চৌকিদার রতিলাল
বাংলোতে বেশ ভিড়। চৌকিদার রতিলাল খাকি পোশাক পরে সেজোগুঁজে ফিটফট হয়েছে, আর কয়েকজন ফরেস্টগার্ড ঘোরাঘুরি করছে। বাইরের বাগানে চেয়ার-টেবিল সাজানো, ফুলদানিতে ভর্তি ফুল! কি ব্যাপার? আজ এখানে উৎসব নাকি?
রান্নাঘরের পাশ থেকে চওড়া মুখে বিনীত হাস্যে রেঞ্জার সুখেন্দু পুরকায়স্থ বেরিয়ে এসে বললো, আজ কনজারভেটর আসবেন, খবর পাঠিয়েছেন। প্রায় সাড়ে তিন মাস বাদে স্যার এদিকে আসছেন, না, না, আপনাদের কোনো অসুবিধে হবে না।
–সেই জন্যই বাইরে ব্যবস্থা করেছি, আপনারা বরাদ্দা কিংবা ঘরে বসুন–উনি অবশ্য আজ রাত্রে এখানে থাকবেন কি না ঠিক নেই।
অরণ্যের অধিপতি আসছেন, তাই সাজসাজ রব। ওদের একটু আড়ষ্ট লাগতে লাগলো, ওরা যেন আজ এখানে অবান্তর, অপ্রয়োজনীয়। সবাই ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। ওদের দিকে বিশেষ কেউ চেয়ে দেখছে না। জয়া বললে, তা হলে আজ আমরা চলে যাই–
শেখর বললো, না, কেন—
অপর্ণার কব্জিতে স্টিকিং প্লাষ্টার লাগানো হয়ে গেছে, সে বললো, বাঃ, যাবো কেন, বেশ সুন্দর লাগছে জায়গাটা—আসুক না ওরা।
জয় তবু স্বস্তিবোধ করছে না। সম্ভ্রান্ত ঘরের বউ সে, একটা জিনিস তার সহ্য হয় না–সে যেখানে উপস্থিত থাকবে, সেখানকার চাকর-আর্দালিরা তার হুকুমের প্রতীক্ষায় না থেকে অন্যদের জন্য খাটবে—এরকম তার অভ্যোস নেই। রতিলালকে দুবার ডেকেও পাওয়া যায় নি। তার ওপর সে যখন শুনলো–শেখরদের ঠিক মতন রিজার্ভেসান নেই এখানে, তাতে সে আরও ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বললো, জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এক্ষুনি চলুন না। আমাদের বাড়িতে! কত ঘর পড়ে রয়েছে–বাবা খুব খুশি হবেন।
সঞ্জয় তাকে বললো, না, বসুন না! সামান্য কে এক কনজারভেটর আসছে বলেই আমরা পলাঝো কেন?
রবির অনুপস্থিতি এখন স্পষ্ট বোধ করা যাচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে রবিই দাপটের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে পারতো। ওরা বারান্দায় বসে নিচুস্বরে গল্প করতে লাগলো।
একটু ঘুরে এসে সঞ্জয় বললো, জনিস শেখর, এখানে আশ্চর্য চলছে। কনজারভেটরদের গুষ্টির জন্য কি রান্না হয়েছে জানিস? রাক্ষসের খাবার! ডজনখানেক টেষ্ট, গুচ্ছের চিংড়ি মাছ ভাজা, ভেটকি মাছ, এক হাঁড়ি রসগোল্লা, ক্ষীর-এসব যোগাড় করলেই বাঁ কি করে? আর, কাদের পয়সায় জানিস?-বলতে বলতে সঞ্জয় উত্তেজিত হয়ে উঠলো, আমি রতিলালকে জিজ্ঞেস করুলুম, সব ঐ রতিলাল আর তিনজন ফরেস্ট-গার্ডের পয়সায়-সাতচল্লিশ টাকা করে মাত্র মাইনে পায়–কী ব্যাপার চলছে এসব এখানে?
অসীম বললো, এসব জঙ্গলের আলাদা নিয়ম-কানুন, তুই এর মধ্যে মাথা গলাচ্ছিস কেন?
–তার মানে? চালাকি নাকি? কনজারভেটরও তো নেহাত একজন সরকারি অফিসার–তার খাওয়ার জন্য এরা খরচ করবে কেন?
–হয়তো সাহেব ওদের পরে বকশিশ দিয়ে দেবে।
–কোনো সরকারি অফিসার বেয়ারাদের বকশিশ দেয় না। আমি জানি না? আচ্ছা, দেখছি ব্যাপারটা।
কিন্তু রতিলালকে আমরা ডাকছি, সে আসছে না কেন? আমরা তো তাকে রোজই বকশিশ দিচ্ছি!
–আমি বলে এসেছি, আসছে এক্ষুনি। ওর দোষ নেই। রতিলাল লোকটা সত্যি ভালো–চোর-টোর নয়, সংলোক। কিন্তু কি করবে? কনজারভেটর ওর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা-আমরা তো এসেছি। দুদিনের জন্য। সুতরাং বড় সাহেবকে খুশি না করলে–
এই সময় রতিলাল আস্তে আস্তে ওদের কাছে এসে দাঁড়ালো নিঃশব্দে। মেয়েদের দিকে একবার আড়াচোখে তাকালে। অসীম জিজ্ঞেস করলো, কী রতিলাল, আমাদের চা দেবে না? এতবার ডাকছি, শুনতে পাও নি?
সে কথার উত্তর না দিয়ে রািতলাল কাঁচুমাচুভাবে বললো, বড়াসাব ইধার আজ রাতমে ঠার জানে সে আপলোগ–
অসীম তীব্রভাবে বললে, সে আমরা বড় সাহেবের সঙ্গে বুঝবো। এই মেমসাহেবদের চেনো? ত্রিপাঠীজির কোঠি–দেরকার হলে আমরা সেখানে চলে যাবো।
অপৰ্ণা বললো, আমার কিন্তু এক্ষুনি চা চাই। যা তেষ্টা পেয়েছে—
পর পর দুটো গাড়ি এসে কম্পাউন্ডে ঢুকলো। গাড়ি থেকে নামলো দুজন সমর্থ পুরুষ, একজন স্থূলাঙ্গী মহিলা, দুটো বাচ্চা, একটি উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলে-চাপা প্যান্ট ও হাতে মাউথ অর্গান, একটি পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ে-আঁট শালওয়ার-কামিজ পরা-হাতে ট্রানজিস্টার, মুহূর্তে জায়গাটা মাউন্ট অর্গানের কর্কশ আওয়াজ আর হিন্দী গানের সুরে মুখরিত হলো। তা ছাপিয়ে শোনা গেল স্থূলাঙ্গী মহিলার কণ্ঠস্বর, লাস্ট টাইম ইধার একঠো ম্যাগনোলিয়া ট্র দেখ করা গিয়া, উও কিধার—?
শেখরয়া বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল, দলটি ওদের এখনো দেখতে পায় নি। সঞ্জয় বললো, ঐ পাইপ মুখে লোকটাই টপ বস, মুখ দেখলে চেনা যায়। বৌ—ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে এসেছে, সুতরাং এটা অফিশিয়াল ট্যুর নয়! ওর কোনো প্রায়রিটি নেই। গাড়িগুলোও নিজেদের না, সরকারি গাড়ি বলেই সন্দেহ হচ্ছে।
শেখর হাসতে হাসতে বললে, সঞ্জয় তুই কোনো গ্রামাঞ্চলে কখনো ঘুরিস নি বুঝতে পারছি। এইসব জায়গায় সরকারি কাজ কিভাবে হয় তোর কোনো আইডিয়া নেই!
সঞ্জয় বললে, তা হোকনা! সপরিবারে বেরিয়েছে—তার মানে অফ ডিউটি, এখন আমরা আর ওরা একই–চল, এগিয়ে গিয়ে কথা বলি।
জয়া বললো–দেখ রুণি, ভদ্রমহিলা কি রকম বিশ্ৰী ধরনের একগাদা গয়না পরেছেন। অপর্ণা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, এক পলক মাত্র সেই দলটির দিকে তাকিয়ে আর গ্রাহ্যই করে নি, এবার আলগাভাবে উত্তর দিলো, তুই আমনি শাড়ি-গয়না দেখতে বসলি।
চোঙা প্যান্ট পরিহিত ছোঁকরা মাউথ অর্গান রেখে ক্যামেরা খুলেছিল, ওদের দিকে চোখ পড়তেই থমকে তাকালো! চোখ সরু করলো! পাইপ-মুখে লোকটি কথা বলতে বলতে থেমে গেলেন। রেঞ্জার পুরকায়স্থ তার কাছে গিয়ে নিচু গলায় কি যেন বলতে লাগলেন। পাইপ-মুখে ব্যক্তিটি বললেন, অফ কোর্স, অফ কোর্স।
সঞ্জয় এগিয়ে গিয়ে বললো, লেট আস্ ইনট্রোডিউস আওয়ার সেলভ্স।
হাসিমুখে তিনি বললেন–একটু ভাঙা উচ্চারণ, কিন্তু নিখুঁত বাংলায় সব শুনেছি, ইনি ডি এফ ও মিঃ শাকসেন, আমি হচ্ছি। আর কে ভগস্ট্র। আপনারা বেড়াতে এসেছেন, খুব আনন্দের কথা–খুব আনন্দ, আমরা তা হলে অন্য জায়গায় যাচ্ছি, আপনার ফ্যামিলি নিয়ে এসেছেন?
শেখর বললো, না, আমরা ফ্যামিলি নিয়ে আসি নি, ওরা আমাদের বান্ধবী–এখানে ওদের বাড়ি আছে, দরকার হলে আমার–।
কনজারভেটর সাহেব আড়চোখে আরেকবার তাকালেন জয়া আর অপর্ণার দিক। ইজিচেয়ারে বসে জয়া অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে, কিন্তু অপর্ণা চেয়ে আছে এদিকেই। থামে হেলান দিয়ে, একটু পা উঁচু করা, উদ্ধত ভঙ্গি অপর্ণার, অপর পুরুষ তার দিকে তাকালে সে তৎক্ষণাৎ চোখ ফিরিয়ে নেয় না।
ডি. এফ. ও-র দিকে তাকিয়ে কনজারভেটর পরম উদার ভঙ্গিতে বললেন, তা হলে মিঃ শাকসেনা, এঁরা যখন এখানে রয়েছেন, আমরা তা হলে অন্য কোথাও–
মিঃ শাকসেনা চকিতে একবার দেখলেন রেঞ্জারের দিকে। ঈষৎ তীব্র দৃষ্টি। তিনি বিশেষ বিনয়ের ধার ধরেন না। জিজ্ঞেস করলেন, এদের কি এখানে রিজার্ভেসান ছিল? আমার দপ্তরে তো কোনো চিঠি যায় নি! এখানকার চৌকিদার কে?
সঞ্জয় ভাড়াতাড়ি বললো, না, আমাদের রিজার্ভেসান ছিল না। খালি দেখে এখানে এসেছি–আমাদের অবশ্য থাকবার অন্য জায়গাও আছে। এখানে।
কনজারভেটর বরাভয়ের ভঙ্গিতে হাত তুললেন, নো নো, ইউ এনজয় ইওরসেলড়ুস। আমরা যাচ্ছি। পুরকাইট, নেক্সট্ ব্যাংলোটা কত দূরে? টুয়েলভ মাইলস্? ফাইন! ম্যাটার অফ হ্যাফ অ্যান আওয়ার-লেটস্ মুভ।
শালওয়ার পর মেয়েটি সারা শরীর দুলিয়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, ড্যাডি, আর নট্ উই স্ট্রেয়িং হিয়ার!
–নো ডার্লিং, উই আর মুভিং ফর আ বেটার রেস্ট হাউস।
ওরা আবার গাড়িতে ওঠার বন্দোবস্ত করছে, ততক্ষণে সার বেঁধে খাবার আসতে শুরু করেছে। সুখেন্দু পুরকায়স্থ ছুটে গিয়ে কনজারভেটরকে বললেন, স্যার, থোড়া টি আউর স্ন্যাক্স্–।
মিঃ ভগৎ গাড়িতে পা দিয়েছিলেন, পেছন ফিরে বললেন, এসব কি! এত খাবারঃ হো-য়া–ই?
মিঃ ভগৎ অত্যন্ত রেগে গেছেন মনে হয়। বললেন, তার মানে? এত খাবার–কে আপনাদের করতে বলেছে? এসব অন্যায়–আমাদের নিজেদের সঙ্গে খাবার আছে। তারপর অসীমের দিকে ফিরে বললেন, দেখেছেন কাণ্ড! এরা কিভাবে—এখনো বৃটিশ আমলে আছে—সাহেবদের খুশি করার জন্য…দিস্ মেন্টালিট…।
—স্যার, সামান্য অন্তত কিছু মুখে দিন—
–রতিলাল সাহেবের স্ত্রীর কাছে গিয়ে অনুরোধ করলো খেতে। মোটা গিন্নী জানালেন, তাঁর এখন পেট ভর্তি, আচ্ছা, এত অনুরোধ করছে যখন, সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন, পরে খাবেন–সুসি ড্রার্লিং টিফিন কেরিয়ার ঠো নিকাল দেও।
কনজারভেটর এবং ডি এফ ও সেই মুহূর্তে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। দুজনেই এগিয়ে গিয়ে গাছ পরীক্ষা করতে লাগলেন। শাল গাছে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষজন বিস্মৃত হয়ে অরণ্য বিষয়ে আলোচনায় মগ্ন হয়ে পড়লেন।
চৌকিদার আর ফরেস্ট-গার্ডরা লাইন বেঁধে খাবারের প্লেট নিয়ে আসতে লাগলো। একটা নয়, তিনটে টিফিন কেরিয়ার ও ইট বক্স বেরুলো গাড়ি থেকে-আলাদা আলাদাভাবে খাবারগুলো ভর্তি হতে লাগলো তাতে; মোটা গিন্নী সম্রাজ্ঞীর ভঙ্গিতে কোমরে হাত দিয়ে সব পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। শালওয়ার পরা মেয়েটি তাঁর কানে কানে কিছু বলতেই, তিনি অবজ্ঞার ভঙ্গিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন অপর্ণাকে। একটু বাদে কনজারভেটর হঠাৎ আবার বাস্তবজ্ঞান ফিরে পেয়ে বললেন, ওয়েল, লেটস্ গো!
গাড়ি ছাড়বার আগে হাসিমুখে মিঃ ভগৎ ওদের দিকে চেয়ে বললেন, এনজয় ইয়োরসেলভ্স। উইস ইউ এ ভেরি গুড টাইম–। পুরাকাইট, কাল আমার সঙ্গে দেখা করবে–।
গাড়ি ছেড়ে যেতেই সুখেদু পুরকায়স্থ ধাপ করে চেয়ারে বসে পড়ে বললো, হয়ে গেলো! ব্যাড রিপোর্ট নিৰ্ঘাত। এখন কার চাকরি যায়—)।
অসীম বললো, চাকরি যাবে কেন? ভদ্রলোক তো বেশ ভালোই—।
–কী বলছেন স্যার, উনি কী রকম রেগে গেছেন বুঝতে পারলেন না!
–কোথায়, রাগ তো দেখলুম না!
–স্বয়ং কনজারভেটর বাংলোয় থাকার জায়গা পান নি—ওনাদের রাগ কি মুখে-চোখে ফোটে? দেখলেন না, আমায় সুখেন্দু না ডেকে পুরাকাইট ডেকেছেন! খাবার একটুও মুখে তুললেন না।
খাবার বানানোই আপনাদের অন্যায় হয়েছে।
–অন্যায়? বৃটিশ আমল আঠারো বছর আগে শেষ হয়ে গেছে, আমরা জানি না? আমরা ঘাস খাইঃ এই সাড়ে তিনমাস আগে উনি যখন এসেছিলেন, কি রকম ভুঁড়িভোজন করে গেছেন, তা জানেন? সেবার আবার বলেছিলেন, চিংড়ি মাছ যোগাড় করতে পারো না? কত কষ্টে এবার সকালের ট্রেনে লোক পাঠিয়ে জামসেদপুর থেকে মাছ আনিয়েছি—শুধু আপনাদের দেখে ভড়ং–।
রতিলাল বিপন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ স্পষ্ট ছলছল, সেদিকে তাকিয়ে সুখেন্দু পুরকায়স্থ বললেন, এই লোকটাই মরবে—।
সঞ্জয় তীব্র কণ্ঠে জানালো, মোটেই না, আপনি বেশি ভয় পাচ্ছেন, আমি ওর চাকরির দায়িত্ব নিলুম।
অসীম অপূৰ্ণার দিকে ফিরে বললো, সঞ্জয়টা লেবার অফিসার তো, এখন ওর মধ্যে সেইটা জেগে উঠেছে। বেড়াতে এসেও চাকরির স্বভাব যায় না ওর। কপালে ঐ যে কাটা দাগটা দেখছে, একবার শ্রমিকরা ওকে মেরেছিল।
সঞ্জয় চেঁচিয়ে উঠলো। আমরা এখানে এসে উঠেছি এবং আছি বলেই রতিলালের চাকরি নিয়ে টানাটনি পড়বে তা হতেই পারে না।
অসীম ব্যঙ্গ করে বললো, চাকরি ওর যাওয়াই উচিত। বৌয়ের অসুখ বলে লোকটা আমাদের জন্য কোনো কাজই করে নি। আজ বিকেলে এসে তিনবার চা চেয়েছি–তবু পাই নি। চাকরি ওর না গেলে আমিই ওর নামে কমপ্লেন করবো।
–অসীম, তুই ঠিক ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না।
–খুব পারছি। বাংলোয় চৌকিদারের কাজ—বাংলোতে যে এসে থাকবে–তারই দেখাশুনা করা। কোনো অফিসারের নিজস্ব আৰ্দলি তো নয়। বৌয়ের অসুখ! আজ সারাদিন এখানে বসে রান্না করলো কি করে?
রেঞ্জার সুখেন্দু পুরকায়স্থ উঠে এসে অসীমের কাঁধে হাত রেখে বিনীতভাবে বললো, অসীমবাবু, বৌয়ের অসুখ নিয়ে ওকে আর ভাবতে হবে না। সে আজ সন্ধ্যা পর্যন্তও বাঁচবে না বোধহয়।
অসীম থতমত খেয়ে বললো, কি বলছেন আপনি! তা-ও ও এসেছে এখানে?
–এসব জায়গায় চাকরির কি রকম দাম আপনি জানেন না। সকালে আমি নিজে গুর বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে গিয়েছিলুম। আমাদের হেলথ সেন্টারের ডাক্তার–তিনি বললেন, কয়েক ঘণ্টার বেশি আয়ু নেই। আমি দেখলুম, বউ যখন বাঁচবেই না তখন আর চাকরিটা হারায় কেন। ছেলেমেয়েগুলোকে খাওয়াতে হবে তো।
গাড়ি দুখানা বাংলোয় গোট পেরিয়ে ডান দিকে বেঁকেছে, এখনো তেমন স্পিড নেয় নি, কোনাকুনি ছুটলে হয়তো এখনো ধরা যায়। হঠাৎ সঞ্জয় সেইদিকে ছুটতে ছুটতে চেঁচিয়ে উঠলো, ওয়ান মিনিট, মিঃ ভগৎ একটু দাঁড়ান, ওয়ান মিনিট, প্লিজ–
কাল রাত্রে যে জঙ্গলের মধ্যে রবি-অসীমরা উলঙ্গ হয়ে ছোটাছুটি করেছিল–সঞ্জয় সেখান দিয়েই ছুটে গেল। গাড়ি দুটো থেমেও গেল–জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মিঃ ভগৎ বললেন, এনি ট্রাবল?
আপনাদের বিরক্ত করুলুম, ক্ষমা করবেন। একটা কথা, আমরা এ বাংলোয় আছি বলে আপনারা কি বিস্ত্ৰজ্ঞ হয়ে চলে যাচ্ছেন? তাহলে–।
–না, না, নাথিং অব দ্যাট সর্ট।
–দেখুন, এখানকার চৌকিদার এবং অন্যান্যদের ধারণা, আমরা আছি বলেই আপনার বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছেন এবং এজন্য পরে ওদের চাকরির ক্ষতি হবে–এরকম নাকি হয়।
–দেখুন। মিঃ, এইসব ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলার কোনো রকম উৎসাহ আমাদের নেই, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সঞ্জয় অত্যন্ত বিনীতভাবে বললো, আপনাদের দেরি করবার জন্য আমি সত্যই দুঃখিত। কিন্তু ওরা ভয় পেয়েছে, আপনি যদি একটু মুখের কথা বলে যান যে, ওদের কোনো ক্ষতি হবে না—
–হোয়াট ড়ু ইউ মিন! আমি আমার সাব-অরডিনেটদের কাছে এক্সপ্লেইন করতে যাবো? আপনার এই অনুরোধকে কেউ কেউ অডাসিটি বলতে পারে।
–না, না, ওদের কাছে বলতে হবে না, আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে ওদের কিছু–
–আমার অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের ব্যাপারে আপনাকে কেন প্রতিশ্রুতি দিতে যাবো। মাইন্ড ইওর ওউন বিজনেস।
–দিস ইজ অলসো মাই বিজনেস! আমরা এখানে এসেছি বলেই যদি একটা লোকের চাকরি যায় সেটা অত্যন্ত অন্যায়। তাতে আমাদের–।
–আপনাদের এখানে থাকতে দিয়ে আমরা চলে যাচ্ছি-এইটাই যথেষ্ট নয়।
–না, যথেষ্ট নয়। আপনার যদি কিছু আপত্তির থাকে আপনি আমাদের বলতে পারেন। পরে শুধু শুধু ঐ গরিবদের ওপর অ্যাকশন নেবেন না। আপনি জানেন না, ঐ চৌকিদারটার বউয়ের ভীষণ অসুখ, হয়তো এতক্ষণে মারা গেছে–তবু এসেছে আপনাদের জন্য।
–অ্যাবসার্ড!
–না, না, সত্যিই। আপনি বরং আরেকবার আসুন।–সব শুনবেন। আমরাও এইমাত্র জানতে পারলাম!
–আপনারা এখানে মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি করতে এসেছেন, আপনাদের তো অত কথা ভাববার দরকার নেই!
আপনি ভদ্র ভাষায় কথা বলুন। ঐ মেয়েরা এখানকার লোকাল লোক–বেড়াতে এসেছে–আপনি শুধু শুধু খারাপ ধারণা করবেন না।
আপনি রাস্তা ছাড়ুন, আমি আর দেরি করতে পারছি না।
–না, আপনি বলে যান। যদি কারুর চাকরি যায়, আমি সহজে ছাড়বো না।
—ইজ দিস চ্যাপ এ লুনাটিক অব সামথিং-? ড্রাইভার চালাও!
সঞ্জয় সত্যিই অনেকটা পাগলের মতন চিৎকার করতে লাগলো। তার কপালে কাটা দাগটা জ্বলজ্বল করছে—সে বলতে লাগলো, আপনাদের খেয়ালখুশিতে লোকের চাকরি যাবে? ভেবেছেন কি? আমি শেষ পর্যন্ত দেখে নেবো–আমারও ইনফ্লুয়েন্স কম নেই! চালাকি নয়, ভেবেছেন জঙ্গলে আছেন বলে যা ইচ্ছে করবেন? আইন আছে, দরকার হয় আমি ওদের হয়ে কেস লড়বো, আমি–।
সঞ্জয়ের মুখের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে গাড়ি দুটো বেরিয়ে গেল!