Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

প্রমিতার মেয়ে বাবলি

প্রমিতার মেয়ে বাবলির জন্মদিন অগাস্টের সাত তারিখে, আর ইরার ছেলে পিকলুর জন্মদিনও ঠিক সেইদিন। সুতরাং দুই বান্ধবীই এই তারিখটা খুব খেয়াল রাখে।

এবছর আট তারিখ রবিবার। শনিবার ইদের ছুটি। চমৎকার ব্যাপার। আগে থেকে ঠিক করা ছিল এ-বছর ওই সময়, দুটি পরিবারই একসঙ্গে বেড়াতে যাবে ডায়মণ্ড হারবার, সেখানেই একসঙ্গে জন্মদিনের উৎসব হবে পিকলুর আর বাবলির।

ডায়মণ্ড হারবারে ইরার মামাদের বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে অনায়াসে যাওয়া যায়। শনিবার সকালে গিয়ে রবিবার সন্ধ্যের পর ফিরে আসা!

ইরার স্বামী ট্রেনিং-এর জন্য গেছে কুয়ালালামপুর। সুতরাং প্রমিতার স্বামী শৈবালকেই সব ব্যবস্থার ভার নিতে হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবু শৈবালের মন খুঁতখুঁত করে।

বেড়াতে যে ভালোবাসে না শৈবাল তা নয়। ডায়মণ্ড হারবারে উইক-এণ্ড কাটিয়ে আসা তো বেশ ভালো প্রস্তাব। কিন্তু ইরার সঙ্গে কি পাল্লা দিয়ে পারা যাবে। ইরা মুঠো মুঠো টাকা খরচ করে, টাকাপয়সার হিসেবেরই ধার ধারে না সে। অথচ, পুরুষসঙ্গী হিসেবে শৈবালেরই খরচ করা উচিত বেশি। কিন্তু শৈবালের হাতে টাকা জমে না। কী একটা কারণে যেন দু-তিন মাস ধরে বেশ টানাটানি চলছে।

পাঁচ তারিখে অফিসে বেরোবার মুখে শৈবাল বলল, কালই হয়তো আমায় একবার এলাহাবাদ যেতে হতে পারে।

প্রমিতা অবাক। এলাহাবাদ? সে কী! একদিনের মধ্যে গিয়ে ফিরে আসা যায় নাকি? কাল এলাহাবাদ যাবে মানে? কবে ফিরবে?

গেলে রবিবার রাত্তিরের আগে কী আর ফেরা যাবে?

তার মানে? আমাদের ডায়মণ্ড হারবার যাওয়া সব ঠিকঠাক।

কিন্তু অফিসের কাজ পড়লে কি না বলা যায়?

সাত, আট তারিখে তোমার ছুটি। তার মধ্যেও অফিসের কাজ?

আমাদের কি আর ছুটি বলে কিছু আছে?

কেন, তুমি এলাহাবাদে সোমবার যেতে পারো না?

একটা জরুরি টেণ্ডারের ব্যাপার আছে, জি এম বলছিলেন…

প্রমিতা রাগে মুখখানা গনগনে করে তাকাল স্বামীর দিকে। রাগ কিংবা আনন্দ কিংবা সবগুলিই প্রমিতার খুব তীব্র। সঙ্গে সঙ্গে মুখে তার ছাপ পড়ে।

আমাদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা উঠলেই তোমার কাজ পড়ে যায়। আমি প্রত্যেকবার দেখেছি। তার মানে তুমি আমাদের নিয়ে যেতে চাও না।

না, আমারও তো খুব ইচ্ছে, দেখি অফিসে আজ একবার বলে—

কোনো দরকার নেই। আমি ইরাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি, যাওয়া হবে না।

আরে আরে, হঠাৎ রেগে যাচ্ছ কেন? যাওয়া বন্ধ করবে কেন? যাওয়া হবেই, বাচ্চারা আশা করে আছে, আমি যদি না-ও যাই, তোমরা যেতে পারবে না?

এই বাচ্চাদের নিয়ে আমরা শুধু মেয়েরা যাব?

আজকাল স্ত্রী স্বাধীনতার যুগে–পুরুষদের বাদ দিয়ে তোমরা কোথাও যেতে পারবে না? তোমার বান্ধবী ইরা খুবই এফিসিয়েন্ট

প্রমিতা ঢুকে গেল রান্নাঘরে। একটু পরেই দুধ পোড়ার গন্ধে ভরে গেল সারা ফ্ল্যাট। অনন্তকে দোকানে পাঠানো হয়েছে, যাওয়ার সময় সে বলে গিয়েছিল, বউদি, গ্যাসটা বন্ধ করে দেবেন কিন্তু

এইরকম কোনো ব্যাপার হলেই প্রমিতা তার স্বামীকে দায়ী করে।

তোমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই তো দুধটা পুড়ে গেল। অন্য দিন হলে রাগতভাবে এই কথাটা বলত প্রমিতা। আজ কিছুই বলল না, দাঁড়িয়ে রইল রান্নাঘরে। সুতরাং শৈবাল বুঝল, অবস্থা খুব গুরুতর।

অনেক গোপন কথা থাকে, যা নিজের স্ত্রীকেও বলা যায় না।

গতবছর কোলাঘাট বেড়াতে গিয়ে ডাব খাওয়া হয়েছিল। ছ-খানা ডাবের দাম ডাবওয়ালা চেয়েছিল ন-টাকা। যদিও সাইজ বেশ বড়ো ছিল, তবু দেড় টাকা করে একটা ডাব? এ তো দিনে ডাকাতি। গাড়ি-চড়া বাবু আর বিবিদের দেখে লোকটা যা-খুশি দাম হাঁকিয়েছে।

ইরাকে দাম দিতে দেয়নি শৈবাল, সে নিজেই টাকা বার করেছিল। অনেক দর কষাকষি করে রফা হল সাত টাকায়। শৈবাল দাম মিটিয়ে দেওয়ার পর ইরা বলেছিল, বাবাঃ, আপনি দরাদরিও করতে পারেন বটে! বেচারার মুখখানা কেমন করুণ হয়ে গেছে। তারপর নিজের হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে একটা দু-টাকার নোট বার করে ডাবওয়ালার দিকে এগিয়ে দিয়ে ইরা বলেছিল, এই নাও তোমারই-বা আর মনে দুঃখ থাকে কেন?

সে-দিন খুব অপমানিত বোধ করেছিল শৈবাল। সামান্য দু-টাকার জন্য নয়, লোকটা তাকে ঠকাচ্ছে বুঝতে পেরেই সে সাত টাকা দিয়েছিল। তারপর ইরার ওইরকমভাবে টাকা দেওয়া কি ঠিক হয়েছে?

সে-রাত্রে শৈবাল স্ত্রীকে বলেছিল, তোমার বান্ধবী ইরা বড় চালিয়াত। তখন ও ডাবওয়ালাকে হঠাৎ আবার টাকা দিতে গেল কেন?

প্রমিতা অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিল, ও মা, সেকথা তুমি মনের মধ্যে পুষে রেখেছ। একটা গরিব ডাবওয়ালাকে সামান্য দু-টাকা যদি বেশি দিয়েই থাকে, তাতে কী হয়েছে? মাঝে মাঝে তুমি এত কৃপণ হয়ে যাও

শৈবাল হল কৃপণ? কোলাঘাটে বেড়ানো উপলক্ষ্যে শৈবাল যে আড়াইশো টাকা খরচ করল, সেটা কিছু নয়? আর ডাবওয়ালাকে ন্যায্য দাম দিতে গেছে বলেই সে কৃপণ হয়ে গেল। শৈবাল নিজে ভালো করেই জানে সে কৃপণ নয়। কিন্তু বিনা কারণে পয়সা নষ্ট করতে তার গায়ে লাগে।

অফিস থেকে সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ফিরতেই বাবলি বলল, বাবা, আমাদের ডায়মণ্ড হারবার যাওয়া হবে না? কেন যাওয়া হবে না? মা বলছিল

মেয়েটার মুখ দেখেই ধক করে উঠল শৈবালের বুকের মধ্যে। কত আশা করেছিল ওর জন্মদিন উপলক্ষ্যে পিকনিক হবে। ওর মনে আঘাত দিতে পারবে না শৈবাল।

ন-বছর বয়স বাবলির। মায়ের চেয়ে বাবাকে বেশি ভালোবাসে। ওর ছোটোভাই রিন্টু মায়ের বেশি প্রিয়। বাবলিকে কাছে টেনে নিয়ে শৈবাল বলল, হ্যাঁ যাওয়া হবে, আমি অফিসে ব্যবস্থা করে এসেছি

আসলে এলাহাবাদে যাওয়ার কথা ওর সহকর্মী চক্রবর্তীর। শৈবাল ভেবেছিল, চক্রবর্তীকে অনুরোধ করে তার বদলে ও নিজেই যাবে।

প্রমিতার মুখে এখনও রাগ রাগ ভাব। সে বলল, না, আমরা যাব না। দুপুরে ইরা এসেছিল, তাকে আমি বলে দিয়েছি, আমাদের যাওয়া হচ্ছে না, ইচ্ছে করলে ও একলা যেতে পারে।

হালকা গলায় শৈবাল বলল, ইরাকে ফোন করে দাও। বলো যে, আমাদের আবার যাওয়া ঠিক হয়েছে।

ইরাদের ফোন খারাপ।

তা হলে চিঠি লিখে অনন্তকে দিয়ে পাঠাও। কিংবা চলো আমরাই এখন বেড়াতে যাই ইরার কাছে। এক্ষুনি সব ঠিকঠাক করে আসি।

আস্তে আস্তে প্রমিতার মুখের রং বদলাতে লাগল। শৈবালের সবতাতেই হাসি-ঠাট্টা। কোনটা যে কখন সিরিয়াসভাবে বলে, তা বোঝাই যায় না।

যাওয়া হবে ইরার গাড়িতে। অনেক দিন বোম্বেতে ছিল, খুব ভালো গাড়ি চালায়। ওর গাড়িতেই দু-জন ধরে যাবে।

শৈবাল বলেছিল, ট্রেনে যাওয়াই তো ভালো। ডায়মণ্ড হারবারে ট্রেনে যেতে কোনো অসুবিধেই নেই। ঘণ্টা দেড়েকের জার্নি।

কিন্তু ইরা গাড়ি ছাড়া কোথাও এক পা যেতে পারে না। তা ছাড়া ডায়মণ্ড হারবার থেকে এদিক-ওদিক একটু বেড়াতে হলে গাড়ি লাগবে। ইচ্ছে হলে কাকদ্বীপ কিংবা নামখানা ঘুরে আসা যায়! গাড়ি যখন আছেই, তখন নিতে আপত্তি কী?

ঠিক আপত্তিটা যে কী, তা ঠিক খুলে বলা যায় না।

গাড়ি চালাবে ইরা, শৈবালকে তার পাশে বসতে হবে। আজকাল অনেক ব্যাপারেই নারী ও পুরুষ সমান। মেয়েরাও আজকাল হাই কোটে জজ হয়, তা ঠিক। তবু একটা মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, আর একজন পুরুষ তার পাশে বসে আছে, এটা দৃষ্টিকটু লাগে।

এখানে আমাদের এই দেশে রাস্তার লোকে অবাকভাবে তাকিয়ে দেখে।

প্রমিতা নিজেই তো একদিন ঠাট্টা করে বলেছিল, ইরা সবসময় আমাদের নিয়ে যায়..তুমি গাড়ি চালানোটা শিখে নিতে পারো-না। তোমাদের অফিসে তো কত গাড়ি!

এ-রকম কথা শুনলে শৈবালকে শুধু বোকার মতন একটু হাসতে হয়, কোনো উত্তর দেওয়া যায় না। গাড়ি চালানো শিখলে-বা কী হত? গাড়ির ব্যাপারে ইরা দারুণ খুঁতখুঁতে, স্টিয়ারিং-এ অন্য কারুকে হাত দিতে দেয় না। সেইজন্যেই তো ড্রাইভার রাখতে চায় না ইরা।

ইরা বলল, ওর বাড়িতে যে মেয়েটি কাজ করে, সেই হেনাকে নিয়ে যাওয়া হবে।

কেন?

বাঃ ওখানে আমার মামাবাড়িতে শুধু তো একজন দারোয়ান আছে, আর কেউ নেই। রান্নাবান্না, মশলা বাটা, তরকারি, মাছ কোটা–এসব কে করবে?

প্রমিতা বলল, তাহলে তো আমাদের অনন্তকে নিয়ে গেলে হয়। ও তো ফ্ল্যাটে একলাই থাকবে। তার বদলে ও বরং আমাদের সঙ্গে চলুক!

কিছুদিন ধরে অনন্ত প্রায়ই জ্বরে পড়ছে। বাড়িতে যেসব টুকিটাকি ওষুধ থাকে, প্রমিতা তাই দেয়। একটু কমে ক-দিন পরে আবার জ্বর আসে!

সে জ্বর-গা নিয়েই কিন্তু অনন্ত কাজ করে, বাজারে যায়। বারণ করলেও শোনে না। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো।

প্রমিতা জিজ্ঞেস করল, কী রে অনন্ত, তুই যাবি আমাদের সঙ্গে ডায়মণ্ড হারবার?

অনন্ত ঘাড় হেলিয়ে জানাল, হ্যাঁ।

শরীর ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ।

ইরা বলল, অনন্ত গেলে আরও ভালো হয়। ও তো খুব কাজের ছেলে।

এই প্রস্তাব শুনে শৈবাল খুব খুশি। গাড়িতে এত আটবে না। তাহলে মেয়েদের আর বাচ্চাদের ইরার গাড়িতে তুলে দিয়ে সে আর অনন্ত ট্রেনে চলে যাবে।

যাওয়ার আগের দিন রাত্রে শুয়ে শুয়ে প্রমিতাকে একথা জানাতেই সে ফোঁস করে উঠল।–তা কখনো হয়? আজকাল রাস্তাঘাটে কতরকম বিপদ-আপদ হতে পারে, কিংবা হঠাৎ যদি নিরালা কোনো জায়গায় গাড়িটা খারাপ হয়ে যায় তখন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে…একজন পুরুষমানুষ সঙ্গে না থাকলে কি চলে।

ইরা যতখানি স্ত্রী-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী প্রমিতা ততটা নয় দেখা যাচ্ছে। সে এখনও পুরুষের পরিত্রাতা ভূমিকাটা পছন্দ করে। তা হলে হেনা আর অনন্ত এই দু-বাড়ির দুই ঝি-চাকরকেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে ট্রেনে।

ইরা সদলবলে পৌঁছে গেল ঠিক সাড়ে পাঁচটায়। ভোর বেলাতেই গাড়ি চালিয়ে আরাম। বেশি বেলায় চিড়বিড়ে রোদ উঠে গেলে বাচ্চাদের কষ্ট হবে।

যথাসময়ে উঠতে পারবে কিনা এই ভয়ে প্রমিতা প্রায় সারা রাতই জেগেছিল, তবু সে তখনও তৈরি হতে পারেনি। জিনিসপত্র গুছোতেই তার আবার ভুল হয়ে যায়। শৈবাল তাড়া দিলেই সে বলে তুমি তো একটুও সাহায্য করতে পারো না।

দারুণ সুন্দর সেজে এসেছে ইরা। ছোট্টখাট্ট মেমসাহেবের মতো চেহারা তার, দেখে মনেই হয় না তার বারো বছরের একটা ছেলে আছে। ব্লু জিনসের প্যান্টের ওপর পরেছে একটা গোলাপি রঙের পাঞ্জাবি। মাথায় চুল বব করা। সেই তুলনায়, পিঠের ওপর চুল ফেলা, একটা গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরা প্রমিতাকে দেখাচ্ছে নন্দলাল বসুর আঁকা ছবির মতন। পোশাকে মিল নেই, তবু এই দু-জন দারুণ বান্ধবী।

ইরা বলল, হেনার ট্রেনে যাওয়ার দরকার নেই শুধু অনন্ত চলে যাক ট্রেনে। হেনার জায়গা হয়ে যাবে এর মধ্যেই।

জায়গা হয়ে যাবে ঠিকই, তবে বেশ চাপাচাপি হবে! দু-দিনের পিকনিকের জন্য মালপত্র তো কম নয়।

কিন্তু ইরার কথার প্রতিবাদে বলবে না, আসলে সে-ই দলনেত্রী। পিছনের সিটে প্রমিতা, বাবলি, হেনা আর রিন্টু, সামনের সিটে শৈবালের পাশে পিকলু।

গাড়িতে উঠলেই রিন্টুর ইচ্ছে হয় অন্য সব গাড়িকে ছাড়িয়ে যেতে। পাশাপাশি অন্য কোনো গাড়ি গেলেই সে লাফাতে থাকে, ইরা মাসি, আরও জোরে, ওই ফিয়াট গাড়িটাকে আগে যেতে দেবে না। আরও জোরে

জোরে চালাতে ইরার কোনো আপত্তি নেই। সে ভুলে যায় যে, এটা বোম্বাইয়ের মতন মসৃণ রাস্তা নয়। এটা কলকাতা, যেখানে-সেখানে গর্ত। শৈবালের ভয় করে, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। মেয়েরা কেউ যখন আপত্তি করছে না, তখন একমাত্র পুরুষ হয়ে এ-রকম কথা বলা কী তার মানায়? অথচ শৈবাল জানে, সে ভীতু নয়। তার ভয় এই বাচ্চাগুলোর জন্য।

সে কথায় রিন্টুকে অন্যমনস্ক করার চেষ্টা করে।

রিন্টু ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল, বাবা, তুমি গাড়ি চালাতে পারো না?

হাসিমুখে দু-দিকে মাথা নাড়ে শৈবাল।

বড়ো হয়ে আমি কিন্তু গাড়ি চালাব। ইরা মাসি তুমি শিখিয়ে দেবে না?

ইরা কৌতুকহাস্যে বলল, আমি তোর বাবাকেও শিখিয়ে দিতে পারতুম, কিন্তু তোর বাবার ইচ্ছেই নেই।

প্রমিতা বলল, হ্যাঁ, তুমি তো ইরার কাছ থেকেই গাড়ি চালানো শিখে নিতে পারো। ক দিনই বা লাগে?

এই আলোচনাটাই একদম পছন্দ হয় না শৈবালের।

গাড়ি খারাপ হল না বটে, কিন্তু আমতলা পেরিয়ে যাওয়ার পর চাকা পাংচার হল। সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। এবার চাকা পালটাতে হবে। এটাও পুরুষদের কাজ। রাস্তাঘাটে কোনোদিন কোনো মেয়েকে চাকা পালটাতে দেখেনি শৈবাল।

কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরা বলল, খাইসে!

ইরা বাঙাল নয়, তবু মাঝে মাঝে বাঙাল কথা বলা তার শখ।

জ্যাকটা টেনে বার করে ইরা গাড়ির নীচে বসাল।

প্রমিতা বলল, এখন তোকেই এসব করতে হবে নাকি?

ইরা বলল, উপায় কী? কাছাকাছি তো কিছু নেই।

শৈবাল যা আশঙ্কা করছিল, ঠিক তাই হল। প্রমিতা তার দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনার সুরে বলল, তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ? হাত লাগাতে পারছ না?

শৈবালের বলবার ইচ্ছে হল যে, আমি যখন গাড়ি চালাতেই শিখিনি, তখন শুধু চাকা পালটানো শিখতে যাব কেন? আমি কি মেকানিক?

কিন্তু এসব সরল যুক্তির কথা মেয়েদের কাছে বলে কোনো লাভ নেই, তার বদলে শৈবাল উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে সমস্যার সমাধান করে দিল খুব সহজে।

উলটো দিক থেকে একটা খালি লরি আসছিল। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত দেখিয়ে সেটাকে থামিয়ে ফেলল শৈবাল। তারপর ড্রাইভারকে মিনতি করে বলল, ভাই পাঁচটা টাকা দেব, আমাদের চাকাটা একটু পালটে দেবেন?

আট-দশ মিনিট সময় খরচ করে পাঁচ টাকা রোজগার করতে কে না রাজি হয়। ড্রাইভারটি উৎসাহের সঙ্গে নেমে এল।

ইরাই যে গাড়ির চালক, তা বুঝতে পেরে একটু কৌতুকও বোধ করল ড্রাইভারটি। সে বাঁকাভাবে দু-একবার তাকাল শৈবালের দিকে।

চাকা পালটাবার কাজ চলছে, এরইমধ্যে হাজির দু-টি ছেলে, তাদের কাছে ডাব। ছুটির দিনে এপথ দিয়ে অনেক টুরিস্ট যায়, সেইজন্য ডাব নিয়ে ছেলের দল সব জায়গায় তৈরি।

ইরা বলল, ভালোই হল, ডাব খাওয়া যাক।

শৈবাল প্রমিতার চোখের দিকে তাকাল। কোনো ভাষা ফুটল না সেখানে। অর্থাৎ প্রমিতার মনে নেই।

আবার সেই দরাদরির ঝামেলা। মানিব্যাগটা বার করে প্রমিতাকে দিয়ে শৈবাল বলল, তোমরা ডাব খাও–দামটা দিয়ে দিয়ো, আমি একটু আসছি।

খানিকটা এগিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এমন একটা কাজ সারতে গেল শৈবাল, যে-সময় সে-দিকে মেয়েদের তাকাতে নেই।

ডায়মণ্ড হারবার পৌঁছোতে বেজে গেল দশটা। অনন্ত অনেক আগেই এসে দাঁড়িয়ে আছে, সাগরিকার সামনে।

ইরার মামাবাড়ির শহর ছাড়িয়ে একটু বাইরে। খোলামেলা চমৎকার বাড়ি। একতলা-দো তলা মিলিয়ে অনেকগুলো ঘর। এমন বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকে।

দুপুরে এবাড়িতেই রান্না হবে, না সাগরিকা থেকে খাবার আনানো হবে, তাই নিয়ে সামান্য মতভেদ হল।

এখন বাজার করে রান্না বসাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে ঠিকই তবু শৈবালের মত এই যে, পিকনিক করতে এসে আর দোকানের খাবার খাওয়া কেন? আসবার পথে ছেলে-মেয়েরা তো হেভি ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিয়েছেই।

ইরা বলল, এবেলা রান্নাবান্নার আর ঝামেলা করে লাভ নেই। ওবেলা হবে।

প্রমিতা বলল, শুধু খিচুড়ি আর মাছভাজা হলে বেশিক্ষণ দেরি লাগবে না। মশলাপাতি আমি সঙ্গে এনেছি।

শৈবাল ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা খিচুড়ি খেতে চাও, না দোকানের খাবার খেতে চাও? হাত তোলো।

ছেলে-মেয়েরা সবাই একসঙ্গে হাত তুলে চেঁচিয়ে বলল, খিচুড়ি খিচুড়ি!

ইরা বলল, তবে তাই হোক।

হেনাকে পাঠানো হল উনুন ধরাতে। অনন্ত বাজারে যাবে। প্রমিতা তাকে জিনিসপত্রের লিস্ট করে দিতে লাগল।

একটু বাদেই ইরা ঘুরে এসে বলল, এই প্রমিতা শোন, এরমধ্যেই প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল, অনন্ত এখন বাজারে যাবে, ফিরে আসবে, তারপর রান্না চাপবে, সে কত বেলা হবে ভেবে দেখ।

শৈবাল বলল, ছুটির দিন, দেড়টা-দুটোর মধ্যে রান্না হলেই তো যথেষ্ট।

ইরা বলল, আপনি বুঝতে পারছেন… তার চেয়েও বেশি দেরি হলে..ছোটোদের হজম হয় না, তা ছাড়া অনেক গরম জল করতে হবে, আমি তো বাইরে কোথাও গরম জল ছাড়া স্নান করি না, পিকলুকেও গরম জলে..

প্রমিতা বলল, আমি স্নান সেরে এসেছি।

ইরা বলল, আজ এবেলা রান্না থাক। অনন্ত, তুমি বরং সাগরিকায় গিয়ে অর্ডার দিয়ে এসো, আমাদের যে ক-প্লেট লাগবে বলে দিচ্ছি…আমরা ঠিক একটা পনেরোর মধ্যে খেতে যাব…বাচ্চাদের জন্য পাতলা স্টু, আর…

অর্থাৎ ইরার কথাই শেষপর্যন্ত থাকবে। অন্যদের মতামতের কোনো দাম নেই, ইরা যা বলবে তাই করতে হবে।

শৈবালের চোয়ালটা কঠিন হয়ে গেল এবার।

পরক্ষণেই সে ভাবল, থাক, রান্না করে আর কী হবে। স্ত্রীর বান্ধবী, তার ওপরে সুন্দরী তার সঙ্গে তো শৈবালের মধুর সম্পর্কই থাকা উচিত। শুধু শুধু মন কষাকষির কোনো মানে হয় না, তাও বাইরে বেড়াতে এসে।

ইরার সব কিছু ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়। ঠিক একটা বেজে দশ মিনিট পর সে গাড়ির হর্ন দিতে লাগল। এবার খেতে যেতে হবে। বাচ্চারা বাগানে হুটোপাটি করে খেলছিল, তারা সবাই বলল, তাদের এখনও খিদে পায়নি।

শৈবালের খিদে পায়নি। আকাশে মেঘ করে আছে, কিন্তু বেলাই হয়নি মনে হয় কিন্তু সাগরিকায় সময় বলে দেওয়া হয়েছে, ইরা আর কাউকে দেরি করতে দেবে না। সবাইকে উঠে পড়তে হল গাড়িতে।

বড়ো বড়ো হোটেলে ঝি-চাকরদের মেঝেতে বসে খেতে দেয় না। আবার বাবুদের মতন একইরকম টেবিলে খেতে দিলেও কেমন দেখায়। কিন্তু হেনা আর অনন্তকে তো খেতে হবে।

শৈবাল জোর দিয়ে বলল, তোমরাও এখানেই বোসো। তারপর একজন বেয়ারার চোখের দিকে তাকিয়ে হুকুমের সুরে সে বলল, ওরা যা খেতে চাইবে দেবে।

একেবারে পাশাপাশি টেবিল নয়, অনন্ত বেছে নিল একেবারে দূরে এক কোণের একটা টেবিল।

ছেলে-মেয়েদের নিয়ে খেতে বসলে তাদের ব্যাপারটাই প্রধান হয়ে ওঠে। বড়োদের নিজস্ব কথা বলার কিছু থাকে না। ইরা ও প্রমিতা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত রইল, শৈবাল রইল নিঃশব্দ। একবার দূরে অনন্তদের টেবিলটার দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়, সবচেয়ে বেশি উপভোগ করছে ওরাই। দু-জনের বয়েস কাছাকাছি, মনে হতে পারে ওরা দু-জন প্রেমিক প্রেমিকা লুকিয়ে লুকিয়ে সাগরিকায় খাচ্ছে। হোক-না ওদের পোশাক অতিমামুলি!

ওরা অবশ্য কথা বলছে না বিশেষ, পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে। অনন্ত এমনিতেই কম কথা বলে।

ইরা ব্যাগ বের করছে দেখে, শৈবাল বলল, আমি দিচ্ছি।

ইরা বলল, না না, আজ আমি আপনাদের এনেছি।

যাঃ! রাখুন তো!

এ কী, সাগরিকায় আমিই জোর করে আপনাদের নিয়ে এলুম।

শৈবাল আর বেশি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, বেয়ারার ট্রের ওপর টপ করে ফেলে দিল একটা এক-শো টাকার নোট।

বেয়ারাটি শৈবালের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, এক-শো বারো টাকা স্যার!

শৈবালের একেবারে আঁতকে ওঠার অবস্থা। এক-শো বারো টাকা! ডাকাত নাকি? এই তো খাবারের ছিরি? অনন্ত, হেনা বেশি খেয়েছে। না, অনন্ত খুব কম খায়। হেনা তো অর্ডার দেয়নি। ও টেবিলে অনন্তই অর্ডার দিয়েছে, সে কখনো বাবুদের বাজে খরচ করাবে না। ছেলে-মেয়েরা দু-একটা ডিম বেশি নিয়ে নষ্ট করেছে অবশ্য।

বাড়িতে খিচুড়ি আর মাছভাজা খেলে কত খরচ হত? পঞ্চাশ-ষাট টাকার বেশি কিছুতেই নয়। আর গরম গরম খিচুড়ির সঙ্গে টাটকা ইলিশ মাছভাজা এই দোকানের খাবারের চেয়ে অনেক বেশি উপাদেয় হত না?

শুধু শুধু এতগুলো টাকা নষ্ট। অথচ একথা বলতে গেলেই শৈবাল ওদের চোখে কৃপণ হয়ে যাবে। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শৈবাল ভাবল, ছেলে-মেয়েরাই সবচেয়ে সুখী। ওদের সবসময় মনে মনে টাকার হিসেব করতে হয় না।

দুপুর বেলা খাটে শুয়ে একটা বই পড়ছিল শৈবাল। ঘরের তো অভাব নেই। তাই শৈবাল একটা আলাদা ঘর নিয়েছে। সব ঘরেই খাট আর গদি পাতা। ইরার স্বামী আসেনি। সেইজন্য রাতে শৈবাল আর প্রমিতার এক ঘরে শোয়া ভালো দেখায় না। তার চেয়ে দুই রমণী দু-ঘরে নিজেদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে থাকুক, শৈবাল আলাদা, সে যেন বাইরের লোক।

বাবলি এসে বলল, বাবা, জানো তো হেনাদিকে পাওয়া যাচ্ছে না।

শৈবাল উঠে বসল।–কী?

হেনাদি নেই। কোথায় যেন চলে গেছে।

লম্বা টানা বারান্দা, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ইরা আর প্রমিতা।

শৈবাল প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, অনন্ত কোথায়?

প্রমিতা বলল, ওই তো অনন্ত উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।

অনন্ত ওইখান থেকে চেঁচিয়ে বলল, পেছনের বাগান-টাগান দেখে এসেছি আমি। কোথাও নেই।

ইরা কোনো কারণে দু-তিনবার ডেকেছিল হেনাকে। সাড়া পায়নি। তারপরই হেনার খোঁজ পড়েছে। সে নেই, সে কোথায় গেছে, কেউ জানে না।

প্রমিতার মুখে আশঙ্কার ছায়া পড়ল! গ্রাম্য বোকা মেয়ে, হঠাৎ কারুকে কিছু না বলে চলে গেল? নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে।

অনন্ত বলল, রাস্তায় দেখে আসব?

প্রমিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি একটু দেখবে? এদিককার রাস্তা দিয়ে খুব জোরে গাড়ি যায়–

এই দুপুর বেলা যুবতী ঝিকে খোঁজার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার একটুও ইচ্ছে নেই শৈবালের। তাও নিজের বাড়ির নয়, অন্য বাড়ির ঝি।

ওই অনন্ত দেখে আসুক।

পিকলু বলল, আমিও যাই অনন্তদার সঙ্গে?

বাবলি রিন্টুও অমনি যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আসে। দুপুর বেলা ওদের আটকে রাখা হয়েছিল।

শেষপর্যন্ত শুধু অনন্তই গেল।

আর ঘুম কিংবা বই পড়া হল না। একতলায় নেমে এল তিনজনে! অনন্ত হেনাকে খুঁজে না পেলে থানায় খবর দিতে হবে কি না, সে-কথা দুই নারীই জিজ্ঞেস করে শৈবালকে। অর্থাৎ সেরকম কিছু হলে শৈবালকেই যেতে হবে থানায়। পুলিশ-টুলিশ সে একেবারেই পছন্দ করে না।

ইরা বলল, এইজন্যই কম বয়েসি কাজের মেয়ে রাখা এক ঝামেলা।

প্রমিতা বলল, মেয়েটা খুব ভালো।

তা ঠিকই। কিন্তু চোখে চোখে রাখতে হয়। তোদের ছেলেটা খুব কাজের, সব বুঝে-শুনে করে।

অনন্তর তো সবই ভালো, তবে রান্নাটা তেমন পারে না।

আমার সঙ্গে বদলাবদলি করবি? তুই হেনাকে নে? আমার ভালো রান্নার দরকার নেই।

এর উত্তরে প্রমিতা শুধু হাসল। এত বিশ্বাসী নির্ভরযোগ্য ছেলে অনন্ত। তাকে সে নিজের বাড়িতে কাজ ছাড়িয়ে দেবে কোন যুক্তিতে? এখন ঘরের ছেলের মতন হয়ে গেছে।

একটু পরেই হেনাকে ধরে নিয়ে এল অনন্ত। হেনার কাপড়চোপড় সব ভেজা।

চোখ কপালে তুলে প্রমিতা বলল, কী সর্বনাশ! জলে পড়ে গিয়েছিল নাকি?

অনন্ত মুচকি হেসে বলল, না।

তাহলে এ-রকম ভেজা কেন?

অনন্ত হাসিমুখটি অন্য দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, আমি জানি না। আমি তো গিয়ে দেখলাম ওইরকম…

এবার প্রমিতা মেয়েটির দিকে এক পা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই, তুই কোথায় গিয়েছিলি?

হেনা খুবই ভয় পেয়ে গেছে। মুখ নীচু করে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে।

কোথায় গিয়েছিলি? কথা বলছিস না কেন?

হেনা তবু অপরাধীর মতন মুখ আমশি করে দাঁড়িয়ে আছে।

চুপ করে রইলি কেন? বল কোথায় গিয়েছিলি? এই অচেনা জায়গায়।

চান করতে গিয়েছিলাম।

চান করতে! এই বেলা সাড়ে তিনটের সময়? একতলায় তোকে তো বাথরুম দেখিয়ে দিয়েছি, তবে আবার কোথায় গিয়েছিলি?

হোটেলের একজন লোক বলল, এখানে…এই নদী গঙ্গা…গঙ্গার কাছে এসে চান না করলে পাপ হয়। সেইজন্য ভাবলুম একটা ডুব দিয়ে আসি।

প্রমিতাই হেনাকে দিয়েছে ইরার বাড়িতে। সেইজন্য তারই যেন দায়িত্ব এইভাবে সে জেরা করেছিল। কিন্তু ইরা ওর মাইনে দেয়, সুতরাং সেই ওর মালিক। সুতরাং সে এগিয়ে এল এবার!

শৈবাল একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। এরমধ্যে তার মাথা গলাবার দরকার নেই।

ইরা জিজ্ঞেস করল, তুই গঙ্গায় স্নান করতে গিয়েছিলি, আমাদের কারুকে বলে যাসনি কেন?

সেইরকম নতমুখে থেকে হেনা বলল, ভাবলুম আপনারা ঘুমোচ্ছেন

তা বলে অচেনা জায়গা–হঠাৎ না বলে-কয়ে–তুই অনন্তকে বলে যাসনি কেন? ও তো জেগেই ছিল।

হেনা এবার চুপ।

শৈবাল ভাবল, এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। হেনা আর অনন্ত পরস্পর খুবই কম কথা বলে! খাবার টেবিলেও ওরা গল্প করেছে বলে মনে হয়নি। আমরা ভাবি এক বয়েসি ছেলে মেয়ে কাছাকাছি এলেই ভাব করে নেবে, প্রেম-ট্রেমের চেষ্টা করবে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা কি তা করে না?

ইরা বলল, যা শিগগির কাপড় বদলে নে। তুই দোতলাতেই থাকবি, তোর ঘর দেখিয়ে দিচ্ছি।

অনন্ত থাকবে একতলায়। আর দোতলায় ভাঁড়ার ঘরের মতন একটা ছোট্ট খালি ঘর নির্দিষ্ট হয়েছে হেনার জন্যে। এটা ইরা আর প্রমিতা আগেই ঠিক করে নিয়েছে।

সন্ধ্যে বেলা একসঙ্গে জন্মদিন হল বাবলি আর পিকলুর। দু-টি কেক আনা হয়েছে, আর সমান মোমবাতি। অন্য অন্য বছর এইদিনে বাবলি আর পিকলুর ক্লাসের বন্ধুরা আসে। এবার তারা কেউ নেই, তবু খুব জমে গেল।

ইরা আর প্রমিতা গান গাইল, হ্যাপি বার্থ-ডে টু ইউ হ্যাপি বার্থ-ডে টু ইউ…ও ডার্লিং।

শৈবাল গাইল : পিকলু-বাবলির জন্মদিনে জানাই ভালোবাসা…সুখে থাকো, ভালো থাকো, এই আমাদের আশা।…

তারপরই শৈবাল চলে গেল মাছের আড়তে। ডায়মণ্ড হারবারে এলে টাটকা ইলিশ না খেলে কোনো মানেই হয় না।

প্রায় সওয়া দু-কিলো ওজনের একটা সুগঠিত ইলিশ নিয়ে শৈবাল ফিরল ঘণ্টাখানেক বাদে। মুখে বেশ গর্বের ভাব।

বাইশ টাকা করে কিলো। তা হোক, এক-আধদিন একটু বাজে খরচ করা যায়ই।

ইরা ইলিশ মাছ খায় না। ওর অ্যালার্জি হয়। আফশোস করে ইরা বলল, জানেন ছেলেবেলায় কী ভালোবাসতুম ইলিশ খেতে! এখনও দেখলে লোভ হয়। কিন্তু খাবার উপায় নেই–কী যে, ছাই অ্যালার্জি, একটু মুখে দিলেই সারাগায়ে র‍্যাশ বেরোবে।

শৈবাল নিরাশ হয়ে গেল। ইলিশ মাছেও কারুর যে অ্যালার্জি থাকতে পারে সে কোনো দিন ধারণাই করেনি।

প্রমিতা বলল, তুমি ফট করে আমাদের না জিজ্ঞেস করে-টরে হঠাৎ একটা এত বড়ো ইলিশ আনতে গেলে কেন? ভেবেছিলুম আজ মুরগি হবে।

শৈবাল ভেবেছিল, ওদের না জানিয়ে হঠাৎ এত বড়ো একটা ভালো ইলিশ এনে চমকে খুশি করে দেবে। তার বদলে এইরকম প্রতিক্রিয়া?

সে ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে সমর্থন পাওয়ার জন্য তাকাল। ইংরেজি স্কুলে পড়া আজকালকার বাচ্চা, ওদের মাছ সম্পর্কে কোনো আগ্রহই নেই! মাছ খেতেই চায় না। ইংলিশ মিডিয়াম কি মাছকে অবজ্ঞা করতে শেখায়? সব বাচ্চার একই অবস্থা কেন?

শৈবালের বাবা এক-একদিন হঠাৎ বাগবাজারের ঘাট থেকে এ-রকম ইলিশ কিনে আনতেন সন্ধ্যে বেলা। ছোটো ভাই-বোনদের সঙ্গে শৈবাল আনন্দে হইহই করে উঠত তা দেখে। ইলিশের গন্ধে ম-ম করত সারাবাড়ি। ভাত খাওয়ার পর আঁচাতে ইচ্ছে করত না, যদি হাত থেকে ইলিশের গন্ধটা চলে যায়। হ্যাঁ, শৈবালদের দেশ পূর্ববঙ্গেই।

তাহলে মুরগিই থোক?

ইরা বলল, না না, অত বড়ো মাছটা এনেছেন, আবার মুরগির কী দরকার! আমি না-হয় খাব না। রাত্রে আমার মাছ-মাংস না খেলেও চলে।

প্রমিতা বলল, অত বড়ো মাছ কে খাবে? নষ্ট হবে। আমি এক টুকরোর বেশি খেতে পারি না। ছেলে-মেয়েরাও এক-আধ টুকরো খায় কিনা সন্দেহ।

হেনা আর অনন্ত মুগ্ধভাবে চেয়ে আছে মাছটার দিকে। ওরা গ্রামের লোক, ওরা মাছ চেনে। শৈবাল ওদের সঙ্গে বসে খাবে।

ইরা বা প্রমিতা কারুরই রান্নাঘরে ঢোকার ইচ্ছে নেই। বেড়াতে এসে কারই-বা এসব ভালো লাগে! আর কাজের লোক আনা হয়েছে যখন, তখন আর ও নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। অনন্ত আর হেনা গেল রান্নাঘরে।

কিছুক্ষণ নদীর ধারে হেঁটে আসা হল। তারপর বাড়িতে ছাদের ওপরে আড্ডা। এখান থেকেও নদী দেখা যায়। হু-হু করে বইছে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতন হাওয়া। ইরা অনেকরকম মজার মজার খেলা জানে, ছেলে-মেয়েদের একেবারে জমিয়ে রেখে দিল। কখন যে সময়টা কেটে গেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ একসময় দেখা গেল দশটা বাজে। রিন্টু ঘুমিয়ে পড়েছে একফাঁকে। ডেকে তোলা হল তাকে।

নীচে নেমে এসে প্রমিতা বলল, অন্তত, বাচ্চাদের আগে খাবার দিয়ে দে।

অনন্ত কাঁচুমাচু মুখে জানাল, এখনও ভাত হয়নি। সবে চাপানো হয়েছে। শোনামাত্র দুই মা তাদের চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। এখনও ভাত হয়নি! ছেলে-মেয়েরা খাবে কখন? রাত দশটা বেজে গেল…। কেন ভাত হয়নি?

মাছ কোটা হয়েছে, দু-রকম মাছের ঝোল হয়েছে, ডাল হয়েছে, এঁচোড়ের তরকারি, ফুলকপির ডালনা..ভাতটা শেষকালে করবে ভেবেছিল অনন্ত।

প্রমিতা একেবারে অগ্নিমূর্তি ধরল! অনন্তকে আজকাল সে বকুনি দেয় না, তবু আজ বকল, তোর একটু আক্কেল নেই? ছেলে-মেয়েরা খাবে…

ইরা বলল, ভাতটা হয়ে থাকলে তবু শুধু দু-টি ডাল-ভাত একটা কিছু ভাজা-টাজা দিয়ে খাইয়ে দিতাম। সন্ধ্যে বেলা তো অনেকখানি কেক খেয়েছেই

প্রমিতা বলল, কী করছিলি এতক্ষণ, আড্ডা মারছিলি?

ইরা বলল, এঁচোড়ের তরকারি, আবার ফুলকপির ডালনা–এত রকম হাবিজাবি কে করতে বলেছে?

অনন্ত বলল, আপনি, ইলিশ মাছ খাবেন না, তাই ভাবলুম ফুলকপির ডালনাটা—

ইরা বলল, আমার জন্য? রাত বারোটার সময় আমি ওইসব খেতে যাব আর ছেলে মেয়েরা না খেয়ে ঘুমোবে?

প্রমিতা বলল, দুটো উনুন, দু-হাতে কাজ করলে এতক্ষণে সব কিছু হয়ে যাওয়ার কথা কী করছিলি সত্যি করে বল তো?

শুধু অনন্তই বকুনি খাচ্ছে দেখে ইরা এবার তার দাসীকে ডেকে বলল, হেনা তুই জানিস, পিকলুবাবু সাড়ে নটার মধ্যে খায়? আর সওয়া দশটা বেজে গেছে, এখনও ভাতই হয়নি

হেনা বলল, আমি তো ভেবেছিলাম…

-চুপ! তোকে কে ভাবতে বলেছে? তোর কাজ করার কথা, ভাবার তো কথা নয়!

এরপর হেনা আর অনন্ত প্রবল বৃষ্টিপাতের মতো বকুনি খেল কিছুক্ষণ। ওরা অবশ্য কেউই আর উত্তর দিল না।

ছেলে-মেয়েরা সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে। এখনকার ছেলে-মেয়েদের স্বভাবই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া। ওরা ভোরে ওঠে। কেননা স্কুলে যেতে হয় তাড়াতাড়ি। শৈবালদের সময় স্কুল ছিল এগারোটায়, এখন তার ছেলে-মেয়েরা সাড়ে আটটার মধ্যে স্কুলে চলে যায়।

যাইহোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই খেতে বসিয়ে দেওয়া হল ওদের। ঘুমন্ত ছেলে-মেয়েদের খাওয়ানো যে কঠিন কাজ! এক-একজন ঢুলে ঢুলে পড়ে, আর প্রমিতা আর ইরা তাদের ডেকে ডেকে জাগায়। ইলিশ মাছ ওরা প্রায় কেউই খেল না। কেক খেয়ে ওদের পেট ভরতি, ওদের খাবার ইচ্ছে নেই।

বড়োরা খেতে বসল একটু পরে। তখন শৈবাল বুঝতে পারল, কেন অনন্ত ভাতটা শেষকালে চাপিয়েছিল। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের স্বাদই আলাদা, তার সঙ্গে টাটকা ইলিশ মাছের ঝোল, এ যে একেবারে অমৃত।

ছেলে-মেয়েরা ভালো করে খায়নি বলেই যেন ইরা আর প্রমিতার খাওয়ার রুচি নেই। সুতরাং শৈবালই-বা একগাদা খায় কী করে?

অত সাধ করে সে এনেছে ইলিশটা, তার ইচ্ছে ছিল এই নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে। কিন্তু ইরা বা প্রমিতার মাছ বিষয়ে কোনো উৎসাহই নেই। শৈবাল দু-একবার বলতে গিয়েও থেমে গেল। তার মনে হল, হায়, বাঙালিরা আজকাল ইলিশ মাছের কথাও ভুলে যাচ্ছে! দু-পিস ইলিশের পেটি খাওয়ার পর আরও একখানা খাওয়ার জন্য তার মন কেমন করছিল, কিন্তু সে হাত গুটিয়ে ফেলল।

সব পর্ব চুকল সাড়ে এগারোটায়। এক্ষুনি শুয়ে পড়ার কোনো মানে হয় না, ইদের চাঁদ উঠেছে আকাশে, ওরা এসে আবার বসল ছাদে। ইরা চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গায়, প্রমিতার ঝোঁক অতুলপ্রসাদ দ্বিজেন্দ্রগীতিতে। দুই সখী বেছে বেছে চাঁদ বিষয়ক গান শুরু করল একটার পর একটা। শৈবালের গলায় একদম সুর নেই তবু সে মুডের মাথায় ওদের এক একটা গানের সঙ্গে গলা মেলাতে গেলে ওরা দুজনেই হেসে ওঠে।

হঠাৎ শৈবালের মনে হল, আর দু-একজন বন্ধুবান্ধব সঙ্গে এলে বেশ ভালো লাগত। তারপরেই শৈবাল ভাবল, দু-টি সুন্দরী মহিলার সঙ্গে আমি একমাত্র পুরুষ, এটাই তো অনেকের কাছে ঈর্ষার ব্যাপার।

গান থামিয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রমিতা বলল, ওদের দুজনকে একসঙ্গে রান্নাঘরে অতক্ষণ থাকতে দেওয়া ঠিক হয়নি।

ইরা বলল, হেনাকে তো আমি ওপরে শুতে বলেছিলাম, আবার নীচে-টীচে চলে যায়নি তো?

রবীন্দ্রনাথ-অতুলপ্রসাদের গানের মাঝখানে ঝি-চাকরদের আলোচনা চলল একটুক্ষণ। নীচ থেকে রিন্টু ডেকে উঠল, মা, মা বলে।

ঘুম ভেঙে রিন্টু একবার হিসি করতে যায় রোজ এইসময়। একলা ঘরের বাইরে যেতে সে ভয় পায়। বাবলিকে তো শত ডাকলেও সে উঠবে না।

প্রমিতা নীচে চলে গেল। ছাদে শুধু ইরা আর শৈবাল। ইরা আবার গান গেয়ে যেতে লাগল আপনমনে। দু-টি গান শেষ করার পর সে জিজ্ঞেস করল, আপনি এত ঝিম মেরে গেলেন কেন? কথা টথা বলছেন না যে? ঘুম পেয়ে গেছে বুঝি?

চমকে উঠে শৈবাল বলল, না শুনছিলাম। এত ভালো গাইছেন—

চোখ বুজে আসছিল আপনার।

না না, ও এমনিই।

আমারও ঘুম পেয়ে গেছে, চলুন, উঠে পড়ি।

স্ত্রীর সুন্দরী বান্ধবীর সঙ্গে নিরালায়, জ্যোৎস্নামাখা আকাশের নীচে কোথায় দু-একটা মধুর কথা বলবে শৈবাল, তা নয়, সে চোখ বুজেছিল!

সে শুধু বলল, আর একটু বসুন না। ততক্ষণে ইরা উঠে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, না এবার নীচে যাওয়া যাক।

এরপর নিজের ঘরটায় এসে শুয়ে পড়ে শৈবাল একটা ছোট্ট স্বপ্ন দেখল। ঠিক স্বপ্ন নয়, চোখ বুজে দেখা একটা চলন্ত ছবি।

কোথায় যেন জায়গাটা? কৃষ্ণনগরের কাছে, পারমাদান না? যাওয়া হয়েছিল জিপগাড়িতে, সব মিলিয়ে ন-জন, দারুণ ঠাসাঠাসি…সকাল বেলা বেরিয়ে ঘণ্টাচারেকের মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা, কিন্তু রানাঘাট না কোথায় যেন খারাপ হয়ে গেল জিপগাড়িটা, তার ওপরে আবার তুমুল বৃষ্টি। পোঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। একটা ছোট্ট ডাকবাংলো। চৌকিদার বলল, এত লোকের রান্নার ব্যবস্থা নেই তার ওখানে, কিন্তু তা শুনে কেউ হৃক্ষেপও করল না, খাওয়া-দাওয়ার যেন কোনো চিন্তাই নেই, ও যা-কিছু একটা হয়ে যাবে। কেমিস্ট্রিতে ফাস্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্র দেবকুমারের যে অত গুণ, তা কে জানত? মাঠের মধ্যে ইট দিয়ে একটা উনুন বানিয়ে ফেলল চটপট। রাত্তিরে ওইখানে মুনলাইট পিকনিক হবে। শৈবালকে পাঠানো হল জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে আনতে। চৌকিদার কী যেন আপত্তি তুলেছিল, তাকে বলা হয়, চোপ!

রাত ন-টার পর বেরিয়ে গিয়ে কাছাকাছি গ্রাম থেকে মুরগি জোগাড় করে আনল দেবকুমার। ঠিক হল ছেলেরাই রাঁধবে, মেয়েরা দেখবে। ইরার সঙ্গে তখনও বিয়ে হয়নি দেবকুমারের। প্রমিতাকে সদ্য বিয়ে করেছে শৈবাল। আরও যে কারা ছিল, সুমন্ত্র, জয়া, মঞ্জু, অনীশ আর সুকুমার।

কাঠের আঁচ, বার বার নিভে যায়। শৈবালের ওপর ভার উনুনে কাঠ জোগানো শুধু! কারণ সে রান্নার কিছু জানে না। উনুনে ফুঁ দিতে দিতে তার চোখ লাল। রাত একটা বেজে গেল, তখনও শুধু ভাত হয়েছে, মাংস চাপেনি। তখন ইরা আর প্রমিতা কোমরে শাড়ি জড়িয়ে এসে বলল, ঢের হয়েছে। এবার আপনারা উঠুন তো মশায়রা, এবার আমরা দেখছি।

খেতে বসা হল রাত আড়াইটেয়। প্রমিতা ঠাট্টা করে বলেছিল, আর একটু অপেক্ষা করলে এটাই আমাদের সকালের ব্রেকফাস্ট হয়ে যেত!

ভাতের তলায় পোড়া লেগে গিয়েছিল, ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ, তবু সে-ভাত সবই শেষ হয়ে গেল। চেটেপুটে খাওয়ার পর দেবকুমার বলেছিল, ইস, আর নেই? মাংসটা দারুণ রান্না হয়েছিল সত্যি।

কতদিন আগের কথা? তেরো না চোদ্দো বছর? সেই প্রমিতা আর ইরা কত বদলে গেছে। আজও চাঁদের আলো আছে, অথচ আজকের পিকনিক…

পাশ ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শৈবাল। সে নিজেও কী বদলে গেছে কম? সে এখন যেকোনো ব্যাপারে কিছু খরচ করতে গেলেই টাকার হিসেব করে। গান গাইতে গাইতে ইরা মনে করে শৈবাল গান শুনছে না, ঘুমিয়ে পড়েছে। সত্যিই তখন একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল শৈবালের।

ঘুমের মধ্যেই শৈবাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশ ফিরল।

পরদিন বাড়ি ফেরার পথে ইরা বলল, যাইহোক, বেশ কাটল এখানে। বেশ জমেছিল। মাঝে মাঝে এ-রকম বেরিয়ে পড়তে পারলে…।

গত রাতের স্বপ্নটা মনে পড়ায় মুচকি হাসল শৈবাল। জমেছিলই বটে। তবে বাচ্চারা বেশ আনন্দ করছে, ওদের তো সব কিছুতেই আনন্দ।

.

০৪.

কলকাতায় ফেরার দু-দিন পরেই আবার গন্ডগোল! অনন্তর জ্বর খুব বেড়েছে। সারা গায়ে ব্যথা। সকাল বেলা অনন্ত বিছানা ছেড়ে ওঠেইনি, ঝিম মেরে শুয়ে থাকে। এ-রকম সে কক্ষনো করে না। বেশ সিরিয়াস ব্যাপার। ডাক্তার ডাকতে হবে। শৈবাল নিজেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কারুর অসুখ দেখলেই এ-রকম ব্যস্ত হয়ে ওঠা শৈবালের স্বভাব। সে নিজের ছেলেমেয়েরই হোক বা কাজের লোকেরই হোক।

পাড়ার একজন ডাক্তার শৈবালের বিশেষ চেনা, প্রায় বন্ধুর মতন। সুতরাং কোনো অসুবিধে নেই। সেই ডাক্তারটি ওদের বাড়িতে এসে দেখলেও চেম্বারের সমানই ভিজিট নেন। সুতরাং অনন্তকে আর চেম্বারে নিয়ে যেতে হবে না। চা খেয়েই শৈবাল বেরিয়ে ডাক্তারকে খবর দিয়ে এল। তিনি বললেন, বাড়ি ফেরার পথে এসে দেখে যাবেন।

শৈবাল ফিরে এসে দেখল, সিঁড়ি দিয়ে তার একটু আগে আগেই উঠছে প্রমিতার বান্ধবী ইরা। সঙ্গে সেই মেয়েটি, হেনা। শৈবাল মুচকি হাসল, তার কথা ঠিক মিলে গেছে। ইরা এরই মধ্যে ফেরত দিতে এসেছে মেয়েটিকে। ইরার বাড়িতে কিছুতেই লোক টেকে না!

ঠিক মেলেনি অবশ্য! ইরা ফেরত দিতে আসেনি হেনাকে। ওকে সঙ্গে নিয়ে বাজার করতে বেরিয়েছে। তার আগে এবাড়িতে ঘুরে যাওয়ার একটা উদ্দেশ্য আছে। হেনা তার গামছা ফেলে গিয়েছিল এবাড়িতে, সেটা নিতে এসেছে। হেনার সঙ্গে একটা ছোটো জামাকাপড়ের পুঁটুলি ছিল। সেটা সে নিয়ে গেছে বটে, কিন্তু ভুল করে গামছা রেখে গেছে।

বসবার ঘরে প্রমিতা, ইরা আর শৈবাল বসল। প্রমিতা হেনাকে বলল, বারান্দায় অনন্তর জামাকাপড় থাকে, দেখ সেখানে তোর গামছা আছে।

হেনা এসে দেখল সেখানে মাদুর পেতে শুয়ে আছে অনন্ত। চোখ দুটো লাল। এদিক ওদিক তাকিয়ে হেনা তার গামছাটা খুঁজে পেল না। অনন্তকে জিজ্ঞেস করতেও তার লজ্জা হচ্ছে! অনন্ত নিজেই জিজ্ঞেস করল, কী?

আমার গামছাটা।

অনন্ত আঙুল দিয়ে দেখাল, ওই যে।

এককোণে একটা খবরের কাগজে মোড়া প্যাকেট। অনন্ত যত্ন করে গামছাটা রেখে দিয়েছে। হেনা ভেবেছিল গামছাটা সে বোধ হয় আর পাবে না। অনন্ত সেটা ফেলে দেবে, কিংবা ঘর-মোছা করবে।

প্যাকেটটা হাতে তুলে নিয়ে হেনা একটু দাঁড়াল।

অনন্ত বলল, আমায় এক গেলাস জল এনে দেবে? ভীষণ গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।

কথাটা শুনে দুঃখের বদলে খুব লজ্জা হল হেনার। সে এবাড়িতে কাজ করে না। রান্নাঘর থেকে জল গড়িয়ে বাবু আর দিদিমণিদের সামনে দিয়ে তাকে নিয়ে আসতে হবে। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে? যদি কেউ কিছু ভাবে? অথচ কেউ জল চাইলে, জল না দিয়েও পারা যায় না। হেনাকে দেখেছে বলেই তো অনন্ত জল চেয়েছে। সে তো বাবু কিংবা দিদিমণিকে ডেকে জল চাইতে পারে না। চাকর-বাকররা অসুখ হলেও কি বাবুদের কাছে সেবা চায়?

রান্নাঘরে গেল জল গড়িয়ে আনতে। একটা গেলাস ভরে নিয়ে বেরিয়ে আসছে, অমনি প্রমিতা ঠিক দেখে ফেলেছে তাকে।

ও কী করছিস?

ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল হেনা। দিদিমণির গলার ঝাঁঝ। সে কি কিছু অন্যায় করে ফেলেছে? কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলল, ওই যে ও, ও জল চাইছিল।

ও মানে কে?

ওই যে…অনন্ত।

প্রমিতা বলল, জল চাইছে অনন্ত? তুই এই গেলাসে–একবার আমাদের জিজ্ঞেস করতে পারিস না? অনন্তর তো আলাদা গেলাস আছে সেটাতে দিবি তো। এটা তো বাবুর গেলাস। রান্নাঘরে দেখ একটা কলাই-করা গেলাস আছে।

ইরা ধমক দিয়ে বলল, তুই আগে আমাদের বলবি তো। আগেই নিজে সর্দারি করে গেলাস নিতে গেছিস কেন?

সেকথাটাই তো ভাবছিল হেনা। চাকর-বাকররা জল চাইলে সেকথা কি বাবুদের বলা যায়? তার সামান্য বুদ্ধিতে এর উত্তরটা খুঁজে পায়নি।

কলাই-করা গেলাসটা খুঁজে পেয়ে তাতে করে জল এনে দিল হেনা। কোনোরকমে মাথা উঁচু করে জলটা খেল অনন্ত। এক দিনের জ্বরেই সে বেশ কাবু হয়ে গেছে। এক চুমুকে জলটা শেষ করে সে বলল, ওঃ।

হেনার ইচ্ছে হল অনন্তকে একটা-কিছু বলে। কোনো সান্ত্বনা দেয় কিন্তু কোনো কথাই তার মনে এল না।

এইসময় ইরা ডাকল, হেনা, হেনা! গামছা পেয়েছিস?

হেনার কিছুই বলা হল না।

ইরারা চলে যাওয়ার পর শৈবাল বলল, বাবা, কী কঞ্জুস তোমার বান্ধবী। একটা গামছাও কিনে দিতে পারে না? সেজন্য এতদূর এসেছে!

এ ব্যাপারটা প্রমিতারও দৃষ্টিকটু লেগেছে। তাই সে বান্ধবীর সমর্থনে কোনো কথা বলতে পারল না। একটা পুরোনো গামছার জন্য এতদূর আসা মোটেই মানায় না ইরাকে। অথচ ইরা মোটেই কৃপণ নয়। যখন-তখন টাকাপয়সা হারায়। বন্ধুবান্ধবদের দামি দামি জিনিস উপহার দেয়।

শৈবালই আবার বলল, অবশ্য সপ্তাহে দু-তিনবার ঝি-চাকর বদলালে কতজনকেই-বা গামছা কিনে দেবে! ইরা বোধ হয় যাচাই করে দেখতে এসেছিল, ওই মেয়েটা সত্যিই গামছা ফেলে গেছে না মিথ্যেকথা বলেছে।

প্রমিতা বলল, তোমার সঙ্গে আমার গল্প করলে চলবে না। রান্না করতে হবে। আজ শুধু ফেনাভাত খেয়ে যেতে পারবে তো?

অনন্তর জ্বর ক-দিনে ছাড়বে তার ঠিক নেই। সে-ক-দিন প্রমিতাকেই রান্না করতে হবে। সেজন্য প্রমিতা অবশ্য খুব-একটা বিরক্ত নয়। অনন্ত প্রায় বাড়ির ছেলের মতন হয়ে গেছে। অনেক লোকজন ছাড়াবার পর ওকে এখন খুব পছন্দ হয়েছে শৈবালেরও। এ-রকম শান্ত নিরীহ লোক আর পাওয়া যাবে না।

ইচ্ছে করলে প্রমিতা বেশ দ্রুত হাতেই রান্নার কাজ সেরে ফেলতে পারে। ইস্কুল-অফিসের ঠিকসময়ে সে খাবার দিয়ে দিল।

শৈবাল বলল, এখন ক-দিন তোমায় রান্না করতে হয় দেখো।

প্রমিতা বলল, সে আমি ঠিক চালিয়ে দেব।

যাওয়ার সময় শৈবাল বলল, ডাক্তার এলে জিজ্ঞেস করে নিয়ো, অনন্ত কী খাবে।

প্রমিতা বলল, দুধ পাউরুটি দিয়ে দেব নাহয়।

অফিসে কাজের মধ্যে সবেমাত্র ডুব দিয়েছে শৈবাল, এইসময় বাড়ি থেকে ফোন এল! প্রমিতা ভয়ে প্রায় চিৎকার করছে। তক্ষুনি সে শৈবালকে একবার বাড়ি চলে আসবার জন্য অনুরোধ করছে!

আবার গোলমাল। দারুণ গোলমাল। ডাক্তারবাবু এসে বলে গেছেন, অনন্তর পক্স হয়েছে।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress