Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অহল্যা ঘুম || Nihar Ranjan Gupta » Page 4

অহল্যা ঘুম || Nihar Ranjan Gupta

আর একটা প্রশ্নের জবাব চাই

আর একটা প্রশ্নের জবাব চাই।

কিসের জবাব?

চিৎকার শুনে আপনিই সবার আগে তিনতলায় যান। তাই তো?

এবং বোধ হয় নির্বাণীতোষের শয়নঘরের দরজা খোলা দেখে সোজাই গিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকেছিলেন?

হ্যাঁ।

সেটাই আমার কাছে যেন কেমন আশ্চর্য মনে হচ্ছে—

কেন?

দীপিকা দেবী ঘরে ঢুকেও ঘরের দরজা খুলে রেখে দিয়েছিলেন, সেটা একটু অস্বাভাবিক নয় কি!

এতক্ষণে যেন শিখেন্দুর কাছে কিরীটীর কথার তাৎপর্যটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেও বলে ওঠে, সত্যিই তো, ঠিকই তো আপনি বলেছেন কিরীটীবাবু, ঘরের দরজাটা তো খোলা থাকার কথা নয়—

অথচ আপনি খোলাই আছে-দেখেছিলেন?

হ্যাঁ।

যাক সে কথা, তারপর ঘরে ঢুকে আপনি কি দেখেছিলেন?

দীপিকা মেঝের ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

না।

কি বলছেন?

বলছি এই যে, দীপিকাদেবী ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিলেন না।

তবে কোথায় ছিল সে? কথাটা বলে কেমন যেন একটু বোকার মতই চেয়ে থাকে শিখেন্দু কিরীটীর মুখের দিকে।

বাথরুমের মধ্যে। সেখান থেকে তাঁর অচৈতন্য দেহটা আপনি বুকে করে তুলে এনে পরে ঘরের মেঝেতে শুইয়ে দিয়েছিলেন, তাই নয় কি?

কিন্তু–

আমি জানি শিখেন্দুবাবু, আমার অনুমান মিথ্যে নয়। আমি যা বললাম সেই রকমই ঘটেছিল।

শিখেন্দু নীরব।

তাহলে মনে হচ্ছে, অবিশ্যি এবারেও আমার অনুমানই দ্বিতীয় অনুমান, দীপিকাদেবী ঘরে ঢুকবার পর দরজা বন্ধ করে দেন ঘরের, কিন্তু নির্বাণীতোষকে ঘরের মধ্যে দেখতে পান না। খুঁজতে খুঁজতেই তখন গিয়ে বাথরুমে ঢোকেন, বাথরুমের আলোটা নেভানো ছিল সম্ভবত, আলোটা জ্বালবার পর তাঁর স্বামীর মৃতদেহটা তাঁর দৃষ্টিতে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে তিনি মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। আর তাই যদি হয় তো ঘরের দরজাটা খুলে দিয়েছিল কে?

কে? প্রতিধ্বনির মতই যেন শিখেন্দু কথাটার পুনরাবৃত্তি করল।

একজনের পক্ষেই সেটা খুলে দেওয়া সম্ভব ছিল—

কে? কার কথা বলছেন?

হত্যাকারী। শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে কিরীটী কথাটা যেন উচ্চারণ করল।

হত্যাকারী!

হ্যাঁ, অথচ তাকে আপনি দেখেননি

না।

তাহলে সে কোন্ পথে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল? এবং কখন? শুধু তাই নয় শিখেন্দুবাবু, ওই সঙ্গে আরও তিনটে প্রশ্ন আসছে

প্রশ্ন! আরও তিনটে?

তাই-ই। প্রথমত হত্যাকারী তখনও উপরেই ছিল, কিন্তু কেন? কেন সে হত্যা করার পরও চলে গেল না? দ্বিতীয়, হত্যাকারীকে সম্ভবত দীপিকাদেবী দেখেছেন, দেখতে পেয়েছিলেন; কথা হচ্ছে হত্যাকারী দীপিকাদেবীর পরিচিত কেউ, না কোন তৃতীয় অপরিচিত ব্যক্তি? এবং তৃতীয়ত, আকস্মিকভাবে স্বামীর মৃতদেহটা আবিষ্কার করা মাত্রই জিনি চিৎকার করে উঠে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, না হত্যাকারীকে চিনতে পেরেই, চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়েছিলেন?

শিখেন্দু যেন একেবারে বোবা। তার মুখে কোন কথাই নেই।

শুনুন শিখেন্দুবাবু, যতদূর আমি বুঝতে পারছি, অবিশ্যি কোন বিশেষ চিকিৎসকই দীপিকাদেবীকে পরীক্ষা করে বলতে পারবেন, বর্তমানে ঘটনার আকস্মিকতায় বা নিষ্ঠুরতায় যাই হোক, তাঁর সম্পূর্ণ স্মৃতি বিলুপ্ত হয়েছে। এবং হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে হলে সর্বাগ্রে ওঁর স্বাভাবিকতা, স্বাভাবিক চেতনা ফিরে আসা একান্ত দরকার এবং আমার মনে হয় সে ব্যাপারে আপনিই সবচাইতে বেশি সাহায্য করতে পারবেন।

আমি?

হ্যাঁ, আপনি।

কিন্তু কেমন করে?

আপনার ভালবাসা দিয়ে, যে ভালবাসা এতকাল ধরে এবং এখনও নিঃশব্দে ফন্তুর মত আপনার মনের মধ্যে বয়ে চলেছে।

না, না–সহসা যেন অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে শিখেন্দু, পারব না—আমি পারব না কিরীটীবাবু, ক্ষমা করুন, আপনি যা বলছেন সে আমার দ্বারা হবে না।

হবে। হতেই হবে। নির্বাণীতোষ আপনার বন্ধু, আর ফিরে আসবে না কোনদিনই, কিন্তু একবার দীপিকার কথা ভাবুন তো, এখন না হয় তিনি বেঁচেও মরে আছেন, কিন্তু যখন তাঁর মনের ঐ বর্তমান কুয়াশা কেটে যাবে, তখন তাঁর অবস্থাটা কি হবে! আপনার ভালবাসাই যে আজ তাঁর জীবনের একমাত্র আশা। বাঁচবার একটিমাত্র পথ। আপনার ভালবাসা—আপনার স্নেহ দিয়ে ওঁর ঐ অহল্যার ঘুম আপনাকেই ভাঙাতে হবে। যা হবার তা তো হয়েছেই, কিন্তু ওঁকে জানতে দিন, ও যেন জানতে পারে, পৃথিবীটা আজও ওঁর কাছে শুকিয়ে যায়নি। জীবনের সব কিছু নির্বাণীতোষের সঙ্গে সঙ্গেই নিঃশেষ হয়ে যায়নি। সমস্ত অর্থ মিথ্যে হয়ে যায় নি।

আপনি জানেন না কিরীটীবাবু, দীপু কি গভীরভাবে ভালবাসত নিবুকে। যে মুহূর্তে ও সজ্ঞানে উপলব্ধি করতে পারবে নিবু নেই, ওর কাছে বেঁচে থাকার প্রশ্নটাই মিথ্যে হয়ে যাবে।

কিরীটী শান্ত গলায় প্রত্যুত্তর দিল, না, শিখেন্দুবাবু, যাবে না। মানুষই মানুষকে চরম দুঃখ দেয় আর মানুষই চরম দুঃখকে বুক পেতে নেয়। আর তাই আজও জীবন এত দুঃখ এত বিপর্যয় ও এত আঘাতের পরও মিথ্যে হয়ে যায় নি। আজও মানুষ তাই বাঁচার চেষ্টা করে, পৃথিবীতে তারা বেঁচে আছে, শেষ হয়ে যায়নি। আপনার কাছে তাই আমার অনুরোধ, দীপিকার এতবড় দুর্দিনে আপনি ওঁর কাছ থেকে দূরে সরে থাকবেন না।

শিখেন্দুর দুই চোখের কোল বেয়ে তখন নিঃশব্দে দুটি ধারা তার গণ্ড ও চিবুককে প্লাবিত করে দিচ্ছে।

আমি এবারে উঠব শিখেন্দুবাবু, শিবতোষবাবুকে বলে দেবেন, এ নিষ্ঠুর হত্যারহস্যের মীমাংসা করবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আর আমার বাড়ির ঠিকানা তো আপনি জানেন, ফোন নম্বরটাও গাইড় থেকে দেখে নেবেন। আমি কিন্তু আপনার পথ চেয়েই থাকলাম।

কিরীটী উঠে ঘরের দরজা ঠেলে বের হয়ে গেল।

পারলারে আর প্রবেশ করল না। সোজা পোর্টিকোতে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে হীরা সিংকে বলল, নিজের কোঠী চল।

বীরেন মুখার্জী তখনও তাঁর জবানবন্দি নেওয়া শেষ করতে পারেন নি।

বাড়ির সকলেরই জবানবন্দি দেওয়া হয়ে গিয়েছিল, সে-সময় তিনি যতীশ সামন্তকে নিয়ে পড়েছিলেন।

কিরীটী ঘর ছেড়ে চলে যাবার পরও অনেকক্ষণ শিখেন্দু চেয়ারটার উপর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।

কিরীটী রায়ের কথাই সে ভাবছিল, কি করে মানুষটা জানতে পারল যে সে-ই বাথরুম থেকে অচৈতন্য দীপিকাকে বুকে করে ঘরের মধ্যে নিয়ে এসেছিল!

মুখে স্বীকার না করলেও কথাটা তো মিথ্যা নয়। সে-ই সর্বপ্রথমে তিনতলায় গিয়েছিল, ঘরের দরজাটা খোলা দেখে ভিতরে গিয়ে ঢোকে সোজা। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ থাকলে কি করত সে জানে না, তবে খোলা পেয়েও তার মনে ঐ মুহূর্তে কোন প্রশ্নই জাগেনি, কেন দরজাটা খোলা রয়েছে! ঘরে ঢুকে ঘরের মধ্যে কাউকে না দেখতে পেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ওর নজরে পড়ে বাথরুমের দরজাটা খোলা, ভিতরে আলো জ্বলছে।

কোন রকম চিন্তা বা ইতস্তত না করেই সে গিয়ে বাথরুমে ঢুকেছিল। ঢুকেই য়ে দৃশ্যটা তার চোখে পড়ে, নিবণীতোষের ছোরাবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহটার পাশেই দীপিকার দেহটা পড়ে আছে অচৈতন্য।

ঘটনার আকস্মিকতায় ও ভয়াবহতায় সে যেন হঠাৎ বিমূঢ় নিশ্চল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটু পরেই তার স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি ফিরে আসে, তখন সে প্রথমে নির্বাণীতোষকে পরীক্ষা করে, সে মৃত দেখে তার পর পরীক্ষা করে দীপিকাকে। সে জ্ঞান হারিয়েছে।

কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর সে ভেবে পায় না কি করবে। তারপর নীচু হয়ে গভীর মমতায় দীপিকার অচৈতন্য শিথিল দেহটা বুকের উপর তুলে নিয়ে শোবার ঘরে এসে ঢোকে। সেই সময়ই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পায়, তাড়াতাড়ি তখন সে দীপিকার অচৈতন্য দেহটা মেঝেতেই নামিয়ে দেয়, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শিবতোষবাবু এসে ঘরে প্রবেশ করেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার, বৌমা….

একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল শিখেন্দু প্রথমটায়, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, বুঝতে পারছি না কিছু কাকাবাবু, ঘরে ঢুকে দেখি দীপিকা পড়ে আছে।

কিন্তু কিরীটীবাবু সত্যটা অনুমান করলেন কি করে? আগের একটা কথা যা কিরীটীবাবু বলে গেলেন, নির্বাণীতোষের শয়নঘরের দরজাটা খোলা ছিল কেন? সত্যিই তো, কেন খোলা ছিল? স্বাভাবিকভাবে তো বন্ধ থাকারই কথা। তবে কি ক্লান্ত দীপিকা দরজাটা ঘরে ঢুকবার পর তাড়াতাড়িতে বা অন্যমনস্কতায় ভিতর থেকে লক্ করতে ভুলে গিয়েছিল! না, সেই সময়ই সন্দেহজনক কিছু তার চোখে পড়ায় বা শব্দ শোনায় সে দরজাটা লক্ করবার কথা ভাববারও সময় পায়নি!

কিন্তু এ সবই তো গেল যুক্তিতর্কের কথা। হত্যা রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে যুক্তিতর্কের কথা—স্বভাবতই যাকিরীটীবাবুর মত তীক্ষ্ণবুদ্ধি লোকের মনে উদয় হয়েছে, হওয়াটা স্বাভাবিক।

হত্যাকারী কে?

কে হত্যা করল নির্বাণীতোষকে? আর কেনই বা হত্যা করল? নির্বাণী চিরদিনই সাদাসিধে সরল প্রকৃতির মানুষ, কারও সঙ্গে কখনও মনোমালিন্য হয়নি, ঝগড়া বিবাদও করেনি। সবাই তাকে বরাবরই ভালবেসেছে। তবে তাকে এইভাবে হত্যা করল কেন?

সকাল হয়ে গিয়েছে, প্রায় সাড়ে ছটা বাজল।

অফিসঘর থেকে বেরুতেই যতীশ সামন্ত সামনে এসে দাঁড়াল, শিখেন্দুবাবু!

বলুন।

দারোগাবাবু আপনাকে একবার ডাকছেন।

কেন?

বোধ হয় আপনার জবানবন্দি নেবেন।

চলুন।

আপনি যান, কর্তাবাবু ডাকছেন, আমি একবার ওপরে যাব। সামন্ত বললে।

কাকাবাবুকে বলে দেবেন কিরীটীবাবু চলে গেছেন।

আচ্ছা।

শিখেন্দু এগিয়ে গিয়ে পারলারে প্রবেশ করল।

শিখেন্দুকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বীরেন মুখার্জী মুখ তুলে তাকালেন, আসুন শিখেন্দুবাবু, বসুন।

শিখেন্দু বসল।

বীরেন মুখার্জী প্রশ্ন করলেন, আপনি আর শিবতোষবাবুই মৃতদেহ প্রথমে আবিষ্কার করেন?

হ্যাঁ।

এঁদের মানে শিবতোষবাবুর ফ্যামিলির সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের পরিচয়,তাই না?

হ্যাঁ, আমি ওঁর বন্ধুর ছেলে।

আচ্ছা, আপনি তো নির্বাণীতোষবাবুর সহপাঠী ছিলেন, তাঁর কোন শত্রু ছিল বলে জানেন?

না।

কখনও কারও সঙ্গে মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাঁটি বা মারামারি হয়নি তাঁর?

না।

তবে যে কেন লোকটাকে অমন ক্রুয়েলি হত্যা করা হল বুঝতে পারছি না! কাউকে আপনার এ ব্যাপারে সন্দেহও হয় না?

না।

ব্যাপারটা দেখছি যেমন স্যাড তেমনি জটিল। তারপর একটু থেমে বললেন বীরেন মুখার্জী, মসেস মল্লিক তো কোন প্রশ্নের জবাবই দিলেন না আর দীপিকাদেবী তো মনে হচ্ছে প্রচণ্ড শোকে মেমারিই হারিয়েছেন! ঠিক আছে ওঁরা সুস্থ হয়ে উঠুন, তারপর এক সময় মাসা যাবে। বিশেষ করে দীপিকাদেবীকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। এখন তাহলে মামি উঠব।

একটা অনুরোধ আছে আপনার কাছে মিঃ মুখার্জী। শিখেন্দু বললে।

বলুন?

সংবাদপত্রে যেন ব্যাপারটা না ছাপা হয়। বুঝতেই পারছেন এত বড় একটা ফ্যামিলির প্রেসটিজ

না না—আমরা কিছু বলব না। কিন্তু পাড়াপড়শীরা তো আছে, সংবাদপত্রের নিউজরিপোর্টারদের কি আর কিছু জানতে বাকি থাকবে!

আর একটা কথা—

বলুন?

ডেড বডি কখন পেতে পারি?

বুঝতেই পারছেন তো, ব্যাপারটা মাডার কেস-তদন্ত না হলে তো পাবেন না দেহ। একটু পরেই এসে ডেড বডি নিয়ে যাবে। তবে চেষ্টা করব আজই যাতে পান। শিবতোষবাবুর সঙ্গে তো ডি.সি.-র পরিচয় আছে, তাঁকেই একবার বলতে বলুন না ওঁকে ফোনে। আচ্ছা চলি।

শিখেন্দুরও নিজেকে অতিশয় ক্লান্ত লাগছিল।

সারাটা রাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি, চোখ দুটো জ্বালা করছিল, ঘর থেকে বেরুতেই রাজেনের সঙ্গে দেখা হল।

রাজেন, আমি একবার মেসে যাচ্ছি, ঘণ্টা-দেড়েকের মধ্যেই ফিরব–কেউ খোঁজ করলে বোলো।

যে আজ্ঞে।

বড় রাস্তায় আসতেই একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে গেল শিখেন্দু। ট্যাক্সিতে উঠে বসে বললে, শিয়ালদার দিকে চলিয়ে সদারজী।

কলেজের কাছাকাছিই সারকুলার রোডের ওপরে একটা মেসেছাত্রজীবন কাটিয়েছে শিখেন্দু। কলেজ-হোস্টেলে কখনও সে থাকেনি। পাশ করার পরও ঐখানেই রয়ে গিয়েছে।

ওরা তিনজনই নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের ছাত্র।

নির্বাণীতোষ বরাবর বাড়িথেকেই পড়াশুনা করেছে। দীপিকাথেকেছেকলেজেরকম্পাউণ্ডের মধ্যে, লেডিজ হোস্টেলে।

দিন পনের হল তার বাবা বিয়ের ব্যাপারে সপরিবারে দিল্লী থেকে এসে বালিগঞ্জ অঞ্চলেই বাড়ি ভাড়া করে আছেন, ইদানীং দীপিকা সেখানেই ছিল।

হোস্টেলে পাশাপাশি দুটো ঘরে ওরা চারজন থাকে; ও আর সঞ্জীব একটা ঘরে, পাশের ঘরে নির্মল ও পরেশ।

ঘরে ঢুকে দেখে জানলাপথে রোদ এসে পড়েছে, সঞ্জীব তখনও শয্যায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। পাশবালিশটা জড়িয়ে।

সঞ্জীব—এই সঞ্জীব!

শিখেন্দুর ডাকে সঞ্জীব চোখ মেলে তাকাল, কে?

ওহ—ওহ—

বিরক্ত করিস না শিখেন্দু, একটু ঘুমোতে দে। সঞ্জীব আবার চোখ বুজলে।

এদিকে খবর শুনেছিস?

পরে শুনব, সঞ্জীব ঘুম-জড়ানো গলায় কথাটা বলে আবার ঘুমোবার চেষ্টা করে।

ওঠ–শোন্-নির্বাণী মারা গেছে, এই–

সঙ্গে সঙ্গে যেন লাফিয়ে উঠে বসল শয্যার উপরে সঞ্জীব, অ্যাঁ! কি বললি? কে মারা গেছে?

নির্বাণী মারা গেছে, নির্বাণীতোষ মল্লিক।

কি যা-তা জোক্ করছিস এই সকালবেলা! সঞ্জীব বললে।

জোক নয়, সত্যি—হি হ্যাজ বিন ব্লুটালি মাডারড, সঞ্জীব।

মার্ডারড! সঞ্জীব কথাটি বলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে যেন শিখেন্দুর মুখের দিকে।

হ্যাঁ।

সত্যি–সত্যি বলছিস শিখেন্দু? সঞ্জীব যেন কথাটা তখনও বিশ্বাসই করতে পারছে না।

শিখেন্দু তার খাটের ওপর বসে সঞ্জীবের মুখের দিকেই চেয়ে থাকে। সঞ্জীব চিরকালই পাতলা, বোগা। গায়ের রংটা যেমন টকটকে ফর্সা, মুখখানিও তেমনি সুন্দর, যেন একটা মেয়েলী ছাপ আছে মুখে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে একটা গেঞ্জি। চোখেমুখে প্রসাধনের চিহ্ন, ঠোঁটে লিপস্টিকের রক্তিমাভা।

কাল তুই বৌভাতের নিমন্ত্রণে যাসনি? শিখেন্দু জিজ্ঞাসা করল।

কখন যাব! থিয়েটারই তো শেষ হল রাত সাড়ে বারোটায়! বলেই তো ছিলাম, কাল আমাদের পাড়ার ক্লাবে থিয়েটার আছে। বহ্নিশিখা নাটকে আমাকে কল্যাণীর রোল করতে হয়েছে।

পাড়ার ক্লাব মানে পাইকপাড়ায় ওরা দীর্ঘদিন ধরে আছে, মানে ওর বাবা রাধিকা বসু মশাই। ঐ পাড়াতেই সঞ্জীবের জন্ম, পাড়ার ক্লাবের থিয়েটারে ও বরাবর ফিমেল রোল করে এসেছে। মানায়ও ওকে ফিমেল রোলে চমৎকার এবং অভিনয়ও করে খুব ভাল।

সঞ্জীব বলল, অত রাত্রে কেউ কোথাও নিমন্ত্রণ খেতে যায়! তাছাড়া ভীষণ টায়ার্ড লাগছিল, ফিরে এসে দেখ না মুখের মেকআপও ভাল করে তুলতে পারিনি, কোনমতে একটু মেকআপ তুলেই শুয়ে পড়েছি। কিন্তু এইমাত্র তুই যা বললি তা সত্যি!

হ্যাঁ, আমাকে এখুনি আবার স্নান করে বেরুতে হবে। দীপা একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে, বোধ হয় স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে।

হবেই তো, বেচারী! হাউ স্যাড, ফুলশয্যার রাত্রেই!

কি করে মেরেছে বেচারীকে জানিস সঞ্জীব!

কি করে?

একটা ছোরা একেবারে পিঠের বাঁ দিকে আমূল বসিয়ে দিয়েছে।

বলিস কি! কি করে মারল, বাড়িভর্তি লোক ছিল—কে মারল কেউ কিছু জানতেই পারল না!

শিখেন্দু সংক্ষেপে তখন সমস্ত ঘটনাটা বলে গেল।

সঞ্জীব যেন একেবারে হতবাক। বললে, সত্যি আমি যেন এখনও ভাবতেই পারছি না ব্যাপারটা শিখেন্দু।

কেবল তুই কেন, কেউই আমরা ভাবতে পারছি না! নির্মল কোথায়? নির্মলকে ডাক—

সঞ্জীব নির্মলকে নাম ধরে ডাকতেই সে পাশের ঘর থেকে এসে এদের ঘরে ঢুকল। গালে শেভিং ক্রিম লাগান, হাতে সেফটি রেজার, অর্ধেক কামাতে কামাতেই ওদের ডাকে ঘরে এসে ঢুকল, কি ব্যাপার? শিখেন্দু কখন ফিরলি?

নির্বাণীতোষ খুন হয়েছে কাল রাত্রে, জানিস? শিখেন্দু বললে আবার।

খুন হয়েছে—নির্বাণী? কি কি বলছিস তুই শিখেন্দু?

এবারে সঞ্জীবই ব্যাপারটা বললে নির্মলকে।

তুই কাল রাত্রে কখন নির্বাণীদের বাড়ি থেকে চলে এসেছিলি? শিখেই প্রশ্নটা করল।

আ—আমি তো—মানে আমি তো বোধ হয় দশটার পরই চলে এসেছি, তখন তো নির্বাণী প্যাণ্ডেলেই ছিল। নির্মল বলল।

হ্যাঁ, নির্বাণী আগাগোড়াই প্যাণ্ডেলে ছিল। রাত পৌনে এগারটা নাগাদ আমাকে বলল তার বড় মাথা ধরেছে। তাই আমি বললাম, আমাদের বন্ধু বান্ধবরা তো সবাই এসে গেছে, এক সঞ্জীব বাকি; সে এলে আমি খাইয়ে দেবখন, তুই যা, ওপরে চলে যা, শিখেন্দু বলল।

তারপর? সঞ্জীব শুধাল।

নির্বাণী ওপরে চলে যায়।

তারপর?

আর পৌনে বারোটা নাগাদ দীপা ওপরে গিয়েছিল, তারপরেই ব্যাপারটা জানা গেল! শিখেন্দু বলল।

ওঃ! নির্মল বলল।

তাহলে মনে হচ্ছে পৌনে এগারটা থেকে রাত পৌনে বারোটা, ঐ একঘন্টা সময়ের মধ্যেই কোন এক সময় নির্বাণীকে কেউ খুন করে গিয়েছে। সঞ্জীব বলল।

ইতিমধ্যে পরেশও এসে ঘরে ঢুকেছিল এবং সব শুনেছিল, ওরা তিনজন কেউ লক্ষ্য করেনি; হঠাৎ ঐ সময় পরেশ বলল, নির্মল তো অনেক রাত্রে ফিরেছিস, রাত বোধ হয়। তখন সাড়ে বারোটারও বেশী হবে, আমি পৌনে বারোটায় প্রায় শুয়েছি, কিন্তু ঘুমোই নি। দশটার পরই যদি তুই নির্বাণীদের বাড়ি থেকে চলে এসে থাকিস তো তোর ফিরতে এত দেরি হল কেন রে?

বাসে যা ভিড়! নির্মল বলল।

অত রাত্রে বাসে ভিড়! পরেশ কথাটা বলে নির্মলের মুখের দিকে তাকাল এবং বলল, দেখ বাবা, চালাকি করো না, অতক্ষণ কোথায় ছিলে বল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *