অদ্ভুত যত ভূত
ছোটমামার সঙ্গে ছিপে মাছ ধরতে যাচ্ছিলুম। ছোটমামার ছিপটা বড় মাছধরা হুইল। আর আমারটা নেহাত পুঁটিধরা কঞ্চির ছিপ। বঁড়শিও খুদে।
ভাদ্র মাসের দুপুরবেলা। কদিন বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। ঝলমলে রোদে গাছপালা-ঝোঁপঝাড়ে সবুজ রঙের জেল্লা বেড়েছে। আমার মনও খুশিতে চঞ্চল। ছোটমামা বলেছেন, বুঝলি পুঁটু? আজ থেকে তোর ট্রেনিং শুরু। তোর ডাকনাম পুঁটু। তাই দেখবি, পুঁটিমাছেরা তোর বঁড়শির সঙ্গে ভাব জমাতে ভিড় করবে। ওরা কিন্তু বড় চালাক। ফাতনা নড়লেই ছিপে খ্যাচ মারবি।
–খ্যাঁচ কী মামা?
–ধুর বোকা! এ্যাচ বুঝিস না? ঠিক আছে। তোকে হাতেকলমে শিখিয়ে দেব।
গ্রামের শেষদিকটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সেখানে আদ্যিকালের ভাঙা শিবমন্দির ঘিরে প্রকাণ্ড বটগাছ এবং ঝোঁপজঙ্গল গজিয়েছে। সেখানেই দেখা হয়ে গেল মোনা-ওঝার সঙ্গে।
মোনার মাথায় জটা। মুখে গোঁফ-দাড়ি। ওপর পাটির একটা দাঁত ভাঙা। তাই গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর কপালে দগদগে সিঁদুরের ঘটা সত্ত্বেও হাসলে তাকে খুব অমায়িক ও সরল মানুষ মনে হয়। কিন্তু যখন সে গম্ভীর হয়ে থাকে, তখন তাকে দেখলে বড় গা ছমছম করে। তার চোখদুটো যে বেজায় লাল।
মোনা-ওঝা আমাদের দেখে কেন কে জানে ফিক করে হাসল। তারপর বলল,–ছোটবাবু, ভাগ্নেকে সঙ্গে নিয়ে ছিপ ফেলতে বেরিয়েছেন বুঝি? ভালো! তা কোথায় ছিপ ফেলবেন?
ছোটমামা বললেন,–সিঙ্গিমশাইয়ের মাঠপুকুরে।
মোনা বলল,–ওই পুকুরে আর মাছ আছে নাকি? এই তো গত মাসে সিঙ্গিমশাই জেলেদের সব মাছ বিক্রি করে দিয়েছেন। সারাদিন জাল ফেলে-ফেলে জেলেরা মাছের ছানাপোনাসুদ্ধ ঘেঁকে তুলে নিয়েছে।
ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন,–সে কী মোনাদা! সিঙ্গিমশাইয়ের কাছে আজ সকালে যখন ছিপ ফেলার জন্য পারমিশন চাইতে গেলুম, উনি বললেন, দুটোর বেশি ধোরো না যেন।
মোনা-ওঝা হেসে কুটিকুটি হল। –মিথ্যে! একেবারে মিথ্যে! বুঝলেন ছোটবাবু? চোরের জ্বালায় মাত্র আড়াইশো-তিনশো গ্রাম ওজন হলেই পোনামাছগুলো বিক্রি করে দেন সিঙ্গিমশাই। তাছাড়া আপনার হুইলে ধরার যোগ্য মাছ কি ওখানে কখনও ছিল? তবে হ্যাঁ। এই খোকাবাবুর ছিপে ধরার মতো পুঁটিমাছ থাকলেও থাকতে পারে।
ছোটমামা খাপ্পা হয়ে বললেন,-মিথ্যুক! হাড়কেল্পন! আমাকে খামোকা হয়রান করল! টাউন থেকে শখ করে এত দামি হুইল কিনে আনলুম। সকাল থেকে কতরকমের চার আর টোপ তৈরি করলুম!
মোনা বলল,–এক কাজ করুন ছোটবাবু! একটু কষ্ট করে দোমোহানির ঝিলে চলে যান। ঝিলে কিন্তু প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড মাছ আছে। ঝাঁপুইহাটির কালিবাবু এই তো দুহপ্তা আগে একটা পাঁচ কেজি রুই তুললেন। আমার চোখের সামনে, ছোটবাবু! মা কালীর দিব্যি!
ছোটমামা একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, কিন্তু বড় দূরে যে!
দুর কী বলছেন? নাক বরাবর ধানক্ষেতের আল ধরে হেঁটে গিয়ে ওই বাঁধে উঠুন। মাত্র আধঘণ্টা হাঁটতে হবে।বলে মোনা আমার দিকে তাকাল, কি খোকাবাবু? যেতে পারবে না মামার সঙ্গে?
কী আর বলব? মাথাটা একটু কাত করলুম শুধু। পুঁটিমাছ ধরার ইচ্ছেটা চাগিয়ে উঠেছে যে!
ছোটমামা হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। বললেন, আয় পুঁটু! মোনাদা ঠিকই বলেছে, মাছ পাই বা না পাই, একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে যাক না। তাছাড়া তোর ট্রেনিংটা ওইরকম ঝিল-জঙ্গলে শুরু করাই উচিত।
ছোটমামাকে অনুসরণ করলুম। পিছন থেকে মোনা-ওঝা বলল,–তবে একটা কথা ছোটবাবু! সূর্য ডোবার পর আর এখানে কিন্তু থাকবেন না। সঙ্গে খোকাবাবু আছে বলেই সাবধান করে দিলুম।
ছোটমামা বললেন,–ছাড় তো বুজরুকে কথা। আমরা অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছি। তাই না পুঁটু? ওঁর কথায় অগত্যা সায় দিতেই হল। যদিও মোনা-ওঝার কথাটা শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল।…
বাঁধের নিচে ঝিলটা বাঁকা হয়ে একটু দূরের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়েছে। কিন্তু ছিপ ফেলার মতো কঁকা জায়গা চোখে পড়ল না। ঝিলে ঘন দাম, পদ্ম আর শালুক ফুলের ঝাঁক। কোথাও শোলাগাছ গজিয়েছে দামের ওপর। ছোটমামা অনেক খোঁজাখুঁজি করে ছিপ ফেলার মতো খানিকটা কঁকা জায়গা আবিষ্কার করলেন। তারপর বললেন,–বুঝলি পুঁটু? এখানেই ঝাঁপুইহাটির কোন কালীবাবু ছিপ ফেলেছিলেন মনে হচ্ছে। এই দ্যাখ, এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ পড়ে আছে। হুঁ! সিগারেটের ফিল্টারটিপও অজস্র। কালীবাবু খুব সিগারেট খান বোঝা যাচ্ছে।
ঝিলের উত্তর পাড়ে এই জায়গাটা ছায়ায় ঢাকা। কারণ, বাঁধে একটা বটগাছ আছে। তার লম্বা ডালপালা ঝিলের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। ছোটমামা ঝটপট চার ফেলে ছিপ সোজা রাখার জন্য ঝোঁপ থেকে একটা আঁকশির মতো ডাল ভেঙে আনলেন। এক হাঁটু জলে নেমে সেটা কাদায় পুঁতে বললেন,–তোর ছিপটা ছোট্ট তো! ওটা হাতে ধরে থাকতে পারবি। আমারটা যে হুইল ছিপ। ডগাটা আঁকশির মাথায় রাখলে তবে ছিপটা সোজা থাকবে।
মাঝে-মাঝে শিরশিরে বাতাস বইছিল। রোদে হাঁটার কষ্টটা শিগগির দূর হয়ে গেল। মামা-ভাগ্নে দুজনে দুটো ছিপ ফেলে বসে রইলুম। ঝিলের ওপারে ঘন বাঁশবন। সেখানে একঝাক পাখি তুমুল হল্লা করছিল। জল-মাকড়শারা জলের ওপর তরতরিয়ে ছোটাছুটি করছিল। একটা লাল গাফড়িং ছোটমামার ছিপের ফাতনা ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলা করছিল। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে একটা জলপিপি পাখি পিপি করে ডাকতে ডাকতে দূরে ঝিলের জলে কোথাও বসল।
এতক্ষণে মনে পড়ল, ছোটমামা আমাকে খ্যাচ মারা শেখাবেন। কিন্তু কথাটা তুলতেই উনি চাপাস্বরে বললেন, আমার চারে মাছ এসে গেছে। বুজকুড়ি দেখতে পাচ্ছিস না? মাছটা টোপ খেলেই আমি ছিপটা যেভাবে জোরে তুলব, সেটাই এ্যাচ। তুই লক্ষ রাখিস।
আমার ছিপের ফাতনা দুবার কেঁপে আবার স্থির হয়ে গেল। খ্যাচ মারা ব্যাপারটা না দেখা পর্যন্ত কী আর করা যাবে!
কিছুক্ষণ পরে দেখি, ছোটমামার ছিপের ফাতনা নড়তে শুরু করেছে। ছোটমামা ছিপের হুইলবাঁধা গোড়ার দিকটা চেপে ধরে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তারপর ফাতনাটা যেই ডুবে গেল, অমনি ছোটমামা জোরে ছিপটা তুলে ফেললেন। সাঁই করে একটা শব্দ হল। কিন্তু কী অবাক! ছোটমামার বঁড়শিতে বিঁধে যে জিনিসটা ছিটকে আমাদের পেছনে গিয়ে পড়ল, সেটা তো মাছ নয়!
ছোটমামা ছিপ ফেলে এক লাফে পেছনে বাঁধের গায়ে ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে গেলেন। তারপর ফাঁসফেঁসে গলায় বলে উঠলেন, কী সর্বনাশ! এটা দেখছি একটা মড়ার খুলি!
কথাটা শুনেই আমি ওঁর কাছে চলে গেলুম। ছোটমামা একটা শুকনো কাঠি দিয়ে বঁড়শি ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, কোনও মানে হয়?
খুলিটা দেখেই আমার বুক ধড়াস করে উঠেছিল। তারপর দেখি, খুলিটা লাফাতে লাফাতে জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ছোটমামা গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি তো ভয়ের চোটে এমন ভ্যাবলা হয়ে গেছি, যেন আমার পাদুটো মাটির সঙ্গে আঠা দিয়ে আটকানো।
ছোটমামা বিড়বিড় করছিলেন, এ কী রে পুঁটু? এ কী রে! এ কী হচ্ছে? অ্যাঁ?
তারপর দেখলুম খুলিটা লাফাতে লাফাতে গিয়ে জলে পড়ল। জলের ওপর কিছুদূর পর্যন্ত বুজকুড়ি উঠে সেগুলো ভেঙে গেল। ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললেন,–এ কী বিচ্ছিরি ব্যাপার বল তো পুঁটু?
বললুম,–ছোটমামা! আমার বড্ড ভয় করছে। চলুন। আমরা এখান থেকে এখুনি চলে যাই।
ছোটমামার এই এক স্বভাব। হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠলেন যেন। বললেন, ধুস! একটা মড়ার খুলি দেখে ভয় পাব আমরা? কী বলিস পুঁটু? বলেছিলুম না আমরা অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছি?
বলে উনি আবার বঁড়শিতে টোপ গেঁথে ছিপ ফেললেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,–দেখলি তো খ্যাচ মারা কাকে বলে?
তারপর বসে আছি তো আছি। কিন্তু আর ফাতনা নড়ে না। আমি জলের দিকে ভয়ে-ভয়ে তাকাতে গিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি। কে জানে বাবা! এবার যদি আমার বঁড়শিতে টোপ খেতে আসে খুলিটা!
তার চেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার, মড়ার খুলি একেবারে জ্যান্ত।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ আমাদের বাঁদিকে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর কে ভরাট গলায় বলে উঠল,–তারা তারা তারা। তারা তারা তারা! ব্রহ্মময়ী মাগো!
আমরা চমকে উঠে ঘুরে বসেছিলুম। দেখলুম, মোনা-ওঝার মতোই জটাজুটধারী একটা মাথা ঝোঁপের ওপর দেখা যাচ্ছে। তারপর ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলেন এক সাধুবাবা। পরনে হাঁটু অবধি পরা লাল কাপড়। এক হাতে ত্রিশূল, অন্য হাতে কমণ্ডলু। তিনি অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন,-বাড়ি কোথায় গো তোমাদের?
ছোটমামা বললেন,-বাবুগঞ্জ।
–অতদূর থেকে তোমরা এখানে ছিপ ফেলতে এসেছ? ভালো করোনি।
–কেন বলুন তো?
–এটা শ্মশানকালীর এলাকা। ওই দেখছ ঘন গাছপালা। সেখানেই মায়ের মন্দির। তার পাশে শ্মশান। তোমরা এখানে বেশিক্ষণ থেকো না বাবারা!
ছোটমামা হাসতে-হাসতে বললেন, আপনি যা-ই বলুন সাধুবাবা! একটা মাছ ধরে এখান থেকে নড়ছি না।
–ওরে পাগল! এ ঝিলে আর মাছ কোথায়? যা দু-চারটে ছিল, কবে মারা পড়েছে।
–মাছ না পাই, মড়ার খুলিই বঁড়শি বিঁধিয়ে তুলব।
সাধুবাবা চমকে উঠে বললেন, তার মানে? তার মানে?
ছোটমামা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বললেন,–এই তো কিছুক্ষণ আগে একটা জ্যান্ত মড়ার খুলি টোপ খাচ্ছিল। এক খ্যাচ মেরে তাকে ডাঙায় তুললুম।
–তারপর? তারপর?
–খুলিটা থেকে বঁড়শি ছাড়িয়ে নিতেই ওটা লাফাতে লাফাতে জলে গিয়ে পড়ল।
–তোমরা তবু ভয় পেলে না?
ছোটমামা বললেন, নাহ। আমরা অ্যাডভেঞ্চারে এসেছি যে সাধুবাবা! আমাদের অত সহজে ভয় পেলে চলে?
সাধুবাবা চাপাস্বরে বললেন,–কিন্তু তোমরা কি জানো ওই খুলিটা কার?
ছোটমামা তাচ্ছিল্য করে বললেন,–তা কেমন করে জানব? জানার দরকারই বা কী?
সাধুবাবা গম্ভীরমুখে বললেন, দরকার আছে। ওই খুলিটা পাঁচু নামে একজন চোরের। তোমরা তার নাম শোনোনি মনে হচ্ছে। পাঁচু ছিল এই তল্লাটের এক ধূর্ত সিঁধেল চোর। সে অনেকদিন আগেকার কথা। এক রাত্রে পাঁচু গেরস্থবাড়িতে সিঁদ কাটতে বেরিয়েছে। এমনসময় পড়বি তো পড় একেবারে বন্ধু দারোগার মুখোমুখি।
বন্ধুবিহারী ধাড়া ছিলেন পুঁদে দারোগা। পাঁচুকে দেখে তিনি টর্চ জ্বেলে পাকড়ো পাকড়ো বলে তাড়া করলেন। তার সঙ্গে দুজন কনস্টেবল ছিল। তারাও পাঁচু চোরকে তাড়া করল। তারপর ঠিক এইখানে এসে যখন পাঁচুকে তিনজনে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছেন, অমনি পাঁচু লাফ দিয়ে ঝিলের জলে পড়ল। দারোগা পিস্তলের গুলি ছুড়লেন। তখন পাঁচু জলে ডুব দিল।
ছোটমামার মন ফাতনার দিকে। শুধু বললেন, হুঁ।
গল্পটা আমি মন দিয়ে শুনছিলুম। তাই বললুম,–তারপর কী হল সাধুবাবা?
সাধুবাবা শ্বাস ছেড়ে বললেন,-পাঁচু ডুব দিল তো দিল। আর মাথা তুলল না। তখন দারোগাবাবু দুই কনস্টেবলকে পাহারায় রেখে থানায় ফিরে গেলেন। রাত পুইয়ে সকাল হয়ে গেল। কিন্তু কোথায় পাঁচু? আসলে কী হয়েছিল জানো? ঝিলের জলের তলায় ঘন দাম আর শ্যাওলা আছে। বেচারা পাঁচু তাতে আটকে গিয়ে আর মাথা তুলতে পারেনি। শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়েছিল।
এবার ছোটমামা বললেন, তারপর জেলে ডেকে এনে জাল ফেলে পাঁচুর মড়া ভোলা হয়েছিল বুঝি?
সাধুবাবা হাসলেন।ওরে পাগল! দেখতে পাচ্ছ না ঝিলের জলের অবস্থা? কত দাম, শ্যাওলা আর কতরকমের জলজ উদ্ভিদ। জাল ফেললে সেই জাল কি আর তোলা যেত? ছিঁড়ে ফর্দাই হয়ে যেত না? তাই কোনও জেলেই জাল ফেলতে রাজি হল না। পাঁচুর মড়া জলের তলায় আটকে রইল। তারপর এতদিনে তার খুলিটা তোমাদের বঁড়শিতে আটকে গিয়েছিল। বুঝলে তো?
ছোটমামা আনমনে আবার বললেন, হুঁ।
সাধুবাবা বললেন,–তো শোনো বাবারা! আবার যদি পাঁচুর খুলি তোমাদের ছিপে ওঠে, তাহলে খুলিটা আমাকে দিয়ে যেও। কেমন? ওই যে দেখছ জঙ্গল! ওর মধ্যে আছে শ্মশানকালীর মন্দির। ওখানে আমাকে পেয়ে যাবে। খুলিটার বদলে আমি তোমাদের একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেব। সেই মন্ত্র পড়ে বঁড়শিতে ফুঁ দিলেই তোমরা প্রচুর মাছ ধরতে পারবে। যাই হোক, এখন আমি যাই। মায়ের পুজোর সময় হয়ে এল।
বলে সাধুবাবা ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে তারা তারা তারা বলতে-বলতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ততক্ষণে দিনের আলো কমে এসেছে। গাছপালায় পাখিদের হল্লা গেছে বেড়ে। ছোটমামাকে বলতে যাচ্ছি, এবার বাড়ি চলুন ছোটমামা-এমন সময় ছোটমামার হুইলে ছিপের ফাতনা আচমকা ডুবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছোটমামা খ্যাচ মারলেন। আর অবাক হয়ে দেখলুম, আবার সেই মড়ার খুলিটা আমাদের পিছনে ঝোঁপের ভেতরে ছিটকে পড়ল। ছোটমামা দৌড়ে গিয়ে এবার খুলিটা চেপে ধরলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন,-এবার? এবার কী করে পালাবে বাছাধন?
বললুম,–ছোটমামা! চলুন। খুলিটা সাধুবাবাকে দিয়ে আসবেন।
তাই চলবলে ছোটমামা পা বাড়ালেন।
বললুম, ছিপদুটো পড়ে রইল যে?
–থাক না। ফেরার সময় নিয়ে যাব।
ঝোঁপঝাড়ের পর উঁচু-উঁচু গাছের ঘন জঙ্গল। এখনই জঙ্গলের ভেতর আবছা আঁধার জমেছে। ছোটমামা বললেন,–পুঁটু! শ্মশানকালীর মন্দির তো দেখতে পাচ্ছি না!
ওই সময় কানে এল কারা চাপাস্বরে কথা বলছে। ছোটমামা সেদিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর দেখলুম, খানিকটা খোলামেলা জায়গায় চারজন লোক একটা খাঁটিয়া নিয়ে বসে আছে। খাঁটিয়াতে একটা মড়া।
খুলি হাতে নিয়ে ছোটমামা যেই বলেছেন,-এখানে শ্মশানকালীর মন্দিরটা কোথায় বলতে পারেন? অমনি লোকগুলো লাফ দিয়ে উঠে ওরে বাবা! এরা আবার কারা? বলে দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেল। ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন, যা বাবা! ওরা হঠাৎ অমন করে পালিয়ে গেল কেন? এই খুলিটা দেখে ভয় পেল নাকি?
তারপর তিনি মড়ার খাঁটিয়ার কাছে গেলেন। গলা অবধি চাদর ঢাকা মড়ার মাথাটা বেরিয়ে আছে। ছোটমামা বললেন,–বেশ শৌখিন লোক ছিল মনে হচ্ছে। বুঝলি পুঁটু! চুলগুলোর কেতা দেখছিস? চোখে সোনালি ফ্রেমের দামি চশমা। গোঁফটার কেতাও আছে। দেখে কিন্তু মড়া বলে মনেই হয় না। আমার ধারণা হার্ট অ্যাটাকে মারা পড়েছে। আহা! এমন শৌখিন লোকের মারা যাওয়া উচিত হয়নি।
ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি এটা শ্মশান। এখানে-ওখানে চিতার পোড়া কাঠ আর ছাই। ভাঙা কলসিও পড়ে আছে। এই মড়াটার জন্য কোনও কাঠের পাজা দেখতে পেলুম না। খাঁটিয়ার কয়েক হাত দূরে ঝিলের জল আবছা দেখা যাচ্ছিল। মনে হল, লোকগুলো মড়া পোড়ানোর কাঠের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু একটা খুলি দেখে ওরা অত ভয় পেল কেন?
ছোটমামা মড়াটা দেখতে-দেখতে আনমনে বললেন, কিন্তু শ্মশানকালীর মন্দিরটা কোথায়?
তারপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ছোটমামার হাত ফসকে খুলিটা ঠকাস করে খাঁটিয়ার মড়ার নাকের ওপর পড়ল। অমনি মড়াটা আর্তনাদ করে উঠল, উঁহু হু হু! গেছি রে বাবা! গেছি! তারপর লাফ দিয়ে উঠে খুলিটা দেখামাত্র জ্যান্ত মানুষের মতো দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেল। আবছা আলোয় দেখলুম, পরনে ধুতি, গায়ে নকশাদার সিল্কের পাঞ্জাবি। ছোটমামাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললুম,–ছোটমামা! ছোটমামা! আমার বড্ড ভয় করছে।
ছোটমামা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খুলিটা চেপে ধরলেন। কারণ এই সুযোগে খুলিটা আবার পালিয়ে যাচ্ছিল।
এতক্ষণে সেই সাধুবাবার কণ্ঠস্বর কানে এল। তারা! তারা! তারা! ব্রহ্মময়ী মা গো!
তারপর একটু তফাতে গাছের ফাঁকে আগুনের আঁচ দেখতে পেলুম।
ছোটমামাকে সেটা দেখিয়ে দিলুম। উনি হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে এগিয়ে চললেন। গাছপালার ভেতর একটা জরাজীর্ণ মন্দির দেখা গেল। তার উঁচু চত্বরে ধুনি জ্বেলে বসে আছেন সেই সাধুবাবা।
ছোটমামা বললেন, সাধুবাবা! সাধুবাবা! এই নিন পাঁচু-চোরের খুলি।
সাধুবাবা ঘুরে খুলিটা দেখে সহাস্যে বললেন,–পেয়েছিস ব্যাটাছেলেকে? দে! শিগগির দে!
ছোটমামা খুলিটা দিতে যাচ্ছেন, আবার সেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ছোটমামার হাত ফসকে খুলিটা সজোরে গিয়ে সাধুবাবার বুকে পড়ল। সাধুবাবা চিৎ হয়ে পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করলেন,–উ হু হু! গেছি রে বাবা! গেছি!
তারপর দেখলুম, তার জটার পেছনে আগুন ধরে গেছে। কারণ তিনি জ্বলন্ত ধুনির ওপর পড়ে গিয়েছিলেন। জটায় আগুনের আঁচ টের পেয়ে সাধুবাবা লাফ দিয়ে চত্বর থেকে নেমে দৌড়ে গেলেন। তারপর আবছা আঁধারে ঝপাং করে জলের শব্দ হল। বুঝলুম, সাধুবাবা আগুন নেভাতে ঝিলের জলে ঝাঁপ দিয়েছেন।
এদিকে খুলিটাও সুযোগ বুঝে গড়াতে শুরু করেছে। ছোটমামা খুলিটা ধরার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পারছিলেন না। ওটা কখনও লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে, কখনও গড়িয়ে চলছে। আমরা যেখানে ছিপ ফেলেছিলুম, সেখানে গিয়ে পৌঁছতেই জলের ভেতর থেকে একটা কঙ্কালের দুটো হাত ভেসে উঠল এবং খুলিটা লুফে নিয়ে আবার জলে ডুবে গেল। এতক্ষণে ছোটমামা ভয় পেয়ে কঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, পুঁটু রে! আর এখানে থাকা ঠিক নয়। ছিপ তুলে নে। মোনা-ওঝা ঠিকই বলেছিল রে! দুজনে ঝটপট ছিপ গুটিয়ে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাঁধের ওপর উঠলুম। তারপর বাঁধের পথে বাড়ি ফিরে চললুম। কিছুদূর চলার পর ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, সবই হল রে পুঁটু। সাধুবাবার কাছে মাছ ধরার মন্ত্রটা শেখা হল না।