পাকাপাকিভাবে কলকাতাতে
ঢাকার বাস তুলে দিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতাতেই এসে বসলাম। প্রথম মাসকতক নিজেকে নিয়েই এত ব্যস্ত ছিলাম যে বটুক অথবা গগনের কোন খোঁজখবর নিতে পারিনি। গগনের সঙ্গে অবশ্য সম্পর্ক রাখবার আদৌ কোন ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু বটুকের সাদর আমন্ত্রণ রাখতে যাবার ইচ্ছে ছিল–নানান ঝঞ্ঝাটে ঘটে ওঠেনি। ক্রমে ভুলেই গিয়েছিলাম সেকথা। মনে পড়ল হঠাৎ একদিন মাসিক বসুমতীর পাতা ওলটাতে বসে। প্রথম পাতাতে যে ছবিটি ছাপা হয়েছে তার চিত্রকর-শ্ৰীবটুকেশ্বর দেবনাথ। ছবির ক্যাপসান–পূজারিণী। ফুলের সাজি ও নৈবেদ্যের থালা হাতে– একটি পূর্ণযৌবনা রমণী মন্দিরের ধাপ বেয়ে উপরে উঠছে। পশ্চাদপটে একটি পুকুর, নারকেল গাছ, রোমন্থনরত গাভি। মেয়েটির পরিধানে একটি ভিজে শাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। ফলে মন্দিরের বাতাবরণে একটা স্বর্গীয় ভাবের সঙ্গে আর্টিস্ট পার্থিব সৌন্দর্যকে সুন্দরভাবে মিলিয়ে দিতে পেরেছেন।
সেদিনই দেখা করতে গেলাম হগমার্কেটে। দোকানের ঠিকানা বটুক আগেই দিয়ে রেখেছিল। ছোট্ট দোকান। ছবি সবই বটুকেশ্বর দেবনাথের আঁকা। প্রতিটি ছবির দাম লেখা আছে ছবির নিচে। বটুক আমাকে দেখে খুশি হল। দোকানের টুলটা টেনে বসালো আমাকে। পাশের দোকান থেকে কেক আর চা এনে খাওয়ালো। বললে, এতদিন পরে অধমকে মনে পড়ল?
–পড়ত না। আজ মাসিক বসুমতীতে তোর ছবিখানা দেখে মনে হল আর্টিস্টকে কংগ্রাচুলেট করে আসা উচিত!
-কেমন লেগেছে? সুন্দর নয়?
–হ্যাঁ, চমৎকার হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাকগ্রাউণ্ডটা।
–আরে দূর! আমি ছবিটার কথা বলছি না। বলছিলাম, সুলেখা সুন্দর নয়?
তার মানে? ঐ তোর বউ সুলেখা নাকি?
খুশিতে বটুকেশ্বরের চোখ দুটো মিটমিট করতে থাকে। ও বসেছিল কাউন্টারের ওপাশে একটা উঁচু টুলে। সেখানে বসে বসে পা নাচায় টুকটুক্ করে। বেঁটে মানুষটা টুলে বসে বেশ দোলনায় বসার আনন্দ লাভ করে। আমি বলি, –আরে সেকথা জানা থাকলে আরও ভাল করে মেয়েটাকে দেখতাম। আমি তো পূজারিণীকে দেখিনি, দেখেছি গোটা ছবিখানা।
বটুক তুরুক করে নেমে পড়ে টুল থেকে। বলে, -দেখ না যত খুশি!
র্যাকের নিচে থেকে টেনে বার করে অরিজিনালখানা। একটু দূরে বসিয়ে দেয় আলোর নিচে। নিজেও একটু দূরে সরে গিয়ে ঘাড় নেড়ে দেখতে থাকে।
বলি, বিক্রি করবি? কত দাম ধরেছিস?
না ভাই, এখানা নয়! সুলেখাকে কথা দেওয়া আছে।
আমি হো হো করে হেসে উঠি। বলি, –কেন রে? ভিজে কাপড় পরে আছে বলে? ও ছবি তো এখন ঘরে ঘরে। অত কনসার্ভেটিভ হলে এ ছবি আঁকবারই বা কি দরকার, আর সেটা মাসিকপত্রে ছাপানোরই বা কি দরকার?
যেন অত্যন্ত গোপন একটি খবর জানাচ্ছেবটুকেশ্বর মুখটা আমার কানের কাছে সরিয়ে এনে বললে, সুলেখাকে মডেল করে ছবিখানা এঁকেছি বটে, তবে মুখটা ইচ্ছে করেই বদলেছি। না বলে দিলে কেউ বুঝতে পারবে না এটা সুলেখার চেহারা। আসলে ফিগারটা সুলেখার, মুখটা কাল্পনিক!
তবে আর ওটা বিক্রি করতে আপত্তি কিসের?
–ওর পিছনে একটা সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু আছে বলে। ছবিটা এবার একজিবিশানে যাবে নট ফর সেল মার্কা নিয়ে।
সুলেখার পোর্ট্রেট এঁকেছিস? কই, দেখি?
–আলেখ্য কেন দীপু, গোটা মানুষটিকেই দেখে এস না বাবা। ও তো প্রায়ই বলে কই, তোমার সেই ডাক্তার বন্ধু আসবেন বলেছিলেন, তা এলেন না তো। একবার তোকে দিয়ে ওকে দেখাতেও চাই। মাঝে মাঝে ফিট হচ্ছে আজকাল। হজমের গণ্ডগোল আছে, কন্সটিপেশন! তাছাড়া এতদিনেও ওর ছেলেপুলে হল না।
বটুকেশ্বর তার স্কেচবই বার করে দেখালো। ওর বউয়ের অনেক স্কেচ এঁকেছে, নানান গৃহকর্মে ব্যাপৃতা। রান্না করছে, তরকারি কুটছে, সেলাই করছে, বসে আছে বা শুয়ে আছে। পেনসিল, পেন-অ্যাণ্ড-ইঙ্ক, টেম্পারা এবং অয়েল। দু-চারখানা রঙিন ক্রেয়নে। বটুক ল্যাণ্ডস্কেপ আঁকে না, স্টিল লাইফও নয়, অধিকাংশ চিত্ৰই মানুষের, বরং বলা উচিত মেয়েমানুষের–আর সেই মেয়েমানুষ ওর মনের মানুষ। পাছে লোকে চিনে ফেলে বলে মুখটা শুধু বদলে দেয়। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পৌরাণিক বা মহাকাব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে কেন সে কাল্পনিক ছবি আঁকে না। বললে, -মুশকিল কি জানিস, পৌরাণিক ছবি আঁকতে গেলে কোন স্টাইলে আঁকব? সুলেখাকে মডেল করে সীতার অগ্নিপরীক্ষা একখানা এঁকেছিলাম। সেটা দেখে অবনদা বললেন-বটুক, তোমার সীতা অগ্নিপরীক্ষায় পার পাবেন কিনা জানি না, কিন্তু আমাকে এ কোন্ অগ্নিপরীক্ষায় ফেললে তুমি?
–অবনদা মানে?
–অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবিখানা জোড়াসাঁকোয় দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম।
–কেন, অবনীন্দ্রনাথ ও কথা কেন বললেন?
বটুক আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়। অবনীন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, ক্ষিতীন্দ্র মজুমদার, নন্দলাল, অসিতকুমার ইত্যাদি পৌরাণিক বিষয়বস্তু নিয়ে অনেক ছবি এঁকেছেন ও আঁকছেন। তাদের একটা নতুন স্কুল হয়েছে। অবনীন্দ্রনাথের ভাষায় সেটা ভারতীয় চিত্রাদর্শ। অ্যানাটমি সেখানে বড় কথা নয়, বড় কথা ভাবের ব্যঞ্জনা। সাহিত্য পত্রিকায় এঁদের ক্রমাগত গালাগাল দিয়ে যাওয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু দেশে-বিদেশে ক্রমে ক্রমে এই ধরনের ছবি সমাদর পাচ্ছে। অবনীন্দ্রনাথের বুদ্ধ ও সুজাতা, নির্বাসিত যক্ষ, যমুনাতটে রাধিকা, শিব-সীমন্তিনী; ক্ষিতীশ মজুমদারের রাসলীলা, শকুন্তলা, গঙ্গা; নন্দলালের– সতী, কৈকেয়ী, সাবিত্রী ও যম, গান্ধারী, কিংবা অসিতকুমারের রাসলীলা, অশোকবনে সীতা, শিব-পার্বতী সার্থক সৃষ্টি বলে স্বীকৃত হয়েছে। এসব ছবির কোথাও অ্যানাটমিকে পুরোপুরি মেনে চলা হয়নি। সুরেশ সমাজপতি তার সাহিত্যে এ জাতীয় ছবির কঠিন সমালোচনা করে চলেছেন। নন্দলালের মহাদেবের তাণ্ডবনৃত্যের সমালোচনায় লিখেছেন, মহাদেব কেন হাড়গিলার মত একপায়ে দাঁড়াইয়া আছেন, তাহা বুঝিলাম না। অবনীন্দ্রনাথের কাজরী চিত্রের প্রসঙ্গে লিখলেন, রমণীর প্যাকাটিবিনিন্দিত হাতের ত্রিভঙ্গিম ভঙ্গী। বটুকেশ্বর যে বছর ম্যাট্রিক পাস করে সেই বছরই অবনীন্দ্রনাথ সরকারী আর্ট স্কুলের সহ-অধ্যক্ষ হয়ে আসেন। আর্ট স্কুলে যখন পড়ছে তখন অবনীন্দ্রনাথের নূতন ভারতীয় ভাবাদর্শ সেখানে নবরূপ পরিগ্রহ করছিল। আর্ট স্কুলে তখন একটি পিকচার গ্যালারি ছিল। তাতে অতি সাধারণ স্তরের য়ুরোপীয় চিত্র ও ভাস্কর্যের নমুনা ছিল। আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষই ই. বি. হ্যাঁভেল এটা সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করলেন, তাতে সায় দিলেন সহ-অধ্যক্ষ অবনীন্দ্রনাথ। ওঁরা সম্পূর্ণ নূতন ভারতীয় আদর্শে আর্ট স্কুলকে উদ্বুদ্ধ করতে চাইলেন। কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আর্ট স্কুলের ছাত্রদল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ সংগ্রহশালা অবনীন্দ্রনাথ অপসারিত করিয়েছিলেন। ওরিয়েন্টাল আর্টের আসন নিরঙ্কুশ হল আর্ট স্কুলে। সুরেশ সমাজপতির শ্লেষাত্মক আক্রমণ সত্ত্বেও নৃতন ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত শিল্পীর দল এগিয়ে চললেন তাঁদের পথে। দেশে-বিদেশে ক্রমে ক্রমে স্বীকৃতি পেলেন তারা। ইতিমধ্যে আর্ট স্কুলে একটি সংগ্রহশালা খোলা হয়েছে। লর্ড কারমাইকেলের আমলে এই সংগ্রহশালার পারচেস কমিটিতে যাঁরা সভ্য হয়ে এলেন তারা সকলেই ভারতীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত–মিস্টার মোলার এবং মিস্টার রুবেনসন নামে দুজন সুইডিশ শিল্পরসিক, মিঃ নর্মান ব্রান্ট, এ ছাড়া গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ। স্যার জন উডরফ ছিলেন কমিটির সভাপতি এবং আর্ট স্কুলের নূতন অধ্যক্ষ মিঃ পার্সিব্রাউন ছিলেন সেক্রেটারী। এই সংগ্রহশালাতে নূতন চিন্তাধারায় যাঁরা ব্ৰতী তাদের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম স্থান পেতে শুরু করল। ওদিকে ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টও তখন জন্ম নিয়েছে। লর্ড কিচেনার তার পৃষ্ঠপোষক, স্যার জন উডরফ এবং বিচারপতি আশুতোষ চৌধুরীও ছিলেন। শিল্পী ও সি. গাঙ্গুলিও আছেন তার ভিতর; ফলে ওরিয়েন্টাল আর্টের জয়যাত্রায় বাধা পড়েনি।
এই আবহাওয়াতেই বটুকেশ্বরের শিল্পকর্মে হাতেখড়ি। সে কিন্তু ভাবাদর্শ পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি। অবনীন্দ্রনাথ তার গুরু বটে কিন্তু মনে মনে সে গুরুত্বে বরণ করেছিল রবি বর্মাকে। পাশ্চাত্যখণ্ডের মিকেলাঞ্জেলো, রাফেল, তিশান, রেমব্রান্টও তার গুরু। ভারতীয় সমসাময়িক চিত্রকরদের মধ্যে একমাত্র যামিনী প্রকাশকে তার ভাল লাগতো। তাঁর ছবিতে মানুষের হাত-পা অস্বাভাবিক মনে হত না। ফলে, পৌরাণিক বিষয়বস্তু নিয়ে আঁকা তার প্রথম প্রচেষ্টা দেখে অবনীন্দ্রনাথ হাসতে হাসতে বলেছিলেন, –তুমি যে আমাকেই অগ্নিপরীক্ষায় ফেললে বটুক!
আমি বলি, –তা পৌরাণিক বিষয়বস্তু না হোক ঐতিহাসিক বিষয় নিয়েও তো আঁকতে পারিস?
–ওরে বাবা! সুরেশদার লক্ষ্মণসেনের পলায়ন নিয়ে যে কাণ্ডটা ঘটে গেল তারপর আর ঐতিহাসিক ছবি আঁকতে আছে? অত ইতিহাসজ্ঞান আমার নেই।
তাই বটুক এঁকে যায় একটি নারীমূর্তির আলেখ্য। নানান ভঙ্গিতে। যার দেহসৌষ্ঠব তার অতি পরিচিত, আর লোকলজ্জার ভয়ে যার মুখোনি ওকে কল্পনা করতে হয়।
আমাদের আলোচনা বেশ জমে উঠেছে, এমন সময় গগন পাল এসে হাজির। একমুখ দাড়ি, চুলগুলো উসকো-খুসকো। কাটে না আজকাল–পিছনদিকে বাবরির। আকার নিয়েছে। বেশ রোগা হয়ে গেছে গগ্যা। ভাল করে খেতে পায় না বোধহয়। গায়ে একটা ময়লা ঘেঁড়া হাফসার্ট। তার বোতামগুলো খোয়া গেছে। তাই রোমশ বুকের। অনেকটাই প্রকট। পায়ে তালপাতার চটি।
–এই যে, ডাক্তারসাহেবও আছেন দেখছি!
আমি জবাব দিই না। বটুক কিন্তু উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, আয় আয়! বাঃ, কী যোগাযোগ! একই দিনে দুজন এসে হাজির। এ অকেশান সেলিব্রেট করতে হয়।
আবার তিন কাপ চায়ের অর্ডার দিল বটুক।
গগন একটা টিনের চেয়ার টেনে নিয়ে বসে। বলে, –মটুকু, গোটা দশেক টাকা দিবি?
–আরে দাঁড়া ভাই। আগে বল্, নতুন কি আঁকলি?
ঝাঁট দে ওসব ছেঁদো কথা!
বটুক রুখে ওঠে, –ছেঁদো কথা মানে? তুই তো সব কিছুকে ঝাঁট দিচ্ছিস ঐ ছবির জন্যে। সেটাও তোর কাছে ছেঁদো কথা?
গগন সেকথার জবাব দিল না। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল আলোর নিচে রাখা পূজারিণীর দিকে। বললে, –মটকু, কেন বাওয়া রঙের শ্রাদ্ধ করছিস? একটা ক্যামেরা। কিনে ফেল। তাতে তবু তো বউকে চেনা যাবে।
বটুকের উৎসাহ নিভে গেল হঠাৎ। আমতা আমতা করে বললে, দূর! ও বুঝি আমার বউ? ও তো পূজারিণী। একটা আইডিয়া।
হো হো করে হেসে উঠল গগন। বললে, –তুই আমার কাছেও চাল মারবি? ও ছুকরির আপাদকণ্ঠ যে আমার চেনা আছে ব্রাদার। মুণ্ডুখানা হয় কল্পনা করেছিস, না হলে আঁকতে পারিসনি। তা ডাক্তারসাহেবকে ডাকতে হল কেন? নিমুনিয়া হয়েছে বলে?
নিমুনিয়া? কার?
কার আবার, তোর বউয়ের। ভিজে কাপড়ে তাকে সিটিং তো কম দিন দিতে হয়নি! তা একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে দে তো মকু। ছুঁড়ি ভিজে তাঁতের শাড়ি পরে মন্দিরে যাচ্ছে কেন? শুকনো গরদ কি তসরের শাড়ি পরলে ক্ষতি কি ছিল?
বটুক স্পষ্টতই আহত হয়েছিল। গম্ভীরভাবে বললে, শিল্পী বোধহয় কল্পনা করেছেন–ঐ পুকুরে স্নান সেরে মেয়েটি মন্দিরে যাচ্ছে, ভিজে কাপড় এখনও সে ছাড়েনি।
বুঝলাম। কিন্তু সায়া-সেমিজ-জ্যাকেট খুলে বুঝি গাঁয়ের মেয়েরা নাইতে যায়?
এবার বটুকের তরফে আমিই অগ্রসর হয়ে আসি। বলি, এতে রিয়ালিস্টিক ভাবই ফুটেছে। গ্রামের মেয়েরা দরিদ্র–সায়া-সেমিজ-জ্যাকেট তারা দিবারাত্র পরে না।
–ও, রিয়ালিসম! কথাটা আমার খেয়াল ছিল না। তা তো ঠিকই। গাঁয়ের মেয়েদের অত পয়সা কোথায়? রুজ, আলতা, লিপস্টিক কিনতেই তো সব খরচ হয়ে যায়!
–তার মানে?
–তাই দেখছি কিনা! বটুকের বউ–আই মীন, ঐ পূজারিণীর কাপড় ভিজে একসা হয়েছে, অথচ প্রসাধনটা ধুয়ে যায়নি। মায় কপালে সিঁদুরের টিপটা পর্যন্ত স্নানের সময় ধেবড়ে যায়নি। রিয়ালিস্টিক ছবি কিনা!
বটুক কোন প্রতিবাদ করে না। খবরের কাগজে মুড়ে ছবিখানা সরিয়ে রাখে।
–দে, সিগ্রেট দে।
বটুক নিঃশব্দে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দেয়। চা খেয়ে, সিগারেট ধ্বংস করে এবং আশ্চর্য-নগদ দশ টাকা ধার নিয়ে গগন উঠে পড়ে। যাবার সময় আমার দিকে ফিরে বলে, -ডাক্তারসাহেবের পসারের এখন কোন স্টেজ? শতমারী, না সহস্ৰমারী?
আমি জবাব দিইনি। গগনও আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না। বটুকের প্যাকেট থেকে আর একটা সিগারেট নিয়ে ফুঁকতে ফুঁকতে চলে যায়।
ও চলে যাবার পর বটুককে বলি, –গগ্যাকে এ পর্যন্ত কত টাকা ধার দিলি?
এবারও বটুক জবাব দেয় না। টুকিটাকি নাড়তে থাকে। বেশ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে সে।
-কি রে? জবাব দিলি নে যে বড়? কেন তুই ঐ লোফারটাকে প্রশ্রয় দিস?
হঠাৎ মুখ তুলে তাকায় বটুক। বলে, দীপু! আমার একটা কথা বিশ্বাস করবি? আজ থেকে একশো বছর পরে যদি কেউ তোর-আমার নাম উচ্চারণ করে তবে তা করবে এইজন্য যে, আমরা গগন পালের বন্ধু ছিলাম!
এর চেয়ে ও যদি আচমকা আমাকে একটা চড় মেরে বসত আমি কম অবাক হতাম!
আমার চমকটা ভাঙার আগেই ও বললে, হতভাগাটা কিছুতেই ওর ছবি বেচবে না। কাউকে দেখাবে না
–ওর ছবি এখন বাজারে ছাড়লে বিক্রি হবে?
–বোধহয় না। গতবছর আর্ট এজিবিশানে আমি জোর করে ওর দুখানা ছবি পাঠিয়েছিলাম। সিলেকশান পায়নি। লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। আর ও হতভাগা বললে, -মটুকু, এ আমি জানতাম রে! আমার ছবি সিলেকসান পাবে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে। তুই জিজ্ঞাসা করছিলি এ পর্যন্ত কত টাকা ওকে ধার দিয়েছি? তা শতখানেকের উপর হবে। জানি, শোধ ও দেবে না; কিন্তু তবু না দিয়ে পারি না। আর টাকার কথাই যদি বলিস–তাও শোধ হবে! আজ ব্যাঙ্কে ঐ শতখানেক টাকা রাখলে সুদসমেত সেটা যত টাকা হবে তার দশ-বিশগুণ বেশি টাকা পাবে আমার নাতি এই ছবিখানা বিক্রী করলে।
দোকান ঘরের পিছন থেকে একখানা ক্যানভাস নিয়ে এল বটুক। ১৮x১২ মাপের ছবি। প্রথমটা মনে হল ক্রোম ইয়ালো, সিপিয়া আর কোবাল্টব্লুর বাটিতে ডুব দিয়ে তিনটে ইঁদুর ঐ ক্যানভাসটার উপর যৌথ নৃত্য করেছে। কিছুই বোঝা গেল না–ছবিটার বিষয়বস্তু কী। তারপর অনেকক্ষণ দেখতে দেখতে মনে হল–একটা খোলার চালের বস্তী। একটা চায়ের দোকান। একটা ছ্যাকড়া ঘোড়ার গাড়ি। পায়ের কাছে কাদা-মাখা ঘোলা জল, একটা ল্যাংটো বাচ্চা, আঁস্তাকুড়, আর এই সব কিছুর উপর দুটি খোলার চালের মাঝখানে আটকা পড়েছে একমুঠো নীল আকাশ। তাতে একটি মাত্র সূরযসাক্ষী নিঃসঙ্গ চিল। এমন ছবি আমি জীবনে দেখিনি একথা অনস্বীকার্য। এর আঙ্গিক, এর অঙ্কন-পদ্ধতি, এর ব্যঞ্জনা সবই নতুন। বলি, -এর মধ্যে সুন্দর কোন্টা?
বটুক বললে, ছবিতে সব সময় সুন্দর কিছু যে থাকতেই হবে তার মানে কি? আর ব্যাপক অর্থে যদি বলিস, তবে ঐ বস্তী পরিবেশের বাস্তব কদর্যতার মধ্যেই ওর সৌন্দর্য।
ব্যাপারটা কিছুই বোঝা গেল না। তাই প্রশ্ন করলাম অন্যদিক থেকে, –এই যদি সার্থক ছবি, তবে তুই এই স্টাইলে আঁকিস না কেন?
–তার একমাত্র কারণ আমি বটুক দেবনাথ, গগন পাল নই!
আমি বলি, কি জানি ভাই, আমার আর্ট সম্বন্ধে যেটুকু ধারণা আছে, তাতে এ ছবিকে কিছুতেই একটি সার্থক সৃষ্টি বলতে পারছি না। প্রথমত, ছবিটা অত্যন্ত তাড়াহুড়ো। করে আঁকা। আমার তো মনে হয় আধঘন্টার বেশি সময় লাগেনি। ফলে এটা সৌখীন মজদুরী। এর পিছনে দীর্ঘ সময়ের সাধনা নেই। দ্বিতীয়তঃ, এ বাচ্চা ছেলেটার গায়ের রঙ সবুজ কেন হল তার মাথা-মুণ্ডু বোঝা যাচ্ছে না। মহিষাসুর ছাড়া সবুজ রঙের মানুষের চেহারা কোথাও দেখিনি। তৃতীয়তঃ, সামনে এই কাদার মধ্যে ঘোলা জল যেটা জমে আছে সেটা কোন দুঃখে টকটকে লাল রঙের হল? চতুর্থতঃ, ঐ আঁস্তাকুড়টা বাদ দেওয়াই শোভন হত–বিশেষ করে ঐ মরা বেড়ালটাকে। ওটা ছবিটাকে বীভৎস করে। তুলেছে।
বটুক একদৃষ্টে ছবিটা দেখছিল। অনেকক্ষণ কোন জবাব দিল না। তারপর ধীরে ধীরে বললে, আমি তোর সঙ্গে একমত দীপু। ঠিক ঐ ত্রুটিগুলিই আমি দেখিয়েছিলাম। ছবিখানা প্রথম দেখে। গগ্যা তার নিজের ছবির সমালোচনা করে না। কিন্তু সেদিন সে মুডে ছিল। দুটি বোতল শেষ করে ভাম হয়ে বসেছিল ওর ছাপরায়? জবাবে কি বললে জানিস?
কি?
বললে, বাবা মটুকু, এ ছবির অর্থ তুমি বুঝবে না চাঁদু। এটি নিয়ে যাও। যত্ন করে রেখে দিও। অনেক টাকা ধার দিয়েছ আমাকে, পঞ্চাশ বছর পরে এই ছবিখানা সে ধার শোধ দেবে। যাও!–আমি বলেছিলাম, ওসব বাজে কথা শুনছি না। ছেলেটা সবুজ, জলটা লাল কেন হল বল্ আগে!-ও বললে, ছবিটা দেখতে হবে আমার চোখ দিয়ে। বাস্তবে কি ছিল জানতে হলে তো তার ফটো তুলতাম। এ তো ফটো নয়–এ হচ্ছে শিল্পীর চোখে দেখা বরানগরের চটকল বস্তী! মাইণ্ড দ্যাট! শিল্পীর চোখে দেখা। শিল্পী ঐ খণ্ডমুহূর্তে দেখেছিলেন ঐ ল্যাংটো ছেলেটার মধ্যে ভবিষ্যৎ তারুণ্যের বিদ্রোহ। তাই তার রঙ সবুজ। সবুজ হচ্ছে তারুণ্যের প্রতীক। শিল্পীর চোখে ওটা বস্তীর কাদা-গোলা জল নয়–বস্তীমজদুরের পাঁজর নিংড়ানো রক্ত! শিল্পী বলতে চান–তবুও এখানে আকাশ বন্দী হয়নি। মরা বেড়ালের ছানাটাই এখানে শেষ কথা নয়, তবুও আছে আকাশ! এ ছবির মানে বুঝতে হলে শিল্পী যে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন সেই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তাকে দেখতে হবে!সব কথা আমি বুঝতে পারিনি; তবু বলেছিলাম, –বেশ, তাহলে তোর নামটা লিখে দে। নিয়ে যাই। গগ্যা হেসে বলেছিল, –মটুকু কোথাকার! আমার স্বাক্ষর তো রয়েছে ছবিতে। দেখতে পাচ্ছিস না? ঐ একমুঠো আকাশের নিঃসঙ্গ চিলটাই আমার স্বাক্ষর।
সেদিন আমার কাছে সবটাই পাগলের প্রলাপ মনে হয়েছিল।
.
বটুকের নিমন্ত্রণ রাখতে গিয়েছিলাম।
ভবানীপুর অঞ্চলে যোগেশ মিত্র রোডে। দ্বিতল বাড়ি, তার একতলায় দুখানি ঘর ভাড়া নিয়ে বটুক বাস করে। দক্ষিণ-চাপা ঘর, বটুক অবশ্য তাতে দুঃখিত নয়দখিনা বাতাসের চেয়ে নর্থ-লাইটটাই নাকি তার বেশি প্রয়োজন। সরু গলির ভিতর। তা হোক, ট্রামের ঘড়ঘড়ানি নেই। মনের একাগ্রতা নষ্ট হয় না। বাইরের ঘরটাই ওর স্টুডিও। পাশে ওর শয়নকক্ষ। পিছনে একফালি বারান্দা। তার ও-প্রান্তে রান্নাঘর। উঠানের ওপাশে স্নানাগার–সেটা দ্বিতলবাসীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়।
বটুক আমাকে আপ্যায়ন করে বসালো। ঘরে মস্ত একটা চৌকি, প্রায় ঘরজোড়া। তার উপর ফরাস। চৌকির উপর একটা কাঠের ডেক্সাে। বটুক ছবি আঁকে ভারতীয় পদ্ধতিতে চৌকিতে বসে, টুলে বসে নয়। রঙ, তুলি, রঙের বাটি একপাশে সাজানো। আর্টিস্টের স্টুডিও বলতে যে অগোছালো ছবিটা মনে ভেসে ওঠে এ-ঘরের সঙ্গে তার সাদৃশ্য নেই। দেওয়ালে অসংখ্য তৈলচিত্র। ওপাশে থাক দেওয়া আছে আরও অনেক ক্যানভাস। ডেকের উপর একটি ছবি খবরের কাগজে ঢাকা দেওয়া।
আমি ঘুরে ঘুরে ছবিগুলি দেখলাম। প্রথম যুগে অনেক স্টিল-লাইফ ও নিসর্গচিত্রও সে এঁকেছে দেখছি। ইদানিং কালে সে শুরু করেছে নারীচিত্র আঁকতে। বোধহয় বিবাহের পর থেকে। তন্ময় হয়ে ছবিগুলি দেখছি, হঠাৎ পিছন থেকে শুনলাম নারীকণ্ঠে, নমস্কার!
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি শিল্পীর স্ত্রীকে। সুলেখা দেবী। বছর ত্রিশ-বত্রিশ বয়স হবে। বটুকের চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট। ওঁকে দেখেই বুঝতে পারি কেন বটুক য়ুরোপীয় পদ্ধতির দিকে ঝুঁকেছে। ভদ্রমহিলার দেহসৌষ্ঠব মোটেই বাঙালী মেয়ের মত নয়। লম্বায় বটুকের চেয়ে অন্তত চার আঙুলের বড়। অথচ সেজন্য শীর্ণকায়া মনে হয় না। তাকে। হয়তো সন্তান হয়নি বলেই দেহের বাঁধুনি এখনও অটুট। পীনোদ্ধত উরস ও গুরু নিতম্বের মাঝখানে মধ্যে-ক্ষামা কটিদেশ। রঙ কালো; কিন্তু এতটুকু কুঞ্চন নেই গাচর্মে। চোখ দুটি গভীর, চিবুকটা নিখুঁত এবং মাথার চুল অজস্র। মাথায় ঘোমটা ছিল, : কিন্তু খোঁপা ছিল না। ঘন কালো কোকড়ানো চুল পাতলা শাড়ির মধ্যে দিয়েও দেখা যাচ্ছে গুরু নিতম্বে আছড়ে পড়েছে।
বটুক বললে, -কেমন হয়েছে বউ?
সুলেখা দেবী লজ্জা পেলেন। স্বামীর দিকে ফিরে বলেন, কথা বলার কি ছিরি! চোদ্দ বছর হয়ে গেছে মশাই-এখন কি আমি নতুন বউ?
বটুক তার কুতকুতে চোখ দুটো পিট পিট করে বলে, -চল্লিশ বছর পরেও তুমি নতুন বউ থাকবে! না কি বলিস দীপু?
আমি হেসে বলি, –তা জানি না, তবে এটুকু বলতে পারি পূজারিণী ছবিতে তুমি যদি কল্পনার আশ্রয় না নিতে তবে ভাল করতে।
একটু রাঙিয়ে ওঠেন সুলেখা দেবী। বলেন, বসুন, আমি ওদিকটা দেখি।
উনি আহারের আয়োজন করতে গেলেন। আমরা দুই বন্ধু গল্প করতে বসি। জিজ্ঞাসা করলাম, তুই এখন কি আঁকছিস?
বটুক মুখে জবাব দিল না। কাপড়ে মোড়া ক্যানভাসখানা খুলে চৌকির ও-প্রান্তে বসিয়ে দিল। বেশ বড় একখানা ক্যানভাস। ওর স্ত্রীর পোর্ট্রেট। মেয়েটি শুয়ে আছে খাটে-ঠিক শুয়ে নেই, অর্ধ-শয়ান। তার পিঠের নিচে একটা বালিশ, মাথার নিচে আর একটা। দুটি হাত মাথার উপর বেষ্টন করে আছে। পরিধানে একটা কল্কা পাড় বেনারসী শাড়ি। মাথার চুল খোলা বালিশের ওপর ছড়িয়ে রয়েছে। ছবিটা অসমাপ্ত।
আমি বললাম, -এখানা খুব ভাল ছবি হবে। হয়তো পোর্ট্রেট সেকশানে প্রাইজ পাবে।
বটুক তার ছোট ছোট চোখ দুটি তীক্ষ্ণ করে বললে, আচ্ছা দীপু, এ ছবিতে তোর চোখে কোন কিছু বিসদৃশ লাগল? কোন অসঙ্গতি?
বিসদৃশ? কই, না তো! আমার বরং মনে হচ্ছে ঠিক এই পোজে আঁকা পোর্ট্রেট আরও কোথাও দেখেছি। কোন বিখ্যাত শিল্পীর ঠিক মনে আসছে না।
হ্যাঁ, গইয়ার। ছবিটার নাম ডাচেস অফ আলভা। মাদ্রিদে আছে। কিন্তু আনন্যাচারাল কোন কিছু লাগছে না তো?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, কই, না!
–অথচ এই ছবিখানা নিয়েই গগ্যার উপর ভীষণ চটে গেছে বউ। ইন ফ্যাক আজ তাকেও নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিলাম আমি। বউ রাজী হল না। ও তাকে দুচোক্ষে দেখতে পারে না।
–তোর বউয়ের সঙ্গে গগ্যার আলাপ করিয়ে দিয়েছিস বুঝি?
-হ্যাঁ। ওকে একবার টেনে এনেছিলাম এখানে। তা সেই প্রথম দিন থেকেই ওকে । একেবারে শনির দৃষ্টিতে দেখছে সুলেখা। বলেছে, খবরদার তোমার বন্ধুকে আর বাড়িতে আনবে না।
আমি বলি, –গগ্যাটা যা ঠোঁটকাটা, কিছু বেঁফাস কথা বলে ফেলেছিল নিশ্চয়।
–তা ফেলেছিল। গগ্যাকে ছবিটা দেখাতেই বললে, -এ আবার কি রে? এমন পাটভাঙা বেনারসী পরে কেউ শুতে আসে? তাতে আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম, ঐ আশ্লেষ-শয়নার ভঙ্গিতে যে আমন্ত্রণ আছে সে কি নিদ্রাদেবীর? ও তো প্রসাধন সেরে দয়িতের প্রতীক্ষা করছে। আর হতভাগা ফস করে বললে, তাহলে বেনারসী কেন বাবারিয়ালিসমের চূড়ান্তই কর না কেন? ন্যুডস্টাডি আঁক! তখন বউ ছিল পাশের। ঘরে। কথাটা তার কানে গেছে।
আমি বলি, -গগনের অন্যায় হয়েছে।
নয়? আর শুধু কি তাই! আমার সবগুলো ছবি দেখে বললে, -মটকু, তোর তো পয়সার অভাব নেই বাবা। তুই একটা ক্যামেরা কিনে ফে হতভাগাটাকে তুলি ধরতে শেখালাম আমি, আর সেই আমাকেই
খেতে বসেছিলাম আমরা ভিতরের একফালি বারান্দায়। একজন পাঁচক ব্রাহ্মণ পরিবেশন করছিল। সুলেখা দেবী একটা হাতপাখা নিয়ে বসেছিলেন একটু দূরে। বলি, কই, মাংসের হাঁড়িকাবাব কই? শুনেছি আপনি খুব ভাল হাঁড়িকাবাব বানাতে পারেন
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বটুক বললে, দেখলে? আমি তখনই বলেছিলাম? তুমি বেশি পণ্ডিত্বেমি করলে?
ব্যাপার কি? একটু পরেই ব্যাপারটা বোঝা গেল। বামুনের জাত যাতে মারা না যায়, তাই বটুক একটি পাঁচক ব্রাহ্মণকে একদিনের জন্য ঠিকা নিয়েছে। রান্নায় হাত দেয়নি সুলেখা।
আমি বলি, –এটা উনিশ শো চব্বিশ সাল! আর আমি ডাক্তারমানুষ-অত জাতের পুতুপুতু নেই আমার। মাংসের হাঁড়িকাবাব কিন্তু আমার পাওনা থাকল সুলেখা দেবী!
সুলেখী দেবী বলেন, বেশ তো, আসছে রবিবার আসুন।
না, এবার আপনারা যাবেন আমার বাসায়। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার আলাপ হয়নি এখনও।
আহারান্তে সুলেখা দেবীকে পরীক্ষা করলাম। মাঝে মাঝে ওর ফিট হয়। হজমেরও গণ্ডগোল আছে। জনান্তিকে বটুককে বলি, –ছেলেপুলে না হলে ওঁর এ ফিটের ব্যারাম সারবে না। মেয়ে-ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে।
বটুক ভিতরের দিকে নজর দিয়ে দেখল; তারপর নিম্নস্বরে বলল, –ওর পেটে একবার সন্তান এসেছিল। বাঁচেনি।
কতদিন আগে?
অনেক আগে। প্রায় চোদ্দ বছর।
একটু চমকে উঠি। চোদ্দ বছর হল বিয়ে হয়েছে ওদের। জিজ্ঞাসা করি, বিয়ের আগে থেকেই ওঁকে চিনতিস বুঝি?
বটুক সচকিত হয়ে বলে, –পরে তোকে সব বলব।
.
সে কাহিনী আর শোনা হয়নি তখন।
আরও মাস চার-পাঁচ পরে আবার ওদের সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে গেল চৌরঙ্গীর উপর। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। হঠাৎ পিছন থেকে কে নাম ধরে ডাকছে শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি শ্রীমান বটুকেশ্বর। তিন-পিসের একেবারে কায়দা দূরস্ত বিলাতি সুট, হাতে ঘড়ি, মাথায় বাউলার হ্যাট। ওয়েস্টকোটের পকেটে রূপালি চেনে পকেট ঘড়ি।
কি হে ডাক্তারসাহেব? কোথায় চলেছ?
এতক্ষণে নজর হল বটুকের পাশেই যে মহিলাটি আছেন তিনি সুলেখা দেবী। সাজগোেজ তিনিও কম করেননি। বেনারসী শাড়ির আঁচলটা গেঁথেছেন জড়োয়া ব্রোচে, গায়ে পুরো-হাতা জ্যাকেট, পায়ে খুরওয়ালা জুতো-যা বাঙালী মেয়েরা পায়ে দিয়ে পথ চলতে সাহস পায় না। নমস্কার করে বলি, কী খবর? ভাল আছেন?
সুলেখী দেবী কিছু বলার আগেই বটুক বলে ওঠে, -এবারে একজিবিশান দেখেছিস? আয় না, একসঙ্গে দেখা যাক। সুলেখা এবার প্রাইজ পেয়েছে যে
সুলেখা?–আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি।
–আই মীন সুলেখার সেই ছবিখানা। সেই পোর্ট্রেটখানা। চল দেখাই।
আজ ওর আনন্দের দিন। তিন-চার বছর প্রদর্শনীতে ওর ছবি থাকছে, এই প্রথম সে প্রাইজ পেয়েছে। আমার অনেক কাজ ছিল হাতে। বিয়ের বাজার করতে বেরিয়েছি। কিন্তু সেকথা ওদের বললাম না। রাজী হয়ে গেলাম। বটুক আমাকে নিয়ে গেল প্রদর্শনীতে। ছাপানো প্রোগ্রাম বই সে-ই কিনল। আমাকে এক একখানা করে দেওয়ালে টাঙানো ছবি দেখিয়ে নানা জ্ঞানগর্ভ আর্টের তত্ত্ব বোঝাতে থাকে। সুলেখা দেবী সঙ্গে সঙ্গে আছেন। যতদূর মনে পড়ছে সেবার অসিতকুমারের সুরের আগুন, সমরেন্দ্র গুপ্তের নটরাজের মন্দিরে, যামিনীবাবুর গণেশজননী আর দেবীপ্রসাদের বুদ্ধের নির্বাণ প্রদর্শিত হয়েছিল। আর প্রতিযোগিতার বাইরে দেখানো হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের শাজাহানের মৃত্যু। গগনেন্দ্রনাথের একখানি ছবি ছিল; তার গঠন পদ্ধতিটা ঠিকমত বুঝলাম না। বটুক বলল, এটা একটা নতুন পদ্ধতি, এর নাম ভারতীয় শিল্পকলায় চতুষ্কোণবাদ।
–এ নাম কে দিয়েছে?
স্টেলা ক্রামরীশ বলেছেন, এ হল ইণ্ডিয়ান কিউস্টিক ছবি। কিউবিস জানিস তো? বছর আট-দশ আগে একবার বার্লিন থেকে ক্যানডিস্কি আর জার্মান কিউবিস্টদের ছবি এনে সোসাইটিতে দেখানো হয়েছিল। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই চিত্রকরদের উদ্দেশ্য আর আদর্শের কথা বুঝে নিয়ে নিজস্ব ধ্যানধারণায় আর স্বকীয় পদ্ধতিতে এই নতুন চতুষ্কোণবাদের রূপ দিয়েছেন।
এর পরে সে কিউবিস্মের গোড়ার কথায় এল। সেখান থেকে ডাডাইস ইম্প্রেশনিস সুররিয়ালিস কত নূতন নূতন তথ্য। সুলেখার কাছে বোরিং হয়ে যাচ্ছে। মনে করে একসময় বলিজানিস দীপু, এই ঘরে ঠিক ঐ জায়গাটায় বছর পাঁচেক আগে একটা মজার কাণ্ড হয়। আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী। সেবার বার্ষিক প্রদর্শনীতে গগনেন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন খানকতক কার্টুন ছবি। কার্টুন আঁকায় তিনি ওস্তাদ, তা তো জানিসই, একটা ছবি ছিল বিবাহ-বিশারদাঁ কুলীন বামুনদের আক্রমণ করে, একটা ছিল ইঙ্গবঙ্গ বাবুদের ব্যঙ্গ করে, আর একখানার ক্যাপশান ছিল পীস ডিক্লেয়ার্ড ইন দ্য পঞ্জাব। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের উপর। নরকঙ্কাল আর নরমুণ্ডে আকীর্ণ জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠ। দু-একটি বুড়ো শকুন ঝিমোচ্ছে। আর মড়ার খুলির পাহাড়ে শান্তভাবে অর্ধশয়ান ইংরাজশাসক ওডায়ার! তা সেবার বড়দিনে কলকাতায় এসেছিলেন ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড। বড়লাটকে প্রদর্শনীতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা হল। কেউ কেউ বললেন, পাঞ্জাবের উপর কার্টুনখানি সরিয়ে রাখলেই ভাল হয়। কিন্তু অবন-গগন তা মানবেন কেন? অগত্যা ছবিখানা থাকল যথাস্থানে। লর্ড চেমফোর্ড এলেন। প্রদর্শনীর বড়কর্তারা সঙ্গে সঙ্গে চলেছেন। ক্ষিতীনদা আছেন, স্যার আর. এন. আছেন, অতুল বসু ছিলেন, গগনেন্দ্রনাথ, ও. সি. গাঙ্গুলীরা ছিলেন–আর আমিও ছিলাম দলের সঙ্গে। স্টেলা। ক্রামরীশই প্রতিটি চিত্রের ইন্ট্রোডাকশান হিসাবে দু-চার কথা বলতে বলতে আসছিলেন। ব্যঙ্গচিত্রটির কাছে এসে তিনি নীরব হলেন। বড়লাট হয়তো খেয়াল করতেন না। ঐ নীরবতাই তার দৃষ্টিটা আকৃষ্ট করল দৃশ্যপটের দিকে। হঠাৎ যেন হোঁচট খেয়েছেন। বড়লাট। থমকে পিছিয়ে আসেন। ঘুরে দেখেন ক্রামরীশের দিকে। তিনি হেসে বলেন, –আই শ্যডন্ট, অফ কোর্স, ট্রাই টু অ্যানালাইস এ কার্টুন অ্যাণ্ড মার ইটস্ হিউমার! লাটবাহাদুর ঝুঁকে পড়ে দেখলেন চিত্রকরের স্বাক্ষর। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন নির্ভীক চিত্রকরও দাঁড়িয়ে আছেন পাশে। মাথায় কাজ করা টুপি, গায়ে সিল্কের জোব্বা। উপযুক্ত খুড়োর উপযুক্ত ভাইপো। খুড়ো যদি অত বড় নাইটহুড ছাড়তে পারেন তবে ভাইপো একখানা ছোট্ট মতো কার্টুন ছাড়তে পারবেন না! সুলেখা দেবী বললেন, –চল, এবার ও-ঘরের ছবিগুলো দেখি।
চল। ওটা হচ্ছে ইণ্ডিয়ান আর্ট সেকশান।
কিন্তু সেদিকে অগ্রসর হতে গিয়েই বাধা পেলাম আমরা। মঁসিয়ে পল গগ্যা তার বিশাল বপু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দোরগোড়ায়। আমাদের দেখতে পেয়ে তার প্রকাণ্ড দেহটি বিনয়াবনত করে বলেন, কী সৌভাগ্য! একসঙ্গে ত্রিরত্ন! আর্টিস্ট, আর্ট সমঝদার আর আর্ট মডেল?
ভু দুটি কুঁচকে ওঠে সুলেখা দেবীর। গগ্যার ঐ প্রকাণ্ড দেহটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে সে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। যেন গগ্যাকে সে দেখেনি। বটুক বলে, –দেখলি?
-আমি তো দেখলাম, কিন্তু উনি বোধ হয় আমার মত ক্ষীণদেহী নগণ্য জীবকে দেখতে পেলেন না।
না, আমি বলছি একজিবিশান দেখলি?
–তাও দেখলাম। চল, আবার দেখি তোদের সঙ্গে।
এই এক ফ্যাচাং জুটল। বটুক কিন্তু নির্বিকার। বেশ বুঝতে পারি বটুকের স্ত্রী বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু পথে-ঘাটে দেখা হলে বটুকই বা কি করবে? আমরা চারজনেই পাশের ঘরে ঢুকি। বটুক গগ্যাকে বলে, –এবার আমার একখানা ছবি প্রাইজ পেয়েছে।
–প্রাইজ পেয়েছে? কই, কোনখানা?
সুলেখার পোর্ট্রেটখানা।
–ও তো কনসোলেশান প্রাইজ। ও, ঐটার কথা বলছিস! আমি ভেবেছি কোন ছবি প্লেস পেয়েছে বুঝি?
সুলেখা দেবী ফস করে বলে বসেন, –আপনার ছবি কোন্ ঘরে আছে গগনবাবু?
গগ্যা ঘুরে দাঁড়ায়। আপাদমস্তক সুলেখা দেবীকে দেখে নিয়ে বলে, –আমার ছবি এখানে নেই।
সাবমিট করেছিলেন সিলেকশান পাননি, না কি সাবমিট করবারই সাহস হল না।
গগ্যা ম্লান হেসে বলে, না, আমি কোন ছবি দাখিলই করিনি।
–গতবার করেছিলেন, না? সিলেকশান পায়নি?
–না, গতবারও আমি সাবমিট করিনি। করেছিল বটুক।
—-আপনার বিনা সম্মতিতে?
-না, সম্মতি ছিল; কিন্তু আমি জানতাম ওরা আমার ছবির মানে বুঝবে না–
এবার সুলেখা দেবী তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, –ঐ ধারণাটাই বুঝি আপনার তরফে কনসোলেশান প্রাইজ?
গগ্যা জবাব দিল না। এক নম্বর হার হল বোধ হয় তার।
ছবি দেখতে দেখতে আমরা এসে উপস্থিত হই পোর্ট্রেট সেকশানে। অতুল বসুর একটি ছবি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। দ্বিতীয় প্রাইজ পেয়েছেন দক্ষিণ ভারতের কে একজন চিত্রশিল্পী–নাম ভুলে গেছি। বটুক পেয়েছে কনসোলেশান প্রাইজ! ছবিটা বেশ ভালই উৎরেছে। আমি এটা অর্ধসমাপ্ত দেখেছিলাম মাস কয়েক আগে। গগ্যা ছবিটা দেখে হঠাৎ সুলেখা দেবীর দিকে ফিরে বললে, আজকের দিনে ঐ বেনারসীটা না পরে এলেই পারতেন। ঐ দেখুন সবাই আপনার দিকে তাকাচ্ছে! এতক্ষণে লক্ষ্য হয়, চিত্রে বটুক যে বেনারসীখানা এঁকেছে সেখানাই পরে এসেছেন সুলেখা দেবী। কিন্তু এভাবে গগ্যার বলা উচিত হয়নি। সুলেখা দেবী কিন্তু ভ্রূক্ষেপ করলেন না, বেশ সপ্রতিভভাবে বললেন, আপনি নিজেকে আর্টিস্ট বলে পরিচয় দেন, অথচ রূপসজ্জার এই ফাণ্ডামেন্টাল কথাটাই জানেন না? সজ্জার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরের দৃষ্টি নিজের দিকে আকর্ষণ করা। এই যে আপনি দাড়ি কামান না, চুলে তেল দেন না এর বেসিক মোটিভটা কি? ব্লেড কেনবার পয়সা নেই, দুপয়সার সরষের তেল কিনতে পারেন না বলে তো নয়! আপনি পাঁচজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান। বলতে চান–ওগো তোমরা আমাকে চিনে নাও, আমি আর্টিস্ট! আমার ছবি একজিবিশানে সিলেকটেড না হলেও আমি বোহিমিয়ান আর্টিস্ট!
শুধু গগ্যাই নয় আমিও অবাক হয়ে যাই। সুলেখা দেবী কি রীতিমত লেখাপড়া জানা মেয়ে?
গগ্যার এবারও বাক্যস্ফুর্তি হল না। দু নম্বর হার হল তার।
সুলেখা দেবী হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বললেন, বড্ড স্টাফি লাগছে, চলুন বাইরে গিয়ে কোথাও বসি।
হঠাৎ গগ্যার দিকে ফিরে বলেন, –আচ্ছা চলি, নমস্কার।
অর্থাৎ- তুমি আমার লেজুড় ধরে সঙ্গে সঙ্গে এস না বাপু!
গগ্যা নক-আউট!
.
১০.
এই সময়ে, বুঝলে নরেন, নিতান্ত ঘটনাচক্রে একদিন আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল চন্দ্রভানের। শ্যামবাজারের দিকে একটি রোগী দেখতে গিয়েছিলাম। রোগী দেখে কর্ণওয়ালিস্ স্ট্রীট ধরে মেডিক্যাল কলেজে ফিরছি, হঠাৎ নজর হল হেদোর ধারে একটা প্যাকিং বাক্সের উপর বসে আছে আমারই বয়সী একজন লোক। দেখেই চেনা চেনা লাগল, পরমুহূর্তেই চিনে ফেললাম তাকে। প্রায় বিশ বছর পরে তাকে দেখছি, কিন্তু চিনতে আমার ভুল হয়নি। এ নিশ্চিত সেই চন্দ্রভান। গাড়ি থামিয়ে নেমে এলাম। লোকটা চুপ করে বসে আছে কী ভাবছে। গায়ে একটা হাফ-সার্ট, তার উপর আলোয়ান, নিম্নাঙ্গে একটা পাৎলুন–পায়জামার মত ক্রীজহীন। পায়ে ছেঁড়া চটি। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ; চুলে বহুদিন তেল চিরুনি পড়েনি। বয়সে বেড়েছে, বেশ রোগাও হয়ে গেছে সে। জমিদার বাড়ির আলালের ঘরের সেই দুলালটির চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট নেই। ওকে চিনতে পারলাম ওর সেই অদ্ভুত চোখ দুটো দেখে। আর কান দুটো। চন্দ্রভানের কান দুটো যেন ওর বিদ্রোহী আত্মার বিজয় কেতন। সহজে ভুল হবার নয়!
-কি রে, চিনতে পারিস?
ও কি যেন ভাবছিল আপন মনে। চমকে ওঠে আমার ডাক শুনে। তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় প্যাকিং বাক্সটা ছেড়ে। বলে, আরে! তুই দীপু না?
জড়িয়ে ধরল একেবারে। ম্যাট্রিক পাস করার পর পাক্কা উনিশ বছর কেটে গেছে। আমার কোন সংবাদই সে রাখত না। ওর সম্বন্ধে আমিও তখন বিশেষ কিছু জানতাম না। লোকমুখে শুনেছিলাম, সে সংসার ছেড়ে বিবাগী হয়ে গিয়েছিল। আর শুনেছিলাম সে নাকি ধর্মত্যাগ করে খ্রীষ্টান হয়ে গেছে। আর কিছু জানতাম না।
-তুই যে একেবারে সাহেব হয়ে গেছিস রে, অ্যাঁ? মটোর গাড়ি? তোর? কিনেছিস?
আমার নিখুঁত স্যুট আর গাড়িটা সে দেখছিল। ঈর্ষার কণামাত্র লক্ষ্য হল না ওর বিস্মিত দৃষ্টিতে। সে যেন খুব খুশি হয়েছে আমার এ উন্নতিতে। বললে, তুই আজকাল কি করছিস রে দীপু? তোর খবর বন্?
ডাক্তার হয়েছি আমি। মেডিক্যাল কলেজে অ্যাটাচ আছি। প্রাইভেট প্র্যাকটিও করি।
বাঃ! বাঃ! তুই তা হলে জীবনে সফল হয়েছিস! ভারি ভাল লাগছে শুনে।
–তুই এখানে বসে কি করছিলি?
চন্দ্রভান হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল হেদোর রেলিঙে টাঙানো একগাদা ছবি। রেলিঙের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে দড়ি খাটানো। তাতে ক্লিপ দিয়ে আটকানো খান দশ বারো ছবি। ফ্রেম নেই, বাঁধানো নয়। কিছু পেনসিল স্কেচ, কিছু ক্রেয়নে, খান তিনেক জলরঙে। এছাড়া রেলিঙের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা আছে খান চার-পাঁচ তেলরঙের ক্যানভাস। হায় ঈশ্বর! শেষে চন্দ্রভানও ছবি আঁকতে শুরু করল? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিগুলো দেখলাম। কয়েকটি নিসর্গ দৃশ্য। একটা ভাঙা গীর্জা, পশ্চাৎপটে কি একটা ফ্রেম-স্ট্রাকচার, তাতে গোল গোল দুটো চাকা। দেবদারু গাছের সারির মাঝখান দিয়ে রাঙা মাটির আঁকাবাঁকা পথ। কতকগুলি কুলি রমণীর ছবি। জনা-কতক সাঁওতাল গোল হয়ে বসে বোধকরি হাঁড়িয়া খাচ্ছে। সাঁওতালী নাচের পালা–মাদল বাজাচ্ছে, বাঁশি বাজাচ্ছে, মেয়েরা নাচছে। একটা কাঠের সাঁকো নিচেকার জলে সাঁকোটা প্রতিবিম্বিত, একটা নৌকা, কজন জলে কাপড় ধুচ্ছে, সাঁকোর উপর একটা এক-ঘোড়ার গাড়ি। আর একটা তেল রঙের ছবি–মাঝখানে জ্বলছে কেরোসিনের টেমি, তিনটি কুলি রমণী ও একজন পুরুষ গোল গোল ডিমের মত কি যেন খাচ্ছে; চিত্রকরের দিকে পিছন ফিরে বসে আছে একটি বছর আষ্টেকের মেয়ে, চিত্রের কেন্দ্রস্থলে।
নেহাৎ মামুলি ছবি সব। বিষয়বস্তুতে আকর্ষণীয় কিছু নেই। তবে রঙের ব্যবহারটাতে সাহসের পরিচয় আছে। কখনও কখনও তুলির সোজা টান না দিয়ে সে পাশাপাশি বিন্দু বিন্দু রঙের ফুটকি বসিয়েছে। কখনও বা বিশেষ করে অয়েল কালারে, রঙ লাগিয়েছে রীতিমত ধ্যাবড়া করে লিনসিড অয়েল-তৃষিত কাঁচা রঙ বোধহয় আঙুলে করে থুপ থুপ করে বসিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের রঙের ব্যভিচার আমি ইতিপূর্বে কখনও দেখিনি।
-কেমন লাগছে?
সেই চিরন্তন সমস্যা! নবীন সাহিত্যিক, নবীন শিল্পীর বন্ধুদলের এ এক সর্বকালের সমস্যা। মুখ ফুটে বলাও যায় না যে, মোটেই ভাল লাগছে না! একটু ঘুরিয়ে বলি, স্টাইলটা নতুন, কিন্তু এ কি পাবলিকে নেবে?
–পাবলিকের জন্য তো আঁকিনি আমি!
–তাহলে হেদোর ধারে সাজিয়ে বসেছিস কেন?
চন্দ্রভান ম্লান হাসে। বুঝতে পারি তার সমস্যা। সাধারণ মানুষে ছবি কেনে না, কেনে রাজা মহারাজা জমিদার এবং বিলাতি কোম্পানির ধনকুবেররা। তাদের নাগাল কেমন করে পাবে চন্দ্রভান? তাছাড়া তারা এ জাতীয় ছবি পচ্ছন্দই করবে না।
–ছবির কথা থাক। তোর খবর বল্। কোথায় আছিস?
চন্দ্রভান বললে, সে কাছেই থাকে। ঠিকানা জানাল না।
বিয়ে করেছিস?
এবার সে হাসল। বললে, করেছি। তুই তো ডাক্তার হয়েছিস দীপু, একটা উপকার করবি?
-কি বল্?
–ওকে একবার ডাক্তার দিয়ে দেখাতে চাই।
–বেশ তো, নিয়ে যাস একদিন। হাসপাতালে কিংবা আমার বাড়িতে
— ছাপানো কার্ড বার করে দিলাম। সেটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে মুখ নিচু করেই বললে, –তোকে দিয়ে দেখানো চলবে না, কোন লেডি ডাক্তার তোর জানাশোনা আছে?
আমি হেসে উঠি। বলি, –তোর বউ পর্দানশীন নাকি? তুই না খ্রীষ্টান হয়েছিস? তোর বউও তো আলোকপ্রাপ্তা? না কি?
না রে! ও কিছুতেই পুরুষমানুষের সামনে বের হতে চায় না। সে অনেক ব্যাপার। তোকে পরে সব বলব একদিন। কোন মেয়ে ডাক্তার হলে
-কি হয়েছে তোর বউয়ের? অসুখটা কি?
–না, অসুখ কিছু নয়। ওর…ছেলেপুলে হবে।
–আচ্ছা! কংগ্রাচুলেশন্স! এই কি ফার্স্ট কনফাইনমেন্ট? প্রথম সন্তান সম্ভবনা?
না। এর আগেও একটি ছেলে হয়েছিল। সেটি মারা গেছে।
জন্মাবার সময়?
–না না। অনেক বড় হয়ে প্রায় আট বছর বয়সে।
–ওঃ! অনেকদিন বিয়ে করেছিস তাহলে। তা এত বছর আর বাচ্চা হয়নি?
না।
-বুঝলাম। তা তুই কালই ওকে হাসপাতালে নিয়ে আয়। আমি ব্যবস্থা করে দেব। ভয় নেই, আমি ঘোমটা দিয়ে থাকব। মেডিক্যাল কলেজে একজন লেডি ডাক্তার। আছেন। ডক্টর মিসেস স্মিথ। কাল তার ভিসিটিং ডে। তুই সোজা আমার ঘরে চলে আসিস।
পরদিনই চন্দ্রভান সস্ত্রীক মেডিক্যাল কলেজে এসে হাজির। স্লিপ দেখে আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। চন্দ্রভানকে নিয়ে এলাম। মিসেস স্মিথের ঘরে। আমার চেম্বারের বাইরে বেঞ্চিতে যারা সারি সারি বসেছিল তাদের মধ্যে একজনকে চন্দ্রভান ইঙ্গিতে আহ্বান করল। উঠে এলেন একজন মহিলা। মুখের উপর এত প্রকাণ্ড ঘোমটা তিনি দিয়েছেন যে, চন্দ্রভানের বউ দেখা আমার হল না, তবে হাত-পাগুলি অনাবৃত ছিল। তাতে মালুম হল, চন্দ্রভান যদি কখনও বটুকেশ্বরের মত তার বউয়ের ছবি আঁকতে বসে তাহলে তার প্রয়োজন হবে একটি মাত্র রঙ-চাইনিস ইংক। বলিষ্ঠগঠনা। দীর্ঘাঙ্গী। নিঃসন্দেহে তার ফিগারটি অনিন্দ্যনীয়, যদিও বর্তমানে তাকে মধ্যে-ক্ষামা বলার উপায় নেই।
মিসেস স্মিথের কাছে ওকে জিন্মা করে আসার আগে বলি, কাল আবার আসিস। ইতিমধ্যে মিসেস স্মিথের কাছ থেকে প্রাথমিক রিপোর্টটা আমি শুনে নেব।
প্রাথমিক রিপোর্টটা আমাকে গরজ করে শুনতে যেতে হল না। ভিসিটিং আওয়ার শেষ হলে ডক্টর মিসেস স্মিথ নিজেই চলে এলেন আমার ঘরে। আমারও রোগী দেখার পর্ব শেষ হয়েছিল। উঠব উঠব করছি, হঠাৎ উনি আসায় আবার বসে পড়ি। উনি বলেন, ডক্টর লাহিড়ী মিস্টার গর্গ কি আপনার বিশিষ্ট বন্ধু?
-হ্যাঁ, আমার সহপাঠী। আমরা একসঙ্গে আর্য মিশন স্কুলে পড়তাম।
–তারপর? তারপর আপনাদের বন্ধুত্বটা কি পর্যায়ে আছে?
-কেন বলুন তো? ম্যাট্রিক পাস করার পর আর ওর খবর কিছু জানতাম না। গতকাল মাত্র দেখা হয়েছে। একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?
মিসেস স্মিথ একটু ইতস্ততঃ করে বলেন, না, কিছু নয়। ওঁর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ, নয়?
-হ্যাঁ। অথচ ও জমিদারের ছেলে। সব ছেড়ে-ছুঁড়ে ও বিবাগী হয়ে যায়।
জমিদারের ছেলে! ও, তাই বলুন!
কেমন যেন অসংলগ্ন কথাবার্তা ওর। মনে হল কি একটা কথা উনি বলি বলি করেও বলতে পারছেন না। অমন একটা লোফারের সঙ্গে আমার মত ডাক্তার মানুষের বন্ধুত্বটা ঠিকমত বরদাস্ত করতে পারছিলেন না বোধ হয়।
মিসেস গর্গকে কেমন দেখলেন বলুন? কোন কমপ্লিকেশান আছে?
এতক্ষণে মুখ তুলে মিসেস স্মিথ চাইলেন আমার দিকে। বললেন, –আছে! কিন্তু চিকিৎসাটা আপনাকে করতে হবে, আমার দ্বারা সম্ভবপর নয়!
এ আবার কি হেঁয়ালি? আমাকে প্রশ্ন করতে হল না। উনি এক নিঃশ্বাসে বলে যান, চিকিৎসার প্রয়োজন ওর স্ত্রীর নয়, মিস্টার গর্গের। আর সে ওষুধটা আপনার পক্ষে প্রয়োগ করাই বাঞ্ছনীয়।
-কি ওষুধ?
–শঙ্কর মাছের চাবুক!
আমি স্তম্ভিত। কি বলছেন উনি? কী বলতে চাইছেন?
মিসেস স্মিথ নিঃশব্দে একটি রিপোর্ট আমার সামনে বাড়িয়ে ধরেন। দেখলাম লেখা আছে-রোগিণী মিসেস গর্গ, বয়স ছত্রিশ, ওজন একশ বারো পাউণ্ড, গর্ভস্থ ভ্রূণের বয়স পঁচিশ সপ্তাহ, এবং আসন্ন জননী উপদংশ রোগে আক্রান্ত!
–ওঁর স্ত্রী নিতান্ত গ্রাম্য মহিলা। কথায় জড়তা আছে। লজ্জায় জড়সড়। বোধকরি আপনার বন্ধু তাকে নিয়ে কোনদিন থিয়েটার্স দেখতেও যান না, পর্দানশীন যে! আর এদিকে নিজে প্রস্ কোয়ার্টার থেকে নিয়ে এসেছেন এ রোগ–চাপিয়ে দিয়েছেন নির্বিচারে একটা অসহায় মেয়ের দেহে। মাপ করবেন ডক্টর লাহিড়ী-আপনার বন্ধু বলে আমি রেয়াৎ করব না। হান্টার পেটা করা ছাড়া ও রোগের চিকিৎসা নেই!
আমি জবাব দিতে পারিনি। জবাব ছিলও না কিছু। সেই চন্দ্রভান এত নিচে নেমে গেছে?
পরদিন আবার চন্দ্রভান এল হাসপাতালে। ঘরে ঢোকবার মুখেই দেখি বেঞ্চির কোণ দখল করে বসে আছে। আমাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে কিছু একটা কথা বলতে চায়। আমি দেখেও দেখি না। সোজা ঢুকে পড়ি চেম্বারে।
একটু পরে আর্দালি খানকতক স্লিপ রেখে গেল টেবিলে। সবার উপরে চন্দ্রভানের চিরকুট। আমি সেটা বাঁ-হাতে সরিয়ে রাখি। থাক বসে। অন্যান্য দর্শনপ্রার্থীদের একে একে বিদায় করতে থাকি। একটি বেলা ওকে বসিয়ে রেখে উঠবার উপক্রম করছি, আর্দালি পুনরায় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল স্লিপ কাগজটার দিকে।
-এর আউটডোর টিকিট কোথায়? এখানে কি চায়?
–না স্যার, উনি এমনিই দেখা করতে চান। বললেন, আপনার বন্ধু।
বন্ধু! নাঃ! এ অধ্যায়ের শেষ করতে হয়। না হলে সকাল-সন্ধ্যা নোকটা বিরক্ত করবে, যেখানে-সেখানে পরিচয় দেবে ডাক্তার দ্বৈপায়ন লাহিড়ী ওর বন্ধু। ঐ চরিত্রহীন, ইন্দ্রিয়াসক্ত লম্পট লোকটা–যে বেশ্যাপল্লী থেকে কুৎসিত ব্যাধি বয়ে নিয়ে এসে সেটা ধর্মপত্নীর দেহে পাচার করেছে তার সঙ্গে সব সম্পর্ক এখনই চুকিয়ে নেওয়া দরকার।
–ডেকে দাও।
চন্দ্রভান পর্দা সরিয়ে ঢুকল। সে নিশ্চয় কিছু আন্দাজ করেছে। বিনা অনুমতিতে বসল আমার ভিসিটার্স চেয়ারে। কেমন যেন গোরু চোরের মত আতঙ্কিত দৃষ্টি। কান দুটো খরগোশের মত খাড়া হয়ে আছে। একমুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
-কি চাই?
একেবারে থতমত খেয়ে গেল চন্দ্রভান। ঢোক গিলে বললে, না, মানে কাল তুই আসতে বলেছিলি কিনা? ইয়ে মিসেস স্মিথ কি বললেন? কোন কমপ্লিকেশান নেই তো?
আমি ওকে বসতে বললাম না। বরং নিজেই উঠে পড়ি। হ্যাঙার থেকে কোটটা পেড়ে গায়ে দিতে দিতে বলি, কপ্লিকেশান যে আছে তা তুমি জান না?
ও বোকার মত তাকিয়ে থাকে। অস্ফুটে বলে, না! কী?
-তোমার স্ত্রী একটি কুৎসিত ব্যাধিতে ভুগছেন, এ কথা তোমার জানা নেই বলতে চাও?
বিশ্বাস কর দীপু, আমি কিছুই জানি না!
ও আমাকে বিশ্বাস করতে বলছে! স্ত্রীর উপদংশ রোগ হয়েছে, তা স্বামী জানে না! ঘুরে দাঁড়িয়ে বলি, –তোর লজ্জা হয় না স্কাউণ্ড্রেল? সমাজে মুখ দেখাস কি করে?
ওর মুখটা একেবারে ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলে, কী বলছিস?
ন্যাকা! কতদিন ধরে প্রস্ কোয়াটার্সে যাচ্ছিস?
মাথাটা নিচু হয়ে গেল ওর।
-কই, তুই তো বললি না–প্রস্ কোয়ার্টার্সে আমি জীবনে যাইনি দীপু!
মুখটা তুলল না। মাথা নিচু করেই বলল, -মিছে কথা আমি বলি না। আমি শুধু ভাবছি তুই কেমন করে জানতে পারলি!
–রোগ চাপা থাকে না। ও-রোগের চিকিৎসা হচ্ছে চাবুক। চাবকে শায়েস্তা করলে তবে ও রোগ ছাড়বে। তবে আমার ওসব ভাল লাগে না। আমার সময়ও নেই, ধৈর্যও নেই। অন্য কোন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাস।
একটি কথাও বলল না চন্দ্রভান। মুখ তুলে চাইল না পর্যন্ত।
আর একটা কথা। আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও আজ এখানে শেষ হল।
–আর কোনদিন এখানে আসব না, এই কথা বলতে চাস?
না। এটা সরকারী হাসপাতালও কথা বলার অধিকার আমার নেই। তবে ডাক্তার দ্বৈপায়ন লাহিড়ীর বন্ধুর পরিচয়ে এখানে আর এস না।
এতক্ষণে চন্দ্রভান হাসল। পাণ্ডুর ম্লান হাসি। বললে, ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি।
বলল বটে, কিন্তু চলে গেল না। জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর আপন মনে বললে, আজব এ দুনিয়া! ক্রিশ্চান ফাদারদের দেখলাম–পাপের সঙ্গে দিব্যি আপস করেছেন তারা, যত আক্রোশ পাপীর উপর, আর কে পাপী তাও চিনতে পারছেন না! আজ আবার মেডিক্যাল কলেজের পাস করা ডাক্তারদের দেখলাম রোগের বিরুদ্ধে তাদের কোন জেহাদ নেই, যত আক্রোশ রোগীর উপর, আর কে রোগী তাও চিনতে পারছেন না তারা।
–তার মানে? তুই নিরোগ? ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বল্ দেখি তোর রতিজ রোগ নেই?
–তা আমি বলব না দীপু। কারণ ঈশ্বরকে আমি মানি না! ঈশ্বরের নামে শপথ নিই না আমি!
-না, মিস্টার ভিন্সেন্ট ভান গর্গ! আমি কালী-দুর্গা-মা শীতলার দিব্যি দিতে বলছি না তোমাকে। তোমাদের গড-দি-ফাদারের নামে ওথ নিতে বলছি।
-হ্যাঁ, আমি ও তাঁর কথা বলছি! ঈশ্বর মানি না আমি! আমি নাস্তিক!
-খুব আনন্দের কথা! সমাজ মানো না, ধর্ম মানো না, ঈশ্বরও মানো না! বাঃ! বেশ কথা, তবে দয়া করে ঐ সঙ্গে আরও একটি জিনিস অস্বীকার কর–আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা!
চন্দ্রভান জবাব দেওয়ার সুযোগ পায়নি। পরক্ষণে আমি নিজেই ঘর ছেড়ে চলে যাই।