Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আদিম রিপু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Banyopadhyay » Page 11

আদিম রিপু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Banyopadhyay

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিতে দেরি হইল। তাড়াতাড়ি বসিবার ঘরে গিয়া দেখি‌, ব্যোমকেশ বসিয়া চিঠি লিখিতেছে‌, কেষ্টবাবু নাই। জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘শিকারী কোথায়?’

ব্যোমকেশ সহাস্য চোখ তুলিয়া বলিল‌, ‘রাত না পোয়াতে কখন উঠে পালিয়েছে।’

কাল রাত্ৰে মদের মুখে যে-সব কথা প্রকাশ পাইয়াছে আজ সকালে তাহা স্মরণ করিয়াই বোধহয় কেষ্ট দাস সরিয়াছে।

তক্তপোশে বসিলাম–’সাত সকলে কাকে চিঠি লিখতে বসলে?’

ব্যোমকেশ চিঠিখানা আমার দিকে বাড়াইয়া দিয়া আর একখানা চিঠি লিখিতে আরম্ভ করিল! চিঠি পড়িয়া দেখিলাম–

ভাই রমেশ‌, এতদিন পরে আমাকে কি তোমার মনে আছে। একসঙ্গে বহরমপুরে পড়েছি। প্রফেসারেরা আমাকে bomb-case বলে ডাকতেন। মনে পড়ছে?

নৃপেন দত্ত নামে একজনের মুখে খবর পেলাম‌, তুমি তোমার গ্রামেই আছ। নৃপেনকে তুমি চেনো‌, তোমার পাড়ার ছেলে। তার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই।

কলকাতায় তোমার আসা যাওয়া নিশ্চয় আছে। একবার এসে না। আমার বাসায়। ঠিকানা দিলাম।

কবে আসছে? ভালবাসা নিও।

ইতি
তোমার পুরনো বন্ধু
ব্যোমকেশ বক্সী

দ্বিতীয় পত্ৰখানি নিমাই-নিতাইকে লেখা–

নিমাইবাবু্‌, নিতাইবাবু্‌, শ্ৰীকান্ত পান্থনিবাসের তেতলার ঘরের কথা জানিতে পারিয়াছি। আমার সঙ্গে অবিলম্বে আসিয়া দেখা করুন‌, নচেৎ খবরটি পুলিস জানিতে পারিবে।

ব্যোমকেশ বক্সী

আমাকে বলিল‌, ‘চল‌, আজ সকালেই বেরুতে হবে।’

‘কোথায়?’

‘দয়ালহরি মজুমদারের বাসার ঠিকানা মনে আছে তো?

‘১৩/৩‌, রামতনু লেন‌, শ্যামবাজার।’

আধা ঘণ্টা পরে আমরা বাহির হইলাম। শ্যামবাজারে গিয়া রামতনু লেন খুঁজিয়া বাহির করিতে সময় লাগিল। দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে গলিটি ক্ষুদ্র‌, দুই ধারের দুইটি বড় রাস্তার মধ্যে যোগসাধন করিয়াছে। আমরা একদিক হইতে নম্বর দেখিতে দেখিতে অগ্রসর হইলাম।

গলির প্রায় মাঝামাঝি পৌঁছিয়াছি হঠাৎ ও-প্রান্তের একটা বাড়ি হইতে একজন লোক বাহির হইয়া আসিল‌, ঝড়ের মত আমাদের দিকে অগ্রসর হইল। চিনিলাম প্ৰভাত। সে আমাদের পাশ দিয়া চলিয়া গেল‌, আমাদের দেখিতে পাইল না। উষ্কখুষ্ক চুল‌, আরক্ত মুখ-চোখ; আগুনের হল্কার মত সে আমাদের পাশ দিয়া বহিয়া গেল।

আমরা ভ্রূ তুলিয়া পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করিলাম‌, তারপর যে দ্বার দিয়া প্রভাত বাহির হইয়াছিল সেই দিকে চলিলাম। নম্বর খুঁজিবার আর প্রয়োজন নাই। ব্যোমকেশ মৃদুগুঞ্জনে বলিল‌, ‘অনাদি হালদার সম্বন্ধ ভেঙে দিয়েছিল…এখন সে নেই‌, তাই প্ৰভাত আবার এসেছিল…কিন্তু সুবিধে হল না।’

১৩/৩ নম্বর বাড়ির দরজা বন্ধ। আমরা ক্ষণেক দাঁড়াইয়া ইতস্তত করিতেছি‌, বাড়ির ভিতর হইতে মেয়েলী গলার গান আরম্ভ হইল। মিষ্ট নিটোল কুহক-কলিত কণ্ঠস্বর‌, সঙ্গে তবলার সঙ্গত।

ব্যোমকেশ দ্বারে ধাক্কা দিল। ভিতরে গান বন্ধ হইল। একটি প্রৌঢ় ব্যক্তি দ্বার খুললেন। একজোড়া কঠিন চক্ষু আমাদের আপাদমস্তক পরিদর্শন করিল।

‘কি চাই?’লোকটির আকৃতি যেমন বেউড় বাঁশের মত পাকানো‌, কণ্ঠস্বরও তেমনি শুষ্ক রুক্ষ। একটু পূর্ববঙ্গের টান আছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার নাম কি দয়ালহরি মজুমদার?’

‘হাঁ। কি দরকার?’ ভিতরে প্রবেশ করিবার আহ্বান আসিল না‌, বরং গৃহস্বামী দুই কবাট ধরিয়া পথ আগলাইয়া দাঁড়াইলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অনাদি হালদার মারা গেছে‌, শুনেছেন বোধহয়। তার সম্বন্ধে কিছু জানতে চাই—‘

‘কে অনাদি হালদার! আমি জানি না।’ দয়ালহরিবাবুর শুষ্ক স্বর উগ্ৰ হইয়া উঠিল।

‘জানেন না? তার আলমারিতে আপনার হ্যান্ডনেট পাওয়া গেছে। আপনি পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়েছেন।’

‘কে বলে আমি ধার নিয়েছি! মিথ্যা কথা। কারুর এক পয়সা আমি ধারি না।’

‘হ্যান্ডনেটে আপনার দস্তখত আমি নিজের চোখে দেখেছি।’

‘জাল দস্তখত।’ দড়াম শব্দে দরজা বন্ধ হইয়া গেল।

আমরা কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলাম‌, তারপর ফিরিয়া চলিলাম। পিছনে গান ও সঙ্গত আবার আরম্ভ হইল। ভৈরবী একতালা।

ট্রামরাস্তার দিকে চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ ক্লিষ্ট হাসিয়া বলিল, ‘দয়ালহরি মজুমদার লোকটি সামান্য লোক নয়। অনাদি হালদার মরেছে শুনে ভাবছে পাঁচ হাজার টাকা হজম করবে। হ্যান্ডনেটে যে দস্তখত করেছে সেটা হয়তো ওর আসল দস্তখত নয়‌, বেঁকিয়ে চুরিয়ে দস্তখত করেছে‌, মামলা যদি আদালতে যায়। তখন অস্বীকার করবে। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়; প্রশ্ন হচ্ছে‌, অনাদি হালদার ওকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দিলে কেন?’

বলিলাম‌, ‘অনাদি হালদারের তেজারাতির ব্যবসা ছিল হয়তো।’

‘তাই বলে বিনা জামিনে শুধু হাতে পাঁচ হাজার টাকা ধার দেবে! অনাদি হালদার কি এতাই কাঁচা ছেলে ছিল? বানরে সঙ্গীত গায় শিলা জলে ভেসে যায় দেখিলেও না হয় প্রত্যয়।’

‘তবে কি হতে পারে?’

‘জানি না। কিন্তু জানতে হবে।–আমার কি সন্দেহ হয় জানো?’

‘কী? বলিবার জন্য মুখ খুলিয়া ব্যোমকেশ থামিয়া গেল। তারপর আকাশের পানে চোখ তুলিয়া বলিল‌, ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম।’

অতঃপর আমি আর প্রশ্ন করিলাম না।

সেদিন বৈকালে আবার আমরা বাহির হইলাম। এবার গন্তব্যস্থান প্ৰভাতের দোকান।

দোকানের কাছাকাছি পৌঁছিয়াছি‌, দেখি আর পাঁচজন লোকের মধ্যে বাঁটুল সদার আমাদের আগে আগে চলিয়াছে। প্ৰভাতের দোকানের সামনে আসিয়া বাঁটুলের গতি হ্রাস হইল‌, মনে হইল সে দোকানে প্রবেশ করবে। কিন্তু প্রবেশ করিবার পূর্বে সে একবার ঘাড় ফিরাইয়া পিছন দিকে চাহিল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হইয়া গেল। অমনি বাঁটুল আবার সিধা পথে চলিতে আরম্ভ করল।

আমি আড়চোখে ব্যোমকেশের পানে তাকাইলাম। তাহার ভ্রূ কুঞ্চিত‌, চোয়ালের হাড় শক্ত হইয়া উঠিয়াছে। আমি মৃদুস্বরে বলিলাম‌, ‘বাঁটুল কি এবার প্রভাতকে খদ্দের পাকড়াতে চায় নাকি?’

ব্যোমকেশ গলার মধ্যে শুধু আওয়াজ করিল।

দোকানে প্ৰবেশ করিলাম।

খরিদ্দার নাই‌, কেবল প্ৰভাত কাউন্টারে কনুই রাখিয়া কপালে হাত দিয়া বসিয়া আছে‌, তাহার মুখ ভাল দেখা যাইতেছে না। আমাদের পদশব্দে সে চোখ তুলিল। চোখ দুইটি জবাফুলের মত লাল। ক্ষণকাল অচেনা চোখে চাহিয়া থাকিয়া সে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল‌, ‘আসুন।’

আমরা কাউন্টারের সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। পুস্তকালয়ের রাশি রাশি বই আমার মনে মোহ বিস্তার করে‌, আমি চারিদিকে ঘাড় ফিরাইয়া দেখিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশের ওসব বালাই নাই। সে বলিল‌, ‘সামান্য একটা কাজে এসেছিলাম। দেখুন তো‌, এই চাবিটা চিনতে পারেন?’

প্রভাত ব্যোমকেশের হাত হইতে চাবি লইয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিল। বলিল‌, না। কোথাকার চাবি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তা আমি জানি না। আপনাদের বাসার পাশে গলিতে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।’

‘কি জানি‌, আমি কখনও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। নতুন চাবি দেখছি। হয়তো রাস্তার কোনও লোকের পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল।’

প্রভাত চাবি ফেরত দিল। ব্যোমকেশ তাহ পকেটে রাখিয়া বলিল‌, ‘কেষ্টবাবুর খবর কি? তিনি আজ সকালবেলা আপনার বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন।’

প্রভাত ক্ষীণ হাসিল—’হ্যাঁ। কাল রাত্রে কোথায় গিয়েছিলেন।’

কোথায় গিয়েছিলেন ব্যোমকেশ তাহা বলিল না‌, জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কেষ্টবাবু তাহলে আপনার স্কন্ধেই রইলেন?’

‘তাই তো মনে হচ্ছে। কি করা যায়? গলাধাক্কা তো দেয়া যায় না।’

‘তা বটে। নৃপেনবাবু কোথায়? চলে গেছেন?’

‘না‌, এখনও যায়নি। তার দু’মাসের মাইনে বাকি.গরীব মানুষ…ভাবছি। তাকে রেখে দেব। দোকানে একজন লোক রাখলে ভাল হয়‌, ওকেই রেখে দেব ভাবছি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘মন্দ কি। আচ্ছা‌, নিমাই নিতাই বোধহয় আর আসেনি? আলমারি কি পুলিসের পক্ষ থেকে সীল করে দিয়ে গেছে?’

‘না‌, পুলিস আর আসেনি। তবে অনাদিবাবুর কোমরে যে চাবি ছিল সেটা তারা নিয়ে গেছে। আলমারির বোধহয় ঐ একটাই চাবি ছিল।’

‘তা হবে। আচ্ছা‌, আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। দয়ালহরি মজুমদার নামে একজনকে অনাদি হালদার পাঁচ হাজার টাকা ধার দিয়েছিল। আপনি জানেন?’

প্রভাত কিছুক্ষণ অবিশ্বাস-ভরা বিহ্বল চক্ষে চাহিয়া রহিল–’পাঁচ হাজার টাকা! আপনি ঠিক জানেন?’

‘অনাদি হালদারের আলমারিতে আমি হ্যান্ডনেট দেখেছি। তাতে দয়ালহরি মজুমদারের সই আছে।’

প্রভাতের শীর্ণ মুখ যেন আরও শুষ্ক ক্লান্ত হইয়া উঠিল‌, সে অর্ধস্ফুট স্বরে বলিল‌, ‘আমি জানতাম না। কখনও শুনিনি।’ সে টুলের উপর বসিতে গিয়া স্থানভ্রষ্ট হইয়া পড়িয়া যাইবার উপক্ৰম করিল। ব্যোমকেশ হাত বাড়াইয়া টপ করিয়া তাহাকে ধরিয়া ফেলিল।

‘প্রভাতবাবু! আপনার জ্বর হয়েছে-গা গরম।’

‘জ্বর। না-ও কিছু নয়। ঠাণ্ডা লেগেছে—‘

‘হয়তো বুকে ঠাণ্ডা বসেছে। আপনি দোকানে এলেন কেন? যান‌, বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাকুন। ডাক্তার দাকান—’

‘ডাক্তার’ প্রভাত সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল–’না না‌, ওসব হাঙ্গামায় দরকার নেই। আপনিই সেরে যাবে।’

‘আমার কথা শুনুন‌, কাছেই আমার চেনা একজন ডাক্তার আছেন‌, তাঁর কাছে চলুন। রোগকে অবহেলা করা ভাল নয়। আসুন।’

প্রভাত আরও কয়েকবার আপত্তি করিয়া শেষে রাজী হইল। দোকানে তালা লাগাইয়া বাহির হইবার সময় ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনার গুর্খা দরোয়ানটিকে দেখছি না। তাকে কি ছাড়িয়ে দিয়েছেন?’

প্রভাত বলিল‌, ‘হ্যাঁ। অনেকদিন দেশে যায়নি‌, কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। আমারও আর পাহারাওলার দরকার নেই-–‘ বলিয়া ফিক হাসিল।

দুই তিন মিনিটে ডাক্তার তালুকদারের ডাক্তারখানায় পৌঁছিলাম। তিনি ডাক্তারখানায় উপস্থিত ছিলেন; ব্যোমকেশ তাঁহাকে আড়ালে লইয়া গিয়া কথাবার্তা বলিল। তারপর তিনি প্রভাতকে ঘরে লইয়া গিয়া টেবিলের উপর শোয়াইয়া পরীক্ষা আরম্ভ করিলেন। আমরা সরিয়া আসিলাম।

পরীক্ষার শেষে ডাক্তার আসিয়া বলিলেন‌, ‘বুকে পিঠে কিছু পেলাম না। তবে স্নায়ুতে গুরুতর শক লেগেছে। একটা ওষুধ দিচ্ছি‌, এক শিশি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।’

ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখিতে গেলেন‌, ব্যোমকেশও তাঁহার সঙ্গে গেল। কিছুক্ষণ পরে ঔষধের শিশি হাতে ফিরিয়া আসিয়া বলিল‌, চলুন। ডাক্তারের প্রাপ্য আমি চুকিয়ে দিয়েছি।’

প্রভাত বিব্রত হইয়া বলিল‌, ‘সে কি‌, আপনি কেন দিলেন? আমার কাছে টাকা রয়েছে—‘

‘আচ্ছা‌, সে দেখা যাবে। এখন চলুন‌, আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’

প্ৰভাতের চক্ষু সজল হইয়া উঠিল—’আপনি আমার জন্যে এত কষ্ট করছেন—’

ব্যোমকেশ একটু হাসিয়া বলিল‌, ‘সংসারে থাকতে গেলে পরস্পরের জন্যে একটু কষ্ট করতে হয়। আসুন।’

ভাড়াটে গাড়িতে প্ৰভাতকে লইয়া আমরা তাহার বাসার উদ্দেশ্যে চলিলাম। ব্যোমকেশের এই পরহিতব্রতের অন্তরালে কোনও অভিসন্ধি আছে কিনা‌, এই প্রশ্নটা বার বার মনের মধ্যে খোঁচা দিতে লাগিল।

বাসায় পৌঁছিলে ননীবালা দেবী প্ৰভাতের জ্বরের সংবাদ শুনিয়া ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন এবং তাহাকে লইয়া গিয়া বিছানায় শোয়াইয়া দিলেন। তিনি অভিজ্ঞ ধাত্রী। ঔষধ-পথ্য সম্বন্ধে তাঁহাকে কিছু বলিতে হইল না। আমরা বিদায় লইলাম।

বাহিরের ঘরে আসিয়া ব্যোমকেশ দাঁড়াইয়া পড়িল। ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল‌, তাহার যাইবার ইচ্ছা নাই। আমি ভ্রূ তুলিয়া প্রশ্ন করিলাম‌, উত্তরে সে বাম চক্ষু কুঞ্চিত করিল।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। নৃপেন প্রবেশ করিল; আমাদের দেখিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল‌, ‘আপনারা?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘প্রভাতবাবুর শরীর খারাপ হয়েছিল‌, তাই তাঁকে পৌঁছে দিতে এসেছি।’

‘প্রভাতবাবুর শরীর খারাপ’ নৃপেন ভিতর দিকে পা বাড়াইল।

‘একটা কথা‌, ব্যোমকেশ চাবি বাহির করিয়া তাহার সম্মুখে ধরিল‌, ‘এ চাবিটা চিনতে পারেন?’

নৃপেনের চোখের চাহনি এতক্ষণ সহজ ও সিধা ছিল‌, মুহুর্তে তাহা চোরা চাহনিতে পরিণত হইল। একবার ঢোক গিলিয়া সে স্বর্যযন্ত্র সংযত করিয়া লইল‌, তারপর বলিল‌, ‘চাবি? কার চাবি আমি কি করে চিনিব? মাফ করবেন‌, প্রভাতবাবুর জ্বর’–কথা শেষ না করিয়াই সে প্ৰভাতের ঘরের দিকে চলিয়া গেল।

ক্ষণেক দাঁড়াইয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ আমার কানে কানে বলিল, ‘অজিত, তুমি দাঁড়াও, আমি এখনি আসছি।’ সে লঘুপদে অনাদি হালদারের ঘরের দিকে চলিয়া গেল।

একলা দাঁড়াইয়া আছি; ভাবিতেছি কেহ যদি আসিয়া পড়ে এবং ব্যোমকেশ সম্বন্ধে সওয়াল আরম্ভ করে‌, তখন কি বলিব! কিন্তু মিনিটখানেক পরে ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিল‌, বলিল‌, ‘চল, এবার যাওয়া যাক।’

নীচে দাওয়ায় বসিয়া ষষ্ঠীবাবু হুঁকা চুষিতেছিলেন‌, আমাদের পানে কট্‌মট করিয়া তাকাইলেন রাস্তায় আলো জ্বলিয়াছে। আমরা দ্রুত বাসার দিকে পা চালাইলাম। চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ। বলিল‌, ‘অনাদি হালদারের আলমারির চাবিই বটে এবং কে গলিতে ফেলেছিল‌, সে বিষয়েও কোন সন্দেহ নেই।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *