অন্তর্জলী যাত্রা (Antarjali Jatra) : 02
এমত কালে তীব্র কলহের অসভ্য ভয়ঙ্কর শব্দে সকলেই শশব্যস্তে, ব্যগ্রতা সহকারে মন ফিরাইলেন। এমনকি কীৰ্ত্তন সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেরই চক্ষু তির্যকভাবে পড়িয়া যাইতে চাহিল। দুই ভাই, বলরাম এবং হরেরাম, প্রখর হইয়া উঠিয়াছে, ক্ষুরধার বচসায় দুইজনে ক্ষিপ্ত, শির সঞ্চালনে দুইজনেই অকাতর।
হরেরাম তখন বলিতেছিল, “তুমি ওখানে বসতে পাবে না।”
“কেন পাব না শুনি…ওঃ ওনার কথায়…”
“না পাবে না…ভাব আমি ঘাস খাই…বুঝি না…না?”
“বলি বোঝাটা কি শুনি…মাঢ়ভেতো বুদ্ধি…”
“খবরদার বলছি…চোর কোথাকার!”
“এই মুখ সামলে…না হলে আমি খড়ম পেটা…”
হরেরামের উত্তর করিবার পূর্বেই বিহারীনাথ রাশভারী কণ্ঠে ধমক দিয়া উঠিলেন। “ছিঃ ছিঃ তোমরা কি মানুষ না পশু? লোকটা এখন-তখন, ছিঃ ছিঃ তোমাদের কি কোন ধম্মজ্ঞান নেই।”
দুইজনেই ধমক খাইয়া বাক্য ত্যাগ করিলেও, অস্পষ্ট ক্রোধবাচক শব্দ তখনও করিতেছিল।
“ছিঃ ছিঃ! তোমরা…”
“ও-ই ত শুরু করলে…দেখুন না সেই কখন থেকে বাবা আমার কোলে মাথা দিয়ে আছেন, তাতে আমার পা অবশ হয়ে গেছে, তাই সাড় ফিরাবার জন্য একটু আঙুল মটকাচ্ছি…অমনি…”
“আঙুল মটকাবার জন্য বাবার পিঠের তলায় তোমার হাত চাবি খুঁজছিল…”
“হরে হরে আমি পৈতে ছিঁড়ে তোমায় অভিশাপ…”
“আবার বলরাম…” বিহারীনাথ দৃঢ়ভাবে কহিলেন।
বচসা থামিল। জ্যোতিষী পুনরায় বৃদ্ধের হাতের প্রতি মনঃসংযোগ করত ধীরে ধীরে বলিলেন, “কর-কোষ্ঠীর কথা আর এক, তবু এখানেও দেখুন…কোন…”
বিহারীনাথ বৃদ্ধের হাতের দিকে শিশুসুলভ মনে দেখিতেছিলেন। এই সময় জ্যোতিষী, বৃদ্ধের দেহের উপর দিয়া, শরীরকে বাঁকাইয়া কবিরাজের কানে কানে কহিলেন, “আর একটা কথা বলি, বুড়ো সীতারাম একা যাবে না,…সৰ্বস্ব পণ করতে রাজী, কবিরাজ মশাই–সীতারাম দোসর নিয়ে যাবেই.” বলিয়া যেক্ষণে বৃদ্ধের দেহ হইতে আপনকার দেহ সরাইয়া লইলেন, তৎক্ষণাৎ সকলেই বৃদ্ধের বক্ষে, যেখানে কতিপয় রোমরাজি–সেখানে এক অলৌকিক বিস্ময়কর দৃশ্যে হতবাক আশ্চর্য্য হইলেন।
সেইখানে এক নয়নাভিরাম, বাবু, সুন্দর প্রজাপতি চুপ হইয়াছিল; সকালের রোদ এবং রোদের অভাবে যাহার মনোহারিত্ব একই। এ জীব যেমন বা সোহাগের আরশিতুল্য, ফলে সকলেরই আসক্তির পরিসীমা ছিল না। সকলেই এই সৌন্দৰ্য্য দর্শনে অভিভূতের ন্যায় ‘আঃ বিস্ময়বাচক শব্দ করিয়াছিল সকলেরই মুখ এখনও অৰ্দ্ধ উন্মুক্ত!
লক্ষ্মীনারায়ণ এই বিভূতি দর্শনে স্তম্ভিত হইলেও একমাত্র তিনিই বলিয়া উঠিয়াছিলেন “প্রজাপতি প্রজাপতি” এবং তাঁহার চোখে জল দেখা দিল।
এখনও সকলেই মোহগ্রস্ত, শুধু বৈজুনাথ কীৰ্ত্তনের দলের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারিয়া এই দৃশ্যটি দেখিবার চেষ্টা করিতেছিল।
এ-পতঙ্গ যে পতঙ্গ সৃষ্টির সাক্ষাৎ পরমায়ু, অক্ষর এবং রঙের মধ্যবর্ত্তী বাসনা, দুঃখীর মনচোরা ভ্রম স্বাধীনতা!
জ্যোতিষী অনন্তহরি ভূতাবিষ্টের মত কহিলেন, “কি(ম) আশ্চর্য! প্রজাপতি সিন্দুর।” এই দৃশ্যের সহিত তাঁহার দৃষ্টি যেমন বা জুড়িয়া গিয়াছিল, কোন ক্রমে সে-জীব হইতে দৃষ্টি ছাড়াইয়া আনিয়া কবিরাজের দিকে তাকাইলেন, বুঝা গেল তিনি অনন্তহরি, অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছেন। আধো আধো স্বরে, “প্রজাপতি, দোসর…দোসর নিবে” অন্যমনস্কভাবে বলিয়াছিলেন।
কবিরাজ এই যুক্তিহীন দৈব-ঘটনাকে প্রীতির চক্ষে না দেখিলেও, এ মহা আশ্চর্যে তিনি সত্যই হতবাক হইয়াছিলেন। সুন্দর তুচ্ছ পতঙ্গটি এরূপ ভয়ঙ্কর খেলা খেলিবে তাহা তাঁহার জানা ছিল না।
অনেকক্ষণ ধরিয়া সকলেই পতঙ্গটি দেখিল, এখনও যাহা স্পন্দনরহিত নির্বিকার। এ কথা নিমেষেই সকলে বুঝিল যে ইহা কোন সৌভাগ্যবতীর বারতা বহন করিয়া আনিয়াছে, জীবনই যাহার জীবিকা, উপাধান যাহার মনের কথার শ্রোতা, লতা পাতা কীট পতঙ্গ যাহার আপনজন, আপনার প্রতি বিতৃষ্ণাই যাহার কর্তব্য; যে বালিকা নিজহাতে শিব গড়িয়া ভক্তিভরে তাহার পূজা করিয়াছে, প্রণাম করিয়াছে। সেই মৃত্তিকা স্তম্ভে (!) আপনকার সুখমোক্ষ দাতাকে প্রত্যক্ষ করত আপনার জীবনে চন্দ্রালোক আনিয়াছে। সিন্দুরকে অক্ষয় করিবার মানসে কায়মনোবাক্যে দেহকে শুদ্ধ এবং মনকে সুন্দর রাখিয়াছে। এই কল্পনা লইয়া যে নিদ্রাচ্ছন্ন এই প্রজাপতি বুঝি তাহার সংবাদ আনিল!
এতক্ষণ পরে প্রজাপতি উড়িল, কীৰ্ত্তনের দল পথ ছাড়িল। ক্রমে ঊর্ধে আরও উর্ধে, নামিল, চলিল! এখন বৈজুনাথের দিকে পতঙ্গটি যাইতেই বৈজুনাথ বোকার মত সরিয়া গেল। এবং এই সময় শুনিল কে যেন হাঁকিতেছে, “আঃ মরণ, গোখোর বেটা…তোর গায়ে যেন না লাগে…”
বৈজুনাথ আর এক-পা ভূতচালিতের মত পিছু হটিতে গিয়া বেসামাল হইল।
কিন্তু লক্ষ্মীনারায়ণ এখনও প্রজাপতিটি লক্ষ্য করিতেছিলেন এবং অনবরত বৈজুনাথকে সরিতে বলিতেছিলেন, কারণ তাহার অঙ্গ যদি স্পর্শ করে তাহা হইলে তাহা অমঙ্গলসূচক হইবে।
কিন্তু হায়, প্রজাপতি শ্মশানে বিভ্রান্ত হইয়াছিল। তাহাকে চিতাধূমের মধ্যে দেখা গেল, অনন্তর। তাহাকে চিতার প্রায় নিকটে দেখা গেল এবং কালক্রমে সে যেন বিমোহিত হইল, রঙ হারাইল, চিতার শিখার রেখার মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল। ধূম অধিকমাত্রায় নির্গতবান, ইদানীং পতঙ্গ অপ্রকট–শেষ অশ্রুজল যদি সে পতঙ্গের, বাষ্প হইয়া দূর ঊর্ধ্বে, ক্রমে শিশুর চাপল্যরীতি-মেঘকায়ানবজলধরে পরিণত, পুনশ্চ বিদ্যুল্লতায় তাহার নশ্বরতা দেখা দিবে এবং মরলোকের প্রেম সে বিভায় উদ্ভাসিত হইবে, রমণীর সৌন্দৰ্য্য ষটচক্র বাহিয়া পদ্মে মতিত্ব দিবে, আর যে আমরা স্থির হইব।
প্রজাপতি ফাঁকি দিয়াছিল। গোচরীভূত সম্বন্ধে সম্পর্কে চক্ষু হাইয়া গিয়াছে মাত্র, অনেকক্ষণ পরে লক্ষ্মীনারায়ণ এবং অন্যান্য সকলেই জমিয়া উঠা রুদ্ধশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন। বৈজুনাথের তীব্র অথচ হতাশ স্বরে সকলেই ইহকাল ফিরিয়া পাইয়াছেন, সে বলিয়াছিল, “হায় গো, গেল গো ছাই হঁইয়ে, বীজ রাখলেন না হে–এ বড় অবাক কথা।”
মন পুনৰ্ব্বার শিরা-উপশিরায় তৎপর হইয়া উঠিল–তখনও স্তব্ধতা ছিল।
বিহারীনাথ আপনাকে সর্বপ্রথম, বিবেচনার মধ্যে পাইলেন; কিঞ্চিৎ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “তাহলে জ্যোতিষী, দোসর তো নেবেই” এই বাক্যে নিঃশ্বাসের আওয়াজ ছিল, ইহার পর যোগ দিলেন, “তাহলে আর কি, তাহলে, মহাব্যোম বড় ‘একা’ জায়গা, অবশ্য প্রকৃতি সেখানেও আছে, দোসর দেখলে চিনে নেবে সীতারাম…বৈকুণ্ঠ বাস হবে।”
সকলেই বিহারীনাথের কথা বুঝিবার ভাণ করিলেন মাত্র। বিহারীনাথ তাহা বুঝিতে পারিলেন না, তিনি নিজের মনোভাবকে আরও রূঢ় করিয়া বলিলেন, “সাতশ’ মন কাঠ যোগাড় কর, সাত বেড়া পেরোতে হবে ত…” অতঃপর সঞ্চিত উষ্ময় দাঁতে দাঁত ঘষিতে লাগিলেন, এই যন্ত্রণাদায়ক বিরক্তিকর শব্দ সকলকেই বিশ্রী করিয়া তুলিয়াছিল।
তটপ্রপাতে তীরবাসীরা যেমত আতঙ্কিত হয়, উৎসাহী ব্যক্তিরাও তেমনি হইয়াছিলেন। একে অন্যের মুখপানে তাকাইয়া পরে অন্যমনা। অনন্তহরি একস্থ, খুব ধীরে আপনার ওষ্ঠের একান্ত ফাঁক করিয়া, একটি ভ্র উঁচু করত কহিলেন, “কবিরাজ মশাই, আপনার নাতির শ্বশুরের কোন এক আত্মীয় ফিরিঙ্গী ভাষা জানে তাই আপনি…” ইহার পর কণ্ঠস্বর আরও দৃঢ় করিয়া বলিলেন, “এ ব্যবস্থা আজকার নয়, মাদ্রীকে মনে পড়ে…”
এই শ্লেষে বিহারীনাথ চকিতেই মুখ ফিরাইয়া জ্যোতিষীর প্রতি কঠিনভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। জ্যোতিষীর ঠোঁটে কুঞ্চিত-হাসির রেশ ছিল, তাঁহার প্রতিপক্ষ যে সঙ্কটাপন্ন তাহা বুঝিয়া লইতে তাঁহার বিলম্ব হয় নাই, এবং তিনি সদম্ভে ঘোষণা করিলেন, “দোসর সীতারাম নেবেই, এ কথা ধ্রুবসত্য, মঙ্গল রাহু বৃহস্পতি ঘর…”
বিহারীনাথ আপনার ক্রোধ শান্ত করিতে সমর্থ হন নাই। বিবাহের প্রস্তাবে এতাবৎ একমাত্র তিনিই বাধা দিয়া আসিয়াছেন, এখন তাঁহার পরাজয় অবধারিত বুঝিয়া তাচ্ছিল্যভরে কহিলেন, “অবশ্যম্ভাবী…”
“শিবের কলম…”
“শিবের কলম, আপনারা দেখছেন সীতারামের কৰ্ম্মপাশ ক্ষয় হয়ে এসেছে…”
“ছিঃ ছিঃ কবিরাজ মশাই, সীতারামবাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছে…সে শুনতে…” লক্ষ্মীনারায়ণ কোন রকমে বলিয়া ফেলিলেন।
“আঃ সত্য কথা ত…”
“বুঝলাম, বুঝলাম কবিরাজ মশাই, কিন্তু আমি কি মহাপাতক হব! আপনিও ত বর্ণশ্রেষ্ঠ, আপনিও কন্যার পিতা”–লক্ষ্মীনারায়ণ এই পর্যন্ত বলিয়া সাধু ভাষা খুঁজিতে লাগিলেন।
“আপনি এখানে সম্প্রদান করিলেই কি…” বিহারীনাথ বলিতে ছিলেন।
“স্বর্গ না লাভ হোক, জাতি কুলমান রক্ষা পাবে নিশ্চিত…এতে কোন সংশয় নেই”–অনন্তহরি কাতর লক্ষ্মীনারায়ণের হইয়া, কবিরাজকে বাধাদান করিলেন এবং পুনৰ্ব্বার কহিলেন, “দেশে বিদেশে পাত্র যদি লক্ষ্মীনারায়ণ খুড়ো পেত, সহৃদয় কাউকে পেত, নিশ্চয় এখানে আসত না। তারপর বিধির লিখন এমন কি স্ত্রীলোকেও জানে জন্ম মৃত্যু বিবাহ…”।
বিহারীনাথ সবই জানিতেন। সীতারামের প্রৌঢ় পুত্রদ্বয়ও পর্য্যন্ত বিবাহ করিতে স্বীকৃত হয় নাই! কেহই হয় নাই, সকলেই প্রয়োজন বুঝিয়াই বিবাহ করিবে। তথাপি কবিরাজ বলিয়া মানুষের প্রতি সংস্কার ছিল, আপনার ভিতরে কে যেমন বা আস্ফালন ব্যস্ত, তিনি আরম্ভ করিলেন, “আপনি জ্যোতিষী, তবু বুঝুন যে লোকের অহোরাত্র পার হয় কিনা…”
“অহোরাত্র নয়, চাঁদে যখন লাল পূর্ণিমা, সীতারাম পুণ্যবান, যাবার সময়েও সে মানরক্ষা করে যাবে” বলিয়া জ্যোতিষী অতি শ্রদ্ধাভরে সীতারামের মুখের দিকে লক্ষ্য করিলেন।
“কিন্তু সত্য কি কন্যার বৈধব্য-যোগ, আছে? না…” বিহারীনাথ দস্তাঘাত করিবার প্রয়াস পাইলেন।
অনন্তহরি তাঁহাকে তুচ্ছ করিয়া কহিলেন, “আগেই ত বলেছি দোসর…”
“বাঃ তাহলেই সব চুকে গেল!” পরাজিত বিহারীনাথ অদ্ভুত বিকৃত স্বরে এই কথা বলিলেন, তাঁহার মনোবৃত্তি ক্ষুণ্ণ, ক্ষুব্ধ, লজ্জিত, অপমানিত, বিপন্ন হইয়াছিল। তাঁহার রোমরাজি কণ্টকিত এবং স্বভাব নষ্টপ্রায়!
লক্ষ্মীনারায়ণ বিক্ষুব্ধ; পুত্রদ্বয় এবং কৃষ্ণপ্রাণ–ইহাদের ক্ষণকালের জন্য স্পষ্ট করিয়া দেখিয়া লইলেন। অনন্তহরির পদতলগত খড়গুলি এক প্রকার শব্দ করিয়া উঠিল, তাঁহার ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটিয়াছিল, ক্রোধান্ধ বিড়ালের মতই সাপাট ছাড়িয়া কহিলেন, “বলি আপনি ত জ্ঞানী সাজছেন, কেন, আপনারা বংশপরম্পরা ওষুধ এত্যাদি দেন না…”
“দেব না কেন, না দিলে ঘর দোর জ্বালাবে বলে…”
“বটে, ঘর রাখতে আপনি যেমন উপায়হীন তেমনি…লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার ধৰ্ম্ম…আপনার সঙ্গে বাক্য নিষ্প্রয়োজন; এক্ষেত্রে ওঁদের কুলপুরোহিত, পুত্ররা বর্তমান…অমত নেই…ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম রক্ষা করতে ব্রাহ্মণই আছে…”।
কৃষ্ণপ্রাণ কহিলেন, “অনন্তহরি, সীতারামের যখন জ্ঞান এসেছে, আৰ্ত্ত নয়, তখন তার একটা মত নেওয়া প্রয়োজন।”
ইতিমধ্যে রিক্ত-মেদ কুঞ্চিত হাতখানি ক্রমে ক্রমে অপগত হয়, তথা সীতারাম আপনার হাতখানি অপসারণ করিল, বিষাক্ত সর্পের ল্যাজ যেমন গহ্বরে অদৃশ্য; তদ্দর্শনে নিকটস্থ মানুষেরা নিশ্চিত হইয়াছিল, শুধুমাত্র লক্ষ্মীনারায়ণ ভীত।
সীতারাম প্রমাণ করিলেন, তাঁহার জ্ঞান আসিয়াছে এবং কৃষ্ণপ্রাণ দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “জ্ঞান ফিরে এসেছে।”
‘জ্ঞান এসেছে’ উক্তিতে জলে নোঙ্গর নিক্ষেপ করার আওয়াজ ছিল, অনন্তহরি ইত্যাদির মধ্যে এক অপরিজ্ঞাত ভাবান্তর হয়–ক্রমাগতই কাহারা জপ করিতেছে, কাহারও মধ্যে শেষোক্ত চন্দ্রকলা পুনরায় দৃশ্যমান, কাহারও সম্মুখে জোনাকী খেলিতে লাগিল, কাহারও মধ্যে বর্ণচ্ছটা আলোড়িত হইল, কোথাও বিন্দু স্ফীত হইতে চাহিল!
সকলেই কিছুক্ষণ এইভাবে অতিবাহিত করিবার পর, সত্বর বৃদ্ধকে স্পর্শ করিবার জন্য আগ্রহান্বিত হইলেন। কেহ বা আপন আপন ইষ্টনাম জপ করিতে লাগিলেন, আরও মনে হয় কেহ বা নিদ্রাকে হস্ত দ্বারা স্পর্শ করিলেন।
জ্ঞান আসিল। বৃদ্ধের পুনরায় ‘আমি’ বলিবার ক্ষমতা আসিল। পৃথিবীর চক্রবৎ পরিবর্তনের শব্দ শ্রুত হইল।
বৃদ্ধের দৈহিক জ্ঞান বিষয়ে অনন্তহরি অত্যধিক আস্থাবান; লক্ষ্মীনারায়ণ অনবরত দুর্গা নামে ব্যস্ত, তৎসহ তাঁহার করজোড় কভু বক্ষস্থলে ক্কচিৎ কপালের আজ্ঞাচক্রে আবেগে উত্তেজনায় উঠানামা করিতে লাগিল। তাঁহার দেহের অনিশ্চয়ত্মক দ্বন্দ্ব তাঁহার নিঃশ্বাসে এখন যন্ত্র আঁকিয়া বীজমন্ত্র লিখিতেছিল।
জ্যোতিষীর হাতের মধ্য হইতে সীতারাম আপনার হাতটি সরাইয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার চোখের পাতা দুই চারিবার উঠাপড়া করিয়া প্রমাণ করিল যে জ্ঞানলাভ হইতেছে। কবিরাজ তাঁহার বক্ষের কাছে মাথা রাখিয়া বুঝিলেন, পৃথিবীর জন্য আবার হৃদয় স্পন্দিত হইতেছে। এবং তিনি মাথা উঠাইতেই কুলপুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ সীতারামের কান হইতে তুলা খুলিয়া বলিলেন, “সীতারাম…”
সীতারাম তাঁহার দিকে চাহিলেন।
“তোমার বিয়ে…”
সীতারাম নির্বাক।
“তোমার বিয়ে, তুমি রাজী…”
দ্বিতীয় প্রশ্নে মনে হয় কৃষ্ণপ্রাণের কথা বুঝিয়া লইবার ইচ্ছা থাকিলেও এখনও, একাধারে কীৰ্ত্তন ও ব্যাখ্যার জন্য সীতারাম সঠিকভাবে শুনিতে পান নাই; কাতর মুখোনি কোনরূপে ঈষৎ নাড়িলেন; কৃষ্ণপ্রাণ তাহাতে যেন বুঝিতে পারিলেন, এবং সেই সঙ্গেই কীৰ্ত্তনকারী ও গীতাপাঠকারীকে থামিতে কহিলেন। তাহারা থামিল। পুনৰ্ব্বার তিনি সীতারামের কর্ণকুহরে বলিবার জন্য গলা পরিষ্কার করিয়া কহিলেন, “সীতারাম, ব্রাহ্মণের কন্যাদায়, তুমি তাকে আমাদের ইচ্ছা, বিয়ে করে, ব্রাহ্মণকে বাঁচাও…তুমি রাজী…”
অধুনা শায়িত সীতারামের মুখে কীৰ্ত্তন থামার দরুণ সকালের আলো পড়িয়াছিল; তিনি–টিয়াপাখী আপনার নাম শুনিলে যেমত মাথা ঘুরায়–তেমনি, মাথা ঘুরাইতে লাগিলেন, এমন মনে হয় উপস্থিত সকলকে যেন ঠিক দিয়া লইলেন, এবং ইহার পর উর্দ্ধ আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াছিলেন। সীতারাম চাটুজ্জ্যের ইত্যাকার ভাব দেখিয়া কৃষ্ণপ্রাণ কাতরভাবে মাথা দুলাইয়া বলিলেন, “সম্ভবত রাজী নয়…”
এই কথায় লক্ষ্মীনারায়ণ কাঁদ কাঁদ হইয়া কহিলেন, “আর একবার…”
“রাজী হতেই হবে! না হলে সাবালক দুই পুত্র বর্তমান, তারাই মত দেবে…আমার গণনা মিথ্যে হতে পারে না…” অনন্তহরি মহা দর্পে বলিলেন।
“নাড়ী ফিরলেই যে সকল জ্ঞান থাকবে এমন নয়, মাঝে মাঝে লুপ্ত হবেই…” কবিরাজ মন্তব্য করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, এবং ঘৃণায় বলিলেন, “অনেক পাপ ত করেছি, এটা নয় নাই করলাম…আমি যাচ্ছি, তবু বলি বাঁড়ুজ্জ্যে মশাই, আমার কাছে অনেক বিষ আছে…তার একটু আপনি…”
লক্ষ্মীনারায়ণ নিজের কানে আঙ্গুল দিয়া কহিলেন, “ছিঃ ছিঃ আপনি কি ব্রাহ্মণ!”
কবিরাজ আর অপেক্ষা করিলেন না।
“ঠাকুর মশাই আপনি বলুন” জ্যোতিষী অনুরোধ করিলেন।
“সীতারাম, ব্রাহ্মণের কন্যাদায়, বিয়ে করবে? রাজী…”
এই কথায় সীতারামের নাসিকাগহ্বর দিয়া জল আসিল। ধীরে ধীরে শীতকম্পিত হাতখানি মুখমণ্ডলে বুলাইয়া কোনমতে বলিলেন, “দাড়ি…” দন্তহীন, মাড়ি দেখা গেল; বাক্যের শব্দের পরিবর্তে হাওয়াই বেশী করিয়া শোনা গেল।
‘খেউরি হইব’ কথাটি বলিতে হইল না, সকলেই বুঝিয়া লইল।
লক্ষ্মীনারায়ণ বোকার মত হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তাঁহার শরীর কিছুটা বাঁকিয়া নীচু হইয়াছিল, তাঁহার মুখের ঠিক নিম্নস্থান দিয়া অনুচ্চ হাসির স্রোত চলাফেরা করিতেছিল, এবং ইহার সহিত জ্যোতিষীর সরস মন্তব্য, “কবিরাজ বলে নাকি জ্ঞান নেই? না না জ্ঞান মাঝে মাঝে লুপ্ত হবে! এই জ্ঞানটুকুই যথেষ্ট…ব্রাহ্মণ বাঁচলো…যাও দাঁড়িয়ে কেন, লক্ষ্মীনারায়ণ, যাও মেয়ে আন।”
“এ্যাঁ”…
“হ্যাঁ হ্যাঁ…”
লক্ষ্মীনারায়ণ যে কি করিবেন তাহা ঠিক পাইলেন না। মাটি দেখিলেন, আকাশ দেখিলেন, পৈতা দেখিলেন, তাহার পর অদূরে গঙ্গা, পাগলের মতই দৌড়াইয়া গিয়া, “মাগো মা মা, এতদিন বাদে দয়া করিলে মা” বলিয়া হাত দিয়া জল মাথায় দিতে গিয়া, হঠাৎ গঙ্গায় নামিয়া অনবরত ডুব দিতে লাগিলেন। তাহার কিয়ৎক্ষণ পরেই উঠিয়া আসিয়া, জলসিক্ত বসনে, রুদ্ধকণ্ঠে প্রশ্ন করিবেন বলিয়া মুখ খুলিলেন, কিন্তু ওষ্ঠদ্বয় বাঁকিল কিন্তু শব্দ বাহির হইল না। এমত সময় ইষ্টদেবতা স্মরণ নিমিত্ত হাতখানি বক্ষের নিকটে স্থাপিত ছিল।
“কি, এই শ্মশানঘাটে স্নান করলে? মাথা খারাপ না কি?কি বল…?”
“হবে ত…” লক্ষ্মীনারায়ণের তখনও প্রত্যয় হয় নাই।
“সীতারাম নিজে রাজী, আবার…! কিন্তু হ্যাঁ, একটা কথা কি জান তোমায় বলে রাখা ভাল, এখনি কথা হচ্ছিল, কি হে বলরাম…কি বল আগের কালের মত ধৰ্ম্ম সত্যরক্ষা একালে নেই, বিয়ের পর তোমার যদি…”
“দেখবেন ঠাকুর মশাই, আমার মেয়ে তেমন…”
“তা নয়, কোম্পানীর রাজত্ব, ঘোর কলি, সহমরণে যে পুণ্য আছে একথা কেউ বিশ্বাস করে কি…যাই হোক…যদি না হয় তোমাকে নিতে হবে…শেষে স্ত্রী বলে একটা মামলা রুজু করে দিলে, এরা বলছে। ব্রাহ্মণের দায় উদ্ধার করতে গিয়ে…”।
“আপনি আমায় তামা তুলসী দিন, গঙ্গা আছেন, আমি…” লক্ষ্মীনারায়ণের সখেদ উক্তি শোনা গেল।
দূর হইতে কবিরাজের কণ্ঠ আসিল, “আর প্রয়োজন নেই, অল্প বয়সী বিধবার ভার কোন বাপ নেয়, আমি বুঝি না।” নিম্নকণ্ঠে মনে হয় বৈজুকে কহিলেন, “একবেলা খাওয়া উপোস, চুল কপচে দেবে, তবু সন্দেহ ঘোচে না…ইস, কিছু করবার যো নেই…”
“ঠাকুর মশায় বারুণ কর তুমি”–বৈজুনাথ অনুরোধ করিয়াছিল।
“বারুণ কে শুনবে? কৃষ্ণপ্রাণ, জ্যোতিষী অনন্ত এদের ত লাভ–সতীদাহ যখন হয় তখন।”
“হাঁ হাঁ জানি জানি, বলবে সোনা ছাড়া স্বগ্যে কিছু যাবে না, ওগো সোনা দাও, অক্ষয় স্বগ্য বাস…সোনা…আমায় বলবে, তুই শালা চাঁড়াল, বামুন কায়েতের সতী, এর ছায়া মাড়াবি না…তারপর চিতা লিভিয়ে সোনা খুঁজবে, আমায় বলবে বেশী গর্ত কর।”
“তা কেন বলবে না, যদি থানাদার…”
“কি হত? সে শালা ঘুষ লিত…”
একথায় বিহারীনাথ অন্যমনস্ক হইয়াছিলেন।
বৈজু মহাআক্রোশে বলিল, “একটু উঁচুজাত না হলে শালা আমি লাঠি ঘুরাতাম…”
“চুপ চুপ…”
“না, বড় প্রাণে লাগে, তোমরা ভাব আমি চাঁড়াল–মড়া দেখতে আমার বেজার নাই, সত্য, কিন্তু কেউ মরছে দেখলে বেজার লাগবে না…” থামিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “আমি চিতা সাজাব, সব পাপ আমার লাগবে, সেই পাপে বউটাকে কুমীরে নিয়ে গেল…”
কবিরাজ উঠিয়া কাহারও কাছে বিদায় গ্রহণ না করিয়া চলিয়া গেলেন–বৈজুও উঠিয়া মাটিতে একটি লাথি মারিল, তাহার পর বলিল, “কি ঠাকুর, কি হল…?”
লক্ষ্মীনারায়ণ যাইতে যাইতে বলিলেন, “হয়েছে, তোকে পেট ভরে খাওয়াব।”
“খাওয়া ছাড়া আমার কি আছে ঠাকুর!”
বেলা এখন প্রায় শেষ! একটি চিতার কোণে প্রজ্বলিত কাঠের উপরে হাঁড়ি টগবগ করিয়া ফুটিতেছে, এক একটি সুসিদ্ধ চাল লাফাইয়া উঠে; বৈজু ‘এ দেহ তরণী ডুবে যাবে’ গাহিতে গাহিতে একটি কঞ্চি দিয়া ভাত তুলিয়া দেখিবার সময় কান খাড়া করিল। কপাল কুঞ্চিত করিয়া কি যেমন একাগ্র মনে শুনিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
দূরাগত শব্দ আসিতেছে, সম্মুখে স্রোতময়ী গঙ্গার কল্লোল, পাতায় পাতায় হাওয়ার চপলতা সেশব্দকে ক্রমাগত বাধা দিতেছিল; বৈজু একান্তে ভাতের কাঠি রাখিয়া, অল্প শতচ্ছিন্ন চ্যাগড়া কুড়াইয়া হাঁড়ি ধরিয়া ফেন গালিতে লাগিল। এতাবৎ দূরাগত শব্দ এক্ষণে কিঞ্চিৎ স্পষ্ট রূপধারণ করিল, শোনামাত্রই বিরক্তি-উৎপাদনকারী ক্রমান্বয় দেশাড়ী সানাইয়ের আওয়াজ ঢাক ভেদ করিয়া ট্যাঁ ট্যাঁ করিয়া উঠিতেছে, আর ট্যাং ট্যাং করিয়া কাঁসির বজ্জাতি; বৈজু আর স্থির থাকিতে পারিল না। কোনমতে হড়মড় করিয়া ফেন গালাইয়া, আড়ায় রাখিয়া পরক্ষণেই দৌড়াইয়া গিয়া উচ্চ ভেড়ীর উপর উঠিল।
সম্মুখের দূরান্ত নিখোঁজ পৃথিবী দেখিতে গিয়া তাহার অসম্ভব ঘোর লাগিল। হয়ত মনে হইয়া থাকিবে এখন সন্ধ্যা হইলে ভাল হইত। অবিশ্রান্ত দূরত্বকে সম্ভবত বুঝিয়া লইবার কারণেই আপনার ছোট সীমাকে একদা দেখিয়া লইল, যাহার নিম্নে হিম জলরেখা, অজস্র প্রতিবিম্ব-সম্ভবা। এভাবে দেখা তাহাকে কোন দিব্য-সাহস দেয় নাই–শুধু তাহার বর্তমানতা, বাস্তব, সাধারণভাবে অস্তিত্বকে স্পষ্ট করে।
বহুদুরে ধান্যক্ষেতের মধ্য দিয়া ক্ষুদ্র একটি শোভাযাত্রা আসিতেছে। বৈজুনাথ বুঝিল যে ইহা কোন নিম্নজাতির শব নহে। স্পষ্টত দেখিল মধ্যবর্ত্তী ডুলির লাল কাপড়, তাহার এক এক প্রান্তে হেমন্তের হাওয়া উড়িতেছে। সম্মুখে সানাই বাদক, কখনও বা কাঁসিবাদক আলের উপর দিয়া গমনে টাল সামলাইতে না পারিয়া ধান ক্ষেতে নামিয়া পড়িতেছে; যদিচ শরৎ চলিয়া গিয়াছে তথাপি ধান নুইয়া। পড়ে নাই–বৈজু এক দৃষ্টিতে দেখিতে দেখিতে, হায় গো’ বলিয়া আপনকার গালে দুইহাত দিয়া চপেটাঘাত করিতে লাগিল। “হায় গো বাবা পঞ্চমুণ্ডি লেমিনাথ, তোমার লৈবিদ্য, দোসর বুঝি।”
কে একজন ঘাট হইতে ডাকিল, “হেই বৈজু চাঁড়াল, ঢাকের বাদ্দি শুনলে চলবে? এদিকে মড়া পড়ে।কোথায় হে?”
এ হেন ডাক অধুনা হাওয়া সংখ্যার মত ভাস্বর, ক্রমে ক্রমে বৈজু শুনিয়াছিল এবং এই প্রথম, হয়ত বা, সে আপনকার পিছনে যাইতে সক্ষম হইয়াছিল। যেখানে সে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লাভ করিয়াও অপটু। যেখানে সে ক্রন্দনে সৰ্বরূপে দক্ষ, কেননা তাহাই উহার একমাত্র ভগবদ্দত্ত ক্ষমতা। আপনার নগ্নতা যেখানে সূর্যের আলঙ্কারিক বিচিত্রতা, আর একটা দিক।
কিয়ৎক্ষণ ধান্যক্ষেত্রের প্রতি তাকাইয়া সহসা হঠাৎ বৈজু ভেড়ী পথ হইতে ভয়ঙ্কর ভাবে চীৎকার করিল, “ওগো তোমাদের পুণ্যাত্মা বুড়ার ক’নে আসছে”, এদিকে শ্মশান যাত্রীদের বলিল, “বস গো বস, এনেছ তো মড়া, কাঠ তো এলো না এখনও, কত ধূম হবে, কত লাচনা গাওনা হবে, দেখবে না?” ইহার পরে সুরে গাহিল,
“তুমি আমার বাবার ঠাকুর,
টোপর মাথায় দিয়ে এলে,
বুড়ী হয়ে বসে থাক প্রাণ,
মাঝে মাঝে এসে ছোঁব–
তুমি আমার বাবার ঠাকুর”
ভেড়ীর উপরেই বৈজুনাথ নৃত্যের ভঙ্গী দেখাইয়া তেহাই দিল। বৃদ্ধ ব্যতীত সকলেই তাহার এই অসভ্য গান শুনিল, হরেরাম হাসিতে গিয়া গম্ভীর।
শ্মশান্যাত্রী দলের অযোগবাহশব্দ স্পষ্ট আপ্লুত স্বর স্বাভাবিক হইয়াছিল। শবের পাটছোঁয়া লোকটি বলিল, “সে কি গো, বউ? বিয়ের কনে!” এবং পরক্ষণেই আপনার অসংযম স্মরণ করিয়া সহসা উচ্চৈঃস্বরে, “ওগো খুড়ো গো” বলিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
‘ক’নে গো ক’নে, বাবা পঞ্চমুণ্ডি লেমিনাথের লৈবিদ্যি…”
“বলে কি!”
বৈজুনাথ কলমকাটা ভেড়ী পথ বাহিয়া নামিয়া আসিয়া ঘোট দৌড়ে এখানে উপস্থিত হইয়া স্ত্রীলোকের মত ভান করত কহিল, “ওমা, অবাক বললে বাছা! বাছা, বলি তোমার কি জাত গো? কেনে, শোন নাই…বামুন কায়েতের ঘরে সব সময় হয়…” বলিয়া ঝুমুরওয়ালী কেষ্টদাসীর মত ভান করিয়াছিল।
“এই শ্মশানে?”
এ বাক্যে বিস্মৃতি; যে লোকটি এ কথা বলিয়াছিল সে চির-চেনা একটি অন্ধকারকে ইদানীং অপরাহের আলোকে যাহা রেখাবৎ–তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিল। যাহা সর্পগতিতে দূর কোন রক্তস্রোত দর্শনে অদৃশ্য।
‘শ্মশান’ কথাটা শুনিয়া বৈজুনাথ শ্লেষ্ময় ভারাক্রান্ত, কটাক্ষ করিতে উন্মত্ত হইয়া উঠিল, “তবে! পরলোকে সংসার কি খামার বাড়ী থেকে পাতবে? এই লাও! এই তার চারবাগাল বাড়ী, চালাকাঁৎ ঘর গো…” বলিতে বলিতে পশ্চিমে ফিরিয়া তাকাইল। কেননা বিরক্তিকর বাজনা এখন অতীব নিকটে।
ভেড়ীর একস্থানে শ্মশানে আসিবার সঙ্কীর্ণ পথ বৰ্ত্তমান, ইহার পুনরায় হঠাৎ বেশ প্রশস্ত স্থান সিঁড়ির মত এবং নীচে শ্মশান ভূমি।
এক একজন বাজনদার বেসামাল পায়ে নামিল। তাহার পর মুরারী নাপিত; তাহার পর লক্ষ্মীনারায়ণ দ্রুতপদে আসিয়াই পিছন ফিরিয়া বাঁশের ছাতা ঘাড়ে করিয়া ডুলি বাহকদের নির্দ্দেশ দিতে লাগিলেন, কিন্তু দেখা গেল ডুলি বাহকের পরিবর্তে একজন কাঠ লইয়া আসিতেছে। লক্ষ্মীনারায়ণ বলিলেন, “আঃ তুমি আবার কোত্থেকে এলে হে? একটু সবুর সয় না…”
সে কহিল, “বাঃ মড়া পড়ে আছে…”
লক্ষ্মীনারায়ণ তাহার কথায় নারায়ণ নারায়ণ’ করিয়া বলিলেন, “যত অলুক্ষণে কাণ্ড, যাও যাও ওরে তুই খুব সাবধান গা, দেখিস…হা হা কোন বিঘ্ন না হয়, আয় আয়…,
সঙ্কীর্ণ পথ, একটি ডুলি দেখা গেল।
সুন্দর লাল কল্কা ছাপ ‘আরকট ছিটের কাপড়ের মধ্যে অসম্ভব করুণ স্তিমিত ক্রন্দনের শব্দের আধার এই ডুলিখানি, জালা যেখানে রাখা সেখানেই সন্তর্পণে রাখা হইল।
এইস্থান হইতে বুড়া সীতারামকে–তথা বরকে স্পষ্ট দেখা যায়।
লক্ষ্মীনারায়ণ এখন তৎপর, ডুলির খুরা হইতে একটি কাঠি মাদুর বাঁধা ছিল, খুলিয়া লইয়া এখানে পাতিলেন। এখনও সীতারামের মাথার উপর হইতে ছাউনি, যাহা দুপুরের রৌদ্রের জন্য খাটান হইয়াছিল, তাহা খুলিয়া লওয়া হয় নাই। পুরোহিত বৃদ্ধের কানের তুলা খুলিয়া, “সীতারাম, ক’নে এসেছে” বলিয়া উঠিয়া, লক্ষ্মীনারায়ণের নিকটে আসিলেন। ডুলির মুখের পর্দায় ‘অযোধ্যায় রাজকৰ্ম্ম ব্যাপৃত রামচন্দ্র পার্শ্বে সীতা’ ছাপা, সেখানে, ইহার সম্মুখে লক্ষ্মীনারায়ণ দাঁড়াইয়া আপন কন্যাকে আহ্বান করিলেন, “এস মা এস।”
কিয়ৎক্ষণের পরে বলিলেন, “লজ্জা কি মা যশো…নেমে এস” ইহার পর নিজেই অধৈৰ্য্যতার সহিত ডুলির পর্দা খুলিয়া দিলেন। যশোবতাঁকে দেখা গেল।
অনিন্দ্যসুন্দর একটি সালঙ্কারা কন্যা প্রতীয়মান হইল, ক্রন্দনের ফলে অনেক স্থানের চন্দন মুছিয়াছে, আকর্ণবিস্তৃত লোচন রক্তাভ, হলুদ প্রলেপে মুখমণ্ডল ঈষৎ স্বর্ণসবুজ। সৰ্ব্বলক্ষণে দেবীভাব বৰ্ত্তমান, ফলে সহজেই মনে হইবে এ যেন বা চম্পক ঈশ্বরী, লক্ষ্মী প্রতিমা। শুধুমাত্র মুখোনি জন্ম দুঃখিনীর মতই বিষাদময়।
বৃদ্ধ সীতারাম কোনক্রমে মুখ আড় করিলেন, ক্রমাগত নিজের গাল চুষিবার শব্দ, সহসা কিঞ্চিৎ লালা গড়াইল, তিনি দেখিলেন, পটে আঁকা একটি ষড়ঐশ্বৰ্য্যময়ী দেবীমূৰ্ত্তি, এখন তাঁহার পায়জোড় পরিহিত পা মাটিতে ছোঁয়ান, দুটি হাতে দুইদিকের ডুলির চৌকার বাঁকা ধরিয়া আছেন।
এই ডুলির পশ্চাতে বাজনদাররা এ দৃশ্যে, বৃদ্ধদর্শনে, বাজনা ভুলিয়া গেল। কেহ ফুঁ দেয় আবার ঠিক হয়, কেহ বেতালা ঢাক বাজায়, কাঁসি খন খন বাজিয়া উঠে।
যশোবতী বৃদ্ধকে দেখিয়াই চক্ষু তুলিলেন, সীতারামের পিছনে, নিম্নে প্রবাহিণী গঙ্গা। দেখিলেন, স্রোতে গলিত দেহেশকুন বসিয়া মনঃসংযোগ করিতে চেষ্টা করিতেছে, তাহারই পার্শ্বে চক্রাকারে ঘুরিয়া । কাক তাহাকে বিরক্ত করে। বেলাতটে একটি অকেজো ভাওলিয়া, যাহার গায়ে মেটে সিন্দুর দিয়া আঁকা চক্ষু, নিম্ন দিয়া ধ্বনিসহকারে জল বহিয়া যাইতেছে। ক্কচিৎ জলজ পানা।
পুনৰ্ব্বার তিনি, যশোবতী, বৃদ্ধকে নিরীক্ষণ করিলেন।
পাতার ফাঁক দিয়া কঠোর সূৰ্য্যালোক পড়িয়াছে, বৃদ্ধের নাক দিয়া কাঁচা জল গড়াইতেছে, এবং অন্যান্য সকল কিছু শব্দকে পরাজিত করিয়া গাল চোষার আওয়াজ ক্রমবর্ধমান, তদ্দর্শনে ডুলিস্থিত প্রতিমা চৈত্রের পাতার মত কম্পিত, তাঁহার জ্ব-যুগলে যেন গুণ টানা হইল। দৃষ্টিকে ছাড়াইয়া চক্ষুদ্বয় আগাইয়া আসিতে চাহিল।
“সীতারামের বেশ জ্ঞান আছে, বিয়ের সময়ও উঠে বসবে, তুমি গিয়ে সীতারামের সঙ্গে একটু কথা বল, মেয়ে দেখে ওর পছন্দ হয়েছে কিনা…” নির্লিপ্তভাবে কৃষ্ণপ্রাণ ইহা বলিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের নিকট দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিলেন। প্রথমতঃ ইহা যথারীতি আচারবিরুদ্ধ, তাহা কোনক্রমে মনে হইল না।
এই কথা কয়টি যশোবতীর যৌবন উচ্ছল শরীরখানিকে যেন বা নিঙড়াইয়া দিল, তাঁহার কণ্ঠ মধ্যে পাখীর বাসার স্বাদ ও গন্ধে রুদ্ধ, তাঁহার মুখোনি ডুলির পর্দার আড়ালে চকিতে অদৃশ্য এবং পরক্ষণেই মুখমণ্ডলের অর্ধভাগ পরিদৃশ্যমান হইল। অচৈতন্য হইবার পূর্বলক্ষণ জানিয়া পিতা লক্ষ্মীনারায়ণ সত্বর আসিয়া কন্যাকে ডাকিলেন, “যশো, যশো!”
যশোবতীর আয়ত চক্ষুদ্বয় এখন উন্মীলিত, তিনি আপনার আদরের পৃথিবী দেখিলেন, যে পৃথিবী শূন্যতার, সৌন্দর্য্যের, বাস্তবতার আধিভৌতিক সমস্যা এবং শুধুমাত্র তিনি উচ্চারণ করিলেন, “বাবা!”
এই স্বরের মধ্যে বিড়াল ও পাখীর ঘোরতর যুদ্ধের আওয়াজের রেশ ছিল। মুক্তাসদৃশ দন্তপাতি দিয়া তিনি তাঁহার নিম্ন ওষ্ঠ চাপিয়া ধরিলেন, এমত সময়ে মানসচক্ষে দেখিলেন, এক বৃক্ষ, শিকড় যাহার উচ্চে, শাখা নিম্নে, এবং পুনরায় তিনি, সমুদয় তাঁহার কাছে!
“আয় মা আয়, আমার মান রক্ষা কর।” তাহার পর ধীরে ধীরে সান্ত্বনার ছলে বলিলেন, “মঙ্গল কাজের সময় চোখের জল ফেলতে নেই মা।”
যশোবতী পিতার মুখের দিকে চাহিয়া নিজের দুর্বলতার হেতু সত্যই লজ্জিতা হইলেন, অত্যধিক দৃঢ়তার সহিত জুলির বাঁশ চাপিয়া ধরিয়াছিলেন, ফলে হাত ছাড়াইয়া লইবার পরেও হাত অৰ্দ্ধ উন্মুক্ত হইয়া রহিল। কন্যাকে ধরিয়া লক্ষ্মীনারায়ণ মাদুরের উপর বসাইয়া দিলেন।
এইস্থানের পরিবেশ দেখিয়া আপনার হতভাগ্যের কথা ভাবিবার মত কোন মনোবৃত্তি যশোবতী খুঁজিয়া পাইলেন না। শুধুমাত্র চক্ষু বুজাইয়া ঘুম চাহিলেন।
বাজনদারদের তখনও স্বাভাবিকভাব ফিরিয়া আসে নাই। কৃষ্ণণ কন্যাপক্ষের হইয়া তাহাদের ধমক দিলেন, তাহারা যুগপৎ নানাবিধ শব্দ করিয়া উঠিল; নাপিত সত্বর ক্ষুরে ধার দিতে লাগিল, তাহার মাথায় কৃষ্ণপ্রাণ গঙ্গাজল দিয়া শুদ্ধ করিয়া বলিলেন, “হরেরাম, নাপিতকে নিয়ে যাও বলরাম তুমি ওখানটা পরিষ্কার কর।”
দ্রুতগতি কাজ শুরু হইয়া গেল। লক্ষ্মীনারায়ণ ছাতার আড়া হইতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মোড়ক, ডুলির বাঁশ হইতে হাঁড়ী কলস নামাইলেন, কৃষ্ণপ্রাণ কলাপাতা কাটিলেন। সকল কিছুর ব্যবস্থা হইল।
যশোবতাঁকে যখন তাঁহার পিতা ডাকিতে আসিলেন তখন তিনি ডুলির উপর মাথা রাখিয়া প্রশান্তচিত্তে ঘুমাইতেছিলেন। পিতার ডাকে উঠিয়া বস্ত্রাদি সম্বরণ করিয়া একটি হাই তুলিবার কালে চারিদিকে তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। আলস্যত্যাগ করা আর হইল না। কিছুকাল স্থির থাকিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া পিতার দিকে শিশুর মতই তাকাইলেন। অনন্তর শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন, “কি করবো?”
“তাড়াতাড়ি নে মা, লগ্নের আর দেরী নেই।”
নাপিত তাহার ছোট বিলাতী আয়নাখানি এখানে বসাইয়া দিয়া গেল। যশোবতী ধীরে ধীরে সাজিতে লাগিলেন। দেহ কাঁপিয়া কাঁদিয়া চমকাইতেছিল, কপোল বহিয়া অশ্রুধারা বর্তমান, কিন্তু তথাপি মনে হয় যেন ক্রন্দনের সেই মনোভাব নাই; কেননা তিনি, যশোবতী, গঙ্গার জলোচ্ছ্বাসে পুনঃ পুনঃ শুনিয়াছিলেন, “হে কৌন্তেয়–হে কৌন্তেয়! সাক্ষাৎ ভগবান আপনার প্রাণপ্রিয় সখাকে যেন ডাকিতেছেন। হঠাৎ দেখিয়াছিলেন, কে যেমন বা নাড়ীসমূহ লইয়া নেতি ধৌতি করিতেছে।
চতুর্দিক অবলোকন করত যশোবতী বলিয়াছিলেন, এ কি খেলা! এবং শ্মশানের ধূম তাঁহাকে মলিন করিতে পারে নাই।
যশোবতী বধূবেশ আপনি ধারণ করিলেন।