রামায়ণ : অযোধ্যাকাণ্ড – দশরথ রাজার মৃত্যু
দিবাকর কিরণ উত্তাপে উত্তাপিতা।
চলিতে কাতরা অতি জনক-দুহিতা।।
হিঙ্গুল-মণ্ডিতা তাঁর পায়ের অঙ্গুলী।
আতপে মিলায় যেন ননীর পুত্তলী।।
মুনির নগর দিয়া যান তিন জন।
দেখিতে আইল পথে মুনি-পত্নীগণ।।
জিজ্ঞাসা করিল সবে জানকীর প্রতি।
পদব্রজে কেন যাও তুমি রূপবতী।।
অনুভব করি তুমি রাজার নন্দিনী।
সত্য পরিচয় দেহ কে বট আপনি।।
দূর্ব্বাদলশ্যাম অগ্রে অতি মনোহর।
আজানুলম্বিত ভুজ রক্ত ওষ্ঠাধর।।
সুন্দর বদন দেখি, অতি মনোহর।
আজানুলম্বিত ভুজ রক্ত ওষ্ঠাধর।।
সুন্দর বদন দেখি, অতি মনোহর।
ধনুর্ব্বাণ করে উনি কে হন তোমার।।
নবীন কমল মুখ ভ্রূভঙ্গ রচিত।
পুলকে মণ্ডিত গণ্ড অল্প বিকশিত।।
লাজে অধোমুখী সীতা না বলেন আর।
ইঙ্গিতে বুঝান, স্বামী ইনি যে আমার।।
কমলিনী সীতা পথে যান ধীরে ধীরে।
সবে উপস্থিত হন যমুনার তীরে।।
তাহার গভীর জল পাতাল প্রমাণ।
রামের প্রভাবে হয়, হাঁটুর সমান।।
না জানিয়া ভেলা তাহে বান্ধেন লক্ষ্মণ।
হাঁটু জল পার হয়ে অক্লেশে গমন।।
মুনির চরণ রাম বন্দেন তখন।
রামেরে দেখিয়া মুনি হরষিত মন।।
বলিলেন, হে রাম আপনি নারায়ণ।
তপস্বীর বেশে কেন আইলেন বন।।
শ্রীরাম বলেন, মুনি পিতার আদেশে।
বিপিনে করিব বাস তপস্বীর বেশে।।
তিন জন তথায় রহিলেন অক্লেশে।
এদিকে সুমন্ত্র গিয়া উত্তরিল দেশে।।
ছয় দিনে উত্তরিল অযোধ্যানগরে।
যোড়হাতে দাণ্ডাইলে রাজার গোচরে।।
কহিতে লাগিল পাত্র নমস্কার করে।
রামে রাখি আইলাম শৃঙ্গবের পুরে।।
সেথা হৈতে আইলাম রাজা তিন দিনে।
রাম সীতা লক্ষ্মণ রহেন সেই স্থানে।।
দিবায় দিলেন রাম মধুর বচনে।
প্রণিপাত করিয়াছে তোমার চরণে।।
রামের যেমন শীল তেমনি বচন।
গর্জ্জন করিয়া কিছু বলিল লক্ষ্মণ।।
প্রচণ্ড কোদণ্ড ধরি গর্জ্জে যেন ফণী।
কিছু মাত্র না বলিল, সীতা ঠাকুরাণী।।
এতেক সুমন্ত্র যদি বলিল বচন।
পুরীর সহিত সবে করিল ক্রন্দন।।
সাতশত মহাদেবী রাজার রমণী।
কান্দিয়া বিকল সবে পোহায় রজনী।।
কেহ কারে না সান্ত্বায় সবে অচেতন।
পূর্ব্বকথা রাজার যে হইল স্মরণ।।
কৌশল্যার ঠাঁই রাজা কহে পূর্ব্বকথা।
মহাজন যা বলেন না হয় অন্যথা।।
মৃগয়াতে গিয়াছিলাম সরযূর তীরে।
অন্ধ-মুনি-পুত্র কলসেতে জল ভরে।।
মম জ্ঞান, মৃগ সব করে জলপান।
পূরিলাম শব্দ মাত্র পাইয়া সন্ধান।।
ভরিতে সলিল তার ফুটে বাণ বুকে।
প্রাণ গেল বলিয়া মুনির পুত্র ডাকে।।
কোন্ অপরাধে প্রাণ নিল কোন্ জনে।
এতেক শুনিয়া আমি গেলাম সে স্থানে।।
মুনিপুত্র বলে, রাজা পাড়িলা প্রমাদ।
আমারে মারিলে কি পাইয়া অপরাধ।।
অন্ধ মাতা পিতা, আমি পুষি রাত্রি দিনে।
বুড়া বুড়ী মরিবেক আমার মরণে।।
অন্ধ মাতা পিতা আছে, শ্রীফলের বনে।
আমা কোলে করি রাজা চল সেই স্থানে।।
যাবৎ আমার পিতা নাহি দেয় শাপ।
আমা লৈয়া চল তুমি যথা বৃদ্ধ বাপ।।
ইহা বিনা তব আর নাহি প্রতিকার।
এতেক বলিলা মোরে মুনির কুমার।।
অন্ধ বুড়া বুড়ী বসি আছে যেইখানে।
শিশু কোলে করি আমি গেলাম সে বনে।।
মুনি বলিলেন, রাজা বড়ই নির্দ্দয়।
কি দোষে মারিলে বল আমার তনয়।।
আমারে লইয়া চল সরযূর কূলে।
পুত্রের তর্পণ আমি করি সেই জলে।।
মুনিরে ধরিয়া নিলাম সরযূর নীরে।
পুত্রের তর্পণ করি শাপিল আমারে।।
পুত্রশোকে মরিয়া করিল স্বর্গবাস।
দেশে আইলাম আমি পাইয়া তরাস।।
সে মুনির বাক্য কভু না হয় খণ্ডন।
আজিকার রাত্রে রাণী আমার মরণ।।
সে অন্ধ মুনির শাপ ফলে অতঃপরে।
ছটফট করি রাজা মুখে বাক্য হরে।।
হাহাকার করি রাজা ত্যজিল জীবন।
নিদ্রা যায় দশরথ, হেন লয় মন।।
পুরীর সহিত কান্দে পোহায় রজনী।
রাজারে চিয়াতে গেল সাতশত রাণী।।
দুইদণ্ড বেলা হয় সূর্য্যের উদয়।
এতক্ষণ নিদ্রা যান রাজা মহাশয়।।
অনন্তর রাজারে করিল মৃতজ্ঞান।
নাড়িয়া চাড়িয়া দেখে নাহি তাঁর প্রাণ।।
আছাড় খাইয়া পড়ে, কদলী যেমনি।
রাজার চরণ ধরি কান্দে সব রাণী।।
একে পুত্রশোকে রাণী পরম দুঃখিতা।
পতিশোকে ততোধিক হইল মূর্চ্ছিতা।।
সত্যবাদী রাজা তুমি, সত্যে বড় স্থির।
সত্য পালি স্বর্গে গেলে ত্যজিয়া শরীর।।
সত্য না লঙ্ঘিলে তুমি বড় পুণ্যশ্লোক।
স্বর্গবাসী হয়ে এড়াইলে পুত্রশোকে।।
রাজা স্বর্গে গেল, আর রাম গেল বন।
দুই শোকে প্রাণ মোর থাকে কি কারণ।।
ভূমে গড়াগড়ি যায় কৌশল্যা তাপিনী।
কৌশল্যারে বুঝান বশিষ্ঠ মহামুনি।।
তোমারে বুঝাব কত নহে ত উচিত।
মৃত হেতু কান্দ যত সকলি অহিত।।
স্বর্গেতে গেলেন রাজা পালিয়া পৃথিবী।
তার ধর্ম্ম কর্ম্ম কর, তুমি মহাদেবী।।
রাজাকে রাখহ করি তৈল মধ্যগত।
দেশে আসি অগ্নিকার্য্য করিবে ভরত।।
বাসি মড়া হইয়া আছেন মহারাজ।
প্রাতঃকালে যুক্তি করে অমাত্য সমাজ।।
সত্য পালি ভূপতি গেলেন স্বর্গবাস।
অরাজক হৈল রাজ্য বড় পাই ত্রাস।।
অরাজক রাজ্যের সর্ব্বদা অকুশল।
অরাজক পৃথিবীতে নাহি হয় জল।।
অরাজক রাজ্যে বৃক্ষে নাহি ধরে ফল।
অরাজক রাজ্যে ধর্ম্ম সকলি বিফল।।
অরাজক রাজ্যে ভৃত্য বশ নাহি হয়।
অরাজক রাজ্যে সর্ব্বক্ষণ দস্যুভয়।।
অরাজক রাজ্যেতে তুরঙ্গ হস্তী ছোটে।
অরাজক রাজ্যেতে প্রজার ধন লোটে।।
অরাজক রাজ্যে সদা হয় ডাকা চুরি।
অরাজক রাজ্য দেখি বড় ভয় করি।।
অরাজক রাজ্যে অন্য নৃপতি গরজে।
অরাজক রাজ্যে প্রজালোক দুঃখে মজে।।
অরাজক রাজ্যে না বরিষে পুরন্দর।
অরাজক রাজ্যের অশুভ বহুতর।।
অরাজক রাজ্যে নারী নাহি রহে পাশে।
অরাজক রাজ্যে স্বামী অন্য নারী তোষে।।
অরাজক রাজ্যে সদা হিতে বিপরীত।
অরাজক রাজ্যে থাকা অতি অনুচিত।।
রাজ্য করিলেন বৃদ্ধ রাজা মহাশয়।
তাঁহার প্রতাপে লোক থাকিত নির্ভয়।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল কাঁপিত তাঁর ডরে।
রাজ্যের কুশল ছিল বুড়ার আদরে।।
হেন রাজা বিনা রাজ্য করে টলমল।
রাজা হৈতে রাজ্যরক্ষা, প্রজার কুশল।।
রাজ্য দিতে ভরতেরে সর্ব্ব অঙ্গীকার।
ভরতেরে আনি দেশে দেহ রাজ্যভার।।
ভরত আছেন মাতামহের বসতি।
দূত পাঠাইয়া তাঁরে আন শীঘ্রগতি।।
রাজা স্বর্গগত, রাম চলিলেন বনে।
এত ঘোর প্রমাদ ভরত নাহি জানে।।
ভরতেরে না কহিবে এ সব ঘটন।
তবে না করিবে সেই দেশে আগমন।।
মাতৃদোষ শুনিলে ভরত না আসিবে।
পিতৃশোকে মনোদুঃখে দেশান্তরী হবে।।
ভরত মাতুল-গৃহে অযোধ্যা পাসরা।
চারি পুত্র সত্ত্বে দশরথ বাসি মড়া।।
বুদ্ধির সাগর পাত্র মন্ত্রণা বিশেষে।
চলিলেন ভরতেরে আনিবারে দেশে।।
করিলেন অনুজ্ঞা বশিষ্ঠ পুরোহিত।
ভরতে আনিতে সবে চলিল ত্বরিত।।
হস্তিনানগরে গেল তৃতীয় দিবসে।
পরদিন গেল তারা কুরঙ্গের দেশে।।
নীহারের রাজ্যে গেল ত্বরিত গমনে।
লক্ষ্মী অধিষ্ঠান সদা, জ্ঞান হয় মনে।।
রাত্রি দিন সবে পথে চলিল সত্বর।
পুনবের রাজ্যে গেল দেখে মনোহর।।
আড়িকুল দেশে গেল যেন সুরপুর।
কুকর্ম্ম বর্জ্জিত লোক সুকর্ম্ম প্রচুর।।
বলরেণু নদী পার হৈল সর্ব্বজন।
যার দুই কূলে বৈসে অনেক ব্রাহ্মণ।।
নদ নদী কন্দর হইল বহু পার।
বহু দেশ দেশান্তর এড়ায় অপার।।
গিরিরাজ দেশেতে কেকয় রাজা বৈসে।
উত্তরিল গিয়া পাত্র পঞ্চম দিবসে।।
রাত্রি দিন পথশ্রমে হইয়া বিকল।
রন্ধন ভোজন করে পেয়ে রম্যস্থল।।
ভরতের সঙ্গে নাহি হয় দরশন।
পথশ্রমে নিন্দ্রা যায় হয়ে অচেতন।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের বাণী অধিষ্ঠান।
রচিল অযোধ্যাকাণ্ড অমৃত-সমান।।