Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

১.

না, তস্য তস্য!

বললেন শ্রীঘনশ্যাম দাস, ঘনাদা নামে যিনি কোনও কোনও মহলে পরিচিত।

এ উক্তির আনুপূর্ব বোঝাতে একটু পিছিয়ে যেতে হবে এ কাহিনীর। স্থান-কাল-পাত্রও একটু বিশদ করা প্রয়োজন।

স্থান এই কলকাতা শহরেরই প্রান্তবর্তী একটি বৃহৎ কৃত্রিম জলাশয়, করুণ আত্মছলনায় যাকে আমরা হ্রদ বলে অভিহিত করে থাকি। জীবনে যাদের কোনও উদ্দেশ্য নেই, অথবা কোনও উদ্দেশ্যেরই একমাত্র অনুসরণে যারা পরিশ্রান্ত, উভয় জাতির নানা বয়সের স্ত্রী-পুরুষ নাগরিক প্রতি সন্ধ্যায় এই জলাশয়ের চারিধারে এসে নিজ নিজ রুচি প্রবৃত্তি অনুযায়ী স্বাস্থ্য অর্থ কাম মোক্ষ এই চতুর্বর্গের সাধনায় একা, একা বা দল বেঁধে ভ্রমণ করে উপবিষ্ট হয়।

এই জলাশয়ের দক্ষিণ তীরে একটি নাতিবৃহৎ বৃক্ষকে কেন্দ্র করে কয়েকটি আসন বৃত্তাকারে পাতা। সেই আসনগুলিতে আবহাওয়া অনুকূল থাকলে প্রায় প্রতিদিনই পাঁচটি প্রবীণ নাগরিককে একত্র দেখা যায়।

এ কাহিনী সূচনার পাত্র এঁরাই। তাঁদের একজনের শিরোশোভা কাশের মতো শুভ্র, দ্বিতীয়ের মস্তক মর্মরের মতো মসৃণ, তৃতীয়ের উদর কুম্ভের মতো স্ফীত, চতুর্থ মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল এবং পঞ্চম জন উষ্ট্রের মতো শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন।

প্রতি সন্ধ্যায় এই পঞ্চ সভাসদের অন্তত চারজনকে এই বিশ্রাম-আসনে নিয়মিতভাবে সমবেত হতে দেখা যায় এবং আকাশের আলো বিলীন হয়ে জলাশয়ের চারিপার্শ্বের আলো জ্বলে ওঠার পর ফেরিওয়ালাদের ডাক বিরল না হওয়া অবধি স্বাস্থ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও বাজারদর থেকে বেদান্তদর্শন পর্যন্ত যাবতীয় বিষয় ও তত্ত্ব তাঁরা আলোচনা করে থাকেন।

এ সমাবেশের প্রাণ হলেন শ্রীঘনশ্যাম দাস, প্রাণান্তও বলা যায়।

এ আসর কবে থেকে তিনি অলংকৃত করছেন ঠিক বলা যায় না, তবে তাঁর আবির্ভাবের পর থেকে এ সভার প্রকৃতি ও সুর সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। কুম্ভের মতো যাঁর উদরদেশ স্ফীত সেই ভোজনবিলাসী রামশরণবাবু আগেকার মতো তাঁর রুচিকর রন্ধন-শিল্প নিয়ে সবিস্তারে কিছু বলবার সুযোগ পান না। মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই ভূতপূর্ব ইতিহাসের অধ্যাপক শিবপদবাবু ঐতিহাসিক বিষয় নিয়েও নিজের মতামত জ্ঞাপন করতে দ্বিধা করেন।

কারণ, শ্রীঘনশ্যাম দাস সম্বন্ধে সবাই সন্ত্রস্ত। কোথা থেকে কী অশ্রুতপূর্ব উল্লেখ ও উদ্ভট উদ্ধৃতি দিয়ে বসবেন, নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশের আশঙ্কাতেই যার প্রতিবাদ করতে পারতপক্ষে কেউ প্রস্তুত নন।

মেদভারে হস্তীর মত যিনি বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবু সেদিন কী। কুক্ষণে ঐতিহাসিক উপন্যাসের কথা তুলেছিলেন!

ভবতারণবাবু নির্বিবাদী নিপাট ভালোমানুষ। সরকারি পূর্ত বিভাগে মাঝারি স্তরে কী একটা আয়েসি চাকরি করতেন। কয়েক বছর হল রিটায়ার করেছেন। ধর্মকর্ম এবং নির্বিচারে যাবতীয় মুদ্রিত গল্প উপন্যাস পড়াই এখন তাঁর কাজ।

এ সভায় বেশিরভাগ সময়ে ভবতারণবাবু নীরব শ্রোতা হিসাবেই বিরাজ করেন। এই দিনে আলোচনায় একবার ঢিল পড়ায় কী খেয়ালে নিজের দুর্বলতার কথাটা প্রকাশ করে ফেলেছেন।

দিবানিদ্রার প্রসঙ্গ থেকেই কথাটা বলবার সুযোগ পেয়েছিলেন।

হ্যাঁ, ও রোগ আমার ছিল। যেন লজ্জিতভাবে বলেছিলেন ভবতারণবাবু, ডাক্তার বলেছিল দিনে ঘুমোনো বন্ধ না করলে চর্বি আরও বাড়বে। কিন্তু দিনে ঘুমোনো বন্ধ করি কী করে? দুপুরের খাওয়া সারতে না সারতেই চোখ দুটো ঘুমে জুড়ে আসে। তারপর ওই এক ওষুধে ভোজবাজি হয়ে গেল!

ওষুধটা কী? সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন উদর যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত বর্তুলাকার সেই রামশরণবাবু, কফি?

না, না, কফি কেন হবে?ভবতারণবাবু গদগদ স্বরে বললেন, আজকালকার সব ঐতিহাসিক উপন্যাস। কী অপূর্ব জিনিস ভাবতে পারবেন না, একবার পড়তে শুরু করলে ঘুম দেশ ছেড়ে পালাবে।

আপনি ওইসব উপন্যাস পড়েন? মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু নাসিকা কুঞ্চিত করলেন।

পড়ি মানে? ওই তো এখন আমার ওষুধ। ভবতারণবাবু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, পড়ে দেখবেন একখানা। আর ছাড়তে পারবেন না। আহা, কী সব গল্প আর কী সব। চরিত্র! চোখের সামনে যেন জ্বলজ্বল করে। শাজাহাঁ, ক্লাইব, নুরজাহান, সিরাজ, বাহাদুর শা, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ সব যেন আপনার চেনা পাড়ার ছেলেমেয়ে মনে হবে, আর কী সুন্দর তাদের আলাপ কথাবার্তা! একটু কোথাও খিচ নেই। পাছে বুঝতে না পারেন তাই এক কথা একশো বার বুঝিয়ে দেবে। ইতিহাসকে ইতিহাস, আরব্যোপন্যাসকে আরব্যোপন্যাস।

শুধু তাই নয়তো! মর্মরমসৃণ মস্তক ঝাঁকি দিয়ে শিবপদবাবু যেন তাঁর অবজ্ঞা প্রকাশ করলেন, পড়ে এখনও অবশ্য দেখিনি, কিন্তু ইতিহাসের শ্রাদ্ধ না হলেই বাঁচি। চোখের সামনে যা আছে তা-ই যারা দেখতে পায় না তারা ইতিহাসের ওপর চড়াও হলে একটু ভয় করে কিনা! সেদিন কী একটা এখনকার সামাজিক উপন্যাসে কলকাতার এক বাঙালি ধনীর স্কাই-স্ক্রেপাবের কথা পড়ে খুঁজতেই গিয়েছিলাম নিউ আলিপুরে। আজকের দিন নিয়েই এই! দু-চারশো বছর আগেকার কথা হলে তো একেবারে বেপরোয়া। পানিপথের প্রথম যুদ্ধেই হয়তো ট্যাঙ্ক দেখিয়ে ছাড়বে!

হুঃ!

নাসিকাধ্বনি শুনে সকলকেই সচকিত সন্ত্রস্ত হয়ে এবার ঘনশ্যাম দাসের দিকে তাকাতে হল। এতক্ষণ তাঁর নীরব থাকাই অবশ্য অস্বাভাবিক বলে বোঝা উচিত ছিল।

হ্যাঁ, ঘনশ্যাম দাসই নাসিকাধ্বনি করেছেন। সকলের দৃষ্টি যথোচিত আকৃষ্ট হবার পর তিনি কেমন একটু বাঁকা হাসির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, পানিপথের প্রথম যুদ্ধ কবে হয়েছে যেন?

২১শে এপ্রিল, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ। শিবপদবাবুকে বিদ্যা প্রকাশের এ সুযোগ পেয়ে বেশ যেন একটু গর্বিত মনে হল।

আর আপনার ওই যুদ্ধের ট্যাঙ্কের ব্যবহার হয় প্রথম কবে?—ঘনশ্যাম দাসের কথার সুরটা এবারও যেন বাঁকা।

কিন্তু শিবপদবাবু এখন নিজের কোটের মধ্যে। তিনি সগর্বে গড় গড় করে শুনিয়ে দিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে মিত্রপক্ষের চতুর্থ বাহিনী ঊনপঞ্চাশটি ট্যাঙ্ক ফ্রান্সের সোম থেকে আস্কর অভিযানে ব্যবহার করে। ইতিহাসে যুদ্ধের সচল ট্যাঙ্কের ব্যবহার সেই প্রথম।

আপনাদের ইতিহাসের দৌড় ওই পর্যন্ত!—ঘনশ্যাম দাসের মুখে অনুকম্পা মাখানো বিদ্রূপ।

তাঁর ঐতিহাসিক পাণ্ডিত্যের ওপর এ কটাক্ষে শিবপদবাবু যদি গরম হয়ে ওঠেন, তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না বোধ হয়।

কী বলে তাহলে আপনার ইতিহাস? শিবপদবাবুও গলা পেঁচিয়ে বললেন।

ইতিহাস আমারও না, আপনারও নয়। দাসমশাই করুণাভরে হেসে বললেন, সত্যিকার ইতিহাসটা কী তা শুনতে চান?

চাই বই কী! শিবপদবাবুর যুদ্ধং দেহি ভাব।

তাহলে শুনুন, গসমশাই শুধু অজ্ঞানতিমির দূর করবার কর্তব্যবোধেই যেন। বলতে শুরু করলেন, প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ট্যাঙ্ক ব্যবহার হয়নি বটে, কিন্তু সচল দুর্গের মতো এ যুদ্ধযান আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত হয়েছে তারও ছ-বছর আগে। এর নাম দেওয়া হয়েছিল মান্টা।

ছ বছর আগে মানে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে? শিবপদবাবুর গলায় বিস্ময়ের চেয়ে বিদ্রূপটাই স্পষ্ট।

হ্যাঁ, সেই জোড়া ছুরির বছরেই প্রথম সচল ট্যাঙ্ক নিয়ে মানুষ যুদ্ধ করে। দাসমশাই করুণাভরে জানালেন।

জোড়া ছুরির বছর! সেটা আবার কী? এবার শিবপদবাবুর গলায় আর বিদ্রূপ

নেই।

ওই ১৫২০ খ্রিস্টাব্দেরই নাম ছিল জোড়া ছুরির বছর টেনচটিটলান-এ।— পরিতৃপ্তভাবে ঘনশ্যাম দাস সমবেত সকলের ব্যাদিত মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার। তারপর বিশদ হলেন—তার আগের বছর ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের নাম ছিল একটি খাদ্য। এই দুটি বছর সমস্ত পৃথিবীর ইতিহাসকে ওলট-পালট করে দিয়ে গেছে। কিন্তু জোড়া ছুরির বছরে টেনচটিটলান-এ ওই সচল ট্যাঙ্ক প্রথম মাথা থেকে বার করে কাজে না লাগালে ইতিহাস আর-এক রাস্তায় চলে যেত। একদিন দেনার দায়ে মাথার চুল বিকোনো অথর্ব হার্নারেমন্ডো কর্টেজ তাহলে ক্ষোভে দুঃখে স্পেনের সম্রাট পঞ্চম চার্লসকে শোনাবার সুযোগ পেতেন না যে, স্পেনে যত শহর আছে গুনতিতে তার চেয়ে অনেক বেশি রাজ্য তিনি সম্রাটকে ভেট দিয়েছেন। ভলতেয়ারের লেখা এ বিবরণ গালগল্প বলে যদি উড়িয়েও দিই, তবু এ কথা সত্য যে টেনটিন-এর নাম তাহলে অন্য যা-ই হোক, মেক্সিকো সিটি হয়ে উঠত না, আর ঘনশ্যামের পেছনে দাস পদবি লাগাবার সৌভাগ্য হত না আমার কপালে।

উপস্থিত সকলের ঘূর্ণমান মাথা স্থির করতে বেশ একটু সময় লাগল। মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবুই প্রথম একটু সামলে উঠে, দুবার ঢোক গিলে, তাঁর বিমূঢ় বিহ্বলতাকে ভাষা দিলেন, ও, আপনি স্পেনের হয়ে কর্টেজ-এর মেক্সিকো বিজয়ের কথা বলছেন? সেই যুদ্ধে প্রথম সচল ট্যাঙ্ক ব্যবহার হয়? কিন্তু তার সঙ্গে আপনার পদবি দাস হওয়ার সম্পর্ক কী?

সম্পর্ক এই যে, ঘনশ্যাম দাস যেন সকলের মূঢ়তা ক্ষমার চক্ষে দেখে বললেন, কর্টেজ-এর অমূল্য ডায়ারি চিরকালের মতো হারিয়ে না গেলে ও মেক্সিকোর অ্যাজটেক রাজত্ব জয়ের সবচেয়ে প্রামাণ্য ইতিহাস হিস্টোরিয়া ভেদাদেরা দে লা কনকুইস্তা দে লা নুয়েভা এল্পনার লেখক বার্নাল ডিয়াজ নেহাত হিংসায় ঈর্ষায় চেপে না গেলে, প্রথম ট্যাঙ্কের উদ্ভাবক ও কর্টেজ-এর উদ্ধারকর্তা হিসেবে যাঁর নাম ইতিহাসে পাওয়া যেত তিনি দাস বলেই নিজের পরিচয় দিতেন।

পদবি তাঁর দাস ছিল? মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল ভবতারণবাবু বিস্ফারিত নয়নে জিজ্ঞাসা করলেন, তার মানে তিনি বাঙালি ছিলেন?

বাঙালি অবশ্য এখনকার ভাষায় বলা যায়। দাসমশাই বুঝিয়ে দিলেন, তবে তখনও এ শব্দের প্রচলন হয়নি। তিনি অবশ্য এই গৌড় সমতটের লোকই ছিলেন।

আপনার কোনও পূর্বপুরুষ তাহলে? স্ফীতোদর রামশরণবাবু সবিস্ময়ে বললেন, অতি-বৃদ্ধ প্রপিতামহটহ কেউ!

না, তস্য তস্য। বললেন দাসমশাই। তারপর একটু থেমে কৃপা করে উক্তিটি ব্যাখ্যা করলেন বিশদভাবে, অর্থাৎ, আমার ঊর্ধ্বতন দ্বাবিংশতম পূর্বপুরুষ ঘনরাম, দাস পদবির উৎপত্তি যাঁর থেকে।

মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু নিজের কোটেও কেঁচো হয়ে থাকতে হওয়ায় এতক্ষণ বোধ হয় মনে মনে গজরাচ্ছিলেন। এবার ভুরু কপালে তুলে। একটু ঝাঁঝালো গলাতেই জিজ্ঞাসা করলেন, ১৫১৯ কি ২০ খ্রিস্টাব্দে আপনার সেই বাঙালি পূর্বপুরুষ মেক্সিকো গেছলেন?

শিবপদবাবু যেভাবে প্রশ্নটা করলেন, তাতে-গঞ্জিকা পরিবেশনের আর জায়গা পেলেন না!—কথাটা খুব যেন উহ্য রইল না।

দাসমশাই তবু অববাধের প্রতি করুণার হাসি হেসে বললেন, শুনতে একটু আজগুবিই লাগে অবশ্য। কিউবা বাহামাদ্বীপ ইত্যাদি আগে আবিষ্কার করলেও ক্রিস্টোফার কলম্বাস-ই তিন বারের বান ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে আসল দক্ষিণ আমেরিকার মাটি স্পর্শ করেন। তাঁর আমেরিকা আবিষ্কারের মাত্র একুশ বছর বাদে তখনকার এক বঙ্গসন্তানের সেই সুদূর অ্যাজটেকদের রাজধানী টেনটিন-এ গিয়ে হাজির হওয়া অবিশ্বাস্যই মনে হয়। কিন্তু ইতিহাসের বুনন বড় জটিল। কোন জীবনের সুতো যে কার সঙ্গে জড়িয়ে কোথায় গিয়ে পৌঁছোয় তা কেউ জানে না। যে বছর কলম্বাস প্রথম আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন সেই ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দেরই ১লা মে তারিখে পোর্তুগালের এক নাবিক ভাস্কো দা গামা আফ্রিকার দক্ষিণের উত্তমাশা অন্তরীপ পার হয়ে এসে ভারতের পশ্চিম কূলের সমৃদ্ধ রাজ্য কালিকটে তার চারটে জাহাজ ভেড়ায়। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিল তাতে বিফল হয়ে ভাস্কো দা গামাকে ফিরে যেতে হয়। কিন্তু কালিকটের জামোরিনের ওপর আক্রোশ মেটাতে দশটি সশস্ত্র জাহাজ নিয়ে ভাস্কো দা গামা ফিরে আসে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে। এবার নরপিশাচের মতো সে শুধু কালিকট ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হয় না। কালিকট ছারখার করে সেখান থেকে কোচিন যাবার পথে হিংস্র হাঙরের মতো সমুদ্রের ওপর যা ভাসে এমন কোনও কিছুকেই রেহাই দেয়নি। যে সব জাহাজ ও সুলুপ লুঠ করে জ্বালিয়ে সে ড়ুবিয়ে দেয় তার মধ্যে ছিল একটি মকরমুখী পালোয়ার সদাগরি জাহাজ। সে সদাগরি জাহাজ সমতট থেকে সূক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্র নিয়ে বাণিজ্য করতে গেছল ভূগুকচ্ছে। সেখানে থেকে ফেরার পথেই এই অপ্রত্যাশিত সর্বনাশ। দা গামার পৈশাচিক আক্রমণে সে সদাগরি জাহাজের সব মাঝি মাল্লা যাত্রীরই শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তা হয়নি। রক্ষা পেয়েছিল একটি দশ বৎসরের বালক। দয়ামায়ার দরুন নয়, নেহাত কুসংস্কারের দরুনই দা গামার জাহাজের নরপশুরা তাকে রেহাই দেয়। জ্বলন্ত সদাগরি জাহাজ যখন ড়ুবছে তখন ছেলেটি কেমন করে সাঁতরে এসে দা গামার-ই খাস জাহাজের হালটা ধরে আশ্রয় নেয়। একজন মাল্লা তাকে সেখানে দেখতে পেয়ে পৈশাচিক আনন্দে আরও ক-জনকে ডাকে ছেলেটিকে বন্দুক ছুড়ে মেরে মজা করবার জন্যে। কিন্তু সেকালের ম্যাচলক বন্দুক। ছুড়তে গিয়ে বন্দুক ফেটে সেই লোকটাই পড়ে মারা। ঠিক সেই সময়ে তিনটে শুশুকের জাতের ড়ুগংকে জলের মধ্যে ডিগবাজি খেতে দেখা যায় জাহাজের কিছু পেছনে। দুটো ব্যাপার নিজেদের কুসংস্কারে এক সঙ্গে মিলিয়ে দৈবের অশুভ ইঙ্গিত মনে করে ভয় পেয়ে

ছেলেটিকে আর মারতে তারা সাহস করে না। তার বদলে তাকে তুলে নেয়। জাহাজের ওপরে।

১৫০৩ সালে ভাস্কো দা গামা লিসবন-এ ফেরবার পর ছেলেটি বিক্রি হয়ে যায় ক্রীতদাসের বাজারে। সেখান থেকে হাত ফেরতা হতে হতে একদিন সে কিউবায় গিয়ে পৌঁছোয়। দশ বছর বয়সে দা গামার জাহাজে যে লিসবন-এ এসেছিল সে তখন চব্বিশ-পঁচিশ বছরের জোয়ান। জুয়ারেজ নামে কিউবায় এসে বসতি করা একটি পরিবারের সে ক্রীতদাস।

কর্টেজ তখন সেই কিউবাতেই সে দ্বীপের বিজেতা ও শাসনকর্তা ভেলাসকেথের বিষ নজরে পড়েছে। বিষ নজরে পড়েছে ওই জুয়ারেজ পরিবারেরই একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমের ব্যাপারে। মেয়েটির নাম ক্যাটালিনা জুয়ারেজ। কর্টেজ স্বভাবে-চরিত্রে একেবারে তখনকার মার্কামারা অভিজাত স্প্যানিশ। উদ্দাম দুরন্ত বেপরোয়া যুবক। প্রেম সে অনেকের সঙ্গেই করে বেড়ায়, কিন্তু বিয়ের বন্ধনে ধরা দিতে চায় না। বিশেষ করে জুয়ারেজ পরিবার বংশে খাটো বলেই ক্যাটালিনার সঙ্গে বেশ কিছুদিন প্রেম চালিয়ে সে তখন সরে দাঁড়িয়েছে। ভেলাসকেথ-এর কোপদৃষ্টি সেই জন্যেই পড়েছে। কর্টেজ-এর ওপর। ভেলাসকেথ-এর সঙ্গে জুয়ারেজ পরিবারের মাখামাখি একটু বেশি। ক্যাটালিনার আর-এক বোন তার অনুগ্রহধন্যা।

জুয়ারেজ পরিবারের সঙ্গে বেইমানি করার দরুন ভেলাসকেথ-এর এমনিতেই রাগ ছিল, কর্টেজ তার ওপর তাঁর বিরুদ্ধেই চক্রান্ত করছে খবর পেয়ে ভেলাসকেথ তাকে কয়েদ করলেন একদিন। কর্টেজ-এর বুঝি ফাঁসিই হয় রাজদ্রোহের অপরাধে। সেকালে স্পেনের নতুন-জেতা উপনিবেশে এ ধরনের বিচার আর দণ্ড আকছার হত।

কর্টেজ কিন্তু সোজা ছেলে নয়। পায়ের শিকল খুলে গারদের জানলা ভেঙে একদিন সে হাওয়া। আশ্রয় নিল গিয়ে এক কাছাকাছি গির্জেয়। তখনকার দিনে গির্জের অপমান করে সেখান থেকে কাউকে ধরে আনা অতি বড় স্বেচ্ছাচারী জবরদস্ত শাসকেরও সাধ্য ছিল না। কিন্তু গির্জের মধ্যে কর্টেজ-এর মতো ছটফটে দুরন্ত মানুষ ক-দিন লুকিয়ে থাকতে পারে। সেখান থেকে লুকিয়ে বেরোতে গিয়ে আবার কটেজ ধরা পড়ল।

এবার হাতকড়া বেড়ি পরিয়ে একেবারে জাহাজে নিয়ে তোলা হল তাকে। পরের দিন সকালেই তাকে চালান করা হবে হিসপানিয়েলায় বিচার আর শাস্তির জন্যে।

বিচার মানে অবশ্য প্রহসন আর শাস্তি মানে প্রাণদণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়।

কর্টেজ-এর এবার আর কোনও আশা কোনও দিকে নেই।

ভেলাসকেথ এবার তাঁর ক্ষমতার বহরটা না বুঝিয়ে ছাড়বেন না।

অথচ এই ভেলাসকেথ-এর সঙ্গেই কর্টেজ প্রধান সহায় রূপে কিউবা-বিজয়ের অভিযানে ছিলেন। ভেলাসকেথ-এর প্রিয়পাত্রও তখন হয়েছিলেন কিছুদিন। হবারই কথা। ভেলাসকেথ তাঁর অভিযানে সব দিকে চৌকস এমন যোগ্য সহকারী আর পাননি। তখন স্পেনের কল্পনাতীত সাম্রাজ্য বিস্তারের দিনেও অসীম সাহসের সঙ্গে স্থির বুদ্ধি ও দুরন্ত প্রাণশক্তির এমন সমন্বয় বিরল ছিল।

কর্টেজ-এর জন্ম স্পেনের পুব-দক্ষিণ দিকের মেদেলিন শহরে। ছেলেবেলায় নাকি ক্ষীণজীবী ছিলেন, কিন্তু বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই সমর্থ জোয়ান হয়ে উঠেছেন। বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিল কর্টেজ আইন পড়ে। বছর দুই কলেজে পড়েই কটেজ পড়ায় ইস্তফা দিয়ে পালিয়ে আসেন। তখন স্পেনের হাওয়ায় নতুন অজানা। দেশ আবিষ্কারের উত্তেজনা ও মাদকতা। দুঃসাহসিক নিরুদ্দেশ যাত্রার উদ্দীপনা সব তরুণের মনে। এসব অভিযানে সোনা দানা হিরে মানিকের কুবেরের ভাণ্ডার লুঠ করে আনার প্রলোভন যেমন আছে, তেমনই আছে অজানা রহস্যের হাতছানি, আর সেই সঙ্গে গৌরব-মুকুটের আশা।

উনিশ বছর বয়সে ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে কর্টেজ স্পেন ছেড়ে পাড়ি দিলেন নতুন আবিষ্কৃত পশ্চিমের দেশে ভাগ্যান্বেষণে। সফল বিফল নানা অভিযানে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ১৫১১ সালে কর্টেজ ভেলাসকেথ-এর সঙ্গে গেলেন তাঁর কিউবা-বিজয়ের সহায় হয়ে। মান-সম্মান অর্থ-প্রতিপত্তি কিছুটা তখন তাঁর হয়েছে। ভবিষ্যৎ তাঁর উজ্জ্বল বলেই সকলের ধারণা। ঠিক এই সময়ে স্বভাবের দোষে আর ভাগ্যের বিরূপতায় এই সর্বনাশ তাঁর ঘটল। চোর-ডাকাতের মতো ফঁসিকাঠে লটকেই তাঁর জীবনের সব উজ্জ্বল সম্ভাবনা শেষ হবে।

জাহাজের গারদকুইরির ভেতর হাত-পায়ে শেকলবাঁধা অবস্থায় এই শোচনীয় পরিণাম নিশ্চিত জেনে কর্টেজ তখন ভেঙে পড়েছেন। উপায় থাকলে আত্মহত্যা করেই নিজের মানটা অন্তত তিনি বাঁচাতেন।

হঠাৎ কর্টেজ চমকে উঠে দুকান খাড়া করেন।

এই রাত্রে নির্জন জাহাজঘাটার পাড়ে কোথায় কোন ধর্মযাজক আভে মেরিয়া-র স্তোত্র পাঠ করতে এসেছেন।

পর মুহূর্তেই কর্টেজের বিস্ময়ের আর সীমা থাকে না।

এ তো আভে মেরিয়া নয়। ভাষাটা ল্যাটিন, সুরটাও মাতা মেরির বন্দনার স্তোত্রের, কিন্তু কথাগুলো যে আলাদা!

কর্টেজ দুবছর কলেজে একেবারে ফাঁকি দিয়ে কাটাননি। ল্যাটিনটা অন্তত শিখেছিলেন।

স্তোত্রের সুরে উচ্চারিত কথাগুলোর মানে এবার তিনি বুঝতে পারেন। এ তো তাঁর উদ্দেশেই উচ্চারণ করা শ্লোক! ল্যাটিনে বলা হচ্ছে যে, ভাবনা কোরো না বন্দি বীর! আজ গভীর রাত্রে সজাগ থেকো। যে তোমাকে মুক্ত করতে আসছে তাকে বিশ্বাস কোবরা।

জাহাজের মাল্লা আর প্রহরীরা গোমুখখু। তাদের বুঝতে না দেবার জন্যেই এই ল্যাটিন স্তোত্রের ছল, তা কর্টেজ বুঝলেন।

কিন্তু কে তাঁকে উদ্ধার করতে আসছে! এমন কোন দুঃসাহসিক বন্ধু তাঁর আছে যে তাঁকে এই জাহাজের গারদ থেকে উদ্ধার করবার জন্যে নিজের প্রাণ বিপন্ন করবে?

সত্যিই কেউ আসবে কি?

আশায় উদ্বেগে অধীর হয়ে কর্টেজ জেগে থাকেন।

সত্যিই কিন্তু সে এল। গভীর রাত্রে প্রহরীরা যখন ঢুলতে ঢুলতে কোনও রকমে। পাহারা দিচ্ছে, তখন জাহাজের গারদ কুঠুরির একটি মাত্র শিক দেওয়া জানালায় গাঢ় অন্ধকারে একটা সিঁড়িঙ্গে ভুতুড়ে ছায়াই যেন দেখা গেল।

কিছুক্ষণ বাদেই জানালার শিকটা দেখা গেল কাটা হয়ে গেছে নিঃশব্দে।

সেই ভুতুড়ে ছায়া গোছের লোকটা এবার জানালা গলে নেমে এল ভেতরে। কর্টেজ-এর হাত-পায়ের শিকল কেটে খুলে দিতে বেশিক্ষণ তার লাগল না।

চাপা গলায় সে এবার বললে, জানালা দিয়ে বাইরে চলে যান এবার। ডেক এর। এদিকটা অন্ধকার। পাহারাতেও কেউ নেই। ডেক-এর রেলিং থেকে একটা দড়ি ঝুলছে দেখবেন। নির্ভয়ে সেটা ধরে নীচে নেমে যান। সেখানে একটা ডিঙি বাঁধা আছে। সেইটে খুলে নিয়ে প্রথম স্রোতে নিঃশব্দে ভেসে জাহাজঘাটা ছাড়িয়ে চলে যান। তারপর যেখানে তোক তীরে উঠলেই চলবে।

এই নির্দেশ পালন করতে গিয়েও একবার থেমে কর্টেজ না জিজ্ঞেস করে পারলেন , আর আপনি?

আমার জন্যে ভাববেন না, বললে অস্পষ্ট মূর্তিটা, আগে নিজের প্রাণ বাঁচান। আমি যদি পারি তো আপনার পিছু পিছু ওই ডিঙিতেই গিয়ে নামব। নইলে গোলমাল যদি কিছু হয়, জাহাজেই তার মওড়া নিতে হবে।

কর্টেজ নির্দেশ মতো ডিঙিতে পৌঁছোবার পর ছায়ার মতো মূর্তিটাও তাতে নেমে এল। জাহাজের ওপর কেউ কিছু জানতে পারেনি।

ডিঙি খুলে স্রোতে ভাসিয়ে অনেকখানি দূরে তীরে গিয়ে ওঠেন দুজনে।

কর্টেজ তখন কৌতূহলে অধীর হয়ে পড়েছেন। কে এই অদ্ভুত অজানা মানুষটা? গায়ে আঁটসাঁট পোশাক সমেত যে চেহারাটা দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে তাঁর চেনা-জানা কোনও কারওই মিল নেই। তারা কেউ এমন রোগাটে লম্বা নয়। মুখটা তখনও অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। একটা শুধু দু-চোখের জন্যে দুটো ফুটো করা কাপড় তাতে বাঁধা।

তীরে নামবার পর কর্টেজ কিছু জিজ্ঞাসা করবার অবসর অবশ্য পেলেন না। লোকটা তাঁকে সে সুযোগ না দিয়ে ব্যস্তভাবে বলল, আর দেরি করবার সময় নেই, ডন কর্টেজ। আরবারে যে গির্জেয় আশ্রয় নিয়েছিলেন, সোজা সেখানেই যেতে হবে সামনের বনের ভেতর দিয়ে। আসুন।

এ দিকের এই বনাঞ্চলটা কটেজ-এর অচেনা। কিন্তু লোকটার সব যেন মুখস্থ। অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে কিছুক্ষণ বাদেই কর্টেজকে সে গির্জের পেছনের কবরখানার কাছে পৌঁছে দিয়ে বললে, এবার আপনি নিরাপদ, উন কটেজ। কেউ এখনও আপনার পালাবার খবর জানতে পারেনি। যান, ভেতরে চলে যান এদিক দিয়ে। ” কিন্তু কর্টেজ গেলেন না। সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে স্পেনের আদব কায়দা মাফিক কুর্নিশ করে দৃঢ়স্বরে বললেন, না, আমার এত বড় উপকার যিনি করলেন, তাঁর পরিচয় না জেনে আমি কোথাও যাব না। বলুন আপনি কে? কী আপনার নাম?

আমার পরিচয় কী দেব, ডন কর্টেজ। লোকটা তার মুখের ঢাকা খুলে ফেলে বললে, ক্রীতদাসের কি কোনও পরিচয় থাকে। আমরা গোরু ঘোড়ার বেশি কিছু নয়। আমায় সবাই গানাদো মানে গোরু-ভেড়া বলেই ডাকে হুকুম করতে।

কর্টেজ তখন হতভম্ব। স্প্যানিশে গানাদো মানে গোরু-ভেড়া। তার চেয়ে ভাল সম্বোধন যার নেই তেমনই একটা ক্রীতদাসকে কুর্নিশ করে আপনি বলেছেন বলে বেশ একটু লজ্জাও বোধ করছেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে কর্টেজ খুব খারাপ ছিলেন না। এত বড় উপকারের কৃতজ্ঞতাটা তাই তৎক্ষণাৎ উড়িয়ে দিতে না পেরে একটু ইতস্তত করে তুই-এর বদলে তুমি বলেই সম্বোধন করে বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি—মানে কাদের ক্রীতদাস তুমি?

যে জুয়ারেজ পরিবারে আপনি আগে যাতায়াত করতেন, তাদেরই। লোকটির মুখে অন্ধকারেও যেন একটু অদ্ভুত হাসি দেখা গেল—ক্রীতদাসদের কেউ তো লক্ষ করে দেখে না! নইলে আপনার ফাইফরমাশও আমি অনেক খেটেছি।

কিন্তু, কিন্তু, কর্টেজ একটু ধোঁকায় পড়েই বললেন এবার, তোমায় তো চেহারায় এদেশের আদিবাসী বলে মনে হয় না। দু-চারজন যে কাফ্রি ক্রীতদাস এখন এখানে আমদানি হয়েছে তাদের সঙ্গেও তোমার মিল নেই। তাহলে তুমি

হ্যাঁ, ডন কর্টেজ, আমি অন্য দেশের মানুষ। কর্টেজ-এর অসম্পূর্ণ কথাটা পূরণ করে লোকটি বললে, আপনারা এক ইন্ডিজ-এর খোঁজে পশ্চিম দিকে পাড়ি দিয়েছেন, কিন্তু আর-এক আসল ইন্ডিজ আছে পূর্ব দিকে। আমি সেখানকার মানুষ। ছেলেবেলায় বোম্বেটেদের কাছে ধরা পড়ে এদেশে এসে ক্রীতদাস হয়েছি।

কর্টেজ সব কথা মন দিয়ে শুনলেন কি না বলা যায় না। আর-এক প্রশ্ন তখন তাঁর মনে প্রধান হয়ে উঠেছে। একটু সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, দু-প্রহর রাত্রে জাহাজঘাটার পাড়ে আভে মেরিয়ার সুরে স্তোত্র পাঠ করে কে আমায় এ উদ্ধারের জন্যে তৈরি থাকতে বলেছিল?

একটু চুপ করে থেকে লোকটি বললে, আর কেউ নয় ডন কর্টেজ, এই অধীন।

তুমি!—কর্টেজ সত্যিই এবার দিশাহারা—তোমার অমন শুদ্ধ ল্যাটিন উচ্চারণ! এ শ্লোক তৈরি করলে কে? শেখালে কে তোমায়?

কেউ শেখায়নি ডন কর্টেজ। লোকটি সবিনয়ে বললে, ও শ্লোক আমিই তৈরি করেছি আপনাকে হুঁশিয়ার করবার জন্যে।

তুমি ও শ্লোক তৈরি করেছ? তুমি ল্যাটিন জানো!-কর্টেজ একেবারে তাজ্জব।

আজ্ঞে, হ্যাঁ-লোকটি যেন লজ্জিত—এখানে চালান হবার আগে অনেককাল ডন লোপেজ দে গোমারার পরিবারে ক্রীতদাস ছিলাম। পণ্ডিতের বাড়ি। শুনে শুনে আর লুকিয়ে-চুরিয়ে পড়াশুনা করে তাই একটু শিখেছি। কিন্তু আর আপনি দেরি করবেন না, ডন কটেজ। গিঞ্জেয় গিয়ে লুকোন তাড়াতাড়ি। বাইরে কেউ আপনাকে দেখলেই এখন বিপদ।

ফিরে গির্জের বাগানে ঢুকতে গিয়েও কর্টেজ কিন্তু আবার ঘুরে দাঁড়ালেন।

কী হবে ওই গির্জের মধ্যে চোরের মতো লুকিয়ে থেকে?কর্টেজ বললেন ক্ষোভ আর বিরক্তির সঙ্গে, কতদিন বা ওভাবে লুকিয়ে থাকতে পারব? আর যদি বা পারি, ছুঁচোর মতো গর্তে লুকিয়ে বাঁচার চেয়ে ফাঁসিকাঠে ঝোলাও ভাল।

ভরসা দেন তো এই অধম একটা কথা নিবেদন করতে পারে। লোকটি। বিনীতভাবে বললে।

কী কথা? কর্টেজ এবার মনিবের মেজাজেই কড়া গলায় বললেন।

লোকটি তবু না ভড়কে বললে, ছুঁচোর মতো গর্তে লুকিয়ে বাঁচবার মানুষ সত্যিই তো আপনি নন। ডন জুয়ান দে গ্রিজাল ভা এই সবে পশ্চিমের কুবেরের রাজ্যের সন্ধান পেয়ে ফিরেছেন, শুনেছেন নিশ্চয়। কিউবার শাসনকর্তা মহামহিম ভেলাসকেথ সেখানে আর একটি নৌবহর পাঠাবার আয়োজন করছেন। এ নৌ-অভিযানের ভার নেবার উপযুক্ত লোক আপনি ছাড়া কে আছে সারা স্পেনে!

খুব তো গাছে চড়াচ্ছ! তিক্ত স্বরে বললেন কর্টেজ, হাতে-পায়ে বেড়ি দিয়ে যে আমায় ফাঁসিতে লটকাতে চায়, সেই ভেলাসকেথ আমায় এ ভার দেবার জন্যে হাত বাড়িয়ে আছে বোধহয়!

হাত তিনি সত্যিই বাড়াবেন, ডন কর্টেজ। বললে লোকটি, শুধু একটি ভুল যদি আপনি শোধরান।

কী ভুল শোধরাব? গরম হয়ে উঠলেন কর্টেজ। লোকটি কিন্তু অবিচলিত। ধীরে ধীরে বললে, ডোনা ক্যাটালিনাকে আপনি বিয়ে করুন, ডন কর্টেজ। তিনি শুধু যে আপনাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন তা নয়, তাঁর মতো গুণবতী মেয়ে সারা স্পেনে খুব কম আছে। তাঁর কথা ভেবে তাঁর খাতিরেই আপনাকে আমি উদ্ধার করেছি।

সাহস তো তোর কম নয়! লোকটার আস্পর্ধায় তুই-তোকারি করে ফেললেও একটু যেন নরম ভাবিত গলাতেই বললেন কর্টেজ, আমি কাকে বিয়ে করব না করব তাও তুই উপদেশ দিতে আসিস!

২.

গোরু যার ডাক নাম—সেই ক্রীতদাস গানাদোর পরামর্শই কিন্তু শুনেছিলেন ডন, হার্নারেমন্ডো কর্টেজ। তাঁর বরাতও ফিরেছিল তাইতে। ডোনা ক্যাটালিনা জুয়ারেজকে বিয়ে করে আবার শুধু ভেলাসকেথ-এর সুনজরেই তিনি পড়েননি, নেতৃত্বও , পেয়েছিলেন কুবেরের রাজ্য খুঁজতে যাবার নৌবহরের।

ক্রীতদাস গানাদোকে তিনি ভোলেননি। স্ত্রী ক্যাটালিনার অনুরোধে জুয়ারেজ পরিবারের কাছ থেকে তাকে কিনে নিয়ে সঙ্গী অনুচর করে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর অ্যাজটেক রাজ্য বিজয়ের অভিযানে।

সে অভিযান এক দীর্ঘ কুৎসিত কাহিনী।

গানাদোর কাছে তা বিষ হয়ে উঠেছিল শেষ পর্যন্ত। স্প্যানিয়ার্ডদের নৃশংস বর্বরতা দেখে যেমন সে স্তম্ভিত হয়েছিল তেমনই হতাশ হয়েছিল অ্যাজটেকদের ধর্মের পৈশাচিক বীভৎস সব অনুষ্ঠান দেখে। তাদের নিষ্ঠুরতম দেবতা হলেন হুইটজিলপচলি। জীবন্ত মানুষের বুকে ছুরি বসিয়ে তার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে বার করে তাঁকে নৈবেদ্য দিতে হয়। এ নারকীয় অভিযান থেকে ফিরে যেতে পারলে গানাদো তখন বাঁচে।

কিন্তু ফেরা আর তার হত না! হিতকথা বলেই একদিন সে কর্টেজ-এর প্রিয়পাত্র হয়েছিল। সেই হিতকথাই আবার গানাদোর সর্বনাশ ডেকে এনেছিল একদিন।

কর্টেজ-এর স্প্যানিশ বাহিনীর তখন চরম দুর্দিন।

স্পেনের সৈনিকদের অমানুষিক অত্যাচারে সমস্ত টেনচ্‌টিট্‌লান তখন খেপে গিয়ে তাদের অ্যাকসিয়াক্যা্টল-এর প্রাসাদে অবরুদ্ধ থাকতে বাধ্য করেছে। টেনচ্‌টিট্‌লান নতুন মহাদেশের ভেনিস। শহরের চারিধার হ্রদে ঘেরা। কর্টেজ কোনও মতে তাঁর বাহিনী নিয়ে এ দ্বীপ নগর থেকে বেরিয়ে পালাবার জন্য ব্যাকুল। কিন্তু তার উপায় নেই। অ্যাজটেকদের আগ্নেয়াস্ত্র নেই, ইস্পাতের ব্যবহার তারা জানে না, তারা ঘোড়া কখনও আগে দেখেনি, কিন্তু তাদের তীরধনুক, ব্রোঞ্জের বল্লম, তলোয়ার আর ইট-পাটকেল নিয়ে সমস্ত নগরবাসী তখন মরণপণ করেছে বিদেশি সাদা শয়তানদের নিঃশেষ করে দেবার জন্যে। অ্যাসিয়াক্যাল্স-এর প্রাসাদ থেকে কারও এক পা বাড়াবার উপায় নেই।

এই বিপদের মধ্যে স্পেনের সৈনিকদের মধ্যেই আবার কর্টেজ-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে উঠেছে। তার নেতা হল অ্যান্টোনিও ভিল্লাফানা নামে এক সৈনিক।

প্রাসাদের একটি গোপন কক্ষে গানাদো ভিল্লাফানার দলের এ চক্রান্তের আলোচনা একদিন শুনে ফেলেছে। কিন্তু কর্টেজকে এসে সে খবর দেবার আগেই তাকে ধরে ফেলেছে ভিল্লাফানা।

ক্রীতদাস গানাদোর কাছে তো আর অস্ত্রশস্ত্র নেই। অ্যান্টোনিও ভিল্লাফানা তাকে সোজা এক তলোয়ারের কোপেই সাবাড় করতে যাচ্ছিল। কিন্তু গানাদো যে কর্টেজ-এর পেয়ারের অনুচর তা মনে পড়ায় হঠাৎ তার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি খেলে গেছে।

সঙ্গীদের কাছ থেকে একটা তলোয়ার নিয়ে তার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলেছে, নে হতভাগা কালা নেংটি, তলোয়ার হাতে নিয়েই মর।

তলোয়ার নিয়ে আমি কী করব, হুজুর! ভয়ে ভয়েই যেন বলেছে গানাদো, আমার মতো গোলাম তলোয়ারের কী জানে!

তবু হাতে করে তোল, হতভাগা! পৈশাচিক হাসি হেসে বলেছে অ্যান্টোনিও, গোলাম হয়ে আমার ওপর তলোয়ার তুলেছিস বলে তোকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি বলবার একটা ওজর চাই যে।

নেহাত যেন অনিচ্ছায় ভয়ে ভয়ে তলোয়ারটা তুলে নিয়েছে গানাদো। অ্যান্টোনিও তলোয়ার নিয়ে এবার তেড়ে আসতেই ভয়ে ছুটে পালিয়েছে আর-একদিকে।

কিন্তু পালাবে সে কোথায়! হিংস্র শয়তানের হাসি হেসে বেড়ালের ইঁদুর ধরে খেলানোর মতো তলোয়ার ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ তাকে নাচিয়ে বেড়িয়ে মজা করেছে অ্যান্টোনিও ভিল্লাফানা। তারপর হঠাৎ বেকায়দাতেই বোধহয় গানাদোর তলোয়ারের একটা খোঁচায় তার জামার আস্তিন একটু ছিঁড়ে যাওয়ায় খেপে উঠেছে অ্যান্টোনিও। এবার আর ইঁদুর খেলানো নয়, একেবারে সোজাসুজি ভবলীলা শেষ গানাদোর।

কিন্তু অ্যান্টোনিওর সঙ্গীরা হঠাৎ থ হয়ে গেছে।

এ কি সেই ক্রীতদাস গানাদোর আনাড়ি ভীরু হাতের তলোয়ার! এ যেন স্বয়ং এ সিড় কম্পিয়াডর আবার নেমে এসেছেন পৃথিবীতে তাঁর তলোয়ার নিয়ে।

ইঁদুর নিয়ে বেড়ালের খেলা নয়, এ যেন অ্যান্টোনিওকে বাঁদর-নাচ নাচানো তলোয়ারের খেলায়।

প্রথম অ্যান্টোনিওর জামার আর-একটা আস্তিন ছিড়ল। তারপর তার আঁটসাঁট প্যান্টের খানিকটা, মাথার টুপিটার বাহারে পালকগুলো তারপর গেল কাটা, তারপর একদিকের চোমরানো গোঁফের খানিকটা।

সঙ্গীরা তখন হাসবে না কাঁদবে ভেবে পাচ্ছে না।

অ্যান্টোনিও ভিল্লাফানা ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক তলোয়ারের খোঁচা বাঁচাতে।

হঠাৎ একটি মোক্ষম মারে অ্যান্টোনিওর হাতের তলোয়ার সশব্দে পড়ে গেছে। মাটিতে। আর সেই সঙ্গে বজ্ৰহুঙ্কার শোনা গেছে—থামো।

চমকে সবাই ফিরে তাকিয়ে দেখেছে, কর্টেজ নিজে এসে সেখানে দাঁড়িয়েছেন তাঁর প্রহরীদের নিয়ে।

অগ্নিমূর্তি হয়ে তিনি গানাদোকে বলেছেন, ফেলো তোমার তলোয়ার। এত বড় তোমার স্পর্ধা, স্পেনের সৈনিকের ওপরে তুমি তলোয়ার তোলো!

ও স্পেনের সৈনিক নয়, তলোয়ার ফেলে দিয়ে শান্ত স্বরে বলেছে গানাদো, ও স্পেনের কলঙ্ক। আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল গোপনে। তা ধরে ফেলেছি বলে আমায় হত্যা করতে এসেছিল। তলোয়ার ধরে তাই ওকে একটু শিক্ষা দিচ্ছিলাম।

না, ডন কর্টেজ।অ্যান্টোনিও এবার হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে কর্টেজ-এর পায়ের কাছে—বিশ্বাস করুন আমার কথা, আপনার পেয়ারের ক্রীতদাস বলে ধরাকে ও সরা দেখে। আমাকে এই এদের সকলের সামনে যানয়-তাই বলে অপমান করেছে। আমি তাতে প্রতিবাদ করি বলে, আমাদের একজনের তলোয়ার খাপ থেকে তুলে নিয়ে আমার ওপর চড়াও হয়।

চড়াও হওয়াটা কর্টেজ নিজের চোখেই দেখেছেন। তার সাক্ষ্য-প্রমাণের দরকার নেই।

অ্যান্টোনিও খাস বনেদি ঘরের ছেলে না হলেও তারই নীচের ধাপের একজন। হিড্যালগো। তার ওপর সামান্য একজন ক্রীতদাসের তলোয়ার তোলা ক্ষমাহীন

অপরাধ।

রাগে আগুন হয়ে অ্যান্টোনিওর কথাই বিশ্বাস করে কর্টেজ গানাদোকে বেঁধে নিয়ে যেতে হুকুম দিয়েছেন। ক্রীতদাসের বিচার বলে কিছু নেই। এ অপরাধের জন্যে সেদিনই যে তার মৃত্যুদণ্ড হবে একথাও কর্টেজ জানিয়েছেন তৎক্ষণাৎ।

হিড্যালগো আর প্রহরীরা তাকে বেঁধে নিয়ে যাবার সময় গানাদো এ দণ্ডের কথা শুনে একটু শুধু হেসে বলেছে, প্রাণদণ্ডটা আজই না দিলে পারতেন, ডন কর্টেজ! তাতে আপনাদের একটু লোকসান হতে পারে।

আমাদের লোকসান হবে তোর মতো একটা গোরু কি ভেড়া মরে গেলে!- কর্টেজ একেবারে জ্বলে উঠেছেন এতবড় আস্পর্ধার কথায়।

গানাদো কিন্তু নির্বিকার। ধীর স্থির গলায় বলেছে, হ্যাঁ, সে ক্ষতি আর হয়তো সামলাতে পারবেন না। বিশ্বাসঘাতক ভিল্লাফানার শয়তানি আজ না হোক, একদিন নিশ্চয় টের পাবেন, কিন্তু ততদিন পর্যন্ত আপনার এ বাহিনী টিকবে কি? আমায় আজ মৃত্যুদণ্ড দিলে উদ্ধারের উপায় যা ভেবেছি, বলে যেতেও পারব না।

কর্টেজ-এর রাগ তখন সপ্তমে উঠেছে। সজোরে গানাদোর গালে একটা চড় মেরে তিনি প্রহরীদের বলেছেন, নিয়ে যা এই গোরুটাকে এখান থেকে। নইলে নিজের হাতটাই নোংরা করে বসব এইখানেই ওকে খুন করে!

৩.

হাত নোংরা না করুন, প্রায় হাতজোড়ই করতে হয়েছে কর্টেজকে সেইদিনই গানাদোর কাছে তার কয়েদঘরে গিয়ে।

কর্টেজ আর তার অ্যাসিয়াক্যাল-এর প্রাসাদে বন্দি সৈন্যদলের অবস্থা তখন সঙ্গিন। প্রাসাদে খাবার ফুরিয়ে এসেছে। খবর এসেছে যে, দ্বীপনগর টেনটিন থেকে বাইরের স্থলভূমিতে যাবার একটিমাত্র সেতুবন্ধ পথ অ্যাজটেকরা ভেঙে নষ্ট করে দিচ্ছে। প্রাসাদকারাগার থেকে বেরিয়ে অন্তত লড়াই করে সে সেতুবন্ধের পথে যাবার একটা উপায় না করলেই নয়।

শুধু সেই জন্যেই কর্টেজ অবশ্য গানাদোর কাছে যাননি। একদিন যে তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছে, যার কাছে অনেক সুপরামর্শ পেয়ে বড় বড় বিপদ থেকে তিনি উদ্ধার পেয়েছেন, ক্রীতদাস হলেও তার প্রতি কৃতজ্ঞতাটা মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে কর্টেজ পারেননি। কিছুটা অনুশোচনাতেও কর্টেজ তাঁর মেক্সিকো অভিযানের দোভাষী ও নিত্যসঙ্গিনী মালিঞ্চে ওরফে মারিনাকে নিয়ে গেছেন গানাদোর কাছে।

কর্টেজ নিজে প্রথমে কিছু বলতে পারেননি। মালিঞ্চেই তাঁর হয়ে বলেছে, আমার কথা বিশ্বাস করো, গানাদো। হার্নারেমন্ডো তোমার এ পরিণামে সত্যি মর্মাহত। কিন্তু ক্রীতদাস হয়ে মনিবের জাতের কারও বিরুদ্ধে হাত তোলার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রদ করবার ক্ষমতা তাঁরও নেই। শুধু স্পেনের জন্যে মস্ত বড় কিছু যদি তুমি করতে পারো, তাহলেই কর্টেজ শুধু প্রাণদণ্ড মুকুব নয়, দাসত্ব থেকেও তোমায় মুক্তি দিতে পারেন সম্রাটের প্রতিনিধি হিসাবে।

হ্যাঁ, বলো গানাদো, কর্টেজ এবার ব্যাকুলভাবেই বলেছেন, আমাদের এ সংকট থেকে বাঁচাবার কোনও উপায় যদি তোমার মাথায় এসে থাকে, এখুনি বলো। তা সফল হলে শুধু নিজেদের নয়, তোমাকে বাঁচাতে পেরেই আমি বেশি খুশি হব। বলো কী ভেবেছ?

ভেবেছি, বলে গানাদো এবার যা বলেছে কর্টেজ বা মালিঞ্চে কেউই তা বুঝতে পারেনি।

এ আবার কী আওড়াচ্ছ? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছে মালিঞ্চে, তুকতাকের মন্ত্র নাকি?

না, একটু হেসে বলেছে গানাদো, ডন কর্টেজকে আমি ছেলেবেলায় শেখা একটা কথা বললাম। বললাম তোমায় রথ দেখাব বলেই ভেবেছি, রথও দেখবে কলাও বেচবে।

সত্যি রথই দেখিয়েছে গানাদো। রথের মতো কাঠের মোটা তক্তায় তৈরি দোতলা সাঁজোয়া গাড়ি। সে ঢাকা সাঁজোয়া গাড়ির দুই তলাতেই বন্দুক নিয়ে থাকবে সৈনিকেরা। নিজেরা কাঠের দেওয়ালের আড়ালে তীরবল্লম আর ইট-পাটকেলের ঘা বাঁচিয়ে নিরাপদে বন্দুক ছুঁড়তে পারবে শত্রুর ওপর। এই কাঠের সাঁজোয়া গাড়ির নামই হল মান্টা।

সেই মান্টা না উদ্ভাবিত হলে কর্টেজ আর তার মুষ্টিমেয় বাহিনী সেবার দ্বীপনগর টেনচুটিটুলান থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পারত না। নতুন আবিষ্কৃত আমেরিকা মহাদেশের ইতিহাসই হয়তো তাহলে পালটে যেত।

কর্টেজ নিজের কথা রেখেছিলেন। গানাদোকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে দামি দামি বহু উপহার সমেত সম্রাটের সওগাত বয়ে নিয়ে যাবার জাহাজেই স্পেনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

পাঠাবার আগে দাসত্ব থেকে মুক্তিপত্র লিখে দেবার সময় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এখন তুমি মুক্ত স্বাধীন মানুষ, গানাদো। বলো কী নামে তোমায় মুক্তিপত্র দেব? কী নেবে তুমি পদবি?

নাম আমার নিজের দেশের ছেলেবেলায় দেওয়া ঘনরামই লিখুন, বলেছিলেন গানাদো, আর আমার বংশ যদি ভবিষ্যতে থাকে তাহলে এ ইতিহাস চিরকাল স্মরণ করাবার জন্যে পদবি দিন দাস।

ঘনশ্যাম দাস থামতেই ঈষৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞাসা করলেন মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু, কিন্তু এ ইতিহাস আপনি পেলেন কোথায়? আপনার আদিপুরুষ সেই গানাদো, থুড়ি ঘনরাম বাংলায় পুঁথি লিখে গিয়েছিলেন নাকি?

হ্যাঁ, পুঁথিই তিনি লিখে গেছলেন।ঘনশ্যাম দাস একটু বাঁকা হাসির সঙ্গে বললেন, তবে সে পুঁথি দেখলেও আপনি পড়তে পারতেন না। নাম এক হলেও ধর্মমঙ্গল লিখে যিনি রাঢ়ের লোককে এক জায়গায় একটু বিদ্রূপ করে গেছেন, ইনি সে ঘনরাম নয়। বাংলায় নয়, দেশে ফেরবার আগে প্রাচীন ক্যাস্টিলিয়ান-এই তিনি তাঁর পুঁথি লিখে গেছলেন। ফ্যালানজিস্টরা স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় ধ্বংস করে না দিলে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে বিখ্যাত পণ্ডিত মুনোজ তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় যেখান থেকে ফ্রানসিসক্যান ফ্রায়ার বার্নাদিনো দে সাহাগুনের অমূল্য রচনা হিস্টোরিয়া ইউনিভার্সাল দে নুয়েভা এসপানা মানে নতুন স্পেনের বিশ্ব-ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন, স্পেনের উত্তরে টলোসা মঠের সেই প্রাচীন পাঠাগারেই এ পুঁথি পাওয়া যেত।

এত জায়গা থাকতে টলোসা মঠে কেন, আর ফ্যাল্যানজিস্টরা যত মন্দই হোক, হঠাৎ একটা নির্দোষ মঠের পাঠাগার ধ্বংস করবার কী দায় পড়েছিল তাদের, জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও শিবপদবাবু নিজেকে সংবরণ করলেন বুদ্ধিমানের মতো! রাত যথেষ্ট হয়েছে।

Pages: 1 2

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *