Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বিশ্বাস মশায়ের বাড়ী মিটিং বসেচে।

বর্তমান সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্যেই মিটিং, তবে কাপালী-পাড়ার লোক ছাড়া অন্য কোনো লোক এতে উপস্থিত নেই। ক্ষেত্র কাপালী বললে—এখন ধান আমাদের দেবেন কিনা বলুন বিশ্বেস মশায়!

বিশ্বাস মশায় অনেকক্ষণ থেকে সেই একই কথা বলচেন—ধান নেই, তার দেবো কি! আমার গোলা খুঁজে দ্যাখো!

অধর কাপালী বললে—আমাদের পাড়াটা আপনি কর্জ দিয়ে বেঁচিয়ে রাখুন। আসচে বারে আপনার ধার এক দানাও বাকি রাখবো না।

বিশ্বাস মশায়ের বাঁ-দিকে গঙ্গাচরণ অনেকক্ষণ থেকে বসে আছে। সে এসেছিল ধানচাল সম্বন্ধে একটা ব্যবস্থা করা যায় কিনা বিশ্বাস মশায়ের সাহায্যে সেই চেষ্টায়। এত বড় মিটিং-এর মধ্যে এসে পড়বে তা সে ভাবে নি। সে চুপ করে বসেই আছে।

হঠাৎ তার দিকে ফিরেই বিশ্বাস মশায় বললেন—পণ্ডিত মশাই, আপনি এই নিন গোলার চাবি। এদের গিয়ে খুলে দেখান ওতে কি আছে—

বিশ্বাস মশায় চাবিটা গঙ্গাচরণের সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই ক্ষেত্র কাপালী বলে উঠলো—গোলা দেখতি হবে না। আমরা জানি ও গোলাতে আপনার ধান নেই।

চটে উঠে বিশ্বাস মশায় বললেন—তবে কোথায় আছে?

—আপনি ধান লুকিয়ে রেখেছেন বাড়ীতে।

—তুমি দেখেচ?

—দেখতে হবে না, আমরা জানি।

কথা শেষ করে ক্ষেত্র কাপালী মিটিং ছেড়ে উঠে চলে গেল।

অধর কাপালী অনুনয়ের সুরে বললে—শুনুন বিশ্বেস মশায়, আপনি পাড়ার মা-বাপ। বিপদে যদি আপনি না বাঁচান, তবে ছেলেপিলে নিয়ে কোথায় দাঁড়াই বলুন দিকি? অমন করবেন না। ধানের ব্যবস্থা আজ করে দিতেই হবে আপনাকে।

বিশ্বাস মশায় দাঁত খিঁচিয়ে বললেন—অমনি বলে সবাই! তুমি তো আমার ঘাড়ে ফেলে দিয়ে দিব্যি নিশ্চিন্দি হলে—তারপর ঠ্যালা সামলায় কে শুনি? ধান আমার নেই।

—একটু দয়া করুন—এট্টু আমাদের দিকি চান। আজ দুদিন বাড়ীতে একটা চালের দানা কারো পেটে যাই নি, সত্যি বলচি।

—বেশ, তুমি আধ কাঠা চাল ঘর থেকে নিয়ে যাও না, তাতে কি? না হয় আমি এক মুঠো কম খাবো। সে কথা তো বললিই হয়, কি বলেন ঠাকুর মশাই?

গঙ্গাচরণ চুপ করে রইল, এ কথায় সায় দিলে পাড়ার লোকে তার ওপর চটে যাবে, সবাইকে নিয়ে বাস করতে হবে যখন, কাউকে সে চটাতে চায় না।

সভা বেশিক্ষণ চললো না। বিশ্বাস মশায়ের কাছে যারা দরবার করতে এসেছিল, সবাই বুঝলে এখানে ডাল গলানো শক্ত। যে যার বাড়ী চলে গেল।

গঙ্গাচরণ সুযোগ পেয়ে বললে—বিশ্বাস মশায়, আমি কি না খেয়ে মরবো?

—কেন?

—বাজারে চাল অমিল। আর দুদিন পরে উপোস শুরু হবে। কি করি পরামর্শ দিন।

—আমার বাড়ী থেকে দু’কাঠা চাল নিয়ে যাবেন।

—তা দিয়ে ক’দিন চলবে বলুন!

—কেন?

—আমার বাড়ীর পুষ্যি দু’তিনজন! ও দু’কাঠা চাল নিয়ে ক’দিন খাবো? আমার স্থায়ী একটা ব্যবস্থা না করলে এই বিপদের দিনে আমি কোথায় যাই? পাঠশালা চালাই কি খেয়ে?

—আমার ধানচাল থাকতো তো বলতে পারা যেত, কিন্তু আমার নেই। আজ দু’কাঠা চাল নিয়ে যান, দিচ্চি—

গঙ্গাচরণ চাল নিয়ে চলে গেল।

সে রাত্রে বিশ্বাস মশায় আহারাদির পর পুকুরপাড় থেকে গরু আনতে গিয়েছেন, কারণ সেখানেই তাঁর গোয়াল—এমন সময় দুজন লোককে গাছের আড়ালে দেখে বলে উঠলেন—ওখানে কে?

—তোর বাবা—

সঙ্গে সঙ্গে তারা এসে বিশ্বাস মশায়ের মাথায় সজোরে এক লাঠি বসিয়ে দিলে। এর পর ওরা তাঁকে পুকুরপাড়ের বাবলা গাছের সঙ্গে মোটা দড়া দিয়ে বেঁধে ফেললে। বিশ্বাস মশায়ের জ্ঞান রইল না বেশিক্ষণ মাথার যন্ত্রণায় ও রক্তপাতে।

জ্ঞান হয়ে প্রথমেই দেখলেন সূর্যের আলো জানলা দিয়ে এসে পড়েচে, তাঁর বিধবা বড় মেয়ে তাঁর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কাঁদচে।

বিশ্বাস মশায় বলে উঠলেন—ডাকাত! ডাকাত!

বড় মেয়ে সৌদামিনী বললে—ভয় কি বাবা? আমি—আমি যে—এই দ্যাখো।

বিশ্বাস মশায় ফ্যালফ্যাল চোখে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে চুপ করে রইলেন।

সৌদামিনী বললে—বাবা কেমন আছ?

বিশ্বাস মশায় একবার ডাইনে বাঁয়ে সতর্কতার সঙ্গে চেয়ে দেখে চুপি চুপি বললেন—সব নিয়ে গিয়েচে?

—কি বাবা?

—সেই সব!

—তুমি কিছু ভেবো না বাবা। সব ঠিক আছে।

—সেই যা আড়ায় তোলা আছে? বস্তা?

—কিছু নেয় নি।

—আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখা মা—

সৌদামিনী বাপের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললে—তুমি সেরে সেমলে ওঠো, আমি কি মিথ্যে বলচি তোমারে? আড়ার ওপর যে বস্তা রেখিলে তা কেউ নেয় নি।

—তক্তাপোশের তলায় যে বস্তা ছিল?

—সব ঠিক আছে। নেবে কে?

এই সময় গঙ্গাচরণ ঘরে ঢোকাতে ওদের কথা বন্ধ হয়ে গেল।

গঙ্গাচরণ পাশে বসে বললে—কেমন আছেন বিশ্বাস মশায়?

—আছি এক রকম।

গঙ্গাচরণ মুরুব্বীয়ানা ভাবে বললে—হাতটা দেখি—

পরে বিজ্ঞের মত মুখ করে বিশ্বাস মশায়ের নাড়ী পরীক্ষা করে বললে—হুঁ।

সৌদামিনী উদ্বিগ্ন সুরে বললে—কি রকম দেখলেন পণ্ডিত মশাই?

—ভালো। তবে কফের ধাত একটু প্রবল হয়েছে।

সৌদামিনী উদ্বিগ্ন সুরে প্রশ্ন করলে—তাতে কি হয়?

—হবে আর কি, তবে বয়েস হয়েছে কিনা, কফের আধিক্য—

—ভালো করে বলুন।

—মানে জিনিসটা ভালো না।

বিশ্বাস মশায় স্বয়ং এবার মিনতির সুরে বললেন—আমাকে এবারটা চাঙ্গা করে তুলুন পণ্ডিতমশাই। আপনি দশ সের চাল নিয়ে যাবেন।

—থাক থাক, তার জন্যে কি হয়েচে?

সৌদামিনী কিন্তু ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে উঠলো—না, আজই নিয়ে যাবেন’খন। ধামা আমি দেবো।

বিশ্বাস মশায় বললেন—এখন নয়। সন্দের পরে। কেউ টের না পায়।

গঙ্গাচরণ এ অঞ্চলে কবিরাজিও করে। কিন্তু কবিরাজি এখানে ভালো চলে না—কারণ এখানকার সবার ‘সারকুমারী মত’। সে এক অদ্ভুত চিকিৎসার প্রণালী। জ্বর যত বেশিই হোক, তাতে স্নানাহারের কোনো বাধা নেই। দু’চারজন সেরেও ওঠে, বেশির ভাগই মরে। তবু ও-মতের লোক কখনো ডাক্তার বা কবিরাজ দেখাবে না, মরে গেলেও না।

গঙ্গাচরণ কথাটা জানে, তাই বললে—আপনার সেই ‘সারকুমারী মতে’র ফকির আসবে নাকি?

—নাঃ, সেবার জলজ্যান্ত নাতিটাকে মেরে ফেললে—আমি ও-মতে আর নেই।

—ঠিক তো? দেখুন, তবে আমি চিকিচ্ছে করি মন দিয়ে।

সৌদামিনী বলে উঠলো—আপনি দেখুন ভালো করে। আমি ও-মতের আর কাউকে যেতে দেবো না বাড়ীতে। চাল নিয়ে যাবেন সন্দের পরে।

দিন দুই পরে বিশ্বাস মশায় একটু সুস্থ হয়ে উঠলেন। একদিন গঙ্গাচরণ গিয়ে দেখলে বিশ্বাস মশায় বিছানায় উঠে বসে তামাক খাচ্চেন। গঙ্গাচরণ শুনলে, এ গ্রাম থেকে বিশ্বাস মশায় উঠে যাচ্চেন। জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা হচ্চে। বাইরে আট-দশখানা গরুর গাড়ীর চাকার দাগ। রাত্রে এই গাড়ীগুলো যাতায়াত করেচে বলেই মনে হয়। গঙ্গাচরণ বুঝতে পারলে, বিশ্বাস মশায় মজুদ ধান চাল সব সরিয়ে দিয়েচেন রাতারাতি।

গঙ্গাচরণ বললে—কোথায় যাবেন চলে নিজের গাঁ ছেড়ে?

বিশ্বাস মশায় বললেন—আপাতোক যাচ্চি গঙ্গানন্দপুর, আমার শ্বশুরবাড়ী। এ গাঁয়ে আর থাকবো না। এ ডাকাতের দেশ। সামান্য দু’চার মণ ধান চাল কে না ঘরে রাখে বলুন তো পণ্ডিত মশায়! তার জন্যে মানুষ খুন? আজ ফসকে গিয়েচে, কাল যে খুন করবে না তার ঠিক কি? না, এ দেশের খুরে নমস্কার বাবা।

—আপনার জমিজমা পুকুর এ সবের কি ব্যবস্থা হবে?

—আমার ভাগ্নে দুর্গাপদ মাঝে মাঝে আসবে যাবে। সে দেখাশুনো করবে। আমি আর এমুখো হচ্চি নে কখনো। ঢের হয়েচে। ভালো কথা, একটা ভালো দিন দেখে দেবেন তো যাবার?

বুধবার সকালবেলা বিশ্বাস মশায় সত্যসত্যই জিনিসপত্র সমেত নতুন গাঁ কাপালী-পাড়ার বাস উঠিয়ে চলে গেলেন।

অনঙ্গ-বৌ শুনে বললে—এই বিপদের দিনে তবুও এই একটা ভরসা ছিল। কোথাও চাল না পাওয়া যায়, ওখানে তবু পাওয়া যেত। এবার গাঁয়ের খুব দুর্দশা হবে। একদানা ধানচাল কারো ঘরে রইল না আর। ভয়ে পড়েই লোকটা চলে গেল।

শ্রাবণ মাসের শেষ।

বেড়ায় বেড়ায় তিৎপল্লার ফুল ফুটেচে। কোঁচ বকের লম্বা সারি নদীর ওপর দিয়ে উড়ে যায় এপার থেকে ওপারের দিকে।

অনঙ্গ-বৌ নদীর ঘাটে জল তুলতে গিয়েচে। ভূষণ ঘোষের বৌ এক জায়গায় হাবড় কাদার ওপর ঝুঁকে পড়ে কি করচে। অনঙ্গ-বৌকে দেখে সে যেন একটু সঙ্কুচিত হয়ে গেল। যেন এ অবস্থায় কারো সঙ্গে না দেখা হওয়াই ভালো ছিল, ভাবটা এমন।

অনঙ্গ-বৌ কৌতূহলের সঙ্গে বললে—কি হচ্ছে গো গয়লা-দিদি?

ভূষণ ঘোষের বৌয়ের বয়স বেশী নয়, অনঙ্গ-বৌয়ের সমবয়সী কিংবা দু-এক বছরের বড় হতেও পারে। আঁচলে কি একটা ঢেকে সলজ্জভাবে বললে—কিছু না ভাই—

—কিছু না, তবে ওখানে কি হচ্চে, তোমার মরণ?

—এমনি।

—তবুও?

—সুষনি শাক তুলচি—

বলেই হঠাৎ সলজ্জ হাসি হেসে আঁচল দেখিয়ে বললে—মিথ্যে কথা বলবো না বামুনের মেয়ের সামনে। এই দ্যাখো—

অনঙ্গ-বৌ বিস্ময়ের সঙ্গে বললে—ও কি হবে? হাঁস আছে বুঝি?

গয়লা-বৌয়ের আঁচলে একরাশ কাদামাখা গেঁড়ি-গুগলি। সে বললে—হাঁস নয় ভাই, আমরাই খাবো।

—ও কি করে খায়?

—এমনি। শাঁস বের করে ঝাল-চচ্চড়ি হবে।

—সত্যি?

—অনেকে খায়, তুমি জানো না? আমরা শখ করে খাই ভাই।

—কি করে রাঁধে আমাকে বলে দিও তো?

—না ভাই, তুমি খেতে যাবে কি দুঃখে? তোমাকে বলে দেবো না।

সেদিনই একটু বেলা হলে কাপালীদের ছোট-বৌ এসে বললে—এক খুঁচি চাল ধার দিতি পারো ভাই? বড্ড লজ্জায় পড়িচি—

অনঙ্গ-বৌ বললে—কি ভাই?

—ভূষণ কাকার বৌ এসেছে দুটো চাল নিতি। দু’দিন ভাত পেটে যায় নি। দুটো গেঁড়ি-গুগলি তুলে এনেচে সেদ্দ করে খাবে। কিন্তু দুটো চাল নেই—আমার বাড়ী এসেচে—তা বলে, তুমি খাও ভাঁড়ে জল, আমি খাই ঘাটে—

—আমারও চাল নেই ভাই।

—দু’টো একটা হবে না?

—আছে, দেবার মত নেই। তোর কাছে নুকুবো না, সের চারেক চাল আছে, তা থেকে দেবো না। তিন বেলার খোরাকও নেই।

কাপালী-বৌ বসে পড়ে গালে হাত দিয়ে টেনে টেনে বললে—তাই তো, কি হবে উপায় দিদি? চাল তো কোথাও নেই, কি করি বল তো?

অনঙ্গ-বৌ বললে—ছিল বিশ্বাস মশায়, তার ঘরে যা হয় দুটো ধান চাল ছিল। সেও চলে গেল—

—আমরাও তো তাই বলি—

—তবে কোনো সাহসে চাল দেবো বের করে?

—তা তো সত্যি কথাই।

হঠাৎ অনঙ্গ-বৌ হেসে বললে—রাগ করলি ভাই ছোট-বৌ?

—না ভাই, এর মধ্যে রাগ কিসের?

—আঁচল পাত। চাল নিয়ে যা—

—তোমাদের?

—যা হয় হবে। তবু থাকতে দেবো না তা কি হয়? নিয়ে যা—

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress