Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আদিম রিপু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Banyopadhyay » Page 6

আদিম রিপু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Banyopadhyay

তিনজনে ওঘরে ফিরিয়া গিয়া দেখিলাম‌, কেষ্টবাবু এবং প্রভাত বেঞ্চির দুই কোণে উপবিষ্ট। কেষ্টবাবু হাই তুলিতেছেন এবং আড়চক্ষে প্রভাতকে নিরীক্ষণ করিতেছেন। প্রভাত করতলে চিবুক রাখিয়া চিন্তামগ্ন। ননীবালা মেঝোয় পা ছড়াইয়া দেয়ালে ঠেস দিয়া ঝিমাইয়া পড়িয়াছেন। আমাদের দেখিয়া সকলে সিধা হইলেন। প্রভাত বেঞ্চি ছাড়িয়া উঠিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল‌, ‘বসুন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বসব না। ভোর হয়ে এল‌, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। এখনি হয়তো পুলিস এসে পড়বে। আমাদের দেখলে পুলিসের মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে পারে। আপনাদের একটা কথা বলে রাখি মনে রাখবেন। কারুর ঘাড়ে দোষ চাপাবার চেষ্টা করবেন না‌, তাতে নিজেরই অনিষ্ট হবে, পুলিস হয়তো সকলকেই ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে পুরবে।’

সকলে চুপ করিয়া রহিল।

‘প্রভাতবাবু্‌, এবার আপনার কথা বলুন। কাল আপনি আপনার মাকে সিনেমায় পৌঁছে দিয়েছিলেন‌, নিজে সিনেমা দেখেননি?’

প্ৰভাত বলিল‌, ‘না। আমি টিকিট কিনে মাকে সিনেমায় বসিয়ে দিয়ে নিজের দোকানে গিয়েছিলাম।’

‘ও। রাত্রি সাড়ে আটটার পর দোকানে গেলেন?’

‘হাঁ। দেয়ালির রাত্রে দোকান আলো দিয়ে সাজিয়েছিলাম।’

‘তারপর?

‘তারপর পেীনে বারোটার সময় দোকান বন্ধ করে আবার সিনেমায় গেলাম‌, সেখান থেকে মাকে নিয়ে ফিরে এলাম।’

মুছলমান্দাজ নটা থেকে পোনে বারোটা পর্যন্ত্র আপনি দোকানই ছিলেন। দোকানে আর কেউ ছিল?’

‘গুরুং ছিল‌, দোরের সামনে পাহারা দিচ্ছিল।’

‘গুরুং-মানে গুর্খা দরোয়ান। খদ্দের কেউ আসেননি?’

‘না।’

‘সারাক্ষণ দোকানে বসে কি করলেন?’

‘কিছু না। পিছনে কুঠরিতে বসে বই বাঁধলাম।’

‘আচ্ছা‌, ওকথা যাক।–অনাদিবাবুর সঙ্গে আপনার সদ্ভাব ছিল?’

প্রভাত ক্ষুব্ধ চোখ তুলিল‌, ‘না। উনি আমাকে পুষ্যিপুতুর নিয়েছিলেন‌, প্রথম প্রথম ভাল ব্যবহার করতেন। তারপর–ক্রমশ—’

‘ক্রমশ ওঁর মন বদলে গেল? আচ্ছা‌, উনি আপনাকে পুষ্যপুত্তুর নিয়েছিলেন কেন?’

‘তা জানি না।’

‘প্ৰথম প্ৰথম ভাল ব্যবহার করতেন‌, তারপর মন-মেজাজ বদলে গেল; এর কোনও কারণ হয়েছিল কি?’

‘হয়তো হয়েছিল। আমি জ্ঞানত কোনও দোষ করিনি।’

প্রভাত ক্লান্তভাবে আবার বেঞ্চিতে বসিল। ব্যোমকেশ তাহাকে সদয়-চক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘আপনি বরং কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন গিয়ে। পুলিস একবার এসে পড়লে আর বিশ্রাম পাবেন কি না সন্দেহ।’

প্ৰভাত কিন্তু কেবল মাথা নাড়িল। ব্যোমকেশ তখন ননীবালার দিকে ফিরিয়া বলিল‌, ‘আপনার সঙ্গেও তো অনাদিবাবুর সদ্ভাব ছিল না।’

ননীবালা যুগপৎ মুখ এবং গো-চক্ষু ব্যাদিত করিয়া প্রায় কাঁদো-কাঁদো হইয়া উঠিলেন‌, ‘আপনাকে তো সবই বলেছি‌, ব্যোমকেশবাবু। আমি ছিলুম। বুড়োর চক্ষুশূল। প্রভাতকে বুড়ো ভালবাসত‌, কিন্তু আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারত না। রাতদিন ছুতো খুঁজে বেড়াতো; একটা কিছু পেলেই শুরু করে দিত দাঁতের বান্দ্যি। এমন নীচ অন্তঃকরণ–’ ননীবালা থামিয়া গেলেন। অনাদি হালদার মরিয়াছে বটে‌, কিন্তু তাহার মৃতদেহ অদূরেই পড়িয়া আছে‌, এই কথা সহসা স্মরণ করিয়াই বোধ করি আত্মসংবরণ করিলেন। অধিকন্তু অনাদিবাবুর সহিত তাঁহার অসদ্ভাবের প্রসঙ্গ অপ্ৰকাশ থাকাই বাঞ্ছনীয়‌, তাহা কিঞ্চিৎ বিলম্বে উপলব্ধি করিলেন।

কেষ্টবাবুও সেই ইঙ্গিত করিলেন‌, হেঁচ্‌কি তোলার মত একটা হাসির শব্দ করিয়া বলিলেন‌, ‘তাহলে শুধু আমার সঙ্গেই অনাদির ঝগড়া ছিল না!’

প্রভাত একবার ঘাড় ফিরাইয়া তাহার দিকে তাকাইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ও কথার কোনও মানে হয় না। দেখা যাচ্ছে সকলের সঙ্গেই অনাদি হালদারের ঝগড়া ছিল; তাতে কিছু প্ৰমাণ হয় না। খুন করতে হলে যেমন খুন করার ইচ্ছে থাকা চাই‌, তেমনি খুন করার সুযোগও দরকার।’ ব্যোমকেশ ননীবালার দিকে ফিরিয়া বলিল‌, ‘কাল সিনেমা কেমন দেখলেন?’

ননীবালা আবার হা করিয়া চাহিলেন।

‘অ্যাঁ–সিনেমা–!’

‘ছবিটা শেষ পর্যন্ত দেখেছিলেন?’

এতক্ষণে ননীবালা বোধহয় প্রশ্নের মমর্থ অনুধান করিলেন‌, বলিলেন‌, ‘ওমা‌, তা আবার দেখিনি! গোড়া থেকে শেষ অবধি দেখেছি‌, ছবি শেষ হয়েছে। তবে বাইরে এসেছি। আমিও বাইরে এসে দাঁড়ালাম‌, আর প্রভাত এল। ওর সঙ্গে বাসায় চলে এলুম। এসে দেখি—’

ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল‌, ‘জানি। এবার চলুন‌, অনাদি হালদারের শোবার ঘরে যাওয়া যাক। লোহার আলমারিটা দেখা দরকার।’

আমরা ছয়জন একজোট হইয়া অনাদি হালদারের শয়নকক্ষের দিকে চলিলাম। কয়েকদিন আগে যে ঘরে অনাদি হালদারের সহিত দেখা হইয়াছিল‌, তাহারই পাশের ঘর। নৃপেন দ্বারের পাশে সুইচ টিপিয়া আলো জ্বলিয়া দিল।

ঘরটি আকারে প্রকারে নৃপেনের ঘরের মতই‌, তবে বাড়ির অন্য প্রান্তে। একটি গরাদযুক্ত জানালা খোলা রহিয়াছে। ঘরে একটি খাট এবং তাহার শিয়রে একটি স্টীলের আলমারি ছাড়া আর কিছু নাই।

আমরা সকলে ঘরে প্রবেশ করিলে ঘরে স্থানাভাব ঘটিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনাদের সকলকে এ-ঘরে দরকার নেই। কেষ্টবাবু্‌, আপনি বরং ও-ঘরে থাকুন গিয়ে। সিঁড়ির দরজা ভাঙা‌, এখুনি হয়তো পুলিস এসে পড়বে।’

আলমারির ভিতর কি আছে‌, তাহা জানিবার কৌতুহল অন্যান্য সকলের মত কেষ্টবাবুরও নিশ্চয় ছিল‌, কিন্তু তিনি বলিলেন‌, ‘কুছ পরোয়া নেই‌, আমিই মড়া আগলাবো। কিন্তু‌, এই সময় অন্তত এক পেয়ালা গরম চা পাওয়া যেত।’ বলিয়া তিনি সম্পৃহভাবে হাত ঘষিতে লাগিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, চা হলে মন্দ হত না‌, সে ননীবালার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টি ফিরাইল।

ননীবালা অনিচ্ছাভরে বলিলেন‌, ‘চা আমি করতে পারি। কিন্তু দুধ নেই যে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দুধের বদলে লেবুর রস চলতে পারে।’

কেষ্টবাবু গাঢ়স্বরে বলিলেন‌, ‘আদা! আদা! আদার রস দিয়ে চা খান‌, শরীর চাঙ্গা হবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আদার রসও চলবে।’

ননীবালা ও কোষ্ট্রবাবু প্ৰস্থান করিলে নৃপেন একটু ইতস্তত করিয়া বলিল‌, ‘আমাকে দরকার হবে কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনাকেই দরকার। প্রভাতবাবু বরং নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করতে পারেন।’

প্রভাত একবার যেন দ্বিধা করিল‌, তারপর কোনও কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিল। ঘরে রহিলাম আমরা দু’জন ও নৃপেন।

ঘরে বিশেষ দ্রষ্টব্য কিছু নাই। খাটের উপর বিছানা পাতা; পরিষ্কার বিছানা‌, গত রাত্রে ব্যবহৃত হয় নাই। দেয়ালে আলনায় একটি কাচা ধুতি পাকানো রহিয়াছে। এক কোণে গেলাস-ঢাকা জলের কুঁজা। ব্যোমকেশ এদিকে ওদিকে দৃষ্টি বুলাইয়া পকেট হইতে চাবি বাহির করিল।

আলমারিটা নূতন। বার্নিশ করা কাঠের মত রঙ‌, লম্বা সরু আকৃতি‌, অত্যন্ত মজবুত। ব্যোমকেশ চাবি ঘুরাইয়া জোড়া কবাট খুলিয়া ফেলিল। আমি এবং নৃপেন সাগ্রহে ভিতরে উঁকি মারিলাম।

ভিতরে চারিটি থাক। সবেচি থাকের এক প্ৰান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এক সারি বই; মাঝে মাঝে ভাঙা দাঁতের মত ফাঁক পড়িয়াছে। কয়েকটি বইয়ের পিঠে সোনার জলে নাম লেখা,

অধিকাংশই বটতলার বই‌, কিন্তু বাঁধাই ভাল। হয়তো প্ৰভাত বাঁধিয়া দিয়াছে।

ব্যোমকেশ নৃপেনকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘অনাদি হালদার কি খুব বই পড়ত?’

নৃপেন শুষ্কস্বরে বলিল‌, ‘কোন দিন পড়তে দেখিনি।’

‘বাড়িতে আর কেউ বই পড়ে?’

‘প্রভাতবাবু পড়েন। আমিও পেলে পড়ি। কিন্তু কর্তার আলমারিতে যে বই আছে‌, তা আমি কখনও চোখে দেখিনি।’

‘অথচ বইয়ের সারিতে ফাঁক দেখে মনে হচ্ছে কয়েকখানা বই বার করা হয়েছে। কোথায় গেল বইগুলো?’

নৃপেন ঘরের এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল‌, ‘তা তো বলতে পারি না। এ-ঘরে দেখছি না। প্রভাতবাবুকে জিজ্ঞেস করব?

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখন থাক‌, এমন কিছু জরুরী কথা নয়।–আচ্ছা‌, বাইরে অনাদি হালদারের কোথায় বেশি যাতায়াত ছিল?’

নৃপেন বলিল‌, ‘কত বাড়ি থেকে বড় একটা বেরুতেন না। যখন বেরুতেন‌, হয় সলিসিটারের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন‌, নয়তো ব্যাঙ্কে যেতেন। এ ছাড়া আর বড় কোথাও যাতায়াত ছিল না।’

ব্যোমকেশ দ্বিতীয় থাকের প্রতি দৃষ্টি নামাইল।

দ্বিতীয় থাকে অনেকগুলি শিশিী-বোতল রহিয়াছে। শিশিগুলি পেটেন্ট ঔষধের‌, বোতলগুলি বিলাতি মদ্যের। একটি বোতলের মদ্য প্রায় তলায় গিয়া ঠেকিয়াছে‌, অন্যগুলি সীল করা।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অনাদি হালদার মদ খেত?’

নৃপেন বলিল‌, ‘মাতাল ছিলেন না। তবে খেতেন। মাঝে মধ্যে গন্ধ পেয়েছি।’

ঔষধের শিশিগুলি পরীক্ষা করিয়া দেখা গেল অধিকাংশই টনিক জাতীয় ঔষধ্‌্‌, অতীত যৌবনকে পুনরুদ্ধার করিবার বিলাতি মুষ্টিযোগ। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘সন্ধের পর বেড়াতে বেরুনোর অভ্যোস অনাদি হালদারের ছিল না?’

নৃপেন বলিল‌, ‘খুব বেশি নয়‌, মাসে দু’-তিন দিন বেরুতেন।’

‘বাঃ! অনাদি হালদারের গোটা চরিত্রটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। খাসা চরিত্র!’ ব্যোমকেশ আলমারির তৃতীয় থাকে মন দিল।

তৃতীয় থাকে অনেকগুলি মোটা মোটা খাতা এবং কয়েকটি ফাইল। খাতাগুলি কার্ডবোর্ড দিয়া মজবুত করিয়া বাঁধানো। খুলিয়া দেখা গেল ব্যবসা সংক্রান্ত হিসাবের খাতা। ব্যবসায়ের রীতি প্রকৃতি জানিতে হইলে খাতাগুলি ভাল করিয়া অধ্যয়ন করা প্রয়োজন; কিন্তু তাহার সময় নাই। ব্যোমকেশ নৃপেনকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘অনাদি হালদার কিসের ব্যবসা করত। আপনি জানেন?’

নৃপেন বলিল‌, ‘আগে কি ব্যবসা করতেন জানি না‌, উনি নিজের কথা কাউকে বলতেন না। তবে যুদ্ধের গোড়ার দিকে জাপানী মাল কিনেছিলেন। কটন মিলে যেসব কলকন্তুজা লাগে‌, তাই। সস্তায় কিনেছিলেন–’

‘তারপর কালাবাজারের দরে বিক্রি করেছিলেন। বুঝেছি।’ ব্যোমকেশ একখানা ফাইল তুলিয়া লইয়া মলাট খুলিয়া ধরিল।

ফাইলে নানা জাতীয় দলিলপত্র রহিয়াছে। নূতন বাড়ির ইষ্টম্বর দস্তাবেজ‌, সলিসিটারের চিঠি‌, বাড়িভাড়ার রসিদ‌, ইত্যাদি। কাগজপত্রের উপর লঘুভাবে চোখ বুলাইতে বুলাইতে ব্যোমকেশ পাতা উল্টাইতে লাগিল‌, তারপর এক জায়গায় আসিয়া থামিল। একটি রুলটানা কাগজে কয়েক ছত্র লেখা‌, নীচে স্ট্যাম্পের উপর দস্তখত।

কাগজখানা ব্যোমকেশ ফাইল হইতে বাহির করিয়া লইল‌, মুখের কাছে তুলিয়া মনোযোগ সহকারে পড়িতে লাগিল। আমি গলা বাড়াইয়া দেখিলাম‌, একটি হ্যান্ডনেট। অনাদি হালদার হাতচিঠির উপর দয়ালহরি মজুমদার নামক এক ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দিয়াছে।

ব্যোমকেশ হ্যান্ডনেট হইতে মুখ তুলিয়া বলিল‌, ‘দয়ালহরি মজুমদার কে?’

নৃপেন কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘দয়ালহরি-ও‌, মনে পড়েছে–একটু কাছে সরিয়া আসিয়া খাটো গলায় বলিল‌, ‘দয়ালহরিবাবুর মেয়েকে প্রভাতবাবু বিয়ে করতে চেয়েছিলেন‌, তারপর কর্তা মেয়ে দেখে অপছন্দ করেন–’

‘মেয়ে বুঝি কুচ্ছিৎ?’

‘আমরা কেউ দেখিনি।’

‘কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা ধার দেওয়ার মানে কি?’

‘জানি না; হয়তো ওই জন্যেই–’

‘ওই জন্যে কী?’

‘হয়তো‌, যাকে টাকা ধার দিয়েছেন‌, তার মেয়ের সঙ্গে কর্তা প্রভাতবাবুর বিয়ে দিতে চাননি।’

‘হতে পারে। অনাদি হালদার কি তেজারিতির কারবার করত?’

‘না। তাঁকে কখনও টাকা ধার দিতে দেখিনি।’

‘হ্যান্ডনোটে তারিখ দেখছি ১১/৯/১৯৪৬‌, অর্থাৎ মাসখানেক আগেকার। অনাদি হালদার মেয়ে দেখতে গিয়েছিল কবে?’

‘প্ৰায় ওই সময়। তারিখ মনে নেই।’

‘দয়ালহরি মজুমদার সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন?

‘কিছু না। বাইরে শুনেছি মেয়েটি নাকি খুব ভাল গাইতে পারে‌, এরি মধ্যে খুব নাম করেছে। ওরা পূর্ববঙ্গের লোক‌, সম্প্রতি কলকাতায় এসেছে।’

‘তাই নাকি! অজিত‌, দয়ালহরি মজুমদারের ঠিকানাটা মনে করে রাখ তো—’ হাতচিঠি দেখিয়া পড়িল–’১৩/৩‌, রামতনু লেন‌, শ্যামবাজার।’

মনে মনে ঠিকানাটা কয়েকবার আবৃত্তি করিয়া লইলাম। ব্যোমকেশ আলমারির নিম্নতম থাকটি তদারক করিতে আরম্ভ করিল।

নীচের থাকে কেবল একটি কাঠের হাত-বাক্স আছে‌, আর কিছু নাই। হাত-বাক্সের গায় চাবি লাগানো। ব্যোমকেশ চাবি ঘুরাইয়া ডালা তুলিল। ভিতরে একগোছা দশ টাকার নোট‌, কিছু খুচরা টাকা-পয়সা এবং একটি চেক বহি।

ব্যোমকেশ নোটগুলি গণিয়া দেখিল। দুইশত ষাট টাকা। চেক বহিখানি বেশ পুরু‌, একশত চেকের বহি; তাহার মধ্যে অর্ধেকের অধিক খরচ হইয়াছে। ব্যোমকেশ ব্যবহৃত চেকের অর্ধাংশগুলি উল্টাইয়া দেখিতে দেখিতে প্রশ্ন করিল‌, ‘ভারত ব্যাঙ্ক ছাড়া আর কোনও ব্যাঙ্কে অনাদি হালদার টাকা রাখত?’

নৃপেন বলিল‌, ‘তিনি কোন ব্যাঙ্কে টাকা রাখতেন তা আমি জানি না।’

‘আশ্চর্য! নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে‌, কনট্রাকটরকে টাকা দিত কি করে?’

‘ক্যাশ দিতেন। আমি জানি‌, কারণ আমি রসিদের খসড়া তৈরি করে কনট্রকটরকে দিয়ে সই করিয়ে নিতাম। যেদিন টাকা দেবার কথা‌, সেদিন বেলা ন’টার সময় কত বেরিয়ে যেতেন‌, এগারটার সময় ফিরে আসতেন। তারপর কনট্রাকটরকে টাকা দিতেন।’

‘অর্থাৎ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা আনতে যেতেন?’

‘আমার তাই মনে হয়।’

‘হুঁ। বাড়ির দরুন কনট্রাকটরকে কত টাকা দেওয়া হয়েছে‌, আপনি জানেন?’

নৃপেন মনে মনে হিসাব করিয়া বলিল‌, ‘প্রায় ত্ৰিশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। রসিদগুলো বোধহয় ফাইলে আছে। যদি জানতে চান–’

ব্যোমকেশ চেক বহি রাখিয়া অর্ধ-স্বাগত বলিল‌, ‘ভারি আশ্চর্য!-না‌, চুলচেরা হিসেব দরকার নেই। চল অজিত‌, এ ঘরে দ্রষ্টব্য যা কিছু দেখা হয়েছে।’ বলিয়া সযত্নে আলমারি বন্ধ করিল।

এই সময় ননীবালা একটি বড় থালার উপর চার পেয়ালা চা লইয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন‌, ‘এই নিন। —প্ৰভাত নিজের ঘরে শুয়ে আছে; তার চা দিয়ে এসেছি।’

নৃপেন আলো নিভাইয়া দিল। জানালা দিয়া দেখা গেল বাহিরে বেশ পরিষ্কার হইয়া গিয়াছে।

আমরা তিনজনে চায়ের পেয়ালা হাতে লইয়া বাহিরের ঘরে আসিলাম‌, কেষ্টবাবুর চায়ের পেয়ালা থালার উপর লইয়া ননীবালা আমাদের সঙ্গে আসিলেন।

বেঞ্চের উপর লম্বা হইয়া শুইয়া কেষ্টবাবু ঘুমাইতেছেন। ঘর্ঘর শব্দে তাঁহার নাক ডাকিতেছে।

ব্যালকনিতে উঁকি মারিয়া দেখিলাম‌, অনাদি হালদারের মৃত মুখের উপর সকালের আলো পড়িয়াছে। মাছিরা গন্ধ পাইয়া আসিয়া জুটিয়াছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *