Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আদিম রিপু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Banyopadhyay » Page 7

আদিম রিপু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Banyopadhyay

চা শেষ করিয়া পেয়ালা নামাইয়া রাখিয়াছি‌, এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের সমবেত শব্দ শোনা গেল। এতক্ষণে বুঝি পুলিস আসিতেছে।

কিন্তু আমার অনুমান ভুল‌, পুলিসের এখনও ঘুম ভাঙে নাই। যাঁহারা প্রবেশ করিলেন তাঁহারা সংখ্যায় তিনজন; একটি অপরিচিত প্রৌঢ় ভদ্রলোক‌, সঙ্গে নিমাই ও নিতাই। ভাগাড়ে মড়া পড়িলে বহু দূরে থাকিয়াও যেমন শকুনির টনক নড়ে‌, নিমাই ও নিতাই তেমনি খুল্লতাতের মহাপ্ৰস্থানের গন্ধ পাইয়াছে।

পায়ের শব্দে কেষ্টবাবুর ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল‌, তিনি চোখ রাগড়াইয়া উঠিয়া বসিলেন। ভিতর দিক হইতে প্ৰভােতও প্ৰবেশ করিল।

প্রথমে দুই পক্ষ নিবর্কিভাবে দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। নিমাই ও নিতাই প্রৌঢ় ভদ্রলোকের দুই পাশে দাঁড়াইয়া ছিল‌, তাহাদের চক্ষু একে একে আমাদের পর্যবেক্ষণ করিয়া ব্যোমকেশ পর্যন্ত শুক্রমিয়া গেল। দৃষ্টি সন্ধি হইয়া উঠিল। বোধহয় তাহার কোমস্পেকে চিনিতে পারিয়াছে।

প্ৰথমে ব্যোমকেশ কথা বলিল‌, ‘আপনারা কি চান?’

নিমাই ও নিতাই অমনি প্রৌঢ় ভদ্রলোকের দুই কানে ফুসফুস করিয়া কথা বলিল।

প্রৌঢ় ভদ্রলোকের অক্ষৌরিত মুখে কাঁচা-পাকা দাড়িগোঁফ কণ্টকিত হইয়াছিল; অসময়ে ঘুম ভাঙানোর ফলে মেজাজও বোধকরি প্রসন্ন ছিল না। তিনি কিছুক্ষণ বিরাগপূর্ণ চক্ষে ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিয়া বিকৃতস্বরে বলিলেন‌, ‘আপনি কে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পারিবারিক বন্ধু বলতে পারেন। আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী।’

তিনজনের চোখেই চকিত সতর্কতা দেখা দিল। প্রৌঢ় ভদ্রলোক একটু দাম লইয়া প্রশ্ন করিলেন‌, ‘ডিটেকটিভ?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সত্যান্বেষী।’

প্রৌঢ় ভদ্রলোক গলার মধ্যে অবজ্ঞাসূচক শব্দ করিলেন‌, তারপর প্রভাতের দিকে চাহিয়া বলিলেন‌, ‘আমরা খবর পেয়েছি অনাদি হালদার মশায়ের মৃত্যু হয়েছে। এরা দুই ভাই নিমাই এবং নিতাই হালদার তাঁর ভ্রাতুষ্পপুত্র এবং উত্তরাধিকারী। এঁরা মৃতের সম্পত্তি দখল নিতে এসেছেন। এ বাড়ি আপনাদের ছেড়ে দিতে হবে।’

প্রভাত কিছুক্ষণ অবুঝের মত চাহিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশের দিকে দৃষ্টি ফিরাইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাই নাকি? বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে! কিন্তু আপনি কে তা তো জানা গেল না।’

প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলিলেন‌, ‘আমি এদের উকিল কামিনীকান্ত মুস্তফী।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘উকিল। তাহলে আপনার জানা উচিত যে অনাদি হালদারের ভাইপোরা তাঁর উত্তরাধিকারী নয়। তিনি পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন।’

উকিল কামিনীকান্ত নাকের মধ্যে একটি শব্দ করিলেন‌, ব্যোমকেশকে নিরতিশয় অবজ্ঞার সহিত নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন‌, ‘আপনি যখন পারিবারিক বন্ধু আপনার জানা উচিত যে অনাদি হালদার মশায় পোষ্যপুত্র নেননি। মুখের কথায় পোষ্যপুত্র নেওয়া যায় না। দলিল রেজিস্ট্রি করতে হয়‌, যাগযজ্ঞ করতে হয়। অনাদি হালদার মশায় এসব কিছুই করেননি। —আপনাদের এক বস্ত্ৰে এখোন থেকে বেরিয়ে যেতে হবে‌, একটা কুটা নিয়ে যেতে পাবেন না। এখানে যা-কিছু আছে সমস্ত আমার মক্কেলদের সম্পত্তি।’

ব্যোমকেশ ক্ষণকালের জন্য যেন হতভম্ব হইয়া প্ৰভাতের পানে তাকাইল; তারপর সে সামলাইয়া লইল। মুখে একটা বঙ্কিম হাসি আনিয়া বলিল‌, ‘বটে? ভেবেছেন হুমকি দিয়ে অনাদি হালদারের সম্পত্তিটা দখল করবেন। অত সহজে সম্পত্তি দখল করা যায়‌, না উকিলবাবু। পোষ্যপুত্র নেয়া যে আইনসঙ্গত নয় সেটা আদালতে প্রমাণ করতে হবে‌, সাকসেশন সার্টিফিকেট নিতে হবে‌, তবে দখল পাবেন। বুঝেছেন?’

উকিলবাবু বলিলেন‌, ‘আপনারা যদি এই দণ্ডে বাড়ি ছেড়ে না যান‌, আমি পুলিস ডাকব।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পুলিস ডাকবার দরকার নেই‌, পুলিস নিজেই এল বলে। —ভাল কথা‌, অনাদিবাবু যে মারা গেছেন এটা আপনারা এত শীগগির জানলেন কি করে? এখনও দুঘন্টা হয়নি–’

হঠাৎ নিমাই নিতাইয়ের মধ্যে একজন বলিয়া উঠিল‌, দুঘণ্টা। কাকা মারা গেছেন রাত্তির এগারোটার সময়–’ বলিয়াই অর্ধপথে থামিয়া গেল।

ব্যোমকেশ মধুর স্বরে বলিল‌, ‘এগারোটার সময় মারা গেছেন। আপনি জানলেন কি করে? মৃত্যুকালে আপনি উপস্থিত ছিলেন বুঝি? হাতে বন্দুক ছিল?’

নিমাই নিতাই একেবারে নীল হইয়া গেল। উকিলবাবু নিমাই (কিম্বা নিতাই)-কে ধমক দিয়া বলিলেন‌, ‘তোমরা চুপ করে থাকে‌, বিলাকওয়া আমি করব। আপনারা তাহলে দখল ছাড়বেন। না। আচ্ছা‌, আদালত থেকেই ব্যবস্থা হবে।’ বলিয়া তিনি মক্কেলদের বাহু ধরিয়া সিড়ির দিকে ফিরিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, চললেন? আর একটু সবুর করবেন না? পুলিস এসে ভাইপোদের বয়ান নিশ্চয় শুনতে চাইবে। আপনারা কাল রাত্রি এগারোটার সময় কোথায় ছিলেন–’

ব্যোমকেশের কথা শেষ হইবার পূর্বেই ভ্রাতুষ্পপুত্রযুগল উকিলকে পিছনে ফেলিয়া দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়া অন্তহিঁত হইল। উকিল কামিনীকান্ত মুস্তকী ব্যোমকেশের প্রতি একটি গরল-ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া তাহাদের অনুগমন করিলেন।

তাহাদের পদশব্দ নীচে মিলাইয়া যাইবার পর ব্যোমকেশ প্রভাতের দিকে ফিরিয়া প্রশ্ন করিল, ‘আপনি যে আইনত অনাদিবাবুর পোষ্যপুত্তুর নন একথা আগে আমাকে বলেননি কেন?’

প্রভাত ক্ষুব্ধ মুখে দাঁড়াইয়া ঘাড় চুলকাইতে লাগিল। এইবার ননীবালা দেবী সম্মুখে অগ্রসর হইয়া আসিলেন। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই‌, তাঁহার মুখ শুকাইয়া যেন চুপসিয়া গিয়াছে‌, চোখে ডাবড্যাবে ব্যাকুলত। তিনি বলিয়া উঠিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, ওরা যা বলে গেল তা কি সত্যি? প্রভাত অনাদিবাবুর পুষ্যিপুত্তুর নয়?

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সেই কথাই তো জানতে চাইছি?—প্রভাতবাবু–?’

প্ৰভাত ঠোঁট চাটিয়া অস্পষ্টস্বরে বলিল‌, ‘আমি-আইন জানি না। প্ৰথমে কলকাতায় আসবার পর অনাদিবাবু আমাকে নিয়ে সলিসিটারের অফিসে গিয়েছিলেন। সেখানে শুনেছিলাম সুপ্রিশ্ন দিতে হলে দলিল রেজিষ্ট করতে হয়‌, হোম-যজ্ঞ করতে হয়। কিন্তু সে সব কিছু হয়নি।’

‘তাহলে আপনি জানতেন যে আপনি অনাদিবাবুর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নন?’

‘হ্যাঁ, জানতাম। কিন্তু ভেবেছিলাম–’

‘ভেবেছিলেন মৃত্যুর আগে অনাদিবাবু দলিল রেজিস্ট্রি করে আপনাকে পুষ্যিপুতুর করে যাবেন?’

‘হ্যাঁ।’

কিছুক্ষণ নীরব। তারপর ননীবালা দীর্ঘকম্পিত নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন‌, ‘তাহলে— তাহলে-প্রভাত কিছুই পাবে না। সব ওই নিমাই নিতাই পাবে!’ ননীবালার বিপুল দেহ যেন সহসা শিথিল হইয়া গেল‌, তিনি মেঝোয় বসিয়া পড়িলেন।

প্রভাত তুরিতে গিয়া ননীবালার পাশে বসিল‌, গাঢ় হ্রস্ব স্বরে বলিল‌, ‘তুমি ভাবিছ কেন মা! দোকান তো আছে। তাতেই আমাদের দু’জনের চলে যাবে।’

ননীবালা প্ৰভাতের গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। যাহোক‌, তবু অনাদি হালদারের মৃত্যুর পর একজনকে কাঁদিতে দেখা গেল।

ব্যোমকেশ চক্ষু কুঞ্চিত করিয়া তাহদের নিরীক্ষণ করিল‌, তারপর ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিল‌, ‘নৃপেনবাবু কোথায়?’

এতক্ষণ নৃপেনের দিকে কাহারও নজর ছিল না‌, সে আবার নিঃসাড়ে অদৃশ্য হইয়াছে।

ব্যোমকেশ আমাকে চোখের ইশারা করিল। আমি নৃপেনের ঘরের দিকে পা বাড়াইয়াছি। এমন সময় সে নিজেই ফিরিয়া আসিল। বলিল‌, ‘এই যে আমি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কোথায় গিয়েছিলেন?’

‘আমি—একবার ছাদে গিয়েছিলাম।’ নৃপেনের মুখ দেখিয়া মনে হয় সে কোনও কারণে নিশ্চিম্ভ হইয়াছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ছাদে! তেতিলার ছাদে?’

না‌, দোতলাতেই ছাদ আছে।’

‘তাই নাকি? চলুন তো‌, দেখি কেমন ছাদ।’

যে গলি দিয়া নৃপেনের ঘরে যাইবার রাস্তা তাহারই শেষ প্রান্তে একটি দ্বার; দ্বারের ওপারে ছাদ। আলিসা দিয়া ঘেরা দাবার ছকের মত একটু স্থান। পিছন দিকে অন্য একটি বাড়ির দেয়াল‌, পাশে গলির পরপারে অনাদি হালদারের নূতন বাড়ি।

ছাদে দাঁড়াইয়া নুতন বাড়ির কাঠামো স্পষ্ট দেখা যায়‌, এমন কি দীর্ঘলফের অভ্যাস থাকিলে এ-বাড়ি হইতে ও-বাড়িতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। নূতন বাড়ির দেয়াল দোতলার ছাদ পর্যন্ত উঠিয়াছে‌, সবঙ্গে ভারা বাঁধা।

আলিসার ধারে ঘুরিয়া দেখিতে দেখিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘ছাদের দরজা রাত্তিরে খোলা থাকে?’

নৃপেন বলিল‌, ‘খোলা থাকবার কথা নয়‌, কত রোজ রাত্রে শুতে যাবার আগে নিজের হাতে দরজা বন্ধ করতেন।’

‘কাল রাত্রে বন্ধ ছিল?’

‘তা জানি না।’

‘আপনি খানিক আগে যখন এসেছিলেন তখন খোলা ছিল‌, না‌, বন্ধ ছিল?’

নৃপেন আকাশের দিকে তাকাইয়া গলা চুলকাইয়, শেষে বলিল, ‘কি জানি, মনে করতে পারছি না। মনটা অন্যদিকে ছিল—’

‘হুঁ।’

আমরা ঘরে ফিরিয়া গেলাম। ননীবালা দেবী তখনও সর্বহারা ভঙ্গীতে মেঝোয় পা ছড়াইয়া বসিয়া আছেন‌, প্রভাত মৃদুকণ্ঠে তাঁহাকে সান্ত্বনা দিতেছে। কেষ্টবাবু বিলম্বিত চায়ের পেয়ালাটি নিঃশেষ করিয়া নামাইয়া রাখিতেছেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পুলিসের এখনও দেখা নেই। আমরা এবার যাই। —এস অজিত‌, যাবার আগে চাবিটা যথাস্থানে রেখে দেওয়া দরকার‌, নইলে পুলিস এসে হাঙ্গামা করতে পারে।’

ব্যালকনিতে গেলাম। মাছিরা দেহটাকে ছকিয়া ধরিয়াছে। ব্যোমকেশ নত হইয়া চাবিটা মৃতের কোমরে ঘুনসিতে পরাইয়া দিতে দিতে বলিল‌, ‘ওহে অজিত‌, দ্যাখো।’

আমি ঝুঁকিয়া দেখিলাম কোমরের সুতার কাছে একটা দাগ‌, আধুলির মত আয়তনের লালচে একটা দাগ‌, জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কিসের দাগ?’

ব্যোমকেশ দাগের উপর আঙুল বুলাইয়া-বলিল‌, রক্তের দাগ মনে হয়। কিন্তু রক্ত নয়। জড়ুল।’

মৃতদেহ ঢাকা দিয়া আমরা ফিরিয়া আসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমরা চললাম। পুলিস এসে যা-যা প্রশ্ন করবে। তার উত্তর দেবেন‌, বেশি কিছু বলতে যাবেন না। আমি যে আলমারি খুলে দেখেছি তা বলবার দরকার নেই। নিমাই নিতাই যদি আসে তাদের বাড়ি ঢুকতে দেবেন। না।–কেষ্টবাবু্‌, ওবেলা একবার আমাদের বাসায় যাবেন।’

কেষ্টবাবু ঘাড় কত করিয়া সম্মতি জানাইলেন। আমরা নীচে নামিয়া চলিলাম। সূর্য উঠিয়াছে‌, শহরের সোরগোল শুরু হইয়া গিয়াছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *