অন্ধকারের গান (১৯৯৭) – Ondhokarer Gaan – 14
বুলুর পায়ে গ্যাংগ্রিন ধরা পড়েছে।
দুবার অপারেশন হল। তৃতীয় বারও সম্ভবত হবে। দুজন ডাক্তারের এক জন কিছুতেই পা এম্পুট করতে রাজি না। সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যেতে চান। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচারী মেদিনীর মতো অবস্থা। এই ডাক্তারটির বয়স অল্প। হৃদয় কঠিন হতে শুরু করে নি। তিনি রাউন্ডে এসে বুলুর বিছানার সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়ান। বুলুর পা পরীক্ষা করেন। এই সময় গভীর বিরক্তিতে তার মুখ অন্যরকম হয়ে যায়। বুলু বলে, আপনি কেমন আছেন স্যার?
তিনি কঠিন গলায় বলেন, ভালো।
আমার পা কেমন দেখলেন?
তিনি জবাব দেন না। বুলু নিচু গলায় বলে, কেটে ফেলে দেবেন কবে?
সময় হলেই ফেলা হবে। আপনি চুপ করে থাকুন।
বেশিরভাগ সময় বুলু চুপ করে থাকে। একটা ঘরের মধ্যে তার সময় কাটে। তন্দ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি এক ধরনের আচ্ছন্ন অবস্থা। যে অবস্থায় চারপাশের জগৎটাকে খুবই অবাস্তব মনে হয়। তার পাশের বেডের দাড়িওয়ালা কালো মানুষটাকে এক সময় খুবই পরিচিত মনে হয় আবার পরমুহূর্তেই মনে হয়—দাড়িওয়ালা এই ছাগল কে?
এই লোকটি বলকে খুব বিরক্ত করে। অকারণে কথা বলে। বলর অসহ্য লাগে বুলু বিরক্ত হয় এমন কাজগুলো সে নিষ্ঠার সঙ্গে করে। কাল দুপুরে কট কট শব্দ করে কী যেন খাচ্ছিল। শব্দটা চট করে বুলুর মাথায় ঢুকে গেল। মাথার ভেতর কট কট শব্দ হতে থাকল। বুলুর এই এক সমস্যা হয়েছে যে কোনো শব্দই চট করে মাথায় ঢুকে যায়। তারপর মাথার ভেতর সেই শব্দ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। লোকটা কট কট শব্দে খাচ্ছে সেই শব্দ পাক খাচ্ছে বুলুর মাথায়। বুলু বলল, কি খান?
লোকটি সঙ্গে-সঙ্গে টিফিন ক্যারিয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন ভাইজান খান।
না আমি খেতে চাই না। আপনি নিজেই খান, তবে দয়া করে কট কট শব্দ করবেন না।
জ্বি আচ্ছা।
বুলু চোখ বন্ধ করল। যখন ঘুম এসে যাচ্ছে তখন আবার কট কট শব্দ শুরু হল। দাড়িওয়ালা লোকটা খাওয়া শুরু করেছে। বুলু থমথমে গলায় বলল, এই যে ভাই আর একবার যদি কট কট শব্দ হয় তাহলে কিন্তু ধাক্কা দিয়ে আপনাকে জানালা দিয়ে ফেলে। দেব।
জ্বি আচ্ছা।
দাড়িওয়ালা এই লোকটির নাম শামসু। একটা লেদ মেশিন চালায়। বুলু যখন কিছুটা ভালো থাকে তখন তার সঙ্গে অনেক কথা কথা বলে। লোকটি প্রতিটি বাক্যে খুব মিষ্টি করে একবার হলেও ভাইজান বলে। বুলুর শুনতে ভালো লাগে। লোকটির বেশিরভাগ কথাই হচ্ছে লেদ মেশিন সংক্রান্ত।
ভাইজান লেদ মেশিন যন্ত্রটা হইল দুনিয়ার এক আজিব চিজ।
তাই নাকি?
জ্বি ভাইজান। এই যন্ত্র যে জানে সে দুনিয়ার সবই জানে।
আপনি জানেন?
নিজের মুখে কি বলব ভাইজান আপনে ধোলাই খালে গিয়া শুধু জিজ্ঞাসা করবেন—শামসু কারিগর। দেখবেন আফনের কি খাতির।
আপনাদের কি কারিগর বলে নাকি?
না মিস্তিরি বলে। আমারে খাতির কইরা কারিগর ডাকে। আপনার সঙ্গে যখন খাতির হইল তখন আর চিন্তা নাই। কথা দিলাম আফনেরে কাজ শিখায়ে দিব।
আমি কাজ শিখে কী করব?
যন্ত্র চালাইবেন। চাকরি-বাকরি দিয়া কি হয় বলেন ভাইজান? কয় পয়সা বেতন? স্বাধীন ব্যবসার মতো জিনিস আছে?
আর কথা বলবেন না ভাই। যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে। ভালো লাগছে না।
দমে দমে আল্লাহু বলেন ভাইজান।
চুপ থাকতে বললাম না।
নিঃশ্বাসটা নেওয়ার সময় বলেন আল্লা ছাড়ার সময় বলেন হুঁ। এতে কাজ হয়।
চুপ। একটা কথা না। ব্যাটা ছাগল।
শামসু দুঃখিত চোখে তাকায়। আশ্চর্যের কথা সেই দুঃখী চোখে প্রচুর মমতাও ঝরে পড়ে।
আজ বুলুর পায়ের যন্ত্রণা খুব বেড়েছে।
নার্স এসে কড়া ধরনের কোনো পেইন কিলার দিয়েছে যা তার পায়ের ব্যথা একটও না কমিয়ে মাথাটাকে কেমন ভোঁতা বানিয়ে দিয়েছে। কানের কাছে পিন পিন শব্দ হচ্ছে। যেন বেশ কিছু মশা দুকানের ভেতর দিয়ে মাথায় ঢুকে গেছে।
রাত আটটার মতো বাজে। মিজান সাহেব ছেলের বিছানার পাশে বসে আছেন। আজ রাতটা তিনি ছেলের সঙ্গেই কাটাবেন। প্রায়ই কাটান। অফিস থেকে সরাসরি এখানে চলে আসেন। খুব যেদিন বাড়াবাড়ি দেখেন সেদিন আর বাসায় যান না।
বুলু ডাকল, বাবা।
মিজান সাহেব নড়ে চড়ে বসলেন। কিছু বললেন না। বুলু বলল, আমি পাশ না করার জন্য খুব লজ্জিত বাবা। থার্ড পেপারটা এমন খারাপ হল।
মিজান সাহেব বললেন, এটা নিয়ে পরে আলাপ করব।
পরীক্ষার হলে খুব নকল হচ্ছিল একবার ভাবলাম—তারপর বাবা মনটা সায় দিল। না।
এখন এইসব থাক।
আমি এতক্ষণ কী ভাবছিলাম জান? ভাবছিলাম যদি নকল করে পরীক্ষায় পাশ করে ফেলতাম তাহলে বাড়ি থেকে পালাতাম না। পায়ে কাঁটা ফুটত না, ডাক্তারেরা পা কেটে বাদ দিত না।
পা কাটার কথা এখনি ভাবছিস কেন? ডাক্তাররা তো চেষ্টা করছেন।
আর চেষ্টা করে কিছু হবে না।
বুলু চোখ বন্ধ করে ফেলল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
দীর্ঘ সময় একা একা বসে থাকা যায় না। মিজান সাহেব অফিসের ফাইল খুললেন। যদি টাকাটার কোনো হদিস পাওয়া যায়। ব্যাংক থেকে ছবছরের স্টেটমেন্ট নিয়ে এসেছেন। মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছেন। যদি এমন কোনো চেক বেরিয়ে পড়ে যার উল্লেখ খাতাপত্রে নেই। রেকর্ড হারিয়ে গেছে। অসম্ভব তো কিছু না।
বুলুর ঘুম ভেঙেছে। সে আগ্রহ নিয়ে তার বাবাকে দেখছে। মানুষটা কি অদ্ভুত। এর মধ্যে খাপত্র নিয়ে মগ্ন হয়ে গেছে। বুলু মৃদু সুরে ডাকল, বাবা।
তিনি চোখ তুলে তাকালেন।
বুলু বলল, ফেল করায় তুমি কি রাগ করেছ?
মিজান সাহেব বললেন, হ্যাঁ। একমাত্র গাধারাই তিনবার বি. এ ফেল করে।
বুলুর কেন জানি হাসি পাচ্ছে। কি অদ্ভুত মানুষ তার এই বাবা। ছেলের এই অবস্থাতেও সান্ত্বনার একটা কথাও বলছেন না। আশ্চর্য তো। বুলু তাকিয়ে আছে। মিজান সাহেব আবার হিসাব নিকাশ শুরু করেছেন।
বুলুর আবার ঘুম পাচ্ছে।
অথচ ঘুমুতে ইচ্ছা করছে না। পায়ের ব্যথা তীব্র হলেই ঘুম পায়। এই ঘুম স্বাভাবিক ঘুমের মতো নয়। অন্যরকম ঘুম। এই ঘুমের সময় আশেপাশের অনেক কিছু টের পাওয়া যায়। ঘুমের ঠিক আগে আগে মাথায় কোনো চিন্তা এলে সেই চিন্তা ঘুমের মধ্যেও থাকে। মাথার মধ্যে ক্রমাগত তা ঘুরপাক খেতে থাকে। একবার ঘুমুতে যাবার ঠিক আগমুহূর্তে মাথায় এল তিনের ঘরের নামতা। তিন চারে বার, তিন পাঁচে পনের…..। মাথায় এই নাম থেকেই গেল। ক্রমাগত কেটে যাওয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো মাথার গভীরে বাজতে থাকল— তিন চারে বার, তিন পাঁচে পনের, তিন ছয় আঠার……
এই ঘুম ও জাগরণ বড় অদ্ভুত। কোটা স্বপ্ন কোন্টা বাস্তবে ঘটছে ঠিক বোঝা যায় না। বীণার সেই বন্ধুটি একবার তাকে দেখতে এসেছিল। সত্যি এসেছিল কিনা সে জানে না। হয়ত সে সত্যি-সত্যি আসে নি। হয়ত এটা কল্পনা। কি কে জানে। সত্যি-সত্যি হয়ত এসেছিল। অলিক ঘরে ঢুকেই বলল, আমার চিঠিটা কি আপনি পেয়েছিলেন?
বুলু বলল, হ্যাঁ।
বীণা কি সত্যি-সত্যি আপনাকে চিঠি দিয়েছে?
হ্যাঁ।
চিঠি পড়ে কি আমাকে আপনার খুব খারাপ মেয়ে মনে হল?
না।
আপনি কি হ্যাঁ এবং না ছাড়া কিছু বলতে পারেন না?
বুলু হাসল। অলিক বলল, এখন বলুন, আপনার পায়ের অবস্থা কেমন?
অবস্থা বেশি ভালো না।
কেটে বাদ দিয়েছে?
এখনো দেয় নি। শিগগিরই দেবে।
ঐ কাটা পা আপনি তখন কী করবেন? সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন?
কি অদ্ভুত প্রশ্ন। অথচ মেয়েটার মুখে প্রশ্নটা মানিয়ে গেছে। মোটেই অদ্ভুত মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এটাই খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন।
কি কথা বলছেন না কেন? কাটা পা নিয়ে আপনি কী করবেন?
আপনি কী করতেন?
আমি সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। আমি কি আমার শরীরের এত বড় একটা অংশ ফেলে যাব নাকি?
বুলু হেসে ফেলল। অলিক হাসল না। সে চোখ তীক্ষ্ণ করে বলল, যন্ত্রণা কি খুব বেশি?
হ্যাঁ বেশি।
অসহ্য যন্ত্রণা তাই না?
ঠিক অসহ্য নয়। সহ্য করতে পারি তবে অন্য একটা ব্যাপার হয় যা সহ্য করা যায় না।
বলুন তো শুনি।
আপনি শুনে কী করবেন?
আমার দরকার আছে। এই ব্যাপারগুলো আমার জীবনে ঘটবে, কাজেই আগে থেকে আমাকে তৈরি থাকতে হবে।
মাঝে মাঝে কিছু কিছু জিনিস আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
বলেন কি?
এখন আমার মাথায় ঘুরছে তিনের ঘরের নামতা। তিন দুগুনে ছয়। তিন ত্রিকে নয়, তিন চারে বার, তিন পাঁচে পনের……
অলিক হেসে ফেলল।
বুলু বলল, হাসছেন কেন?
নামতার বদলে একটা মজার কিছু আপনার মাথায় ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয় ভাবছি।
মজার কিছু মানে?
ধরুন আমি যদি এখন আপনাকে বলি–I LoveYou, তাহলে ভালো হয় না? আপনার মাথার মধ্যে ক্রমাগত ঘুরবে—I Love You, I Love You, নামতার চেয়ে এটা ভালো না?
এই জাতীয় কথাবার্তা বুলুর সঙ্গে কি সত্যি হয়েছিল? না পুরোটাই তার কল্পনা কিংবা স্বপ্নে দেখা দৃশ্য। অসুস্থ অবস্থায় স্বপ্নগুলো খুব বাস্তব হয়। স্বপ্নে বর্ণ থাকে গন্ধ থাকে।
বুলু ঘুমিয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে লক্ষ করল ডাক্তার সাহেব ঢুকছেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরে তার পা দেখলেন। বুলু বলল, স্যার কি অবস্থা?
ডাক্তার শুকনো গলায় বললেন, আপনার কাছে কেমন মনে হচ্ছে?
ভালো মনে হচ্ছে না।
দেখি আরেকটা অপারেশন হোক!
কবে হবে?
দুএক দিনের মধ্যেই হবে। আপনি মনে সাহস রাখুন।
রাখতে চেষ্টা করছি। অপারেশনে কিছু না হলে কী করবেন?
পা এ্যামপুট করব।
বুলু খুব সহজ গলায় বলল, কাটা পা কিন্তু আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব ডাক্তার সাহেব। আপনি যেন ওটা আবার ফেলে দেবেন না।
ডাক্তার সাহেব শীতল চোখে বুলুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুলু ঘুমিয়ে পড়ল। এক সময় ঘুম ভাঙল। কতক্ষণ পর ভাঙল কে জানে? বাবা এখনো খাপত্রের ওপর ঝুঁকে আছেন। বুলু ডাকল, বাবা।
মিজান সাহেব চোখ না তুলেই বললেন, কি?
বুলু মনে করতে পারল না, বাবাকে সে তুমি করে বলে, না আপনি করে বলে। তার মনে হল সে আপনি করেই বলে। বুলু বলল, এত কিসের হিসাব নিকাশ করছেন?
মিজান সাহেব ফাইল বন্ধ করে বললেন, অফিসের একটা হিসাব। লাখ দু-এক টাকার হিসাব মিলছে না। বুলু তাকিয়ে আছে বাবার দিকে।
মিজান সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, হিসাব মিলাতে পারছি না। গনি সাহেবের ধারণা আমি বোধ হয় তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। তাঁর মনে হল তাঁর নিজের মাথাও বোধ হয় এলোমেলো হয়ে আছে। ছেলেকে এইসব কথা বলার কী অর্থ থাকতে পারে। বুলু বলল, তুমি বাসায় চলে যাও বাবা। বাসায় গিয়ে ঘুমাও।
বুলু লক্ষ করল সে তুমি করে বলছে। বাবা তাতে চমকে উঠছেন না। তার মানে সে হয়ত তুমি করেই বলত।
বাবা।
কি?
আমি ঠিক করেছি আবার বি.এ পরীক্ষা দেব। এইবার পাশ করবই।
ভালো।
তুমি বাসায় চলে যাও। বাসায় গিয়ে আরাম করে ঘুমাও।
ওরা তো কেউ আসছে না।
চলে আসবে। আর না আসলেও কোনো অসুবিধা নেই।
মিজান সাহেব বিড় বিড় করে বললেন, হিসাবটা মিলছে না, বুঝলি? কেন এ রকম হল বুঝতে পারছি না।
বুলু বলল, সব হিসাব কি আর সব সময় মেলে বাবা?