Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আচার || Achar by Lila Majumdar

আচার || Achar by Lila Majumdar

অমৃতবাজার পত্রিকার টুকরোটা হাতে নিয়ে বাবার প্রকাণ্ড চটি-জোড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে সঘোতন খুব লক্ষ করে দেখল, পিসিমা এসে নিবিষ্ট মনে থোকনাকে ঠ্যাঙাচ্ছেন।

প্রথমে ডান কান প্যাঁচালেন, তারপর বললেন, হতভাগা ছেলে! তারপর বাঁ গালপট্টিতে চাঁটালেন, তারপর বললেন, তোকে আজ আমি–তারপর বাঁ-কান প্যাচালেন– আদা লঙ্কা দিয়ে ছেঁচব! তারপর ডান গালপট্টিতে চাঁটালেন– তেল-নুন দিয়ে আমসি বানাব। তারপর পিঠে গুমগুম করে পিঠে গোটা দশেক কিল কষিয়ে, মাথা থেকে চিমটি চিমটি চুল ছিঁড়ে, জুলপি ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, ঠিক ভাড়ার ঘরের দরজার বাইরে! টিপ দেখে ঘোতন তাকে শ্রদ্ধা না করে পারল না।

আরেকটু হলে নিজেই ধরা পড়ে যাচ্ছিল। তবেই হয়েছিল! ভীষণ না রাগলে পিসিমার নাক খনো ও-রকম ফোলে না। অমৃতবাজারের কুচিটুচি ফেলে ঘোতন তো হাওয়া! খোকনটারও যা বুদ্ধি! এত করে বলে দেওয়া হল যেখানে হেয়ারপিন সেই পর্যন্ত পিসিমা পড়েছেন, আচারের জন্য তার এদিক থেকে কাগজ ছিড়িস! বোকা ভাবলে কি না এদিক মানে পিছন দিক, মনেও গজালো না যে একটু পড়লেই ছেঁড়া পাতা এসে যাবে। মাথায় কিচ্ছু নেই, এক যদি গোবর থাকে! বেশ হল! আচারও পেল না, ঠ্যাঙাও খেলো।

আবার পিসিমার টিপের কথা মনে হল। কী চমৎকার টিপ! সেই যে সেবার ক্রিকেট সিজন-এ পানু নিজের ব্যাট দিয়ে খুঁচিয়ে স্টাম্প উড়িয়ে দিয়ে, জিভ কেটে, মাথা চুলকে, তাড়াতাড়ি পালাতে গিয়ে বাউন্ডারির দড়িতে ঠ্যাং আটকে খুঁটিসুদ্ধ দড়ি উপড়ে এনেছিল। বড়োকাকা ছিলেন ক্যাপ্টেন, তিনি এক হাতে পানুর শার্টের কলার আর এক হাতে পেন্টেলুন ধরে তাঁবু থেকে তাকে ঝুলিয়ে নিয়ে বেড়া টপকে ওপারে ফেলে দিয়েছিলেন, আর পিছন পিছন ওর জুতো, প্যাড, গ্লাভস, ব্যাট ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন, প্রত্যেকটি ওর গায়ে লেগেছিল! বাজে প্লেয়ার হলে কি হবে কী-রকম টিপ! পিসিমারই-বা হবে না কেন, ওঁরই তো দিদি!

ঘোতন এদিক ওদিক ঘুরে আচারের কথা ভুলতে চেষ্টা করল। নাঃ! খোকনটা আবার কোথায় উধাও মারল, তার যে পাত্তাই নেই!

অনেক খুঁজে দেখা গেল, ওই রেগেমেগে ভালো ভালো ব্যবহার-না-করা ডাকটিকিটগুলো টেবিলের ঠ্যাঙে একটার নীচে একটা লাইন করে দিব্যি থুতু দিয়ে সাঁটছে! ছোঁড়ার সাহস আছে!

ঘোতনা কাছে এসে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল– লেগেছিল?

খোকনা বললে, কী লেগেছিল?

কী মুশকিল! লাগবে আবার কীসে?

আরে ঠ্যাঙানিতে, ঠ্যাঙানিতে!

উঁহু!

তবে যে দেখলুম মাথাটা এমনি হয়ে গেল?

ও-রকম মাঝে মাঝে হয়।

খাবি নাকি আচার?

না।

ঘেবড়ে গেছিস?

দুৎ! সত্যি বলছি, না। আচ্ছা তুই আন তো দেখি।

ঘোতন এক ছুটে ভাড়ার ঘরের দরজার কাছে চলে গেল। দরজার বাইরে সারি সারি বড়ির থালা অন্ধকারে এ-ওকে ঠেলাঠেলি করে চোখ টিপছে। সারা সকাল মা চিনু মিনুকে নিয়ে বড়ি দিয়েছেন। ঘোতন দেখেছিল মেয়েগুলোর কী বুদ্ধি! প্রথমটা বড়ি চ্যাপটা চ্যাপটা ঘুঁটের মতন হচ্ছিল। যেই মা বললেন যার বড়ি যত উঁচু তার বরের নাক তত উঁচু, অমনি বোকাগুলো টেনে টেনে বড়ির নাক তুলতে লাগল। বুঝবে শেষটা!

যাক, কিন্তু দরজায় যে তালা মারা! অ্যাঃ, মিলার লক! হেয়ারপিন পাকিয়ে ঘোতন তাকে এক মিনিটে শায়েস্তা করে দিল। আজ আর কোনো ভয় নেই। কী করবে পিসি? ঠ্যাঙাবে? ওঃ! ঠ্যাং নেই?

তাকে তাকে আচার! বড়ো বয়ামে, ছোটো বয়ামে, মাটির ভাঁড়ে পাথরের থালায়, শিশিতে, বোতলে। ঘোতনের চোখ দুটো চারদিকে পায়চারি করতে লাগল। ঠিক সেবারের বাঙালি পল্টনের মতন–একটা এগোনো, একটা পেছোনো, একটা লম্বা, একটা বেঁটে! বাঁকা লাইন, দুধের দাঁত পড়ে থোকনার যেমন ত্যাড়াবাকা দাঁত উঠেছিল সেইরকম। সত্যি সেপায়ের মতন। আনাড়ি সেপাইকে যেমন কাঁচা কাঁচা ধরে এনে এক পায়ে ঘাস বেঁধে মার্চ করায়– ঘাস বিচালি ঘাস বিচালি! লেফট রাইট লেফট রাইট তো আর বোঝে না!

আজ কে পিসিমাকে কেয়ার করে!

বয়ামের গায়ে টোকা মেরে মেরে ইচ্ছে করে ভিতরের আচারের ঘুম ভাঙিয়ে দিল।

কীরকম একটা বিশ্রী গন্ধ নাকে আসছিল। ঘরের আনাচে-কানাচে ছুঁচোদের বাবা, মা, দাদা, দিদিরা চুপ মেরে কীসের যেন অপেক্ষা করছে! দেয়ালের গায়ে সুপুরির মতন কেঁদে কেঁদো মাকড়সা খাপ পেতে রেয়েছে। ছাদের উপর টিকটিকিরা খচমচ করে চলাফেরা করছে। তারা অনেক দিন পায়ের নখ কাটেনি। বড় বয়ামের পাশে ওটা কী? নিশ্চয় আমতেল, কেটে পড়ার চেষ্টায় আছে। তুলে দেখে–এ মা! আম তো নয়, আরশুলা চ্যাপটা! যেই পেন্টেলুনে হাতটা মুছতে যাবে–এই রে, পিসিমা! ঘোতনের আত্মারাম শুকিয়ে জুতোর সুখতলার মতন হয়ে গেল, হাত-পাগুলো পেটের ভিতর সেঁদিয়ে গেল।

পিসিমা বললেন, দরজার কাছে হাওয়া আটকে দাঁড়ালে আচার ভেপসে উঠবে। ঘোতন ভয়ের চোটে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল, পিসিমা আবার ডেকে বললেন, আচার নিয়ে যাও।

পিসিমা যে কী! বকলেও বিপদে ফেলেন, না বকলেও বিপদে ফেলেন। ঠেঙিয়েও হার মানান, আবার না ঠেঙিয়েও হার মানান। অন্য বুড়োদের মতন একটুও না।

ঘোতনের ভারি লজ্জা করল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *