অসমাপ্ত
“হ্যালো ম্যাডাম, কংগ্রাচুলেশনস। পুরো অনুষ্ঠানে শুধু আপনারই জয় জয়কার।আপনাকে নিয়ে গুরুজীর অহংকার যথার্থ। আপনি গুরুজীর যোগ্য উত্তরসূরী…’
ফোনের ও প্রান্ত থেকে আসা কথাগুলো সংযুক্তার কানে যেন গরম শিশা ঢেলে দিচ্ছে।
গুরুজী,মানে পণ্ডিত মনোময় চক্রবর্তী।সংযুক্তার সঙ্গে ওঁর দেখা হয় জামশেদপুরের বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে । সেখানে সংযুক্তারও গান গাওয়ার কথা। সংযুক্তার গান শুনে মনোময় মুগ্ধ হয়ে যায়।ওর সুরেলা কন্ঠ ওঁকে আকৃষ্ট করে।বরাবরের অহংকারী দাপুটে মনোময় নিজে সংযুক্তার সঙ্গে আলাপ করতে এগিয়ে আসেন। উনি ওকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম দিতে আগ্রহী হন।
সংযুক্তা তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্তু বাড়িতে মাকে বলাতে মা প্রচন্ড আপত্তি করে ওর একা কলকাতায় যাওয়ায়।
‘মা আমিতো গুরুজীর বাড়িতেই থাকবো।তুমি রাজি হয়ে যাও মা।আমার জীবনে এমন সুযোগ আর কখনো আসবে কিনা জানি না। তুমিওতো বলো মা আমি গানটা যেন ভালো করে তালিম নিই।এই রকম সুযোগ স্বেচ্ছায় আমার হাতে এসেছে আর তুমি আমাকে যেতে বাঁধা দিচ্ছ।’ শেষপর্যন্ত মেয়ের জেদের কাছে সুপর্ণা হার স্বীকার করতে বাদ্ধ হয়। সেই থেকে সংযুক্তার কলকাতায় মনোময় চক্রবর্তীর বাড়িতে গান শেখা শুরু। কিন্তু সংযুক্তা জানতো না এখানেই লুকিয়ে আছে তার জীবনের চরম সত্যি।
সংযুক্তার মা ছাড়া তিন কুলে আর কেউ নেই। মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে মা বলে ‘আমিতো আছি।’ ‘আমিই তোর বাবা আমিই তোর মা।’ ওদিকে তালিমের কিছুদিনের মধ্যেই সংযুক্তা গুরুজীর শ্রেষ্ঠ ছাত্রী হয়ে উঠলো।ওর নিষ্ঠা ওর সুরেলা কন্ঠ সবাইকে ছাপিয়ে গেল, ও হয়ে উঠলো গুরুজীর নয়নের মণি। ধ্রুপদী সংগীতের আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য গুরুজী যখন সংযুক্তার নাম ঘোষণা করেন সংযুক্তার গুরুজীর প্রতি শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় মন সিক্ত হয়ে ওঠে। জামশেদপুর এসে মাকে সব কথা জানালে মা এই প্রথম ওকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদেফেলে। এমনিতে সুপর্ণা কোনোদিনই মেয়ের গুরুজীকে নিয়ে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করে নি।এমনকি মেয়ের সামনে মনোময় নামটাও কখনো উচ্চারণ করে নি, তাই সংযুক্তা ভাবতো মা হয়তো ওর কলকাতায় গিয়ে গান শেখায় খুবই অসন্তুষ্ট। তাই গুরুজীর কথা উঠলেই মা এড়িয়ে যায়।
সুপর্ণা একটা সময় একা একা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে মেয়েকে মানুষ করতে। কলকাতায় বাবার বাড়ি ছেড়ে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সুপর্ণা একা এই জামশেদপুরে চলে আসে।পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ওর সাথে ছিলো না। এই অজানা অচেনা জায়গায় এসে প্রথমে একটা বাড়িতে রান্নার কাজ নিয়ে সেই বাড়িতেই থাকতে শুরু করে। তারপর যখন ওর প্রসবের সময় এগিয়ে এলো ওই বাড়ির লোকজনেরাই এগিয়ে এসে ওকে সবরকম ভাবে সাহায্য করে। সংযুক্তার জন্ম হয়। একা মা ছোট্ট শিশুকে নিয়ে কি ভাবে মানুষ করবে এই চিন্তায় সুপর্ণা একদিন রান্নার বাড়ির বৌদিকে কথাটা বলেই ফেলল-
‘বৌদি আমি সংগীতে এম এ করেছি, এখানে কোনো স্কুলে গানের শিক্ষিকা নেওয়া হয় কি না তুমি জানো?’
‘তুমি গানে এম এ করেছো?আর আমাদের বাড়ি সামান্য রান্নার কাজ করছো! আমি আজই তোমার দাদার সঙ্গে কথা বলবো।কোনো স্কুলে যদি শিক্ষিকা নেয় তাহলে উনি তোমার কথা বলবেন। উনিতো এখানকার বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের সভাপতি, ওঁর কাছে সব খবর থাকে।’
হ্যাঁ ওই বাড়ির দাদাই ওকে স্কুলের চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছে। তারপর থেকে সুপর্ণা মেয়েকে নিয়ে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। আপন বলতে আছে ওই বাড়ির দাদা আর বৌদি। সত্যি, কখনো কখনো পর কতো আপন হয়ে যায়। আর যারা তার আপনজন, বাবা, মা তারা সুপর্ণাকে ওই অবস্থায় বাড়ি থেকে বের করে দিলো, কোনো রকম সম্পর্কই রাখলো না, কারণ সুপর্ণা ওর বাচ্চা নষ্ট করতে রাজি হয়নি বলে। আর ওই ঠগ মানুষটার কথা মনে পড়লেও সুপর্ণার সারা শরীর ঘেন্নায় কেঁপে ওঠে।
সংযুক্তার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। দেখে, মা একটা ছবি হাতে নিয়ে বসে আছে, আর বিড় বিড় করে বলছে-
‘মনোময় তুমি হেরে গেছ; তুমি ডাহা হেরে গেছ; একদিন যাকে মাঝপথে একা ফেলে চলে গিয়েছিলে। বদনামের ভয়ে যাকে পৃথিবীতে আনতে চাওনি, সে’ই আজ তোমার মুখ উজ্জ্বল করছে। যাকে নিয়ে তোমার এতো গর্ব তুমি জানোও না তার আসল পরিচয়। না, আমি কোনদিন তোমাকে জানতে দেব না ওর পরিচয়। পিতৃত্বের দাবী নিয়ে কোনো দিন তোমাকে ওর সামনে দাঁড়াতে দেব না।’
সংযুক্তা মার কথা শুনে হতবাক হয়ে যায়।অস্ফুটে বলে- গুরুজী! আমার বাবা!
অনুষ্ঠানের শেষে সকলের সাথে গুরুজীও সংযুক্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু সংযুক্তা গুরুজীকে সেই শ্রদ্ধার আসনে বসাতে পারছে কই। বার বার শুধু সেদিন মাঝরাতের মা’র কথাগুলো মনে পড়ছে। ও আচমকাই গুরুজীকে জিজ্ঞেস করে বসে –
‘গুরুজী আপনার সুপর্ণা ব্যানার্জীকে মনে আছে?’
‘কোন সুপর্ণা ব্যানার্জী?’
‘ কেন, একসময় আপনার প্রিয় ছাত্রী ছিল! চিনতে পারছেন না?
উনিতো আমার মা।’
‘তোমার মা? আর তোমার বাবা?’
‘নেই! কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, উনি একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি।’
অজানা ঝড়ের আশঙ্কায় সদা অহংকারী পণ্ডিত মনোময় চক্রবর্তীর উজ্জ্বল মুখটা মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল।