Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আত্মা ও দুরাত্মা || Mayukh Chowdhury

আত্মা ও দুরাত্মা || Mayukh Chowdhury

আত্মা ও দুরাত্মা

পৃথিবীতে অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে যার সঠিক অর্থ বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এই ধরনের একটি কাহিনি আমি সংগ্রহ করেছি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে।

যে ভদ্রলোক এই ঘটনা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি একজন সম্পন্ন ব্যবসায়ী। ভদ্রলোকের মাতৃভূমি ইংল্যান্ড কিন্তু তার ব্যবসায়ের ক্ষেত্র ছিল আফ্রিকার উগান্ডা নামক স্থানে।

ভদ্রলোকের লিখিত বিবরণী থেকে নিম্নলিখিত কাহিনিটি পরিবেশন করছি—

আমার জমিতে কয়েকজন নিগ্রো শ্রমিক নিযুক্ত করেছিলাম। একদিন শ্রমিকদের দলপতি আমার সঙ্গে দেখা করে জানালে, গত রাত্রে তাদের দলভুক্ত একজন মজুর হঠাৎ মারা পড়েছে। নিগ্রোদের বিশ্বাস ঘরের মধ্যে কোনো লোক মৃত্যুবরণ করলে প্রতিবেশীদের অকল্যাণ হয়। এই জন্য তারা অধিকাংশ সময়ে মুমূর্ষ রোগীকে জঙ্গলের মধ্যে রেখে আসে। রুণ ব্যক্তি বনের মধ্যেই মারা যায়, মৃতদেহের সৎকার হয় না, হায়না প্রভৃতি হিংস্র শ্বাপদ তার দেহের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে, নির্দিষ্ট স্থানে পড়ে থাকে শুধু চর্বিত কঙ্কালের স্তূপ।

অসুস্থ মজুরটির সম্বন্ধেও তার সহকর্মীরা পূর্বোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে চেয়েছিল, কিন্তু দলের সর্দার বাধা দেওয়ায় তাদের পরিকল্পনা কার্যে পরিণত হয়নি। বিগত রাত্রে ওই মুমূর্ষ ব্যক্তি তার কুটিরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। মালিক এখন মৃতদেহ সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা করবেন সেই কথাই জানতে এসেছে সর্দার।

সর্দারের সঙ্গে গিয়ে মৃতদেহটাকে কুটিরের ভিতর থেকে এনে আমার গাড়িতে রাখলাম, তারপর বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম হাসপাতালের দিকে। মৃত ব্যক্তির শব ব্যবচ্ছেদ করে তার মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয় করা দরকার–সেইজন্যই আমি হাসপাতালের দিকে যাত্রা করেছিলাম।

কুটিরের মধ্যে আবছা আলো-আঁধারির লীলাখেলা আমার দৃষ্টিকে দুর্বল করে দিয়েছিল, তাই মরা মানুষটাকে তখন খুব ভালো করে দেখতে পাইনি। বাইরে উজ্জ্বল সূর্যালোকে তার মুখ দেখে আমি তাকে চিনতে পারলাম। মাত্র কিছুদিন আগেই লোকটি আমার কাছে মজুরের কাজ করতে এসেছিল। লোকটিকে আমি হালকা কাজ দিয়েছিলাম, কারণ কষ্টসাধ্য কাজ করার মতো উপযুক্ত শরীর তার ছিল না।

তার একটি পা ছিল ভাঙা, একটি চোখ ছিল অন্ধ এবং অজ্ঞাত কোনো দুর্ঘটনার ফলে তার মুখের ওপর থেকে লুপ্ত হয়েছিল নাসিকার অস্তিত্ব, নাকের জায়গায় দৃষ্টিগোচর হত দুটি বৃহৎ ছিদ্র!

তবে লোকটির দেহে বিকৃতি থাকলেও মানুষ হিসাবে সে খারাপ ছিল না। কাজকর্ম সে মন দিয়েই করত। কিন্তু অন্যান্য শ্রমিকরা তাকে এড়িয়ে চলত তাদের ধারণা ছিল বিকৃত দেহের অধিকারী ওই ব্যক্তি একজন জাদুকর!

যাই হোক, সেদিন মৃত ব্যক্তির লাশটা হাসপাতালে জমা করে দিলাম। কর্তৃপক্ষ বললেন, কয়েকদিনের মধ্যেই তার মৃত্যুর কারণ আমাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।

হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ কথা রেখেছিলেন। দিন দুই পরেই তারা আমাকে লোকটির মৃত্যুর কারণ জানিয়ে দিলেন।

উক্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে পেটের গোলমালে। মৃত ব্যক্তির পেটের ভিতর পাওয়া গেছে কয়েকটা লম্বা লম্বা লোহার পেরেক, কাঁচের টুকরো এবং অনেকগুলো পাথর! পৃথিবীতে এত রকম খাদ্য থাকতে লোকটা কাঁচ, লোহা আর পাথর খেয়ে মরতে গেল কেন? খুব সম্ভব জাদুবিদ্যার অনুশীলন করার জন্যই লোকটি ওই অখাদ্য বস্তুগুলিকে ভক্ষণ করেছিল।

তবে লোকটি জাদুকর হলেও খুব উচ্চশ্রেণির জাদুকর নয়, জাদুবিদ্যাকে হজম করতে পারেনি বলেই তার পেটে কাঁচ, লোহা আর পেরেক হজম হল না।

পূর্ববর্ণিত ঘটনার কিছুদিন পরে আমাদের এলাকায় হানা দিল এক অজ্ঞাত আততায়ী।

প্রতি রাত্রেই এলাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ভেড়ার আস্তানাগুলোতে হানা দিয়ে অজ্ঞাত হত্যাকারী যথেচ্ছভাবে হত্যাকাণ্ড চালাতে লাগল। মৃত পশুগুলির দেহে অধিকাংশ সময়ে কোনো ক্ষতচিহ্ন থাকত না, হন্তারক:শুধু ভেড়ার মাথার খুলি ভেঙে ঘিলুটা খেয়ে পালিয়ে যায়।

আমার মজুররা এই হত্যাকাণ্ডের জন্যে নান্দি ভালুক নামে এক অতিকায় ভালুককে দায়ী করলে।

আফ্রিকায় ভল্লুক নেই, নান্দি ভালুক নামক জীবের অস্তিত্ব শুধু নিগ্রোদের কল্পনায়। আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এই কাল্পনিক জন্তুটির কথা নিগ্রোদের মুখে মুখে ফেরে।

বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই।

আমি অনুমান করলাম, এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক হচ্ছে একটি অতিকায় হায়না। মাংসাশী শ্বপদগোষ্ঠীর মধ্যে ভেড়ার মাথার খুলি কামড়ে ভেঙে ফেলার মতো চোয়ালের জোর একমাত্র হায়নারই আছে। চোয়ালে অসাধারণ শক্তি থাকলেও হায়না খুব ভীরু জানোয়ার, তবে দুই একটি হায়না মাঝে মাঝে দুঃসাহসের পরিচয় দেয়।

আমি ঠিক করলাম মেষকুলের হন্তারক এই অজ্ঞাত আততায়ীকে যেমন করেই হোক বধ করতে হবে।

চেষ্টার ত্রুটি হয়নি। ফাঁদ পেতে রেখেছি।

খুনি ফাঁদের ধারে কাছেও আসেনি। বন্দুক হাতে প্রতি রাত্রে টহল দিয়েছি মারা তো দূরের কথা,হত্যাকারীকে চোখেও দেখতে পাইনি। অথচ প্রতিদিন সকালে খবর এসেছে এক বা একাধিক মেষ আততায়ীর কবলে মৃত্যুবরণ করেছে।

তবে চোখে না-দেখলেও হন্তারক যে একটি হায়না সেই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না।

কয়েকদিন পরেই একটি ঘটনায় ২ প্রমাণ হল আমার ধারণা নির্ভুল।

আমার জন্য নির্দিষ্ট বাড়িটা তখনও তৈরি হয়নি। সবেমাত্র নির্মাণকার্য চলছিল। আমি একটা ঘাসের তৈরি কুঁড়েঘরে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

হঠাৎ একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সংকেত অগ্রাহ্য করে আবার শয্যা গ্রহণ করব কি না ভাবছি, হঠাৎ একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনলাম আমার বিছানার খুব কাছে। বালিশের তলা থেকে টর্চ নিয়ে জ্বেলে দিলাম।

পরক্ষণেই আমার চোখের সামনে তীব্র বৈদ্যুতিক আলোর মধ্যে ভেসে উঠল একটা প্রকাণ্ড হায়নার মূর্তি!

আমি স্তম্ভিত নেত্রে দেখলাম, আমার বিছানা থেকে মাত্র এক গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। জন্তুটা এত বড়ো হায়না ইতিপূর্বে আমার চোখে পড়েনি!

নিজের অজ্ঞাতসারেই আমার গলা থেকে বেরিয়ে এল এক তীব্র চিৎকার ধ্বনি, একলাফে শয্যা ত্যাগ করে ঘরের কোণ থেকে আমি বন্দুকটা টেনে নিলাম। এমনই দুর্ভাগ্য যে শুতে যাওয়ার আগে বন্দুকে গুলি ভরতে ভুলে গিয়েছিলাম। টেবিলের উপর একটা ছোটো বাক্সে টোটাগুলো রেখেছিলাম, হাত বাড়িয়ে বাক্সটা খুঁজছি, এমন সময়ে হল আর এক নূতন বিপদ! সাঁ করে ছুটে এল একটা দমকা হাওয়ার ঝটকা, আর সেই হাওয়ার ধাক্কা লেগে কুঁড়েঘরের নীচের দিকের ঝাঁপটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল!

(উগান্ডার যে অঞ্চলে আমি ছিলাম সেখানকার কুটিরগুলোর দরজায় কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। মেঝের সঙ্গে সমান্তরালভাবে উপর-নীচ লাগানো থাকত দুটি ঝপ বা দরজার পাল্লা।)

ঝাঁপের পাল্লাটা বন্ধ হয়ে যেতেই আমি চমকে উঠলাম। অত্যন্ত সঙ্গিন মুহূর্ত–পালানোর পথ বন্ধ দেখে হায়না হয়তো আমাকে এখনই আক্রমণ করবে। ঝপের নীচের অংশটা সে একলাফে টপকে যেতে পারে বটে কিন্তু পলায়নের ওই সহজ পন্থা তার মগজে ঢুকবে কি না। সন্দেহ।

বুনো জানোয়ার যদি নিজেকে কোণঠাসা মনে করে তাহলে সে সামনে যাকে পায় তার ওপরই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

জন্তুটার বিরাট দেহের দিকে তাকালাম।

সত্যি, এটা একটা অতিকায় হায়না।

যদি এক গুলিতে জন্তুটাকে শুইয়ে দিতে না-পারি তবে বন্ধ ঘরের মধ্যে হায়নার আক্রমণে, আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত। খুব সাবধানে যতদূর সম্ভব আমি বন্দুকে গুলি ভরতে লাগলাম।

হঠাৎ বন্ধ ঘরের মধ্যে হল আর এক চতুষ্পদের আবির্ভাব! আমার বুল-টেরিয়ার শ্যাম বোধ হয় দরজার কাছেই ছিল–নীচের দিকের ঝাঁপটা একলাফে ডিঙিয়ে এসে শ্যাম হায়নাকে আক্রমণ করলে!

শ্যাম সাহসী কুকুর, কিন্তু বোকা নয়।

হায়নার ভয়ংকর দাঁত আর শক্তিশালী চোয়াল সম্বন্ধে সে যথেষ্ট সচেতন–চারপাশে ঘুরে ঘুরে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুকে সে বিব্রত করে তুলল, কিন্তু হায়নার ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে নিজের জীবন বিপন্ন করলে না।

হায়নার দংশন অতি ভয়ংকর, এক কামড়েই সে শ্যামের মাথার খুলি ভেঙে দিতে পারে। বুদ্ধিমান কুকুর তাকে সেই সুযোগ দিলে না।

ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে আমি এক লাথি মেরে দরজার নীচের অংশটা খুলে দিলাম। তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে হায়নাটা দূরের ঝোপ লক্ষ করে ছুটল।

আমি ততক্ষণে বন্দুকে গুলি ভরে ফেলছি।

জন্তুটাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়লাম। নিশানা ব্যর্থ হল।

হায়নার ধাবমান দেহ অদৃশ্য হয়ে গেল অরণ্যের অন্তরালে।

বেশ কয়েকটা দিন কাটল নির্বিবাদে।

আমরা ভাবলাম খুনি বোধ হয় আমাদের আর বিরক্ত করবে না। কিন্তু কয়েকদিন পরেই আবার শুরু হল হত্যাকাণ্ড।

প্রতি রাত্রেই একটি কি দুটি ভেড়া হায়নার কবলে মারা পড়তে লাগল।

আমার জেদ চেপে গেল, জন্তুটাকে মারতেই হবে।

প্রতিদিন শেষরাতে ভোর হওয়ার একটু আগে আমি সমস্ত অঞ্চলটায় টহল দিতে শুরু করলাম। পরপর আটটি রাত কাটল, অবশেষে নবম রাত্রে আমার চেষ্টা সফল হল।

একটু দূরে অবস্থিত উঁচু জমির তলায় ঝোপের ভিতর, একটা কালো ছায়া যেন স্যাৎ করে সরে গেল!

হয়তো চোখের ভুল।

তবু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। না, ভুল হয়নি

হঠাৎ ঝোপের ওপর উঁচু জমির ওপর আত্মপ্রকাশ করল একটা চতুষ্পদ পশু!

নীলাভ-কৃষ্ণ আকাশের পটভূমিকায় উচ্চ ভূমির ওপর দণ্ডায়মান হায়নার দেহটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠল আমার দৃষ্টিপথে–লক্ষ্য স্থির করে গুলি ছুড়লাম।

গুলি লাগল হায়নার পেটে। দারুণ যাতনায় অস্থির হয়ে জন্তুটা নিজের উদর দংশন করতে লাগল। আবার অগ্নিবৃষ্টি করলে আমার বন্দুক, হায়নার মৃতদেহ উপর থেকে আছড়ে পড়ল নীচের জমিতে গুলি এইবার জন্তুটার মস্তিষ্ক ভেদ করেছে।

মৃত হায়নার কাছে এসে তাকে লক্ষ করতে লাগলাম। বিরাট জানোয়ার। জন্তুটার দেহে কিছু খুঁত আছে।

তার পিছনের একটি পা ভাঙা, অজ্ঞাত কোনো দুর্ঘটনার ফলে তার একটি চক্ষু হয়েছে অন্ধ এবং নাসিকার কিছু অংশ লুপ্ত হয়ে গেছে মুখের ওপর থেকে!

বিদ্যুৎচমকের মতো আমার মনে একটা সন্দেহের ছায়া উঁকি মারল, মুহূর্তের জন্য আমার মানসপটে ভেসে উঠল একটি মৃত মানুষের প্রতিমূর্তি!

কিছুদিন আগে যে নিগ্রো মজুরটি মারা গেছে তার সঙ্গে এই জন্তুটা অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে। পূর্বোক্ত মানুষটিরও ছিল একটি পা ভাঙা, একটি চোখ অন্ধ এবং ভূমিশয্যায় শায়িত এই মৃত হায়নার মতো তার মুখের উপরও ছিল না নাসিকার অস্তিত্ব।

আমার সর্বদেহের ভিতর দিয়ে ছুটে গেল আতঙ্কের শীতল স্রোত। পরক্ষণেই নিজের মনকে শাসন করলাম–বিকৃত দেহ মানুষ যদি থাকতে পারে তবে তার মতো একটা হায়নাই-বা থাকবে না কেন? দৈহিক সাদৃশ্যটা নিতান্তই ঘটনাচক্রের যোগাযোগ।

আমি আস্তানায় ফিরে এসে কয়েকজন শ্রমিককে হন্তারকের মৃত্যুসংবাদ দিলাম। তারা বিলক্ষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আমি জন্তুটাকে মাটির নীচে কবর দিতে বললাম–হায়নার চামড়া কোনো কাজে লাগে না।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা মজুরদের আস্তানা থেকে একটা কোলাহল ধ্বনি আমার কর্ণগোচর হল। গোলমালের কারণ অনুসন্ধান করার জন্য আমি শব্দ লক্ষ করে পা চালিয়ে দিলাম।

নির্দিষ্ট স্থানে এসে দেখলাম, মৃত হায়নার দেহটা সেইখানেই পড়ে আছে। জন্তুটার পেট চিরে ফেলা হয়েছে। মৃত পশুটার থেকে একটু দূরে বসে একদল শ্রমিক গান ধরেছে উচ্চৈঃস্বরে। সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ শব্দে বাজছে অনেকগুলো ঢাক!

ওইসঙ্গে আরও এক অদ্ভুত দৃশ্য আমার চোখে পড়ল। ভিড়ের ভিতর থেকে এক একজন এগিয়ে এসে হায়নাটার উপর জোরে জোরে ফুঁ দিচ্ছে আর সঙ্গেসঙ্গে দ্বিগুণ জোরে বেজে উঠছে। ঢাকের বাজনা এবং সমবেত কণ্ঠের ঐকতান!

একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে মজুরদের সর্দার। সর্দারের কাছে এগিয়ে গিয়ে এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জানতে চাইলাম।

ওরা হায়নার মৃতদেহ থেকে প্রেতাত্মাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, সর্দার উত্তর দিলে। এখন হায়নার দেহে আর প্রেত থাকবে না। সে চেষ্টা করবে অন্য কোনো দেহকে আশ্রয় করতে। এখানে উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে হয়তো কারো ওপর সে ভর করতে পারে।

সেইজন্য তাকে আমরা তাড়িয়ে দিচ্ছি।

মূর্খ। তোমার দলের লোকগুলো তো একেবারেই বোকা, এদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা নেই, এরা কুসংস্কারের দাস, কিন্তু

একটু হেসে আমি বললাম, কিন্তু তুমি কিছু কিছু লেখাপড়া করেছ, তুমিও কি এইসব সংস্কারে বিশ্বাস করো?

না, বাওয়ানা, সর্দার বললে, আমার কুসংস্কার নেই। তবে তবে মানে আমি আপনাকে কয়েকটা জিনিস দেখাচ্ছি।

কথা অসমাপ্ত রেখেই সে একটি মজুরকে ইশারা করলে।

মজুরটি এগিয়ে এল।

সর্দার তার হাত থেকে কতকগুলি জিনিস তুলে নিয়ে আমার চোখের সামনে ধরলে।

কয়েকটা লম্বা লম্বা লোহার পেরেক, কয়েকটা পাথর আর ভাঙা কাঁচের টুকরো রয়েছে সর্দারের হাতে!

বাওয়ানা, সর্দার বললে, এই জিনিসগুলো পাওয়া গেছে হায়নার পেটের ভিতর!

আমি কথা বলতে পারলাম না, অনুভব করলাম আমার ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে উঠেছে কাঁটার মতো!

সবই কি ঘটনাচক্র?

একটা পা ভাঙা, একটি চক্ষু অন্ধ, মুখের ওপর ছিন্ন নাসিকার অংশ

সব কিছুই কি শুধু ঘটনাচক্রের যোগাযোগ?

অবশেষে এই পাথর, পেরেক আর কাঁচ?

মৃত মানুষটা কেন ওইসব বস্তু গলাধঃকরণ করেছিল জানি না, কিন্তু এই সৃষ্টিছাড়া হায়নাটাও বিশেষ করে ওই অখাদ্য বস্তুগুলিকে উদরস্থ করলে কেন?

আমি এই ঘটনার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারিনি। তবে অশিক্ষিত আফ্রিকাবাসীর বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে আজ আর আমি কুসংস্কার বলে অবজ্ঞা করতে পারি না।

কাহিনির লেখক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। তিনি এখানেই সমাপ্তির রেখা টেনে দিয়েছেন।

আফ্রিকার অরণ্যসংকুল প্রদেশে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে যেসব শ্বেতাঙ্গ পর্যটক ও শিকারি ঘুরে বেড়িয়েছেন তাঁদের লিখিত রোজনামচায় অনেক অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। বিস্তীর্ণ আফ্রিকার বুকের ওপর ঘুমিয়ে আছে এক রহস্যময় জগৎ।

সভ্য পৃথিবী আজও সেই জাদুপুরীর দরজা খুলতে পারেনি।

পূর্ববর্ণিত ঘটনা-প্রসঙ্গে বলছি প্রেতাত্মার ভিন্ন দেহে আশ্রয় গ্রহণ করার আরও অনেক কাহিনি আফ্রিকাবাসীর মুখে মুখে শোনা যায়। অবশ্য যাবতীয় দুষ্কর্মের জন্য যে সবসময় অলৌকিক শক্তির অধিকারী জাদুকর বা প্রেতাত্মারা দায়ী হয় তা নয়–অনেক সময় পার্থিব জগতের সমাজবিরোধী দুরাত্মার দলও নির্বিচারে নরহত্যা করে অথবা পশুমাংসের লোভে প্রতিবেশীর পালিত পশুকে হত্যা করে বন্য জন্তুর ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। প্রেত-আশ্রিত পশু ছাড়া । অরণ্যচারী হিংস্র শ্বাপদের আক্রমণও একটি কঠিন সমস্যা। সিংহ, লেপার্ড প্রভৃতি মাংসাশী শ্বাপদ যখন গৃহপালিত পশু হত্যা অথবা নরমাংসের প্রতি আসক্ত হয় তখন আত্মা, দুরাত্মা ও চতুষ্পদ শ্বাপদের ত্র্যহস্পর্শ যোগের ফলে যে বিচিত্র ধাঁধার সৃষ্টি হয় তার থেকে প্রকৃত অপরাধীকে আবিষ্কার করা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে আলোচনা করতে হলে আফ্রিকার চিতামানুষ বা সিংহ মানুষ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা দরকার।

আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে এক শ্রেণির দুবৃত্ত সিংহের মস্তক ও দেহচর্মের আবরণে আত্মগোপন করে নরহত্যায় প্রবৃত্ত হয়। নির্জন স্থানে অসতর্ক পথিককে দেখতে পেলে তারা হতভাগ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

নকল সিংহের হাতে আসল সিংহের মতোই বাঁকা বাঁকা নখ বসানো নকল থাবা লাগানো থাকে। নখরযুক্ত ওই নকল থাবা দিয়ে হতভাগ্য মানুষের দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করে দুবৃত্তরা তাকে হত্যা করে। কখনো কখনো হত্যাকাণ্ডের জন্য বিশেষ ধরনের ছোরা ব্যবহৃত হয়। নিহত মানুষের দেহে ক্ষতচিহ্ন দেখে মনে হয় বনবাসী সিংহের নখরাঘাতেই তার মৃত্যু হয়েছে।

সিংহের ছদ্মবেশে এইভাবে যারা নরহত্যা করে তাদেরই বলা হয় লায়ন-ম্যান বা সিংহ-মানুষ।

সিংহ-মানুষের মতো চিতা-মানুষও একই উপায়ে নরহত্যা করে। তফাত শুধু এই যে লেপার্ডম্যান বা চিতা-মানুষ সিংহের ছদ্ম আবরণের পরিবর্তে চিতাবাঘের ছদ্মবেশ ধারণ করে।

আফ্রিকাবাসীদের বিশ্বাস এইসব নকল সিংহ-মানুষ বা চিতা-মানুষ ছাড়া এমন লোক আছে যারা ইচ্ছা করলেই নিজের নরদেহকে পরিবর্তিত করে হিংস্র শ্বাপদের রূপ ধারণ করতে পারে।

আফ্রিকার স্থানীয় মানুষের এইরূপ বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে কিছু কিছু ঘটনা দিয়ে বিচার করে হয়তো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব ছিল, কিন্তু আগেই বলেছি, নরখাদক শ্বাপদ, লৌকিক অপরাধী এবং অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী জাদুকরদের গোলকধাঁধার জটিলতা ভেদ করে প্রকৃত রহস্যের সমাধান করা খুব কঠিন কাজ। প্রসঙ্গত আর একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।

উল্লিখিত কাহিনিটি বলেছেন ব্রিটিশ সরকারের একজন ইংরেজ কর্মচারী, নাম তার এইচ ডবলিউ টেলর।

টেলর সাহেবের লিখিত বিবরণী থেকে সংক্ষেপে কাহিনিটি বলছি :

ইথিওপিয়ান সোমালিল্যান্ডের সীমানায় সরকারের কার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন টেলর সাহেব। রাজনৈতিক কারণে পূর্বোক্ত অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে টহল দিয়ে তিনি পর্যবেক্ষণ কার্য চালাতেন–ওইটি ছিল তার কর্তব্য কর্ম।

বনচারী হিংস্র পশুরা তাদের রাজ্যে মানুষের অনধিকার প্রবেশ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে রাজি হয়নি তাই গর্জিত রাইফেল আর উদ্যত নখান্তের সংঘর্ষে বনরাজ্যের শান্তিভঙ্গ হয়েছে বারংবার।

টেলর সাহেবের নিশানা ছিল অব্যর্থ; পশুরাজ সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বড়ো আনন্দ পেতেন মি. টেলর–তার রাইফেলের গুলি খেয়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে স্বর্গের দিকে প্রস্থান করেছিল অনেকগুলো সিংহ।

অন্যান্য হিংস্র জন্তুও তিনি শিকার করেছিলেন কিন্তু বিশেষভাবে তার মন এবং দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করেছিল পশুরাজ সিংহ।

টেলর যে অঞ্চলে সরকারের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন সেই এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব ছড়িয়ে বাস করছিল এক বৃদ্ধ সিংহ। স্থানীয় নিগ্রোরা তার নাম দিয়েছিল লিবা। লিবা নরখাদক। তবে গৃহপালিত পশুর মাংসেও তার অরুচি ছিল না। স্থানীয় মানুষ তাকে ভয় করত যমের মতো।

জন্তুটার পদচিহ্ন দেখে খুব সহজেই তাকে শনাক্ত করা যেত। লিবা নামক সিংহটির বাঁ-দিকের থাবায় একটা আঙুল ছিল না, খুব সম্ভব কোনো ফাঁদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার সময়ে ওই আঙুলটাকে সে বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিল।

নিহত গোরু-বাছুরের কাছে লিবার পায়ের চিহ্ন দেখলে স্থানীয় নিগ্রোরা আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়ত। তারা সিংহটাকে কখনো হত্যা করার চেষ্টা করেনি। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে টেলর সাহেবকে খবর দিলে তিনি নিশ্চয়ই রাইফেল হাতে ছুটে আসতেন এবং নিহত শিকারের আশেপাশে লুকিয়ে থেকে লিবাকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করতেন।

মৃত পশুর মাংস খাওয়ার জন্য দ্বিতীয়বার অকুস্থলে আবির্ভূত হলেই লিবা পড়ত সাহেবের রাইফেলের মুখে।

কিন্তু নিগ্রোরা কখনো যথাসময়ে হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সরবরাহ করত না। টেলর খবর পেতেন অন্তত দুই কি তিন দিন পরে ততক্ষণে লিবা শিকারের মাংস উদরস্থ করে সরে পড়েছে নির্বিবাদে। অনেক চেষ্টা করেও টেলর লিবার সাক্ষাৎ পাননি।

কিন্তু টেলর সাহেব লিবার সংবাদ না-রাখলেও লিবা নিশ্চয়ই সাহেবের খবর রাখত।

তখন বর্ষাকাল। বিশেষ কাজে টেলর তার দল নিয়ে টহল দিতে বেরিয়েছেন। টেলর গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হওয়ার আগেই অরণ্যের বুকে উপস্থিত হল রাত্রির নিবিড় অন্ধকার। পরিশ্রান্ত টেলর তবু তাবু ফেলার আদেশ দিলেন না তিনি ভাবছেন কোনোরকমে সামনে আট মাইল পথ অতিক্রম করতে পারলেই তিনি গ্রামের মধ্যে এসে পড়বেন–তার মানসপটে ভেসে উঠেছে কুটিরের মধ্যে অবস্থিত একটি তপ্ত শয্যার লোভনীয় দৃশ্য।

হঠাৎ পিছন থেকে সশস্ত্র আস্কারিদের সর্দার তাকে জানিয়ে দিলে একটা সিংহ তাদের পিছু নিয়েছে। সাহেব ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। এখানকার বনে-জঙ্গলে অনেক সিংহ আছে–সিংহকে ভয় করলে আফ্রিকার বনভূমিতে ঘোরাফেরা করা চলে না। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আট মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার উৎসাহ আর রইল না–টেলর তাবু খাটাতে বললেন।

সেই রাতেই টেলরের আস্তানায় হল সিংহের আবির্ভাব। গভীর রাত্রে গোরু আর উটের দল দড়ি ছিঁড়ে বেড়া ভেঙে ছুটোছুটি করতে লাগল কয়েকটা জন্তু আবার বন্ধন মুক্ত হয়ে ছুটল জঙ্গলের দিকে… অরণ্যের অন্ধকার কালো যবনিকা ফেলে তাদের দেহগুলিকে ঢেকে ফেলল কিছুক্ষণের মধ্যে।

টেলর অথবা তার দলের লোকজন কোনো বন্য পশুর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারলেন না, কিন্তু অনুমানে বুঝলেন একটু আগেই এখানে হয়েছিল সিংহের আবির্ভাব। গৃহপালিত জন্তুদের এই ধরনের আতঙ্কের একটিই কারণ থাকতে পারে সিংহ!

পশুরাজ অত্যন্ত ধূর্ত। সে এমনভাবে রজ্জবদ্ধ গোরু-বাছুরের কাছে এসে দাঁড়ায় যে মানুষরা সিংহের উপস্থিতি বুঝতে না-পারলেও জন্তুগুলো গায়ের গন্ধে পশুরাজের অস্তিত্ব বুঝতে পারে।

ভয়ে পাগল হয়ে জন্তুগুলো দড়ি ছিঁড়ে বেড়া ভেঙে ছুটোছুটি করতে থাকে এবং মানুষের নিরাপদ সান্নিধ্য ছেড়ে ছুটতে ছুটতে এসে পড়ে বনজঙ্গলের মধ্যে! এই সুযোগেরই অপেক্ষায় সিংহ পছন্দসই একটা মোটাসোটা গোরু অথবা বাছুরকে বধ করে শিকারের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। এখানেই সেই ব্যাপার।

অকুস্থলে লিবার মার্কামারা পায়ের ছাপ খুঁজে বার করলে আস্কারির দল। সেই রাত্রে লিবার অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল, একটি জন্তুকেও সে বধ করতে পারেনি।

রাত্রির পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা সকলেই খুব সতর্ক থাকল। কিন্তু লিবা দ্বিতীয়বার অকুস্থলে পদার্পণ করলে না।

টেলর সাহেব বিরক্ত হয়েছিলেন। পরদিন সকালে তিনি আস্কারিদের জানালেন, এখন তার কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তিন-চার দিন এখানে থেকে তিনি লিবার খোঁজ করবেন।

ওই সময়ের ভিতর অন্তত একবার তিনি নিশ্চয়ই সিংহটাকে রাইফেলের আওতার মধ্যে পাবেন। হতভাগা খোঁড়া সিংহটা এই অঞ্চলে অনেকদিন অত্যাচার করছে, কিন্তু টেলারের দলের ওপর ইতিপূর্বে সে হামলা করেনি। টেলর তাকে ছাড়বেন না।

আগে লিবাকে হত্যা করে তারপর অন্য কাজ।

টেলরের সংকল্প শুনে আস্কারিদের সর্দার কয়েকবার ঢোঁক গিলে বললে, বাওয়ানা! আমরা কর্মচারী আদেশ পালন করতে আমরা বাধ্য। কিন্তু যদি আমাদের কথা শোনেন তবে বলব লিবার পিছনে তাড়া করে কোনো লাভ নেই। ওকে মারতে পারবেন না।

ক্রুদ্ধকণ্ঠে টেলর বললেন, কেন?

কারণ লিবা সত্যি সত্যি সিংহ নয়। ও একটা জাদুকর। মন্ত্রের গুণে মাঝে মাঝে সিংহের দেহ ধারণ করে। আমরা সবাই ওকে জানি।

টেলর সকৌতুকে প্রশ্ন করলেন, ওকে জানো? কী নাম তার?

উত্তরে আস্কারিদের সর্দার বললে, এই অঞ্চলে সবাই তাকে চেনে। সে বায় বাহ জাতীয় নিগ্রো, তার নাম আলি।

টেলর বিস্মিত হলেন। আলি তার অপরিচিত নয়। লোকটি বিচক্ষণ সাহসী ও বুদ্ধিমান। গভীর রাত্রে অনেকবার আলি জঙ্গলের পথ ভেঙে এসেছে তার কাছে আবার অন্ধকারের মধ্যেই ফিরে গেছে। তার হাতে একটা ছোটো লাঠি ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্র থাকত না। গভীর রাত্রে শ্বাপদসংকুল বনভূমির ভিতর দিয়ে অস্ত্র হাতে যাতায়াত করাও বিপজ্জনক নিরস্ত্র অবস্থায় অন্ধকার বনপথে পদার্পণ আত্মহত্যারই নামান্তর। কিন্তু আলি রাতের পর রাত নির্ভয়ে বনের পথে যাতায়াত করত।

সম্বল ছিল তার একটি তুচ্ছ লাঠি!

টেলর আস্কারিদের কথা বিশ্বাস করেননি।

তবে তিনি কথা দিলেন যে লিবাকে হত্যার করার চেষ্টা তিনি করবেন না।

টেলর বুদ্ধিমান মানুষ তিনি জানতেন নিগ্রোদের সংস্কার বা বিশ্বাসে আঘাত দিলে অনেক সময় পরিণাম খুব খারাপ হয়। একটা সিংহের জন্য দলের লোকের কাছে অপ্রীতিভাজন হওয়ার ইচ্ছা তাঁর ছিল না।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরেই দৈবক্রমে হঠাৎ আলির সঙ্গে টেলর সাহেবের দেখা হয়ে গেল। আলি তাকে খুব প্রশংসা জানিয়ে বললে যে মি. টেলর লিবাকে হত্যা করার সংকল্প ত্যাগ করে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। সাদা চামড়ার মানুষগুলো সাধারণত নির্বোধ হয় কিন্তু মি. টেলর হচ্ছেন নিয়মের ব্যতিক্রম, তার স্বদেশবাসীর মতো তিনি যে মূর্খ নন এই কথা জেনে আলি অতিশয় আনন্দিত হয়েছে।

টেলর সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন, তুমিই কি লিবা?

আলি উত্তর দিলে না। বাঁ-হাতটাকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।

টেলর দেখলেন আলির বাঁ-হাতের একটা আঙুল নেই!

আলি গম্ভীর স্বরে বললে, আমি আপনার কিছু উপকার করব। আমি জানি কিছুদিন আগেও সিংহের মুখে আপনার জীবন বিপন্ন হয়েছিল। তা ছাড়া সিংহের উপদ্রবে আপনি মাঝে মাঝে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এ-কথাও আমার অজানা নয়। আমার আদেশে আজ থেকে এই অঞ্চলের সিংহরা আপনাকে বা আপনার দলভুক্ত লোকজনদের কখনো আক্রমণ করবে না। সিংহের সম্মুখীন হলেও আপনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ থাকবে।

এমন গম্ভীরভাবে সে কথাগুলো বললে যে তার বক্তব্য বিষয়কে টেলর সাহেব লঘু বিদ্রূপ বলে মনে করতে পারলেন না।

টেলর অবরুদ্ধ হাস্য দমন করলেন, তারপর তিনিও গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার ঘোড়া, গোরু আর অন্যান্য পোষা জানোয়ারগুলি সম্বন্ধেও আমি নিরাপত্তার দাবি করছি।

তুমি সিংহদের নিষেধ করে দিয়ে তারা যেন আমার পোষা জন্তুগুলিকে রেহাই দেয়।

আলি প্রতিবাদ করে বললে, তা কী করে হবে? ঘোড়া, গোরু প্রভৃতি জন্তু হচ্ছে সিংহের খাদ্য। আমার সিংহরা তাহলে খাবে কী?

টেলর বললেন, পোষা জানোয়ার সিংহের খাদ্য নয়। তারা বুনো জন্তু মেরে খাবে।

অনেক তর্কবিতর্কের পর সাহেবের অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হল আলি, কিন্তু তারও একটা শর্ত ছিল–

টেলর কোনো কারণেই সিংহ শিকার করতে পারবেন না।

আলির প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন টেলর।

আস্কারিরা যখন শুনল সিংহের দলপতি আলির সঙ্গে সাহেবের সন্ধি হয়েছে তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল।

টেলর প্রথমে আলির কথার বিশেষ গুরুত্ব দেননি। কিন্তু কিছুদিন পরেই যখন তিনি লক্ষ করলেন যে সিংহরা তার দলের মানুষ ও পশু সম্বন্ধে হঠাৎ খুব উদাসীন হয়ে পড়েছে তখন আর আলির কথাগুলো তিনি উড়িয়ে দিতে পারলেন না।

সকাল বেলা উঠে অনেকদিনই তাবুর কাছে রজ্জবদ্ধ গোরুর পাল ও অশ্বদলের নিকটবর্তী জমির ওপর তিনি সিংহের পদচিহ্ন দেখেছেন।

পায়ের ছাপগুলো দেখে বোঝা যায়, সিংহরা খুব কাছে এসে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে আবার বনের আড়ালে সরে গেছে! টেলরের দলের মানুষ কিংবা পশুর ওপর তারা হামলা করেনি!

একবার নয়, দু-বার—

বারংবার হয়েছে এই ধরনের বিভিন্ন ঘটনার পুনরাবৃত্তি। টেলরের বিবরণীতে আলির বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য লিখিত নেই। ওই অঞ্চলের সিংহরা হঠাৎ তাঁর দলের মানুষ ও পশু সম্বন্ধে অহিংস হয়ে যাওয়ায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আলির অলৌকিক ক্ষমতায় তিনি বিশ্বাস করেছিলেন কি না জানি না।

তবে তিনি তার শর্ত রক্ষা করেছিলেন। টেলর সাহেব পরবর্তীকালে কখনো সিংহ শিকার। করেননি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *