অপেক্ষা : ০৫
নিজেকে ইমনের খুব বড় মনে হচ্ছে। যেন হুট করে একদিনে অনেক বড় হয়ে গেছে। সে সবাইকে রেখে একা একা গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। ছোট চাচা অবশ্যি সঙ্গে যাচ্ছেন তারপরেও সে একা একা যাচ্ছে—এটা ভাবা যায়! ইমনের হাতে ছোট্ট ব্যাগ। ব্যাগে জামা কাপড়। টুথপেষ্ট, টুথব্রাস। একটা চিরুনী।
সুরাইয়া ছেলের হাতে দুটা দশ টাকার নোট দিল। ইমন সেই নোট দুটা গম্ভীর ভঙ্গিতে সার্টের পকেটে নিল। সুরাইয়া বলল, খুব সাবধানে থাকবে।
ইমন মাথা কাত করল।
গ্রামে অনেক পুকুর-টুকুর আছে। সাবধান, একা একা পুকুরে যাবে না। জঙ্গল টঙ্গলেও যাবে না, সাপ খোপ আছে। মনে থাকবে?
হুঁ।
আচ্ছা তাহলে যাও। রাতে ছোট চাচার সঙ্গে থাকবে। বাথরুম পেলে তাকে জাগাবে—গ্রামের বাথরুম দূরে হয়
আচ্ছা।
বাহ, আমাদের ইমন কুমারকেতো খুব স্মার্ট লাগছে। কাছে এসো কপালে চুমু খেয়ে দি।
ইমন কাছে গেল। মা যখন কপালে চুমু খেলেন তখন হঠাৎ তার মনে হল–মা কে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না। গ্রামেব বাড়িতে না গেলেই সবচে ভাল হয়। ইচ্ছাটা হল খুব অল্প সময়ের জন্যে।
টেনে উঠে ইমনের মনে হল সে শুধু বড় না, অনেক বড় হয়ে গেছে। কারণ ছোট চাচা তার ট্রেনের টিকিট তার হাতে দিয়েছেন। টিকিট দেয়ার সময় বলেছেন–হারাবি না, হারালে টিকেট চেকার ফাইন করে দেবে। ইমনকে ছোট চাচার কোলে বসতে হল না। তার জন্যে জানালার কাছে আলাদা সীট। ছোট চাচা চা খেলেন, সেও খেলো। ঠিক বড়দের মত আলাদা কাপে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখতে তার কি যে ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছিল সে সারাজীবন টেনে কাটিয়ে দিতে পারবে। এরমধ্যে ছোট চাচা বললেন–এই যে মিষ্টার হার্ড নাট। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাব। তোর দায়িত্ব হচ্ছে ষ্টেশনের নোম পড়তে পড়তে যাওয়া। যখন দেখবি ষ্টেশনের নাম নান্দাইল রোড তখন আমাকে ডেকে তুলবি। ট্রেন ষ্টেশনে ঢুকতেই জানোলা দিয়ে মাথা বের করে ষ্টেশনের নোম পড়া কি রোমাঞ্চকর ব্যাপার।
গ্রামের বাড়ি দেখে ইমন আনন্দে অভিভূত হল। কি অদ্ভুত বাড়ি। টিনের চাল। ছোট ছোট জানালা। চারদিকে এত গাছপালা যেন মনে হয়। জঙ্গলের ভেতর বাড়ি। একটা কুমড়ো গাছ বাড়িটার চালে উঠে গেছে। সেই গাছ ভর্তি কুমড়ো। উঠোনে সত্যিকার একটা মা ভেড়া চারটা বাচ্চা নিয়ে বসে আছে। ইমন যখন তার সামনে দাঁড়াল ভেড়াটা একটুও ভয় পেল না। বাচ্চা ভেড়াদের একটা আবার এসে ইমনের গা শুকতে শুরু করল।
বিস্ময়ের উপর বিস্ময় বাড়িতে দুটা রাজ হাঁস। তারা গলা উঁচু করে কি গম্ভীর ভাবে হাঁটছে। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। ছোট চাচা অবশ্যি বললেন, রাজ হাঁস দুটা খুবই ত্যাদড়। খবরদার কাছে যাবি না। কামড় দেয়। কি অদ্ভুত কথা, হাঁস আবার মানুষকে কামড় দেয়। হাঁস কি কুকুর না-কি যে কামড়াবে?
আকলিমা বেগম নাতীকে দেখে ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদেন আর একটু পর পর বলেন, আমার ইমাইন্যা আইছে। তোমরা কে কই আছ— দেইখ্যা যাও আমার ইমাইন্যা আইছে। দাদীর কান্না দেখে ইমনের লজ্জা লাগছে–আবার ভালও লাগছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এমন বুড়ো একজন মানুষ তার মত ছোট্ট একজনকে এত ভালবাসে কেন। দাদীজানের শরীর অবশ। শুধু ডান হাতটা নাড়াতে পারেন। সেই হাতে তিনি ইমনকে ধরে আছেন। কিছুতেই ছাড়ছেন না। হাতে ন্যাপথলিনের গন্ধ। বুড়ো মানুষদের হাতে কি ন্যাপথালিনের গন্ধ হয়?
ইমনের সারাটা দিন কাটল ভয়াবহ উত্তেজনায়। দুবার তাকে রাজহাঁস তাড়া করল। এতে ভয় যেমন লাগছিল মজাও লাগছিল।
বড়ই গাছে উঠে সে নিজের হাতে পাকা বড়ই পেড়ে খেলো। বড়ই গাছে নিজে নিজে ওঠা কঠিন। তবে ছোট চাচা একটা টেবিল এনে গাছের সঙ্গে লাগিয়ে দিলেন। টেবিল থেকে চট করে গাছে ওঠা যায়। তবে খুব বেশী দূর ওঠা যায় না। গাছ ভর্তি কাঁটা।
ছোট চাচা কামরাঙ্গা গাছের ডালে একটা দোলন টানিয়ে দিলেন। খুব অদ্ভুত দোলন–চেয়ার দোলনা। একটা চেয়ারের হাতলের সঙ্গে দড়ি বেঁধে গাছের ডালে ঝলিয়ে দেয়া! কি যে মজার দোলনা। মনে হয় চেয়ারে বসে আছে, সামনে টেবিল। চেয়ার এবং টেবিল দুটাই দুলছে।
তারপর সে ছোট চাচার সঙ্গে গেল ছিপ ফেলে পুকুরে মাছ ধরতে। দুজনের হাতে দুটা ছিপ। ছোট চাচার বড় ছিপ, তার ছোট ছিপ। মাটি খুঁড়ে কেঁচো বের করে, কেঁচো দিয়ে টোপ দেয়া হল। খুবই ঘেন্নার কাজ। মাছ মারতে হলে একটু ঘেন্নার কাজ করতেই হয়। ঢাকার কেউ বিশ্বাস করবে না, কিন্তু ঘটনা একশ ভাগ সত্যি। ইমন তার ছিপে একটা সরপুটি মাছ ধরে ফেলল। মাছটা ধরে তার এত আনন্দ হল যে শব্দ করে কেঁদে ফেলল। ছোট চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, আরো গান্ধা! মাছ ধরে কাঁদছিস কেন? এখানে কাদার কি হল? মাছ ধরতে না পেরে কাদলেও একটা ব্যাপার ছিল। এত বড় মাছ ধরে ফিচ, ফিচ কান্না। ছিঃ!
নিজের মারা সরপুটি মাছ ভাজা দিয়ে সে দুপুরে ভাত খেল। আরো অনেক খাবার ছিল, মুরগীর মাংসের কোরমা ছিল, ডিমের তরকারী ছিল–তার আর কিছুই খেতে ইচ্ছে করল না।
পরদিন আরো বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। ছোট চাচা বললেন, আয় তোকে সাঁতার শিখিয়ে দি। এক দিনে সাঁতার। আমি সাঁতার শিখানোর একজন ওস্তাদ।
সাঁতার শিখতে হলে প্রথম কোন কাজটা করতে হয় বল দেখি?
জানি না।
প্রথম পানিতে নামতে হয়। পানিতে না নেমেও সাঁতার শেখা যায়। সেই সাঁতারের নাম শুকনা সাঁতার। স্থলে বেঁচে থাকার জন্যে এই সাঁতার খুবই প্রয়োজনীয়। বেশীর ভাগ মানুষ শুকনা সাঁতার জানে না বলে স্থলে ভেসে থাকতে পারে না।
তুমি পার?
না, আমিও পারি না।
ইমন ভয়ে ভয়ে চাচার হাত ধরল। পুকুরটাকে খুব গভীর মনে হচ্ছে। পানি কি পরিষ্কার-টলটল করছে। ফিরোজ বলল, ঝুপ করে পানিতে নাম। একদিনে সাঁতার।
ইমন অবাক হয়ে বলল, সত্যি সত্যি একদিনে সাঁতার শিখব।
তোর যদি ইচ্ছা থাকে শিখতে পারবি। ইচ্ছা আছে?
আছে।
পানিতে আমার সঙ্গে নামবি কিন্তু পানিকে ভয় করতে পারবি না। পানিকে ভয় করলে একদিনে সাঁতার শিখতে পারবি না। শুধু মনে রাখবি আমি যখন আছি তখন তুই ড়ুববি না। আমি ধরে ফেলব। আমার উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। পারবি বিশ্বাস রাখতে?
পারব।
তাহলে আয়। শুরু করা যাক। প্রথম এক ঘন্টা শুধু পানিতে দাপাদাপি করবি আমি তোর পেটে হাত দিয়ে তোকে ভাসিয়ে রাখব।
ফিরোজ ইমানকে ভাসিয়ে রাখছে। ইমন প্ৰাণপণে দাপাদাপি করছে। প্রথমে একটু শীত লাগছিল, দাপাদাপির কারণে এখন আর শীত লাগছে না। ইমনের মনে হচ্ছে সে তার বাকি জীবনটা পানিতে দাপাদাপি করে কাটিয়ে দিতে পারবে। সঙ্গে শুধু একজনকে লাগবে যে তাকে ভাসিয়ে রাখবে। ছেড়ে দেবে না।
ইমন দুঘন্টার মাথায় সত্যি সত্যি সাঁতার কাটল। ইমনের চেয়েও অনেক বেশী অবাক হল ফিরোজ। সে মুগ্ধ গলায় বলল—হার্ড নাট! তুইতো সত্যি হার্ড নাট! সত্যি সত্যি একদিনে সাঁতার শিখে ফেললি? তুইতো বড় হয়ে গেছিসরে ব্যাটা!
গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার সময় ইমনের এত মন খারাপ হল যে বলার নয়। বিদায়ের দিন আকলিমা বেগম নাতীকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন। এক ফোঁটাও চোখের জল ফেললেন না। বিদায়ের সময় চোখের জল ফেলতে নেই, অমঙ্গল হয়। এমিতেই এই পরিবারে অমঙ্গলের ছায়া পড়ে আছে। আকলিমা বেগম ধরা গলায় বললেন, ইমাইন্যা।
ইমন বলল, জ্বি দাদীমা।
তোরে একটা কথা বলি—তুই যখন বড় হইয়া বিয়া করবি তখন বউরে নিয়া আসবি। আমিতো বাঁইচ্যা থাকব না। তোরা দুইজনে আমার কবরের সামনে খাড়াবি।
ইমন মাথা কাত করে বলল, জি আচ্ছা।
তোর লাগি আমি আল্লাহ পাকের কাছে খাস দিলে দোয়া করছি। আমার দোয়া আল্লাহপাক কবুল করছেন।
আকলিমা বেগম নাতীর হাতে কাপড়ে মোড়া একটা ছোট্ট উপহার তুলে দিলেন।