Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দুর্গা পণ্ডিত বেশ শেকড় গেড়ে বসে গেল সেদিন থেকে, মনে হল গঙ্গাচরণের। মনে মনে বিরক্ত হলেও গঙ্গাচরণ মুখে কিছু বলতে পারে না। দেখতে দেখতে তিন দিন দিব্যি কাটিয়ে দিলে। অনঙ্গ-বৌয়ের আশ্রিত জীব, কোথা থেকে এনে যে ওকে অনঙ্গ-বৌ খাওয়ায়, কেউ বলতে পারে না।

সেদিন দুর্গা পণ্ডিতকে বসে সামনের বেড়া বাঁধতে দেখে গঙ্গাচরণ বিরক্ত হয়ে বললে—ও কাজ করতে আপনাকে কে বলেচে?

দুর্গা পণ্ডিত থতমত খেয়ে বললে—বসে বসে থাকি, বেড়াটা বাঁধি ভাবলাম।

—না, ও রাখুন। ও আপনাকে করতে হবে না। হাবু বাঁধবে এখন।

—ও ছেলেমানুষ, ও কি পারবে?

—খুব ভালো পারে। আপনার হাতে এখুনি দায়ের কোপ লেগে যাবে। এখন ও রাখুন।

দুর্গা পণ্ডিত একটু কুণ্ঠিত হয়েই থাকে। সংসারের এটা-ওটা করবার চেষ্টা করে, তাতে গঙ্গাচরণ আরও চটে যায়। এর মতলবখানা কি, তাহলে এখানেই থেকে যেতে চায় নাকি? অনঙ্গ-বৌ দিব্যি ওকে চা খাওয়াচ্চে, খাবার যে না খাওয়াচ্চে এমন নয়। স্ত্রীকে কিছু বলতেও সাহস করে না গঙ্গাচরণ।

চালের অবস্থা ভীষণ। এর ওর মুখে শুধু শোনা যাচ্চে চাল কোথাও নেই। একদিন সাধু কাপালী সন্ধান দিলে, কুলেখালিতে এক গোয়ালার বাড়ীতে কিছু চাল বিক্রি আছে। কথাটা গঙ্গাচরণের বিশ্বাস হল না। তবুও গরজ বড় বালাই, সাধু কাপালী ও সে দুজনে সাত ক্রোশ হেঁটে কুলেখালি গ্রামে উপস্থিত হল। এদিকে রেল-টেল নেই, বড় বাজার গঞ্জ নেই—চাল থাকতেও পারে বিশ্বাস হল গঙ্গাচরণের!

খুঁজে খুঁজে সেই গোয়ালা-বাড়ী বারও হল। ব্রাহ্মণ দেখে গৃহস্বামী ওকে যত্ন করে বসাল, তামাক সেজে নিয়ে এল।

গঙ্গাচরণ বললে—জায়গাটা তোমাদের বেশ।

আসল কথা কিছু বলতে সাহস করচে না, বুক ঢিপ ঢিপ করচে। কি বলে বসে কি জানি! চাল না পেলে উপোস শুরু হবে সবসুদ্ধু।

গৃহস্বামী বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ, তবে ম্যালেরিয়া খুব।

—সে সর্বত্র।

—আপনাদের ওখানেও আছে? নতুন গাঁয়ে বাড়ী আপনার, সে তো নদীর ধারে!

—তা আছে বটে, তবু ম্যালেরিয়াও আছে।

—এদিকে যাচ্ছিলেন কোথায়?

—তোমার এখানেই আসা।

—আমার এখানেই? সে আমার ভাগ্যি। ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলো পড়লো। তা কি মনে করে?

—ভয়ে বলবো না নির্ভয়ে বলবো?

—সে কি কথা বাবাঠাকুর! আমাদের কাছে ও কথা বলতে নেই। বলুন কি জন্যে আসা?

—তোমার বাড়ী চাল আছে সন্ধান পেয়ে এসেচি। দিতেই হবে কিছু। না খেয়ে মরচি একেবারে।

গৃহস্বামী কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বললে—আপনাকে বলেচে কে?

—আমাদের গ্রামেই শুনেচি।

—বাবাঠাকুর, চাল আমার আছে, মিথ্যে কথা বলবো না, আপনি দেবতা। কিন্তু সে চাল বিক্রি করবার নয়।

—কত আছে বলবে?

—তিন মণ। নুকিয়ে রেখেছিলাম, যেদিন গবর্ণমেণ্টের লোক আসে কার ঘরে কত চাল আছে দেখতে, সেদিন মাটির মধ্যে পুঁতে রেখেছিলাম বলে চালগুলো একটু গুমো গন্ধ হয়ে গিয়েচে। ধান নেই, শুধু ওই চাল কটা সম্বল। ও বিক্রি করলি—আমরা কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে ঘর করি, রাগ করবেন না, অভিসম্পাত দেবেন না বাবাঠাকুর। দিতি পারলি দিতাম। ওই কটা চাল ছাড়া আমার আর কোনো সম্বল নেই। ব্রাহ্মণের পায়ে হাত দিয়ে বলচি।

চাল পাওয়া গেল না। ফিরে আসবার পথে গঙ্গাচরণ চোখে অন্ধকার দেখলে। সাধু কাপালীও সঙ্গে ছিল ওর। ক্রোশ দুই এসে ওদের বড় খিদে ও জলতেষ্টা পেলো। সাধু বললে—পণ্ডিত মশাই, আর তো হাঁটা যায় না।

—তাই তো দেখছি, কাছে কি গাঁ?

—চলুন যাই, বামুনডাঙা-শেরপুর সামনে, তার পরে ঝিকরহাটি।

বামুনডাঙা-শেরপুর গ্রামে ঢুকেই ওরা একটা বড় আটচালা ঘর দেখতে পেলে। সাধু কাপালী বললে—চলুন এখানে। ওরা একটু জল তো দেবে?

গৃহস্বামী জাতিতে সদগোপ, ওদের যত্ন করে বসালে; গাছ থেকে ডাব পেড়ে খেতে দিলে। তারপর একটা বাটিতে খানিকটা আখের গুড় নিয়ে এল, জল নিয়ে এল। বললে—এবেলা এখানে দুটো রসুই করে খেয়ে যেতে হবে।

গঙ্গাচরণ আশ্চর্য হয়ে বললে—রসুই?

—হাঁ বাবাঠাকুর। তবে চাল নেই।

গঙ্গাচরণ আরও আশ্চর্য হয়ে বললে—তবে?

—বাবাঠাকুর চাল তো অনেকদিনই নেই গাঁয়ে। দিন দশেক থেকে কেউ ভাতের মুখ দেখে নি এখানে।

—তবে কি রসুই করবো?

—বাবাঠাকুর বলতে লজ্জা করে, কলাই-সেদ্ধ খেয়ে সব দিন গুজরান করচে। বড়-ছোট সবাই। আপনাকেও তাই দেবো। আর লাউ-ডাঁটা চচ্চড়ি। ভাতের বদলে আজকাল সবাই ওই খাচ্চি এ গাঁয়ে।

সাধু কাপালী তাতেই রাজী। সে বেচারী দুদিন ভাত খায় নি—ওর মুখের দিকে চেয়ে গঙ্গাচরণ বললে—বাপু যা আছে বের করে দাও।

সেদ্ধ কলাই নুন আর লঙ্কা, তার সঙ্গে বেগুনপোড়া। সাধু কাপালী খেয়ে উঠে বললে—উঃ, এতও অদেষ্টে ছিল পণ্ডিতমশাই!

গঙ্গাচরণ বললে—একটা হদিস পাওয়া গেল, এ জানতাম না সত্যি বলছি। কিন্তু এ খেয়ে পেটে সইবে কদিন তাই ভাবচি।

সন্ধ্যার দিকে শুধু হাতে গঙ্গাচরণ বাড়ী ফিরলো, কেবল সাধু কাপালী গোটাকতক বেগুন দিয়েচে। সাধু গরীব লোক নয়, তরি-তরকারি বেচে সে হাটে হাটে তিন-চার টাকা উপার্জন করে, কিন্তু টাকা দিয়েও চাল মিলচে কোথায়?

দুর্গা, অনঙ্গ-বৌ ও ছেলেদের কারো খাওয়া হয়নি, ওদের মুখ দেখে বুঝতে পারলে গঙ্গাচরণ। ও নিজে তবুও যা হোক দুটো কলাই-সেদ্ধও খেয়েছে। অনঙ্গ-বৌ স্বামীকে খালি হাতে ফিরতে দেখে চালের কথা কিছু জিজ্ঞেস করলে না। গঙ্গাচরণ হাত-পা ধুয়ে বসলে চা করে ও নিয়ে এল। দুর্গা নিজেও আজ চালের চেষ্টায় বেরিয়েছিল। কোথাও সন্ধান মেলে নি। অনঙ্গ-বৌ ওকে বললে—খাবে এখন? গঙ্গাচরণ কৌতূহলের সঙ্গে খাবার জায়গায় গিয়ে দেখলে থালার একপাশে শুধু তরকারী, ভাত নেই—খানিকটা বেশি করে মিষ্টি কুমড়ো সেদ্ধ, একটু আখের গুড়। স্ত্রী যেন অন্নপূর্ণা, এও তো কোথা থেকে জোটাতে হয়েছে ওকেই!

গঙ্গাচরণ কিছু ঠিক করতে পারে না ভেবে ভেবে। রোজ রোজ এই খেয়ে মানুষ কি বাঁচে! স্ত্রীকে বললে—আর এক খাবার দেখে এলুম বামুনডাঙা-শেরপুরে। সেখানে সবাই কলাই সেদ্ধ খাচ্চে—খাবে একদিন?

অনঙ্গ-বৌয়ের দিকে চেয়ে ওর মনে হল এই কদিনে ও রোগা হয়ে পড়েচে। বোধ হয় পেট পুরে খেতে পায় না নিজে, আর ওই বুড়োটা এসে এই সময় স্কন্ধে চেপে আছে। বুড়োকে খাওয়াতে গিয়ে ওর নিজের পেটে কিছু যাচ্চে না হয় তো। নাঃ, এমন বিপদেও পড়া গিয়েচে!

অনঙ্গ-বৌ কি বলতে যাচ্ছিল এমন সময় বাইরে থেকে কে বলে উঠলো—ও বামুন-দিদি—

অনঙ্গ-বৌ বাইরে এসে দেখলে ভাতছালার মতি-মুচিনী উঠোনে দাঁড়িয়ে। শরীর জীর্ণশীর্ণ, পরনে উলি-দুলি ছেঁড়া কাপড়, মাথার রুক্ষ চুল বাতাসে উড়চে।

ওকে দেখে মতি হাসতে গেল। কিন্তু শীর্ণ মুখের সব দাঁতগুলো বেরিয়ে হাসির মাধুর্য গেল নষ্ট হয়ে। সর্বপ্রথমে অনঙ্গ-বৌ প্রশ্ন করলে—কে মতি! খাস নি কিছু? আয়—বোস।

তারপর দু’মিনিটের মধ্যে দেখা গেল টেমি জ্বেলে উঠোনে একখানা কলার পাত পেতে মতিকে বসিয়ে দিয়ে অনঙ্গ-বৌ ওকে খেতে দিয়েচে, সেই মিঠে কুমড়ো সেদ্ধ আর লাউশাক চচ্চড়ি। মতি বললে—দুটো ভাত নেই বামুন-দিদি? অনঙ্গ-বৌ দুঃখিত হল।

মতি-মুচিনীর মুখে নিরাশার চিহ্ন। ভাত দিতে পারলে না ওর পাতে অনঙ্গ-বৌ। একদানা চাল নেই ঘরে কদিন। এই সব খেয়ে চলচে সবারই। তাও যে মেলে না। লাউশাক আর কুমড়ো কত কষ্টে যোগাড় করা।

অনঙ্গ-বৌ আদর করে বললে—আর কি নিবি মতি?

মতি হেসে বললে—মাছ দ্যাও, মুগির ডাল দ্যাও, বড়ি-চচ্চড়ি দ্যাও—

—দেবো, তুই খা খা—হ্যাঁরে, ভাত পাসনি কদিন রে?

মতি চোখ নীচু করে কলার পাতার দিকে চেয়ে বললে—পনেরো-ষোল দিন আজ সুদ্ধু কচু সেদ্ধ আর পুঁইশাক সেদ্ধ খেয়ে আছি। আর পারি নে বামুন-দিদি—তাই জোটাতে পাচ্ছি নে। ভাবলাম আর তো মরেই যাবো, মরবার আগে বামুনদিদির বাড়ীতে দুটো ভাত খেয়ে আসি।

অনঙ্গ-বৌ চোখের জল মুছে দৃপ্তকণ্ঠে বললে—মতি, তুই থাক আজ। ভাত তোকে আমি কাল খাওয়াবোই। যেমন করে পারি।

মতি-মুচিনীকে দুদিন অন্তর যাহোক দুটি ভাত দেয় অনঙ্গ-বৌ।

কোথা থেকে সে ভাত যোগাড় হয়, তা তাকে কেউ জিজ্ঞেস করে না। দুর্গা বুড়ো বাড়ী গিয়েচে কামদেবপুরে, কিন্তু গঙ্গাচরণের দৃঢ়বিশ্বাস, ও ঠিক আবার এসে জুটবে। এ বাজারে এমন নির্ভাবনায় আহার জুটবে কোথা থেকে?

সেদিন মতি দুপুরে এসে হাজির। ওর পরনে শতচ্ছিন্ন কাপড়, মাথায় তেল নেই। অনঙ্গ-বৌ ওকে বললে—মতি তেল দিচ্চি, একটা ডুব দিয়ে আয় দিকি!

—পেট জ্বলচে বামুন-দিদি। কাল ভাত জোটে নি, নেয়ে এলেই পেটে আগুন জ্বলে উঠবে।

—তুই যা, সে ভাবনা তোকে ভাবতে হবে না।

মতি-মুচিনী নির্বোধ মেয়ে নয়, সে চুপ করে থেকে বললে—না, তোমাদের এখানে আর খাবো না।

—কেন রে?

—তুমি পাবে কোথায় বামুন-দিদি যে রোজ রোজ দেবে?

—সে ভাবনা তোর নয়, আমার। তুই যা দিকি, নেয়ে আয়—

মতি-মুচিনী স্নান সেরে এল। একটা কলার পাতে আধপোয়াটাক কলাইসিদ্ধ ও কিসের চচ্চড়ি। অনঙ্গ-বৌ ধরা গলায় বললে—ওই খা মতি।

মতি অবাক হয়ে একদৃষ্টে ওর দিকে চেয়ে বললে—তোমাদেরও এই শুরু হয়েচে?

—তা হয়েচে।

—চাল পেলে না?

—পঞ্চান্ন টাকা মণ। দাম দিলে এখুনি মেলে হয়তো।

—কিন্তু এ তোমরা খেয়ো না বামুন-দিদি।

—কেন রে?

—এ কি তোমাদের পেটে সহ্যি হয়? আমাদের তাই সহ্যি হয় না।

—তুই খা খা—এত বক্তিমে দিতে হবে না তোকে।

বিকেলে মতি এসে বললে—বামুন-দিদি, এক জায়গায় মেটে আলু আর বুনো শোলা কচু হয়েচে জঙ্গলের মধ্যে। একটা শাবলটাবল দ্যাও, কেউ এখনো টের পায় নি, তুলে আনি।

অনঙ্গ-বৌ বললে—তুই একলা পারবি আলু তুলতে?

—কেন পারবো না? দ্যাও একখানা শাবল—

—খাস নি, দুর্বল শরীর, ভিরমি লেগে পড়ে যাবি! তুই আর আমি যাই—

এই সময় কাপালীদের ছোট-বৌ এসে জুটলো। বললে—কি পরামর্শ হচ্চে তোমাদের গা?

অতএব ছোট বৌকেও ওদের সঙ্গে নিতে হল।

গ্রামের উত্তর মাঠের নিচেই সবাইপুরের বাঁওড়। বাঁওড়ের ধারে খুব জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে একটা শিমুলগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ষাঁড়াগাছের দুর্ভেদ্য ঝোপের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়।

ওরা এগিয়ে গিয়েচে অনেকখানি, কিন্তু অনঙ্গ-বৌ আর কাপড় ছাড়াতে পারে না। কি বিশ্রী কাঁটা!

মতি-মুচিনী বিরক্ত হয়ে বললে—তখুনি বললাম তুমি এসো না। এখানে আসা কি তোমার কাজ? কক্ষনো কি এসব অভ্যেস আছে তোমার? সরো দেখি—

মতি এসে কাঁটা ছাড়িয়ে দিলে।

অনঙ্গ-বৌ রাগ করে বললে—ছুঁলি তো সন্দেবেলা?

মতি হেসে বললে—ছুঁলি তো সন্দেবেলা?

—যা যা, আর মজা দেখতে হবে না তোমার—ঢের হয়েচে।

আরও এক ঘণ্টা কেটে গেল। মস্ত বড় মেটে আলু লতার গোড়া খুঁড়ে সের পাঁচ-ছয় ওজনের বড় আলুটা তুলতে ওরা সবাই ঘেমে নেয়ে উঠেচে। মতি-মুচিনী মাটি মেখে ভূত হয়েচে, কাপালী-বৌ লতার জঙ্গল টেনে ছিঁড়তে ছিঁড়তে হাত লাল করে ফেলেচে, অনঙ্গ-বৌ একটু আনাড়ির মত আলুর একদিক ধরে বৃথা টানাটানি করচে গর্ত থেকে সেটাকে তুলবার প্রচেষ্টায়।

কাপালী-বৌ হেসে বললে—রাখো রাখো বামুন-দিদি, ও তোমার কাজ নয়। দাঁড়াও একপাশে—

বলে সে এসে দু’হাত দিয়ে টানতেই আলুটা গর্ত থেকে বেরিয়ে এল।

অনঙ্গ-বৌ অপ্রতিভের হাসি হেসে বললে—আমি পারলাম না—বাবাঃ—

—কোথা থেকে পারবে বামুন-দিদি—নরম রাঙা হাতের কাজ নয় ওসব।

—তুই যা—তোকে আর ব্যাখ্যান কত্তে হবে না মুখপুড়ী—

এমন সময় এক কাণ্ড ঘটলো। সেই ঘন ঝোপের দূর প্রান্তে একজন দাড়িওয়ালা জোয়ান মত চেহারার লোকের আকস্মিক আবির্ভাব হল। লোকটা সম্ভবত মেঠো পথ দিয়ে যেতে যেতে নদীতীরের ঝোপের মধ্যে নারীকণ্ঠের হাসি ও কথাবার্তা শুনতে পেয়ে এদিকে এসেচে। কিন্তু তার ধরনধারণ ও চলনের ভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি দেখে সর্বপ্রথমে অনঙ্গ-বৌয়ের মনে সন্দেহ জাগল। ভালো নয় ও লোকটার মতলব। ঝোপের মধ্যে তিনটি সম্পূর্ণ অপরিচিতা মেয়েকে দেখেও ও কেন এদিকেই এগিয়ে আসচে? যে ভদ্র হবে, সে এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করবে?

মতি এগিয়ে এসে বললে—তুমি কে গা? এদিকি মেয়েছেলে রয়েচে—এদিকি কেন আসচো?

কাপালী-বৌও জনান্তিকে বললে—ওমা, এ ক্যামনধারা নোক গা?

লোকটার নজর কিন্তু অনঙ্গ-বৌয়ের দিকে, অন্য কোনোদিকে তার দৃষ্টি নেই। সে হন হন করে সোজা চলে আসচে অনঙ্গ-বৌয়ের দিকে। অনঙ্গ-বৌ ওর কাণ্ড দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে মতির পেছনদিকে গিয়ে দাঁড়ালো। তার বুক ঢিপ ঢিপ করচে—ছুটে যে একদিকে পালাবে এ তেমন জায়গাও নয়। তখনও লোকটা থামে নি।

মতি চেঁচিয়ে উঠে বললে—কেমন নোক গা তুমি? ঠেলে আসচো যে ইদিকে বড়ো?

কাপালী-বৌ এসময়ে আরও পিছিয়ে। কারণ কাছাকাছি এসে লোকটা ওর দিকেও একবার কটমট করে চেয়েচে—মুখে কিন্তু লোকটা কোনো কথা বলে নি।

এদিকে অনঙ্গ-বৌয়ের মুশকিল হয়েচে, ছুটে পালাতে গিয়ে ওর চুল জড়িয়ে গিয়েচে শেয়াকুল কাঁটায় আর কুঁচ লতায়। বসন হয়ে গেছে বিস্রস্ত। ঘামে ও পরিশ্রমে মুখ হয়েছে রাঙা। লোকটা ওর দিকে যেন অগ্নিশিখার দিকে পতঙ্গের মত ছুটে আসচে—কাছে এসে যেমন খপ করে অন।-বৌয়ের হাত ধরতে যাবে, মতি তাকে প্রাণপণ শক্তিতে মারলে ঠ্যালা। সঙ্গে সঙ্গে অনঙ্গ-বৌ বলে উঠলো—খবরদার! কাপালী বৌ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

লোকটা ধাক্কা খেয়ে মেটে আলুর গর্তের মধ্যে পড়ে গেল।

ততক্ষণ মতি এসে অনঙ্গ-বৌকে কাঁটার বাঁধন থেকে মুক্ত করবার প্রাণপণে চেষ্টা করচে। তার তখন রণরঙ্গিণী মূর্তি। সে চেঁচিয়ে বললে—তোল শাবলটা কাপালী-বৌ—মিনসের মুণ্ডুটা দিই গুঁড়ো করে ভেঙে—এত বড় আস্পদ্দা!

অনঙ্গ-বৌ ষাঁড়াঝোপের নিবিড়তম অংশে ঢুকে গিয়েচে ততক্ষণ, ও ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। কারণ ঝোপ থেকে বেরুবার পথ নেই বাইরে, সে সুঁড়ি পথটাতে ওর আর মতির যুদ্ধ চলছিল। লোকটা গর্ত থেকে উঠবার চেষ্টা করচে, মতি কাপালী-বৌয়ের হাত থেকে শাবলটা নিচ্চে—এই পর্যন্ত অনঙ্গ-বৌ দেখতে পেল। পালাবার পথ বন্ধ। অনঙ্গ-বৌ যেখানে ঢুকেচে সেখানে মানুষ আসতে হলে তাকে হামাগুড়ি দিয়ে চার হাতে-পায়ে আসতে হবে। বিষম কুঁচ কাঁটার লতাজাল। মাথার ওপর শাবল হাতে মতি মুচিনী রণরঙ্গিণী মূর্তিতে দাঁড়িয়ে।

লোকটা নিজের অবস্থা বুঝল। মতির হাত থেকে শাবল কেড়ে নেওয়া অত সহজ হবে না।

এদিক-ওদিক চেয়ে সে সে-পথেই এক-পা দু-পা করে পিছু হঠতে লাগলো।

একেবারে ঝোপের প্রান্তসীমায় পৌঁছে লোকটা হঠাৎ পিছন ফিরে দিলে দৌড়। মতি-মুচিনী বললে—বেরিয়ে এসো গো বামুনদিদি—পোড়ারমুখো মিনসে ভয় পেয়ে ছুট দিয়েছে।

অনঙ্গ-বৌ তখনও কাঁপছে, তার ভয় তখনও যায় নি। কাপালী-বৌ ভয় পেলেও অনঙ্গ-বৌয়ের মত ভয় পায় নি বা তার অতটা ভয় পাওয়ার কারণও ঘটে নি। সে হেসে ফেললে।

অনঙ্গ-বৌ ধমক দিয়ে বললে—আবার হাসি আসচে কিসে পোড়ারমুখে? চুপ, ছুঁড়ির রঙ্গ দ্যাখো না—

মতি-মুচিনী বললে—ওই বোঝো।

সবাই মিলে এমন ভাবটা করলে যেন সব দোষটা ওরই।

কাপালী-বৌয়ের বয়স কম, সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে কৌতুকজনক মনে না হলে সে হাসে নি—হাসি চাপবার চেষ্টা করতে করতে বললে—ওঃ, মতি-দিদির সে শাবল তোলার ভঙ্গি দেখে আমার তো—হি-হি-হি—

অনঙ্গ-বৌ ধমক দিয়ে বললে—আবার হাসে!

—নাও, নাও, বামুন-দিদি আর রাগ কোরো না—

—হয়েছে, এখন চলো এখান থেকে বেরিয়ে—বেলা নেই।

এতক্ষণ ওদের যেন সেদিকে দৃষ্টি ছিল না—এখন হঠাৎ ঝোপ থেকে উঁকি মেরে সবাই চেয়ে দেখলে সবাইপুরের বাঁওড়ের ওপারে নোনাতলা গ্রামের বাঁশবনের আড়ালে কতক্ষণ পূর্বে সূর্য অস্ত গিয়েচে, ঘন ছায়া নেমে এসেচে বাঁওড়ের তীরে তীরে, বাঁওড়ের জলের কচুরিপানার দামের ওপর। আবার কি উৎপাত না জানি হয় সন্ধেবেলা! মাত্র তিনটি মেয়েছেলে তেপান্তর মাঠের মধ্যে।

অনঙ্গ-বৌ বললে—বাবাঃ—এখন বেরোও এখান থেকে।

মতি বললে—বা রে, মেটে আলুটা?

—কি হবে তাই?

—অত বড় মেটে আলুটা ফেলে যাবা? কাল থাকবে? এই মন্বন্তরের সময়?

কথাটা সকলেরই প্রাণে লাগলো। থাকবে না মেটে আলু। আজকাল গ্রামের লোক সব যেন কেমন হয়ে উঠেছে। সন্ধান পাবেই।

কাপালী-বৌ বললে—তাই করো বামুন-দিদি। আলুটা নেওয়া যাক—নোক সব হন্যে হয়ে উঠেচে না খেতি পেয়ে। বুনো কচু আলু কিছু বাদ দিচ্চে না, সব্বদা খুঁজে বেড়াচ্চে বনে জঙ্গলে। ওই আলুটা তুললে আমাদের তিন বেলা খাওয়া হবে।

আবার সবাই মিলে আলুর পিছনে লাগলো এবং যখন সকলে মিলে গর্ত হতে মেটে আলুটা বের করে উপরে তুলে ধুলো ঝাড়ছে—তখন সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকার মাঠ-বন ঘিরে ফেলেছে। মতি-মুচিনী নিজেই অত বড় ভারী আলুটা নিয়ে চললো, মধ্যে অনঙ্গ-বৌ, পেছনে শাবল হাতে কাপালী-বৌ। ওরা সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিকে সশঙ্ক দৃষ্টিতে চাইতে চাইতে গ্রামের মধ্যে এসে ঢুকলো।

গ্রামে ঢুকবার আগে অনঙ্গ-বৌ বললে—এই ছুঁড়ি, আজকের কথা ওই সব যেন কাউকে বলিস নে—

কাপালী-বৌ ঘাড় নেড়ে বললে—নাঃ—

—বড্ড পেট-আলগা তুই, পেটে কোনো কথা থাকে না—

—কেন, কবে আমি কাকে কি বলিচি?

—সে হিসেব এখন বসে বসে দেবার সময় নেই—মোটের ওপর একথা কারো কাছে—

—কোনো কথা? মেটে আলুর কথা?

—আবার ন্যাকামি হচ্চে? দ্যাখ ছুটকি, তুই কিন্তু দেখবি মজা আমার হাতে আজ। তুমি বুঝতে পারচো না কোনো কথা? নেকু!

কাপালী-বৌ আবার হি-হি করে হেসে ফেললে—কি কারণে কে জানে।

অনঙ্গ-বৌ বললে—এ পাগলকে নিয়ে আমি এখন কি করি? তুই বলবি ঠিক—না?

কাপালী-বৌ হাসি থামিয়ে আশ্বাস দেওয়ার সুরে বললে—পাগল বামুন-দিদি! তোমায় নিয়ে যখন কথা, তখন জেনো, কাগ-পক্ষিতেও একথা টের পাবে না। মাথার ওপর চন্দ্র-সূয্যি নেই?

বাড়ী এসে আলুর ভাগ নিয়ে চলে গেল যে যার ঘরে।

গঙ্গাচরণ বেরিয়েছিল চাল যোগাড়ের চেষ্টায়। কিন্তু ন’হাটার হাটে ঘোর দাঙ্গা আর লুটপাট হয়ে গিয়েচে চালের দোকানে। পুলিস এসে অনেক লোককে ধরে নিয়ে গিয়েচে। গঙ্গাচরণ বর্ণনা করে স্ত্রীর কাছে বসে সন্ধ্যার পরে।

অনঙ্গ-বৌ বললে—এখন উপায়?

—উপবাস।

অনঙ্গ-বৌ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবলে সে উপোস করতে ভয় খায় না, উপোস কি করে নি এর মধ্যে? কিন্তু এই যে উনি শুকনো মুখে এত দূর থেকে এসেছেন ফিরে, ওঁকে এখন সে কি খেতে দেবে এই মেটে আলু সিদ্ধ ছাড়া? বাধ্য হয়ে দিতে হল তাই—শুধু মেটে আলু সিদ্ধ, এক তাল মেটে আলু সিদ্ধ। সবাইকে তাই খেতে হল। দুর্গা পণ্ডিত সম্প্রতি বাড়ী চলে গিয়েচে। তবুও আলু সেদ্ধ খানিকটা বাঁচবে। হাবু খেতে বসে বললে—এ মুখে ভালো লাগে না মা—

অনঙ্গ বললে—এ ছেলের চাল দ্যাখ না? মুখে ভালো না লাগলে করচি কি?

মতি-মুচিনী খেতে এল না, কারণ সে ভাগের আলু নিয়ে গিয়েচে, আলাদা করে আলু সেদ্ধ বা আলু পোড়া খেয়েচে।

পরদিনও আলু সেদ্ধ চললো। এ কি তাচ্ছিল্যের দ্রব্য? কত বিপদের সম্মুখীন হয়ে তবে ওইটুকু আলু সংগ্রহ করে আনতে হয়েচে—ছেলের মুখে ভালো লাগে না তো সে কি করবে?

রাত্রিতে অনঙ্গ-বৌ বললে—হ্যাঁগা, চাল না পাও, কিছু কলাই আজ আনো। আলু ফুরিয়েছে।

—তাই বা কোথা থেকে আনি?

—পরামাণিকদের দোকানে নেই?

—সব সাবাড়। গুদোম সাফ।

—কি উপায়?

—কিছু নেই ঘরে? আলুটা?

—সে আর কতটুকু? কাল ফুরিয়েচে। তবুও তো এবার পণ্ডিত ঠাকুর নেই—মতি নেই—নিজেরাই খেয়েছি।

—কাল থেকে কি হবে তাই ভাবচি—

—চাল কোথাও নেই?

—আছে। পঁয়ষট্টি টাকা মণ, নেবে? পারবে নিতে?

অনঙ্গ-বৌ হেসে বললে—আমার হাতের একগাছা রুলি আছে, তাই বেচে চাল নিয়ে এসো।

তিন দিন কেটে গেল।

চাল তো দূরের কথা, কোনো খাবারই মেলে না। কলাইয়ের মণ ষোল টাকা, তাও পাওয়া দুষ্কর।

কাপালী-বৌ না খেয়ে রোগা হয়ে গিয়েচে, তার চেহারায় আগের জলুস আর নেই। সন্ধ্যাবেলা পা টিপে টিপে অনঙ্গ-বৌয়ের কাছে এসে বললে—কি করচো বামুন-দিদি?

—বসে আছি ভাই, রান্না-বান্না তো নেই।

—সে তো কারো নেই।

—কি খেয়েছিস? সত্যি বলবি?

কাপালী-বৌ ওর দিকে চেয়ে রইল অদ্ভুত দৃষ্টিতে। ওকে দেখে কষ্ট হয়।

একটু কাছে ঘেঁষে এসে বললে—আজ যাবো।

অনঙ্গ-বৌ বিস্ময়-সুরে বললে—কোথায় যাবি?

—ইটখোলায়।

—কোনো ইটখোলায়?

—দীঘির পাড়ের বড় ইটখোলায়—জানো না? আহা!

কাপালী-বৌ যেন ব্যঙ্গের সুরে কথা শেষ করলে!

অনঙ্গ-বৌ বললে—সেখানে কেন যাবি রে?

কাপালী-বৌ চুপ করে রইল নিচু চোখে। অনঙ্গ-বৌ বললে—ছুটকি!

—বলো গে তুমি বামুন-দিদি। তোমার মুখের দিকে চেয়ে আমি এতদিন জবাব দিই নি। আর পারি নে না খেয়ে—না খেয়েই যদি মলাম, তবে কিসের কি? আমি কোনো কথা শুনবো না—চলি বামুনদি, পাপ হয়ে নরকে পচে মরবো সেও ভালো—

অনঙ্গ কোনো কথা বলবার আগে কাপালী-বৌ ততক্ষণ হন হন করে চলেচে বেড়ার বাইরের পথে।

অনঙ্গ-বৌ পিছনে ডাক দিলে—ও বৌ শুনে যা, যাস নি,—শোন ও বৌ—

পুরোনো ইটখোলার এদিকে একটা বড় শিমুল গাছের তলায় অন্ধকারে কে একজন দাঁড়িয়ে। কাপালী-বৌ আনাড়ির মত অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পথ চলে সেখানে পৌঁছলো।

দাঁড়িয়ে আছে পোড়া-যদু—বাল্যে সর্বাঙ্গ পুড়ে গিয়েছিল, এখনও সে দাগ মেলায় নি—তাই ওর ওই নাম গ্রামের মধ্যে। পোড়া-যদুও বলে, আবার যদু-পোড়াও বলে। যদু ইটখোলায় কাঠ যোগান দেওয়ার ঠিকাদার। মোটা পয়সা রোজগার করে।

যদু-পোড়া ওকে দেখতে পেয়ে বললে—এই যে, ইদিকি!

কাপালী-বৌ ভেংচি কেটে বললে—ইদিকি! দেখতি পেইচি। এ অন্ধকারে আর ও ভূতের রূপ চোখ মেলে দেখতি চাইনে। আঁতকে ওঠবো।

যদু-পোড়া শ্লেষের সুরে বললে—তবু ভালো। তবুও যদি—

কাপালী-বৌ বাধা দিয়ে না থামিয়ে দিলে যদু-পোড়া একটা কি অশ্লীল কথার দিকে ঝুঁকেছিল।

থামিয়ে দিয়ে নীরস রুক্ষসুরে বলে—কই চাল?

—আছে রে আছে—

—না, দেখি আগে। কত কটি?

—আধ পালি। তাই কত কষ্টে যোগাড় করা। শুধু তোকে কথা দিইচি বলে।

—কে তোমার কাছে কথা পেড়েছিল আগে? আমার কাছে তুমি কখন কথা দিইছিলে? বাজে কথা কেন বলো? আমি দেরি করতে পারবো না—সন্দে হয়ে গিয়েচে—দেখি চাল আগে—তোমাকে আমার বিশ্বাস নেই—

যদু-পোড়া নিজের সততার প্রতি এ রূঢ় মন্তব্যে হঠাৎ বড় অবাক হয়ে উঠে কি একটা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কাপালী-বৌ আবার ধমক দিয়ে বলে উঠলো—আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু। সারারাত এ শিমুলতলায় তোমার মত শ্মশানের পোড়া কাঠের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতি হবে নাকি? চললাম আমি—

যদু-পোড়া ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে বললে—শোন শোন—যাস নে—বাবাঃ, এ দেখচি ঘোড়ায় জিন দিয়ে—আচ্ছা আচ্ছা—এই দ্যাখ চাল—এই ধামাতে—এই যে—বাপ রে, কি তেজ!

কাপালী-বৌ সদর্পে বললে—চুপ!

—আচ্ছা আচ্ছা, কিছু বলচি নে—তাই বলচি যে—

কাপালী-বৌ আধঘণ্টা পরে ইটখোলা থেকে বেরুলো, আঁচলে আধ পালি চাল! পেছনে পেছনে আসছে যদু-পোড়া। অন্ধকার পথের দু’ধারে আশসেওড়া বনে জোনাকি জ্বলচে।

কাপালী-বৌ তিরস্কারের সুরে বললে—পেছনে পেছনে কোনো যমের বাড়ী আসচো?

—তোকে একটু এগিয়ে দি—

—ঢের হয়েচে। ফিরে যাও—

—অন্ধকারে যাবি কি করে?

—তোমার সে দরদে কাজ নেই—চলে যাও—

—গাঁয়ের লোক এ পথে আসবে না, ভয় নেই—

—সে ভয় করি নে আমি—আমাকে সবাই চেনে—তুমি যাও চলে—

তবুও যদু-পোড়া পিছু পিছু আসচে দেখে কাপালী-বৌ হঠাৎ দাঁড়িয়ে ঝাঁঝের সুরে বললে—যাও বলচি—কেন আসচো?

যদু-পোড়া আদরের সুরে বললে—তুমি অমন করচো কেন হ্যাঁগো! বলি আমি কি পর?

কাপালী-বৌ নীরস কণ্ঠে বললে—ওসব কথায় দরকার নেই। তোমাকে উপকার করতে কেউ বলচে না, যাও বলচি, নইলে এ চাল সব ওই খানায় ফেলে দেবো কিন্তু।

যদু-পোড়া এবার থমকে দাঁড়ালো। বললে—যাচ্চি, যাচ্চি—একটা কথা—

—কি কথা?

—চাল আর কিছু আমি যোগাড় করচি—পরশু সন্দেবেলা আসিস।

—যাও তুমি—

অনঙ্গ-বৌ রান্নাঘরের দাওয়ায় আঁচল পেতে শুয়ে আছে, গঙ্গাচরণ কোথায় বেরিয়েচে, এখনো ফেরে নি। আধ-অন্ধকারে কে একজন দাওয়ার ধারে খুঁটি ধরে এসে দাঁড়ালো, অনঙ্গ-বৌ চমকে বলে উঠলো—কে?

পরে ভালো করে চেয়ে দেখে বললে—আ মরণ! মুখে কথা নেই কেন?

কাপালী-বৌ মুখে আঁচল দিয়ে খিল খিল করে হাসচে।

অনঙ্গ-বৌ বললে—কি মনে করে?

—একটু নুন দেবা?

—দেবো। কোত্থেকে এলি?

—এলাম।

—বোস না—

—বোসবো না। খিদে পাই নি?

—খাবি কি?

কাপালী-বৌ আঁচল দেখিয়ে বললে—এই যে!

—কি ওতে?

—চাল—দেখতি পাচ্চ না? নুন দ্যাও দিনি। খাই গিয়ে—

—কোথায় পেলি চাল?

—বলবো কেন? তুমি দুটো রাখো বামুন-দিদি।

অনঙ্গ-বৌ গম্ভীর সুরে বললে—ছুটকি, তোর বড় বাড় হয়েচে। যত বড় মুখ না তত বড় কথা—

—পায়ে পড়ি বামুন-দিদি। নাও দুটো চাল তুমি—

—তোর মুখে আগুন দেবো—

—আচ্ছা বামুন-দিদি, আমরা নরকে পচে মরবো ঠিকই, আমাদের কথা বাদ দাও তুমি। তুমি সতীলক্ষ্মী, পায়ের ধুলো দিও—নরকে গিয়েও যাতে দুটো খেতি পাই—

অনঙ্গ-বৌয়ের চোখে জল এল। সে কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।

কাপালী-বৌ বললে—নেবা দুটো চাল?

—না, তুই যা—

—তবে মর গিয়ে। আমিই খাই গিয়ে। কই নুন দ্যাও—

নুন নিয়ে চলে গেল কাপালী-বৌ। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এসে বললে, ও বামুন-দিদি, আজ তুমি কি খেয়েচ?

—ভাত।

—ছাই! সত্যি বলো?

—যা খাই তোর কি? যা তুই—

কাপালী বৌ এগিয়ে এসে বললে—পায়ের ধুলো একটু দ্যাও—গঙ্গা নাওয়ার কাজ হয়ে যায়—

বলেই সে অনঙ্গ-বৌয়ের দুই পায়ের ধুলো দুই হাতে নিয়ে মাথায় দিলে। তারপর কি একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে গঙ্গাচরণ এসে পড়াতে সে ছুটে পালালো।

—গঙ্গাচরণ বললে—ও কে গেল গা?

—ছোট-বৌ কাপালীদের।

—কি বলছিল?

—দেখা করতে এসেছিল। চাল পেলে?

—এক জায়গায় সন্ধান পেয়েচি। ষাট টাকা মণ—ভাবচি কিছু বাসন বিক্রি করি।

—তাতে ষাট টাকা হবে?

—কুড়ি টাকা তো হবে। তেরো সের চাল কিনে আনি—আর না খেয়ে তো পারা যায় না, সত্যি বলচি—

—তার চেয়ে আমার সোনা-বাঁধানো শাঁখাটা বিক্রি করে এস। বাসন থাক গে—

—তোমার হাতের শাঁখা নেবো?

—না নিলে অনাহারে মরতে হবে। যা ভালো বোঝো তাই করো।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress