বছর দুয়েক পরে
প্রায় বছর দুয়েক পরের কথা।
এ দু বছরের ভিতর আমার জীবনে গগন বা চন্দ্রভান কোন ছায়াপাত করেনি। ওদের খবরই জানতাম না। বরিশাল থেকে মাঝে মাঝে বটুকের চিঠি আসত। পাটোয়ারি ব্যবসা তার ভালই চলছে। একদিন আমার সঙ্গে ডাক্তারখানায় দেখা করতে এলেন এক ভদ্রলোক। বলিষ্ঠ সুগঠিত শরীর। যুবাপুরুষ। বলেন, আমায় চিনতে পারলেন না দীপুদা? আমি সূরয!
–আরে তাই তো? কত বড় হয়ে গেছ সূরয! কী খবর? কী করছ, কোথায় আছ?
সূরযভান তার সব খবর জানায়। দিল্লীতে কমিসেরিয়েটে চাকরি করে। প্রথম কলকাতাতেই চাকরিতে ঢুকেছিল। যে বছর মোহনবাগান শীল্ড পেল, সে বছরই ভারতের রাজধানী চলে গেল দিল্লীতে। সূরযও ঐ সময় দিল্লী চলে যায় বদলি হয়ে। সে আজ বছর পনের আগের কথা। ইতিমধ্যে প্রথম যুদ্ধ এসেছে এবং গেছে। সূরযের বয়স এখন বছর তেত্রিশ। বিবাহ করেনি। একাই আছে দিল্লীতে। পৈতৃক সম্পত্তি সে পায়নি। সে একা নয়, ওরা দু ভাই বঞ্চিত হয়েছিল পৈতৃক সম্পত্তি থেকে। কাকা একটি উইল বার করে তাঁর নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। উইলটা জাল কি সাচ্চা যাচাই করবার মত আর্থিক সঙ্গতি ছিল না সূরযভানের। আর তার দাদা তো আগে থেকেই নেপথ্যে সরে গেছে। ফলে সূরয কোন দাবী করেনি; নীরবে মেনে নিয়েছে দুর্ভাগ্যকে। দুঃখ নেই তার। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে আবার।
জিজ্ঞাসা করি, –তোমার দাদা কোথায়?
কলকাতাতেই আছে। সেই দাদার ব্যাপারেই এসেছি আপনার কাছে। দাদা আমার কাছে দিল্লীতে গিয়ে থাকতে চায় না। তাছাড়া–মানে, সে অনেক কথা। মোট কথা দাদা বরাবরই কলকাতাতেই আছে। একাই। আমিই মাসে মাসে তাকে খরচ পাঠাই। ও আপন মনে ছবি এঁকে যায় শুধু। দাদার ছবি এখনও লোক নেয়নি।
আবার প্রশ্ন করি, তোমার দাদা একা থাকে মানে? তোমার বউদি কোথায়?
–বৌদি দাদার কাছে থাকে না। দাদাকে ছেড়ে চলে গেছে।
একটু ইতস্ততঃ করে বলি, তোমার বৌদিকে নিয়ে চন্দ্রভান বছর দুই আগে আমার কাছে এসেছিল, তখন তাঁর সন্তান সম্ভাবনা ছিল। বাচ্চাটা–
-হ্যাঁ, জানি। দাদা বলেছে। একটি মেয়ে হয়েছিল তাঁর।
সুস্থ সবল?
হ্যাঁ।
–ও! তারপর?
সূরযভান একটা সঙ্কোচকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বলে, –আপনাকে বরং খোলাখুলি সব কথা বলি। ডাক্তারের কাছে কোন কিছু গোপন করা ঠিক নয়। দাদা ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করেনি; একসঙ্গে ওরা থাকত। মেয়েটি খুব ভাল ঘরের নয়। সে যাই হোক, সে দাদাকে ছেড়ে চলে গেছে। দাদা শ্যামবাজারের ওদিকে একাই থাকে। নিজে হাতে রান্না করে খায়। আপনার কাছে যে জন্য এসেছি তা এবার বলি। আজ মাস দুয়েক হল দাদার একটু মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এমনি ভালই থাকে, কিন্তু মাঝে মাঝে সে কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করে বসে। হঠাৎ ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করে। তখন ও এমন সব কাজ করে বসে যার কোন মানে হয় না। ও নিজেই পরে অনুতপ্ত হয়। নিজের কাছে নিজেই কোন কৈফিয়ৎ দিতে পারে না। গত এক বছরে এমন বার-তিনেক হয়েছে। প্রথমটা আমাকে সে কিছু জানায়নি। গোপন করতে চেয়েছিল; কিন্তু এবার সে ভয় পেয়ে আমাকে জানায়। আমি ছুটি নিয়ে চলে এসেছি। আপনি একবার দাদাকে পরীক্ষা করে দেখবেন?
কি জবাব দেব বুঝে উঠতে পারি না। রতিজ রোগ থেকে মস্তিষ্ক বিকৃতি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এসব কথা কি সূরযকে বলা উচিত? আবার গোপন করাও ঠিক নয়; বস্তুত সেই তো এখন রোগীর গার্জেন। শেষে বলি, –সূরয, তোমার দাদার সঙ্গে বছর দুই আগে আমার একটা মনোমালিন্য ঘটেছিল
জানি, দাদা সব কথা বলেছে আমাকে। তাই তো সে আজ আমার সঙ্গে এল না।
-তুমি এক কাজ কর। আমি একজন ডাক্তারকে একখানা চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি প্রথমে তাকে দিয়ে চন্দ্রভানকে দেখাও। তারপর আমাকে রিপোর্টটা দেখিও। আমি পরবর্তী ব্যবস্থা করব।…আচ্ছা সূরয, একটা কথা বল তো! তোমাদের বংশে কারও উপদংশ অথবা প্রমেহ অসুখ ছিল বলে শুনেছ?
না। একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?
-মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণ হিসাবে বংশানুক্রমিক ইতিহাসটাও তো বিবেচনা করতে হয়।
সূরয দিন তিনেক পরে আমার নির্বাচিত ডাক্তারের রিপোর্ট নিয়ে এল। চন্দ্রভান কোন দৈহিক অসুখে ভুগছে না। তার ওজন কম, রক্তচাপ অস্বাভাবিক, অন্যান্য উপসর্গ নেই; আর সবচেয়ে বড় কথা, যে অসুখের কথা আমি আশঙ্কা করেছিলাম সে অসুখ তার নেই, কখনও হয়নি।
কিমাশ্চর্যমতঃপর!
চন্দ্রভান কিন্তু কিছুতেই আমার কাছে আসতে রাজী হল না। অগত্যা সূরযকে সঙ্গে নিয়ে আমিই তার বাসায় গিয়েছিলাম। অভিমান করার হক্ আছে বইকি চন্দ্রভানের!
অপমানটা তো সেদিন আমি কম করিনি!
শ্যামবাজার অঞ্চলে একটা এঁদোস্য-এঁদো কানা গলি। দুজন লোক পাশাপাশি চলতে পারে না। আগু-পিছু হাঁটতে হয়। তারই ভিতর একটা খোলার চালের ঘর। দু-অংশে ভাগ করা। ও-অংশে কতকগুলি মেহনতী মানুষের বাস। দিনের বেলায় কেউ ঠেলা চালায়, কেউ রিকশা। কেউ বা ঝকা নিয়ে চলে যায় শ্যামবাজার অথবা হাতিবাগানের বাজারে মোট বইতে। অপর অংশে বাস করে শিল্পী ভিন্সেন্ট ভান গর্গ। একটা চৌকি, খানকয় এনামেল আর অ্যালুমিনিয়ামের বাসন। একটা স্টোভ আর ইন্দুমাধব মল্লিক মশায়ের নব-আবিষ্কৃত একটা অদ্ভুত যন্ত্র। ওতে নাকি একসঙ্গে ভাত-ডাল-আলুসেদ্ধ রান্না হয়ে যায়। আর আছে তার আঁকবার নানান সরঞ্জাম। রঙ, তুলি, ক্যানভাস। সে গৃহস্থালীর সঙ্গে তুলনা করা চলে একমাত্র বরানগরে দেখা গগ্যার ঘরখানার।
চন্দ্রভান কিন্তু আমাকে আদর করে বসালো। আমি প্রথমেই বললাম, কিরে, রাগ করে আছিস নাকি?
ও পুরাতন প্রসঙ্গটাকে আমলই দিল না। বললে, –আয় আয়, বস!
চৌকির উপর তেলচিটে মাদুরটা পেতে দেয়।
.
চন্দ্রভানের চিকিৎসার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম আমি।
বন্ধুকৃত্য ছাড়া আরও দুটি কারণ ছিল সে সিদ্ধান্তের পিছনে। প্রথমত, কেমন একটা অপরাধবোধে অনুশোচনা জেগেছিল আমার। দু বছর আগে ওভাবে যদি আমি তাকে তাড়িয়ে না দিতাম, তাহলে হয়তো চন্দ্রভান এ রোগে পড়ত না। সকলের কাছ থেকে ক্রমাগত অপমান, আঘাত আর প্রত্যাখ্যান পেতে পেতে ও বোধহয় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে বসেছে। দু বছর আগে সে অনেক আশা নিয়ে তার পুরনো বন্ধুর কাছে এসেছিল একটু সহানুভূতির আশায়। সেখানে আবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে বসে থাকতে পারে। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে আমি হয়তো ওর মানসিক ব্যাধির অন্যতম কারণ। দ্বিতীয়ত, আমার দুরন্ত কৌতূহল হয়েছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসাবে। ডক্টর মিসেস্ স্মিথ-এর রিপোর্টটার কথা আমি ভুলতে পারিনি। যার স্ত্রীর যৌনব্যাধি অমন শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিল সে কেমন করে এমন সুস্থ সবল থাকল দৈহিক নিরিখে?
মনোবিজ্ঞানের চর্চা তখনও ভারতবর্ষে খুব ব্যাপকভাবে শুরু হয়নি। গিরীন্দ্রশেখর বসু মহাশয়ের গবেষণাপ্রসূত জ্ঞান তখনও আমরা জানতাম না। কিছু কিছু আধুনিক বিলাতী ম্যাগাজিনে সাইকোঅ্যানালিসিসের পদ্ধতি মোটামুটিভাবে জানা ছিল। দুএকজন চিকিৎসক এ নিয়ে পড়াশুনা করছেন, গবেষণা করছেন কিন্তু তাদের সাহায্য পাওয়ার মত আর্থিক সামর্থ্য ছিল না আমার বন্ধুর। ও যে একজন মস্তবড় শিল্পী এমন ধারণা আমার আদৌ ছিল না, তবে ও যে আমার বন্ধু এ তো অস্বীকার করতে পারি না! তাই নিজেই যেটুকু সম্ভব তা করব বলে স্থির করি। মনের অসুখের বিষয়ে বই এনে পড়তে শুরু করলাম। একজন অস্ট্রিয়ান বৈজ্ঞানিকের সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বই পেয়ে গেলাম লাইব্রেরীতে। বইটি সবেমাত্র ইংরাজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। তার চিকিৎসা-পদ্ধতির মূল কাঠামো এবং কয়েকটি কেস হিস্ট্রিও লেখা আছে। বৈজ্ঞানিকের বয়স পঁয়ষট্টি, নাম দেখলাম সিগমুণ্ড ফ্রয়েড–চিকিৎসা-পদ্ধতির নাম সাইকোঅ্যানালিসিস। রাত জেগে পড়ে ফেললাম বইটা। স্থির করলাম, চন্দ্রভানই এ পদ্ধতিতে আমার প্রথম রোগী হবে। ফ্রয়েড নামধেয় ডাক্তার সাহেব বলেছেন, মানসিক ব্যাধির মূল মানুষের অবচেতন মনে বাসা বাঁধে। কোন একটা গোপন কামনা তার অন্তস্তল কুরে কুরে খায়। রোগী যদি তার অতীত জীবনের সমস্ত ঘটনা অকপটে কোন বন্ধুর কাছে অথবা ডাক্তারের কাছে খুলে বলতে পারে তাহলে অনেক সময় তার রোগের নিরাময় হয়। সেকথা ফ্রয়েড সাহেবকে বলতে হবে কেন? এ তো আমরাও জানি। মনের ভার নামিয়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় কাউকে সব কথা খোলাখুলি বলে ফেলা। এ-ক্ষেত্রে সুবিধা এই-যে ডাক্তার সেই হচ্ছে ওর বাল্যবন্ধু। সুতরাং ও নিশ্চয় নিঃসঙ্কোচে সব কথা বলতে পারবে। আমাকে শুধু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে, ওকে উৎসাহিত করতে হবে, আগ্রহ দেখাতে হবে, সহানুভূতি জানাতে হবে।
সূরযভান আমার কাছে দাদাকে বুঝিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তভাবে ছুটির শেষে তার কর্মস্থলে ফিরে গেল। মাসান্তে সে মনি-অর্ডার করে দাদার সংসার-খরচ পাঠায়। চিকিৎসার যাবতীয় খরচ সে যোগাবে বলে প্রতিশ্রুত হল।
চন্দ্রভানের সঙ্গে নূতন করে বন্ধুত্ব হল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর সে আমার কাছে আসত। তার অতীত জীবনের সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করে যেত। তার গৃহত্যাগের কথা, বাওয়ালীতে আগমন, সেখানে ঊর্মিলা শারদাঁর প্রতি তার আকর্ষণ, তার ধর্মান্তর গ্রহণ। তারপর ধর্মপ্রচারক হিসাবে তার জোড়-জাঙ্গাল কোলিয়ারিতে আবির্ভাব, গীর্জার সংস্কার। যোসেফ মুর্মু-এককড়ি সরখেল–পাঁচু হালদারের দল জীবন্ত হয়ে উঠল আমার কাছে। ফাদার মার্লো, ব্রাদার দাভিদ অথবা নাথানিয়াল সাহেবদের আমি চোখ বুজলেই দেখতে পেতাম। তারপর সে এল পাঁচু হালদারের বোনঝির প্রসঙ্গে। এবার আর আমার নির্বাক শ্রোতা হয়ে থাকা সম্ভবপর হল না। বলি, চিত্রলেখা! কেমন দেখতে মেয়েটা? তার বাপ-মা কোথায় গেল?
চন্দ্রভান জানায়, মেদিনীপুরে বন্যায় এক রাত্রে কিভাবে চিত্রলেখার বাপ-মা-ভাই ভেসে গিয়েছিল। চিত্রলেখার একটা নিখুঁত আলেখ্য আঁকল সে কথার জাল বুনে। একহারা লম্বা ছিপছিপে শ্যামলা মেয়ে, চোখ দুটি উজ্জ্বল, চিবুকটা নিখুঁত। আমি চিনতে পারলাম তাকে। বুঝতে পারি চন্দ্রভান ভুল বলছে দামোদরের জলে ডুবে মরেনি ওর সেই চিত্রলেখা, মরেছে অক্সালিক অ্যাসিড খেয়ে। আমি নিজে হাতে তাকে পুড়িয়েছি কেওড়াতলার শ্মশানঘাটে। সেকথা জানে না চন্দ্রভান। সেকথা আমিও জানাই না। কী লাভ ওকে নতুন করে আঘাত দিয়ে?
চন্দ্রভান বলে, –ঐ জোড়-জাঙ্গাল ছেড়ে আসার সময়েই আমার প্রথমবার অ্যাটাক হয়।
–অ্যাটাক হয়! কিসের অ্যাটাক?
–পাগলামির। একটা খণ্ডমুহূর্তে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি কী করছি তা আমি জানতাম না। সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল আমার ডান হাতখানা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাকে শাস্তি দিতে হবে। কঠিন শাস্তি দিয়েছিলাম হাতটাকে। এই দেখ–সে প্রায়শ্চিত্ত আমার আজীবনের সঙ্গী হয়ে আছে।
ডান হাতখানা আলোর সামনে মেলে ধরে সে। হাতের তালুতে প্রকাণ্ড একটা পোড়া দাগ। বিধাতা ওর হাতে আয়ু-রেখা, ভাগ্য-রেখা, যশ-রেখা কী লিখেছিলেন তা আর কোনদিন পড়া যাবে না। বিধাতার দেওয়া সে হস্তরেখার সমস্ত চিহ্ন চন্দ্রভান পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। বিধাতাকে সে মানে না। বিধাতার দেওয়া হস্তরেখার নির্দেশও সে মানবে না। সে আপন দুর্ভাগ্য আপনি গড়ে তুলেছে অতঃপর। বললে, মোমবাতির শিখায় আধ মিনিট হাতখানা কেমন করে ধরে রেখেছিলাম আজও ভেবে পাই না! কিন্তু যতদূর মনে আছে আমি তখন একতিলও কপিনি, যন্ত্রণায় একটি আর্তনাদও করিনি! আমি ঐ এক মিনিট ধরে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম।
এবার যে আমার পাগল হওয়ার পালা! ওর সে পাগলামির বর্ণনা শুনে মুহূর্তে আমার চোখের উপর থেকে একটা পর্দা সরে গেল। বহুদিনের একটা সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। বটুক বলেছিল বটে–যীশুখ্রীষ্টের ডান হাতের তালুতে পেরেকের দাগটার বিষয়ে সুলেখার মনে একটা অবসেশান ছি। বটুকের ডান হাতের তালুতে একবার সামান্য একটু কেটে যাওয়ায় ফিট হয়ে গিয়েছিল সুলেখা। মনে পড়ল শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের সেই নার্সটির কথাসুলেখার মূৰ্ছিত দেহের কাছে কোন প্রদীপ জ্বলছিল না। তবু তার হাতে একটা ফোস্কা হয়েছিল। চিত্রলেখা কি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে চন্দ্রভানের যন্ত্রণার অনুভূতিটাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল?
জোড়-জাঙ্গাল কলিয়ারি ছেড়ে আসার পরের ইতিহাসটা এবার সে বলতে শুরু করে।
সূরযভান তখন কলকাতার একটি মেসে থাকে। মাত্র উনিশ কুড়ি বছর বয়স তখন তার। সবে চাকরিতে ঢুকেছে ম্যাট্রিক পাস করে। মেসে দাদাকে এনে তুলতে পারল না। বাধা ছিল। চন্দ্রভান খ্রীষ্টান, মেসবাবুরা সবাই হিন্দু। বাধ্য হয়ে চন্দ্রভান একটি ঘর ভাড়া নিল। প্রতিদিন অফিস ছুটির পর সূরয এসে দাদার খবরদারি করত। ক্রমে ওর হাতের
ঘা সারল। চন্দ্রভান লেগে থাকল তার ছবি আঁকার সঙ্কল্পে। সূরয ছবির কিছুই বোঝে। না; কিন্তু ওর দৃঢ় ধারণা দাদার ছবি একদিন না একদিন সমাদর পাবেই। এর কিছুদিন পর সূরয বদলি হয়ে গেল দিল্লীতে। একা পড়ে গেল চন্দ্রভান। দিনরাত সে ছবি এঁকে বেড়ায়। ঘরেবাইরে। দুজনের সঙ্গে তার পত্রালাপ চলত। চিঠি যেত দিল্লী-মুখো আর আসানসোল-মুখো। জবাব আসত সূরযের কাছ থেকে, আসত দেবনারায়ণবাবুর কাছ থেকে। সূরয অন্ধ বিশ্বাসে ওকে উৎসাহ যোগাতো, আর দেবনারায়ণবাবু ওকে যে। আশীর্বাদ করতেন তার পিছনে থাকত দক্ষ শিল্পীর ধ্যান-ধারণা।
ল্যাণ্ড স্কেপ আর স্টিল-লাইফ আঁকার দিকে ঝোঁক। মানুষজনের কিছু কিছু স্কেচ করেছে, পেনসিলে বা ক্রেয়নে। পোর্ট্রেট আঁকবার সুযোগ কই? কে ওর জন্য ধৈর্য ধরে সময় নষ্ট করবে? জোড়-জাঙ্গালের মালকাটারা তবু ওর খেয়াল চরিতার্থ করবার সুযোগ দিত। হাজার হোক সে ওদের ফাদারদা। কলকাতা শহর সে হিসাবে নিতান্ত উদাসীন। কাজের চাকায় বাঁধা এর লক্ষ বাসিন্দা।
এই সময় আরও একটা ধারণা অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে শিল্পীর মনে। তার মনে হত যে জগন্টা সে দেখতে পাচ্ছে সেটা সত্য নয়। এ যেন প্রেক্ষাগৃহের সামনে প্রলম্বিত একটা প্রকাণ্ড যবনিকা। রূপরস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের চিত্র বিচিত্র করা ঐ পর্দাটা টাঙানো আছে চোখের সামনে, কারণ দর্শকদের কে যেন আড়াল করে রাখতে চায় ভিতরের গোপন আয়োজন থেকে। ঐ পর্দাটা যখন উঠে যাবে তখন শুরু হবে আসল অভিনয়। ভিন্সেন্ট তার ক্যানভাসে পথ-ঘাট, গাছ-পালা আঁকে কিন্তু তার মন ভরে না; তার মনে হয়–এহ বাহ্য। ঐ পথ যেন কী একটা কথা বলতে চায়, ঐ গাছ যেন তার প্রাণের কথা শোনাতে চায়—-ঐ বর্ষণোম্মুখ মেঘ, ঐ সান্ধ্য আকাশের অস্তরবিচ্ছটার যেন আরও কিছু বক্তব্য আছে কিন্তু তারা সে কথা বলতে পারছে না। ওর ক্যানভাসে সেই গোপন কথা ফুটে উঠছে না। দৃশ্যমান জগতের অন্তরের নিবিড় বাণী যদি তার ক্যানভাস মূর্ত না হয়ে ওঠে তবে আর কী ছবি আঁকল সে? সেটা তো ফটোগ্রাফ।
আর সৃষ্টির সবচেয়ে বড় রহস্য-মানুষ! তার সামনে যে আবার ডবল পদা! সে কথা বলে মনের ভাব ব্যক্ত করতে নয়, গোপন করতে! সে হাসে কান্না লুকোতে! সে কাঁদে-ধরা পড়ে যাবার ভয়! তার উপর সে চড়িয়েছে আবরণ। শুধু মন নয়, দেহের উপরেও টেনে দিয়েছে পর্দা! ভিন্সেন্ট ঈশ্বরে বিশ্বাস হারিয়েছে কিন্তু বাইবেল বর্ণিত ঈশ্বর ও-ভুল করেননি। তিনি আদিম আদম আর ঈভকে অনাবৃত রেখেছিলেন। তাই রেনেসাঁস যুগের শিল্প-ঋষির দল টেনে খুলে ফেলেছিলেন ঐ নির্মোক!
চন্দ্রভান স্থির করল–তাকে ন্যুড স্টাডি করতে হবে।
কিন্তু কে সিটিং দেবে? কে বসবে ঐ নিলজ্জ ভঙ্গিতে?
রঙ-তুলি ক্যানভাস নিয়ে চন্দ্রভান অবশেষে অবতীর্ণ হল রূপোপজীবিনীদের পাড়ায়।
দুঃসাহস বলতে হবে। কিন্তু দুঃসাহসে ভিন্সেন্ট কোনদিনই বা পিছ-পাও হয়েছে? সে নীতি মানে না, ধর্ম মানে না, ঈশ্বর মানে না। মানে বিবেক। সেই বিবেকের নির্দেশে সে এসে হাজির হল দেহের তীর্থে!
পাৎলুন আর হাফসার্ট পরা অদ্ভুতদর্শন মানুষটাকে দেখে খিল খিল করে হেসে উঠেছিল ওরা। সরু গলি। আধো-আলো আধো-অন্ধকার। ডিমের ডালনা না কঁকড়ার তরকারি কিসের একটা উৎকট রসুন-মিশ্রিত গন্ধের সঙ্গে মিশেছে বেলফুলের সৌরভ। খোলা দরজার ওপাশে একটা জোরালো বাতি–তারই এক প্রস্থ আলো আছাড় খেয়ে পড়েছে গলি-পথটায়। নেপথ্যে হারমনিয়াম তবলা সহযোগে ভেসে আসছে আবহ গজল। দেওয়াল-সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে সাত-আটটি মেয়ে। মাথায় বেলফুলের মালা, চোখে কাজলচড়া রঙের রুজ মেখেছে গালে। কপালে কাঁচ পোকার টিপ। সদর। দ্বারের কাছে ঐ খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা বিচিত্র জীবটাকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে ওরা এ-ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ে হাসতে হাসতে। কে একজন বলে, কি গো ভাল মানুষের পো? ভির্মি যাবে নাকি?
পিছন থেকে বর্ষীয়সী একজন স্থূলকায়া রমণী ওদের ধমক দিয়ে ওঠে, কী ছেনালি করিস তোরা? আসতে দে না ওরে! পথ আটকে আছিস কেন?
সামনের মুখরা মেয়েটি বলে ওঠে, –ওমা, কি যে বল মাসি? পথ আটকাবো কোন্ দুঃখে গো? কারে নজরে ধরল তা তো ও বলবে? না কি ও তোমার কাছেই যেতে চায়?
আবার খিল্ খিল্ হাসি।
ভিন্সেন্ট অপ্রস্তুত হয়নি মোটেই। ইতিমধ্যে তার নজর পড়েছিল আর একদিকে। ভীড়ের পিছনে দেওয়াল-সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মধ্যবয়স্কা। উৎকট প্রসাধন করেছে সে। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। কিন্তু মেয়েটি মাতৃত্বের ভারে আনত! ভিন্সেন্ট তৎক্ষণাৎ মনস্থির করে ফেলে। জীবন রহস্যের মর্ম উদ্ঘাটনে সে অভিযাত্রী-আর জীবন-রহস্যের মূল তো সৃষ্টিতত্ত্বে! এই পঙ্কিল দুনিয়ার পঙ্কিলতম অন্ধকারে পিতৃ পরিচয়হীন যে শিশু আবির্ভাবের জন্য প্রহর গুনছে-আঁকতে হয় তারই মায়ের ছবি আঁকবে ভিন্সেন্ট! ঐ অনাগত শিশুর সম্মুখেও মাতৃজঠরের আবরণ–কিন্তু নিরাবরণ জননীতত্ত্বের ছবিই বা কে কবে এঁকেছে? ভিন্সেন্ট মনে মনে তার চিত্র-অভিজ্ঞতার পাতা উল্টে যায়। প্রাচ্য বা প্রতীচ্য–কে কবে নিরাবরণা মাতৃত্বের ছবি এঁকেছে? ন্যুড স্টাডি হাজার বছর ধরে করেছে শিল্পীদল; কিন্তু সেখানে বিষয়বস্তু নারী, জননী নয়! কেন? শিল্পীর চক্ষে কি এতাবৎকাল স্ফীতোদর জননীর চিত্রটা সুন্দর মনে হয়নি? সত্য কি সুন্দর নয়? সৃষ্টিই কি সত্য নয়? সুন্দর নয়? মুহূর্তমধ্যে মনস্থির করে ভিন্সেন্ট; ভীড় ডিঙিয়ে ঐ মেয়েটিকে প্রশ্ন করে, তোমার ঘর কোষ্টা?
-ওমা আমি কোথায় যাব! তা হ্যাঁগা ভাল্ মানুষের পো! ওর মুখখানাই শুধু দেখলে তুমি-কেঁচড়ে যে মুড়ির মোয়র পুঁটুলি বেঁধেছে সেটা নজর হল নি?
–তুই চুপ যা দেখি চামেলি! ধমকে ওঠে বর্ষীয়সী বাড়ি-উলি। এগিয়ে এসে সে
ভিন্সেন্টের হাতখানা ধরে, বলে, তুমি ভিতরে এস বাছা; নইলে অরা তোমারে ছিঁড়ে খাবে!
ভিন্সেন্টকে বাড়িউলি মাসি হাত ধরে ভিতরে নিয়ে যায়। তাকে বসিয়ে দেয় একটা ঘরে। এটা বোধহয় মাসির নিজস্ব ঘর। বলে, -কিছু মনে কর না ভাই। নতুন যারা আসে তাদের নিয়ে ওরা এমনি মস্করা করে। কিন্তু তাও বলি ভাই তুমি ঠিক বুদ্ধির পরিচয় দাওনি।
তারপর মুখটা কানের কাছে এনে বলে, বুঝতে পারনি তুমি? ওর বাচ্চা হবে!
–তাহলে ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলে কেন?
–কোথায় যাবে বল ভাই? ঐ তো, এক অন্ধকূপ কুটুরি! সাঁঝের বেলা একটু নিঃশ্বাস নিতে দাঁড়ায় ওখানে! ও কি এখন তোক বসাতে পারে?
ভিন্সেন্ট কি একটা কথা বলতে যায়; কিন্তু তার আগেই দ্বারের কাছে এসে কে। ডাকে, মাসি!
-কি রে?
মাসি দ্বারের কাছে সরে আসে। আগন্তুক সেই আসন্নজননী মেয়েটি। সে নিম্নস্বরে কি বললে তা শোনা গেল না; কিন্তু মাসির আপত্তিটা শোনা গেল। মাসি কিছুতেই রাজী হতে চায় না। শেষ পর্যন্ত সে হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসে। ভিন্সেন্টকে বলে, কি জানি বাপু! ও আবাগিরও দেখি তোমারে মনে ধরেছে। তা বেশ। তিন টাকা লাগবে বাপু। দু-ট্যাকা অর, এক টাকা আমার! প্রথম দিন, কম করেই ধরলাম। আর শোনো
মুখটা কানের কাছে এনে ভিন্সেন্টকে একটু সাবধান করে দেয়। দু-একটা উপদেশ দেয়। ভিন্সেন্টের খরগোশের মত খাড়া কান দুটো লাল হয়ে ওঠে।
ছোট্ট ঘর। সেখানে ঘর জোড়া চৌকি। পরিষ্কার বিছানা পাতা তাতে। নরম গদি। দুটি বালিশ। দেওয়ালে কালীঘাটের একটি পট। অন্নপূর্ণা ভিক্ষা দিচ্ছেন ভোলানাথকে। কুলুঙ্গিতে একটি লক্ষ্মীর পট। কাল বৃহস্পতিবার গেছে। ফুলের মালাটা পটের উপর এখনও শুকিয়ে যায়নি। দেওয়ালে টাঙানো একটা হাত-আয়না। কোণায় একটা হাতলহীন চেয়ার। ভিন্সেন্ট চেয়ারে গিয়ে বসল। মেয়েটিও ঢুকেছে ঘরে।
ভিন্সেন্ট তখনও মুখ তুলে মেয়েটিকে ভাল করে দেখেনি। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ। থেকে সে রঙ-তুলি ক্যানভাস বার করতে থাকে। ঘরে আলো বড় কম। বললে, একটা ভাল লণ্ঠন আনতে পার?
মেয়েটি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল এবং একটা লণ্ঠন এনে নামিয়ে রাখে মেঝেতে। ভিন্সেন্ট সেটা ঠিক করে বসিয়ে দিল। মেয়েটি দরজাটায় খিল এঁটে চুপচাপ গিয়ে বসল খাটের উপর। এবার মুখ তুলে ভিন্সেন্ট দেখে মেয়েটি ওকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছে! চোখাচোখি হতেই চমকে ওঠে ভিন্সেন্ট। ঐ রূপোপজীবিনীকে সে আগে কখনও দেখেছে? চেনা চেনা লাগছে কেন ওকে? না! মেয়েটি তার পূর্ব-পরিচিত হতেই পারে না। এ পাড়ায় সে কখনও আসেনি। কত বয়স হবে ওর। উত্তীর্ণ-যৌবনা বলা যায় না। তাকে। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। মুখে বসন্তের দাগ। মাথায় বেলফুল জড়ানো। খোঁপা। গায়ে সস্তা ব্রোকেডের জ্যাকেট। পরনে হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি। দু-হাতে দুটি গিল্টি করা বালা, কানে পিতলের ঝুমকো দুল।
ভিন্সেন্ট হঠাৎ বলে বসে, –একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কতক্ষণ থাকতে দেবে আমাকে?
মেয়েটি মুখ নিচু করে বলে, আপনার যতক্ষণ ইচ্ছে। ভাল লাগলি তামাম রাত!
-ও আচ্ছা! তবে তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। শোন আমি তোমাকে কোন কষ্ট দেব না। তুমি খাটে শুয়ে থাকবে, আমি তোমার একখানা ছবি আঁকব শুধু। যে ভঙ্গিতে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকতে তোমার অসুবিধে হবে না সেভাবে শুয়ে পড়।
মেয়েটি বোধহয় ওর কথাগুলো ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সে ডাগর চোখ মেলে শুধু তাকিয়েই থাকে।
কী আশ্চর্য! ওকে এত চেনা-চেনা লাগছে কেন? ঐ রকম মুখ সে কোথায় দেখেছে? বত্তিচেল্লি-পেরুজিনোকরেজজো? না হোলবাইন ব্ৰখেল-ফ্র্যাঞ্জ হ্যাঁলস? না কি আরও পরের যুগের দেলাক্রোয়ে-মানে-এগার-দেগা-রেনোয়? কোন এক দিকপাল শিল্পী নিশ্চয় ঐ রকম একখানা মুখের ছবি এঁকেছিলেন–সেই ছবি-দেখার স্মৃতিটাই ওকে এই বিভ্রমের মধ্যে ফেলছে–মনে হচ্ছে ওকে আগেও দেখেছি।
–ছবি আঁকবেন? অস্ফুটে প্রশ্ন করে মেয়েটি।
বেশ্যাপল্লীতেও ভদ্রতার এই রীতি নাকি? দেহদানের পূর্ব মুহূর্তেও অপরিচিত পুরুষকে আপনি সম্বোধন!
–হ্যাঁ। শুয়ে পড় তুমি। ছবিই আঁকব তোমার।
তারপর ইতস্তত করে বলে, -ভেবেছিলাম ন্যুড-স্টাডি করব; কিন্তু থাক, তোমার অসুবিধা হবে।
-কি করবেন?
–ও কিছু নয়, থাক।
–শুব?
–হ্যাঁ, তাই তো বলছি তখন থেকে।
জামা কাপড় খুলবনি?
খুলবে? বেশ, তাই কর।
চেয়ারটা অন্যদিকে সরিয়ে ভিন্সেন্ট দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে। উপায় নেই। এতটুকু ঘরে স্থানান্তরে সে যাবে কোথায়? কোন ভদ্রমহিলা বেশ পরিবর্তন করতে চাইলে যেটুকু শালীনতা বজায় রাখতে হয় সেটুকু রাখতেই বেচারির কপালে ঘাম ফুটে ওঠে।
দীর্ঘ তিন ঘন্টা ধরে পোর্ট্রেটখানা আঁকল ভিন্সেন্ট। মেয়েটি ওর দিকে ফিরেই শুয়েছিল। হাতখানা আলো আড়াল করতে রেখেছিল চোখের উপর। ভিন্সেন্ট ছবি আঁকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। ঘন্টা তিনেক পরে ও বললে অনেক কষ্ট দিলাম তোমাকে। এবার জামা কাপড় পরে নাও। আমার ছবি শেষ হয়ে গেছে।
আবার পিছন ফিরে বসে। মেয়েটি তার পরিধেয় বস্ত্রটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলে, — ই- চায় আপনি এই পেরথম আসিছেন, লয়?
ভিন্সেন্ট জবাব দেয় না। পকেট থেকে তিনটি টাকা বার করে সে রাখে খাটের উপর। বলে, -এবার যাই আমি?
মেয়েটি চট করে উঠে দাঁড়ায়। ভিন্সেন্টের হাতখানা চেপে ধরে। গুঁজে দেয় টাকা তিনটে। সে নেবে না ওর দান। ভিন্সেন্ট চমকে ওঠে। এতক্ষণ স্পর্শ বাঁচিয়ে চলছিল সে। হাতখানা চেপে ধরায় বিব্রত বোধ করে। হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে; কিন্তু মেয়েটি দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে রাখে তাকে। বলে, -হাই বাবা গ! তুমি আমারে চিনতে লারলেক ফাদারদা?
অবাক বিস্ময়ে এবার তাকিয়ে থাকে ভিন্সেন্ট। বিস্মৃতির যবনিকা উঠে যায় তার চোখের উপর থেকে। কী আশ্চর্য! একে চিনতে পারেনি সে? বলে, তুই? বাতাসী?
বারবনিতারও, তা হলে লজ্জা থাকে? দু হাতে মুখ ঢেকে বাতাসী বলে, হাই!
তুই এখানে কেমন করে এলি? মুখে ওসব কি দাগ? বসন্ত হয়েছিল তোর? এ কী চেহারা করেছিস?
বাতাসী ওকে ছাড়ে না। অনেক, অনেক কথা জমে আছে ওর পেটে। ভিন্সেন্ট জোড়-জাঙাল কোলিয়ারি ছেড়ে আসার পর কত কথা! দূরন্ত মারীরোগে মরতে বসেছিল সে। কিন্তু যম তাকে নিল নাফিরিয়ে দিল। মরল মুর্মুর মেয়েটা। মুখে বিশ্রী দাগ, চুল উঠে গেছে। বাতাসী উঠে বসল অসুখ থেকে কিন্তু জোড়-জাঙালে তার মন বসল না। নানুক চলে গেছে। যোসেফের মেয়েটাও থাকল না। শুনল তাদের ফাদারদাও কোথায় চলে গেছে। আর চ্যাতরা দিদিমণি? সেও ডুবে মরেছে। দামোদর খেয়েছে তার বাপকে, মাকে, ভাইকে। সেই দামোদরই জুড়িয়েছে চ্যাতরা দিদিমণির জ্বালা। তারপর অনেক ঘাট ঘুরে বাতাসী এসে পড়েছে এখানে। মাসি তাকে ঠাই দিয়েছে। তার উপার্জনের এক-তৃতীয়াংশ চুক্তিতে তাকে খেতে দেয়, পরতে দেয়, থাকতে দেয়। কত মানুষ দেখেছে বাতাসীকত বিচিত্র মানুষ। গরীব গুর্বো, হঠাৎ বড়লোক, বাবু মশাইরা বাঙালি বিহারী-মাড়োয়ারী, মায় কাবুলিওয়ালা! বহুভোগ্যা বাতাসী আজও বেঁচে আছে। বসন্তের দাগ? ওসব ওরা দেখে না। ওরা যা চায় তার সম্বল আজও নিঃস্ব হয়ে যায়নি বাতাসীর। যেদিন তা ফুরাবে? সেদিন ভিক্ষে করতে বসবে।
সেরাত্রে ভিন্সেন্ট আর বাড়ি ফেরেনি। সারা রাত ছিল ওখানে।
তার পর থেকে সে প্রায়ই যেত ওখানে। বাতাসীর কাছে। ওর ভাল লাগত বাতাসীকে। অন্তত কথা বলার লোক তো পেল এতদিনে। মাঝে মাঝে খরচ করতে হত–না হলে মাসির রসনা মুখর হয়ে উঠবে। ভিন্সেন্ট বাতাসীর অনেক ছবি আঁকল। কিন্তু শুধু ছবি এঁকে ওর তৃপ্তি নেই। নতুন চিন্তা ঢুকেছে তার মাথায়। এভাবে বাতাসীকে সে মরতে দেবে না।
বাতাসী রাজী হয়ে গেল। মাসির সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে একদিন বের হয়ে এল ঐ নরককুণ্ড থেকে। এসে উঠল ভিন্সেন্টের এক কামরার ঘরে। নৃতন পরীক্ষায় মেতেছে। ভিন্সেন্ট। মাসান্তে সে যে কটা টাকা পায়, সমঝে চললে তা থেকে দুজনে আধ-পেঠা খেয়ে বাঁচতে পারে। তারপর যদি দু-একখানা ছবি বেচতে পারে তখন আর তাকে পায় কে? সংসারধর্ম তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। বাতাসীই তার সহধর্মিণী। বাতাসী তাকে বুঝেছে। তাকে স্নেহের চোখে, শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে। বাতাসী রান্না করতে পারে, ঘরদোর গুছিয়ে রাখতে জানে। ওর এক কামরার গৃহস্থালী নৃতন রূপ নিল। প্রতিবেশীরা সব সাড়ে বত্রিশ ভাজা। রিকসা-আলা ঠেলাওয়ালা ভাজিওয়ালা। তারা নাক গলাতে এল না। বাতাসী হল এ গৃহের ঘরণী। সমস্ত কথা খোলাখুলি লিখে জানালো সূরযকে। সে যখন চিঠির জবাব দিল তখন এ-প্রসঙ্গের উচ্চবাচ্য পর্যন্ত করল না।
বাতাসীর মাসির পরামর্শ ছিল বাচ্চাটাকে পৃথিবীর মুখ দেখতে না দেওয়া; কিন্তু ভিন্সেন্ট কিছুতেই রাজী হল না। পাখি-পড়া করে সে বাতাসীকে বোঝালো। শেষে বাতাসী রাজী হল ডাক্তারের কাছে যেতে। ঐ সময়েই সে দীপু-ডাক্তারের কাছে আসে। কিন্তু ওর বাল্যবন্ধুও ওকে দরজা থেকে হাঁকিয়ে দিল। তা দিকজাগতিক বিধান কারও নীতিবাক্যে থেমে থাকে না। যথাসময়ে বাতাসীর একটি কন্যাসন্তান হয়েছিল। ভিন্সেন্টের সে কী আনন্দ। কে মেয়ের বাপ তা বাতাসী জানে না। কিন্তু পিতৃপরিচয়হীন অনেক মহাপুরুষই তো অক্ষয় কীর্তি রেখে গেছেন দুনিয়ায়। ভিন্সেন্টই বেশি মাতাল মেয়েকে নিয়ে।
একেবারে নির্ভেজাল আনন্দ কিছু নেই এ দুনিয়ায়। দেবনারায়ণবাবু ওর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করলেন। তিনি কি কারণে কলকাতায় এসেছিলেন। ঠিকানা খুঁজে ভিন্সেন্টের বাসায় এসে মর্মাহত হয়েছিলেন। ভিন্সেন্ট মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারেনি। স্বীকার করেছিল, বাতাসী তার বিবাহিতা স্ত্রী নয়। দেবনারায়ণবাবু তৎক্ষণাৎ চলে গিয়েছিলেন। ত্যাগ করেছিলেন শিষ্যকে।
সূরযভান কিন্তু ওকে ত্যাগ করেনি। প্রতি মাসে দাদাকে মনিঅর্ডার করে গেছে। জানতে চেয়েছে সে নূতন কি আঁকল। সকল আঘাত সইতে প্রস্তুত ছিল ভিন্সেন্ট। বাতাসীকে সে বিবাহ করতে চেয়েছিল। রাজী হয়নি বাতাসী। বলে কী বুলছিস রে তুই? বেবুশ্যের কি বিয়া হয়?
কে বোঝাবে ওকে? ভিন্সেন্ট অনেক কথা বলেছে। সমাজতত্ত্বের কথা, দেশ বিদেশের নরনারীর সম্পর্কের কথা, দেশাচার ভেদে বিবাহের নিয়মাবলী কেমনভাবে বদলায়; কিন্তু বাতাসী ওসব কথায় কর্ণপাত করে না। বলে, –তু কি পাগল হয়ে গেলি ফাদারদা? চ্যাহ্বা দিদিমণি তুরে কেনে বিয়া করতে লারলেক, সি কথাটো বুঝা মোরে।
বিচিত্র যুক্তি বাতাসীর। চ্যাতরা দিদিমণি লেখাপড়াজানা ভদ্র ঘরের মেয়ে। এমন অশুচি অবস্থায় বিবাহ যদি বিধিসম্মত হত তা হলে কেন চ্যারা দামোদরে ডুবে মরতে যাবে? ফাদারদা তো তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। চ্যাতরা দিদিমণি যে ফাদারদাকে। ভালবেসেছিল এটুকুও কি বোঝেনি বাতাসী? তাহলে? বাধা তো ঐখানে। ফাদারদা আর চ্যাতরা দিদিমণির মাঝখানে সেদিন মূর্তিমান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল লম্পট নাথানিয়েল। এই যদি সত্য হয়, তাহলে এবার? ঐ ফাদারদা আর বাতাসীর মাঝখানে আছে কয়েকশ মূর্তিমান বাধা বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন জাতের। বাঙালি বিহারী-মারোয়াড়ী-পাঞ্জাবী, মায় কাবুলিওয়ালা। না, না, ছি ছি!
ঈশ্বর না মানো, নাই মানলে–একটা কিছু মানতে হবেই। তাকে ভাগ্যই বল, নিয়তিই বল, আর যাই বল। না হলে চন্দ্রভানের পিছনে অতন্দ্রভাবে কে এমন করে লেগে আছে? সে যা কিছুতে হাত দেয় তাই ছাই হয়ে যায়। সারা জীবনে কোথাও সে সফল হতে পারল না। বাতাসীকে নিয়ে এই অদ্ভুত পরীক্ষাতেও শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে হল তাকে। কী আশ্চর্য! কী অপরিসীম আশ্চর্য! বাতাসী এখানে টিকতে পারল না। ভিন্সেন্টের অভাবের সংসারনুন আনতে পান্তা ফুরায়; কিন্তু বাতাসী কিছু রূপার চামচ-মুখে জন্মায়নি। অভাব কাকে বলে বাতাসী তা ভাল মতই জানে। সেজন্য তো নয়। তাহলে কেন? বোধহয় অমিতাচারেই বাতাসী অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল-সাত্ত্বিক জীবনযাত্রা সহ্য হল না তার।
প্রথম প্রথম এ-পাড়ায় এসে বাতাসী আদপেই বাড়ির বার হতে চাইত না। নেহাৎ পথে নামতে হলে একগলা ঘোমটা দিত। তার জীবনে যে অসংখ্য পুরুষ এসেছে। তাদের কাছ থেকে ও আত্মগোপন করতে চাইত। পথে-ঘাটে কেউ যেন না হঠাৎ বলে বসে, -আরে, বাতাসী যে!
কিন্তু শেষদিকে সে বেপরোয়া হয়ে পড়ল। ভিন্সেন্ট বেরিয়ে গেলে মেয়ে কোলে নিয়ে সেও কোথায় বেরিয়ে যেত। ভিন্সেন্ট টের পেত, প্রশ্ন করত কিন্তু বাতাসী কোথায় যায় তা বলে না। একদিন ভিন্সেন্ট বলে বসল, তুমি কি মদের নেশায় বাড়ির বাইরে যাও বাতাসী? তার প্রয়োজন কি? তুমি বাড়িতে বসেই খেও!
–ঈ বাবা গ! কী বলছিস্ তু? মদ আমি খাই না গ!
ডাহা মিথ্যে কথা। জোড়-জাঙালেও বাতাসী হাঁড়িয়া খেত, বেশ্যাপল্লীতেও নিশ্চয় খেয়েছে। অথচ এখন এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন মদ কাকে বলে সে জানেই না!
বাতাসী যে কোথায় যায় তা টের পাওয়া গেল অচিরেই। একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে ভিন্সেন্ট দেখে বাড়িউলি বসে আছে তার ঘরে। বাতাসী স্টোভে খাবার করছে। সুজির মোহনভোগ। বাতাসী পয়সা পেল কোথায়? না কি মাসিই সুজি আর চিনি কিনে দিয়েছে? ভিন্সেন্টের মুখটা কালো হয়ে ওঠে। বাতাসী যদি তার ঐ জীবনকে একেবারে না মুছে ফেলতে পারে তবে কোনদিনই তার পরীক্ষা সাফল্যলাভ করবে না।
–এস জামাই। বস। আহা, সারাদিনমানে মুখখানা যে রাঙা হয়ে গেছে গো!
ভিন্সেন্ট জবাব দেয় না। খুকিকে কোলে তুলে নিয়ে পার্কের দিকে চলে যায়।
এই নিয়েই বিবাদ। ভিন্সেন্টের স্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও মাসি এ বাড়িতে ঘন-ঘন আসতে। শুরু করল। শেষে সে অন্য কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসা আরম্ভ করে। কখনও ময়না, কখনও চাপা, কখনও পদ্ম। ভিন্সেন্ট ওদের চেনে। সে মনে মনে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এটা ভদ্রপল্লী। বাতাসীর বিষয়ে কেউ কৌতূহলী হয়নি। তার সাজ-পোশাক সে পাটে ফেলেছিল এ পাড়ায় এসে; কিন্তু ওদের যে দেখলেই চেনা যায়!
ভিন্সেন্ট বাতাসীকে বললে, -তুমি কি চাও স্পষ্ট করে বল তো? আমি কিন্তু বেঁধে। রাখিনি তোমাকে। এখানে যদি ভাল না লাগে তুমি সোজাসুজি ও পাড়ায় চলে যাও। এ রকম দু-নৌকোয় পা দিয়ে চলতে পারবে না।
-কী করলাম আমি? হাই বাবা গ! ধমকাইছ কেনে?
–তোমাকে বারণ করেছি তবু তুমি ওদের এখানে কেন নিয়ে আসছ?
–উরা আমারে এত বছর খাওয়াইলেক, দেখভাল করলেক, সিটি কি ভুলি যাব?
–হ্যাঁ, ভুলে যাবে। ওরা খেতে দিয়েছে, পরতে দিয়েছে–তুমিও গতরে খেটে শোধ দিয়েছ। সে সব চুকেবুকে গেছে। আর ভুলতে যদি না পার তো স্পষ্টাস্পষ্টি সেখানে চলে যাও। এ অধ্যায়টা ভুলে যেও।
–আমারে তাড়াই দিছিস ফাদারদা?
হঠাৎ চমকে ওঠে ভিন্সেন্ট ওর সম্বোধনে। তাই তো! ও এখনও বাতাসীর ফাদারদা। দেড় বছর সে বাতাসীর সঙ্গে ঘর করছে–তবু সে আজও আছে তার সম্মানের উচ্চ আসনে। এক ঘরে দুজনে রাত কাটায়। বাতাসীর একাধিক ন্যুড স্টাডি এঁকেছে সে–তবু বাতাসীর চোখে আজও ভিন্সেন্টফাদারদা! ফাদার অথবা দাদা!
কথা বলছিস না কেনে রে, তাড়ায়ে দিছিস?
তাড়িয়ে আমি দিচ্ছি না, তুই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিস বাতাসী?
এবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললে প্রায়-প্রৌঢ় বাতাসী। ভিন্সেন্ট কি বুঝবে বাতাসীর যন্ত্রণা? আপনভোলা উদাসীন মানুষটার সংসারের কোন খোঁজ রাখে? সব কিছু বাতাসীর হাতে তুলে দিয়ে সে নিশ্চিন্ত হয়েছে। এতদিন ধরে সে মেতে আছে তার রঙ-তুলি নিয়ে। সারাটা দিনভর বাইরে বাইরে ছবি এঁকে বেড়ায়, ঘরে ফিরলে মেয়েকে নিয়ে পড়ে। এক বছরের মেয়েটার সঙ্গে তখন তার কত গল্প, কত আলাপ! কিন্তু বাতাসী? তাকে এই হালভাঙা পালছেঁড়া নৌকোটাকে বেয়ে নিয়ে যেতে হয় এক মাস পয়লার ঘাট থেকে পরের মাসের মাস-পয়লায়। সূরযভানের মাসিক বরাদ্দ আছে অপরিবর্তিত। অথচ সংসারে মানুষ এক থেকে দুই হল, তারপর দুই থেকে আড়াই। কিন্তু বাঁধা বরাদ্দ অপরিবর্তিত। একদিকে এই অবস্থা, অপরদিকে বাড়িউলি মাসির ক্রমাগত প্রলোডন! আকৈশোর যে-জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে আছে সেই জীবনের ডাক শুনতে পেত-চামেলি, চাপা, ময়নাদের কণ্ঠে! মনকে শক্ত করত বাতাসী–না, সে ঐ জীবনে আর ফিরে যাবে না। কিন্তু মন কি কারও পোষা পাখী? আর পাখীও তে শিকল কেটে পালায়? ভিন্সেন্টের চোখ এড়িয়ে দু-পাঁচ টাকা রোজগার শুরু করতে বাধ্য হল বাতাসী। না হলে তিনজনকেই উপোস করে থাকতে হত! এমন সরল আত্মভোলা মানুষটা-সে ভেবে দেখল না, কিভাবে সংসারটা চলছে!
আকৈশোর পুরুষের সোহাগ পেয়েছে বাতাসী–কিন্তু সত্যিকারের স্নেহ ভালবাসা কাকে বলে তা জানত না। সে অভিজ্ঞতাটাই কি কম? একটা আত্মভোলা মানুষের জন্য ঘুম-ঘুম চোখে ভাত আগলে বসে থাকার যে আনন্দ সেটা সে কবে পেয়েছে? নিজের পাতের মাছখানা হাতসাফাই করে ওর পাতে চালান করে দিয়ে, নিজের ভাতের থালা ওর পাতে ঢেলে দিয়ে উপবাসে থাকার যে কষ্ট, সে আনন্দ সে কবে পেয়েছে? এ এক অনাস্বাদিতপূর্ব জীবনমাধূর্য! এটাকেও বাতাসী ছাড়তে চায়নি। তাই এতদিন দু-নৌকোয় পা দিয়ে সে চলেছিল কোনক্রমে। আজ ধরা পড়ে গেল নাকি?
ভিন্সেন্ট তাগাদা দেয়, কই, জবাব দিলি নে যে? আমি তোকে তাড়িয়ে দিচ্ছি, না তুই আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিস?
–আমি কেনে যাব? টুক বাইরে না গেলি চলবে কেমনে, বল কেনে?
-কেন? সংসার তো চলছে। উপোস তো করতে হচ্ছে না কাউকে। সেদিন তো সুজি করলি; ভাতের পাতে আজকাল তো মাছও দিচ্ছিস?
বাতাসী অশ্রুসিক্ত মুখটা তুলে বলে, –তুরে কেনে বুঝাই ফাদারদা? কী বুলব তুকে?
বিদ্যুদস্পৃষ্টের মত চমকে ওঠে ভিন্সেন্ট। তাই তো! বাতাসী আসার আগে তার সংসার চলতে চাইত না। মাসের বিশ তারিখের পর তাকে একবেলা আহার বন্ধ করতে হত। মাসের শেষ, তিন-চারটে দিন ঐ একবেলাও সে অর্ধাহারে থাকত। পরের মাসে ডাকের গণ্ডগোলে মনি-অর্ডার আসতে দেরি হলে মাস-পয়লার প্রথম কদিন উপবাসেও থাকতে হয়েছে। কিন্তু কই, গত এক বছর ধরে এমন অবস্থা তো একবারও হয়নি! অথচ সংসারে মানুষ বেড়েছে। তার একটিমাত্র অর্থই হয়। বাতাসী উপার্জন করছে। তাই মাঝে-মাঝে বাড়িউলি-মাসি আসে এখানে। তাই মাঝে মাঝে বাতাসী কোথায় যেন চলে যায়! একটা তীব্র আত্মগ্লানিতে ওর সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে আসে। সে অশক্ত, অসহায়, উপার্জনহীন! তাই বাতাসী–
ভিন্সেন্ট বসে পড়ে চৌকির প্রান্তে। ক্লান্তভাবে বলে, কতদিন এভাবে দেহ বেচে আমাকে খাওয়াচ্ছিস বাতাসী?
ঈ বাবা গ! আমি কেনে খাওয়াব তুকে? ভগবান খাওয়ায়,
–চুপ কর! ভগবান নেই!
–ঈ কথাটো তু বুললি ফাদারদা! তু?
-হ্যাঁ, বললাম। শোন! ও-ভাবে তোকে রোজগার করতে হবে না। দরকার হয় আমরা তিনজনেই উপোস করব। বুঝলি?
বাতাসী তর্ক করে না। ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। মেনে নেয়। এবার ভিন্সেন্ট সজাগ হয়েছে। সে টের পায় বাতাসী তার পথ পরিবর্তন করেনি। এখন আর লুকোছাপার প্রয়োজন বোধ করে না। চক্ষুলজ্জাটা ঘুচে গেছে। সন্ধ্যাবেলা ভিন্সেন্ট ঘরে ফিরে এলে মেয়েকে তার কাছে বসিয়ে দিয়ে বলে, –অ্যারে টুক রাখ দিকিন ফাদারদা। আমি টুক ঘুর্যা আসি।
তার শাড়ি জ্যাকেটের পুটুলি বেঁধে নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে রাত গভীরে। ভিন্সেন্টের হৃৎপিণ্ডটা কে যেন পিষতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত সে বাধ্য হয়ে বিদায় দিল বাতাসীকে। প্রায় দু বছর ঘর করার পর। হ্যাঁ, তাড়িয়েই দিল। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ভেসে গেল বাতাসী ফিরে গেল তার। অভ্যস্ত জীবনে। রূপোপজীবিনীর উপার্জনে জীবনধারণের গ্লানি সহ্য করতে পারল না ভিন্সেন্ট। ছবি তার কেউ কেনে না। বহু চেষ্টা সে করেছে। দোকানে দিয়েছে, বাড়ি বাড়ি ফেরি করেছে, হেদোর ধারে ছবি টাঙিয়ে অপেক্ষা করছে কেউ ফিরে তাকায়নি। দু পাঁচ টাকা দিয়েও কেউ একখানা ছবিও নেয়নি। আর্ট-একজিবিশানের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে লাভ হয়নি। একবারও তার কোন ছবি নির্বাচিত হয়নি। কিন্তু অন্য কোন জীবিকার কথা তার মনে আসেনি। সূরয তাকে চাকরির সন্ধান দিয়েছিল–ও সেখানে চেষ্টাই করেনি। পাশেই আছে এক চানাচুরওয়ালা। মাঝে সে অসুস্থ হয়ে দেশে চলে যায়। ভিন্সেন্টকে বলেছিল আঁকাটা নিয়ে সে ফেরি করতে পারে। ভিন্সেন্ট রাজী হয়নি। আত্মসম্মানে লেগেছে বলে নয়–তার দৃঢ় বিশ্বাস সে ও-সব কাজ করার জন্য পৃথিবীতে আসেনি। সে শিল্পী, সে আর্টিস্ট। আজ পৃথিবী তাকে যতই অসম্মান করুক, একদিন কড়া-ক্রান্তিতে সব শোধ দিতে হবে। আজকের এই উপেক্ষিত, অবহেলিত, অনাহার-ক্লিষ্ট ভিন্সেন্ট হয়তো সেদিন থাকবে না। কিন্তু এ একেবারে ধ্রুব সত্য যে, পৃথিবীকে একদিন নতমস্তকে সলজ্জে স্বীকার করতে হবে–পৃথিবীরই ভুল হয়েছিল, ভিন্সেন্ট ভান গর্গকে সে চিনতে পারেনি। বলতে হবে ভিন্সেন্ট যা সৃষ্টি করে গেছে তা মহত্তম শিল্প! কিন্তু সে কবে? কোন্ অনাগত প্রভাতে?
বাতাসী চলে গেল। আবার নিঃসঙ্গ জীবন। আবার ইকমিক্কুকার! আবার একা!
মাঝে মাঝে পুরনো কথা মনে হয়। ঊর্মিলা এ জীবন সহ্য করতে পারত না। ঊর্মিলা তার জীবনের সঙ্গে নিজেকে জড়ায়নি, ভালই করেছে। কিন্তু চিত্রলেখা? সে কি। ভিন্সেন্টের সঙ্গে এ দুঃখীর জীবন ভাগ করে নিতে পারত না? হয়তো একটু মানসিক শান্তি পেলে, একটু দৈহিক আরাম পেলে ও এতটা ব্যর্থ হত না। বাতাসী ওকে ভাতের থালা, কাঁচা কাপড় আর পাতা বিছানা জুগিয়েছেদু বছর শান্তিতে রেখেছে। তাতেই অনেকটা তৃপ্তি পেয়েছে ভিন্সেন্ট। কিন্তু চিত্রলেখা তাকে আরও কিছু বেশি দিতে পারত। চিত্রলেখার বাবা ছিলেন স্কুল-মাস্টার-সে লেখাপড়া জানা মেয়ে। সে উৎসাহ দিয়ে, সান্ত্বনা দিয়ে হয়তো ওকে গড়ে তুলতে পারত সার্থক শিল্পীরূপে। বাতাসী শিল্পীর মডেল হতে পারে, জীবনসঙ্গিনী হতে পারে না–সে উপাদানে বাতাসীকে গড়েননি সৃষ্টিকর্তা। চিত্রলেখা হয়তো পারত। চিত্রলেখা কখনও এভাবে তাকে ফেলে পালাত না। বাতাসীর মত নেমকহারামের মত।
নেকহারাম? কিন্তু বাতাসী কি সত্যিই অকৃতজ্ঞ? কেন সে পারল না এই নতুন জীবনকে স্বীকার করে নিতে? নিদারুণ দারিদ্র্যই কি তার একমাত্র কারণ? ভিন্সেন্ট যদি দু-চারখানা ছবি বিক্রি করতে পারত–তাহলে কি বাতাসী উপেক্ষা করতে পারত বাড়িউলি-মাসির আকর্ষণ? হয়তো না। উচ্ছলতা তার রক্তের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। আকৈশোর সে পুরুষমানুষের সংস্পর্শে এসেছে প্রায় বিশ বছরের অভ্যাস। রাতারাতি তা কি ত্যাগ করা যায়? আর তাছাড়া?
হ্যাঁ, আরও একটি নিদারুণ হেতু অনস্বীকার্য! ভিন্সেন্ট বাতাসীকে উদ্ধার করেছে, আশ্রয় দিয়েছে। প্রতি মাসে মনি-অর্ডারের টাকা ওর হাতে ফেলে দিয়েছে, হিসাব চায়নি। এক ঘরে রাত্রিবাস করেছে, এক শয্যায় শুয়েছে, অসংখ্য ছবি এঁকেছে। কিন্তু তবু একটা প্রকাণ্ড কিন্তু রয়ে গেছে। বাতাসীর নারীত্বকে সে স্বীকার করে নেয়নি। বাতাসীর চোখে ভিন্সেন্ট এক আত্মভোলা আর্টিস্ট! এক বিচিত্র জীব! পুরুষমানুষ নয়! বাতাসীর চোখে সে-ফাদারদা!
হয়তো এটাই সহ্য হল না উত্তীর্ণ-যৌবনা মেয়েটির। এতে সে অভ্যস্ত নয়। সে হেরে গেছে। নত মস্তকে যে ফিরে গেল সে বাতাসী নয়–অবমানিতা নারীত্ব!
.
১৪.
প্রায় মাসখানেক ধরে চন্দ্রভান । তার অতীত জীবনের কাহিনী শোনালো আমাকে। তিল তিল করে মনের ভার লাঘব করল। আমি ওকে হাওয়া বদল করার পরামর্শ দিলাম। কলকাতার ঐ অন্ধগলির কুঠুরি ঘরে সে মনমরা হয়ে আছে; ও-পাড়ায় তার পরিচিত প্রতিবেশী এমন কেউ নেই যার সঙ্গে বসে ও দুটো মনের কথা বলতে পারে। নূতন পরিবেশে নূতন পরিচয় হতে পারে। আমার একজন পয়সাওয়ালা ক্লায়েন্টের এক খানি বাড়ি ছিল রাঁচিতে। সখ করে বানানো বাড়ি শীতকালে বা পূজার সময় মাঝে-মধ্যে কর্তারা বেড়াতে যান। তাছাড়া তালাবন্ধই পড়ে থাকে বাড়িটা মালির হেপাজতে। ভাড়া দেওয়া হয় না। ভদ্রলোক আমাকে বহুবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তার বাড়িতে কিছুদিন গিয়ে বেড়িয়ে আসার জন্য। ডাক্তারী ছেড়ে একবারও আমার যাওয়া হয়নি। সেই ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেল। তাছাড়া রাঁচিতে আমার এক বন্ধু আছেন, ডক্টর ডেভিডসন–আমার। সহপাঠী; বিলাতী খেতাব নিয়ে এসে রাঁচিতে বসেছেন। ডক্টর ডেভিডসন মনস্তত্ত্বের বিশেষজ্ঞ। সরকারী ব্যবস্থাপনায় ওখানে একটা উন্মাদাশ্রম তৈরী হচ্ছে। ডেভিডসন তার পরিচালক। এঁদের দুজনের সঙ্গে ব্যবস্থা করলাম। বস্তুত ভিন্সেন্টের অসুখের জন্য আমি নিজেকে পরোক্ষভাবে দায়ী করেছিলাম। ভিন্সেন্ট রোগমুক্ত না হলে আমার মনটা শান্ত হবে না। ওর ইতিহাস শুনে সহানুভূতিও জেগেছিল। ভিন্সেন্ট এ প্রস্তাবে রাজী হল। রাঁচির প্রাকৃতিক দৃশ্যও মনোরম। বিহার প্রদেশের শীতকালীন রাজধানী। ভিন্সেন্ট বললে, এবার সে ল্যাণ্ডস্কেপ ধরবে। রঙ-তুলি ক্যানভাস তাকে কিনে দিলাম এবং একদিন রাঁচির গাড়িতে তাকে তুলে দিয়ে এলাম।
রাঁচি পৌঁছে ভিন্সেন্ট চিঠি দিল। জায়গাটা তার পছন্দ হয়েছে। বাড়িটাও। মালি সরযূপ্রসাদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করেছে। মালির বউদি ওকে দুবলো দুটি বেঁধে দেয়। একেবারে ঝাড়া হাত-পা হয়ে ভিন্সেন্ট দিবারাত্র ছবি এঁকে বেড়াচ্ছে। শীত শেষ। রাঁচি বেশ ফাঁকা ফাঁকা। চেঞ্জারদের ভীড় নেই। দু-চারজন প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সবাই অবাঙালী, স্থানীয় লোক। ডক্টর ডেভিডসনের সঙ্গেও দেখা করে এসেছে। অমায়িক ভদ্রলোক। ওকে পরীক্ষা করেছেন, দেখেছেন, বলেছেন মনের আনন্দে ছবি এঁকে যান। শরীর খারাপ বোধ হলেই খবর দেবেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ভিন্সেন্ট লম্বা লম্বা চিঠি লিখত। কখনও খামের ভিতর দু-একটা স্কেচ। আমি ওর উৎসাহটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য মাঝে মাঝে পোেস্টকার্ডে জবাব দিতাম। সূরযের চিঠিও সে নিয়মিত পায় টাকাও আসে যথারীতি।
ভিন্সেন্ট প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যায় তার রঙ-তুলিক্যানভাস নিয়ে। কোন কোনদিন দুপুরে ফেরে না। সন্ধ্যায় এসে মধ্যাহ্ন আহার করে। প্রতিবেশীরা দু-দিনেই চিনে ফেলল এই তসবিরওয়ালা বাবুকে। ওদের বাড়ির মালি সরযূপ্রসাদের দাদাও থাকে এই বাড়ির চৌহদ্দিতে। এবাড়ির আউট-হাউসে। রঘুবীরপ্রসাদ সরকারী চাকুরে। স্থানীয় পোস্টঅফিসের ডাকপিয়ন। ওরা জাতে কাহার। লিখাপড়ি শিখে ডাকপিয়নের কাজ পেয়েছে। দু ভাই এ বাড়ি পাহারা দেয়। রঘুবীর নিজেই ভিন্সেন্টের সঙ্গে আলাপ করে। গেল মনি-অর্ডার দিতে এসে। তারপর কারণে-অকারণে অনেকবার এসেছে। এমনকি ওকে ধরে নিয়ে গেছে নিজের খাপরা-টালির ছাপরায়। চারপাই বার করে বসতে দিয়েছে। রঘুবীরের স্ত্রী একগলা ঘোমটা দিয়ে কখনও এগিয়ে দিয়েছে মোষের দুধের চা, কখনও ঘরে করা লেট্টি। মোটা মোটা রুলি-পরা দুটি হাত সর্বদাই কর্মরত। এই । মেয়েটিই ওর রান্না করে দেয়। ওদের সকলের কাছেই ভিন্সেন্ট একটা বিস্ময়। রঘুবীর, তার স্ত্রী, ছেলে ভগলু ও ভাই সরযূপ্রসাদ অবাক হয়ে দেখত তসবিরবাবুর কাণ্ডকারখানা। আজব মানুষ। সবচেয়ে উৎসাহ ভগলুর। বছর তের-চোদ্দ বয়স। প্রাণ চঞ্চল কিশোর। দিবারাত্র তসবিরবাবুর সঙ্গে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াত। ভিন্সেন্ট যখন রঘুবীরের একখানি তৈলচিত্র আঁকার প্রস্তাব করল তখন রঘুর মুখখানা দেখবার মত। সযত্ন বিন্যস্ত দাড়ি দু ফাঁক করে গালপাট্টার আকারে সাজালো। গায়ে চড়ালো সরকারী কোট, পিতলের তকমা আঁটা সরকারী নীল পগগ চড়াল মাথায়। ছবিখানা দেখে ওরা মুগ্ধ হয়ে গেল। হুহু রঘুবীর! তাই দেখে ভগলুও বায়না ধরল। সেও তসবির আঁকাবে। ভিন্সেন্টও পিছ-পা নয়–আঁকল তাও।
মাস দুয়েক বেশ সুখেই ছিল। আপনমনে ছবি এঁকে বেড়িয়েছে। ইতিমধ্যে একবারও তার মানসিক উত্তেজনা বা অবসাদ কিছু হয়নি। ডেভিডসনের সঙ্গে দেখা করায় তিনি বলেছিলেন-যতদিন কোন অসুবিধা না হচ্ছে ততদিন ও-কথা মনে রাখবেন না, আমার সঙ্গে দেখা করতেও আসবেন না। আপনার বাড়ির চাকরকে বলে রাখবেন, প্রয়োজন বুঝলেই যেন আমাকে খবর দেয়। এখানে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেই আপনার মনে পড়ে যাবে অসুস্থতার কথা। সেটা আপনি ভুলে থাকুন, এটাই আমি চাই।
ভিন্সেন্ট মেনে নিয়েছে সে আদেশ। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ঐ উন্মাদ-আশ্রমটা সে দেখতে চায়নি। ওখানে কারা থাকে, কেমনভাবে থাকে তা দেখার জন্য কৌতূহল ছিল ভয়ও ছিল। ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মত সেসব কথা সে ভুলে থাকতে চেয়েছে।
বেশ চলছিল, হঠাৎ ভিন্সেন্ট লিখল এক বিচিত্র সংবাদ। লিখেছে–গগনকে মনে আছে নিশ্চয়? গগন পাল। ম্যাট্রিক ফেল করে সেই তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি। তুই শুনলে অবাক হয়ে যাবি, সেও সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে ছবি আঁকা ধরেছে। ঠিক আমারই মতন। তার অবস্থা নাকি আমার চেয়েও খারাপ। আমার তবু সূরয আছে। তার কেউ নেই। বর্তমানে কপর্দকশূন্য। নিতান্ত ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে সূরযের দেখা হয়ে যায় একদিন ট্রেনে। বিনা টিকিটে যাচ্ছিল বলে ওকে রেলপুলিসে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। সূরয চিনতে পেরে ওকে উদ্ধার করেছে। গগন দিল্লীতে আছে।
খবরটা পেয়ে আমি বিচলিত বোধ করি। গগনের ইতিহাসটা ভিন্সেন্টকে বলা হয়নি। ইচ্ছা করেই বলিনি। স্থির করলাম সূরযভানকে চিঠি লিখে সাবধান করে দিতে হবে। কিন্তু তার আগেই এল ভিন্সেন্টের দ্বিতীয় পত্র। সূরয নাকি তার দাদাকে লিখেছে সে গগনকে টিকিট কেটে ট্রেনে তুলে দেবে। গগনও আপাতত রাঁচিতে এসে থাকবে। আমার বন্ধুর নিশ্চয় এতে আপত্তি হবে না। ওরা দুজনে মিলে এবার ছবি আঁকবে। সূরযের ইতিমধ্যে পদোন্নতি হয়েছে–সে ওর মাসোহারাটাও বাড়িয়ে দিতে রাজী।
আমার বন্ধুর আপত্তি হওয়ার কথা নয়। আপত্তি ছিল আমার নিজেরই। গগন আর ভিন্সেন্ট দুটোই পাগল–শেষে দু বন্ধু না খুনোখুনি করে বসে! কী জবাব দেব স্থির করে ওঠার আগেই এল ভিন্সেন্টের তৃতীয় পত্র–গগন আগামী বুধবারে আসছে। আমার বন্ধুর যে আপত্তি নেই–আমার নীরবতা থেকেই সেটা ওরা অনুমান করেছে।
ওদের রাঁচিবাসের জীবনকথা পরে বিস্তারিত শোনার অবকাশ হয়েছিল।
ভিন্সেন্ট মালিকে বলে, সর, আমার এক বন্ধু পরশু আসবেন, বুঝেছ। সেও ছবি আঁকে। খুব সুন্দর ছবি আঁকে। এবার থেকে আমারা দুজনে মিলে ছবি আঁকব।
আপসে ভি আচ্ছা ক্যা? সরযূপ্রসাদ একটা তুলনামূলক প্রশ্ন করে বসে।
ভিন্সেন্ট জবাবে বলে, –তা আমি জানি না। তোমরা দেখে বল, কে ভাল আঁকে।
একদিন ওর ছবি আঁকা বন্ধ রইল। জনে জনে সে শুনিয়ে এল গগন পালের আসন্ন। আগমনবার্তা। রঘুবীর, ভগলু, এক্কাওয়ালা মকবুল আলি, চায়ের দোকানদার ভীমাকে। প্রতিবেশীরাও ওর মত অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকে কখন এসে পড়ে দুনম্বর তসবিরবাবু।
অবশেষে গগন এসে উপস্থিত হল। সে তো আগমন নয়, সে যে আবির্ভাব। ভিন্সেন্ট মালিকে দিয়ে ও-ঘর থেকে একটা চৌকি এ-ঘরে আনিয়ে রেখেছিল। মালির হেপাজতে বিছানা বালিশ চাদর সবই আছে, পরিপাটি করে ভিন্সেন্ট একটি বিছানা পেতে রাখল। বাগান থেকে ফুল তুলে এনে কসার গ্লাসে সাজিয়ে রাখল গগনের বিছানার । পাশে। নিজের ছবিগুলি টাঙিয়ে রাখল ঘরের চারদিকের দেওয়ালে। সিঙারণ নদীর সাঁকো, জোড়-জাঙালের গির্জা, আলুর ভোজ, বাতাসীর ন্যুড-স্টাডি, রঘুবীরপ্রসাদের সাম্প্রতিক আঁকা পোর্ট্রেট। বন্ধুবরণের সব আয়োজন সেরে স্টেশনে গেল বন্ধুকে আনতে।
স্টেশন প্লাটফর্মে দুই শিল্পী বন্ধুর মিলনদৃশ্যটা মনে রাখবার মত। ভিন্সেন্ট ওকে মাথায় তুলে নিয়ে নাচতে বাকি রাখল। গগনের তোরঙ্গ, আর প্যাকিংকেসে বাঁধা ছবির বাণ্ডিল কুলির মাথায় দিয়ে প্লাটফর্মের বাইরে এল। টাঙায় করে বন্ধুকে নিয়ে এল বাসায়।
গগন কিন্তু ভিন্সেন্টের ব্যবস্থাপনায় খুশি হল না। বললে, অতগুলো ঘর তালা বন্ধ রেখে এমন গুঁতোগুতি করে থাকার কী দরকার বাওয়া? শুধু মুধু আত্মাকে কষ্ট দেওয়া!
ভিন্সেন্ট বলে, দুজনে একঘরে থাকলে গল্পগুজব করা যাবে– বাধা দিয়ে গগন বলে, ঝাঁট দে ওসব ছেঁদো কথা! তামাম রাত তোর বক্কানি কে শুনবে? মেয়েছেলে না হলে একঘরে কারও সঙ্গে শুতে পারি না আমি!
বোঝা গেল গগন ফাঁকা থাকতেই ভালবাসে। কিন্তু একটু মর্মাহত হয় ভিন্সেন্ট; কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, -এক হিসাবে কথাটা অবশ্য ঠিক। এ-ঘরের দেওয়াল তো আমার ছবিতেই ভরে গেছে। তোর ছবি টাঙানোর জন্য আরও ওয়ালস্পেস চাই।
গগন বলে, –সেজন্য নয়। আমি দেওয়ালে আদৌ ছবি টাঙাব না। আসলে একটু নিরালা না হলে আমি ঠিক জুত পাই না।
অগত্যা মালী আর ভিন্সেন্ট ধরাধরি করে বিছানাটা ও-ঘরে নিয়ে যায়।
গগন যে ওর আঁকা ছবিগুলো দেখতে মোটেই কৌতূহলী হয়নি এটা নজর এড়ায়নি ভিন্সেন্টের। কিন্তু এ নিয়ে সে কিছু বলে না। রাতে খেতে বসে গগন বললে, বাঁধে কে? তুই?
না, মালিক বউদি।
কই, তাকে তো দেখলাম না?
–আছে কোথাও। তুই নতুন লোক বলে লজ্জা পাচ্ছে হয় তো!
–ও বাবা! লজ্জাবতী লতা নাকি? তোর ঘরে একটা ন্যুড স্টাডি দেখলাম। সেটা
কি ঐ মালির বৌদির?
–দূর! তোর মাথা খারাপ! অমন ছবি কি কারও বউ কখনও আঁকাতে পারে?
–পারে না বুঝি? তবে কার?
ও অন্য একটা মেয়ে। নাম বাতাসী।
সাঁওতাল মেয়ে?
–হ্যাঁ। ওর কথা বলব তোকে।
ভিন্সেন্টের হাতের কাজের দিকে কৌতূহল না থাকলেও তার অতীত জীবনের বিষয়ে খুব আগ্রহ দেখালো গগন। ভিন্সেন্ট স্কুল ছাড়ার পর তার জীবনের সমস্ত ঘটনা বলে যায়। গগন ধৈর্য ধরে শোনে। কাহিনী শেষ হতে হো-হো করে হেসে ওঠে সে।
-কি হল রে? অমন করে হাসছিস কেন?
গগন হাত দুটি জোড় করে বলে, ফাদার চন্দ্রভান! তুমি হয় ঋষ্যশৃঙ্গ মুনি, নয় হিজড়ে, আর নয় ফাদারদা, নয় ফাদার বৌঠান! কোষ্টা তুমি?
ভিন্সেন্ট হাসতে হাসতে বলে, –এ কথার মানে?
–শালা, তোর জীবনে তিন-তিনটে ডবকা হুঁড়ি এল। আর আজ ছত্রিশ বছর বয়েসেও তুই ভার্জিন! তুই শালা নমস্য ব্যক্তি। পায়ের ধুলো দাও বৌঠান!
সত্যিই ওর পায়ের ধুলো নিতে যায়। ভিন্সেন্ট হাসতে থাকে।
কিন্তু এই রসিকতাই ওর কাল হল!
ওরা দুজনেই শিল্পী; একই পথের পথিক। কিন্তু দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমান-জমিন ফারাক। যে-কোন বিষয়বস্তু নিয়েই ওরা আলোচনা শুরু করুক, শেষ-মেশ এসে থামে চিত্রশিল্পে। আর তখনই হয় মতান্তর। মতান্তর থেকে মনান্তর। রীতিমত বচসা শুরু হয়ে যায়। আর মজা হচ্ছে এই, গগন তখনই নৈর্ব্যক্তিক আর্টবচার থেকে নেমে আসে ভিন্সেন্টের ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গে। ঠাট্টা-তামাসা শুরু করে দেয়। ওকে ক্ষেপায়। ভিন্সেন্ট যখন আগুন হয়ে আস্তিন গোটায় গগন হেসে ওঠে। বলে, থাক বৌঠান! আমি হার মানছি!
উত্তেজনায় ভিন্সেন্টের মুখটা থমথম করে। ভূ দুটি কুঁচকে ওঠে। বলে, –বৌঠান মানে?
–তুমি তো পুরুষমানুষ নও বাবা চন্দ্রভান! ঊর্মিলাকে তুমি কাব্যে উপোসী করে রাখলে, চ্যারা দিদিমণি মাঝরাতে তোমার ঘরে জ্বালা জুড়াতে এল, তুমি তাকে বাসিমুখে তাড়িয়ে দিলে; মায় বাতাসী পাক্কা দু বছর তোমার বিছানায়
তুই পাষণ্ড! তোর মুখ অত্যন্ত অশ্লীল!
গগন হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ বৌঠান! আমার মুখটাই অশ্লীল কিন্তু ছবিগুলো তোমার মত অশ্লীল নয়!
–আমার ছবি অশ্লীল! কোন্ ছবি?
সবগুলোই। আলুর ভোজ একখানা অশ্লীল ছবি! মানুষগুলো বাঁদরের মত– গোগ্রাসে খাচ্ছে বেবুনের মত। ও কি একটা আঁকবার মত বিষয়বস্তু? সর্ডিড অ্যাণ্ড ভালগার!
-তুই কিছুই বুঝিস না! তোকে দেখানোই ভুল হয়েছে আমার—
গগন সেকথায় কর্ণপাত না করে একনাগাড়ে বলে যায়, বাতাসীর ন্যুড-স্টাডি আর একখানা অশ্লীল ছবি! জয়টাকের মত অতবড় পেট যার, তার ন্যুড-স্টাডি ভদ্দরলোকে আঁকে–
-তোর মাথায় গোর পোরা! ও ছবির মর্ম তুই কি বুঝবি? তুই একটা ক্যাডাভেরাস!
–দেখ চন্দ্রভান! গালাগাল দিয়ে লাভ নেই! সত্যি করে বল্ তো, তুই কোন্ প্রেরণায় ঐ ছবিখানা এঁকেছিলি? ঐ ন্যুডখানা?
–সে তুই বুঝবি না। ফিমেল ফিগার বলতে তোদের ধারণা সেই কালিদাসের মধ্যে ক্ষমা চকিত-হরিণী প্রেক্ষণা। রিয়ালিমকে তোরা সহ্য করতে পারিস না। মাতৃত্বের ভারে স্ত্রীলোকের জীবনে এমন পর্যায় আসে যখন মধ্যে ক্ষামা থাকা তার পক্ষে সম্ভবপর নয়; আর সেটাই তার জীবনের সার্থকতা! সেই মাতৃত্বের পরিপূর্ণ নগ্ন স্বরূপ কেউ কখনও আঁকতে সাহস পায়নি। আমি এঁকেছি! এ ছবির সৌন্দর্য দেখবার অন্য চোখ চাই
গগন বলে, –আমরা দৈনিক যা আহার করি, তার একটা বিরাট অংশ দেহকে ত্যাগ করতে হয়। সেটাও জীবনের একটা আবশ্যিক পর্যায়। যেহেতু সেটা, সত্য, তাই সে দৃশ্যও আর্টের বিষয়বস্তু হবে বোধকরি, তোর ধারণায়?
না, হবে না! কেন হবে না, তা বুঝতে হলে আর্ট কি তাই জানতে হবে। ধর একগুচ্ছ আঙুর—
–ধরব না। একগুচ্ছ আঙুর কেউ ধরতে বললে আমি সেটা মুখে পুরব প্রথমেই।
জানি! সেজন্যই বলি তুই শিল্পী নস–তুই পাষণ্ড!
-আমিও জানি। তুই ঐ আঙুরগুচ্ছের স্বাদ জিহ্বায় নিতে সাহস পাবি না। দূর থেকে সেটার স্টিল-লাইফ স্টাডি করবি। কিন্তু কিছুই হবে না। আঙুরের স্বাদ যে পায়নি, সে কোনদিন আঙুরের ঢলঢল তলিত আভা–যাকে বলে আঙুরের লাবণ্যযোজনা তা আঁকতে পারবে না!
আমি মানি না! চটকে ঘেঁতো না করলে আঙুরগুচ্ছের ছবি আঁকা যায় না, এ কোন কাজের কথাই নয়!
–তোমার কাছে আঙুর ফল টকই থেকে যাবে বৌঠান। ও তোর ছবিতে ফুটবে না। আবার বৌঠান! এই ডাকটাই ভিন্সেন্টের মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয়।
ভিন্সেন্টের ছবি আঁকা বন্ধ হয়ে গেল। মন দিতে পারে না। দিবারাত্র শুধু তর্কই করে চলে। গগনকে কোনও দিক থেকে আক্রমণ করতে পারে না। গগন তার প্যাকিং-কেস খোলেনি। তার আঁকা ছবি দেখায়নি ভিন্সেন্টকে। বন্ধুর সনির্বন্ধ অনুরোধ বারে বারে উপেক্ষা করে বলেছে-তার ছবি সে কাউকে দেখাবে না। গগনের ছবি বুঝবার মত মানুষ নাকি এখনও এ দুনিয়ায় জন্মায়নি। তার ছবি দেখানো হবে পঞ্চাশ বছর পরে। ততদিনে মানুষ ক্রমোন্নতি করে শিল্পীর সমতলে আসতে শিখবে! ভিন্সেন্ট রাগে ফুঁসতে থাকে। গগনের ছবি দেখে কোন সমালোচনা করবার অধিকারই পেল না ভিন্সেন্ট। তাছাড়া নিজের অতীত জীবন সম্বন্ধেও গগন অদ্ভুতভাবে নীরব। এতদিন কোথায় ছিল, কি করেছে কিছুই সে বন্ধুকে জানায়নি। সেদিক থেকে পাল্টা আক্রমণের সুযোগ ভিন্সেন্ট পেল না!
মোটকথা ভিন্সেন্টের স্বপ্ন সার্থক হল না। দু বন্ধু একসঙ্গে ছবি আঁকতে বসল না একদিনও। তারা একসঙ্গে বেড়ায়, ঘোরে, খায়-দায় আর দিবারাত্র তর্ক করে।..
শেষে একদিন ঘটনাচক্রে গগন একটু মুখ খুলল। অতীত জীবনের কিছুটা আভাস দিয়ে ফেলল অসতর্কভাবে। কাহিনীটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল চন্দ্রভান। ঘটনাটা ঘটল একটা চায়ের দোকানে। দু বন্ধু সন্ধ্যার দিকে রোজই বেড়াতে যায়। সেদিনও গিয়েছিল স্টেশনের দিকে। হঠাৎ কি খেয়াল হল দুজনে ঢুকল একটা চায়ের দোকানে। দু পেয়ালা চায়ের অর্ডার দিয়ে জমিয়ে বসল কাঠের বেঞ্চিতে এবং তৎক্ষণাৎ অসমাপ্ত তর্কের বিষয়বস্তুতে ডুবে গেল। ভিন্সেন্ট বলে, রিয়ালিস্ম্ বলতে তুই যা বুঝছিস আমি তা বুঝছি না। রিয়ালিস্ম্ শিল্পীর সামনে একটা জগদ্দল পাহাড় নয়! রিয়ালিস মানে এ নয় যে, দুনিয়ার বাস্তবে যা আছে বা যা দেখছি তাই এঁকে যাওয়া। অনেক সময় এমন হয় যে, যা দেখছি তা অস্বাভাবিক, মানে আমার আর্টের বিষয়বস্তুর পক্ষে সেটা অবাস্তব, অবাঞ্ছনীয়! শিল্পীর অধিকার আছে সেটা অস্বীকার করার! বদলে দেবার!
–যেমন? একটা উদাহরণ দে?
ধর তুই একটা সুন্দর সূর্যোদয়ের ল্যাণ্ডস্কেপ আঁকছিস। তোর মূল লক্ষ্য হচ্ছে অরুণোদয়ে পৃথিবী কেমন করে অন্ধকারের বুক থেকে জেগে উঠছে তাই ফুটিয়ে তোলা। তোর রঙ আর রেখা রামকেলী অথবা ভৈরোঁয় বাঁধা। এখন বাস্তবে তোর চোখে পড়ল সামনে দিয়ে চারজন শববাহী একটা মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যেহেতু ঐ খণ্ডদৃশ্যটা তোর বিষয়বস্তুর সঙ্গে একসুরে বাঁধা নয়–তুই অনায়াসে ঐ মৃতদেহবাহীদের অস্বীকার করতে পারিস। শিল্পী হিসাবে তোর অধিকার আছে ওটাকে উপেক্ষা করে ল্যাণ্ডস্কেপ আঁকার।
গগন দৃঢ় প্রতিবাদ করে। বলে, ঝাঁট দে ওসব ছেঁদো কথা! তাহলে ওটাকে ল্যাণ্ডস্কেপ বলা যাবে না আদৌ! তোরা মনে করিস চিত্রের জগৎ বুঝি সঙ্গীতের রাগ রাগিণীর ফর্মুলায় বাঁধা! সকালবেলা দরবারী কানাড়া অচল, মধ্যরাত্রে ভৈরো ধরলে ওস্তাদকে পিটিয়ে ছাতু করতে হবে! এ দুনিয়াটা অমন মনুসংহিতার বিধান মেনে চলে না। এখানে: ঊষালগ্নেও মানুষ মরে–সেটা বাস্তব! আর ঐ বাস্তবকে অস্বীকার করা মানে তুই একটা কল্পিত ইউটোপিয়ায় উটপাখির মত মুখ লুকোতে চাইছিস!
–তুই আমার কথাটা বুঝতে পারছিস না। দুনিয়া যে মিশ্ররাগিণীতে বাঁধা এ তো আমি অস্বীকার করছি না; কিন্তু আর্টিস্ট হিসাবে আমি তো একটা কিছু বলতে চাই। যা বলতে চাই তার সঙ্গে সুর না মিললে আমি বাস্তবকে অতিক্রম করতে পারব না কেন? ধর আমার আলুর ভোজ! সেদিন তুই বললি–মালকাটার দল বেবুনের মত গোগ্রাসে খাচ্ছে! ওদের প্রচণ্ড ক্ষুধার দৃশ্যই আমি আঁকতে চেয়েছি–তাই ওদের বাস্তবতাকে আমি অস্বীকার করিনি; কিন্তু আমার ছবির সুরের সঙ্গে যদি বাস্তব না মেলে–তাহলে আলবৎ আমি কল্পনার আশ্রয় নেব। আমার কল্পনাই সে ক্ষেত্রে হবে বাস্তব!
আর একটা উদাহরণ দে!
ধর ঐ ক্যালেণ্ডারের ছবিটা! শিল্পী বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ওটাতে কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। যা দেখেছেন তাই যদি আঁকতেন তাহলে মেয়েটির কপালে সিঁদুরের টিপ থাকার কথা নয়। ও সদ্যঃস্নাতা। মেয়েটি ভিজে কাপড় ছাড়েনি, ফলে স্নানের পরে ও প্রসাধন করেনি। তাহলে ওর কপালে সিঁদুরের টিপ থাকতে পারে না। তবু শিল্পী টিপটা এঁকেছেন, এবং সেটা তথাকথিতভাবে অবাস্তব হলেও সার্থক। কারণ, শিল্পীর কল্পনায় অবগাহন-স্নানান্তে ঐ পূজারিণীর মালিন্যটুকুই ধুয়ে গেছে, মাঙ্গলিক চিহ্নটুকু ধুয়ে যায়নি!
গগন নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে দেখতে থাকে দোকানের ও-প্রান্তে টাঙানো একখানা ক্যালেণ্ডার। অনেকদিন পরে ছবিটা দেখল আবার। বটুকেশ্বর দেবনাথের পূজারিণী যে ক্যালেণ্ডাররূপে রাঁচির অখ্যাত চায়ের দোকানে স্থান পেতে পারে এটা তার বিশ্বাস। হচ্ছিল না। গগন ঐ সদ্যঃস্নাতা বিকশিত-যৌবনার মূর্তির ভিতর সুলেখাকে খোঁজবার চেষ্টা করে। মুখখানা বটুক অন্যরকম করে এঁকেছিল–তাই সুলেখাকে চেনা যাচ্ছে না।
কি হল? কথা বলছিস না যে? ভিন্সেন্ট তাগাদা দেয়।
গগন বলে, ছবিটা কার আঁকা জানিস?
না। তুই জানিস?
–হ্যাঁ। ওটা বটুকেশ্বরের আঁকা। ছবিটা বটুকের বউয়ের।
এবার ভিন্সেন্ট এগিয়ে যায়। ছবিটাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখে। ফিরে এসে বেঞ্চিতে বসে বলে, একটু ফটোগ্রাফিক হয়েছে, তা হোক। মেয়েটির চরিত্রটা ঠিকমত ফুটিয়েছে বটুক।
গগন ব্যঙ্গভরা একচিলতে হাসে। বলে, -মেয়েটির চরিত্রের কোন দিক?
–ছবিটা দেখলেই মনে হয় মেয়েটির মন নরম, সে সুখী, সে খাঁটি হিন্দুর মেয়ে, পূজা-আর্চা ভালবাসে।
গগন বলে, –তবেই দেখ! আমি যা বলতে চাইছি তাই প্রতিপন্ন হল! এখানে শিল্পী তাঁর পূর্বনির্ধারিত একটি ফর্মুলায় মেয়েটিকে বেঁধে ফেলেছেন। মেয়েটির আসল চরিত্র মোটেই উদ্ঘাটন করতে পারেননি নিজের কল্পনার বোঝ ওর ঘাড়ে চাপিয়ে ওর চরিত্রটাকেই বিকৃত করে দিয়েছেন। আমার মতে তাই এ ছবি–অশ্লীল!
আর একটু বুঝিয়ে বলবি?
বলব। ঐ মেয়েটি, মানে বটুকের বউয়ের মন আদৌ নরম নয়, সে মোটেই সুখী ছিল না, হিন্দুর দেবদেবীতে তার তিলমাত্র বিশ্বাস ছিল না। অতৃপ্ত কামনা বাসনা নিয়ে সে নিজের অন্তর্জালায় গুমরে মরছিল। কিন্তু যেহেতু শিল্পী একটি ভজন গাইতে বসেছেন তাই সেই বাস্তবতাকে উনি অস্বীকার করেছেনউঠপাখির মত বালিতে মুখ লুকিয়েছেন!
বাধা দিয়ে ভিন্সেন্ট বলে, –তুই এত কথা কি করে জানলি?
-যেহেতু ঐ বৌটির সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন রাত্রিবাস করেছি।
ভিন্সেন্ট স্তম্ভিত।
বিশ্বাস হল না? তাহলে বলি শোন
গগন তারপর বটুক সুলেখার উপাখ্যান শোনাতে থাকে।
আদ্যন্ত কাহিনীটা শুনে ভিন্সেন্ট বললে, তুই একটা স্কাউড্রেল। পাষণ্ড!
গগন হে-হে হাসি হাসে।
ফেরার পথে ভিন্সেন্ট একটা কথাও বলে না। তার মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা যন্ত্রণাবোধ হচ্ছে। বটুকেশ্বরকে সে স্কুলজীবনের পর আর দেখেনি; তার স্ত্রী সুলেখা দেবনাথকে সে চেনে না–তবু গগন যে-ভাবে ওর বন্ধুর সুখের সংসারটা ছারখার করে দিয়ে এল তাতে গগনের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখাই এখন কঠিন হয়ে পড়বে মনে হচ্ছে। আচ্ছা, এসব কথা দীপু তো ঘুণাক্ষরেও বলেনি! গগন বা বটুকের কথাও উঠেছে কথা প্রসঙ্গে দীপু এড়িয়ে গেছে। কেন?
গগন পাশে পাশে চলছিল। বললে, তুই আমার ওপর রাগ করেছিস না রে?
ভিন্সেন্ট জবাব দেয় না।
গগন আবার হেসে ওঠে। বলে, আরে ঝট দে! ঘাবড়াচ্ছিস কেন? তোর তো আর বউ নেই? ঊর্মিলাচ্যারা বাতাসীরা কেউ এখানে থাকলে না হয়–
–প্লীজ গগন! চুপ কর!
গগনকে যেন আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সত্যিই যদি ভিন্সেন্ট এখানে সস্ত্রীক বসবাস করত তাহলে কি গগন তার সংসারেও আগুন ধরিয়ে দিত? ঊর্মিলা কিংবা চিত্রলেখা–
মাথার মধ্যে ঝিম ঝিম করে ওঠে ওর।
এর পর দুদিন ভিন্সেন্ট আর গগনের সঙ্গে বেড়াতে যায়নি। অনেকিদন পরে রঙ তুলি বার করে সে আঁকতে বার হল। স্থির করল, গগনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাটা কমিয়ে দিতে হবে। গগন একলা থাকতে ভালবাসে। তাই থাকুক। গগনও আপত্তি করল না। ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে সেও ছবি আঁকতে বসল।
ভিন্সেন্ট বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে একদিন আঁকতে বসেছে। সামনে ঢালু উপত্যকা। ও-পাশে নীলচে-সবুজ পাহাড়ের রেখা। একটা সপ্তপর্ণী গাছের ছায়ায় সে ঈজেলটাকে বসিয়ে একমনে আঁকছে। পাশ দিয়ে রাঙা মাটির একটা রাস্তা চলে গেছে। সাচির দিকে। তাতে সারি সারি গো-গাড়ি চলেছে। তৈল-তৃষিত গো-যান চক্রের আর্তনাদ আর কয়েকটি ঘুঘুর ঝিমন্ত কৃজন ছাড়া চরাচর স্তব্ধ। হঠাৎ একটি হুড-খোলা মোটরগাড়ি ওর থেকে কিছুটা দূরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। ভিন্সেন্টের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে গেল সে-শব্দে। ঘাড় ঘুরিয়ে ও দেখে একটি মেমসাহেব বসে আছেন গাড়িতে। তিনিই চালাচ্ছিলেন। তাঁর পাশে একজন সাহেব। পিছনের আসনে দুটি বাচ্চা। সাহেব নেমে আসেন গাড়ি থেকে। বলেন, হ্যালো মিস্টার গর্গ! কেমন আছেন? কী আঁকছেন দেখি?
এগিয়ে আসেন তিনি।
ভিন্সেন্ট প্রত্যভিবাদন করতে ভুলে যায়। সে স্তব্ধ-বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছিল মেমসাহেবটিকে। টক্টকে ফর্সা রঙ-মেমসাহেবদের যেমন হয়। মাথায় নীল রঙের টুপি, ফিতে দিয়ে চিবুকের সঙ্গে আটকানো। সোনালী চুলের গুচ্ছ কপালের উপর জটলা করছে। দু চোখে কৌতুক উপছে পড়ছে। বয়স প্রায় ভিন্সেন্টের মতই। তবু চিনতে অসুবিধা হল না তার।
মিসেস ডেভিডসন! আমার স্ত্রী! আপনার সঙ্গে আলাপ হয়নি। ইনি মিস্টার ভিন্সেন্ট ভান গর্গ!
মিসেস ডেভিডসন গাড়ি থেকে নেমে এসে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ডিলাইটেড টু মিট য়ু মিস্টার গর্গ। কিন্তু আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
ভিন্সেন্ট তখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি। ঊর্মিলা কি সত্যিই ওকে চিনতে পারছে না, কি এও ওর একটা চাল? কিন্তু কী সুন্দর দেখতে হয়েছে ঊর্মিলাকে! কোথায় সেই কিশোরী ঊর্মিলা, আর কোথায় এই পূর্ণযৌবনা মিসেস ডেভিডসন!
আপনি কি বাওয়ালী গ্রামে ফাদার শারদাঁর কাছে কখনও এসেছিলেন? ঠিক ঐ । রকম বড় বড় খরগোশের মত কান
ডক্টর ডেভিডসন একটু অপ্রস্তুত। সদ্য-পরিচিত কোন ভদ্রলোকের দৈহিক বিকৃতি নিয়ে তাঁর স্ত্রী যে এমন অশালীন উক্তি করে বসতে পারেন, এটা যেন ধারণা ছিল না তাঁর।
ভিন্সেন্ট মুহূর্তে মনস্থির করে। প্রগম্ভ ঊর্মিলা ওকে নিয়ে রসিকতা করছে! ভুল করেছিল ভিন্সেন্ট, এটা সে স্বীকার করছে। ঐ মেয়েটিকে প্রেম নিবেদন করে সে ভুল করেছিল। কিন্তু তার ভালবাসায় তো কোন খাদ ছিল না। উপেক্ষ্য সহ্য হয়, কিন্তু তার, সঙ্গে অপমানের কৌতুক যোগ করার কি প্রয়োজন? গম্ভীর হয়ে বলে, আপনি বোধহয় অন্য কারও সঙ্গে আমায় ভুল করেছেন। বাওয়ালী গ্রামের ফাদার শারদাঁকে আমি চিনি না।
ফাদার শারদাঁ না হলেও অন্তত রেভ. হেনরি চার্ডিনকে নিশ্চয় চেনেন?
ভিন্সেন্ট এবার ঊর্মিলাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ডক্টর ডেভিডসনকে বলে, –এদিকে কোথায় যাচ্ছিলেন?
ছুটির দিনে পিকনিক করতে বেরিয়েছি। কোন নির্জন জায়গায় বসে দুপুরটা কাটাব। সঙ্গে গ্রামাফোন আছে, খাবার আছে।
মিসেস ডেভিডসন বলেন, –আপনিও আসুন না মিস্টার গর্গ! ছবি আঁকা তো রোজই আছে। আজ পিকনিক করে যান বরং। আপনাকে দেখে আমার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
ডক্টর বলেন, আসবেন? মন্দ মজা হয় না তাহলে—
ভিন্সেন্ট দোটানার মধ্যে পড়ে যায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না ঊর্মিলা ওকে নিয়ে মজা করতেই এ প্রস্তাবটা করছে। সে শুধু ভিন্সেন্টকে নিয়ে কৌতুক করতে চায়, খেলা করতে চায়। কিন্তু ভিন্সেন্ট? দীর্ঘদিন পরে ঊর্মিলাকে দেখে ওর কী ভাল যে লাগছে! ওকে এখনই দৃষ্টির আড়ালে সরে যেতে দিতে মন সরে না। বলে, -পুরানো কথা মানে?
মিসেস ডেভিডসন তার স্বামীর দিকে ফিরে বলেন, তোমাকে বলেছি কিনা ঠিক মনে নেই। বাওয়ালীতে আমি একবার কালল্যাভে পড়েছিলাম। ছেলেটিকে দেখতে অনেকটা আপনার মত মিস্টার গর্গ। অন্তত তার কান দুটো!
ডক্টর ডেভিডসন হো-হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, তুমি এসব কথা আমাকে কোনও দিনই বলনি! কিন্তু এভাবে মিস্টার গর্গকে বিব্রত করা কি তোমার ঠিক হচ্ছে?
–আপনি কি বিব্রত বোধ করেছেন মিস্টার গর্গ?
ভিন্সেন্ট মাথা নেড়ে বলে, –মোটেই না! আমার বরং হিংসে হচ্ছে। আমি নিজেই কেন সেই ছেলেটি হলাম না!
ডক্টর আবার দিলখোলা হাসি হাসেন। বলেন, ঠিক মুখের মত জবাব হয়েছে।
ঊর্মিলাও হাসতে হাসতে বলে, –তা হলেই বা কী লাভ হত? আপনিও নিশ্চয় তার মত পালিয়ে যেতেন!
-তোমার বুল কাফ কি তোমার গুঁতো খেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন নাকি?–প্রশ্ন করেন ডক্টর।
-হ্যাঁ! প্রণয় উপহার দেবার ভয়ে!
ভিন্সেন্ট গম্ভীর হয়ে বলে, কী উপহার চেয়েছিলেন আপনি?
–বিশেষ কিছু নয়! তার খরগোশের মত কান দুটো!
অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন ডেভিডসন, –ও য়ু নটি গার্ল!
ভিন্সেন্টের কর্ণমূল লাল হয়ে ওঠে। সে জবাব দিতে পারে না!
ডক্টর ডেভিডসনের সনির্বন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা করল শেষ পর্যন্ত। সে পিকনিক যেতে রাজী হল না। ছবিটা আজই শেষ করতে হবে তাকে। মিসেস ডেভিডসন ওকে বারে বারে নিমন্ত্রণ করে গেলেন। বললেন, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি, মিস্টার গর্গ! কিন্তু আপনাকে দেখলে আমার সেই হারানো-প্রেমের আনন্দ ফিরে পাব। আসবেন কিন্তু!
ভিন্সেন্ট বললে, -নেহাৎ যদি না যেতে পারি আমার প্রেসেন্ট আপনাকে পাঠিয়ে দেব!
–প্রেসেন্ট? ছবি?
না! আমার কান দুটো! সে দুটোর উপরেই তো আপনার লোভ!
হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন সস্ত্রীক ডক্টর ডেভিডসন।
ভিন্সেন্ট ওঁদের সঙ্গে বনভোজনের আনন্দ ভাগ করে নিতে পারেনি। নিরলস নিষ্ঠায় সে সারাদিন ধরে ল্যাণ্ডস্পেকখানা শেষ করল। তারপর সন্ধ্যাবেলা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দেখে সারা দিনমান সে পণ্ডশ্রম করেছে। রাঁচির নিসর্গ চিত্র মোটেই আঁকেনি। নিজের অজান্তে সে এঁকে গেছে কী, তা সে নিজেই জানে না। কিছুটা লাল, কিছুটা সবুজ, কিছুটা কালোর প্রলেপ। সম্পূর্ণ বিমূর্ত চিত্র! তার অর্থ বোধকরি স্বয়ং শিল্পীরও বোধের অতীত। যেন শিল্পীর অবদমিত অবচেতন মনের কতকগুলো রক্তের মত জমাট উলঙ্গ বাসনা কামনা তুলির মুখে বেরিয়ে এসে ক্যানভাসটাকে কলঙ্কিত করেছে। হালকা তুলির স্পর্শ নয়, সে যেন স্যাব-হেয়ার ব্রাশটাকে শংকর মাছের চাবুকের মত ব্যবহার করেছে। সারাদিন। ক্যানভাসের পিঠ সেই চাবুকের আনিতেই চিত্রের উপর ফুটে উঠেছে রক্তের মত রাঙা রেখা! যা বলতে চেয়েছে, যা আঁকতে চেয়েছে তা বলা হয়নি, আঁকা হয়নি। বরং যা বলতে চায় না, লুকাতে চায় তাই বলে বসে আছে!
ক্যানভাসটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রিক্তহাতে ফিরে এসেছিল ভিন্সেন্ট।
সমস্ত রাত ওর ঘুম হল না। যন্ত্রণায় বিছানায় সে শুধু এপাশ-ওপাশ করল।
পরদিন সমস্ত দিন সে স্বেচ্ছাবন্দীর মত পড়ে রইল ঘরে। গগন ওর খবর নিল না। সে যে পাশের ঘরে আছে তা বোঝা যায় খুট খুট শব্দে। দিনভর কিছু খায়ওনি। বাড়া ভাত পড়ে আছে টেবিলের উপর। জানালা দিয়ে চড়ুই পাখি এসে খুঁটেছে, ছিটিয়েছে। ভিন্সেন্টের মাথার মধ্যে আবার সেই যন্ত্রণাটা শুরু হয়েছে।
সেরাত্রে একটা ঘুম এসেছিল ওর। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল বাঁশীর শব্দে। পাশের ঘরে গগন একলা বসে আড়বাঁশী বাজাচ্ছে। ফিনকি দিয়ে জ্যোৎস্না ফুটেছে বাইরে। স্তব্ধ রাত্রে সেই বাঁশীর মীড়-গমক যেন কোন অতীন্দ্রিয় লোকে যাত্রা করেছে। অপার্থিব কোন সুরলোকের একটা অব্যক্ত মূৰ্ছনা যেন পাথরের দেওয়ালে মাথা খুঁড়ছে ক্রমাগত। ভিন্সেন্টের মনে হল এমন সুরজাল যে সৃষ্টি করতে পারে সে কেমন করে বন্ধুর ঘর ভাঙে?
এর দুদিন পরের কথা। সমস্ত দিন বাইরে বাইরে ছবি এঁকে ক্লান্ত দেহে ভিন্সেন্ট ফিরে আসছিল তার ডেরায়। গগনের সঙ্গে এখনও তার সন্ধি হয়নি। দুজনে দু ঘরে থাকে আপন মনে। ভিন্সেন্ট আউটডোব ধরেছে সারাদিনই বাইরে থাকে, ফিরে আসে সন্ধ্যায়। আর গগন সারাদিন তার রূদ্ধদ্বার কক্ষে কী আঁকে তা সেই জানে, বাড়ির বাইরে যায় সন্ধ্যায়। ফিরে আসে গভীর রাত্রে টলতে টলতে। সেদিন সমস্ত দিন ছবি এঁকে ভিন্সেন্ট ফিরে আসছিল হঠাৎ গেটের কাছে তাকে রুখল ভগলু, রঘুবীরের ছেলে। তার বিচিত্র দেহাতী ভাষায় প্রশ্ন করে, মেমসাবকা সাথ ভেট ভেল কা?
-কৌন সা মেমসাব?–প্রশ্ন করে ভিন্সেন্ট।
জবাবে জানতে পারে তার সঙ্গে সাক্ষাতের মানসে আজ নিয়ে তিনদিন এক মেমসাহেব গাড়ি নিয়ে আসছেন। কোনদিন সকালে, কোনদিন বিকালে। একদিনও দেখা হয়নি। ভিন্সেন্ট আশ্চর্য হয়ে যায়। ভারি অদ্ভুত তো! এমন খবরটা ইতিপূর্বে কেউ তাকে জানায়নি! না গগন, না মালি!
ঘরে ফিরে এসে মালিকে ডেকে পাঠায়। লণ্ঠন জ্বেলে নিয়ে মালি সরপ্রসাদ বার হয়ে আসে তার ভোলার চালের আউট-হাউস থেকে।
-হ্যাঁরে! আমার সঙ্গে এক মেমসাহেব দেখা করতে এসেছিল?
জী হাঁ। বহু তো হর রোজ আতি হ্যায়।
কই, আমাকে বলিসনি তো?
–হামি কি বলবে? ম্যয় নে সোচা কি ৰহ তসবির বালা বাবু নে আপকো কহা থা!
সরযূর দোষ নেই। সে কেমন করে জানবে মেমসাহেব কার সন্ধানে আসে! সে স্বতঃই আন্দাজ করেছিল এক বাবু দোসরা বাবুকে যা জানাবার তা জানাবে। হঠাৎ বুকের মধ্যে ছাঁৎ করে ওঠে। গগন এ-খবরটা লুকোচ্ছে কেন? ঊর্মিলা নিশ্চয়ই বলেছে সে ভিন্সেন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল! একটু সন্ধান নিতে আরও সব অদ্ভুত খবর বার হয়ে পড়ে। মিসেস ডেভিডসন প্রতিদিনই আসেন এবং অনেকক্ষণ বসে যান। দুনম্বর তসবিরবাবুর সঙ্গে গল্পগুজব করেন। গতকাল নাকি ও বাবু মেমসাহেবের বাচ্চার একখানা তসবির এঁকেছে! মেমসাহেব অনেকক্ষণ ছিলেন এখানে। পেনসিলের ছবি আঁকিয়ে নিয়ে গেছেন।
ভিন্সেন্ট উন্মাদের মত পায়চারি করতে থাকে। আজ সে এর ফয়সালা করবে। সে বটুকেশ্বর নয়। সবকিছু নির্বিবাদে সয়ে যাবার মত মানুষ ভিন্সেন্ট ভান গর্গ নয়। প্রয়োজন হলে সে উচিত শিক্ষা দিয়ে দেবে গগনকে। বন্ধু বলে রেয়াৎ করবে না। আজ আসুক গগন! যত রাত্রিই হোক ও জেগে অপেক্ষা করবে।
অদ্ভুত যোগাযোগ! সে রাত্রে গগন ফিরল না। সমস্ত রাত বারান্দায় পায়চারি করে গেল চন্দ্রভান। প্রহরের পর প্রহর কেটে গেল। শেষকালে পুব দিকের আকাশ ফর্সা হয়ে এল, কিন্তু গগনের পাত্তা নেই। আলো ফুটতেই সে বেরিয়ে পড়ল।
হনহন করে রাস্তা পার হয়ে ডক্টর ডেভিডসনের বাসায় এসে যখন পৌঁছল তখনও ভাল করে সকাল হয়নি। বাড়ির দরজায়ান একটু অবাক হল এত সকালে ভিসিটার্স আসতে দেখে। জানালো, সাহেব মেমসাহেব দুজনের কেউ নেই। গাড়ি নিয়ে হাজারিবাগ গেছে গতকাল। সন্ধ্যায় ফিরবেন।
গাড়িতে আর কে কে আছে?
–বাচ্চারা আছে। আর লম্বা মত এক বাবু আছে। তসবিরবালা বাবু।
তসবিরবালা বাবু? তুমি কেমন করে জানলে?
ও তো মেমসাহেবের তসবির বানাচ্ছে।
আবার হনহন করে ফিরে এল বাসায়। গগন ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চায়! ঊর্মিলার সঙ্গে সে ভাব জমিয়েছে। ভিন্সেন্টকে ইচ্ছা করেই কিছু বলেনি। কে জানে ঊর্মিলা তাকে কতখানি বলেছে। এর একটা ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ভিন্সেন্ট সুস্থ হতে পারবে না। এখনি তাকে এর শোধ নিতে হবে। আবার সে আপন মনে বিড়বিড় করে বললে, তুমি ভুল করছ গগন; আমি বটুকেশ্বর দেবনাথ নই। ঊর্মিলার ওপর কোন বাঁদরামি আমি সহ্য করব না।
পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মত সে পায়চারি করছে বারান্দায়, আর মাঝে মাঝে চোখ তুলে চাইছে কখন ফিরে আসে গগন।
মনে পড়ে গেল গগন রাঁচিতে আসার আগে তাকে প্রশ্ন করেছিল ওদের মধ্যে কে বেশি ভাল ছবি আঁকে। কে বড় আর্টিস্ট ভিন্সেন্ট ভান গর্গ, না পল গগ্যা। সে সমস্যার সেদিন মীমাংসা হয়নি। আজ গগন ওর জীবনের প্রথম প্রেমকে ছিনিয়ে নিয়ে দুনিয়ার কাছে প্রমাণ রাখবে সেই বড়। কিন্তু কেমন ছবি আঁকে গগন? তার আঁকা একখানা। ছবিও সে ভিন্সেন্টকে দেখতে দেয়নি।
দুত্তোর, নিকুচি করেছে।
ভিন্সেন্ট লাফিয়ে ওঠে। কয়লা ভাঙার জন্য একটা লোহার ডাণ্ডা ছিল; সেটা নিয়ে দমাদম বাড়ি মারতে থাকে গগনের ঘরের তালাটায়। অচিরেই ওর সেই প্রচণ্ড ক্রোধের সম্মুখে হার স্বীকার করল ছোট্ট তালাটা। ঘরে ঢুকল ভিন্সেন্ট। সমস্ত ঘর অগোছালো। রঙ, তুলি, ক্যানভাস ছড়ানো। ও-পাশে থাক দিয়ে রাখা আছে গগনের আঁকা ছবি। ভিন্সেন্ট হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তুলে নেয় স্বচেয়ে বড় ক্যানভাসটা। বসিয়ে দেয় খাটের উপর। তারপর একটু দূরে সরে গিয়ে তাকিয়ে দেখে।
তৎক্ষণাৎ ভিন্সেন্টের মাথার মধ্যে টলে উঠল। একটা আর্ত চিৎকার তার কণ্ঠনালী বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু স্বর ফোটে না তার মুখে। ওর হাত-পা অসাড় হয়ে যায়।
ওর থেকে হাত চারেক দূরে খাটের উপর খাড়া করে রাখা আছে একটা ক্যানভাস। এইমাত্র সেটা সে নিজেই বসিয়েছে। ছবিটা সেই পূজারিণী মেয়েটির। কিন্তু সে কি তবে সেদিন দেবীমন্দিরে পূজা দিতে যাচ্ছিল না? মদনমন্দিরে পূজা দেবার জন্যই যৌবন বিকশিত করে সদ্যঃস্নাতার বেশে দাঁড়িয়ে ছিল? তাই কি বটুকেশ্বরের স্ত্রী নিলর্জ ভঙ্গি তে কিন্তু বটুকের স্ত্রী কোথায়? ও যে, ও যে হ্যাঁ, কোন ভুল নেই। চিত্রলেখা? নাথানিয়েল নয়, বটুকেশ্বর নয়–গগন পাল তার শ্লীলতা হানি করেছে।
হঠাৎ হিংস্র শ্বাপদের মত লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। চিত্রলেখা নেই, গগন পাল নেই, কিন্তু ঐ ছবিখানা আছে। ওর সমস্ত আক্রোশ ফেটে পড়ল ঐ ছবিখানার উপর। এতক্ষণে একটা আর্ত জান্তব চিৎকার বার হয়ে এল ওর কণ্ঠনালী বিদীর্ণ করে। ভিন্সেন্ট লাফ দিয়ে পড়ল ক্যানভাসটার উপর। দুহাতের নখ বসিয়ে দিল ঐ নগ্নিকার নরম বুকের মাঝখানে। তারপর সে ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ফেলল ছবিখানা। দুমড়ে মুচড়ে টেনে টেনে খুলে ফেলল ফ্রেমের কাঠগুলো। পেরেকে হাত কেটে গেল। রক্ত ঝরল; কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই ভিন্সেন্টের। ওর চিৎকারে ইতিমধ্যে দ্বারের কাছে কারা যেন ছুটে এসেছে। সে-সব দেখতে পেল না ভিন্সেন্ট। বদ্ধ উন্মাদের মত সে তখন ক্যানভাসটা কুঁচি কুঁচি করে ছিঁড়ে ফেলছে। মুখ দিয়ে গাঁজলা বার হচ্ছে। তারপর সংজ্ঞা হারিয়ে সে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। জ্ঞান যখন হল, তখন দেখে সে শুয়ে আছে খাটের উপর। ভগলু আর সরযূপ্রসাদ বসে আছে পায়ের কাছে। স্থানীয় একজন ডাক্তারবাবুও আছেন। আর তার পিছনে দীর্ঘকায় গগনের মাথাটা জেগে আছে।
-গেট আউট! য়ু স্কাউণ্ড্রেল!-চিৎকার করে ওঠে ভিন্সেন্ট।
ডাক্তারবাবুর ইঙ্গিত পেয়ে মুহূর্তে গগন বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।
ক্রমশ ভিন্সেন্ট সুস্থ হয়ে উঠল। ডক্টর ডেভিডসন এসে ওকে পরীক্ষা করলেন। ইনজেকশান দিয়ে গেলেন। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ভিন্সেন্ট।
ডাক্তার বলে গিয়েছিলেন ক্রাইসিস্টা পার হয়ে গেছে। পুরো দেড়দিন ঘুমবে রোগী। তারপর সে স্বাভাবিক হয়ে জেগে উঠবে। ডাক্তারের ভবিষ্যদ্বাণী কিছুটা ফলেছিল। পুরো ছত্রিশ ঘন্টা ঘুমলো ভিন্সেন্ট। বাকি ভবিষ্যদ্বাণীটা ফলে থাকলে বলতে হবে সুস্থ মস্তিষ্কেই সে খুন করতে চেয়েছিল গগন পালকে।
শেষরাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল গগনের। খোলা জানালা দিয়ে চতুদর্শী চাঁদের আলোয় ঘরটা আলোয় আলো। গগন দেখতে পেল তার বিছানার অদূরে দাঁড়িয়ে আছে ভিন্সেন্ট। পা টিপে টিপে সে এগিয়ে আসছে ওর খাটের দিকে। ভিন্সেন্টের ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ; তার চোখে খুনীর দৃষ্টি। তার হাতে একখানা খোলা ক্ষুর। ক্রপ-কোম্পানির যে ক্ষুর দিয়ে গগন রোজ দাড়ি কামায়।
চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে গগন। দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে ফেলে ভিন্সেন্টের ডান হাতখানা। গগনটা একটা অসুরভিন্সেন্টের তুলনায়। তবু আজ যেন ভিন্সেন্টের গায়ে মত্তহস্তীর বল। দুজনে জড়াজড়ি করে পড়ে মেঝের উপর। ভিন্সেন্টের হাত থেকে ক্ষুরটা ছাড়িয়ে নিতে যায় গগন-ফলে তার নিজের হাতটাই মারাত্মকভাবে কেটে যায়। উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত গগন ওকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে পালায়।
ভিন্সেন্ট উঠে বসে। ক্ষুরে রক্তের দাগ। গগনের রক্ত।
হঠাৎ আবার নজরে পড়ে গতকাল যেখানে চিত্রলেখার ছবিখানা বসানো ছিল ঠিক সেইখানে আজ বসানো আছে আর একটি চৈলচিত্র। ঊর্মিলা ডেভিডসন। সমস্ত শরীর নয়, আবক্ষ চিত্র। পোর্ট্রেট। ছবিটা ভাল কি খারাপ সার্থক কি ব্যর্থ তা লক্ষ্যই হল না ভিন্সেন্টের। সে একনজরে দেখে নিয়েছে লাবণ্যময়ী মেয়েটির বুকের তলায় স্বাক্ষর রেখেছে ওর সহপাঠী গগন পাল। এবার আর ছবিখানা নষ্ট করল না ভিন্সেন্ট। সেটা তুলে নিল হাতে। চোখটা ঝাপসা হয়ে এল।
ছবিটাকে উদ্দেশ করে সে ডান হাতখানা বাড়িয়ে ধরে। বলে, -ঊর্মিলা, এই দেখ চিত্রলেখার প্রণয়চিহ্ন সারাজীবন আমি বয়ে বেড়াচ্ছি–তবু সে আমাকে ছেড়ে ঐ গগ্যার কাছে গেছে! তুমি যা প্রণয়চিহ্ন চেয়েছ তাও আমি তোমাকে দেব। বাকি জীবন সে চিহ্নও বয়ে বেড়াব কিন্তু কথা দাও, তুমি চিত্ৰলেখার মত বিশ্বাসঘাতকতা করবে না? বল! কথা দাও!
তারপর ও অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসে।
এক পোঁচে নিজের ডান কানটা কেটে ফেলে ক্ষুর দিয়ে।
ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে! চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে জল। তবু নির্বিকার ভিন্সেন্ট। কাটা কানটা দিয়ে ঢাকা দেয় ঊর্মিলার ছবির দক্ষিণ স্তনের উপর গগন পালের ঐ স্বাক্ষরটা। হাত দিয়ে কানের ক্ষতচিহ্নটা চেপে ধরে। রক্ত বন্ধ হয় না। ধারাস্রোতে রক্ত ঝরছে। ঝরুক। ভিন্সেন্ট ঐ ছবিটার সঙ্গে কাটা কানটা দিয়ে একটা প্যাকেট জড়ায়। তারপর গগনের বিছানার চাদরটা তুলে নেয়; নিজের ক্ষতচিহ্নটার উপর দিয়ে একটা প্রকাণ্ড পাগড়ি বাঁধে। বেরিয়ে আসে বাইরে।
ভগলু যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। তাকে ডাকল। বললে, –এই প্যাকেটটা ডাক্তার সাহেবের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়। বলবি মেমসাহেবকে আমি দিয়েছি।
ভগলু বোধ করি রক্তের দাগটা লক্ষ্য করেনি। সে প্যাকেটটা নিয়ে চলে যায়। টলতে টলতে ফিরে আসে ভিন্সেন্ট। ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে যায় দোরগোড়ায়।
গগন পরদিনই রাঁচি ছেড়ে পালায়। সুলেখা আর চিত্রলেখা যে অভিন্ন ঊর্মিলা আর মিসেস ডেভিডসন যে একই ব্যক্তি এসব তথ্য গগন আদৌ জানত কিনা জানি না কিন্তু এটুকু সে জানত ভিন্সেন্ট সুযোগ পেলেই তাকে খুন করবে!
গগনের খবর পেয়েছিলাম পরে। সে নাকি কলকাতায় ফিরে আসে। খিদিরপুরের ডক-অঞ্চলে থাকত। শেষ পর্যন্ত কোন সারেঙের ব্যবস্থাপনায় একটি বিদেশী জাহাজে খালাসী হয়ে কোন্ সুদূরে পাড়ি জমায়। গগন আর ভারতবর্ষে ফিরে আসেনি।
কিন্তু ভিন্সেন্ট? তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন ডক্টর ডেভিডসন। খবর পেয়ে কলকাতা থেকে আমি এবং দিল্লী থেকে সূরযভান রাঁচি এসে হাজির।
ভিন্সেন্টের যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন চোখ মেলে প্রথমেই সে দেখতে পেল ডক্টর ডেভিডসনকে। তখন সন্ধ্যা হব-হব।
-হ্যালো! ডাকল ভিন্সেন্ট।
–হ্যালো! ফিরে দাঁড়ালেন ডক্টর ডেভিডসন।
–আমি কি আপনার বাড়িতে আছি?
বাড়িতে নয়, হাসপাতালে।
–ও!
বোধহয় মনে পড়ে গেল ভিন্সেন্টের। নিজের অজ্ঞাতেই হাতটা চলে গেল কানের দিকে। ডাক্তার ওর হাতটা ধরে ফেলেন। বলেন, ওখানে হাত দেবেন না।
–ও হ্যাঁ! আমার মনে পড়ে গেছে..ওটা নেই! না?
–না থাকে ক্ষতি নেই। বাঁধাকপির পাতার মত ঐ কানটা দিয়ে তো মানুষ শোনে । আপনার শুনতে কোন অসুবিধা হবে না। দু-চার দিনেই ঘা শুকিয়ে যাবে।
আমার বন্ধু, গগন পাল! সে কোথায়?
তিনি চলে গেছেন। তার মালপত্র নিয়ে চলে গেছেন।
মিসেস ডেভিডসন? তিনি কোথায়?
–আপনি বেশি কথা বলবেন না এখন। চুপ করে শুয়ে থাকুন। অনেকটা রক্ত পড়েছে ত! আপনি দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
ভিন্সেন্ট অস্ফুটে বলে, আপনি খুব ভাল লোক ডাক্তার সাহেব!
ঘুমবার চেষ্টা করে। ঘুম আর আসে না। ডাক্তারবাবু চুপ করে বসেছিলেন একটু দূরে, একখানা চেয়ারে। ভিন্সেন্ট লক্ষ্য করে দেখে ঘরে তার খাট আর ঐ চেয়ারখানা ছাড়া আর কোন আসবাব নেই। এটা নিশ্চয় হাসপাতালের কেবিন। কিন্তু কেবিনে সাধারণত যেসব জিনিস থাকে তা তো নেই! আবার বলে, –এটা কি হাসপাতালের কেবিন?
-হ্যাঁ।
–ঘরটা এত ফাঁকা কেন?
–আমি ঘর থেকে সব কিছু সরিয়ে দিয়েছি, আপনাকে বাঁচাতে।
-কার কাছ থেকে?
–আপনার নিজের কাছ থেকে।
ও!
আপনি একটু ঘুমবার চেষ্টা করুন।
এবার সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে ভিন্সেন্ট।
পরদিন সকালে যখন ওর ঘুম ভাঙল দেখে ডাক্তারবাবুর সেই চেয়ারখানায় বসে আছে সূরযভান। তার মুখটা ম্লান, ক্লান্তিতে যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। চোখ দুটো টকটকে লাল।
-সূরয! ডাকল চন্দ্রভান।
সূরয চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে। বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। দাদার হাতখানা টেনে নিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
-আশ্চর্য সূরয! যখনই তোর জন্য প্রাণ কাঁদে চোখ মেলে দেখি তুই এসেছিস! সেই জোড়-জাঙালের কথা মনে আছে সূরয?
সূরযভান মাথাটা নাড়ে। কথা বলতে পারে না।
–তুই কেমন করে খবর পেলি রে?
–গগ্যাদা টেলিগ্রাফ করেছিল।
–গগ্যার ভারি অন্যায়। মিছিমিছি তোর অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল। আমি তো ভালই হয়ে গেছি।
দুজনেই কিছুটা চুপচাপ। তারপর সূরয বলে, ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। ও কিছু নয়। দু-চার দিনের মধ্যেই তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। এবার আমি তোমাকে দিল্লী নিয়ে যাব দাদা। এভাবে একা একা তোমার থাকা চলবে না।
–বেশ তো। না হয় দিল্লীতে গিয়েই থাকব। তোর কাছে থাকলেই আমি ভাল থাকব।
একটু ইতস্তত করে সূরয বলে, –একটা খবর আছে দাদা!
-খবর! ভাল, না খারাপ?
–তোমার ভালই লাগবে নিশ্চয়!
–কী রে?
–আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি।
ভিন্সেন্ট কী জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ তার খেয়াল হয়, কী আশ্চর্য! এমন একটা আনন্দের কথায় সে চুপচাপ আছে! খুশিয়াল হয়ে বলে, বাঃ বাঃ! খুব ভাল কথা! মেয়ে দেখেছিস? কেমন মেয়ে?
–দেখেছি বইকি! আমাদের প্রতিবেশী। ওরাও আমাদের স্বজাত। কনৌজী ব্রাহ্মণ। ওর বাবা দিল্লীতে ব্যবসা করেন। মেয়েটি লেখাপড়াও শিখেছে। হিন্দি আর ইংরাজি।— তারপর একটু হেসে বলে, বাংলা জানে না কিন্তু।
–তাতে কি? ও তুই শিখিয়ে নিবি।
সূরষের ছুটি পাওনা ছিল না। বাধ্য হয়ে পরদিন তাকে ফিরে যেতে হল। যাবার আগে বললে, তুমি গিয়ে না দাঁড়ালে তো বিয়ে হবে না! কবে যেতে পারবে বল?
–ডাক্তার সাহেব ছেড়ে দিলেই যেতে পারি।
ডাক্তারবাবু বললেন দিন পনের পরেই ভিন্সেন্ট ট্রেনে চাপতে পারবে। আর দুদিন পরেই ভিন্সেন্ট চলা-ফেরা করতে শুরু করল। হাসপাতালের বারান্দায়; ক্রমে বাগানে।
সেদিন বাগানে ধীরে ধীরে পায়চারি করছিল, ডাক্তারবাবু ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন, –আজ কেমন আছেন?
সম্পূর্ণ ভাল হয়ে গেছি মনে হচ্ছে। ব্যাণ্ডেজটা কবে খুলছেন?
পরশুর পর দিন। আপনি এখন ইচ্ছে করলে একটু একটু ছবি আঁকতে পারেন।
ভিন্সেন্ট হাসতে হাসতে বলে, –ছবিও আমি পরশুর পর দিন শুরু করব, কারণ, এবার প্রথমেই আঁকব একটা সেলফ পোর্ট্রেট। কানকাট্টা সেপাই!
ডাক্তার সাহেব কাছে ঘনিয়ে এসে বললেন, বলুন তো মিস্টার গর্গ হঠাৎ কেন অমন কাণ্ডটা করলেন?
ভিন্সেন্ট অনেকক্ষণ কোন জবাব দিল না।
ডাক্তার সাহেব পুনরায় বললেন, –সেদিন আমার স্ত্রী আপনার কান নিয়ে ঠাট্টা করেছিল বলে?
না না না! আপনার স্ত্রীর কোন দোষ নেই। আমি জানি না, কেন অমন কাণ্ডটা হঠাৎ করে বসলাম। তিনি কোথায়? তাঁর কাছে আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে।
–সে ঘটনার পরদিনই চলে গেছে। ওর মনে হয়েছে সেদিন বড় চড়া সুরে ঐ রসিকতা করেছিল সে। দিনকতকের জন্যে সে ঘুরে আসতে গেছে।
–ও! না, তার দোষ নেই! এ নিছকই একটা পাগলামি!
ডক্টর ডেভিডসনের কাছে ভিন্সেন্ট স্বীকার করতে পারেনি। করেছিল আমার কাছে। আমি দিনসাতেক পরে যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন ও অনেকটা সুস্থ। হাসপাতাল থেকে তখনও ছাড়া পায়নি। আমার কাছে একেবারে ভেঙে পড়ল চন্দ্রভান। বললে, আমি এখন কি করব দীপু? আমি নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছি!
দূর, পাগল হলে এমন স্বাভাবিকভাবে কেউ কথা বলতে পারে?
–কিন্তু প্রতি তিনমাস অন্তর একটা বিশেষ তিথিতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, এটা তো ঠিক!
ভিন্সেন্ট হিসাব কষে দেখেছে ওর মানসিক বিকলতা একটা ছন্দ মেনে আসছে। গত চার-পাঁচ বারের আক্রমণের মাঝখানে প্রতিবারেই তিন মাসের ব্যবধান। পঁচাশি থেকে পঁচানব্বই দিনের একটা কালের ব্যাপ্তি। প্রতিবারেই পূর্ণিমার কাছাকাছি তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। সবটা শুনে আমি বলি, তাই যদি হবে এবার আমরা আগে থেকেই সাবধান হতে পারব। শুনলাম, এবার তুই দিল্লীতে সূরযের কাছে থাকবি?
মুখটা ম্লান হয়ে যায় ভিন্সেন্টের। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার। বলে, প্রথমে তাই ভেবেছিলাম রে; কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম সে পথও বন্ধ হয়ে গেছে আমার। সূরয বিয়ে করতে যাচ্ছে। পাশের বাড়ি ওর শ্বশুরবাড়ি। ওরা কনৌজী ব্রাহ্মণ। আমাদের বাংলা দেশের মত নয়–ওরা নিশ্চয় খুব গোঁড়া ব্রাহ্মণ। আমি খ্রীষ্টান, কেমন করে থাকব সেখানে? তাছাড়া তিন মাস পরে পাগলামোর সময় যদি সূরযের বউকে-না না না, দীপু! সে কিছুতেই হতে পারে না!
তাহলে কী করতে চাস তুই?
–আমি এখানেই থাকব। গরম কমে এসেছে। এখন চেঞ্জাররা আসবে। তোর সেই ক্লায়েন্ট ভদ্রলোক কি এবার শীতকালে রাঁচি আসবেন?
-না, এবার ওঁরা দক্ষিণ-ভারতে তীর্থে যাচ্ছেন। তুই যতদিন ইচ্ছে ওবাড়িতে থাকতে পারিস।
আহ, বাঁচালি!
বুকের থেকে একটা পাষাণভার নেমে গেল যেন ওর। নিরাশ্রয় আর্টিস্ট ভান গর্গের। বেচারির একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল ছোট ভাইয়ের ডেরা সেখানে যেতে ও ভরসা পায় না। তাই হাসপাজল ছেড়ে বেরিয়ে এসে ও কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এটাই ছিল চিন্তা। আমি প্রশ্ন করি, হারে চন্দর, তুই গগ্যাকে সত্যিই খুন করতে গিয়েছিলি?
ও অনেকক্ষণ কোন জবাব দিল না। বোধকরি নিজের মনকেই ও প্রশ্নটা করল, আর তার জবাবের অপেক্ষায় চুপ করে বসে রইল। শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, -হ্যাঁ!
–তুই কি সুযোগ পেলে এখনও গগ্যাকে খুন করতে চাস?
দূর! আমি তো এখন ভাল হয়ে গেছি! ও সময়…কেমন যেন…হঠাৎ…
কিভাবে কথাটা শেষ করবে বুঝে উঠতে পারে না। আমি পুনরায় বলি, তা যেন হল। গগ্যার ওপর তোর প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল। কিন্তু কানটা কি দোষ করল? হঠাৎ নিজের কানটা কেটে ফেললি কেন?
এবারও জবাব দিতে ওর দেরি হল। তারপর বললে, -ডক্টর ডেভিডসনকে বলিনি। কিন্তু তোকে বলব। লজ্জা পাওয়ার কথা আমার নয়, ওর। তাই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে…
ওর কথার মধ্যে বেশ অসঙ্গতি। জিজ্ঞাসা করি, কার কথা বলছিস তুই?
ঊর্মিলার! ঊর্মিলার শারদাঁ!
ভিন্সেন্ট কি এখনও স্বাভাবিক হয়নি? এ তো রীতিমত প্রলাপ! আমার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে তার সময় লাগে না। বলে, –আমি পাগলামি করছি না দীপু। ডক্টর ডেভিডসন বিয়ে করেছেন ফাদার শারদাঁর ভাইঝিকে। বিশ্বাস না হয় তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখিস।
সমস্ত কথাই খুলে বলেছিল ভিন্সেন্ট। কেন সে খুন করতে গিয়েছিল গগ্যাকে। বটুকেশ্বরের বউকে শুধু নয়, ভিন্সেন্টের মানসী প্রতিমাকেও ধূলায় টেনে নামিয়েছিল গগ্যা। তারপর বললে কেন হঠাৎ নিজের কানটা কেটে ফেলল। মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল ঠিকই কিন্তু কার্যকারণসম্পর্ক একটা আছে ওর পাগলামির। সমস্তটা শুনে আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। সব কথা ডক্টর ডেভিডসনকে খুলে বলা কি উচিত হবে? মিসেস ডেভিডসন নিঃসন্দেহে হৃদয়হীনতার প্রমাণ দিয়েছেন। ভিন্সেন্ট কেন যে তাঁকে চিনতে পারেনি, একথা তাঁর বোঝা উচিত ছিল। তা তো তিনি তলিয়ে দেখলেনই না, উপরন্তু ওর আহত স্থানে পুনরায় আঘাত করলেন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ভিন্সেন্ট সেই উপেক্ষার, সেই অবমাননার একটা চরম প্রতিশোধ নিয়ে বসল। নিজের কান কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ! নিরতিশয় আত্মগ্লানিতে মিসেস ডেভিডসন স্থানত্যাগ করেছেন নিজের কাছ থেকেই পালাতে চেয়েছেন তিনি। এসব কিছুই জানেন না তার স্বামী। এ ব্যাপারে যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেই ভিন্সেন্ট তার আত্ম-লাঞ্ছনার ইতিকথা গোপন করে গেছে ডাক্তার সাহেবের কাছে। ফলে আমি কেন তা প্রকাশ করে দিই? ডক্টর ডেভিডসনের কাছে তাঁর স্ত্রীকে অপদস্থ করি? অথচ সব কথা না জানলে ডাক্তার সাহেব ওর চিকিৎসাই বা করবেন কেমন করে?
মোট কথা অপ্রিয় সত্যটা আমাকে গোপন করেই যেতে হল। প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্য । ওকে জিজ্ঞাসা করি, এখানে সারাদিন কি করিস? সময় কাটে কি করে?
–ডাক্তার সাহেব অনুমতি দিয়েছেন। আমি ছবি আঁকি বসে বসে।
-কই, কি আঁকছিস দেখি!
ভিন্সেন্ট একখানা ক্যানভাস এনে আমাকে দেখালো। ইতিমধ্যে ওর ঘরে আবার আসবাবপত্র এসেছে। ওর কেবিনটা দ্বিতলে। পিছন দিকে একটা বড় জানালা। ভিন্সেন্ট ঐ জানালার ধারে গিয়ে বসে। ভিতরের উঠোনটার একটা ছবি এঁকেছে। অদ্ভুত ছবিখানা! মানসিক রোগাক্রান্তদের কিছু শারীরিক পরিশ্রমের প্রয়োজন। অথচ ওদের সাহস করে বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় না। ফলে পাঁচিল-ঘেরা বন্দীশালায় ওরা গোল হয়ে পায়চারি করে। গোল হয়ে ঘুরতে থাকে। সকলের একই রকম পোশাক, একই রকম ভঙ্গি। যেন ঝরাফুলের একটা গোল মালা। তালে তালে পা ফেলে ওরা ক্রমাগত পাক খায়। অনেকগুলি ফিগার এঁকেছে ভিন্সেন্ট। ডানদিকের এক কোণে উন্মাদাগারের তিনজন রক্ষী।
এ ছবিখানা ভিন্সেন্ট ডক্টর ডেভিডসনকে উপহার দিয়েছিল।