে কথা বললে।”

“উনি বুড়ো মানুষ হবেন কেন? চুল পাকা শুরু হলেই বুড়ো মানুষ হয়?”

আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “না, মানে, ঐ তো–

“উনি আমাদের টিম লিভার। ডক্টর সারোয়ার। অনেক বড়ো সায়েন্টিস্ট।”

মামী সাত নম্বর কেবিনের সামনে দাঁড়ালেন, নেমপ্লেটে মামীর নাম লেখা। দরজায় চাবি লাগানো, মামী চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। ছোটো একটা কেবিন, দুই পাশে দুটি বিছানা, দুটি জানালা, একটা বড়ো আয়না একেবারে বিদেশী কায়দা। আমি অবশ্য জীবনে বিদেশী জাহাজ দেখি নাই, সিনেমাতেও দেখি নাই, কিন্তু তবু মনে হলো এরকমই নিশ্চয় হবে।

মামী ঘাড় থেকে তার ব্যাকপেক খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কোন বেড নিবি? ডান দিকেরটা না বাম দিকেরটা?”

দুটি একেবারেই একরকম কিন্তু মামী যেহেতু জিজ্ঞেস করেছেন তখন কিছু একটা বলা উচিত। আমি যেহেতু ডান কাত হয়ে ঘুমাই তাহলে ডান দিকের বেডটা মনে হয় ভালো হবে, ঘুমানোর সময় কেবিনের দেওয়াল দেখতে হবে না। বললাম, “ডান দিকেরটা।”

মামী বললেন, “গুড।” তারপর তার বেডের ওপর ব্যাকপেকটা রেখে সেখান থেকে তার জিনিসপত্র বের করতে শুরু করলেন।

মামীর দেখাদেখি আমিও আমার বেডে আমার ব্যাকপেক রাখলাম, তখন আমি টের পেলাম যে আমি মনে হয় বাম কাত হয়ে ঘুমাই। কোন দিক বাম আর কোন দিক ডান সেটা মনে থাকে না, সেটাই হচ্ছে মুশকিল।

যাই হোক এটা বড়ো কোনো সমস্যা না। আমি চিত হয়েও ঘুমাই, উপুড় হয়েও ঘুমাই। কাজেই এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নাই।

আমার জাহাজটা দেখার ইচ্ছা করছিল, তাই মামীকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামী, আমি কি জাহাজটা ঘুরে দেখতে পারি?

মামী বললেন, “যা।”

“কোনোকিছু করা কি নিষেধ আছে?”

মামী বললেন, “রেলিং থেকে লাফ দিয়ে সমুদ্রে পড়ে যাসনে তাহলেই হবে।”

আমি হাসলাম, বললাম, “না সমুদ্র পড়ে যাব না।”

“আর জাহাজে অনেক যন্ত্রপাতি–কারো অনুমতি না নিয়ে কোনোকিছু টিপাটিপি করিস না।”

“করব না। আর কিছু?”

“জাহাজে বাথরুম যেহেতু কম থাকে তাই বাথরুমে গেলে ঝটপট কাজ সেরে বের হয়ে আসবি।”

এই কাজটা আমার জন্য কঠিন তবুও বললাম, “ঠিক আছে।”

“নিচে ডাইনিং রুমের পাশে চা কফি কোল্ড ড্রিংকস নানা রকম স্ন্যাকের ব্যবস্থা আছে। খেতে ইচ্ছে করলে খাবি।”

“পয়সা দিতে হবে না?”

“না।”

“যত ইচ্ছা খাব? ফ্রী?”

মামী আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, বললেন, “হ্যাঁ যত ইচ্ছা খাবি। ফ্রী।”

‘কী আজব।’ যত ইচ্ছা খাওয়া যায়–সব ফ্রী আমি জন্মেও এরকম জায়গার কথা শুনি নাই।

আমি যখন বের হয়ে যাচ্ছিলাম, মামী বললেন, “তোদের বয়সী আরও কিছু বাচ্চা-কাচ্চা থাকতে পারে। খুঁজে দেখ। এবারে আমার দেখাদেখি অনেকে ছেলেমেয়ে ভাতিজা ভাগ্নী এনেছে।”

আমি মুখে খুশী খুশী একটা ভাব করলাম, আসলে ব্যাপারটা খুশীর কিনা বুঝতে পারলাম না। আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা সাধারণত আমাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। আমি নিজেও আমার বয়সী অপরিচিত ছেলেমেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি না। এসব কাজে আপু হচ্ছে এক্সপার্ট, চোখের পলকে বন্ধুত্ব করে ফেলে।

আমি যখন বের হচ্ছি মামী বললেন, “একটা বাচ্চা মেয়ে এসেছে খবর পেয়েছি। মেয়েটা স্পেশাল।”

“স্পেশাল?”

“হ্যাঁ।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী রকম স্পেশাল?”

“তুই নিজেই দেখবি?”

আমি দুশ্চিন্তার মাঝে পড়ে গেলাম। মেয়ে হলেই তারা স্পেশাল, ব্যবহার ভালো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সুন্দর করে কথা বলে, লেখাপড়ায় ভালো, গান জানে, কবিতা আবৃত্তি করতে পারে–আর তার ওপর যদি স্পেশাল হয় তাহলে তো বিপদ। এসেছিলাম সমুদ্রে বেড়াতে এখন যদি স্পেশাল মানুষদের পেছনে পেছনে ঘুরতে হয় তাহলে তো মুশকিল।

আমি কেবিন থেকে বের হয়ে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। একটু সামনে অনেক বড়ো ডেক, সেখানে অনেকগুলো চেয়ার। দেখলেই মনে হয় গা এলিয়ে বসে থাকি, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি একটা চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেলাম ঠিক তখন হঠাৎ করে লক্ষ করলাম এক পাশে একটা চেয়ারে একটা মেয়ে মোটা বই নিয়ে বসে আছে। মনে হল আমার পায়ের শব্দ শুনে মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়েছে। মেয়েটা আমার বয়সী কিংবা হয়ত একটু ছোটো হবে। চেহারার মাঝে একটু অবাক অবাক ভাব, মনে হয় কিছু একটা দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছে। হাতের মোটা বইটা দেখে বুঝতে পারলাম এই মেয়েটা নিশ্চয়ই মামীর স্পেশাল মেয়ে। যদি জানতাম এখানে বসে আছে। তাহলে সামনে না এসে পেছন থেকেই সরে যেতাম। এখন যেহেতু চোখাচোখি হয়ে গেছে আমার গিয়ে একটু ভদ্রতার কথা বলতে হবে। কী যন্ত্রণা!

আমি আমার মুখে আমার স্পেশাল বেকুবী হাসিটা দেওয়ার চেষ্টা করে এগিয়ে গেলাম, বললাম, “ও আচ্ছা তুমি? হা ইয়ে মানে আমি আমার মামীর সাথে হা তুমি মানে ইয়ে—”

আমি তখন থেমে গেলাম। যদি কথা বলার চেষ্টা করি তাহলে নিজেকে আরও গাধা প্রমাণ করব তার থেকে বোকা বোকা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো।

মেয়েটা কোনো কথা বলল না। তারপর খুবই অদ্ভুত একটা কাজ করল। হাত দিয়ে তার কান দেখাল তারপর মুখে হাত দিল তারপর হাত নেড়ে বোঝাল এগুলো নাই–আমার বুঝতে একটুও সমস্যা হলো না যে মেয়েটা বলছে সে কানে শুনতে পায় না আর কথা বলতে পারে না।

আমি মুখ হা করে দাঁড়িয়ে রইলাম। যে ছেলেমেয়ে কানে শুনে আর মুখে কথা বলতে পারে, আমি তাদের সাথেই সুবিধা করতে পারি না, এই মেয়ের সাথে আমি কী করব? আমি কি হাত নেড়ে কিছু বলব? হাত নেড়ে কীভাবে কথা বলে? আমি কীভাবে জিজ্ঞেস করব তোমার নাম কী? কোন ক্লাসে পড়ো।

মেয়েটা কিছুক্ষণ চোখে মুখে একটা প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর তার বুকে আটকে রাখা একটা ছোটো নোট বই আর কলম বের করল। তারপর নোট বইয়ের ছোটো পৃষ্ঠাতে কুট কুট করে খুব তাড়াতাড়ি কী যেন লিখে ফেলে আমার দিকে নোট বইটা এগিয়ে দিল।

আমি দেখলাম নোট বইয়ে লেখা, ‘আমার নাম মিতি। আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি।’

আমি অবাক হয়ে তাকালাম, যে প্রশ্নটা করার কথা চিন্তা করছিলাম ঠিক সেই প্রশ্নটার উত্তর লিখে দিয়েছে, প্রশ্ন করার আগেই। এখন আমার নিশ্চয়ই এই নোট বইয়ে আমার নাম লেখা উচিত। কোন ক্লাসে পড়ি সেটাও লেখা উচিত। কিন্তু এই ছোটো নোট বইয়ে মানুষ লিখে কেমন করে? মেয়েটার হাতের লেখা কী সুন্দর, এটাকেই নিশ্চয়ই মুক্তার মতো হাতের লেখা বলে। আমার হাতের লেখা এত জঘন্য যে আমার তো কিছু লিখতেই লজ্জা করবে। লিখলেও বানান ভুল করে ফেলব। কী বিপদ। তাই আমি কিছু লেখার চেষ্টা না করে নোট বইটা ফেরত দিয়ে আমার স্পেশাল বেকুবী হাসিটা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তারপর কী করব বুঝতে না পেরে মাথা নেড়ে সেখান থেকে সরে হেঁটে হেঁটে চলে গেলাম। যাওয়ার সময় দেখলাম মেয়েটা আবার তার মোটা বইটা পড়তে শুরু করেছে।

সামনে একটা সিঁড়ি পেয়ে তাড়াতাড়ি সেটা দিয়ে নেমে গেলাম। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে যাওয়া যায় ততই ভালো।

নিচের তলায় একটু হাঁটাহাঁটি করে আমি শেষ পর্যন্ত ডাইনিং রুমটা পেয়ে গেলাম। এক পাশে নীরা মামীর সেই বিখ্যাত ফ্রী স্ন্যাক। আমি অবাক হয়ে দেখলাম সব রকম খাবার আছে। সকালে নাস্তা করা হয়নি, কিছু নাস্তা করা দরকার। কিন্তু সেটা মামীর সাথে এসে করা যাবে আপাতত কিছু একটা নিয়ে যাই। আমি একটা চিপসের প্যাকেট নিয়ে সেটা খুলে ভেতর থেকে একটা চিপস বের করে মুখে দিয়েছি তখন শুনলাম কে যেন পেছন থেকে বলল, “এই ছ্যামড়া!”

আমি চমকে পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম একটু আগে দেখা সেই ছেলেটা যার মাথার দুই পাশে চুল ছোটো ছোটো করে রাখা এবং ওপরে জঙ্গলের মতো চুল! যে একটা শার্ট পরেছে যেটার বুকের দুই তিনটা বোতাম খোলা।

আমি বুঝে গেলাম এই চিড়িয়া হচ্ছে মূর্তিমান অভিশাপ!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *