হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ —
এই হল তার বুলি ।
দিবস রজনী যেতেছে বহিয়া ,
কাঁদে সে দু হাত তুলি ।
হাসিছে আকাশ , বহিছে বাতাস ,
পাখিরা গাহিছে সুখে ।
সকালে রাখাল চলিয়াছে মাঠে ,
বিকালে ঘরের মুখে ।
বালক বালিকা ভাই বোনে মিলে
খেলিছে আঙিনা-কোণে ,
কোলের শিশুরে হেরিয়া জননী
হাসিছে আপন মনে ।
কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়
চলেছে যে যার কাজে —
কত জনরব কত কলরব
উঠিছে আকাশমাঝে ।
পথিকেরা এসে তাহারে শুধায় ,
‘ কে তুমি কাঁদিছ বসি । ‘
সে কেবল বলে নয়নের জলে ,
‘ হাতে পাই নাই শশী । ‘
সকালে বিকালে ঝরি পড়ে কোলে
অযাচিত ফুলদল ,
দখিন সমীর বুলায় ললাটে
দক্ষিণ করতল ।
প্রভাতের আলো আশিস-পরশ
করিছে তাহার দেহে ,
রজনী তাহারে বুকের আঁচলে
ঢাকিছে নীরব স্নেহে ।
কাছে আসি শিশু মাগিছে আদর
কণ্ঠ জড়ায়ে ধরি ,
পাশে আসি যুবা চাহিছে তাহারে
লইতে বন্ধু করি ।
এই পথে গৃহে কত আনাগোনা ,
কত ভালোবাসাবাসি ,
সংসারসুখ কাছে কাছে তার
কত আসে যায় ভাসি ,
মুখ ফিরাইয়া সে রহে বসিয়া ,
কহে সে নয়নজলে ,
‘ তোমাদের আমি চাহি না কারেও ,
শশী চাই করতলে । ‘
শশী যেথা ছিল সেথাই রহিল ,
সেও ব ‘ সে এক ঠাঁই ।
অবশেষে যবে জীবনের দিন
আর বেশি বাকি নাই ,
এমন সময়ে সহসা কী ভাবি
চাহিল সে মুখ ফিরে
দেখিল ধরণী শ্যামল মধুর
সুনীল সিন্ধুতীরে ।
সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া
কাটিতেছে পাকা ধান ,
ছোটো ছোটো তরী পাল তুলে যায় ,
মাঝি বসে গায় গান ।
দূরে মন্দিরে বাজিছে কাঁসর ,
বধূরা চলেছে ঘাটে ,
মেঠো পথ দিয়ে গৃহস্থ জন
আসিছে গ্রামের হাটে ।
নিশ্বাস ফেলি রহে আঁখি মেলি ,
কহে ম্রিয়মাণ মন ,
‘ শশী নাহি চাই যদি ফিরে পাই
আর বার এ জীবন । ‘
দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ
সুন্দর লোকালয়
প্রতি দিবসের হরষে বিষাদে
চির-কল্লোলময় ।
স্নেহসুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী
ফিরিছে গৃহের মাঝে ,
প্রতি দিবসেরে করিছে মধুর
প্রতি দিবসের কাজে ।
সকাল বিকাল দুটি ভাই আসে
ঘরের ছেলের মতো ,
রজনী সবারে কোলেতে লইছে
নয়ন করিয়া নত ।
ছোটো ছোটো ফুল , ছোটো ছোটো হাসি ,
ছোটো কথা , ছোটো সুখ ,
প্রতি নিমেষের ভালোবাসাগুলি ,
ছোটো ছোটো হাসিমুখ
আপনা-আপনি উঠিছে ফুটিয়া
মানবজীবন ঘিরি ,
বিজন শিখরে বসিয়া সে তাই
দেখিতেছে ফিরি ফিরি ।
দেখে বহুদূরে ছায়াপুরী-সম
অতীত জীবন-রেখা ,
অস্তরবির সোনার কিরণে
নূতন বরনে লেখা ।
যাহাদের পানে নয়ন তুলিয়া
চাহে নি কখনো ফিরে ,
নবীন আভায় দেখা দেয় তারা
স্মৃতিসাগরের তীরে ।
হতাশ হৃদয়ে কাঁদিয়া কাঁদিয়া
পুরবীরাগিণী বাজে ,
দু-বাহু বাড়ায়ে ফিরে যেতে চায়
ওই জীবনের মাঝে ।
দিনের আলোক মিলায়ে আসিল
তবু পিছে চেয়ে রহে —
যাহা পেয়েছিল তাই পেতে চায়
তার বেশি কিছু নহে ।
সোনার জীবন রহিল পড়িয়া
কোথা সে চলিল ভেসে ।
শশীর লাগিয়া কাঁদিতে গেল কি
রবিশশীহীন দেশে ।