Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আদিম রিপু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Banyopadhyay » Page 12

আদিম রিপু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Banyopadhyay

হাপ্তাখানেক কাটিয়া গেল। কোনও দিক হইতে আর কোনও সাড়া শব্দ নাই নিমাই-নিতাইকে ব্যোমকেশ অবিলম্বে আসিয়া দেখা করিতে বলিয়াছিল‌, তাহারাও নিশ্চুপ। আবার যেন সব ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। ইস্টিশন হইতে ট্রেন ছাড়িয়া গেলে যেমন হয়‌, এ যেন অনেকটা সেইরকম অবস্থা।

তারপর ট্রেন আসিল। একটার পর একটা ট্রেন আসিতে লাগিল। শেষ পর্যন্ত এত ট্রেন আসিল যে নিশ্বাস ফেলিবার সময় রহিল না।

সকালবেলা ডাকে দু’টি চিঠি আসিল। একটি চিঠি সত্যবতীর। সে দীর্ঘকাল আমাদের না। দেখিয়া আমাদের বাঁচিয়া থাকা সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া উঠিয়াছে‌, অবিলম্বে দর্শন চায়। দ্বিতীয় চিঠিখানি খেজুরহাটের রমেশ মল্লিকের। তিনি লিখিয়াছেন—

ভাই ব্যোমকেশ‌, তুমি তাহলে আমাকে ভোলনি? তোমার চিঠি পেয়ে কী আনন্দ যে হল বলতে পারি না। সেই পুরনো ভুলে যাওয়া কলেজ-জীবনের কথা আবার মনে পড়ে যাচ্ছে।

ভাই, আমি তোমার সঙ্গে নিশ্চয় দেখা করতে যেতাম, কিন্তু কিছুদিন থেকে বাতে শয্যাশায়ী হয়ে আছি‌, নড়বার ক্ষমতা নেই। তোমার কীর্তিকলাপ বইয়ে পড়েছি‌, তুমি কলকাতায় থাকো তাও জানি। কিন্তু ঠিকানা জানা ছিল না বলে এতদিন যেতে পারিনি। এবার সেরে উঠেই যাব।

তুমি যার কথা জানতে চেয়েছ তার সম্বন্ধে অনেক কথাই জানি‌, দেখা হলে সব বলব। ভারি গুণী লোক। একবার জেল খেটেছে। ওর প্রধান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে‌, যে-কোনও তালার চাবি একবার দেখলে অবিকল নকল চাবি তৈরি করতে পারে। গুণধর ছেলে‌, খুড়ো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। খুড়োর সিন্দুকের চাবি তৈরি করেছিল‌, মাঝে মাঝে পোশ দশ টাকা সরাতো। খুড়ো তাড়িয়ে দেবার পর কলকাতায় গিয়ে চাকরি করত‌, সেখানেও ক্যাশ-বাক্সর চাবি তৈরি করেছিল। ধরা পড়ে জেলে গেল। সে আজ চার পাঁচ বছরের কথা। তুমি কোন সূত্রে তার সম্পর্কে এসেছ জানি না‌, কিন্তু সাবধানে থেকো।

তোমাকে দেখার জন্যে মন ছট্‌ফটু করছে। আজ এই পর্যন্ত। ভালবাসা নিও। ইতি-তোমার রমেশ।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘গুণী লোক তাতে সন্দেহ কি। এমন গুণী লোক পৃথিবীতে অল্পই আছে। যাহোক‌, ন্যাপার কার্য-পদ্ধতি এবার বেশ বোঝা যাচ্ছে। অনাদি হালদার আলমারির চাবি কোমরে রাখত‌, দেখার সুবিধে ছিল না। কোনও সময় ন্যাপী একবার চাবিটা দেখে ফেলেছিল‌, সে চাবি তৈরি করল। আলমারিতে মাল আছে সে জানত‌, সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর কালীপুজোর রাত্ৰে— বলিয়া ব্যোমকেশ থামিল।

‘কালীপুজোর রাত্রে কী?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিবার পূবেই দ্বারের কড়া নড়িয়া উঠিল। দ্বার খুলিয়া দেখি‌, অপূর্ব দৃশ্য। উকিল কামিনীকান্ত মুস্তকী দুই পাশে দুই মক্কেল লইয়া দাঁড়াইয়া আছেন। কামিনীকান্তর মুখে সুধাবিগলিত হাসি। নিমাই ও নিতাইকে দেখিয়া মানুষ বলিয়া চেনা যায় না‌, সত্য সত্যই দু’টি ভিজা বিড়াল। খালি পা‌, গায়ে গরদের দোছোট‌, মুখে অক্ষৌরিত দাড়ি‌, অশৌচের বেশ।

তিনজনে ঘরে প্রবেশ করিলেন। ব্যোমকেশ আরাম-কেদারা হইতে একবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল‌, তাহার মুখের তাচ্ছিল্য-ভাব ক্ৰমে ব্যঙ্গহাস্যে পরিণত হইল। সে বলিল‌, ‘আপনারা শেষ পর্যন্ত এলেন তাহলে?—বসুন।’

তিনজনে তক্তপোশের কিনারায় বসিলেন। কামিনীকান্ত বলিলেন‌, ‘একটু দেরি হয়ে গেল। আপনি চিঠিতে যে-রকম ভয় দেখিয়ে দিয়েছিলেন‌, ওরা একলা আসতে সাহস করেনি‌, আমার কাছে ছুটে গিয়েছিল। তা আমি হলাম গিয়ে উকিল‌, একটু খোঁজ-খবর না নিয়ে তো আসতে পারি না। তাই—‘

‘কোথায় খোঁজ-খবর নিলেন? শ্ৰীকান্ত পান্থনিবাসে? সেখানে বুঝি সুবিধে হল না? সাক্ষী ভাঙাতে পারলেন না? শ্ৰীকান্তবাবু সত্যের অপলাপ করতে রাজী হলেন না?’

কামিনীকান্তবাবু আহত স্বরে বলিলেন‌, ‘ছি ছি‌, এ আপনি কি বলছেন‌, ব্যোমকেশবাবু! সাক্ষী ভাঙানো আমার পেশা নয়‌, মক্কেলের পক্ষ থেকে সত্য আবিষ্কার করাই আমার কাজ।’

‘সত্য আবিষ্কার করবার জন্যে শ্রীকান্ত হোটেলে যাবার দরকার ছিল না, মক্কেল দুটিকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারতেন।’

‘ওরা ছেলেমানুষ‌, তার ওপর অশৌচ চলছে। যাহোক‌, আপনি কি জানতে চান বলুন‌, কোনও কথাই ওরা আপনার কাছে লুকোবে না। ওদের বয়ান শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন যে‌, ওরা সম্পূর্ণনিদেৰ্য।’

ব্যোমকেশ নিতাই ও নিমাইকে পযায়িক্রমে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘এদের মধ্যে শ্ৰীকান্ত হোটেলে যাতায়াত করতেন কে?’

কামিনীকান্ত বলিলেন‌, ‘ওরা দু’জনেই যেত। তবে ওদের চেহারা অনেকটা একরকম‌, তাই বোধহয় হোটেলের লোকেরা বুঝতে পারেনি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হুঁ। শ্ৰীকান্ত হোটেলের তেতলার ঘর ভাড়া নেবার উদ্দেশ্য কি?’

কামিনীকান্ত বলিলেন‌, ‘তাহলে গোড়া থেকেই সব খুলে বলি–’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওঁদের কথা ওঁরা নিজের মুখে বললেই ভাল হত না?’

‘হেঁ হেঁ‌, সে তো ঠিক কথা। তবে কি জানেন‌, ওরা ছেলেমানুষ‌, তার ওপর ব্যাপারস্যাপার দেখে খুবই নাভাস হয়ে পড়েছে। হয়তো বলতে গিয়ে গোলমাল করে ফেলবে-আপনি সন্দেহ করবেন ওরা মিছে কথা বলছে—’

নিশ্বাস ফেলিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ আপনিই বলুন তাহলে। বুঝতে পারছি আপনার বলা আর ওদের বলায় কোনও তফাৎ হবে না। মিছে সময় নষ্ট করে লাভ কি?’

ছেলেমানুষ দু’টি বাঙ্‌নিষ্পত্তি করিল না‌, কামিনীকান্ত তাদের জবানীতে কাহিনী বিবৃত করিলেন। মোটামুটি কাহিনীটি এই—

বছর দুই আগে অনাদি হালদার মহাশয় যখন কলিকাতায় বসবাস আরম্ভ করেন তখন নিমাই নিতাই খবর পাইয়া কাকার কাছে ছুটিয়া আসে। তাহারা পিতৃহীন‌, কাকাই তাঁহাদের একমাত্র অভিভাবক‌, কাকাকে তাহারা সাবেক বাড়িতে লইয়া যাইবার জন্য নির্বন্ধ করে।

অনাদি হালদার অতিশয় সজ্জন এবং ভালো মানুষ ছিলেন‌, ভাইপোদের প্রতি তাঁহার মেহের সীমা ছিল না। কিন্তু একদল দুষ্ট লোক তাঁহার ভালমানুষীর সুযোগ লইয়া ঘাড়ে চাপিয়া বসিয়াছিল‌, তাঁহার কানে কুমন্ত্রণা দিতে লাগিল‌, ভাইপোদের উপর তাঁহার মন বিরূপ করিয়া তুলিল। তিনি নিতাই-নিমাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিয়া দিলেন।

নিমাই নিতাই ন্যায়তঃ ধৰ্মতঃ অনাদিবাবুর উত্তরাধিকারী। তাঁহাদের ভয় হইল‌, এই দুষ্ট লোকগুলো কাকাকে ঠকাইয়া সমস্ত সম্পত্তি আত্মসাৎ করিবে‌, হয়তো তাঁহাকে খুন করিতেও পারে। নিমাই নিতাই তখন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিয়া শ্ৰীকান্ত হোটেলে ঘর ভাড়া করিল। এবং জানোলা দিয়া অনাদিবাবুর বাসার উপর নজর রাখিতে লাগিল। তাঁহাদের বাড়িতে একটাশ পুরনো আমলের দূরবীন আছে‌, সেই দূরবীন চোখে লাগাইয়া অনাদিবাবুর বাসার ভিতরকার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করিবার চেষ্টা করিত। এই দেখুন সেই দূরবীন।

—নিমাইনিতাইয়ের একজন চাদরের ভিতর হইতে দূরবীন বাহির করিয়া দেখাইল। চামড়ার খাপের মধ্যে চোঙের মত দূরবীন‌, টানিলে লম্বা হয়; ব্যোমকেশ নাড়িয়া চাড়িয়া ফেরত দিল। কামিনীকান্ত আবার আরম্ভ করিলেন। —

নিমাই নিতাই পালা করিয়া হোটেলে যাইত এবং চোখে দূরবীন লাগাইয়া জানালার কাছে বসিয়া থাকিত। অবশ্য ইহা নিতান্তাই ছেলেমানুষী কাণ্ড। কামিনীকান্ত কিছু জানিতেন না‌, জানিলে এমন হাস্যকর ব্যাপার ঘটিতে দিতেন না। যাহোক‌, এইভাবে কয়েকমাস কাটিবার পর কালীপূজার রাত্ৰি আসিয়া উপস্থিত হইল।

রাত্রি দশটা আন্দাজ নিমাই হোটেলে গিয়া দূরবীন লাগাইয়া বসিল। অনাদিবাবু ব্যালকনিতে দাঁড়াইয়া বাজি পোড়ানো দেখিতেছিলেন। এগারোটার সময় এক ব্যাপার ঘটিল। অনাদিবাবু হঠাৎ পিছনের দরজার দিকে ফিরিলেন‌, যেন পিছনে কাহারও সাড়া পাইয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকের আওয়াজ হইল এবং বন্দুকের গুলি নিমাইয়ের কানের পাশ দিয়া চলিয়া গেল। ওদিকে ব্যালকনিতে অনাদিবাবু ধরাশায়ী হইলেন। কিন্তু ঘরের অন্ধকার হইতে কে গুলি চালাইয়াছে নিমাই তাহা দেখিতে পাইল না।

নিমাই ব্যাপার বুঝিতে পারিল। বন্দুকের গুলি অনাদিবাবুর শরীর ভেদ করিয়া আর একটু হইলে নিমাইকেও বধ করিত; ভাগ্যক্রমে গুলিটা তাহার রগ ঘোষিয়া চলিয়া গিয়াছে। সে তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরিয়া গেল এবং দুই ভাইয়ে পরামর্শ করিয়া সেই রাত্রেই কামিনীকান্তর কাছে উপস্থিত হইল। তারপর যাহা যাহা ঘটিয়াছে ব্যোমকেশবাবু তাহা ভালভাবেই জানেন।

ইহাই সত্য পরিস্থিতি‌, ইহাতে বিন্দুমাত্র মিথ্যা নাই। ব্যোমকেশবাবু বিবেচক ব্যক্তি‌, তিনি নিশ্চয় বুঝিয়াছেন যে পূজ্যপাদ খুল্লতাতকে বধ করা কোনও ভদ্রলোকের ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব তিনি যেন পুলিসে খবর না দেন। পুলিস-বিশেষত বর্তমানকালের পুলিস-যদি এমন একটা ছুতা পায় তাহা হইলে নিতাই-নিমাইকে নাস্তানাবুদ করিয়া ছাড়িবে‌, নিরাপরাধের প্রতি জুলুম করিবে। ইহা কদাচ বাঞ্ছনীয় নয়। একেই তো অবিচার অত্যাচারে দেশ ছাইয়া গিয়াছে।

কামিনীকান্ত শেষ করিলে ব্যোমকেশ আড়মোড়া ভাঙিয়া হাই তুলিল‌, অলসকণ্ঠে বলিল‌, ‘এঁরা succession certificate-এর জন্য দরখাস্ত করেছেন নিশ্চয়? তার কি হল?’

কামিনীকান্ত বলিলেন‌, ‘দরখাস্ত করা হয়েছে। তবে আদালতের ব্যাপার‌, সময় লাগবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার বিশ্বাস প্রভাত কোনও আপত্তি তুলবে না। তবে বইয়ের দোকানটা তার নিজের নামে; আপনারা যদি সেদিকে হাত বাড়ন তাহলে সে লড়বে।’

‘না না‌, অনাদিবাবু যা দান করে গেছেন তার ওপর ওদের লোভ নেই। —তাহলে ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি শ্ৰীকান্ত হোটেলের কথাটা প্ৰকাশ করবেন না। আশা করতে পারি কি?’

‘এ বিষয়ে আমি বিবেচনা করে দেখব। নিমাইবাবু নিতাইবাবু যদি নির্দোষ হন তাহলে নিৰ্ভয়ে থাকতে পারেন। আচ্ছা‌, আজ আসুন তাহলে।’

তিনজনে গাত্ৰোত্থান করিয়া পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিলেন‌, চোখে চোখে কথা হইল। তারপর কামিনীকান্ত একটু আমতা আমতা করিয়া বলিলেন‌, ‘আজ আমরা আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। ক্ষতিপূরণস্বরূপ সামান্য কিছু— বলিয়া পকেট হইতে পাঁচটি একশত টাকার নোট বাহির করিয়া বাড়াইয়া ধরিলেন।

ব্যোমকেশের অধর ব্যঙ্গ-বঙ্কিম হইয়া উঠিল—’আমার সময়ের দাম অত বেশি নয়। তাছাড়া‌, আমি ঘুষ নিই না।’

কামিনীকান্ত তাড়াতাড়ি বলিলেন‌, ‘না না‌, সে কি কথা। আপনি অনাদিবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে তদন্তু করছেন‌, তার তো একটা খরচ আছে। সে খরচ এদেরই দেবার কথা। আচ্ছা‌, আর আপনার সময় নষ্ট করব না। নমস্কার।’ নোটগুলি টেবিলে রাখিয়া তিনি মক্কেল সহ ক্ষিপ্ৰবেগে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

ব্যোমকেশ নোটগুলি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া পকেটে রাখিতে রাখিতে বলিল‌, ‘ঘুষ কি করে দিতে হয় শিখলাম।’ তারপর ভ্রূ বাঁকাইয়া আমার পানে চাহিল—’কেমন গল্প শুনলে?’

বলিলাম‌, ‘আমার তো নেহাৎ অসম্ভব মনে হল না।’

‘এরকম গল্প তুমি লিখতে পারো? সাহস আছে?’

‘এমন অনেক সত্য ঘটনা আছে যা গল্পের আকারে লেখা যায় না‌, লিখলে বিশ্বাসযোগ্য হয় না। তবু যা সত্য তা সত্যই। Truth is stranger than fiction.’

তর্ক বেশ জমিয়া উঠিবার উপক্ৰম করিতেছে এমন সময় দ্বারে আবার অতিথি সমাগম হইল। দরজা ভেজানো ছিল; একজন দরজার ফাঁকে মুণ্ড প্রবিষ্ট করাইয়া বলিল, ‘আসতে পারি স্যার?’ বলিয়া দাঁত খিঁচাইয়া হাসিল।

অবাক হইয়া দেখিলাম‌, বিকাশ দত্ত! বছরখানেক আগে চিড়িয়াখানা প্রসঙ্গে তাহার সহিত পরিচয় ঘটিয়াছিল। তাহার হাসিটি অটুট আছে। কিন্তু বেশভূষা দেখিয়া মনে হয় ধন-ভাগ্যে ভাঙন ধরিয়াছে।

ব্যোমকেশ সমাদর করিয়া বিকাশকে বসাইল‌, হাসিয়া বলিল‌, ‘তারপর‌, খবর কি?’

বিকাশ বলিল‌, ‘খবর ভাল নয়। স্যার। চাকরি গেছে‌, এখন ফ্যা ফ্যা করে বেড়াচ্ছি।’

ব্যোমকেশের মুখ গভীর হইল–’চাকরি গেল কোন অপরাধে?’

বিকাশ বলিল‌, ‘অপরাধ করলে তো ফাঁসি যেতম স্যার। অপরাধ করিনি। তাই চাকরি গেছে।’

‘হুঁ। তা এখন কি করছেন?’

‘কাজের চেষ্টায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। আপনার হাতে যদি কিছু থাকে তাই খবর নিতে এলাম।’

ব্যোমকেশ একটু ভাবিয়া বলিল‌, ‘কাজ-? আচ্ছা‌, কাজের কথা পরে হবে‌, আজ বেলা হয়ে গেছে‌, এখানেই খাওয়া-দাওয়া করুন।’

বিকাশের মুখে কৃতজ্ঞতার একটি ক্লিষ্ট হাসি ফুটিয়া উঠিল—’না স্যার‌, আমাকে দুপুরবেলা বাসায় ফিরতে হবে। যদি কিছু কাজ থাকে‌, ওবেলা আবার আসব।’

বিকাশের মুখ দেখিয়া মনে হইল তাহার বাসায় কোনও অভুক্ত প্রিয়জন তাহার পথ চাহিয়া আছে।

ব্যোমকেশ আবার একটু ভাবিয়া বলিল‌, ‘আমার হাতে একটা কাজ আছে সে কাজে আপনার মতন কুঁশিয়ার লোক চাই। একটি লোকের হাঁড়ির খবর যোগাড় করতে হবে?

বিকাশ পকেট হইতে ডায়েরির মত একটা খাতা ও পেন্সিল বাহির করিল—‘নাম?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘শিউলী মজুমদারের নাম শুনেছেন?’

‘শিউলী মজুমদার? গান গায়?’

‘হ্যাঁ। তার বাপের নাম দয়ালহরি মজুমদার‌, ঠিকানা ১৩/৩‌, রামতনু লেন‌, শ্যামবাজার। এদের বাড়ির সব খবর সংগ্ৰহ করতে হবে।’

লিখিয়া লইয়া বিকাশ বলিল‌, ‘কবে খবর চান?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘একদিনের কাজ নয়। অনেকদিন ধরে একটু একটু করে খবর যোগাড় করতে হবে। অতীতের খবর‌, বর্তমানের খবর‌, বাড়িতে কারা আসে যায়‌, কী কথা বলে সব খবর চাই। অনাদি হালদার আর প্রভাত-এই দুটো নাম মনে রাখবেন। যখনই কিছু খবর পাবেন আমাকে এসে জানাবেন।’

‘বেশ‌, আজ তাহলে উঠি।’ খাতা পেন্সিল পকেটে পুরিয়া বিকাশ উঠিয়া দাঁড়াইল।

ব্যোমকেশ একটি একশত টাকার নোট তাহার হাতে দিয়া বলিল‌, ‘আজ একশো টাকা রাখুন। কাজ হয়ে গেলে আরও পাবেন।’

নোট হাতে লইয়া বিকাশ কিছুক্ষণ অপলক চক্ষে সেইদিকে চাহিয়া রহিল‌, তারপর চোখ তুলিয়া বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, পেটে ভাত না থাকলে মুখ দেখে ধরা যায়-না? আপনি ঠিক ধরেছেন?’ খপ করিয়া ব্যোমকেশের পায়ের ধূলা লইয়া বিকাশ দ্রুতপদে প্রস্থান করিল।

ব্যোমকেশ দ্বার বন্ধ করিয়া দিয়া খামখেয়ালী গোছের হাসিল–’কিছু টাকার সদগতি হল। চল‌, আর দেরি নয়‌, নেয়ে খেয়ে নেওয়া যাক। নৈলে এখনি হয়তো আবার নতুন অতিথি এসে হাজির হবে।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *