Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আমার ডেঞ্জারাস মামী || Muhammad Zafar Iqbal » Page 5

আমার ডেঞ্জারাস মামী || Muhammad Zafar Iqbal

বাসায় এসে আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপু তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?

আপুকে কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য কখনো অনুমতি নিতে হয় না, তাই আপু একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, “কর।”

বাসার সবাই জানে অঙ্ক আমার দুই চোখের বিষ, কাজেই সেই অঙ্ক নিয়ে কোনো একটা প্রশ্ন করতে আমার একটু লজ্জা লাগছিল, তারপরও লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “আচ্ছা আপু এটা কি সম্ভব যে দুটি সংখ্যা যোগ করলেও দুই পাওয়া যায় আবার গুণ করলেও দুই পাওয়া যায়?”

আপু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, সে নিশ্চয়ই চিন্তাও করে নাই যে আমি তাকে অঙ্কের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব। তারপর অবাক ভাবটা লুকিয়ে আমার প্রশ্নটা নিয়ে চিন্তা করল এবং তখন আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোকে কে এই অঙ্কটা করতে দিয়েছে?”

“কেন?”

“এটার উত্তর কমপ্লেক্স নম্বর–তোকে কে কমপ্লেক্স নম্বরের অঙ্ক করতে দিয়েছে? এটার উত্তর আমারও জানার কথা না–”

“কিন্তু উত্তর আছে?”

“হ্যাঁ।”

“আমাকে একটা কাগজে লিখে দেবে আপু?”

আপু আমাকে কী কী যেন আজগুবি জিনিস লিখে দিল। আমি কাগজটা ভজ করে আমার বইয়ের ভেতরে রাখলাম। আপু সেটা দেখল তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী করবি, এটা দিয়ে?”

আমি বলব কী বলব না চিন্তা করলাম তারপর আপুকে বলেই ফেললাম, “এটার উত্তর নিয়ে আজকে মারামারি হয়েছে।”

আপু চোখ বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “মারামারি? তোর সাথে!”

“হ্যাঁ।” আমি তারপরে আপুকে সবকিছু বললাম। আপুর মতো ভালো মানুষ দুনিয়াতে নাই তাকে সব কথা বলা যায়। সবকিছু শুনে আপু হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল। আমি এত অবাক হলাম বলার মতো না। কাহিনীটার মাঝে উত্তেজনা আছে, রাগ দুঃখ, অপমান সবকিছু আছে কিন্তু হাসি কোন জায়গায় আছে আমি বুঝতে পারলাম না! এটা কী হাসির কাহিনী?

মানুষকে বোঝা খুবই মুশকিল!

রাত্রি বেলা ঘুমানোর সময় আপু আমাকে বলল, “টুলু, জানিস কাল নীরা মামী আসছে?”

আমি বিছানায় উঠে বসে বললাম, “সত্যি?”

“হ্যাঁ। সত্যি।”

“কী মজা! কয়দিন থাকবেন?”

“জানি না।” আপু একটু থেমে বলল, “মামী বলেছেন আমার জন্য একটা খবর আছে!”

“শুধু তোমার জন্য? আমাদের জন্য না?”

“তাই তো বললেন।” আপু চিন্তিত মুখে বলল, “কী খবর হতে পারে মনে হয় তোর?”

“শুধু তোমার জন্য হলে তো সোজা।”

আপু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী সোজা?”

“তোমার জন্য একটা জামাই পেয়েছেন। ছোটোখাটো গোলগাল।”

শুনে আপু হি হি করে হাসল, বলল, “ঠিকই বলেছিস, মনে হয় মামী তার ব্যাকপেকে ভরে নিয়ে আসবে, সেটা ব্যাকপেকের ভেতর থেকে বের হওয়ার জন্য ক্যাঁ ক্যাঁ করে চ্যাঁচাবে!”

আপুর বর্ণনা শুনে এবারে আমি হি হি করে হাসলাম। আমার পাশে পিলু শুয়েছিল, সে হাসল না। বলল, “একজন মানুষ কখনো ব্যাকপেকের ভেতর আঁটবে না!”

নীরা মামী পরের দিন সন্ধাবেলা এলেন। সেই একই পোশাক শাড়ী, বুট জুতো এবং পিঠে ব্যাকপেক। হাতে একটা বিশাল কাতল মাছ।

আম্মু চোখ কপালে তুলে বললেন, “এই মাছ কেন?”

মামী অপরাধীর মতো বললেন, “জানি না। বেঁচে থাকলে এটা নদীতে ছেড়ে দিতাম, এখন তো ছেড়ে দেওয়ার উপায় নাই।”

পিলু বলল, “মনে হয় কেটে খেতে হবে।”

চম্পা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, পেটি দিয়ে ভাজি, গাদা দিয়ে তরকারী আর মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট।”

আম্মু ভয়ে ভয়ে ঝর্ণা খালাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই মাছ কাটতে পারবে ঝর্ণা?”

ঝর্ণা খালা হাসল, “না পারার কী আছে। কতদিন বড়ো মাছ কাটি না। দেন আপা–” বলে নীরা মামীর হাত থেকে মাছটা নিয়ে ঝর্ণা খালা রান্নাঘরে ঢুকে গেল। মাছ কাটা দেখার জন্য নীরা মামীও পেছনে পেছনে গেলেন, আমরাও তার পেছনে পেছনে গেলাম।

ঝর্ণা খালা যখন বটি পা দিয়ে চেপে ধরে মাছটাকে ধরে কীভাবে কীভাবে তার মাথাটা কেটে ফেলল তখন নীরা মামী আম্মুকে বললেন, “ভাবি, আমার মাছ কেনার কোনো প্ল্যান ছিল না। বাসটা একটা বাজারের কাছে থেমেছে, কাছে মাছের বাজার। আমরা প্যাসেঞ্জাররা বাস থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করছি তখন আমি এই মাছটাকে দেখলাম। মনে হয় মাত্র নদী থেকে ধরে এনেছে, তখনো নড়ছে। এত বড়ো মাছ কত দাম হতে পারে সেটা আইডিয়া করার জন্য শুধু দামটা জিজ্ঞেস করেছি ব্যাস কাজ হয়ে গেল!”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কাজ হয়ে গেল মানে কী?”

“মানে সব মানুষ আমার হয়ে দামাদামি শুরু করে দিল! একেকজনের কী উৎসাহ!”

“তোমাকে নিশ্চয়ই ঠকিয়েছে–”

“ঠকালে ঠকিয়েছে। কিন্তু দরদাম করা যে একটা আর্ট সেটা টের পেলাম।”

পিলু জিজ্ঞেস করল, “কত দাম ছিল মামী?”

মামী পিলুর ঘাড় ধরে একটা ছোটো ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “তুই কি মাছের ব্যবসা করবি নাকি? মাছের দাম শুনে কী করবি?”

আমি বুঝলাম নিশ্চয়ই অনেক দাম এই মাছের তাই মামী বলতে চাচ্ছেন না!

রাত্রে সেই মাছের ভাজা দিয়ে সবাই যখন ভাত খাচ্ছি তখন আপু জিজ্ঞেস করল, “মামী, তুমি না বলেছিলে আমার জন্য একটা খবর আছে?”

“হ্যাঁ, আছে। তার আগে বল, সামনের সপ্তাহে তোদের স্কুল কি বন্ধ?”

“হ্যাঁ।” আপু মাথা নাড়ল, “সামার ভ্যাকেশন। কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে বারোটা বাজিয়ে রেখেছে।”

“তুই কি দশ বারো দিনের জন্য যেতে পারবি?”

আপু চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “কোথায়?”

“আমার সাথে।”

আপু চিৎকার করে বলল, “পারব! পারব। একশবার পারব।”

আপুর কপালটা দেখে হিংসায় আমার বুকটা প্রায় ফেটে যাওয়ার অবস্থা হলো, আমি নিঃশ্বাস চেপে জিজ্ঞেস করলাম, “আপু তোমার সাথে কোথায় যাবে মামী?”

মামী বললেন, “সমুদ্রে।”

আপু আবার চিৎকার করল, “স-মু-দ্র! ইয়া হু–”

মামী বললেন, “অবশ্যই তোর আম্মু আব্বু যদি পারমিশন দেন!”

আপু তখন চিৎকার থামিয়ে আম্মু আর আব্বুর দিকে তাকাল, বলল, “পারমিশন? তোমার সাথে যেতে পারমিশন?”

আব্বু বললেন, “তোমার সাথে যাবে, পারমিশন তো পাবেই। কিন্তু আগে শুনি কোথায় যাবে কীভাবে যাবে।”

নীরা মামী বললেন, “দেশে একটা ফাউন্ডেশন আছে তার নাম হচ্ছে সি লাইফ ফাউন্ডেশন, সংক্ষেপে এস এল এফ। খুবই লো কী, তাই দেশের। মানুষ এর নাম জানে না। কিন্তু অনেকদিন থেকে কাজ করে যাচ্ছে। সমুদ্র নিয়ে কাজ করে। একধরনের হাঙর মাছ আছে তার নাম করাত মাছ, আগে বাংলাদেশের সমুদ্রে অনেক পাওয়া যেত আজকাল তত পাওয়া যায় না। সারা পৃথিবীতেই এক অবস্থা। এদেরকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে। মাঝে মাঝে সমুদ্রে গিয়ে এক দুই সপ্তাহ থাকে, অনেক কিছু স্টাডি করে। আমি তাদের সাথে আছি।”

নীরা মামী তার প্লেটে আরেকটা বিশাল মাছ ভাজা নিলেন, এক টুকরা ভেঙে তৃপ্তি করে মুখে দিয়ে বললেন, “মাছ ভাজাটা ফ্যান্টাস্টিক। ঝর্ণা খুব ভালো মাছ ভেজেছ।”

ঝর্ণা খালা বলল, “মাছ ভালো হলে এমনিতেই খেতে মজা হয়।”

আমি বললাম, “আগে হাঙর মাছের কথা বলো, তারপর মাছ ভাজা।”

নীরা মামী বলল, “হ্যাঁ যেটা বলছিলাম। এই ফাউন্ডেশন শুধু সমুদ্রের মাছ না, সামুদ্রিক সবরকম প্রাণী, গাছপালা স্টাডি করে। পরিবেশ স্টাডি করে, পলিউশান স্টাডি করে। রিপোর্ট তৈরি করে এখানে সেখানে পাঠায়। সামনের সপ্তাহে তাদের সাথে আমি সমুদ্রে যাব।”

আপু জিজ্ঞেস করল, “কীসে করে যাবে?”

“ছোটো একটা জাহাজ আছে। বেশকিছু কেবিন, কিছু ল্যাব ফেসিলিটি। কিচেন বাথরুম তো আছেই।”

“আমিও সেটা করে যাব?” উত্তেজনায় মনে হলো আপুর নিঃশ্বাস আটকে যাবে।

“হ্যাঁ।” নীরা মামী মাথা নাড়লেন, প্রচুর ডাটা নিতে হয়, ডাটা এন্ট্রির মার। আমি ভাবলাম মিলাকে নিয়ে যাই একটু ছোটো হয়ে গেল–”

আপু চিৎকার করে বলল, “আমি মোটেও ছোটো না। আমি পারব ডাটা এন্ট্রি করতে– আমাদের ভলান্টারি অর্গানাইজেশনের সব ডাটা আমি এন্ট্রি করি।”

“গুড। তাহলে তো ভালো।”

আম্মু বললেন, “এত ছোটো মেয়েকে এত বড়ো কাজে নিচ্ছ তোমার ফাউন্ডেশনের লোকজন আপত্তি করবে না?”

মামী বললেন, “অন্য কেউ হলে হয়ত একটু আধটু আপত্তি করত, আমার বেলা করবে না। কখনো করে না। ওরা এতদিনে বুঝে গেছে আমার নিজের একটা দায়িত্ববোধ আছে। অন্যদের সাথে সবসময় মিলে না কিন্তু কাজ করে।”

আমি আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পৃথিবীর সব আনন্দ অন্য সবার জন্য, আমার জন্য কিছু নাই। কেউ আমার দীর্ঘশ্বাসটা লক্ষ করে নাই, কিন্তু আপু লক্ষ করল। আমার দিকে একবার তাকাল, কিছু বলল না।

রাত্রি বেলা ঘুমানোর আগে আপু বিছানায় তার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে লাগল। নীরা মামী কিছু বলে নাই কিন্তু তার সাথে যাওয়ার সময় তো আর বিশাল স্যুটকেস নিয়ে রওনা দিতে পারবে না। একটা ব্যাকপেকে সবকিছু নিতে হবে। আপু তার কয়েকটা টি-শার্ট, প্যান্ট রাখল। একটা নোট বই আর কলম রাখল। নীরা মামী তাকে ছোটো ছোটো টাইপের যে ইংরেজি বইটা দিয়েছিলেন সেটা রাখল। আপুর নিজের মোবাইল টেলিফোন আছে তার চার্জারটা রাখল। একটা চাদর রাখল, একটা লাল গামছা রাখল দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “টাওয়েল নিবে না?”

“নাহ। টাওয়েল অনেক জায়গা নিয়ে নেবে। তা ছাড়া টাওয়েল একবার ভিজলে শুকাতে জান বের হয়ে যায়। গামছা কোনো জায়গা নেয় না। ভিজলে চিপে একবার ঝাড়া দিবি শুকিয়ে যাবে। তা ছাড়া গামছা দিয়ে শুধু শরীর মোছা যায় না এটা অন্য কাজেও লাগে। দরকার হলে বাঁধার জন্য দড়ি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কী সুন্দর রং দেখেছিস? কেটে জামা কাপড় বানানো যায়।”

আমি বললাম, “মনে হচ্ছে তুমি গামছার বিজনেস করবে, তার বিজ্ঞাপন করছ।”

“করাই তো যায়, বিদেশে মানুষ গামছা এক্সপোর্ট করে বড়োলোক হয়ে যেতে পারে। নাম দিতে হবে বিউটিফুল ম্যাজিক টাওয়েল ফ্রম বাংলাদেশ!”

শুনে আমি আর পিলু দুজনেই হাসলাম, আমি হাসা শেষ করে আবার ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আপুর কত আনন্দ তাই গামছা নিয়েই কত কী বলছে।

রাত্রে শুয়ে শুয়ে দেখলাম আপু তার ব্যাকপেকে জিনিসপত্র ঢুকাচ্ছে, তারপর ব্যাকপেকটা পিঠে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। কাল রাতে তার ট্রেন। ট্রেনে খুলনা যাবে, সেখান থেকে ট্রলারে করে জাহাজে তারপর জাহাজে করে সমুদ্রে।

পরের দিন স্কুল সকাল সকাল ছুটি হয়ে গেছে। পরদিন থেকে আমাদের ছুটি। আপু দুপুরে খেয়ে বের হয়ে গেল, তার ফুটপাতের স্কুল আছে। আগামী দশদিন থাকবে না তখন তার কাজগুলো কে কীভাবে করবে সেগুলো ঠিক করে আসবে। যাওয়ার সময় আম্মু বললেন, “বেশী দেরি করিস না। আজ রাতে তোদের ট্রেন, মনে আছে তো?”

আপু তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসল, বলল, “মনে থাকবে না? খুব ভালো মনে আছে আম্মু। আমার সবকিছু রেডি! ব্যাকপেকটা ঘাড়ে নি আর মামীর সাথে বের হয়ে যাব।”

চারটার একটু পরে আম্মুর টেলিফোনটা বাজল, আম্মু রান্নাঘরে কী যেন করছিলেন, আমাকে ডেকে বললেন, “টুলু দেখ দেখি, টেলিফোনটা কোথায়।”

আমি দেখলাম আপু ফোন করছে, আমি টেলিফোনটা আম্মুর হাতে দিলাম। আম্মু বিড়বিড় করে বললেন, “মিলা আবার কী নিয়ে ফোন করে?” তারপর ফোনটা কানে লাগালেন।

অন্য পাশ থেকে আপু কী বলল আমি জানি না কিন্তু মুহূর্তের মাঝে আম্মুর মুখটা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল, হাত দিয়ে রান্নাঘরের কেবিনেটটা ধরলেন, তারপর বললেন, “কোন হাসপাতাল?”

আপু কী বলল আমি শুনতে পেলাম না, আম্মু বললেন, “অনেক বেশী ব্যথা? জ্ঞান ছিল?”

আবার কী যেন শুনলেন, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি আসছি।”

আম্মু ফোনটা রাখতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে আপুর? হাসপাতালে কেন?”

আম্মু আমার কথা শুনলেন বলে মনে হলো না, কেমন যেন ঘোরের মাঝে হেঁটে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারের ওপর বসলেন, তারপর আবার বিড়বিড় করে বললেন, “এজন্যই মনটা সকাল থেকে অস্থির হয়েছিল। হে খোদা”

আমি এবারে প্রায় কান্না কান্না হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে। আপুর। বলো আম্মু–”

আমার গলা শুনে পাশের ঘর থেকে নীরা মামীও চলে এসেছেন। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,”কী হয়েছে আপা?”

আম্মু বললেন, “মিলা ফুটপাতে বসে পড়াচ্ছিল, রাস্তা থেকে একটা ট্রাক ফুটপাতে উঠিয়ে দিয়েছে–”

মামী একটা আর্তনাদ করলেন, আম্মু বললেন, “আমার মিলার সাথে কথা হয়েছে সে বলছে বিশেষ কিছু হয় নাই। মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সিতে আছে—”

“অন্যদের?”

“কারোই নাকি বড়ো কিছু হয় নাই কিন্তু আমি না দেখা পর্যন্ত কিছু বিশ্বাস করি না।”

নীরা মামী বললেন, “হাসপাতালে যাবেন?”

“হ্যাঁ।”

“চলেন।” সোফায় বসে নীরা মামী তার বুট জুতো পরতে লাগলেন।

কিছুক্ষণের মাঝে আম্মু আর নীরা মামী বের হয়ে গেলেন। আব্বুকেও জানানো হয়েছে, আব্বু অফিস থেকে হাসপাতালে চলে যাবেন।

কী করব বুঝতে না পেরে আমি তখন বাসার ভেতরে এক রুম থেকে অন্য রুমে হাঁটছি। আমার পেছনে পেছনে পিলু আর চম্পা হাঁটছে। কী হয়েছে তার যেটুকু আমি জানি সেটা অনেকবার তাদের বলা হয়ে গেছে। প্রথম দিকে শুনেছে এখন পিলু ফাস ফাস করে কাঁদছে। তার কাদা দেখে আমার চোখেও মনে হয় পানি চলে আসছে।

ঠিক সন্ধ্যাবেলা আব্বু আম্মু আর নীরা মামী আপুকে নিয়ে বাসায় এসেছে। যখন বাসার সামনে গাড়ী থেমেছে আমরা সবাই তখন দৌড়ে বাইরে গেছি। নীরা মামী দরজা খুলে দিলেন, আম্মু গাড়ীর ভেতর থেকে আপুকে ধরে রাখলেন। আব্বু কোমরে হাত দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আপু প্রথমে তার প্লাস্টার করা একটা পা বের করল তারপর দুটি ক্রাচ তারপর অন্য পা। নীরা মামী তখন আপুর হাতের নিচে হাত দিয়ে তাকে বের হতে সাহায্য করলেন। আপু বের হয়ে তার ভালো পায়ে ভর দিয়ে ক্রাচ। দুটিকে ধরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বিশাল একটা হাসি দিল, যেন কত মজা হচ্ছে।

আপুকে হাসতে দেখে আমার বুক থেকে অনেক বড়ো একটা ভার নেমে গেল। অবস্থা খারাপ হলে নিশ্চয়ই এভাবে হাসতে পারত না। পিলু গাধাটা অবশ্য ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। আপু বলল, “কী হলো? কাঁদছিস কেন? আমি কি মরে গেছি নাকি?”

পিলু বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি মরে যাবে। ট্রাকের নিচে পড়লে সবসময় মরে যায়।”

চম্পা বলল, “আমি অনেক বেশী দোয়া করেছি। সেজন্য তোমার কিছু হয় নাই।”

ঝর্ণা খালা বলল, “আল্লাহ মেহেরবান।”

বাসায় এসে আপু সোফার টেবিলে তার প্লাস্টার করা পা তুলে সোফায় বসল। আমি আপুর কাছে বসে আপুর হাতটা ধরে রাখলাম, কেন জানি শুধু চোখে পানি চলে আসছিল। আপু সেটা দেখেও না দেখার ভান করল। অন্যরা সবাই আপুকে ঘিরে বসেছে। আপু সবার দিকে তাকিয়ে একটু অপরাধীর মতো হাসল, তারপর বলল, “আমি খুবই সরি, সবাইকে এরকম ঝামেলার মাঝে ফেলে দিলাম।”

আম্মু মুখ শক্ত করে বললেন, “সবার কাছে যেটা শুনলাম, এখন তো মনে হচ্ছে খুবই অল্পের ওপর দিয়ে গিয়েছে। শুধু পা ভেঙেছে। তোদের সবার মরে যাওয়ার কথা ছিল- আম্মু কথা শেষ করতে পারলেন না, শাড়ীর আঁচলটা দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন।

আপু বললেন, “তুমি এভাবে কেঁদো না আম্মু, তোমাকে কখনো কাঁদতে দেখি নাই–”

ঝর্ণা খালা বলল, “একটা মুরগি ছদকা দিতে হবে।”

আম্মু বললেন, “হ্যাঁ, ঝর্ণা তুমি ব্যবস্থা করো।”

আপু নীরা মামীর দিকে তাকিয়ে বলল, “মামী, সরি। আমি তোমার ডাটা এন্ট্রি করে দিতে পারব না।”

মামী বললেন, “লাইফে নতুন করে এন্ট্রি করেছিস, তাতে আমি খুশী। ডাটা এন্ট্রি না করলেও ক্ষতি নাই।”

আম্মু বললেন, “নীরা তোমার ট্রেনের কিন্তু খুব বেশী দেরি নাই।”

মামী উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “হ্যাঁ। আমি রেডি হয়ে যাই।”

ঠিক তখন দরজায় শব্দ হলো। ঝর্ণা খালা দরজা খুলতে যাচ্ছিল নীরা মীমা তার আগেই দরজা খুলে দিলেন। কে এসেছে ঠিক দেখতে পেলাম না, মনে হলো একজন মহিলা। মহিলার গলার স্বর শুনতে পেলাম, “এইটা মিলা ম্যাডামের বাসা?”

মামী বললেন, “মিলা ম্যাডাম? মানে আমাদের মিলা?”

মহিলা ভেতরে উঁকি দিল, আপুকে দেখে বলল, “জে, জে এইতো মিলা ম্যাডাম। তারপর স্যান্ডেল খুলে ভেতরে ঢুকল, পেছনে লুঙ্গি পরা একজন মানুষ, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

আম্মু বললেন, “আপনাদের স্যান্ডেল খুলে আসতে হবে না–পায়ে থাকুক।”

মহিলা আম্মুর কথা শুনল বলে মনে হলো না, ভেতরে ঢুকে একেবারে আপুর কাছে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমরা সবাই অবাক, আপু জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন?”

মহিলা শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মুছল, তারপর বলল, “আমি রতনের মা।”

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “রতনটা কে?”

আপু বলল, “আমাদের স্কুলের ছাত্র। রতন কেমন আছে?”

“হের তো কিছুই হয় নাই, তারে বাঁচাইতে গিয়া আপনার এত বড়ো সর্বনাশ। আপনি তারে না বাঁচাইলে এখন সে ট্রাকের তলায় পিষে যেত।”

আপু কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, “না, না, আমি কিছু করি নাই।”

“আমি সব জানি, আপা আপনি কী করেছেন। ট্রাকটারে দেইখা আপনি লাফ দিয়ে সরে যেতে পারতেন। আপনি সরেন নাই, নিজে ট্রাকের সামনে লাফ দিছেন। আমার রতনরে বুকে চেপে ধরে সরাইছেন। নিজে সরতে পারেন নাই–” বলে মহিলা আবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। শাড়ীর আঁচল কাঁদার জন্য খুবই কাজের জিনিস, চোখে মুখে চেপে ধরে কাঁদা যায়। ছেলেদের এরকম কিছু নাই, শার্টের কোনা তুলে চোখ মোছা যায় কিন্তু তাহলে পেটটা বের হয়ে যায়।

নীরা মামী ঘরের কোনার টিস্যুর বাক্সটা থেকে একটা টিস্যু বের করে মহিলাকে দিলেন। তখন পুরুষ মানুষটাও সেখান থেকে একটা টিস্যু নিয়ে চোখ মুছল। মহিলাটি এত নাটকীয়ভাবে কাঁদছে যে পুরুষ মানুষটার চোখেও যে পানি সেটা কেউ লক্ষ করে নাই।

মহিলা টিস্যু দিয়ে নাক মুছে বলল, “আপা, আপনি আমার ছেলেটারে বাঁচাইছেন, আমি তারে পেটে ধরেছি কিন্তু আমি আপনারে বলতে আসছি আজ থেকে এই ছেলে আপনারে মা ডাকব।”

আপু চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “কী মজা! পেটে না ধরেই রেডিমেড বাচ্চা!”

“আমি ছেলেরে বলছি, এখন থেকে তোর দুই মা, যখন বড় হবি তখন এই মারেও দেখে রাখবি। তার জন্য জান দিবি।”

পুরুষ মানুষটা কোনো কথা বলে নাই, এবারে সে জোরে জোরে মাথা নাড়ল।

আপু বলল, “আমার জন্য জান দিতে হবে না, তাকে যে হোমওয়ার্ক দিয়েছি সেগুলো করলেই হবে।”

আব্বু এবারে কথা বললেন, “আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসেন।”

আম্মু বললেন, “হ্যাঁ, আর ঝর্ণা তুমি চা নাস্তা কিছু একটা দাও।”

পুরুষ মানুষটা এবারে কথা বলল, “না, না, আমরা বসমু না। আমার ছেলের জান ফিরায়ে দিছেন সেইজন্য ধন্যবাদ দিতে আসছি। আর আমরা মুখ্য সুখ মানুষ, কী বলতে কী বলেছি, বেয়াদবি মাফ করে দিবেন।”

আম্মু বললেন, “কী আশ্চর্য, এখানে বেয়াদবির কী আছে!”

মানুষটার হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ ছিল, এতক্ষণ লক্ষ করি নাই। সে ব্যাগটা আপুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপা, আপনের জন্য কী আনমু বুঝতে পারি না, কয়টা ফল আনছি!”

আপু হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। কিন্তু কিছু আনার দরকার ছিল না। রতনের কিছু হয় নাই শুনেই আমার মনটা খুশী হয়ে গেছে।” আপু ব্যাগটা খুলে চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “আপেল। আমার সবচেয়ে প্রিয়!”

বাসায় আমরা সবাই জানি আপু আপেল খেতে চায় না, দেখলেই বিরক্ত হয়! কিন্তু এখন এমন ভান করল যে এটা দেখেই সে খুশী হয়ে গেছে। আপু এই কাজগুলো খুব ভালো পারে।

ব্যাগটা খুলে আপু একটা আপেল বের করে মানুষটার দিকে এগিয়ে দিয়ে, বলল, “এটা রতনকে দিবেন! বলবেন আমি দিয়েছি।”

মহিলা এবং পুরুষ মানুষ দুজনেই মাথা নাড়ল, “না, না, লাগবে না। লাগবে না।”

আপু বলল, “আমি জানি লাগবে না। কিন্তু আমি দিতে চাই। নেন।”

মহিলাটা আপেলটা হাতে নিয়ে তার শাড়ীর আঁচলে বেঁধে ফেলল। মেয়েদের শাড়ী একটা অসাধারণ পোশাক। তার আঁচল দিয়েই কত কাজ করা যায়।

মহিলা এবং পুরুষ মানুষটা চলে যাওয়ার পর সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর আম্মু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “মিলা, তোর কিছু হয় নাই তুই বেঁচে গেছিস। কিন্তু তুই ট্রাকের সামনে লাফিয়ে পড়েছিলি সেটা তো বলিস নাই”

আপু দুর্বলভাবে হেসে বলল, “বলার মতো কিছু হয় নাই। আমি চিন্তা করে কিছু করি নাই–তুমি থাকলে তুমিও তাই করতে। আরেকটু হলে বাচ্চাটা শেষ হয়ে যেত!” আপু শিউরে উঠল।

নীরা মামী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মিলা, আমি তোকে একটা গিফট দিতে চাই। কী চাস? যা চাইবি তা-ই পাবি। বাজেট নিয়ে চিন্তা করিস না।”

“কোনো গিফট লাগবে না মামী। তুমি বলেছ এতেই আমি খুশী।” কী আশ্চর্য, এরকম সুযোগ কেউ ছাড়ে? আমি হলে বলতাম একটা ল্যাপটপ। আপুটা রীতিমতো বোকা।

আপু বলল, “কিন্তু অন্য একটা জিনিস বলতে পারি।”

“কী বলবি?”

“আমি যেহেতু তোমার সাথে যেতে পারছি না তুমি টুলুকে নিয়ে যাও। তার খুব শখ।”

আমি চমকে উঠে আপুর দিকে তাকালাম। আব্বু অবাক হয়ে বললেন, “টুলু? টুলু পারবে?”

আম্মু বললেন, “এত ছোটো!”

মামী এক সেকেন্ড কী যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, “যদি দশ মিনিটের মাঝে রেডি হতে পারে তাহলে তোর বদলে টুলুকে নিতে পারি।”

আপু বলল, “দশ মিনিট লাগবে না। পাঁচ মিনিটে হয়ে যাবে–আমার ব্যাগে সব রেডি আছে। শুধু আমার কাপড়গুলো বের করে টুলুর কয়টা কাপড় ঢুকিয়ে নেবে।”

মামী আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “যাবি?”

অন্য যেকোনো সময় হলে আমি আনন্দে চিৎকার দিতাম কিন্তু এখন কেমন জানি মন খারাপ হলো। বিড়বিড় করে বললাম, “আপু এত যেতে চেয়েছিল, তার বদলে আমি?”

আপু তার ক্রাচ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “ঢং করিস না। আয় তোর ব্যাগ রেডি করে দিই।”

ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে থেমে গিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে কেমন লাগে আমি সবসময় জানতে চাচ্ছিলাম।”

পিলু জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগে?”।

“অনেক মজা! পায়ের ব্যথাটা কমলে আরও মজা লাগবে। দেখবি হেঁটে?”

পিলুর খুব উৎসাহ দেখা গেল না।

আমি সত্যি সত্যি দশ মিনিটের মাঝে মামীর সাথে সমুদ্রে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেলাম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *