Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অন্ধকারের গান (১৯৯৭) || Humayun Ahmed » Page 2

অন্ধকারের গান (১৯৯৭) || Humayun Ahmed

অন্ধকারের গান (১৯৯৭) – Ondhokarer Gaan – 2

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর অলিকের একটা বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে—দুপুরে ঘুমানো। তাদের সব ক্লাস দেড়টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। একটা সাবসিডিয়ারি ক্লাস আছে তিনটায়। সপ্তাহে একদিন। সাবসিডিয়ারির স্যার একদিন আসেন তো তিন দিন আসেন না। পড়ানোরও কোনো আগা মাথা নেই, একদিন যেটা পড়ালেন পরদিন আবার সেটাই শুরু করলেন। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে রাগীরাগী গলায় বলেন, বেশি বুঝতে চেষ্টা করবে না। যতুটুকু বোঝার ততটুকুই বুঝতে চেষ্টা কর। নো মোর, নো লেস।

বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অলিকের মোহ কেটে গেছে। সাবসিডিয়ারি ক্লাসে যাওয়া সে ছেড়ে দিয়েছে। অনার্স ক্লাসও সব কটি করা হয় না। তার ধারণা একটি ক্লাস না করেও ঘরে বসে পড়ে সে চমৎকার রেজাল্ট করে বের হয়ে আসবে। তবে কোনো কোনো টিচার রোলকল করেন। যে কারণে তাঁদের ক্লাস করতে হয়। ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস খুব মজার হবার কথা, তা হয় না। অধিকাংশ ক্লাসই অঙ্কের ক্লাসের মতো মনে হয়। সাহিত্য এত রসকষহীন হবে জানলে সে ইকনমিক্স কিংবা সাইকোলজি নিয়ে নিত।

আজ বুধবার বি আর এর ক্লাস। এই ক্লাসটা মোটামুটি ভালোই হয়। বি আর মন্দ পড়ান না। প্রাইড এন্ড প্রিজুডিস পড়তে ভালোই লাগে। যদিও উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ওপর রাগে গা জ্বলে যায়।

অলিক ক্লাসে গিয়েছিল। ক্লাস হল না। তাদের ক্লাস রুমের ঠিক সামনে একটা বোমা ফেটেছে। মেঝেতে ভাঙা কাঁচের টুকরো ছড়ানো। বোমা ফাটার কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্যি সব শান্ত তবু বি আর ক্লাস নিলেন না। বিরক্ত মুখে বললেন, পড়াশোনা করে কী হবে? যাও বাড়িতে গিয়ে ঘুমাও। অলিক স্যারের কথা অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছে। বাড়িতে এসে কিছু না খেয়েই ঘুম। দরজার বাইরে হাতে লেখা। নোটিশদয়া করে বিরক্ত করবেন না।

কেউ তাকে বিরক্ত করল না। অবশ্যি বিরক্ত করার মানুষও এ বাড়িতে নেই। বাবা বনানী থেকে ফিরবেন রাত আটটার দিকে। বনানীতে তাদের বাড়ি তৈরি হচ্ছে। ঐ নিয়ে তিনি খুব ব্যস্ত। এ বাড়িতে অন্য যারা আছে তারা অলিককে বেশ ভয় করে। যদিও ভয় করার তেমন কোনো কারণ নেই। অলিক কারো সঙ্গেই উঁচু গলায় কথা বলে না।

তার ঘুম ভাঙল বিকেলে। বিকেলে ঘুম ভাঙলে তার খুব অস্থির লাগে। কেন লাগে কে জানে। তখন খুব এক জনপ্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে। মুশকিল হচ্ছে অলিকের তেমন কোনো প্রিয়জন নেই। মাঝে-মাঝে ঘুম ভাঙা মাত্রই সে টেলিফোন তুলে চোখ বন্ধ করে ছটা নাম্বার ঘুরায়। বেশিরভাগ সময় কোনো শব্দ হয় না। আবার মাঝে-মাঝে রিং হয়। তখন দারুণ উত্তেজনার একটা ব্যাপার ঘটেকে টেলিফোন ধরবে? একটি ছেলে ধরবে, না মেয়ে? যদি কোনো ছেলে ধরে তাহলে সে কেমন ছেলে? বুদ্ধিমান না ইডিয়ট শ্রেণীর? ওপার থেকে উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায়, হ্যালো কে বলছেন? হ্যালো। অলিক টেলিফোন নামিয়ে রাখে।

আজ ঘুম ভাঙামাত্র অভ্যাস মতো হাত বাড়িয়ে টেলিফোন রিসিভার টেনে আনল। চোখ বন্ধ করে ছটা নাম্বার ডায়াল করল। রিং হচ্ছে কেউ ধরছে না। পাঁচবার রিং হবার পর অলিক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। দরজা খুলে ময়নার মাকে বলল, চা এবং কিছু খাবার দিতে।

ময়নার মা ভয়ে-ভয়ে বলল, আপনের কাছে কে এক জন আসছে। অনেকক্ষণ হইছে।

ছেলে না

মেয়ে? মেয়ে।

আগে কখনো এ বাড়িতে এসেছিল?

না।

তাহলে চলে যেতে বল।

উনার নাম বীণা বলছে আপনের বন্ধু।

চলে যেতে বল। বীণা নামের কাউকে আমি চিনি না। গায়ে কাপড় কী? শাড়ি না কামিজ?

শাড়ি।

শাড়ির রঙ কি?

সাদার মধ্যে নীল ফুল।

বড় বড় ফুল না ছোট ছোট ফুল?

ময়নার মা মনে-মনে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এই আপা বড় যন্ত্ৰণা করে। মাথা খারাপ করে দেয়।

মেয়েটার চেহারা কেমন?

সুন্দর।

আমার চেয়েও সুন্দর?

অত জানি না আফা। আপনেও সুন্দর উনিও সুন্দর।

অলিক নিচে নেমে এল। মেয়েটি যদি সুন্দর হয় তাহলে এক নজর দেখা যেতে পারে। সে মনে-মনে বলল-I Loved a love once, fairest among women, closed her doors on me, I must not see her, এই কবিতাটা সে গত সপ্তাহে মুখস্থ করেছে। প্রতি সপ্তাহে সে একটা করে কবিতা মুখস্থ করার পরিকল্পনা করেছে। এই সপ্তাহে সুইনবার্নের কবিতা মুখস্থ করার কথা। এখনো কবিতা সিলেক্ট করা হয় নি।

আরে বীণা তুই?

অলিক প্রায় ছুটে গিয়ে বীণাকে জড়িয়ে ধরল। এবং সেখানেই থেমে থাকল না, বীণাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল সোফায়, তবুও ছাড়ল না। গাঢ় গলায় বলল, তুই আমার ঠিকানা পেলি কোথায়?

মালবী দিয়েছে।

তোর কথা আমি কত ভেবেছি। বিশ্বাস কর।

দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাত ছাড়।

না ছাড়ব না। I loved a love once, I must not see her.

তুই আগের চেয়েও পাগল হয়েছিস অলিক।

অলিক হাত ছেড়ে দিল এবং গম্ভীর হয়ে বলল, একটা খবর আছেরে বীণা মা মারা গেছে।

সে কী?

I was so happy, খুবই আনন্দ হয়েছিল।

চুপ কর।

সত্যি কথা বলছি বীণা। মার মৃত্যু আমার জন্যে আনন্দের ছিল।

বলতে বলতে অলিকের চোখে পানি এসে গেল। বীণা অবাক হয়ে বান্ধবীকে দেখছে। কি সুন্দর হয়েছে অলিক। চোখ ফেরানো যায় না, এমন সুন্দর। স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। গায়ের রঙ হয়েছে আরো উজ্জ্বল। চোখ দুটি গভীর কালো। কালো চোখে পানি টলমল করছে। যেন তুলিতে আঁকা ছবি।

অলিক, শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে খুবই সহজ গলায় বলল, মাকে পুরো এগার মাস কষ্ট করতে দেখলাম। সে যে কী অমানুষিক কষ্ট—তুই বিশ্বাস করতে পারবি না। মনে হচ্ছে জীবন্ত একটা প্রাণীর গা থেকে টেনে চামড়া ছাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে।

চুপ কর। শুনতে চাই না।

না তোক শুনতে হবে। শেষ কমাস মা শুধু বলত, তোমাদের পায়ে পড়ি, তোমরা আমাকে মেরে ফেল। প্লিজ প্লিজ।

আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। বুঝলি, একদিন সত্যি-সত্যি মার জন্য বিষ। কিনতে গেলাম। নিউ মার্কেটের একটা ওষুধের দোকানে। দোকানদার ভাবল আমি বোধহয় পাগল।

খালার কী হয়েছিল? কেউ জানে নাকী চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। বিলেতের ডাক্তাররা বললেন, এ রেয়ার স্কিন ডিজিজ। গায়ের পুরো চামড়া পাল্টে নতুন চামড়া লাগালেই শুধু ঠিক হবে। বীণা তুই আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার কথা বলার কেউ নেইরে। আয় আমার ঘরে আয়। আমার সঙ্গে ভাত খাবি।

এখন ভাত খাব কী? পাঁচটা বাজে।

আমি দুপুরে খাই নি, বড় ক্ষিদে লেগেছে। আয় বীণা, না করি না। না বললে আমার খুব খারাপ লাগবে। I might cry.

বীণা অলিককে তার পাশের খবর দিতে এসেছিল, সে তার কোন সুযোগ পেল না। অলিক অনবরত কথা বলছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে বলছে, কথা বলার লোক পা না বীণা। এই জন্যে এত কথা বলছি। রাগ করছিস না তো?

না, রাগ করছি না।

আচ্ছা তোর ঐ দাদী, এখন বেঁচে আছেন? ঐ যে একবার দেখতে গেলাম। পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। তুই পরিচয় করিয়ে দিলি-দাদী, আমার বান্ধবী। আর উনি আমাকে বললেন, ম হারামজাদী।

বীণা অপ্ৰস্তুত গলায় বলল, উনার মাথার ঠিক নেই অলিক।

সেই জন্যেই তো উনাকে আমার এত পছন্দ। আমারো মাথার ঠিক নেই। উনি কি এখনো বেঁচে আছেন?

হ্যাঁ।

জানতাম বেঁচে আছেন। পাগলরা দীর্ঘজীবী হয়। আমিও অনেকদিন বাঁচব।

অলিক সত্যি-সত্যি পাগলের মতোই হাসতে লাগল। বীণা বলল, তোর স্বভাবচরিত্র এতটুকু বদলায় নি। আগে ইংরেজিতে কবিতা লিখতি, এখনো লিখিস?

অলিক জবাব দিল না। ঠোঁট টিপে হাসছে। নিশ্চয়ই কিছু ভাবছে।

এই অদ্ভুত মেয়েটা বীণাদের কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে এসে ভর্তি হল। চশমা চোখের রোগা লম্বা একটি ধারাল চেহারার মেয়ে। কেমন যেন জড়ানো গলায় কথা বলে। কথা বলার সময় স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। একবারও চোখের পাতা ফেলে না। প্রথম দিনেই তার নাম হয়ে গেল সর্পরাণী। কারণ সাপ চোখের পাতা ফেলে না–সাপের চোখের পাতা নেই।

সপ্তাহখানেক পর একদিন টিফিন টাইমে বীণা টিফিন খাচ্ছে, অলিক এসে উপস্থিত। চোখে পলক না ফেলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল, তোমাকে আমি বন্ধু হিসেবে নিলাম। কারণ একমাত্ৰ তুমিই আমাকে সৰ্পরাণী বল নি আর সবাই বলেছে।

বীণা কী বলবে বুঝতে পারল না। অলিক তার পাশে বসে সহজ স্বরে বলল, এখন আমরা বন্ধু হয়েছি। কাজেই আমি আমার জীবনের একটি গোপন কথা তোমাকে বলব। আর তুমি বলবে তোমার জীবনের গোপন কথা। ঠিক আছে?

বীণা হকচকিয়ে বলল, আমার জীবনের কোনো গোপন কথা নেই।

আমার আছে। আমারটা আমি বলছি তোমার জীবনে যদি কখনো কোনো গোপন কথা হয় আমাকে বলবে কেমন? এই বলেই খুবই অবলীলায় অলিক তার জীবনের কথাটা বলল–

আমাদের বাসায় অনেকগুলোবাথরুম। কিন্তু বাথটাব আছে শুধু একটাবাথরুমে। ঐ বাথরুমটা সবার ঘরের সঙ্গে লাগানো। আমি কী করি জানঃ গরমের সময় সব কাপড় ছেড়ে বাথটাবের ভেতর শুয়ে শুয়ে বই পড়ি। একদিন হঠাৎ আমার মনে হল, কেউ যেন আমাকে দেখছে। অথচ দেখার কোন উপায় নেই। কী হোল দিয়ে কিছু দেখা যায় না অথচ রোজ আমার মনে হয় কেউ আমাকে দেখছে। একদিন বুঝলাম সত্যি-সত্যি দেখছে। ইলেকট্ৰিকেল ওয়ারিং-এর জন্যে উপর দিয়ে যে ফুটো করা আছে সেই ফুটো দিয়ে আমাকে দেখছে। আমি শুধু লোটার চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম তবু তাকে চিনলাম। চোখ দেখে মানুষকে চেনা যায়। লোকটা হচ্ছে আমাদের অনেক দূরের আত্মীয়, সম্পর্কে আমার মামা হন, বাবার কারখানায় কাজ করেন।

তুমি কী করলে, সবাইকে বলে দিলে?

না। একদিন তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁকে বললাম, মামা আমাকে যে আপনার এত দেখতে ইচ্ছা করে তা তো জানতাম না। আমাকে বললেই হত। আপনি এত কষ্ট করে দেখেন। মানুষের শরীর তো এমন কিছু না যে কেউ দেখলেই পচে যাবে। এরপর যদি কখনো আপনার দেখতে ইচ্ছা করে আমাকে বলবেন। কষ্ট করার কোনো দরকার নেই। এই বলেই আমি চলে এলাম। তারপর আর কোনোদিন উনি উঁকি দেন নি। গল্পটা মজার না?

বীণা মনে-মনে ভাবল, মেয়েটা বদ্ধ উন্মাদ। এরকম একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় না হওয়াই বোধহয় ভালো। বন্ধুত্বের প্রশ্নই ওঠে না।

তবু বন্ধুত্ব হল। এরকম বন্ধুত্ব যে হাত ধরে বসে না থাকলে ভাল লাগত না। চার মাস মেয়েটি তাদের কলেজে রইল তারপর হঠাৎ একদিন ক্লাসে এসে বলল—তার মা অসুস্থ। মাকে নিয়ে সে বিলেত যাচ্ছে। এর পর আর কোনো যোগাযোগ নেই। অলিক। কোনো ঠিকানা রেখে যায় নি।

বীণাকে অলিকের সঙ্গে বিকেল পাঁচটায় ভাত খেতে হল। বর্ষার সময়, দিন খারাপ করছে আকাশে মেঘ জমছে অথচ অলিক তাকে ছাড়বে না। বীণা বলল, অলিক, • আবার আসব, আজ ছেড়ে দে। বাসায় চিন্তা করবে।

চিন্তা করুক। অসুবিধা কি? একদিন চিন্তা করলে মানুষ মরে যায় না।

তুই আমাদের বাসার ব্যাপারটা জানিস না তাই এ রকম বলছিস। আমি সন্ধ্যার আগে না ফিরলে বাবার হার্ট এ্যাটাক হবে।

এত সহজে মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয় না। হার্ট খুবই শক্ত জিনিস। চোখের সামনে মা মরে গেল, আমার কিছু হয় নি। আমি ইংরেজিতে কিছু কবিতা লিখেছি আয় তোকে শোনাব।

সন্ধ্যা মিলাল। দিন সত্যি খারাপ করেছে, গুড়ু-গুড় করে মেঘ ডাকছে। অলিক শক্ত করে তাকে ধরে আছে। বোঝাই যাচ্ছে এই বাঁধন ছাড়ানো সম্ভব না। সন্ধ্যা পর্যন্ত বীণার বাইরে থাকার ব্যাপারটা যে কত ভয়াবহ অলিক সেটা বুঝতেই পারছে না। এমনিতেই বাবার মেজাজ খারাপ। অফিসে কি নাকি ঝামেলা। ভাইয়া সাত দিন ধরে উধাও। কোনোরকম খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বাবার রাতে ঘুম হয় না। বারান্দায় পায়চারি করেন।

বীণা সন্ধ্যা সাতটার সময় কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, তোর পায়ে পড়ি অলিক। দেখ বৃষ্টি নেমে গেছে।

বর্ষাকালে বৃষ্টি নামবে না? এটা আবার কেমন কথা? এই কবিতাটা শোন, আমার লাস্ট জন্মদিনে লেখা। এটা হচ্ছে সনেট। এলিজাবেথিয়ান সনেট। সনেট কী জানিস তো? চৌদ্দটা লাইন থাকে। মিল হচ্ছে abab, cdcd, efef, gg…………

বীণা ছাড়া পেল রাত আটটায়। অলিক বিরক্ত গলায় বলল, এরকম করছিস কেন? মনে হচ্ছে ফিট হয়ে পড়ে যাবি। যা বাড়ি যা।

কাউকে সঙ্গে দে ভাই, বাসায় পৌঁছে দিক।

কাউকে সঙ্গে দেব না। তুই একা একা যাবি। কি লজ্জার কথা, এতবড় একটা মেয়ে একা বাড়ি যেতে পারছে না। ভাবতেও লজ্জা লাগছে। যা ভাগ।

ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে একাই বীণাকে বাসায় ফিরতে হল। কেন যে গেল অলিকের কাছে? যে সব কথা সে বলতে গিয়েছিল তার কোনোটাই বলা হয় নি। তার রেজাল্টের কথাটা পর্যন্ত বলতে পারল না। এখন রাত দুপুরে একা একা ফিরতে হচ্ছে। রাস্তা অন্ধকার। রিকশাওয়ালার ভাবভঙ্গি যেন কেমন-কেমন। বার-বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে। কোনো রিকশাওয়ালা তো এরকম করে তাকায় না। একবার সে রিকশা থামাল, বীণার বুক ধ করে উঠল। শুধু শুধু রিকশা থামাল কেন? কী চায় সে? বীণা এখন কী করবে? চিৎকার দেবে? রাস্তায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চিৎকার করলে কেউ কি শুনবে?

পৌঁছতে পৌঁছতে রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল। বীণা রিকশায় বসে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। পথ যেন তার ফুরাচ্ছে না।

মিজান সাহেব সন্ধ্যা থেকেই কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে একটা টর্চ লাইট। মাথার উপর ছাতা ধরা থাকা সত্ত্বেও তিনি কাকভেজা হয়ে গেছেন গায়ে জ্বরও আসছে। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। বীণা যখন রিকশা থেকে কাঁপা গলায় ডাকল, বাবা তখনো ঘোর কাটল না। বীণা বলল, উঠে আস বাবা। তিনি উঠলেন না। একবার শুধু টর্চ ফেলে বীণার মুখের দিকে তাকালেন। তারপরই টর্চ নিভিয়ে রিকশার পেছনে পেছনে আসতে লাগলেন।

দুঘন্টা হয়েছে বীণা ঘরে এসেছে। মিজান সাহেব এই দুঘন্টায় একটি কথাও বলেন নি। কাপড় বদলে খাওয়া-দাওয়া করেছেন। বারান্দায় জলচৌকিতে বসে দুটো সিগারেট শেষ করেছেন। সমস্ত ঘরের আবহাওয়া থমথমে। ফরিদা স্বামীর পাশে পাশে আছেন। লীনা ও বাবলু খুবই উঁচু গলায় পড়ছে। যেন তাদের সমস্ত ইন্দ্ৰিয় পড়ার বইতে। মিজান সাহেব দ্বিতীয় সিগারেটটা শেষ করলেন না, বৃষ্টির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে শীতল গলায় বললেন, বীণাকে আমার ঘরে পাঠাও।

ফরিদা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, মেয়ে বড় হয়েছে, মারধোর করবে না।

যা করতে বলছি, কর।

বীণা মাথা নিচু করে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আতঙ্কে তার মুখ নীল। মিজান সাহেব স্ত্রীকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দরজা বন্ধ করে দিলেন। পরবর্তী কিছু সময় পর্যন্ত মিজান সাহেবের কোনো জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখলেন বীণা মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে, তার ঠোঁট কেটে গলগল করে রক্ত পড়ছে। ফরিদা প্রাণপণে দরজা ধাক্কাচ্ছেন। বাবলু ও লীনা চিৎকার করে কাঁদছে। এক সময় মিজান সাহেব দরজা খুললেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই শুধু লীনা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে বলল, আপা মরে গেছে। ও আম্মা, আপা মরে গেছে।

রাত প্রায় দুটোর মতো বাজে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মিজান সাহেব ঘুমান নি। জলচৌকির উপর বসে আছেন। বারান্দায় বাতি নেভানো। তবু বারান্দা পুরোপুরি অন্ধকার হয় নি। আকাশে চাঁদ আছে। তার ক্ষীণ আলোয় সব কিছুই ম্লানভাবে নজরে আসে।

মিজান সাহেব জলচৌকি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নিঃশব্দে তার ঘরের জানালার সামনে এসে দাঁড়াতেই বৃদ্ধা বললেন, কী চাসরে মিজান?

মিজান সাহেব বললেন, বীণা কি ঘুমুচ্ছে?

হ ঘুমাইতেছে। তুই কামটা কী করলি?

তিনি জবাব দিলেন না। বৃদ্ধা বললেন, তোর মাথাটা খারাপ হইছে। তুই একটা তাবিজ কবচ নে। একটা ডাক্তার দেখা। তোর মইদ্যে আমি মাথা খারাপের লক্ষণ দেখি।

তিনি চুপ করে রইলেন। তাঁর খুব ঘরে ঢোকার ইচ্ছা হচ্ছিল। ঢাকা সম্ভব নয়। দরজা খুলতে হলে বীণাকে জাগাতে হবে। বীণাকে জাগাতে ইচ্ছা করছে না।

বৃদ্ধা বললেন, ভিতরে আয় দরজা খোলা।

তিনি ভেতরে ঢুকলেন।

বৃদ্ধা বললেন, এক কাম কর। মেয়ের মাথায় হাত দিয়া মনে-মনে মেয়ের কাছে। মাফ চা। মাফ না চাইলে তুই মনে শান্তি পাইবি না। আর এর মধ্যে দোষের কিছু নাই।

মিজান সাহেব এগিয়ে এসে মেয়ের পিঠে হাত রাখলেন।

ও মিজান।

কি?

মেয়েটার বিয়া দে। তার কাছে মেয়েটা কষ্ট পাইতেছে।

মিজান সাহেব জবাব দিলেন না। তাঁর চোখে পানি এসে গেছে। তিনি লজ্জিত বোধ করছেন। ঘর অন্ধকার নয়ত আরো বেশি লজ্জা পেতেন। অবশ্যি আলো থাকলেও তাঁর মা তাকে দেখতে পেতেন না।

ও মিজান।

কি?

যা ঘরে যা। ঘরে গিয়ে ঘুমা।

মিজান সাহেব বের হয়ে এলেন। তিনি অবশ্যি জানতে পারলেন না যে বীণা ঘুমায় নি। জেগেই ছিল। জানলে তাঁর কেমন লাগত কে জানে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress