Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আবার যদি ইচ্ছা কর || Narayan Sanyal » Page 4

আবার যদি ইচ্ছা কর || Narayan Sanyal

গগন পালের গল্প বলি এবার। গগন চরিত্রটিকে আমি ঠিকমত বুঝে উঠতে পারিনি। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে যা শুনেছি তাই লিখে যাওয়া। দাদু বলেছিলেনঃ

..বুঝলে নরেন, গগন ছেলেটা চিরকালই ছিল একটু ডাকাবুকো ধরনের। আপনমনে থাকত সে, কারও সাতে-পাঁচে নেই। পড়াশুনায় মন ছিল না। টিকিয়ে ঢিকিয়ে ক্লাস প্রমোশন পেত। মাস্টার মশাইদের হাতে চড়টা-চাপড়টা ছিল তার নিত্য বরাদ্দ; কিন্তু অসুরের মত শক্তি ছিল ওর গায়ে—চড়-চাপড়ে বড়-একটা কিছু হত না। খুব চাপা। ধরনের ছেলে; আমরা আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা আলোচনা করতাম, ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখতাম এবং বন্ধু মহলে তাই নিয়ে কথাবার্তাও হত। সে সব আড্ডায় গগনটা স্রেফ চুপচাপ বসে থাকত, অথবা মাঠ থেকে চোরকাটা উপড়ে নিয়ে তার উঁটি চেবাতো। গায়ে পড়ে কেউ যদি তাকে জিজ্ঞাসা করে বসে বড় হয়ে সে কী হতে চায়, তবে জবাবে বলত, ঝাঁট দে ওসব কথা! ঐ তার এক মুদ্রাদোষ! সব কথাতেই শুধু ঝাঁট দে! ভালমন্দ সব কিছুই সে ঝেটিয়ে বিদায় করতে চায়। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় আমাদের চার বন্ধুর মধ্যে একমাত্র সেই ফেল করে। কিন্তু সান্ত্বনা দেওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। কদিন তার দেখাই পাইনি। পরে শুনলাম, সে দেশে চলে গেছে। দেশ কোথায়, সেখানে কে আছে কিছুই জানতাম না। এমন চাপা ধরনের ছেলে ছিল সে। প্রথম প্রথম আমরা আশা রেখেছিলাম, দেশে গিয়ে সে নিশ্চয় আমাদের চিঠি দেবে। তা সে দেয়নি। এতদিনের স্কুল-জীবনের বন্ধুত্ব সে বুঝি ঝেটিয়েই বিদায় করে দিল।

মাঝে মাঝে হয়তো ওর কথা উঠে পড়ত। কেউ হয়তো বলত, –পল্ গগ্যার খবর জানিস?

আমরা বলতাম, –সে বেটা দেশে গিয়ে ম্যালেরিয়ায় উজাড় হয়েছে নিশ্চয়। না হলে একটা পোস্টকার্ড অন্তত লিখত।

গগন পালের ডাকনাম ছিল গগ্যা। আমরা ওর উপাধিটা সামনের দিকে পাচার করে মাঝে মাঝে সাহেবি-ঢঙে ওকে ডাকতাম পল্ গগ্যা। তা সেই পল গগ্যার সাক্ষাৎ আবার পেয়েছিলাম অনেক অনেকদিন পরে। ঢাকা শহরে। সেটা বোধহয় উনিশশো তেইশ বা চব্বিশ। তার মানে তখন আমার বয়স চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ; গগন চল্লিশ ছোঁয় ছোঁয়। ডাক্তারী পাস করে আমি তখন ঢাকায় প্র্যাকটিস্ করি। বুড়িগঙ্গার সমান্তরালে একটি খাল বেঁকে এসে শেষ পর্যন্ত ঐ বুড়িগঙ্গাতেই পড়েছে। রেলগুমটি থেকে খোয়া বাঁধানো যে পাকা রাস্তাটি ঐ খালকে অতিক্রম করে সদরঘাটের দিকে চলে গেছে তারই উপর রায়সাহেবের বাজার। ওখানেই ছিল আমার ডিপেনসারী। জনসন রোডের উপর, মসজিদটার কাছাকাছি। ঢাকা কোর্ট থেকে নবাবপুর রোড পর্যন্ত অনেকগুলি পরিবারেই আমি ছিলাম পারিবারিক চিকিৎসক। জনসন রোডের পশ্চিমপারে মোটামুটি হিন্দুদের বাস, পূর্বপারে মুসলমানদের। আমার ডাক্তারখানাটা ছিল মুসলমান মহল্লার কাছাকাছি। সবাই শ্রদ্ধা করত, সম্মান করত। পসারটা ক্রমে রেললাইনের ওপারেও বিস্তৃত হতে শুরু করেছিল। এই সময় একদিন পুরাননা-পল্টন এলাকা থেকে আমার একটি ডাক এল। ডাকতে এসেছিল বছর বারো-তের বয়সের একটি কিশোর ছেলে। অসুখ তার ছোট বোনের। ছেলেটিকে দেখেই মনে হয়, এ যেন আমার চেনা-চেনা! মুখের আদলটা যেন আমার পরিচিত। তখন স্বপ্নেও ভাবিনি, এ আমাদের সেই গগন পালের ছেলে। চুলগুলো রুক্ষ, চোখ দুটো উজ্জ্বল। ও এসেছিল একটা সাইকেলে চেপে। সীটে বসতে পারে না, হাফ-প্যাড করতে করতে এতটা পথ চলে এসেছে। আমাকে ডেকে নিয়ে যেতে। আমিও তখন সাইকেলে চেপে রুগী দেখতে যেতাম। ব্যাগটা কেরিয়ারে বেঁধে নিয়ে আমি রুগী দেখতে গেলাম। ঐ ছেলেটিই পথ চিনিয়ে নিয়ে গেল। এতদিন পরে অবশ্য ঠিক মনে নেই, মেয়েটির কী অসুখ করেছিল, তবে সে আমার চিকিৎসাতেই শেষ পর্যন্ত সেরে ওঠে। ঐ সূত্রে আলাপ হয়ে গেল পরিবারটির সঙ্গে। ছেঁড়া-বেড়ার দেওয়াল, উপরে করগেট-টিন-পাশাপাশি দু-খানি ঘর। পিছনে উঠান পার হয়ে রান্নাঘর। দরজার ধারে লক্ষ্য পড়েছিল নেমপ্লেটটার উপর। তাতে গৃহস্বামীর নয়, গৃহকত্রীর পরিচয়টাই ঘোযিত। মিসেস্ শান্তি পাল, বি. এ.। স্থানীয় মেয়েদের স্কুলে শিক্ষয়িত্রী ছিলেন তিনি। বছর ত্রিশেক বয়স, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, বেশ সপ্রতিভ এবং সুরুচিশীলা। বাইরের ঘরেই রোগিণী শুয়েছিল। সে ঘরে খান-তিনেক ছবি-রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও শরৎচন্দ্রের। পিছনের দেওয়ালে হুক থেকে টাঙানো একটি কিংখাবে মোড়া সেতার অথবা সরোদ। জানলার পর্দাতেই সেলাই-এর কাজ। সে-আমলে সেলাই-এর কাজ বলতে আমরা বুঝতাম কার্পেটের অথবা চটের উপর পাড়ের সুতো দিয়ে বোনা পতি পরম গুরু জাতীয় গুরুতর বাণী। মনে হল, এ ভদ্রমহিলার রুচি সূক্ষ্মতর।

গৃহকর্তা বলে যাকে প্রথমটা ভুল করেছিলাম দেখা গেল তিনি গৃহকর্তীর ফুলদা। ঝোলা গোঁফ, গলার কণ্ঠীটা কথা বলার সময় নড়তে থাকে, মাথায় পরিপাটি টেরি। তিনি অযাচিত কয়েকটি মন্তব্য করলেন। আমাকে ইনজেকশান দেওয়ার পরামর্শ দিলেন, এবং পথ্য সম্বন্ধে একটা মন্তব্য করবার চেষ্টা করতেই গৃহকত্রী তাঁকে বললেন, তুমি একটু বাইরে নজর রাখ ফুলদা, ওঁর সাইকেলটা নিয়ে কেউ না পালায়।

ফুলদা অতঃপর আমার সাইকেলটাই পাহারা দিলেন। ঔষধ-নির্দেশ ভদ্রমহিলাকেই দিতে হল। ভিজিটও তিনি দিলেন এবং রোগী দেখার পর সেই কিশোর ছেলেটি আমার পিছন পিছন ডাক্তারখানায় এল, এবং ওষুধটা সার্ভ করিয়ে নিয়ে গেল।

গৃহস্বামীর সাক্ষাৎ পাইনি। ভদ্রমহিলার সিঁথিতে নির্দেশ ছিল তিনি কোথাও না কোথাও আছেন। সম্ভবত ঢাকায় নেই-নাহলে সেকথা উঠত। ওঁরা সে প্রসঙ্গ যখন তুললেন না তখন আমিও তা তুলিনি। বস্তুত প্রথমদিন সেকথা আমার মনেই পড়েনি। পড়েছিল পরে। চার-পাঁচ বার ওবাড়িতে যেতে হয়েছিল আমাকে। কোনবারই গৃহস্বামীর সাক্ষাৎ পাইনি। কিন্তু নেপথ্যচারী গৃহস্বামীর উল্লেখ কেউ না করায় সৌজন্যবোধে আমিও কোনদিন ও-প্রশ্ন করিনি। করতে হল কদিন পরে। মেয়েটি ভাল হয়ে যাবার পর আবার একদিন সেই কিশোর ছেলেটি আমাকে আমন্ত্রণ করতে এল– সান্ধ্য চায়ের নিমন্ত্রণ। প্রশ্ন করলাম, হঠাৎ চায়ের নিমন্ত্রণ?

-মিষ্টি ভাল হয়ে উঠেছে কিনা, তাই মা সত্যনারায়ণ করেছেন।

–চা দিয়ে সত্যনারায়ণের সেবা হয় নাকি?

–ছেলেটি হাসল। জিজ্ঞাসা করি, তোমার নামটি কি?

–শ্রীরাধাগোবিন্দ পাল। ডাকনাম বাবলু।

সত্যনারায়ণের সির্নীর সঙ্গে গোকুল পিঠে, চন্দ্রপুলি, কড়াই শুটির কচুরি ও চা এল।

সেদিন প্রশ্ন করেছিলাম, মিস্টার পাল কোথায়?

শান্তি দেবীকে জবাব দিতে হয়নি। তাঁর ফুলদা আগ বাড়িয়ে বলে ওঠেন, সে গেছে দোকানে। সেই সক্কাল বেলা যায় দোকানে, আর ফিরতে যার নাম সেই রাত দশটা। মস্ত দোকান দিয়েছে যে ভায়া! দেখেননি? শান্তি স্টোরস-ঐ রমনার দিকে!

শান্তি দেবী বললেন, ফুলদা, একটা দেশলাই কিনে আন না!

আঁচল খুলে একটি একানি বার করে দিলেন তিনি।

ফুলদা বেজার হলেন; কিন্তু যেতে হল। এই ফুলদা ব্যক্তিটি সংসারে নিতান্ত উদ্বৃত্ত, এবং শান্তি দেবী তাকে আমার দৃষ্টির আড়ালে রাখতে চান। তাছাড়া হঠাৎ এখন দেশলাই কেনার এমন জরুরী প্রয়োজন কি হল তা বুঝে উঠতে পারিনি। শান্তি দেবীর কাছেই শুনলাম পালমশাই রমনার দিকে একটি মনিহারী দোকান দিয়েছেন। রমনা অঞ্চলে দ্রুতহারে হাল-ফেশানের নতুন নতুন বাড়ি উঠছে। দুদিনেই এলাকাটা জমজমাট হয়ে উঠবে। এই সুযোগে একটি দোকান খুলে বসেছেন মিস্টার পাল। আখেরে কাজ দেবে সেটা। তখনও কল্পনা করতে পারিনি, এই দোকানদারই আমার সহপাঠী সেই ঝাঁটদেনেওয়ালা গগন পাল।

সেদিনই ওঁর টেবিলের উপর একটা মাসিক পত্রিকা দেখেছিলাম। সেটা তুলে নিয়ে বলি, –প্রগতি? এটা কি ঢাকা থেকে বের হয়?

–বের হয় নয়; বের হল! ওটাই প্রথম সংখ্যা। খবর পাননি?

না, সাহিত্য আলোচনা করবার আর অবকাশ কোথায় আমার? আমি তো নিতান্ত ডাক্তার মানুষ। তবে এককালে খুব ঝোঁক ছিল।

আসুন না আমাদের প্রগতিতে। আসবেন?

বলি, আপনার ঘরে তিনজন দিকপাল সাহিত্যিকের ছবি দেখেই বুঝতে পেরেছি। আপনি সাহিত্যরসিকা; কিন্তু আমার কি সময় হবে?

শান্তি দেবী বিচিত্র হেসে বলেছিলেন, সময়ের অভাবটা উপলক্ষ-আসল কথা ইচ্ছেটা।

বলি, -দেখি, সুযোগ সুবিধা হয় তো–

আরও মাস তিনেক পরের কথা। মনে আছে সেটা চৈত্র মাস। বাবলু এসে আমাকে একটি হাতে-লেখা নিমন্ত্রণ-চিঠি দিয়ে গেল। মুক্তোর মত ঝরঝরে হাতের লেখা। বাবলুর মা আমাকে নিমন্ত্রণ করেছেন–ওঁর বাড়িতে সন্ধ্যায় একটি সাহিত্যবাসর হবে। তাতে যোগদানের জন্য।

আমি তখন সিউডো ব্যাচিলর। তোমার দিদিমা তখন কলকাতায় কল্যাণী অথবা খোকা সেবার হবে। সন্ধ্যার পর আমার অখণ্ড অবসর। শেষ রুগীটিকে বিদায় দিয়ে তাই সাহিত্য-আসরে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। আড্ডাটা ওঁদের বৈঠকখানায় বসেনি, বসেছিল বাড়ির পিছনের উঠানে। সমস্ত দিনমান দাবদাহের পর দিব্যি দখিনা বাতাস দিতে শুরু করেছে; রাতটাও চাঁদনি, শুক্লপক্ষের। শান্তি দেবী কয়েকজন নবীন সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলেন। আট-দশজন পুরুষ আর জন-তিনেক মহিলা। গান হল, স্বরচিত কবিতা পাঠ হল, প্রবন্ধও পড়লেন কেউ কেউ। কোথা দিয়ে তিন-চার ঘন্টা সময় কেটে গেল টের পেলাম না। শান্তি দেবী নিজে কোন অংশ নিলেন না দেখে আমি বলি, -এবার আপনার একখানা গান হোক–

–গান? আমি জীবনে কোনদিন গান গাইনি! বলেন শান্তি দেবী।

আমি বলি, সেকথা কে বিশ্বাস করবে বলুন? আপনার বাইরের ঘরে কিংখাবে মোড়া যন্ত্রটা আপনার বিরুদ্ধে নীরব সাক্ষী।

যন্ত্র? কী যন্ত্রণা! ওটা আমি বাজাই না, উনি বাজান।

একজন আগন্তুক ভদ্রলোক বলেন, ভাল কথা, দাদা কোথায়? গগনদা?

গগনদা? আমি সচকিত হয়ে উঠি।

-হ্যাঁ। শ্রীগগনবিহারী পাল। এ বাড়ির খোদ কর্তা। আপনি যে গগন থেকে পড়লেন ডাক্তারবাবু!

আমি বলি, বলেন কি? গগন পাল? আচ্ছা, উনি কি কলকাতার আর্যমিশন স্কুলে পড়তেন?

প্রশ্নটা শান্তি দেবীকে। তিনি বলেন, -আর্য মিশনে পড়তেন কিনা জানি না, তবে ছাত্রাবস্থায় কলকাতাতেই ছিলেন, বাগবাজারের দিকে।

আমি বলি, -কী আশ্চর্য! এটা গগনের বাড়ি? গগন যে আমার…তা তিনি কখন ফিরবেন?

–ওঁর ফিরতে সেই যার নাম রাত দশটা। দোকান বন্ধ করে ফেরার পথে আজ উনি একটি টিউশানি সেরে আসবেন।

–ও বুঝি প্রাইভেটে ছেলে পড়ায়?

শান্তি দেবী বলেন, ছেলে নয়, মেয়ে; আর পড়ান নয়, গান শেখান।

তবে এ গগন পালই। প্রাইভেট ট্যুইশানি শুনে একটু হতাশ হয়েছিলাম। আর্য মিশনে যে জ্ঞান সে অর্জন করেছে তাতে ছেলে পড়ানোর আশা কম। কিন্তু হতভাগার গানবাজনার দিকে বরাবরই একটা ঝোঁক ছিল। খালি গলাতেই চমৎকার গাইতে পারত, আর পারত সুন্দর আড়বাঁশী বাজাতে। কিন্তু খবরটা কি করে জানা যায়? ওর বাবার নাম জানি না। কোথায় দেশ তাও জানি না। মরিয়া হয়ে বলি, –ওর কপালে কি একটা কাটা দাগ আছে?

শান্তি দেবী জবাব দেন না। নিঃশব্দে উঠে যান ঘরে। একটু পরে ফিরে আসেন একখানি বাঁধানো ফটো সমেত। বিয়ের পরে তোলা ছবি। যুগলে। বরবধূ বেশ। ক্যামেরাম্যানের নির্দেশটা বেশিমাত্রায় মেনেছে গ্যগা–এক গাল হেসেছে সে। লাফিয়ে উঠি আমি, -এই তো গগ্যা! এ যে আমার বিশিষ্ট বন্ধু!

দেবেনবাবু হেসে বলেন, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। বিশিষ্ট বন্ধু না হলে ঢাকা শহরের দুপ্রান্তে দুজনে এমন গা-ঢাকা দিয়ে ঘুরছেন?

সবাই সমস্বরে হেসে ওঠে।

চিড়ে ভাজার প্লেটটি নামিয়ে রেখে আমি উঠে পড়ি।

বলি, এখনও আমার দুচারটি রুগী মরতে বাকি আছে। ফেরার পথে তাদের একটু খোঁজখবর নিয়ে যেতে হবে। আজ উঠি। আপনাদের কাব্যালোচনা চলুক। শান্তি দেবীর দিকে ফিরে বলি, -গগ্যাকে বলবেন কাল সকালেই যেন আমার ডিপেনসারীতে এসে চা খেয়ে যায়। উফ্ কতদিন দেখিনি ওকে! আপনাদের সাহিত্যের ভাষায় শতাব্দীর পঞ্চমাংশ!

গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন শান্তি দেবী। বিদায় নমস্কার করে বললেন, –আবার আসবেন।

-এবার তো আপনাদের যাওয়ার কথা। এখন তো আপনি আমার বন্ধুপত্নী। তবে আপনাকে এখনই আমন্ত্রণ করছি না। আমার বেটার হাফ কলকাতা গেছেন। তাই আপাততঃ কর্তাটিকেই পাঠাবেন রিটার্ন ভিজিট দিতে। কাল সকালেই।

-বলব। তবে আপনার খেয়ালী বন্ধুকে তো চেনেন!

বাগানটা পার হয়ে সাইকেলে উঠতে যাব, পিছন থেকে আওয়াজ হল, ডাক্তারবাবু নাকি?

দাঁড়িয়ে পড়ি। শান্তি দেবীর ফুলদা। খাপটি মেরে বসেছিলেন কালভার্টের উপর। এগিয়ে এসে বলেন, –মাচিস্ আছে ডাক্তারবাবু আপনার পকেটে?

দেশলাইটা বার করে দিলাম। ফুলদা সেটি গ্রহণ করে নিজের ফতুয়ার পকেট তল্লাশি করে বললেন, -দূর ছাই, বিড়ির বাণ্ডিলটাও ফেলে এসেছি।

বাধ্য হয়ে প্যাকেট থেকে একটি বার্ডস-আই বার করে দিলাম। উনি ধন্যবাদ জানিয়ে মৌজ করে সিগারেট ধরালেন। আমি রওনা দিলাম।

পরদিন সকালে কিন্তু গগ্যা এল না। তার পরদিনও নয়। ক্রমে দিন সাতেক কেটে গেল। আমিও ওদিকে যাবার কোন সুযোগ করতে পারিনি। দিন দশেক পরে রমনার দিকে যাচ্ছি রুগী দেখতে। সকাল তখন গোটা দশেক হবে। নবাবপুর রোড ধরে চলেছি সাইকেল চেপে। লেভেল-ক্রসিং পার হয়ে পুরানো পল্টনের ফাঁকা মাঠটা ডাইনে রেখে রমনার দিকে মোড় নিতে গিয়েই মনে পড়ল গগ্যার কথা। হতভাগাটা এল না কেন? শরীর খারাপ হয়ে থাকলে সবার আগে আমারই খবর পাওয়ার কথা। ডান দিকেই মোড় নিলাম। সেটা ছুটির দিন। শান্তি দেবী বাড়ি ছিলেন। ছেলেমেয়েরাও। আমাকে দেখতে পেয়ে মিষ্টি চিৎকার করে ওঠে, –মা, ডাক্তারবাবু এসেছেন।

আর ডাক্তারবাবু নয় রে, পাগলি! এবার থেকে ডাক্তারকাকু বলবি।

শান্তি দেবী বোধকরি রান্নাঘরে ছিলেন। হাতটা ধুয়ে আঁচলে মুছতে মুছতে এসে বসেন, আসুন, আসুন।

-না, আমি আসব না আজ। গগ্যা কোথায়?

–সে তো এই একটু আগেই দোকানে চলে গেল।

–আজ ছুটির দিনেও দোকান?

ছুটির দিন বলে কি আপনারই রেহাই আছে?

তা বটে। দোকানদার অথবা ডাক্তারের আবার ছুটির দিন কি? বলি, অভিযোগ আছে। এখন বলুন, আসামী কে? আপনি, না আপনার কর্তা? আপনিই বলতে ভুলেছেন, না সে-ই যেতে ভুলেছে?

-যায়নি সে?

–কেন, গেলে আপনি জানতে পারতেন না? ফিরে এসে গল্প করত নিশ্চয়?

বিচিত্র হেসে শান্তি দেবী বলেন, স্কুল জীবনে ও বুঝি খুব গপ্পুড়ে ছিল?

আমি জবাব দিইনি। দোকানের নামটা জানা ছিল। অবস্থানটা জেনে নিয়ে ফের রওনা হয়ে পড়ি। হতভাগাটাকে কষে গালাগাল দিতে হবে। ওকে খুঁজে বার করবই। শান্তি স্টোরস্ খুঁজে পেতে অবশ্য আমাকে বেগ পেতে হয়নি। যে আমলের কথা বলছি তখন ওখানে দোকান-পাট একেবারেই ছিল না। কিন্তু দোকানেও তার দেখা পেলাম না। দোকানে সে নেই। ছিল একজন কর্মচারী। বছর ষোলোসতেরর একজন কিশোর। নাম বললে, প্রফুল্ল। বললে–আজ্ঞে না, বাবু তো আসেননি।

ছোট্ট দোকান। বিস্কুট, লজেন্স, খাতা-পেন্সিল, স্নো-পাউডারের আয়োজন। কাঠের তাকে সাজানো। সামনে একটা গ্লাস-কেস। এতটুকু দোকানে এই জনহীন প্রান্তরে ওর কতই বা বিক্রি হয়, যে একজন কর্মচারী রেখেছে? যাক, আমার কি! প্রফুল্লকে নিজ পরিচয় দিয়ে বললাম, বাবু এলে বল–আমি এসেছিলাম। রুগী দেখতে যাচ্ছি। ফেরার পথে আবার খোঁজ নিয়ে যাব।

ফিরতে আমার রীতিমত বেলা হয়ে গেল। কিন্তু দোকানে তার দেখা পেলাম না। তখনও সে আসেনি। ফেরার পথে ওর বাড়িতে আবার খোঁজ নিলাম। শান্তি দেবী একটু অবাক হলেন যেন। বলেন, –সে কি! এখনও দোকানে আসেনি? কি জানি তাহলে কোথায় গেছে!

মোটকথা, আমার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা হল না।

সেদিন হয়নি, হয়েছিল তার পরদিন।

সকালবেলা দোকান খুলে সবে বসেছি, হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল গগ্যা। প্রায় বিশ বছর পরে ওকে দেখলাম। বেশ বদলে গেছে। সেটাই স্বাভাবিক। প্রকাণ্ড দৈত্যের মত চেহারা হয়েছে তার। মাথায় আমার চেয়ে এক বিঘৎ লম্বা। চুলগুলো পিছনে ফেরানো-একটুও পাক ধরেনি। ইয়া চওড়া কাঁধ, ইয়া বুকের ছাতি। কে বলবে ওর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। আমি আনন্দে লাফিয়ে ওঠার আগেই ও আমার টেবিলটা ধরে হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে কড়া স্বরে বললে, —-আমার পিছনে লেগেছিস কেন?

অবাক হয়ে বলি, -কী বলছিস রে গগ্যা?

-বলছি, কাল দুবার আমার বাড়িতে গিয়ে বলে এসেছিস আমি দোকানে যাইনি, আর দুবার দোকানে গিয়ে বলে এসেছিস আমি বাড়িতে নেই। কেন? আমার পিছনে গোয়েন্দাগিরি করা ছাড়া কি তোর কাজকর্ম নেই?

হাসব না রাগ করব বুঝে উঠতে পারি না। গগ্যাটা চিরকালই পাগল। ওর কথাগুলো চিরদিনই কড়া কড়া। বলি, চটছিস কেন রে? ধরা পড়ে গেছিস বলে? কোথায় গিয়েছিলি সত্যি করে বল তো? কোন ছাত্রীকে গান শেখাতে নয় নিশ্চয়!

গগ্যা ইতিমধ্যে বসে পড়েছিল চেয়ারটায়। চট করে উঠে দাঁড়ায়। বলে, দীপু, আমি তোদের সাতে-পাঁচে নেই–তুই কেন আমার সব ব্যাপারে নাক গলাচ্ছিস?

আমি রীতিমত ঘাবড়ে যাই। গগ্যা যদি প্রেম করে বেড়ায় তাতে আমার কি? বললাম সেকথা, কী পাগলামি করছিস গগ্যা? এতদিন পরে দেখা, আর তুই ঝগড়া করছিস এমনভাবে? আচ্ছা, তুই কী রে–কোন্ ডাক্তার তোর মেয়েকে চিকিৎসা করল তার নামটা পর্যন্ত বউকে জিজ্ঞাসা করিসনি?

–কেন করব না? আমি তো জানতামই তুই মিণ্টির চিকিৎসা করছিস।

এবার আর অবাক নয়, আহত বোধ করলাম। বলি, তাহলে তুই আমার পরিচয় এই কমাস ধরে জানিস? সে ক্ষেত্রে আমার সঙ্গে দেখা করিসনি কেন?

ঝাঁট দে ওসব ছেঁদো কথা! আমি তো তোর মত নই যে, পরের রোজগারে নাক গলাব!

তার মানে?

তার মানে মিষ্টি যে আমার মেয়ে একথা জানতে পারলে তুই ফি নিতে পারতিস?

–তা হয়তো পারতাম না। সে লোকসান অন্যভাবে পুষিয়ে যেত। পঁচিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্বটা ফেরত পেতাম।

গগ্যা বলে, -থাক ভাই, পুরানো বন্ধুত্বের জের আর নাই টানলি! তোদের কাব্যপাঠ, সাহিত্য-আলোচনা আর প্রগতিচর্চায় আমি ভাগ বসাতে চাই না। দয়া করে তোমরা যদি আমাকে নিজের মত থাকতে দাও তাহলেই আমি ধন্য।

আমি বলি, সমাজে বাস করতে হলে সামাজিকতার দায় তোকে মিটিয়ে দিতে হবে। বইকি।

গগ্যা বলে, –আমি তোদের সামাজিকতার ধার ধারি না। সোজা কথা বলে যাচ্ছি। দীপু, আমার ব্যাপারে নাক গলাতে এলে ভাল হবে না কিন্তু!

যাবার জন্য ও পা বাড়ায়।

আমি পিছন থেকে ডাকি, যাচ্ছিস কোথায়? না হয় তোর ছাত্রীদের ব্যাপারে আর নাক গলাব না; কিন্তু এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যা।

না। চায়ের পর আসবে সিগারেট; তারপর নস্যি। তারপর আবার নাক সুরসুর করবে তোমার। ওসব ছেঁদো সামাজিকতার জড় একেবারে গোড়াতেই ঝাঁট দিয়ে ফেলা ভাল।

ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল গগ্যা।

বলা বাহুল্য রীতিমত মর্মাহত হয়েছিলাম আমি। ব্যাপার কি? গগ্যা এভাবে আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে কেন? নিঃসন্দেহে ওদের দাম্পত্য জীবনে কোথাও গোলমাল আছে। গগ্যা সুখী নয়। বোধকরি শান্তি দেবীও নন। মনে পড়ে গেল, সেদিন আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন—ও বুঝি ছেলেবেলায় খুব গপ্পুড়ে ছিল? কিন্তু কেন ওদের মনের মিল হয়নি? বোধ হয় শান্তি দেবীর সাহিত্যকাব্য আলোচনা, তাঁর প্রগতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটা গগন পছন্দ করত না। গগ্যা ম্যাট্রিক ফেল, ওর স্ত্রী বি. এ. পাস। এটাই কি অশান্তির কারণ? না কি ওর স্ত্রীর রোজগার ওর চেয়ে বেশি বলে? মেয়ে স্কুলের শিক্ষয়িত্রী হিসাবে শান্তি দেবী বোধকরি মাসান্তে যতগুলি মুদ্রা নিয়ে আসেন তার অর্ধেকও আনতে পারে না সে তার দোকান থেকে। কিন্তু তাহলে দোকানে একজন কর্মচারী রেখেছে কেন? যাই হোক, বেশ বোঝা যাচ্ছে গগ্যা আমাদের পুরানো বন্ধুত্বের। জের টেনে চলতে চায় না। ছেলেটা চিরকালই রুক্ষ প্রকৃতির-কাঠ কাঠ কথা বলতে ওস্তাদ। শান্তি দেবীর কোন দোষ নেই; কোন মেয়েই বোধহয় ওকে সুখী করতে পারত না, সুখী হত না ওকে পেয়ে। সে যা হোক, মন থেকে গগ্যাকে বিদায় দিলাম ওর ভাষায় ঝাঁট দিয়ে দিলাম।

.

ক্রমশঃ ওর কথা ভুলেই গেলাম। তখন অন্য একটা ব্যাপারে আমার মন এমনিতেই বিভ্রান্ত হয়ে ছিল। আমার ডাক্তারখানাটা জনসন রোডের পশ্চিম পারে। বাজারের উপর। রাস্তার পুব পারে মুসলমানদের বাস। কিছুদিন আগে ঐ অঞ্চলে একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মত হয়ে গেছে। সিনেমা হলের সামনে একটি হিন্দু যুবক বেমক্কা খুন । হয়ে গেল। হিন্দু পাড়াতে তার বদলাও নেওয়া হয়েছে। অনেক শুভানুধ্যায়ী বলছেন, এ দোকানটা ছেড়ে আমি যেন হিন্দু মহল্লায় উঠে যাই। আমি ডাক্তার মানুষ–একা থাকি; আর্ত মানুষের কোন ধর্ম নেই। ম্যালেরিয়ায় কাঁপুনি যখন ধরে তখন নেড়ের দাড়ি আর কাফেরের টিকি সমানভাবে দুলতে দেখি! কিন্তু দাঙ্গাটা একটু ঘোরালো হয়ে ওঠার পর বেশ দুশ্চিন্তায় আছি। এ মহল্লার কয়েকজন বর্ধিষ্ণু মুসলমান ভদ্রলোক কাজী ওদুদ সাহেব, মৌলভি জিয়াউদ্দিন সাহেব প্রভৃতি একদিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমার ডাক্তারখানায় এলেন। আমাকে নানাভাবে আশ্বাস দিয়ে গেলেন। আমি যেন অন্যত্র যাওয়ার কথা না ভাবি। ওঁরা জান দিয়ে আমাকে রক্ষা করবেন। এদিকে কলকাতা থেকে বাবা লিখছেন, আমি যেন ঢাকার বাস তুলে দিয়ে সেখানেই ফিরে যাই। বাবা প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছেন। বয়স হয়েছে তার। আমি যেন গিয়ে তার শূন্য আসনে অধিষ্ঠিত হই এবং তার পসারের সুযোগটা গ্রহণ করি। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর তাই স্থির হল। ঢাকার পাঠ তুলেই দেব। শুনে অনেকেই ক্ষুব্ধ হলেন; দুঃখ প্রকাশ করলেন।

প্রায় মাসখানেক পরের কথা। একদিন বাজারে দেখা হয়ে গেল শান্তি দেবীর ফুলদার সঙ্গে। আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বলেন, ডাক্তারবাবু না? কই, আর তো আসেন না আপনি? কেমন আছেন?

সৌজন্যবোধে বলতে হল, –ভাল আছি। ওঁরা কেমন আছেন প্রশ্ন করা মাত্র ফুলদা যেন লাফিয়ে ওঠেন, –আমাদের কথা আর বলবেন না ডাক্তারবাবু। গগনটা তো মানুষ নয়, চামার! কোথায় কোথায় ঘোরে পাত্তাই পাওয়া যায় না। ছেলেমেয়েগুলোও হয়েছে। তেমনি। শিক্ষার বালাই নেই। আমি হলাম গিয়ে তোদের মামা, তা আমাকেও ছেড়ে কথা বলে না। ফুলমামা বাজার থেকে ফেরার সময় একটা খাতা কিনে এন, ফুলমামা আমার জন্য একটা লাল ফিতে কিনে এন। কেন রে বাবা? আমি কি তোদের খানাবাড়ির চাকর? আসল কথা কি জানেন–আসলে মায়ের শাসন না থাকলে ছেলেমেয়েগুলো কখনও মানুষ হয়? নিজের বোন হলে কি হয় ওর নাম শান্তি নয়, অশান্তি হওয়া উচিত—

বাধা দিয়ে বলি, -শান্তি দেবী আপনার নিজের বোন?

না, নিজের বোন নয়। মামাতো বোন। তাও দূর সম্পর্কের মামা নয়, ওর বাবা হল আমার মায়ের আপন পিসতুতো ভাই। একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ কিনা।

পিসতুতো ভাইয়ের আপন পিসতুতো বোন? সম্পর্কটা ঠিক বোধগম্য হল না। একান্নবর্তী সংসারটা কার ছিল? কার অন্ন কে ধ্বংস করত? তা অতীতের সে কথা বোঝা না গেলেও বর্তমানটা বেশ পরিষ্কার। বর্তমানে ফুলদা ঐ শান্তি দেবীর অন্ন ধ্বংস করে থাকেন এবং তিনি যে বাজার-সরকার নন এটা প্রমাণ দিতে তিনি উদগ্রীব।

পাশ কাটাবার জন্য বলি, আচ্ছা, চলি ফুলদা।

যাবেন? তা যাবেন বৈকি। আপনারা হলেন কাজের মানুষ। পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে দুদণ্ড কথা বলারই বা সময় কই আপনার। তবে একটা কথা। আমি যে শান্তির নামে আপনাকে এসব কথা বলেছি তা যেন ওকে বলবেন না। ভারি অভিমানী মেয়ে তো!

ভয়ও করে তাহলে। করবে নাই বা কেন? বেকার মানুষটার ঐ তো একমাত্র ভরসাস্থল। পিসতুতো মামার মাসতুত বোনের কী একটা ক্ষীণ সম্পর্ক ধরে দুনিয়াদারী করতে হচ্ছে বেচারিকে। সর্বক্ষণই তাই সে কাঁটা হয়ে থাকে। হয়তো পদে পদে তাকে ধমক খেতে হয় কর্তার কাছে, গিন্নির কাছে, মায় ছেলেমেয়েদের কাছে।

-ডাক্তারবাবু!

আবার ফিরতে হল। একটু ইতস্ততঃ করে ফুলদা আবার বলেন, আপনার কাছে একটা টাকা হবে ডাক্তারবাবু? একখানা খাতা আর ফিতে নিয়ে যেতে বলেছিল ওরা, অথচ বাজার করতে সব ফুরিয়ে গেল।

বুঝতে পারি ফুলদার অবস্থা। আহার এবং আশ্রয় জুটেছে। হাত-খরচটাই সমস্যা। একটা আধুলি বার করে দিলাম। ফুলদা তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিলেন পরদিনই তিনি সকাল বেলায় এসে ধারটা শোধ করে যাবেন।

ভেবেছিলাম ঢাকা ছেড়ে চলে যাবার আগে শান্তি দেবীর সঙ্গে একবার দেখা করে যাব। গগন নয়, তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে আসব। বাঁধাছাদা এবং নানান বৈষয়িক ব্যাপারে ব্যাপৃত থাকার সময় করে উঠতে পারিনি। হঠাৎ একদিন সকালে তার স্কুলে যাবার পথে গগ্যার ছেলে এসে হাজির। এবার আর হাতচিঠি নিয়ে আসেনি, মুখেই বললে, -মা আপনাকে একবার যেতে বলেছেন।

বললাম, হ্যাঁ যাব, দু-একদিনের মধ্যেই। আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি বাবলু। আর হয়তো তোমাদের সঙ্গে দেখাই হবে না কোনদিন।

বাবলুর তাতে কোন ভাবান্তর হল না। বললে, না, দু-একদিন পরে নয়, মা এখনই একবার আপনাকে যেতে বলেছেন।

-কেন? কারও অসুখ করেছে নাকি?

বাবলু মুখটা নীচু করে নখ খুঁটতে খুঁটতে বললে, না, অসুখ নয়। বাবা হঠাৎ দিন চারেক আগে কলকাতা চলে গেছেন। কী একটা বিশ্রী মামলা বেধেছে। আমি ঠিক জানি, না। আপনি এখনই একবার আসুন ডাক্তারকাকু।

–এখনই? কিন্তু এখন তো তোমার মা স্কুলে যাবেন?

না, মা আজ কদিন স্কুলে যাচ্ছে না। ছুটি নিয়েছেন।

–তোমার ফুলমামা কোথায়?

বাড়িতেই আছেন। ফুলমামাও কলকাতায় যেতে চেয়েছিলেন, মা যেতে দেননি। ঐ বাবার ব্যাপারে

হঠাৎ মাঝপথেই থেমে গেল বাবলু। অবাক হয়ে দেখি, ওর দুটি চোখ জলে ভরে উঠেছে। ব্যাপার কি? কিসের মামলায় জড়িয়ে পড়ল গগন? বাবলু আমার দিকে পিছন ফিরে চোখ দুটি মুছে নেয়। আর লজ্জা লুকাতে তখনই সাইকেলে চেপে রওনা হয়ে পড়ে। আমিও দোকান তালাবন্ধ করে পুরানো পল্টনের দিকে যাত্রা করি।

ওদের বাড়িতে গিয়ে যা শুনলাম তা রীতিমত বিভ্রান্তিকর। ঘরে ঢুকতে প্রথমে দেখা হয়ে গেল ফুলদার সঙ্গে। আজ আর তাঁর সেই সাবেকি গোরুচোরের ভঙ্গি নয়। ক্যাম্বিসের ইজিচেয়ারে অর্ধশয়ান হয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে কী যেন গভীরভাবে চিন্তা করছিলেন তিনি। আমাকে দেখতে পেয়ে দগ্ধাবশেষ বিড়িটায় একটা অন্তিম সুখটান দিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন জানলা পার করে।

আসুন, আসুন ডাক্তারবাবু, বসুন।

আমি বেতের একটা মোড়া টেনে নিয়ে ভাল করে বসতে না বসতেই একেবারে ঝুঁকে পড়লেন আমার দিকে। যেন অত্যন্ত গোপন কোন কথা হচ্ছে এভাবে প্রায় আমার কানে কানে বলেন, -গগনের সঙ্গে আপনার শেষ কবে দেখা হয়েছে?

দিন দশেক আগে। মিসেস পাল কোথায়?

–ও, দশদিন আগে?-ফুলদা আবার লম্বমান হয়ে পড়েন ইজিচেয়ারে। আমার প্রশ্নটা ওঁর কানে যায়নি। আবার গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন উনি। চোখ দুটি বুজে যায়। বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে কপালে ধীরে ধীরে টোকা মারতে থাকেন।

ওঁর এই গাম্ভীর্যে বিরক্তবোধ করি। হঠাৎ এই ভাব পরিবর্তনটাও কেমন যেন বিসদৃশ লাগে। তাই পুনরায় বলি, মিসেস্ পালকে একটু ডেকে দিন। শুনলাম গগন কী একটা বিশ্রী মামলায়

চোখ দুটি খুলে যায় ফুলদার। বিচিত্র হেসে বলেন, -কে বলেছে? বাবলু? ও জানে না।

কী হয়েছে বলুন তো?

উৎসাহে আবার উঠে বসেন। চোখ দুটি মিটমিট করে। বলেন, গগন সটকেছে।

-সটকেছে? তার মানে?

ইলোপমেন্ট কেস্ মশাই। নারী-ঘটিত ব্যাপার!

আমি তো স্তম্ভিত। লোকটা বলে কি! কিন্তু আমাকে কোন প্রশ্ন করতে দিলেন না উনি। পকেট থেকে দেশলাইটা বার করে হাত বাড়ালেন আমার দিকে, –দিন, একটা বার্ডস আই ছাড়ুন। বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিয়ে দেখি–

এ আর ভিক্ষা নয়। রীতিমত উপার্জন। প্যাকেটটা বার করে দিলাম। একটি তুলে নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেন। প্যাকেটটা উনি নিজের কাছেই রাখলেন। বুদ্ধির গোড়ায় বোধকরি ভবিষ্যতে ধোঁয়া দিতে হবে ওঁকে।

বাধ্য হয়ে আলাপ চালিয়ে যেতে হল, কী বলছেন মশাই গগনের বয়স যে প্রায় চল্লিশ?

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে হাসি হাসি মুখে ফুলদা বলেন, এ কি সরকারী চাকরি ডাক্তারবাবু, যে বয়সের বাধা হবে? প্রেমে পড়ার আবার বয়স আছে নাকি? ওর তো সবে চল্লিশ। ষাট বছরের বুড়োও যে ঘাড় গুঁজড়ে পড়ে। যার যাতে মজে মন বুয়েছেন না?

আমার আদৌ বিশ্বাস হয়নি। বারো-তের বছরের ছেলে আছে ওর–পনের-ষোলো বছর বিবাহিত জীবনের পর গগন নারীহরণের মামলায় জড়িয়ে পড়বে, এ যে অবিশ্বাস্য! একটা ঢোক গিলে বলি, –মেয়েটি কে?

জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনটার দিকে তাকিয়ে ফুলদা গম্ভীর হয়ে বলেন, –পুরো নামটা এখনও জানা যায়নি। তবে কতকগুলো ক্লু পেয়েছি যা থেকে অনেকগুলি সিদ্ধান্তে আসা গেছে। প্রথমতঃ, মেয়েটি বড়লোকের ঘরের; দ্বিতীয়তঃ, সে ছবি আঁকতে জানে; তৃতীয়ত, তার নামের আদ্য অক্ষর দুটি হচ্ছে জি. এস.।

এ যে রীতিমত গোয়েন্দা কাহিনী!

এই সময়ে এসে উপস্থিত হল গগনের দোকানের সেই কর্মচারী ছোকরা। প্রফুল্ল। রোদে রোদে ঘুরে বেচারির মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে। তাকে দেখতে পেয়েই ফুলদা নূতন করে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন।

–এই যে প্রফুল্ল, তুমি এসে গেছ। কী খবর? অমলেন্দু সেনের বাড়ি গিয়েছিলে?, না, ইতস্ততঃ করার কিছু নেই। ডাক্তারবাবু আমাদের ঘরের লোক। তুমি অসঙ্কোচে সব কথা বলতে পার।

প্রফুল্ল কোঁচার খুঁটে মুখটা মুছতে মুছতে বললে, না, অমলেন্দুবাবুর বাড়িতে কিছুই হয়নি। তার মেয়ে গীতা বাড়িতেই আছে।

তুমি নিজে চোখে দেখেছ? না শুনে এলে?

না। গীতাই দরজা খুলে দিয়েছিল।

–আই সী! গীতা সেন নয় তাহলে? বেটাচ্ছেলে খুব ভোগাবে মনে হচ্ছে!

ফুলদা আবার চোখ দুটি বুজে খানিকক্ষণ কি যেন চিন্তা করেন। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটি নোটবই বার করে দেখে নিয়ে বলেন, বেশ, এবার তুমি একবার জীতেনবাবুর বাড়ি যাও। জীতেন সামন্ত। ওঁর মেয়ের নাম অবশ্য কমলা। তা হোক—

হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বলেন, –জি দিয়ে কোন ডাকনাম থাকতে পারে। তাছাড়া প্রেমিক-প্রেমিকা অনেক সময় আপোষে নিজেদের আদরের নাম রাখে, কি বলেন?

প্রফুল্ল খিঁচিয়ে ওঠে, আপনারা আর কাউকে পাঠান। আমার দ্বারা হবে না।

-কেন কেন? তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে?

-অসুবিধা নয়? ওভাবে কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসা করা যায়–ওগো তোমাদের মেয়ে ভেগেছে কিনা একটু দেখে বলবে!

–আহা ওভাবে জিজ্ঞাসা করবে কেন? একটু ঘুরিয়ে

হঠাৎ ভিতরের দিক থেকে এবার দৃঢ় প্রতিবাদ শুনলাম, না! যাও প্রফুল্ল, তুমি বাড়ি যাও। আর কোথাও যেতে হবে না তোমাকে।

ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি অন্দরমহলের দরজার পর্দা সরিয়ে শান্তি দেবী এসে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্কোচে তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারলাম না। ফুলদা রীতিমত ধমক দিয়ে ওঠেন, তুমি আবার কেন উঠে এলে শান্তি? তোমাকে বললাম না চুপচাপ শুয়ে থাকতে? যা করবার আমি করছি।

শান্তি দেবী এ কথার জবাব দিলেন না। প্রফুল্লকেই পুনরায় বললেন, তুমি যাও প্রফুল্ল। আজও দোকান খুলতে হবে না। কাল একবার এস সকালে। ডাক্তারবাবু কতক্ষণ এসেছেন?

এবার চোখ তুলে দেখতে হল। প্রফুল্ল চলে গেল। দশদিন আগে যে শান্তি দেবীকে চিনতাম এ মহিলার সঙ্গে তাঁর আকাশপাতাল তফাত। চুলগুলো রুক্ষ, চোখ দুটি টকটকে লাল। কিন্তু এখন অশ্রুর বাষ্পমাত্র নেই। বোধকরি এ কয়দিনে মনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া সেরে নিয়েছেন তিনি। ভেঙে পড়লে তার চলবে না, এটা বুঝেছেন। সংসারের অর্থনৈতিক সমস্যাটা তার তত বড় নয়, আসল সমস্যা হচ্ছে লোকলজ্জা। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, তবু এখনও তারা কিছু জানে না। কেমন করে খবরটা তাদের বলবেন? কেমন করে গোপনই বা করে রাখবেন? কতদিনই বা এই ফুলদার মোড়লি সহ্য করতে হবে?

–তুমি যদি আমার কথা না শোন শান্তি, তবে তো আমাকে এ ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলতে হয়!

শান্তি দেবী ক্লান্ত বিষণ্ণ দুটি চোখে মিনতি মেলে চুপ করে বসে থাকেন। বুঝতে পারি কতদূর অসহায় হয়ে পড়েছেন উনি। ঐ পরগাছা ফুলদার ধমকও আজ তাকে মাথা পেতে মেনে নিতে হচ্ছে।

ফুলদা পুনরায় বলেন, তুমি আমাকে কলকাতায় যেতে দিলে না, না হলে ঠিক ঘাড় ধরে স্কাউলেটাকে নিয়ে আসতাম এখানে।

শান্তি দেবীর চোখ দুটি হঠাৎ দপ্ করে জ্বলে ওঠে। বলেন, –পথে-ঘাটে যদি তার দেখা পাও ফুলদা, তাহলে ও দুঃসাহস কর না। টুলের উপর না উঠলে ওর ঘাড়ের নাগাল তুমি পাবে না, সে কথা নয়–নিজের ঘাড়টার কথা খেয়াল রেখ!

বোমার মত ফেটে পড়লেন ফুলদা, -ঈস! যা ভাবছ তা নয়! হোঁৎকা চেহারা হলেই শুধু চলে না। ছেলেবেলায় আমি স্যাণ্ডো করতাম, বুয়েছ! তাছাড়া এক্ষত্রে জোরটা হচ্ছে নৈতিক। ও স্কাউন্ড্রেলটা আমাকে দেখলে এখন ইঁদুরের গর্তে–

শান্তি দেবী আমার দিকে ফিরে বলেন, আপনাকে এ নোংরামির মধ্যে টেনে আনতে সত্যিই লজ্জা হচ্ছে ডাক্তারবাবু। তবু আমার অবস্থার কথা বিবেচনা করে আশা করি ক্ষমা করবেন। আপনি ওর বন্ধু হয়তো আপনি চেষ্টা করলে

সঙ্কোচে থেমে পড়েন মাঝপথেই। আমি বলি, আমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব নিশ্চয়। করব; কিন্তু ব্যাপারটা কী, আমি এখনও বুঝে উঠতে পারিনি!

শান্তি দেবী কোন সঙ্কোচ করেন না আর। মনকে শক্ত করে ধীরে ধীরে আদ্যোপান্ত ইতিহাসটা জানিয়ে দেন। যেন এ বিয়োগান্ত নাটকের নায়ক ও নায়িকা গগন আর শান্তি নয়দুটি অচেনা ছেলেমেয়ে। যেন মাসিক পত্রিকায় ছাপা একটা নিতান্ত জলো ছোটগল্পের কাহিনী উনি আমাকে শোনাচ্ছেন?

শান্তি দেবীর বাপেরবাড়ি যশোর। বাবা আছেন, মা আছেন। বাবা সম্পন্ন গৃহস্থ। তিনি বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন গগনের সঙ্গে। সেখানে এখনও শান্তি দেবী কিছুই জানাননি। জানিয়ে লাভ নেই কিছু। ওঁর বাপ বৃদ্ধ–ছোট ছোট ভাইবোনেরা আছে। তারা কী সাহায্য করতে পারে? এদিকে গগনের পৈতৃক পরিবারেরও কেউ নেই, যাকে জানানো যেতে পারে। সুতরাং নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে কোন সাহায্য তিনি প্রত্যাশা করেন না। আর অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য তাঁর অতটা মাথাব্যথা নেই। আসল সমস্যা হচ্ছে ব্যাপারটা কী, তাই ঠিক মত বুঝে নেওয়া। হঠাৎ এভাবে গগন সংসার ত্যাগ করে গেল কেন?

–কেন আবার? সেই মেয়েটা! জি. এস.! মাঝখানেই ফোড়ন কাটেন ফুলদা।

সে কথায় কান দিলেন না শান্তি দেবী। আমিও উপেক্ষা করলাম মন্তব্যটা। বস্তুত মিসেস পালের সহজ-স্বাভাবিক বিশ্লেষণে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। এতবড় আঘাতটা কি অপরিসীম উদাসীনতায় গ্রহণ করেছেন তিনি। বেশ বুঝতে পারছি মর্মান্তিক অপমানে, অবর্ণনীয় অভিমানে তাঁর অন্তঃকরণ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল। অনেকটা দমে গেছেন তিনি, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। না হলে অন্তত এরপর আঁচল খুলে একটি আনি বার করে তিনি তাঁর ফুলদাকে একটি দেশলাই কিনে আনতে বলতেন; কিন্তু সে মনের জোর আজ আর তার নেই। তবু ভেঙে পড়েননি। শান্তি দেবী শুধু শিক্ষিতাই নন, সত্যিকারের আধুনিকা। শ্রদ্ধায় আমার অন্তঃকরণ আপ্লুত হয়ে গেল। বলি, যাবার আগে কোন চিঠিপত্র লিখে রেখে গেছে?

না। চিঠিপত্র কিছুই সে লিখে রেখে যায়নি। গৃহত্যাগের দিনও যথারীতি সকালে দুটো নাকে-মুখে গুঁজে দোকানে গিয়েছিল। দোকানে বসেনি কিন্তু। প্রফুল্লকে সে বলেছিল, হঠাৎ বিশেষ প্রয়োজনে তাকে বাইরে যেতে হচ্ছে, কবে ফিরবে তার স্থিরতা নেই। কোথায় যাচ্ছে, তা বলেনি। দোকানের ক্যাস থেকে বত্রিশটা টাকা সে নিয়ে গেছে। বাড়িতে কাউকে কিছু বলেনি। রাত্রে সে না ফেরায় এঁরা উদ্বিগ্ন হলেন। দাঙ্গা-জনিত কারণে এখানে-ওখানে মাঝে মাঝে খুন-জখম হচ্ছে। তাই রাত্রেই শান্তি দেবী বাবলুকে পাঠিয়েছিলেন প্রফুল্লর বাড়িতে। বাবলুই খবর নিয়ে আসে, গগন হঠাৎ কোথায় চলে গেছে। পরদিন প্রফুল্ল এসে সব কথা জানালো। বাবু কোথায় গেছেন, কেন গেছেন কিছুই সে জানে না। শান্তি দেবী স্তম্ভিত হয়ে যান। খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন গগন একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ নিয়ে গেছে, তাতে নিয়েছে খানকতক ধুতি-জামা। আর দু-একটা টুকিটাকি। মায় তার দাড়ি কামানোর ক্ষুরটা পর্যন্ত নিয়ে যায়নি। আলমারি খুলে দেখেন টাকাপত্র সে কিছুই নিয়ে যায়নি। সবচেয়ে মজার কথা, গগনের একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল–শান্তি দেবী লক্ষ্য করে দেখেন তার চেক বইতে গগন প্রতিটি পৃষ্ঠায় তারিখহীন স্বাক্ষর রেখে গেছে।

আমি বলি, কিন্তু এ পর্যন্ত যা বলেছেন, তা থেকে তো আমার মনে হচ্ছে না যে, এর পেছনে নারী-ঘটিত কোন ব্যাপার আছে।

এই প্রথম লক্ষ্য করলাম শান্তি দেবী লজ্জা পেয়েছেন। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে উনি নীরবই রইলো এবং সেই নীরবতার সুযোগ গ্রহণ করে আসরে এতক্ষণে অবতীর্ণ হলেন তাঁর ফুলদা; বলেন, তার কারণ শান্তি সব কথা গুছিয়ে বলতে পারছে না। আমি আপনাকে কি কি বলেছি ডাক্তারবাবু? গগন যে ঘুড়ির প্রেমে পড়েছে।

শান্তি দেবী উঠে গেলেন। যাবার সময় একটা আতো কৈফিয়ৎ ফেলে রেখে গেলেন স্থানত্যাগের। বললেন, –একটু চা করে আনি।

চায়ের প্রয়োজন ছিল না। এই মারাত্মক অবস্থায় চা-পানের সৌজন্যও নিষ্প্রয়োজন; কিন্তু শান্তি দেবীর অন্তরালে যাওয়ার অছিলাটাকে উড়িয়ে দিতে পারলাম না। ফুলদাকে সাড়ম্বরে সায় দিলেন, হ্যাঁ, বেশ কড়া দু কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এস বরং। আসুন ডাক্তারবাবু, ততক্ষণ বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া দিন।

সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি বাড়িয়ে ধরেন ফের।

-কি বলছিলাম যেন? ও হ্যাঁ, গগন যে মাগীর প্রেমে পড়েছে তার সম্বন্ধে আমি কি কি বলেছি। প্রথম কথা মেয়েটি বড়লোকর ঘরের; দ্বিতীয়তঃ, সে ছবি আঁকতে পারে; তিন নম্বর তার নামের আদ্যক্ষর হচ্ছে–জি. এস.! এই তো? শুনুন এবার।

ফুলদা আকৈশোর গোয়েন্দা গল্প পড়েছেন। অপরাধ-বিজ্ঞান জিনিসটা তাঁর। নখদর্পণে। এতদিন এ বাড়ির সকলের সম্মিলিত ধমকে ছাইচাপা আগুনটা কারও নজরে পড়েনি। এখন তিনি স্বয়ংপ্রকাশ। বাড়ির কর্তা অন্তর্হিত হওয়ার পরেই উনি উঠে-পড়ে লেগেছেন। সমস্ত বাড়িটা সার্চ করেছেন। বাড়িতে অবশ্য কোন প্রেমপত্র-ফত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে দোকানে। প্রফুল্ল ছোঁড়া কিছুই জানে না। ও কী বুঝবে এসব ঘোরপ্যাঁচের? গগন সাড়ে নটার মধ্যে নাকে-মুখে খেয়ে দোকান যাচ্ছি বলে রওনা হত, আর দোকানে গিয়ে পৌঁছাত কখনও বিকেল চারটেয়, কখনও পাঁচটায়। তাহলে সারাটা দুপুর সে থাকে কোথায়? করে কি? যদি বল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে গিয়ে বই পড়ে, তাহলে প্রশ্ন হবে-বইটা দোকানে নিয়ে এসে পড়লেই চলে। যদি বল, নির্জনে গিয়ে সাধন-ভজন করে, তাহলে জিজ্ঞাসা করব বাড়ি কি দোষ করল? তোর বউ যায় মেয়ে ঠেঙাতে, ছেলে-মেয়ে ইস্কুলে বাড়ির চেয়ে তোর নির্জন জায়গা কোথায়? ফুলদা সুতরাং সিদ্ধান্তে এসেছেন–ব্যাপারটা তাহলে নিষিদ্ধ কোন কিছু আছে। কী হতে পারে? হয় প্রেম, নয় বোমাবাজি। মাত্র কমাস আগে পার্ক স্ট্রীট আর চৌরঙ্গীর মোড়ে বিপ্লবী গোপীনাথ সাহা টেগার্টভ্রমে একজন ইংরজেকে গুলি করে মেরেছে। দেশের আকাশ বাতাসে তারই গোপন অনুরণন। ফুলদার প্রথম সন্দেহ হয়েছিল বিপ্লবীদের সঙ্গে গগনের যোগাযোগ আছে। কিন্তু দোকানখানা তল্লাসী করে ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল। দোকানের এক গোপন দেরাজ থেকে বার হল একগাদা ছবি। হাতে আঁকা ছবি, পেনসিলে, কলমে অথবা লাল নীল রঙিন পেনসিলে আঁকা ছবি। সব জাতের ছবিই আছে। মাঠ-ঘাট, ফুল-গাছ, মেয়ে-মদ্দ। সব ছবির নিচেই লেখা আছে–টু পল গগা, উইথ লাভ ফ্রম জি. এস.। আর আছে তারিখ। গত তিন-চার মাসের। ফলে ব্যাপারটা স্পষ্টই বোঝা গেল। প্রফুল্লকে চেপে ধরলেন ফুলদা। ছোঁড়া শেষ-মেষ স্বীকার করে ফেলল–ছবির কথা যদিও সে জানে না, তবে বাবু যাবার আগে একটা ঠিকানা দিয়ে গেছেন। বলেছেন, তাঁর অবর্তমানে অনেক পাইকার এসে হয়তো মিথ্যা বিল পাঠাবে, দোকানের নামে। সে-ক্ষেত্রে প্রফুল্ল যেন ওর সঙ্গে পত্রালাপ করে এই ঠিকানায়।

ঠিকানা লেখা কাগজটা আমার সামনে মেলে ধরে ফুলদা নাটকীয়ভাবে বলেন, এই হল সেই ক্ল। এখন আপনিই বিচার করে দেখুন ডাক্তারবাবু। ঠিকানায় জানা যাচ্ছে, গগনবাবুর অর্থকষ্ট নেই। মাত্র বত্রিশটা টাকা সে বেটা হাতিয়েছে দোকান থেকে। তাহলে কোন সাহসে কলকাতার টাওয়ার হোটেলে ওঠে? ওখানে তো এক মাসেই তার টাকা ফুকে যাবে! ফলে অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে–ঐ জি. এস. নামে যে ছুঁড়ি ওর সঙ্গে ভেগেছে তার কাছেই কিছু রেস্ত আছে। হয় নগদ অথবা গহনা। না কি বলুন? এই যে চাও এসে গেছে। কিছু চিড়ে ভাজা বানালে পারতে শান্তি।

শান্তি দেবী দুটি চায়ের কাপ নামিয়ে দিয়ে নীরবে আসন গ্রহণ করেন। বলি, আপনি চা খাবেন না?

নাঃ। বড় অম্বল হয়! যাক, সব তো শুনলেন ডাক্তারবাবু, এখন বলুন–কি করা যায়? ফুলদা কলকাতায় যেতে চেয়েছিল। আমি বাধা দিয়েছি। ফুলদার যাওয়াটা ঠিক হবে না। প্রফুল্লকে উনি বারে বারে বারণ করে দিয়েছিলেন আমাদের কাউকে ঠিকানাটা না জানাতে। তাই বলছিলাম, আপনার জানা কেউ কলকাতায় আছেন যিনি একটু খোঁজ। নিয়ে…মানে, আমি জানতে চাইছি আসলে কী এমন ব্যাপার ঘটেছে যাতে..

আমি বলি, ঠিক আছে। অন্য লোকের প্রয়োজন নেই, আমি নিজেই যাব।

–আপনি যাবেন? আপনার প্র্যাকটিস ছেড়ে?

বললাম, –এমন বিপদে সাহায্য না করলে আর কি রকম বন্ধু হলাম আমি?

–তাহলে আপনার যাতায়াতের খরচটা কিন্তু নিতে হবে ডাক্তারবাবু।

কিছু দরকার নেই। আমাকে এমনিতে একবার কলকাতা যেতে হত। আপনাকে বলা হয়নি–আমি এখানকার বাস উঠিয়ে পাকাপাকিভাবে কলকাতা চলে যাচ্ছি। সুতরাং তার আগে একবার সেখানে ঘুরে আসা দরকার। আপনাকে দিন সাতেকের ভিতরেই আমি খবর দিতে পারব।

শান্তি দেবীর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

দুএক মিনিট কেউই কোন কথা বলি না। যে যার চিন্তাতে বিভোর ছিলাম। হঠাৎ নীরবতাকে খান্ খান্ করে ভেঙে দিয়ে চাপা গর্জন করে ওঠেন ফুলদা, চামার, চামার, মশাই! সতের বছরের বিয়ে করা বউকে ফেলে যে হারামজাদা নতুন মাগী নিয়ে ফুর্তি করতে ছোটে সে মানুষ, না জানোয়ার? নেহাৎ বেজন্মা! বাপের ঠিক নেই!

শান্তি দেবীর মুখটা ছাইয়ের মত ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হঠাৎ কেমন যেন রক্ত চড়ে গেল মাথায়। আমিও চাপা গর্জন করে উঠি, দেখুন মশাই! কিছুই যখন জানা নেই তখন এভাবে আপনি আমার বন্ধুকে গাল দেবেন না।

–কিছুই না জেনে মানে? জানতে আর বাকি আছে কি? সে মাগীর নাম?

সাট আপ্!আমি উঠে দাঁড়াই।

ফুলদা একেবারে ঘাবড়ে যায়। আমি বলি, -খুনী আসামীও আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ পায়। গগন আমার বাল্যবন্ধু। তার সম্মান রক্ষা করবার দায় আমার। তার স্ত্রীর সম্মুখে বারে বারে আপনি যদি অমন অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন, তবে আপনাকে আমি চুপ করিয়ে দিতে বাধ্য হব। গগন করেছেটা কি? কদিনের জন্যে গা-ঢাকা দিয়েছে। টাকা-পয়সা নিয়ে যায়নি। ঠিকানা রেখে গেছে, মায় তার চেকবুকে সই পর্যন্ত করে গেছে। আপনি তারই অন্ন ধ্বংস করে এতদিন এখানে বাস করছেন–আর আজ তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বাপ-মা তুলে গাল দিচ্ছেন! আপনি কি মানুষ?

ফুলদা একেবারে কুঁকড়ে যান। আমতা আমতা করে উঠে পড়েন চেয়ার ছেড়ে।

শান্তি দেবীর মুখে রক্ত ফিরে এসেছে এতক্ষণে। স্বাভাবিক স্বরে তিনি কথা বলতে পারেন এর পর। আঁচল থেকে খুলে একটা দো-আনি বের করে বাড়িয়ে ধরেন ফুলদার দিকে–দু-আনার বাতাসা কিনে আনবে ফুলদা? আজ বিদ্যুত্বার, বাজারের সময় তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।

মনে হল আমার ধৈর্যচ্যুতিটা মঙ্গলই ঘটিয়েছে এ সংসারে। আউট-অফ গীয়ার, যন্ত্রপাতিগুলো মুহূর্তে ফিরে আসছে যে যার জায়গায়। শুধু শান্তি দেবীই আত্মবিশ্বাস একা ফিরে পাননি, ফুলদাও ফিরে এসেছেন তার স্বস্থানে। দো-আনিটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে নীরবে স্থান ত্যাগ করেন তিনি।

আর তখনই ভেঙে পড়লেন শান্তি দেবী। দু হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন ভদ্রমহিলা। আমি নীরবে উঠে যাই ভিতরের উঠানে। খানিকটা কাঁদবার সুযোগ ওঁকে দিতে হবে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সামলে নিলেন নিজেকে। ভিতরের বারান্দায় এসে বলেন, –আসুন ডাক্তারবাবু। চলুন আমরা বাইরের ঘরে গিয়ে বসি।

আবার সেই বাইরের ঘরে। মুখ মুছে শান্তি দেবী অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছেন এতক্ষণে। বললেন, ডাক্তারবাবু, একটা কথা এতক্ষণ বলিনি। ফুলদা ছিল বলেই বলিনি। ও কলকাতা পৌঁছে আমাকে একখানা চিঠি লিখেছে। ফুলদা জানে না।

মিসেস পাল উঠে যান ভিতরের ঘরে। ফিরে আসেন চিঠিখানা হাতে করে। আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেন। আমি ইতস্ততঃ করছি দেখে বলেন, –পড়ুন আপনি।

পাঁচ-সাত লাইনের ছোট্ট চিঠি। কোন পাঠ নেই উপরে। কোন সান্ত্বনাও নেই, বা কৈফিয়ও নেই। গগন লিখেছে–শান্তি, আমার অনুপস্থিতিতে তোমার কোন অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। দোকানের হিসাব প্রফুল্ল জানে। আমি কোন ধার-দেনা করিনি। এ চিঠি কলকাতায় পৌঁছে ডাকে দেব। আমি তোমার সংসারে আর ফিরে আসব না। এ সিদ্ধান্ত বদলাবার নয়। দোকান থেকে বত্রিশটা টাকা নিয়ে গেলাম। মিথ্যে আমার খোঁজ খবর কর না। আমি রগচটা মানুষ তা তো জানই। অশান্তি আমার বরদাস্ত হয় না। ইতি গগন।

আমি শুধু বললাম, আশ্চর্য!

এত দুঃখেও শান্তি দেবী হেসে উঠলেন, –আশ্চর্য কোষ্টা? ঐ শেষ লাইনটা? না, ডাক্তারবাবু–ওর মধ্যে কোন অলঙ্কার নেই। শান্তি-অশান্তি কোনটাই ওর বরদাস্ত হয় না। সব ও ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চায়।

একটু ইতস্ততঃ করে বলে, কিছু মনে করবেন না শান্তি দেবী; কিন্তু আপনার কি মনে হয় এর ভিতর আর একটি মেয়ে আছে?

-মনে করার কি আছে? বন্ধুভাবেই তো আপনার সাহায্য চাইছি। হ্যাঁ, তাও হতে পারে।

আপনি কিছুই টের পাননি?

–না। এ কি টের পাওয়া যায়?

আবার কিছুটা চুপচাপ। শেষে উনি আবার বলেন, –ও যা একরোখা, ওর সিদ্ধান্ত বদলাবে বলে মনে হয় না। আমি…মানে, আমি ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝে নিতে চাই। আসলে কী ঘটেছে? কেন এমনভাবে সে চলে গেল? যদি অন্য কোন মেয়ের মোহেই। চলে গিয়ে থাকে, তাহলে একদিন সে নাটকের শেষ হবে। ওকে তাহলে বলবেন…আমি ওর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করব না কোনোদিন। সে যদি ফিরে আসতে চায়, আজ না হোক দু-দশ বছর পরেও, তবু তার জন্য আমার দরজা খোলা থাকবে। আর অন্য কোন মেয়ে যদি এর ভিতর না থাকে, তাহলে তার সব ছেড়ে যাবার আর কি কারণ থাকতে পারে তাও তো বুঝি না–

–ওর সঙ্গে কোন ঝগড়াঝাটি হয়নি তো?

–তেমন কিছু নয়। অন্তত মাসখানেকের ভিতর নয়।

কিন্তু আপনার ফুলদার হিসাব মত সে মাসকতক গোপনে কিছু একটা করত। সেটা কী হতে পারে?

-ফুলদার ধারণা অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে ওর ইয়ে ছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রে আজ চার পাঁচ দিনের মধ্যে কি আমরা খবর পেতাম না? ঢাকা শহর কলকাতা নয়, একটি মেয়ে খোয়া গেলে সে খবর কি চাপা থাকত? তারও বাপ-মা কি খোঁজ নিতে আসত না?

আবার ইতস্ততঃ করে বলি, –ওর সঙ্গে দেখা হলে কি বলব?

কি আবার বলবেন আসল ব্যাপারটা শুধু জেনে আসবেন।

–সে যদি ফিরে আসতে শেষ পর্যন্ত না চায় তাহলে বাবলুকে কোন চিঠি লিখতে বলব কি?

জবাব দিতে দেরী হল শান্তি দেবীর। আবার দাঁত দিয়ে ঠোঁটটা কামড়ে ধরে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন। অতি কষ্টে চোখের জলকে ঠেকিয়ে রেখেছেন উনি। তারপর বললেন, –ছেলে-মেয়ে আমার একার নয়। কিন্তু আমার হয়ে সে অনুরোধও আপনি করবেন না। সত্য কথাটা শুধু আমি জানতে চাই। বাবলু আমার বুঝমান ছেলে সত্য কথাই বলব তাকে আমি, তা সে যতই রূঢ় হোক, যতই কদর্য হোক! মিটিকেও বলতে হবে হয়তো কিছুদিন পরে। যখন তার বোঝবার বয়স হবে।

আবার মনে পড়ল ফুলদার সেই অনবদ্য উক্তিটি–ছেলেমেয়ে বয়ে যায় মায়ের আশকারাতে।

আর কিছু বলার নেই তো? আমি তাহলে যাই?

একটু বসুন।

শান্তি দেবী হুক থেকে সেতারটা পেড়ে আনেন। আমার হাতে সেটা দিয়ে বলেন, — এটাও নিয়ে যান। ওর সখের জিনিস।

অদ্ভুত ক্ষমতা ভদ্রমহিলার। বয়সে ছোট আর সম্পর্কে বন্ধুপত্নী না হলে আমি সেদিন তাঁকে প্রণাম করতাম।

আবার নিজে থেকেই বলেন, –ও হো, আপনি তো সাইকেলে চেপে এসেছেন। আচ্ছা থাক, আমি পাঠিবে দেব। কবে যাচ্ছেন আপনি?

বললাম, কালই।

.

০৮.

কলকাতায় পৌঁছে টাওয়ার হোটেলে দেখা করতে গেলাম গগ্যার সঙ্গে। হোটেলে কিন্তু তার দেখা পেলাম না। হোটেলের ম্যানেজার একটি ঠিকানা দিলেন আমার হাতে। বললেন, গগন পাল এই ঠিকানাতে আছে। তার নামে কোন চিঠি এলে এ ঠিকানাতে পাঠিয়ে দিতে বলেছে।

যেন নিতান্ত কথার ছলে কথা বলছি, বললাম, -ও তো প্রথমে এখানেই সস্ত্রীক এসে উঠেছিল, তাই নয়?

না। ও এখানে ওঠেনি। গগনকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। একদিন এসে এই ঠিকানা দিয়ে বলে গেল চিঠিপত্র এলে এই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে। এখানে ওঠেনি।

অগত্যা ঠিকানা খুঁজে কলকাতার একেবারে উত্তর প্রান্তে এসে হাজির হলাম। বরাহনগরের একটি চটকলের বস্তীতে। একটি বেলা গেল ঘর খুঁজে বার । করতে। অবশেষে সন্ধান পাওয়া গেল। খোলার চালের বস্তী। চতুর্দিকে নোংরা আর কাদা। অধিকাংশই হিন্দুস্থানী মজদূর। তারই একটা খোপে নাকি বাস করে গগন পাল। ঘরটা দেখিয়ে দিল একজন ভাজিওয়ালা। বলে, নয়া আদমি তো? ইয়া পাট্টা জোয়ান? বাঙ্গালিবাবু? হাঁ হাঁ, পালমোশা! যাইয়ে না সিধা। সতের নম্বর কামরা।

বলি, –শেঠজি, বাঙ্গালিবাবু কি একা আছে, না ওর বিবিও আছে?

শেঠজি সম্বোধনে ভাজিওয়ালা কিছু খুশি হল। বললে, রামজি জানে বাবুমোশা। অগর বিবি না লিয়ে এসে থাকে তবে এতোদিনে জুটে গেছে লিসচয়! ঐসান পাট্টা জোয়ান কি সাত রাত একা একা থাকবে?

–কেকরাকে বাত করতে হো ভিখ? প্রশ্ন করে পানওয়ালা।

–ঐ বাঙ্গালিবাবু রে! পালমোশা।

–নেহি নেহি, বিবি-উবি কুছ নেহি আছে যাইয়ে না সিধা।

এবার ভরসা করে এগিয়ে যায়। পাশাপাশি খুপরি। খোলার চাল, বাঁশের খুঁটি, হেঁচা বাঁশের দেওয়াল আর মাটির মেঝে। বারোঘরের এক উঠান। সতের নম্বরের দরজা খোলাই ছিল। একটা ছোট চারপাইতে চিৎ হয়ে পড়ে ছিল গগন। খালি গা, পরনে একখানি লুঙ্গি। খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফ গজিয়েছে। আমাকে দেখে উঠে বসে। হঠাৎ দপ্ করে জ্বলে ওঠে তার চোখ দুটো। তারপর কি ভেবে হেসে ফেলে। গামছা দিয়ে বগলদুটো মুছে নিয়ে বলে, দূত অবধ্য! বল, শুনি।

আমি চুপচাপ বসে পড়ি ওর খাটিয়ার একপ্রান্তে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে একটা ধরাই। ওকে দিই না; কিন্তু প্যাকেটটা পকেটেও ভরি না। রাখি ওর নাগালের মধ্যে। গগ্যা নেয় না তা থেকে। পুনরায় বলে, –শুরু কর। আমি প্রস্তুত।

একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে আমি বলি, আমি তো বলতে আসিনি গগন। আমি শুনতে এসেছি।

–এই কথা? কিন্তু আমার যা বক্তব্য তা তো চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছি। সে চিঠি কি পায়নি তোমার বন্ধুপত্নী?

বন্ধুপত্নী? তার মানে বন্ধু এবং পত্নী দুটো সম্পর্কই স্বীকার কর তুমি?

–তুই ভীষণ চটে আছিস মনে হচ্ছে?

আমি নীরবে ধূমপান করে চলি।

–এই দীপু! সেদিন তুই চা খাওয়াতে চেয়েছিলি। আমি খাইনি। আজ খাওয়াবি মাইরি এক কাপ? পকেটে একটা পয়সা নেই।

বত্রিশটা টাকা সাত দিনে ফুঁকে দেবার মত নবাবিয়ানার আয়োজন তো দেখছি না।

—ও বাবা; তুই যে পাই-পয়সার হিসাব রাখিস দেখছি! হ্যাঁ, সব খরচ হয়ে গেছে। অনেক সাজসরঞ্জাম কিনতে হল কিনা।

-কিসের সাজসরঞ্জাম?

থাক বাবা; চা খেতে চাই না আমি।

পকেট থেকে একটা দোয়ানি বার করে ওর হাতে দিই। ও বলে, –পয়সা আমি নিয়ে কি করব? দোকানিকে দিবি। আয়, চা-টা খেয়ে আসি বরং।

দুজনে উঠে এলাম ঘর ছেড়ে। গগন গায়ে গেঞ্জিটা চড়ালো না। পায়েও দিল না কিছু। দরজাটা হাট করে খোলা রইল। ভ্রূক্ষেপ নেই ওর। দোকান রাস্তার ওপরেই। দুহাত বাই দুহাত দোকান! উপরে পান-বিড়ির আয়োজন, নিচে তোলা-উনুনে জল ফুটছে. মাটির ভাঁড়ে করে দু ভড় চা দিল দোকানি। চায়ের সঙ্গে তার সাদৃশ্য শুধু মাত্র উত্তাপে। তারিয়ে তারিয়ে ভাড়টা নিঃশেষ করে গগ্যা বললে, চল ঘরে গিয়ে বসি।

আবার মুখোমুখি বসলাম দুজন। দুই বাল্যবন্ধু। বর্তমানে প্রতিপক্ষ। আমি বলি, — আমার সময় কম গগ্যা। ভণিতা ছেড়ে সোজা কথায় আসা যাক। এভাবে পালিয়ে এসেছিস কেন?

–পালিয়ে মোটেই আসিনি। ঠিকানা জানিয়েই এসেছি। না হলে তুই এ বস্তীতে আমাকে কিছুতেই খুঁজে পেতিস না।

না হয় পালিয়ে নয়, চলে এসেছিস। তাই বা এসেছিস কেন? তোর বউ ছেলে মেয়ে খাবে কি?

–এতদিন যা খেয়ে এসেছে। ওরা আমার উপার্জনে খেত না।

–শান্তি দেবীর বিরুদ্ধে তোর আসল অভিযোগটা কি?

অভিযোগ? কিছুমাত্র না।

কিন্তু এভাবে স্ত্রীকে ত্যাগ করলে পাঁচজনে তোকে গালমন্দ দেবে না?

–গালমন্দ দেওয়া পাঁচজনের স্বভাব। ও আমি ভ্রূক্ষেপ করি না।

স্বভাব কেন? অন্যায় করছে দেখলে সবাই বলবে। তোর বাপান্ত করবে।

করুক। ওরা বাপান্ত করার আগেই বাপ আমার অন্ত লাভ করেছেন।

–তোর লজ্জা হচ্ছে না?

কিছুমাত্র না।

তুই মানুষ না, জানোয়ার! একটা পাষণ্ড! একটা চামার!

মেনে নিলাম।

আমার দম ফুরিয়ে গেল। একতরফা ঝগড়া চলে না। গগন অহেতুক ঝগড়া বাধাতো। অথচ এখন নির্বিবাদে সব গাল হজম করে নিল। এবার কি বলব? কিন্তু এত সহজে হার মানা চলে না। আবার নবোদ্যমে শুরু করি, –এইমাত্র বললি, তোর কাছে একটা পয়সা নেই, তুই খাবি কি?

-রোজগার করব।

কোনও বিকার নেই ওর। জবাবগুলো ওর ঠোঁটের আগায়। মনে মনে ও বোধহয় এসব প্রশ্নোত্তরের মহড়া করে রেখেছে। আবার বলি, -জানিস, আমরা আইনত তোকে বাধ্য করতে পারি বউয়ের কাছে ফিরে যেতে? তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব তুই অস্বীকার করতে পারিস না!

-ভুল করছিস দীপু। আইনের মাধ্যমে আমাকে বউয়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা তোদের নেই। আইনত তোরা হয়তো আমাকে জেল খাটাতে পারিস। তাও ঠিক পারিস কিনা জানি না। সেটা আদালতে ফয়সালা করা চলে।

হ্যাঁ জানি। এটা হতভাগ্য ভারতবর্ষ! তাই এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে আর একটা বিয়ে করায় আইনত কোন বাধা নেই; কিন্তু নিতান্ত অমানুষ না হলে কেউ সেটা করে?

মাথা ঝাঁকিয়ে গগ্যা এতক্ষণে বিরক্তি প্রকাশ করে। বলে, ঝাঁট দে ওসব ছেঁদো কথা! থিওরেটিক্যাল কথাবার্তা আপাতত বাদ দে। দুটো বিয়ে তো আমি করিনি।

-করিসনি; কিন্তু করবি তো?’

–কি করব? আর একটা বিয়ে? ঝাঁট দে ওসব ছেঁদো কথা!

বিয়ে করবি না তো কি রক্ষিতা করে রাখবি?

কাকে?

যাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিস?

গগ্যা অনেকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর এতক্ষণে আমার প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরায়। বলে, কী আবোল-তাবোল বকছিস দীপু?

–তুই অস্বীকার করতে চাস জি. এস. নামে একটা মেয়েকে তুই নিয়ে আসিসনি?

—জি. এস.? তার মানে? এসব কার কল্পনা? শান্তি না তার ফুলদা?

-কল্পনা কারও নয় গগ্যা। আমি নিজের চোখে দেখেছি। তোর দোকানঘর থেকে বের হয়েছে রাশি রাশি ছবি। আর তাতে লেখা টু পল, ফ্রম জি. এস.।

কোথাও কিছু নেই প্রচণ্ড স্বরে হাসতে গিয়ে কেশে উঠল গগ্যা। সিগারেটের ধোঁয়া ছিল তার মুখে। কাশতে কাশতে চোখে জল এসে গেল বেচারির। তারপর মুখ চোখ মুছে স্থির হয়ে বসে বলে-বেচারি শান্তি! প্রেম আর ভালবাসা ছাড়া আর কিছু জানে না। এ ঐসব ম্যাগাজিন পড়ার ফল। ঐ প্রগতি-মগতি।

তুই বলতে চাস এর মধ্যে দ্বিতীয় একটি মেয়ে নেই?

ঝাঁট দে! আমি ঢাকা থেকে খোলা মনে একা এসেছি। এখানে একাই আছি।

ছবিগুলো তাহলে কে এঁকেছে?

–আমি।

–তুই? তুই তো ছবি আঁকতে জানিস না। তাছাড়া ছবিগুলো তো তোকেই উৎসর্গ করা। তাহলে জি. এস. কে?

–ছবিগুলো গগ্যা দি আর্টিস্টকে দিয়েছে গগ্যা দি শপ কীপার!

মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যায় না। বলি, তুই এখানে কি করতে চাস?

ছবি আঁকতে চাই।

ছবি আঁকতে চাস? তুই গগন পাল? আর্য মিশনের সেই গগ্যা?

এতক্ষণে সোজা হয়ে উঠে বসে। আমার চোখে চোখ রেখে যেন প্রতিধ্বনি করে, — ঠিক তাই ছবি আঁকতে চায়, গগন পাল? আর্য মিশনের সেই ফেল করা ছেলে, গগ্যা! কেন, আপত্তি আছে?

-না, আপত্তি করলেই বা শুনছে কে? কিন্তু দোকানদারী করতে করতেও তো ছবি আঁকা যায়?

–সেসব সৌখীন মজদুরী। আমি সর্বতোভাবে ইবি আঁকায় আত্মনিয়োগ করতে চাই।

–অর্থাৎ প্রফেসনাল আর্টিস্ট ও জিনিসটা বিলাতে আছে, এদেশে নেই। আর তাছাড়া ছবি এঁকে তুই নাম করতে পারবি তার স্থিরতা কোথায়?

-কে চাইছে নাম করতে? আমি যশের কাঙাল নই। আমি স্রেফ ছবি এঁকে যেতে চাই। সে ছবি কেউ দেখল কি দেখল না, সুখ্যাতি না কুখ্যাতি করল এ নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।

আমি ধমক দিয়ে উঠি, –পাগলামিরও একটা মাত্রা থাকে গগ্যা। এ কী বলছিস তুই? পাঁচজনে দেখবে বলেই তো মানুষ ছবি আঁকে? না কি?

অন্তত আমি সেজন্য আঁকব না!

তবে কি জন্য আঁকবি?

–না এঁকে আমার নিস্তার নেই-তাই আঁকব।

–এ একটা কথা হল? মনে কর প্রশান্ত মহাসাগরের এক নির্জন দ্বীপে তোকে। নির্বাসন দেওয়া হল; সেখানে সভ্য মানুষ নেই। সেখানে কেউ তোর ছবি দেখবে না। তা সত্ত্বেও তুই সেখানে একা একা বসে ছবি আঁকতে পারিস?

গগন জবাব দিল না। জানলা দিয়ে আগুন-ঝরা বৈশাখী আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। দূর আকাশে পাক খাচ্ছে সূরযসাক্ষী একটা নিঃসঙ্গ চিল।

-কই, জবাব দিলি নে যে বড়?

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল গগ্যার। যেন স্বপ্নের ঘোরে বললে, তাহলে আমি আর কিছুই চাইব না রে দীপু! নারকেল গাছ ছাওয়া একটা নির্মল নিস্তরঙ্গ অ্যাটল ..দু-চারটে পাতায়-ছাওয়া কুঁড়েঘর…দু-চারজন উলঙ্গ আদিম আদিবাসী, যাদের ভাষা আমি বুঝি না, প্রখর সূর্যালোক, সবুজ বন…নীল আকাশ আর ধূসর সমুদ্র! উফ্!

আবেশে চোখ বুজল গগ্যা।

হেসে বলি, –ওসব রোমান্টিসিস কাব্যেই ভাল লাগে গগ্যা। বাস্তবে ও কল্পনাবিলাসের কোন অর্থ হয় না। ছবি আঁকতে চাস, তা ঢাকায় বসে আঁক না?

যেন বাস্তবেই ফিরে এল সে। বললে, ওখানে হবে না। ঝট দে!

-কেন হবে না? গগন, কিছু মনে করিস নে ভাই। ছবির বিষয়ে আমি কিছু কিছু বুঝি। দেবনারায়ণবাবুর ড্রইং ক্লাসে তোর চেয়ে আমি অথবা বটুক বরাবর বেশি নম্বর। পেতাম। তোর দ্বারা ওসব হবে না।

-মটুকুও তাই বলে; কিন্তু আমার উপায় নেই। আমাকে আঁকতে হবে। ছবি না এঁকে আমার নিস্তার নেই।

–মটুকু? মানে বটুক? বটুক কোথায় জানিস?

–জানি। হগসাহেবের বাজারে সে দোকান দিয়েছে। ভাল রোজগার করছে।

কিসের দোকান?

–ছবির।

ওকে আবার বলি, -গগ্যা, বটুকের ভাল রোজগার হচ্ছে বলে তোরও যে হবে এমন কোন কথা নেই। বটুক পাক্কা চার বছর আর্ট স্কুলে শিখেছে। সে পাস করা আর্টিস্ট। সে গোড়া থেকেই ঐ লাইনে লেগে ছিল। তোর বয়স চল্লিশ। এ বয়সে কি ছবি আঁকা শেখা যায়? না তা থেকে রোজগার করা যায়?

একগুঁয়ে গোঁয়ারটা জবাবে ঐ একই কথা বললে, –তা জানি না; কিন্তু ছবি আমাকে আঁকতেই হবে। ছবি না এঁকে আমার নিস্তার নেই। অগত্যা উঠে পড়ি। বলি, চলি তাহলে?

যাবি? তা যা।

–ও, ভাল কথা। শান্তি দেবী তোর সেতারটা আমাকে দিয়েছেন তোকে দিতে। সেটা আমার বাড়িতে আছে, তুই নিয়ে আসবি? না হলে আবার কষ্ট করে আমাকে

না না। তুই আবার কেন কষ্ট করবি? চল, এখনই চল, নিয়ে আসি।

কোন বিকার নেই। এই সেতার ফেরত দেওয়ার ভিতর যে তীব্র অভিমান আছে– এর ভিতর যে একটি কাব্য আছে এটা ওর যেন খেয়ালই হল না। সেতার সে বাজাতে ভালবাসে। সেতারটা সে ফেলে এসেছিল। এখন সেটা হাতে পাওয়া যাবে এতেই ও খুশি। পাথরে মাথা খুঁড়ছি জেনেও বললাম, -সেতারটার জন্য খুব অভাব বোধ করছিলি। নিশ্চয়। তোর বউ মনে করে।

গগন একটা হাফ সার্টের মধ্যে মাথা গলাচ্ছিল। জুতোটা পায়ে দিয়েছে এবার। ঐ অবস্থাতেই আমাকে বাধা দিয়ে ও বললে, –আরে ঝাঁট দে! সেতারের কথা এতদিন। মনেই ছিল না আমার। তুই বললি অমনি মনে পড়ল।

–তাহলে এখনই ছুটছিস কেন?

না হলে আজ রাতে খাব কি? বললাম না, পকেট একেবারে গড়ের মাঠ! ওটা সেকেণ্ড হ্যাঁণ্ডে আজই বেচে কিছু নগদ টাকা রোজগার করতে হবে। সিপিয়া আর আলট্রামেরিন রঙের টিউব দুটোও ফুরিয়েছে ও দুটোও কিনে আনব। কি হল, দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? চল?

কেন যে হঠাৎ পথের উপর দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম তা আর ওকে বলিনি।

কিন্তু মোড়ের মাথাতেই দেখা হয়ে গেল অপ্রত্যাশিতভাবে আর একজন বন্ধুর সঙ্গে। বটুকেশ্বর দেবনাথ। উৎসাহের আতিশয্যে একেবারে জড়িয়ে ধরল আমাকে।

উঃ! কতদিন পর দেখা! চল চল ঘরে গিয়ে বসি। নে, সিগ্রেট খা।

অগত্যা আবার ফিরে গিয়ে বসি গগ্যার ছাপরায়। বটুকেশ্বর একনাগাড়ে কিছুটা বকবক করে চলে। হগমার্কেটে দোকান দিয়েছে সে। নানান জাতের ছবি আঁকে। গত তিন-চার বছর ধরে সরকারী চিত্রশালার বার্ষিক প্রদর্শনীতে তার ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রাইজ এখনও পায়নি, তবে গত বছর তার প্রদর্শিত তিনখানি ছবিই বিক্রি হয়েছে। বেশ ভাল দামে। একটি একশোয় এবং বাকি দুটি পঞ্চাশে। এবার সে একখানা বড় ছবি আঁকছে। পাঁচ বাই তিন। অয়েল কালার। বিষয়বস্তুটা কী, তা সে বলবে না; আমাকে দেখে বলতে হবে। আমার খোঁজ-খবরও নিল। ঢাকা ছেড়ে কলকাতা আসছি শুনে খুব খুশি হল; বললে, তোর পাকাপাকিভাবে কলকাতা আগমনে আমি পার্টি দেব। পোলাও আর মাংস। ওঃ! হাঁড়ি কাবাব যা বানায় সুলেখা! সিমপ্লি সুপার্ব!

সুলেখা? তোর বউ? বিয়ে করেছিস?

চোখ দুটি ছোট ছোট করে বটুক তাকায়, বলে, –তুই কী, ভেবেছিলি বটুকের কোনদিন বে হবে না? কেন? এই খানদানি বদনখানির জন্যে?

বটুকেশ্বর দেবনাথের উচ্চতা পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি। গগ্যার বুকের কাছে তার মাথা। মাথাটা দেহের তুলনায় বড়, এবং সেই মাথা ভরা টাক! কন্দর্পকান্তি নয় বটুক–এটা সেও জানে, আমরাও জানি। কিন্তু তার সাজ-পোশাকের বাহার আছে। কোট-প্যান্ট-টুপি চড়িয়েই সে এসেছে এই বরাহনগরের বস্তীতে। পায়ে তার চঞ্চকে গ্লেসড কিড জুতো

-খাস চিনেবাড়ির।

অপ্রীতিকর প্রসঙ্গটা এড়িয়ে বলি, –ছেলেমেয়ে কি?

-ছেলেপুলে হয়নি।

এখনও হয়নি? কতদিন বিয়ে করেছিস?

—ওঃ! সে অনেক দিন! তের-চোদ্দ বছর হয়ে গেছে।

অর্থাৎ সন্তান হওয়ার আশাও আর নেই। ঐ চিত্রগুলিই ওর সন্তান।

বটুক মনিব্যাগ খুলে একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে গগ্যার দিকে, –নে ধর!

গগ্যা ছোঁ মেরে নোটটা নিয়ে আমার দিকে ফিরে বলে, –সেতারটা কাল পরশু গিয়ে নিয়ে আসব।

বটুক বলে, স্টিল লাইফটা শেষ করেছিস?

প্রশ্নটা গগ্যাকে। সে হাফ সার্টটা খুলে একটা পেরেকে ঝুলিয়ে রাখছিল। বিনা বাক্যব্যয়ে খাটিয়ার নিচে থেকে টেনে বার করল কাগজে জড়ানো ক্যানভাস। বটুক সেটা ঘরের এক কোণে রেখে সমঝদারের মত একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ডাইনে-বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বললে, কিশু হয়নি। বললাম, ড্রইংটা আরও চালিয়ে যা। তা নয়, তুলি। ধরব। ওরে বাবা, এ এত সহজ নয়! বুঝলি? ড্রইংটা মসো না হলে কিছুই হবে না। গেলাসটা সিমেট্রিকাল হয়নি। সেন্ট্রাল লাইনের ডাইনে সরে গেছে। খাটিয়ার পায়াগুলো ভার্টিকাল নয়। দে, তুলি দে

ছবিটা ঘরের ভিতরেই এঁকেছে গগ্যা। খাটিয়ার একটা অংশ, একটা কলসি, একটা তালপাখা, একটা গেলাস। তেলরঙে আঁকা ক্যানভাস। রঙ ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া করে লেগেছে। কাঁচা হাতের আঁকা। ঠিকই বলেছে বটুক। গেলাসটা ঠিকমত আঁকা হয়নি। খাটিয়ার পায়াও বেঁকে গেছে।

খাটিয়ার নিচে থেকে প্যালেট আর তুলিটা নিয়ে বটুক এগিয়ে যেতেই ছবিখানা ছোঁ মেরে তুলে নিল গগ্যা। বললে, আমার ছবিতে মেরামত করতে হবে না তোকে। আর কিছু শেখাতেও হবে না। কিভাবে লিনসিড অয়েলে রঙ গুলতে হয় এটুকুই শিখতে চেয়েছিলাম তোর কাছে

–ওঃ! বাদবাকি তুই নিজেই শিখে নিবি? একলব্য হয়েছিস?

গগ্যা হাসল। বললে, –তাই হতে চাই রে মটুকু।

ফেরার পথে অনেকটা পথ বটুকের সঙ্গে এলাম। ও ভবানীপুরের দিকে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছে। দুটি তো মাত্র প্রাণী। দুখানি ঘর। কল ও স্নানাগার অপর একজন ভাড়াটের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করতে হয়। তাও মাসে বারো টাকা ভাড়া। বটুকের ইচ্ছে ছিল সেদিনই আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে যায়। আমি রাজী হতে পারি না। পরে একদিন যাব বলে পাশ কাটালাম। বলি, বটুক, তুই গগ্যাকে টাকা দিলি কেন? ধার?

ধার বলেই দিলাম। তবে শোধ পাবার আশা না রেখে। কি করব? একেবারে ধরে পড়েছিল।

–ওর সব কথা তুই জানিস? গগ্যা তার সতের বছরের বিয়ে করা বউকে ফেলে চলে এসেছে।

বটুক বললে, জানি! তাতেই তো শ্রদ্ধা হল ওর ওপর। ওর বুকের পাটা আছে।

আমি বললাম, বুকের পাটা যে আছে, সেটা ওর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বাঙালি ছেলের অমন চওড়া বুক আমি খুব কমই দেখেছি, কিন্তু সেটাই কি সব বটুক? বুকের পাটাটাই দেখলি তুই? কিন্তু ঐ বুকের ভিতর স্নেহ-ভালবাসা-মমতা কি একতিলও থাকতে নেই?

পথ চলছিলাম দুজনে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বটুক। বলে, দেখ দীপু, ওভাবে ওকে বিচার করিস না। ও হল আর্টিস্ট! ওর জাত আলাদা! তোর আমার মত সহজভাবে ওকে বিচার করা চলে না!

এবার আমিও দাঁড়িয়ে পড়ি। বলি, কী বলছিস তুই? গগ্যা আর্টিস্ট? ওর লাইন জ্ঞানই তো হয়নি এখনও। খাটিয়ার পায়াগুলো কিভাবে এঁকেছে দেখেছিলি?

-হ্যাঁ, ওর হাতটা এখনও আর্টিস্টের নয়; কিন্তু চোখ আর্টিস্টের। কতবড় দিল থাকলে তবে অমন গোছানো সংসার, নিশ্চিত রোজগারকে এভাবে ফেলেছেড়ে মানুষ ছবি আঁকবার উন্মাদনায় বস্তীতে এসে উঠতে পারে ভেবে দেখেছিস!

আমি বলি, কিন্তু বস্তীতে ওঠার কি প্রয়োজন ছিল ওর?

–সে তুমি বুঝবে না ডাক্তারসাহেব!

–কিন্তু তোকে তো ঘর সংসার ছেড়ে রাস্তাতে এসে বাস করতে হচ্ছে না?

–যে অর্থে গগ্যা আর্টিস্ট সে অর্থে আমি আর্টিস্ট নই–এ থেকে সেটাই প্রমাণ হয়। ব্যাপারটা তোকে বুঝিয়ে বলতে পারব না দীপু। আমি নিজেও বুঝিনি ঠিকমত। কিন্তু ওর চোখে আমি আগুন দেখেছি, সেখানে ভুল হয়নি আমার।

একটু থেমে আবার বলে কোম্পানির বাগানের সেই সন্ন্যাসীর কথা মনে আছে। দীপু? গগ্যাকে তিনি বলেছিলেন–তেরা বনৎ বনৎ বনি যাই! বিগড়ি বনৎ বনি যাই। মনে পড়ে?

কথাটার মানে কি রে?

-ওটা তুলসীদাসজীর একটা দোঁহার অপভ্রংশ। অর্থাৎ তোমার চেষ্টা করতে করতে হয়ে যাবে, ভুল করতে করতে ঠিক হয়ে যাবে!

বিশ বছর আগেকার ভবিষ্যদ্বাণী। আমার একটুও মনে ছিল না সেকথা। বটুক কিন্তু ভোলেনি। ঐ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল আর একটি বন্ধুর কথা। প্রশ্ন করি

–হ্যাঁরে, চন্দ্রভানের খবর রাখিস?

–হ্যাঁ। চন্দ্রভান মারা গেছে।

মারা গেছে? ঈস্! কবে? কেমন করে?

চন্দ্রভান মরে জন্মেছে ভিন্সেন্ট ভান গর্গ! ধ্রুবানন্দের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। যবন কাহকা! চন্দ্রভান খ্রীষ্টান হয়ে গেছে।

আমি বলি, কিন্তু তোর সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী তো ফলেনি! তুই পাসও করেছিস। নামকরা আর্টিস্টও হয়েছিস। একশো টাকা দিয়ে তোর ছবি কিনছে লোকে–

বটুক কি একটা কথা বলতে গেল। বলল না কিন্তু শেষ পর্যন্ত। ম্লান হেসে বললে, কি জানি! হ্যাঁ, তা তো বটেই; আমি আর্টিস্ট হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছি। দেবী বীণাপাণির প্রসাদ পেয়েছি আমি! না, ধ্রুবানন্দ অগ্নিহোত্রীর ভবিষ্যদ্বাণী অন্তত আমার ক্ষেত্রে ফলেনি!

বটুক কী কথা বলতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গিয়েছিল, সেদিন তা বুঝিনি। সেটা বুঝতে পেয়েছিলাম অনেক অনেকদিন পরে।

সাতদিনের মাথায় ফিরে এলাম ঢাকায়। ইতিমধ্যে গগ্যা এসেছিল একদিন সেতারটা নিতে। আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। আমি বাড়িতেই ছিলাম। চাকরের হাতে যন্ত্রটা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। গগ্যা চাকরটাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি আছি কিনা। আছি শুনেও সে কিন্তু দেখা করতে চায়নি। সেতারটা নিয়ে ফিরে গিয়েছিল।

আমি কিন্তু বটুকের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। তার যুক্তির কোনও অর্থ হয় না। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের দায় তাকে মেটাতে হবে। আর্টিস্ট হতে চাই বললে তার সাত-খুন মাপ হয় না। ঢাকাতে পৌঁছেই পরদিন গিয়ে দেখা করলাম শান্তি দেবীর সঙ্গে। দুপুরবেলাতেই গিয়েছিলাম, যাতে ছেলেমেয়েরা স্কুলে থাকে। সৌভাগ্যক্রমে ওঁর ফুলদাও বাড়ি ছিলেন না। এ কয়দিনে আরও যেন ভেঙে পড়েছেন শান্তি দেবী। চোখের কোলে কালি পড়েছে। মুখটা শুকিয়ে গেছে।

–আসুন ডাক্তারবাবু, কবে এলেন?

কালই এসেছি। শুনুন, গগ্যার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

ক্লান্ত বিষণ্ণ দুটি দৃষ্টি মেলে বসে থাকেন শান্তি দেবী। যেন আমার বক্তব্যের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। একটু অবাক হতে হল আমাকে। এতটা অনীহার কারণ কি? যাইহোক, যা দেখেছি, যা বুঝেছিযা যা কথাবার্তা হয়েছে আনুপূর্বিক বলে গেলাম। দীর্ঘ সময় শান্তি দেবী কোন কথা বলেননি। ক্রমে ক্রমে তার উদাস দৃষ্টিতে স্বাভাবিকতা ফিরে এল। ওঁর চোখের তারায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠল আগ্রহের রেশ। সব কথা শেষ হতে বললেন, ছবি আঁকতে চায়? আর কিছু না?

না। আর কিছু নয়। বারে বারেই সে বললে ঐ কথা। সে বুঝেছে, ছবি না এঁকে তার নিস্তার নেই। আর এখানে বসে বসে তার ছবি আঁকা হবে না।

হঠাৎ উঠে পড়েন উনি। বলেন, ডাক্তারবাবু, আপনাকে একটু কষ্ট দেব। আমাকে যা বললেন, সেই কথাগুলি আবার আপনাকে বলতে হবে বাবলুকে। কিছুই বাদ দেবেন না। সব কথা খুলে বলবেন।

–বেশ। বাবলু ফিরে আসুক স্কুল থেকে।

না। ও স্কুলে যায়নি আজ। পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে। আসুন, দেখুন।

পাশের ঘরের পর্দা সরিয়ে উনি দেখালেন। এ কী? বাবলু শুয়ে আছে চৌকির উপর; কিন্তু মাথায় একটা ব্যাণ্ডেজ বাঁধা।

-কি ব্যাপার? মাথা ফাটলো কেমন করে?

–স্কুলে মারামারি করে এসেছে। ফুলদার কল্যাণে সারা ঢাকা শহরে রটে গেছে আপনার বন্ধুর কাহিনী। স্কুলে কে বুঝি তাই নিয়ে বাবলুকে কি বলেছে, বাপের অপমান ছেলে সহ্য করেনি। মাথা ফাটিয়ে বাড়ি এসেছে। আপনি ওকে সব কথা খুলে বলুন। ওর জানা দরকার–ওর বাপ ব্যভিচারী নয়! আবার মনে হল, অদ্ভুত মেয়ে এই শান্তি দেবী।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *