Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

০৫.

রুন কখনো সকালে উঠতে পারে না।

নটার সময় বেড-টি খেয়ে সে খবরের কাগজ পড়তে বসে। খেলাধুলা এবং আইন আদালত এই দুটি অংশ পড়তে পড়তে দশটা বেজে যায়। রোজই সে দাঁত ব্রাশ করতে যায় দশটার পর।

আজ একটা বিচিত্র কারণে রুটিনের ব্যতিক্রম হল। শেষরাতের দিকে রুন একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখল। যেন সে এবং অ্যানি সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়েছে। কিন্তু অ্যানির গায়ে কোনো কাপড় নেই। সে খুব বিরক্ত হয়ে বলছে, এইসব কী অসভ্যতা, অ্যানি। ছি!

ঠিক তখন অ্যানি ভয়-পাওয়া স্বরে বলল, মা, পালাও! ওরা আমাদের ধরতে আসছে।

রুন চমকে পিছনে ফিরে দেখল তিনটি বদ্ধ উন্মাদ ছুটে আসছে তাদের দিকে। ওদের গায়েও কোনো কাপড় নেই। রুন দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু অ্যানি সেরকম দৌড়াতে পারছে না। পাগলগুলো শেষ পর্যন্ত অ্যানিকে ধরে ফেলল। রুন শুনল, অ্যানি প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে, জামশেদ আমাকে বাচাও।

রুন এই সময় জেগে উঠল। পরপর দুপেগ ব্রান্ডি খেয়ে বাইরে এসে দেখল ভোর হয়েছে। অ্যানি জগিং সুট পরে দৌড়াচ্ছে বাড়ির সামনের খোলা মাঠটায়। রুন একবার ভাবল অ্যানিকে ডাকে। কিন্তু ডাকল না। রেলিঙে ভর দিয়ে তাকিয়ে রইল, স্বপ্নের ঘোর তার তখনও কাটেনি। এখনও গা কাঁপছে।

রুন দেখল জামশেদ নিচে নেমে যাচ্ছে। হাত-ইশারা করে ডাকছে অ্যানিকে। কী যেন বলছে। উপর থেকে ঠিক শোনা যাচ্ছে না। রুন নিচে নেমে এল। জামশেদ ভারী গলায় উপদেশ দিচ্ছে অ্যানিকে।

তুমি ভালোই দৌড়াচ্ছ, কিন্তু শুরুটা ভালো হচ্ছে না। দৌড়ে শুরুটাই আসল। ঠিক সময় শুরু করতে হবে। সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ রাখতে হবে।

অ্যানি বলল, তুমি কি আমাকে শেখাবে? আমি জানি আমি ভালো দৌড়াতে পারি, কিন্তু শুরুটা আমার সত্যি সত্যি খারাপ।

রুন দেখল জামশেদ গম্ভীর হয়ে আছে। এই লোকটি কি সহজ হতে জানে না?

আমাকে তুমি শেখাবে? প্লিজ।

হ্যাঁ, শেখাব। এসো আমার সঙ্গে।

রুন লক্ষ করল অ্যানির সমস্ত চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এসব মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। মেয়েটি ক্রমে ক্রমেই অপরিচিত এই ভয়ংকর লোকটির দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

রুন ভিকিকে টেলিফোন করল দুপুরে। ভিকি টাকাপয়সার কী-একটা সুরাহা করবার জন্যে রোমে গিয়েছে। গতকালই ফেরার কথা ছিল, ফেরেনি।

হ্যালো, ভিকি?

হা। কী ব্যাপার?।

গতকাল রাতে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

তা-ই নাকি?

হ্যাঁ। শোনো কী দেখলাম…

ভিকি ভ্রূ কুঁচকে শুনতে লাগল। লং ডিসটেন্স কল। প্রচুর বিল উঠবে কিন্তু উপায় নেই, শুনতেই হবে। স্বপ্নের কথা ভিকিকে দশ মিনিট ধরে শুনতে হল। সবশেষে রুন বলল, আমার খুব ভয় লাগছে।

ভয়ের কিছু নেই। স্বপ্ন স্বপ্নই।

হোক স্বপ্ন। তুমি আজকেই চলে আসবে।

আমি আসতে পারছি না। টাকার কোনো ব্যবস্থা করতে পরিনি।

কবে আসবে?

দেখি।

টেলিফোন রেখে দেয়ার আগে ভিকি বলল, বড় ঝামেলায় পড়ে গেছি। তুমি কিছু টাকার ব্যবস্থা করতে পার নাকি, রুন?

আমি, আমি কোত্থেকে করব?

তোমার তো অনেক গয়নাটয়না আছে।

রুন জবাব না দিয়ে টেলিফোন রেখে দিল।

ভিকি ছোট্ট একটি নিশ্বাস ফেলল।

রুন আজ কিছু কেনাকাটা করবে বলে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু মত বদলালো। দুঃস্বপ্ন দেখার পর তার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। সে ঠিক করল আজ সারাদিন সে ঘরেই থাকবে। আজ রান্না করলে কেমন হয়? অনেক দিন কোনো রান্নাবান্না করা হয়নি। কিন্তু রান্না করার ইচ্ছাটা স্থায়ী হল না। রুন টিভি খুলে টিভির সামনে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর টিভি দেখতেও ভালো লাগল না। সমস্ত দিন ঘরে বসে থাকাটা এমন ক্লান্তির ব্যাপার তা তার জানা ছিল না। দুপুরের দিকে অতিষ্ঠ হয়ে সে এতরাকে টেলিফোন করল, এতরী, তুমি কি সন্ধ্যার পর আসতে পার?

নিশ্চয়ই পারি। কী ব্যাপার?

ব্যাপার কিছু নয়, গল্পগুজব করা যাবে।

বাইরে কোথাও খেতে চাও? বনভিলে চমৎকার একটা রেস্টুরেন্ট আছে।

না, আজ আমি কোথাও বেরুব না ঠিক করেছি।

এতরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ভিকি ফেরেনি?

নাহ।

কবে ফিরবে জান?

আমি ঠিক জানি না। কাল ফিরতে পারে।

ভিকি তো শুনলাম দারুণ ঝামেলায় পড়েছে।

কী ঝামেলা?

ওর একটা সিল্ক কারখানা শুনলাম বন্ধ হয়ে গেছে।

রুন অবাক হয়ে বলল, কই, আমি তো কিছু জানি না!

তোমাকে কিছু বলেনি?

না। আচ্ছা আমি এসে বলব।

রুনের একটু মন-খারাপ হল। ভিকি তা হলে সত্যি সত্যি বড়রকমের ঝামেলায় পড়েছে। তাকে সাহায্য করা উচিত। রুন ইচ্ছা করলেই তা পারে। মোটা অঙ্কের টাকা রুনের আছে। তার নিজস্ব টাকা। এবং টাকা যে আছে তা ভিকি নিজেও জানে না। রুনের বাবা বলে দিয়েছিল, কিছু-কিছু জিনিস স্বামীদের জানাতে নেই। একটি হচ্ছে স্ত্রীদের ব্যাংক-ব্যালেন্স! তোমার টাকাটা হচ্ছে তোমার দুঃসময়ের জনো, ভিকির দুঃসময়ের জন্য নয়।

রুন বলেছিল, কিন্তু বাবা, ধরো, ভিকি একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ল, তখন?

তখন তুমি ওকে ছেড়ে চলে আসবে।

বাবার কথা এখন মনে না রাখলেও চলবে। বাবা মারা গেছে, কাজেই খবরদারি করবার জন্যে ছুটে আসবে না। রুন তার ব্যাংকে টেলিফোন করল, আমি মোটা অঙ্কের কিছু টাকা তুলতে চাই।

কতদিনের মধ্যে

এক সপ্তাহ।

ক্যাশ হলে পারা যাবে না।

ক্যাশ নয়, ক্রসড চেক করে দিলে হবে। পারা যাবে?

কোন কারেন্সি?

ইতালিয়ান হলেই হবে। পারা যাবে?

যাবে। তবে আপনার একটা চিঠি লাগবে।

বেশ। চেক রেডি করে রাখুন।

আপনার ঠিকানায় পাঠাব?

না, শুধু রেডি করে রাখুন।

রুন টাকার পরিমাণ এবং ক্রসড চেকের নাম বলল। ব্যাপারটা যে এত সহজে হবে তা তার ধারণা ছিল না। সুইস ব্যাংকগুলি খুব এফিসিয়েন্ট।

এতরা এল রাত নটার দিকে। রুন হালকা গোলাপি একটা স্কার্ট পরে বসে ছিল লবিতে। এতরা হাসিমুখে বলল, আমরা যত বুড়ো হচ্ছি তুমি ততই রূপসী হচ্ছ।

রুন তরল গলায় হাসল। এতরা রুনের কাঁধে হাত রাখল। কাঁধে সে হাত স্থায়ী হল না, নিচের দিকে নেমে আসতে লাগল। রুম কিছু বলল না। লবি অন্ধকার, কেউ কিছু দেখছে না। এতরা হালকা গলায় বলল, ভিকি বেচারা মহাবিপদে পড়েছে।

রুন বলল, ঠিক কত টাকা হলে সে বিপদ থেকে মুক্তি পায়?

কেন জিজ্ঞেস করছ?

জানবার জন্যে। সাময়িক মুক্তি না চিরকালের জন্যে মুক্তি?

চিরকালের জন্যে মুক্তি।

অনেক টাকার ব্যাপার। ওয়ান মিলিয়ন ইউ এস ডলার।

এত টাকা?

হ্যাঁ। সে ঝামেলাটা পাকিয়েছে বড় করেই।

এতরা রুনের জামার হুক খুলতে চেষ্টা করল। রুন তেমন বাধা দিল না। একবার শুধু অস্পষ্ট স্বরে বলল, আহ্ কী করছ?

কিছুই করছি না, রুন। এতরা আরো এগিয়ে এল।

রুন বলল, ভিকি একটা অপদার্থ, তবু মনে হয় আমি ওকে পছন্দ করি।

তা হয়তো করো।

ইদানীং বেচারা ঘুমাতে পারছে না। আমি ওকে সাহায্য করতে চাই।

এতরা রুনের কথা ঠিক শুনতে পায়নি। সে জামার হুকটি খুলে ফেলেছে। জলপরীর মতো একটা অর্ধনগ্ন নারী পাশে থাকলে কথাবার্তায় মন দেয়া যায় না। এতরা সে-রাতটা এখানেই কাটাল।

০৬.

অ্যানিদের স্কুলে আজ বার্ষিক স্পোর্টস। অ্যানি তার বাবা এবং মা দুজনের জন্যে দুটি টিকিট এনেছে। ভিকি বলেছে সে যেতে পারবে না, তার প্রচুর ঝামেলা। রুন হ্যাঁ না কিছুই বলেনি। খুব সম্ভব সেও যাবে না। রোদে বসে থাকলে রুনের মাথা ধরে। তা ছাড়া যেদিন স্পোর্টস ঠিক সেদিনই হোটেল শেরাটনে গোলাপ ফুলের প্রদর্শনী হচ্ছে। এই প্রদর্শনীটি অন্য প্রদর্শনীগুলোর চেয়ে আলাদা। চিত্রতারকাদের বাড়ির গোলাপ প্রদর্শনী। এতরা দুটি টিকিট জোগাড় করেছে। বাচ্চাকাচ্চাদের দৌড়-ঝাঁপ দেখার চেয়ে হোটেল শেরাটনে যাওয়া বহুগুণে শ্রেয়। কিন্তু সেন্টিমেন্টের ব্যাপার আছে। অ্যানির এই স্পোর্টস নিয়ে খুব আগ্রহ। দু-তিন মাস আগে থেকেই বলে রেখেছে, যেতেই হবে। এখন তাকে না বলাটাই এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু রুন ঠিক করে ফেলল ব্যাপারটা ঝুলিয়ে না রেখে মিটিয়ে ফেলাই ভালো। রাতের খাবার টেবিলে রুন প্রসঙ্গটা তুলল, অ্যানি, তোমার স্পোর্টস কবে?

সতেরো তারিখ। তোমাকে তো বলেছি আগে।

তুমি কিসে কিসে আছ?

একশো মিটার দৌড়।

আর কিছুতে না?

না। তুমি যাচ্ছ তো মা?

রুন ইতস্তত করে বলল, খুব চেষ্টা করব আমি, কিন্তু …

অর্থাৎ যাচ্ছ না। আমি আগেই জানতাম যাবে না।

এর মানে কী? তুমি আগেই জানতে মানে?

মানে কিছু নেই। তোমরা কেউ যাবে না তা আমি আগেই জানতাম। অ্যানি থালা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল।

ডিনার শেষ করো অ্যানি।

আমার খিদে নেই।

অ্যানি, তোমার বয়স হচ্ছে। এখন তুমি আর ছেলেমানুষ নও। সবার সুবিধা অসুবিধা তোমার বুঝতে পারা উচিত।

অ্যানি জবাব না দিয়ে ছুটে চলে গেল নিজের ঘরে। মারিয়া টেবিল থেকে খালা সরাতে সরাতে বলল, অ্যানি এবার একশো মিটার স্পোর্টসে প্রাইজ পাবে।

তা-ই বুঝি?

হ্যা, ম্যাডাম। ঐ লোকটি খুব ভালো শেখায়।

দৌড়ানোর মধ্যে আবার শেখানোর কী আছে?

তা জানি না, তবে লোকটি যত্ন করে শেখাচ্ছে।

রুন গম্ভীর হয়ে গেল।

মারিয়া হঠাৎ বলল, লোকটি খুব খারাপ না ম্যাডাম।

খারাপ হবে কেন?

না, মানে লোকটি অ্যানিকে পছন্দ করে।

রুন চোখ তুলে তাকাল।

মারিয়া কফি ঢালতে ঢালতে বলল, অ্যানির যে-রাতে জ্বর এল, সে-রাতে একবার সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে জ্বর কত?

তা-ই বুঝি?

হুঁ। ওর কাছ থেকে তা আশা করা যায় না, ঠিক না ম্যাডাম?

জামশেদ সারা দুপুর একটা বই পড়তে চেষ্টা করছে, দি ইয়েলো নাই! পড়া মোটেও আগাচ্ছে না। অভ্যেস না থাকলে যা হয়। বইটির কভারে লেখা আছে এই সত্যি ভূতের গল্প কেউ যেন রাতে না পড়ে। যাদের ব্লাডপ্রেশার বা হার্টের অসুখ আছে তারা যেন ভুলেও এ-বই না পড়ে। জামশেদ বহু কষ্টে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে এবং যতই এগুচ্ছে ততই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এমন সব আজগুবি জিনিসও লেখা হয় এবং লোকজন কিনে এনে পড়ে। একটি একুশ বছরের মেয়ের সঙ্গে প্রতিরাতে একটি পিশাচ এসে ঘুমায়। গাঁজাখুরিরও সীমা থাকা দরকার। জামশেদ বই বন্ধ করে বিরক্তমুখে বারান্দায় চলে এল। তার প্রচণ্ড তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। এমন তৃষ্ণা যা সময়-অসময় মানে না, হঠাৎ জেগে উঠে চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলে। কিন্তু এখন যদি দরজা বন্ধ করে বোতল খুলে বসে তা হলে আর নিজেকে সামলানো যাবে না। জামশেদ প্রাণপণে তৃষ্ণা ভুলে থাকতে চেষ্টা করল। ব্যস্ত থাকলে কাজ হবে হয়তো। সে নিচে নেমে এল। লনের এক প্রান্তে অ্যানি বসে ছিল। তার বসায় ভঙ্গিটি অদ্ভুত–যেন কঁদছে। এবং কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। জামশেদ একবার ভাবল তাকে ডাকবে না। তবু ডাকল এবং আশ্চর্য, ডাকল খুব নরম স্বরে, কী করছ, অ্যানি?

কিছু করছি না।

কাঁদছিলে নাকি?

অ্যানি তার জবাব না দিয়ে বলল, তুমি কি কাল আমার স্পোর্টস দেখবে, না গাড়িতে বসে থাকবে?

লোকজনের ভিড় আমার পছন্দ হয় না। আমি গাড়িতে থাকব।

জামশেদের কথা শেষ হবার আগেই অ্যানি প্রায় ছুটে চলে গেল। সারা বিকেল এবং সারা সন্ধ্যা তার আর দেখা পাওয়া গেল না।

রাত দশটায় জামশেদ রান্নাঘরে উঁকি দিল। মারিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। জামশেদকে কখনো এখানে আসতে দেখা যায় না। সে অবাক হয়ে বলল, কী, কফি খাবে? কফির জন্যে এসেছ?

না। অ্যানি কোথায়?

ঘুমুতে গেছে।

ঘুমিয়ে পড়েছে?

না, এখনও ঘুমায়নি। আমি দুধ নিয়ে যাব। দুধ খেয়ে শোবে।

জেগে আছে তা হলে?

হ্যাঁ। কী ব্যাপার? কিছু বলবে অ্যানিকে?

তুমি অ্যানিকে বলবে যে আমি ওর স্পোর্টস দেখতে যাব।

মারিয়া বলল, আমি এক্ষুনি ওকে বলছি।

এক্ষুনি বলার দরকার নেই।

মারিয়া বলল, আমি খুব খুশি হয়েছি যে তুমি যাচ্ছ। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক। অ্যানি মেয়েটি খুব নিঃসঙ্গ।

জামশেদ জবাব দিল না, গম্ভীরমূর্খ উপরে উঠে এল।

একশো মিটার দৌড় হচ্ছে তিন নম্বর ইভেন্ট। অ্যানি খুব নার্ভাস হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে প্রতিযোগী পাঁচজন। এদের মধ্যে নিন্তি নামের মেয়েটি হরিণের মতো দৌড়ায়।

মাঠে নামবার আগে জামশেদ বলল, যখন দৌড়াতে শুরু করবে তখন একটি জিনিসই শুধু খেয়াল রাখবে। সামনের লাল ফিতা। ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

ভয় লাগছে?

হ্যাঁ। মনে হচ্ছে আমি হেরে যাব।

কাউকে তে হারতেই হবে।

আমার হারতে ভালো লাগে না।

স্টার্টিং ফায়ার হতেই অ্যানি বিদ্যুতের মতো ছুটল। জামশেদ হাসল,–চমৎকার স্টাটিং! অপূর্ব!! অ্যানি নিমেষের মধ্যে প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে দিল। কিন্তু অঘটন ঘটল–অ্যানি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। একটা হাহাকার উঠল দর্শকদের প্যাভিলিয়ন থেকে। অ্যানির আশাহত চোখের সামনে প্রতিযোগীরা ছুটে বেরিয়ে গেল। লাফিয়ে উঠল জামশেদ–উঠে দাঁড়াও, দৌড়াও বোকা মেয়ে, দৌড়াও।

অ্যানি উঠে দাঁড়িয়েছে।

জামশেদ তৃতীয়বার চেঁচাল, দৌড়াও।

অ্যানি ছুটতে শুরু করল। পৌঁছাল সবার শেষে।

অ্যানি কাঁদতে কাঁদতে দর্শকদের প্যাভিলিয়নের দিকে আসছে। জামশেদ এগিয়ে গেল। একটি ছোট্ট শিশুর মতো অ্যানি জমিশেদকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল।

বাড়ি ফেরার পথে জামশেদ বলল, আমি খুব খুশি হয়েছি যে পড়ে যাবার পরও তুমি উঠে দাঁড়িয়েছ এবং দৌড়াতে শুরু করেছ।

তাতে কিছুই যায় আসে না।

তাতে অনেক কিছুই যায় আসে, অ্যানি।

অ্যানি ফ্রকের হাতায় চোখ মুছল। জামশেদ বলল, পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। খুব অল্প কিছু মানুষ উঠে দাঁড়াতে পারে।

অ্যানি চাপাস্বরে বলল, ওরা এসে পৌঁছায় সবার শেষে।

আপাতদৃষ্টিতে এরকম মনে হয়। সত্যিকার অর্থে ওরাই কিন্তু জয়ী।

অ্যানি জবাব দিল না।

জামশেদ বলল, সমুদ্রের দিকে যেতে চাও, অ্যানি? ওখানে বালির উপর বসে আইসক্রিম খাওয়া যেতে পারে। কী, চাও যেতে?

চাই।

এসো, আজকের দিনটি আমরা খুব ফুর্তি করে কাটাই। মিউজিয়ামে গেলে কেমন হয়?

মিউজিয়াম আমার ভালো লাগে না।

তা হলে চলো চিড়িয়াখানায় যাওয়া যাক। চিড়িয়াখানা ভালো লাগে?

লাগে।

যাবে?

অ্যানি তাকিয়ে দেখল, বুড়ো ভালুকের পাথরের মতো চোখ দুটি কোন এক আশ্চর্য উপায়ে তরল হয়ে যেতে শুরু করেছে।

ভিকি পরপর দুরাত ঘুমাতে পারেনি। এক সপ্তাহের মধ্যেই একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাকে নিতে হবে। সিল্কের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তু। তিন-পুরুষের একটা ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হঠাৎ নেয়া যায় না। এর জন্যে অনিদ্রায় কাতর হতে হয়।

রুন দেখল, ভিকি রাত নটার দিকে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করে আনতে বলছে।

কোথায় যাচ্ছ?

একটা কাজে যাচ্ছি।

টাকার জোগাড় করতে?

না। ওটা আর জোগাড় হবে না।

আশা ছেড়ে দিয়েছ মনে হচ্ছে?

ভিকি জবাব দিল না। রুন বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমাকে ভালো একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাও-না!

ভিকি নিঃশব্দে টাইয়ের নট বাঁধতে লাগল।

কী, কথায় জবাব দিচ্ছ না যে? চলো-না সমুদ্রের ধারে যে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে গিয়ে লবস্টার খেয়ে আসি।

ভিকি ক্লান্ত স্বরে বলল, রুন, তুমি বুঝতে পারছ না আমি একটা দারুণ সমস্যার মধ্যে আছি। এমন হতে পারে যে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে লবস্টার আর কোনোদিনই আমরা খেতে পাব না।

রুন হাসিমুখে বলল, কিন্তু এমন তো হতে পারে যে হঠাৎ করে তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।

আমার বেলা হঠাৎ করে কিছু হয় না।

একেবারে আশা ছেড়ে দেয়া ঠিক না।

চলো যাই। রুন ভিকির হাত ধরল।

প্লিজ, রুন! আমাকে বিরক্ত কোরো না। খুব খারাপ সময় যাচ্ছে।

সময় ভালোও তো হয়ে যেতে পারে। কথা শোনো আমার।

ভিকি কোনো কথা শুনল না। বিরক্তমুখে নিচে নেমে গেল। তার বেশ মাথা ধরেছে। রুনের ন্যাকামি শুনতে এতটুকুও ভালো লাগছে না।

এতরা চোখ কপালে তুলে বলল, এ কী চেহারা হয়েছে তোমার?

ভিকির চেহারা সত্যি সত্যি খারাপ হয়েছে। বুড়োটে দেখাচ্ছে। চোয়াল ঝুলে পড়েছে। চোখের দৃষ্টিও নিষ্প্রভ। এতরা সরু গলায় বলল, একেবারে ভেঙে পড়েছ মনে হচ্ছে?

তা ভেঙেছি। সেটাই স্বাভাবিক নয় কি?

না। তোমার যা ইচ্ছে তা খুব অস্বাভাবিক। তুমি কোনো সমাধানের দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকাচ্ছ।

সমাধান কিছু নেই।

এতরা মিটিমিটি হাসল। হাসিমুখেই বলল, চমৎকার একটা ডিনারের অর্ডার দাও। সেইসঙ্গে জার্মান কিছু হোয়াইট ওয়াইন আনতে বলো। তোমাকে সমাধান দিচ্ছি।

ভিকির কোনো ভাবান্তর হল না। সে সিগারেট ধরিয়ে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে রইল। এতরা খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, প্রথম শ্রেণীর সমাধান আছে আমার কাছে, ঠাণ্ডা মাথায় শুনতে হবে।

বলো, শুনি।

বলছি। তার আগে নার্ভগুলি ঠাণ্ডা করাবার জন্যে এক পশলা মার্টিনি হোক। মার্টিনি উইথ অলিভ।

এতরা হাতের ইশারায় ওয়েট্রেসকে ডাকল।

কী তোমার সমাধান?

বলছি। শর্ত হচ্ছে সবটা বলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। প্রথমে কোনো সাড়াশব্দ না করে শুনবে ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

তা হলে শুরু করছি।

এতরা লম্বা একটা চুমুক দিল মার্টিনিতে। নিচুস্বরে বলতে শুরু করল, তুমি নিশ্চয়ই জান, ইংল্যান্ডের একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি অদ্ভুত অদ্ভুত সব ইনস্যুরেন্স পলিসি বিক্রি করে। জান তো?

জানি।

ওরা ইদানীং একটা নতুন ইনস্যুরেন্স পলিসি বিক্রি করতে শুরু করেছে। ধনী বাবা-মারা তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা ইনস্যুরেন্স করছেন।

তা-ই নাকি? জানতাম না তো!

ইনস্যুরেন্স করার পর যদি ইনস্যুর-করা ছেলেমেয়েরা কিডন্যাপ হয় তা হলে কিডন্যাপারদের দাবি অনুযায়ী সব টাকা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি দিয়ে দেয়। বুঝতে পারছ?

পারছি।

এতরা আরেকটি ভবল মার্টিনির অর্ডার দিয়ে বলল, এতক্ষণ যা বললাম তা হচ্ছে তোমার সমস্যার সমাধান।

তার মানে?

ব্যস্ত হয়ো না। বুঝিয়ে দিচ্ছি।

ভিকি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এতরা সহজ ভঙ্গিতে বলতে লাগল, তুমি অ্যানির জন্যে ঐ একটি পলিসি কিনবে। এক মিলিয়ন ডলারের একটি পলিসি। তারপর কিছু দুষ্টলোক অ্যানিকে চুরি করে এক মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবি করবে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি এক মিলিয়ন ডলার দেবে তা তো বুঝতেই পারছ। সেখান থেকে পাঁচ লাখ ডলার পাবে তুমি, আর বাকিটা যাবে কিডন্যাপের ব্যবস্থা যারা করবে তাদের হাতে।

ভিকি নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল।

এতরা হাসিমুখে বলল, পরিকল্পনা দায়িত্বে যারা থাকবে তারা সবাই খুব বিশ্বাসী। আমার নিজের লোক বলতে পার।

ভিকি কোনো জবাব দিল না।

অবিশ্যি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কিছু বিধিনিষেধ আছে। যেমন পলিসি বিক্রি করবার আগে ওদের দেখাতে হবে যে তুমি তোমার মেয়ের নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা করেছ। যেমন, ওর জন্যে চব্বিশ ঘণ্টার বডিগার্ড আছে। বাড়িতে পাহারাদার কুকুর আছে। বুঝতে পারছ?

ভিকি কিছু বলল না, চুপচাপ বসে রইল।

এতরা বলল, ডিনারের অর্ডার দেয়া যাক, কী বল? এমন মনমরা হয়ে গেলে কেন?

তোমার সমাধানটি আমার পছন্দ হয়নি।

ভালো। পছন্দ যে হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা নতুন সমাধানের কথা চিন্তা করব। তবে ভিকি, এতক্ষণ আমরা যে-কথাবার্তা বললাম তা যেন তৃতীয় কোনো প্রাণী জানতে না পারে।

জানবে না।

রুনকেও বলবে না।

এতরা, আমি আমার নিজস্ব ব্যাপারগুলোর কথা ঘরে বলে বেড়াই না।

গুড। আর শোনো, যদি তোমার মনে হয় আমার পরিকল্পনাটি প্রথম শ্রেণীর তা হলে বিনা দ্বিধায় আমাকে জানাবে। বুঝতে পারছি অ্যানির নিরাপত্তার বিষয়েই তুমি বেশি চিন্তিত। অ্যানিকে আমি আমার নিজের মেয়ের মতোই দেখি, ওর নিরাপত্তার যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেয়া হবে বলাই বাহুল্য।

ভিকি গম্ভীরমুখে ডিনারের অর্ডার দিল। ডিনার ছিল সাদামাটা কিন্তু ডিলারশেষে প্রচুর ড্রিংকসের ব্যবস্থা হল। এবং একসময় ভিকি বলল, তুমি যে-পরিকল্পনার কথা বলহু তার পেছনে তোমার কী স্বার্থ?

আমার দুটি স্বার্থ। বন্ধুর উপকার হবে। তা ছাড়া, আমিও কিছু টাকা পাব। দশ হাজার ডলার। বিরাট কিছু নয়, তবে মন্দ নয়।

ভিকি হঠাৎ বলল, আমি রাজি আছি।

ভালো। আমি জানতাম তুমি রাজি হবে।

ভিকি উত্তর দিল না।

কোনোরকম ঝামেলা ছাড়া এতবড় একটা দান একমাত্র জুয়ার টেবিলেই পাওয়া সম্ভব। এতরা টেনে টেনে হাসতে লাগল। আরেক রাউন্ড হবে?

ভিকি জবাব দিল না।

আরেক রাউন্ড হোক। ভিকি, তোমাকে খুব বিমর্ষ দেখাচ্ছে। ফুর্তির জন্যে কোথাও যেতে চাও? দুটি স্প্যানিশ মেয়ে আছে, আমার পরিচিত। অপূর্ব! এবং বিশেষ পারদর্শী।

ফুর্তির জন্যে আমি কখনো বাইরে যাই না।

ঠিক ঠিক। খুবই ঠিক।

এতরা হাতের ইশারায় ওয়েট্রেসকে ডাকল। সে মনে হল কিঞ্চিৎ নেশাগ্রস্ত।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress