Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অদ্ভুতুড়ে || Shirshendu Mukhopadhyay » Page 5

অদ্ভুতুড়ে || Shirshendu Mukhopadhyay

নন্দবাবু রান্নাঘরে

নন্দবাবু রান্নাঘরে এত রাতে কাউকে দেখবেন বলে আশা করেননি। মনে তাঁরও ভয়। চুরি করে খেতে এসে ধরা পড়লে কেলেঙ্কারির একশেষ। কিন্তু উঁকি না দিয়েও পারেননি। এত রাতে চোরটোর কেউ যদি ঢুকে পড়ে থাকে তা হলে তো মুশকিল। নন্দবাবু চোরকেও কিছু কম ভয় পান না। চোরদের ধর্মবোধ নেই, মায়াদয়া নেই, বিপদে পড়লে তারা খুন-জখমও করে থাকে বলে তিনি শুনেছেন।

তাই খুব সাবধানে দেওয়ালের আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখে নিলেন, ভিতরে লোকটা কে।

যা দেখলেন, তাতে তাঁর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। ঝুলে পড়ল চোয়াল। হাঁ-মুখের মধ্যে একটা উড়ন্ত মশা ঢুকে চক্কর খেতে লাগল। স্বপ্ন দেখছেন নাকি? দুলাল স্যার এত রাতে তাঁদের রান্নাঘরে ঢুকে খাচ্ছেন এ তো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের ঘটনা!

এখানে বলে রাখা ভাল, দুলাল স্যারকে যে ভুবন রায় ল্যাবরেটরির কাজে লাগিয়েছেন, এটা নন্দবাবুর জানা ছিল না। জানা অনেকেরই ছিল না। কারণ ভুবন রায় যখন যা খুশি করতে ভালবাসেন, কাউকে কিছু জানানোর দরকার আছে বলে মনে করেন না।

নন্দবাবু চোখ কচলালেন, নিজের গায়ে চিমটি দিলেন। তারপরও তাকিয়ে দেখলেন, সেই একই দৃশ্য। দুলালবাবু খাচ্ছেন। এবং পরিমাণটাও ফ্যালনা নয়। এরকম রোগা মানুষ অতটা বিরিয়ানি বা মাংস কী করে খাবেন, সেটাও একটা মস্ত প্রশ্ন।

এই প্রশ্নটা মাথায় উকুনের মতো কুটকুট করতে থাকায় নন্দবাবু ভারি ভাবিত হয়ে মাথা চুলকোতে গেলেন, ফলে কনুইয়ের ধাক্কায় দরজা খচাং করে নড়ে উঠল এবং দুলালবাবু তাঁর দিকে একবার চেয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে চোখটা সরিয়ে নিয়ে ফের খেয়ে যেতে লাগলেন।

ছাত্রবয়সে নন্দবাবু দুলালবাবুর কাছে পড়েছেন। নন্দবাবু ছাত্র হিসেবে তেমন সুবিধের ছিলেন না। তার ওপর বাঁদর ছেলে বলে নাম-ডাকও ছিল। দুলালবাবুর হাতে বিস্তর চড়-চাপড় আর বেত খেয়েছেন এককালে। ভারি রাগী লোক। এখনও দুলালবাবুর প্রতি সেই ভীতিটা তাঁর রয়ে গেছে।

কিন্তু দৃশ্যটা স্বপ্ন না বাস্তব? তার একটা ফয়সালা হওয়া দরকার। তাই নবাবু খুব কষে গলাখাঁকারি দিয়ে মৃদু স্বরে অতিশয় বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “ইয়ে…..।”

দুলালবাবু বিরিয়ানির ভিতর থেকে একটা মোটা হাড় খুঁজে পেয়ে আরামে চিবোতে-চিবোতে একবার তাঁর দিকে চেয়ে দেখে নিলেন। কিন্তু কোনও কথা বললেন না। ইয়ে….. তো কোনও প্রশ্ন নয় যে, জবাব দিতেই হবে।

নন্দবাবু ফের মাথা চুলকোলেন এবং আর একটু সাহস সঞ্চয় করে বললেন, “স্যার, ভাল আছেন তো!”

দুলালবাবু একথাটারও জবাব দিলেন না। ফুলকপির রোস্টটা আজ খুব উতরেছে। এক কামড় খেয়েই তাঁর চোখ বুজে এল আরামে।

নন্দবাবু এবার ঘরের মধ্যে সাহস করে ঢুকলেন। তারপর একগাল হেসে বললেন, “স্যারের দেখছি বেশ খিদে পেয়েছে!”

দুলালবাবু এবার লোকটার দিকে বিরক্তির সঙ্গে চেয়ে বললেন, “চুপ করে বোসো। খাওয়ার সময় কথাটথা বলতে নেই।”

নন্দবাবু মাথা নেড়ে গম্ভীরভাবে বললেন, “বটেই তো।”

বলে সামনেই খুব সাবধানে বসলেন। স্যারের সামনে জীবনে কখনও চেয়ারে বসেননি। তবে এখন বয়স-টয়স হয়েছে, তাই বসলেন। বসে চোখের পাতা ফেলতে পারলেন না।

দুলাল-স্যার অন্তত আধসের মাংস আর সেরটাক বিরিয়ানি সাফ করে দিয়েছেন। অন্যান্য উপকরণও সেই পরিমাণে। সবশেষে উনি জমাটি এক জামবাটি ভর্তি পায়েস খুবই স্নেহের সঙ্গে কাছে টেনে নিতেই নন্দবাবুর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, “বাব্বাঃ”!

দুলালবাবু ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কে?”

নন্দবাবু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। দুলালবাবুর তাঁকে না-চেনার কথা নয়। দিন-তিনেক আগেও বাজারে দেখা হয়েছে দুলালবাবু উবু হয়ে বসে মন দিয়ে বাছছিলেন। নন্দবাবুকে দেখে বলে উঠলেন, “কী রে হনুমান, আঁকটাক ঠিকমতো করছিস তো!”

নন্দবাবুর আর আঁক কষার দরকার নেই। কিন্তু সে কথা সেদিন আর বলতে সাহস হয়নি।

তা এই কদিনেই এমন কী হল যে, দুলাল স্যার তাঁকে চিনতে পারছেন না? নন্দবাবু ফের মাথা চুলকে বললেন, “আমি নন্দ, স্যার। আমাকে চিনতে পারছেন না?”

দুলালবাবু ভ্রূ কুঁচকে নন্দবাবুর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “নন্দ?”

“হ্যাঁ স্যার। নন্দলাল রায়।”

দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “বাঃ, নামটা তত বেশ। তা কত দাম পড়ল?”

নন্দবাবু অবাক হয়ে বললেন, “কিসের দাম?”

“নামটা তো কিনতে হয়েছে বাপু। আমি পাঁচু নামটা কিনেছি পাঁচ টাকায়। লোকটা ভাল, ইচ্ছে করলে আরও বেশি চাইতে পারত।”

নন্দবাবু মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে না পেরে বললেন, “নাম কিনেছেন?”

“না কিনে করি কী বলল, নাম ছাড়া কি কাজ চলে?”

“কেন স্যার, আপনার নাম তো দুলাল সেন!”

“দুলাল সেন! আমার নাম আবার কবে দুলাল সেন ছিল?”

“ছিল কেন স্যার, এখনও আছে। আপনি তো জলজ্যান্ত দুলাল সেন।”

দুলালবাবু একটু ভাবলেন। তারপর পায়েসের বাটি থেকে এক খাবলা তুলে খেতে-খেতে বললেন, “তা সেটা আগে বলতে হয়। পাঁচ-পাঁচটা টাকা গচ্চা দিয়ে একটা নাম কিনে ফেলেছি, সেটা তো আর ফেলে দিতে পারি না। তুমি বরং দুলাল সেন নামটা কিনে নাও, ওই পাঁচ টাকাই দিও। প্রতি অক্ষরে এক টাকা করে, জলের মতো সোজা হিসেব।”

নন্দবাবুর সন্দেহ হল, দুলালবাবুর মাথার একটু গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। এরকম হতেই পারে। নন্দবাবু সারা জীবন কেবল আঁক কষে গেছেন আর ঝুড়ি ঝুড়ি বিজ্ঞানের বই পড়ে গেছেন। অত বই পড়লে আর আঁক কষলে মাথা খারাপ হতেই পারে।

নন্দবাবু দুঃখিতভাবে জিব দিয়ে একটু চুকচুক শব্দ করে বললেন, “আহা।” দুলালবাবু এবারও ভ্রূ কুঁচকে নন্দবাবুর দিকে চাইলেন। তারপর বললেন, “তা হলে কিনছ?”

নন্দবাবু মাথা চুলকে বললেন, “আমার তো নাম একটা আছে স্যার। একটা থাকতে আর একটা নাম কেনা কি উচিত?”

“তোমার নামটা যেন কী বললে!”

“আজ্ঞে নন্দদুলাল রায়।”

নাক কুঁচকে দুলালবাবু বললেন, “বাজে নাম। বিশ্রী নাম। পচা নাম। দুলাল সেন নামটা কত সুন্দর। তোমাকে বেশ মানাবেও হে। শস্তায় দিচ্ছি।”

নন্দবাবু সাধারণত কারও সঙ্গে রঙ্গরসিকতা করেন না। তাতে মনটা লঘু হয়ে যায়। তবু এখন কেমন যেন একটু রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারলেন না। বললেন, “আজ্ঞে শস্তা কোথায়? বেজায় আক্রা। প্রতি অক্ষর দশ পয়সা দরে পাওয়া যায়।”

দুলালবাবু হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “বলো কী? নরহরি যে বলল, অক্ষর একটাকা করে!”

“নরহরি কে স্যার?”

“সে আমার শাকরেদ। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।”

“কিসের শাকরেদ?”

“আমরা চুরি করতে বেরিয়েছি। খুব ভাল কাজ। সোজাও বটে।”

নন্দবাবু চোখ গোল করে বললেন, “চুরি!”

দুলালবাবু একগাল হেসে বললেন, “খুব সোজা কাজ। লোকের বাড়ি ঢুকে সব জিনিসপত্র চুপিচুপি সরিয়ে ফেলতে হয়। সেগুলো নরহরিই বেচে পয়সা এনে দেবে। তুমিও আমাদের সঙ্গে নেমে পড়ো কাজে। চুরি করলে বুদ্ধি বাড়ে, সাহস বাড়ে, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বাড়ে, চোখ কান-নাক সব সজাগ হয়। চুরির মতো জিনিস নেই।”

“বলেন কী স্যার? এ যে ভূতের মুখে রাম নাম।”

“তার মানে কী?”

“আপনি যে খুবই সাধু লোক ছিলেন। পঁচিশ বছর আগে কার কাছ থেকে যেন একটা পোস্টকার্ড ধার করে বাবাকে চিঠি লিখেছিলেন, পঁচিশ বছর ধরে সেই পোস্টকার্ডের জন্য আপনার মানসিক যন্ত্রণা হত। পরে সেই লোকটার ছেলেকে খুঁজে বের করে একটা পোস্টকার্ডের ধার শোধ করেছিলেন! এ গল্প আপনি নিজেই আমাদের বলেছিলেন।”

দুলালবাবু দ্রুতবেগে জমাট পায়েস খেতে-খেতে ভারি আরাম বোধ করতে করতে বললেন, “পোস্টকার্ড! সেটা কী জিনিস বলো তো!”

নন্দবাবু খুবই হতাশ হয়ে দুলালবাবুর দিকে চেয়ে রইলেন।

দুলালবাবু পায়েসের বাটি শেষ করে একটা ঢেকুর তুলে বললেন, “বাঃ, দিব্যি খাওয়া হল। এবার কাজ।”

“কী কাজ স্যার?”

“বাসনপত্রগুলো সব চুরি করতে হবে। আর গয়নাগাঁটিও। চলো তো ছোঁকরা, আমার সঙ্গে একটু হাত লাগাবে। নরহরি বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে।”

নন্দবাবু হাসবেন কি কাঁদবেন তা বুঝতে পারলেন না। স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। দুলাল সেন তাঁর চোখের সামনেই বাসনপত্রগুলো গুছিয়ে পাঁজা করে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বলে গেলেন, “এগুলো চালান করে দিয়েই ফের আসছি এবাড়িতে দেখছি মেলাই জিনিস।”

দুলালবাবু খোলা জানালাটার কাছে এসে আহ্বাদের গলায় ডাকলেন, “নরহরি।”

সঙ্গে সঙ্গে জানলায় পাঁচুর ছায়া উদয় হল।

“এই যে ধরো। আরও জিনিস আছে।”

পাঁচু বাসনগুলো নিয়ে খুশি হয়ে বলল, “বড় সময় নিচ্ছেন যে পাঁচুবাবু। আরও একটু তাড়াতাড়ি করলে হয় না?”

দুলালবাবু হেসে বললেন, “খাচ্ছিলুম তো। বেশ খাওয়া হল। তাও তাড়াতাড়িই হত, একটা লোক এসে খামোখা নানা কথা জুড়ে দিল।”

আঁতকে উঠে পাঁচু বলল, “লোক! বলেন কী! তা হলে তো ধরা পড়ে গেছেন।”

“আরে না। তাকেও দলে ভিড়িয়েছি। সে এখন গয়নাগাঁটি নিয়ে আসছে।”

পাঁচু অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে থেকে বলল, “কাজটা ঠিক করেননি পাঁচুবাবু। চুরির সময় অন্যদিকে মন দিতে নেই।”

দুলালবাবু একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, “আচ্ছা, এবার মন দিয়েই চুরি করছি।”

পাঁচু বাসনগুলো নিয়ে গামছায় পোঁটলা বেঁধে ফেলল। তার মনে হল, এবারে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ। লোকটা পাগল। ধরা পড়তে আর দেরি নেই। যা বাসনপত্র পেয়েছে পাঁচু তা বেচলে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা হেসেখেলে হয়ে যাবে। বেশি লোভ করা ভাল নয়।

পাঁচু বাসনের পোঁটলাটা পিঠে ফেলে রওনা দিল।

আর হঠাৎ দুটো লোহার মতো হাত এসে পিছন থেকে জাপটে ধরল তাকে।

.

আচমকা ধরা পড়ে পাঁচু আঁতকে উঠেছিল ঠিকই, তবে বহুদিনের শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার ফলে ঘাবড়ে গেল না। চেঁচামেচিও করে উঠল না। শুধু বজ্র আঁটুনিতে ‘কোঁক, কোঁক’ করে কয়েকটা শব্দ বেরোল মুখ দিয়ে। পাঁচু খুব বেকায়দায় পড়ছে। বুঝতে পেরে অমায়িক হেসে মোলায়েম গলায় বলল, “কে রে তুই দাদুভাই, অমন করে কি ধরতে আছে রে? বুড়ো হয়েছি না? তার ওপর এই দ্যাখ দাদুভাই, তোর ঠাকুমা একগাদা বাসন ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বলল, যাও, বেয়াইবাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসো। তা মাইল তিনেক পথ হেঁটে এই একটু জিরেন নেব বলে। ভাবছিলাম।”

পিছন থেকে যে সাপটে ধরে আছে সে এবার ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “তুমি একটা জোচ্চর!”

পাঁচু জিভ কেটে বলল, “ওকথা বলবেন না বাবুমশাই। এই ভোরবেলায় দেবতারা সব বেড়াতে বেরোন কিনা। শুনে ফেলবেন। আর শুনলেই চিত্তির। সোজা স্বর্গে ফিরে গিয়ে আমার পুণ্যির খাতে যা জমা হয়েছিল সব ঢ্যাঁড়া মেরে দেবেন। এই ভোরবেলাটায় তাই পাপ কথা বলতে নেনই। পাপ কাজও করতে নেই।”

“কিন্তু তুমি যে জোচ্চোর!”

পাঁচু চাপের চোটে দমসম হয়ে পড়েছিল। আর কয়েকবার কোঁক-কোঁক শব্দ করে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আজ্ঞে, আপনি যদি খুশি হন তা হলে বলি, আমি জোচ্চোরই বটে। এবারে ফাঁসটা একটু আলগা করুন, নইলে যে খুনের দায়ে ধরা পড়বেন বাবুমশাই।”

“নামের দাম অক্ষর-প্রতি কত ঠিক করে বলো তো এবার বাছাধন।”

ভয়ের চোটে এতক্ষণ গলাটা চিনতে পারছিল না পাঁচু, যদিও চেনা-চেনা লাগছিল। এবার চিনতে পেরে একগাল হেসে বলল, “ওঃ, পাঁচুবাবু নাকি? তা এই তো এক পাঁজা বাসন গস্ত করলেন, দিব্যি হাত হয়েছে, এর মধ্যে হঠাৎ আবার মেজাজ বিগড়োল কেন?”

দুলালবাবু অত্যন্ত ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, “নন্দবাবু বলেছে, নামের দাম প্রতি অক্ষরে দশ পয়সা। আর তুমি জোচ্চুরি করে নিয়েছ এক টাকা করে।”

পাঁচু অত্যন্ত বিনয়ী গলায় বলল, “নামের বাজার এবেলা-ওবেলা ওঠানামা করে। তবু বলি পাঁচুবাবু, উটকো লোকের কথায় না নাচাই ভাল। নন্দবাবু নামের জানেটা কী? আর নানান নামের নানান দর। পাঁচু নামটা কি যেমন-তেমন নাম? চন্দ্রবিন্দু থাকলে নামের দর একটু বেশি পড়েই যায়। দেখে আসুন না নামের বাজারটা। এবার যদি দয়া করে একটু ছাড়েন তো ভাল হয়। হাড়গোড় যে গুঁড়িয়ে গেল পাঁচুবাবু।”

দুলালবাবু ছাড়লেন। বললেন, “তা হলে জোচ্চুরি করোনি?”

জিভ কেটে পাঁচু বলল, “আপনার সঙ্গে! কী যে বলেন।”

“জোচ্চুরি না করলে পালাচ্ছিলে কেন?”

চোখ কপালে তুলে বলল, “পালাচ্ছিলুম? কখনো নয়। আমার চোদ্দপুরুষে কেউ কখনও পালায়নি। একটু আলগা দিচ্ছিলুম আর কি!”

‘নন্দলাল যে বলল, ওই যে লোক্টা পালাচ্ছে, গিয়ে ধরুন!”

‘মহা মিথ্যেবাদী। যে নামের দাম নিয়ে জল ঘোলা করে তাকে কি বিশ্বাস করতে আছে?”

“আছে,” বলে হঠাৎ নন্দবাবু হাতে একটা লাঠি নিয়ে এগিয়ে এলেন।

“বাবা গো!” বলে পাঁচু দৌড়তে লাগল। তার পিছু পিছু নন্দবাবু।

দুলালবাবু ঘটনার আকস্মিকতায় একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কী করা উচিত তা বুঝতে পারলেন না। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, মেলা কাজ বাকি। এখনও সোনাদানা গয়নাগাঁটি চুরি করা হয়নি। বাড়িটা ভর্তি কেবল জিনিস।

দুলালবাবু আবার জানলা গলে ভিতরে ঢুকে পড়লেন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তিনি ঘর থেকে নানা জিনিস বের করে আনতে লাগলেন। জলের কুঁজো, কুলো, কৌটো, ছেঁড়া জুতো থেকে শুরু করে মগ, বালতি কিছুই বাদ দিলেন না। দেখতে দেখতে জানলার বাইরে মেলা জিনিস স্থূপাকার হয়ে জমে উঠল। দুলালবাবু খুব খুশি হলেন। বাঃ, চুরিটা দিব্যি জমে উঠেছে।

দোতলায় উঠে তিনি যখন ভুবন রায়ের ঘরে হানা দিলেন, তখন তিনি চুরির নেশায় হন্যে হয়ে উঠেছেন।

ভুবন রায়ের ঘরে মেলাই জিনিস। তবে বেশির ভাগই বাজে জিনিস। দুলালবাবু অনেক জিনিস নীচে নামিয়ে আনলেন। তারপর তাঁর নজর পড়ল ভুবন রায়ের লোহার আলমারিটার দিকে। কিন্তু আলমারি চাবি দেওয়া।

দুলালবাবু গিয়ে ভুবন রায়কে ডাকাডাকি করতে লাগলেন, “এই যে মশাই, ও দাদু, আলমারির চাবিটা একটু দিন তো! দেরি হয়ে যাচ্ছে যে!”

ভুবন রায়ের ঘুম খুব গাঢ়। সহজে ভাঙে না। কিন্তু এত ডাকাডাকিতে মড়াও উঠে বসে।

দুলালবাবুকে দেখেই ভুবন রায় বললেন, “কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছেন নাকি?”

দুলালবাবু একগাল হেসে বললেন, “কত কী!”

“এর মধ্যেই?” বলে ভুবন রায় তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন, “তা কী আবিষ্কার করলেন শুনি?”

দুলালবাবু খুব গম্ভীর হয়ে আঙুলের কর গুনে-গুনে বলতে লাগলেন, “প্রথমেই আবিষ্কার করলাম একটা ঝাঁটা। তারপর বিরিয়ানি, ফুলকপি, পায়েস, তারপর জুতো, জামা, কৌটো…”

ভুবন রায় স্বপ্ন দেখছেন কি না বুঝতে না পেরে নিজের গায়ে চিমটি কেটে নিজেই উঃ করে উঠলেন।

দুলালবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “এখন ওই আলমারির মধ্যে কী আছে সেইটি আবিষ্কার করতে হবে। চাবিটা দিন তো।”

ভুবন রায় ভ্রূকুটি করে বললেন, “আপনি কানে কম শোনেন জানতাম। কিন্তু এতটাই যে কম শোনেন, তা জানা ছিল না। আমি আপনাকে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কাজে লাগিয়েছি, আর আপনি রাতদুপুরে আমার বাড়িতে ঢুকে ঝাঁটা জুতো আবিষ্কার করছেন।”

দুলালবাবু মাথা চুলকোতে লাগলেন, তাঁর মাথাটা যেন কেমন ঝিমঝিম করছে। কানে কম শোনেন! অথচ তিনি তো দিব্যি শুনতে পাচ্ছেন! অথচ কথাটা তাঁর মিথ্যে বলেও মনে হচ্ছিল না। কী যেন তাঁর মনে পড়তে লাগল অল্প-অল্প করে।

ভুবন রায় আবার ধমকের সুরে বললেন, “ছিঃ দুলালবাবু, আপনার কাণ্ডজ্ঞান যে এতটাই কম তা আমার জানা ছিল না।”

দুলালবাবুর মাথাটা খুব রিমঝিম করতে লাগল। একটু আগেও আর একজন তাঁকে দুলালবাবু বলে ডেকেছিল বটে। নামটা তাঁর চেনা-চেনাও ঠেকছে যে!

আচমকাই দুলালবাবুর মাথাটা কেমন যেন বোঁ করে ঘুরে গেল। তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন। তারপর পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালেন।

ওদিকে নন্দবাবু পাঁচুর পিছনে ছুটতে ছুটতে যেখানে এসে হাজির হলেন, সেটা তাঁদের ভৌত-ক্লাব। ক্লাবের পিছনে সেই ভাঙা বাড়ি। চারদিক ঝিমঝিম করছে, নির্জন।

বুড়ো হলেও লোকটা যে বেশ জোরে দৌড়তে পারে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর নন্দবাবু নিজে যে এখনও ভালরকমই দৌড়তে পারেন তা তাঁর জানা ছিল না।

ভৌত ক্লাবের কাছে চোরটা গা-ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছিল।

নন্দবাবু তাকে ডেকে বললেন, “ওহে নরহরি, তোমার ভয় নেই। পালিও না।”

পাঁচু ওরফে নরহরি একটা গাছের আড়াল থেকে বলল, “ভয় আছে কি নেই, সেটা বুঝব কী করে?”

নন্দবাবু খুশিয়াল গলায় বললেন, “তোমার দৌড় দেখে আমি খুশিই হয়েছি।”

পাঁচু চাপা গলায় বলল, “আজ্ঞে কর্তা, আপনিও কিছু কম যান না।”

নন্দবাবু বললেন, “হেঃ হেঃ, তা বলতে পারো বটে। দৌড়ঝাঁপে আমার কিছু এলেম ছিল এককালে।”

“এখনও আছে।” বলে বিগলিত মুখে পাঁচু শিশুগাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। সে বুঝে গেছে, আজ রাতে এ-শহরে পাগলের সংখ্যা বেজায় রকমের বেড়ে গেছে।

নন্দবাবু ভৌত ক্লাবের ভেজানো দরজাটা ঠেলে খুলে ফেলে বললেন, “এসো, একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। বড্ড জলতেষ্টা পেয়েছে।”

পাঁচুরও যথেষ্ট ধকল গেছে। এই বয়সে এত হুটোপাটি কি সয়? সেও নন্দবাবুর পিছু পিছু ঘরে ঢুকে মেঝের ওপর বসে পড়ল, “যে আজ্ঞে”।

নন্দবাবু মোমবাতি জ্বাললেন, তারপর কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেলেন। তারপর পাঁচুর দিকে চেয়ে বললেন, “এটা কিসের ক্লাব জানো?”

পাঁচু একগাল হেসে বলল, “তা আর জানব না? এ হল ভুতুড়ে কেলাব।”

“ভৌত-ক্লাব।”

“ওই হল। আপনারা সব সাঁঝের বেলায় এখানে বসে ভূত-প্রেত নামানোর জন্য চেষ্টা করেন। তবে তাঁরা নামেন না।”

নন্দবাবু মাথা নেড়ে দুঃখের সঙ্গে বললেন, “ঠিকই বলেছ, আমাদের একজন তো ভূত দেখার জন্য কত চেষ্টাই করলেন। শালার কাছে তাঁর মুখ দেখানোই ভার হয়েছে।”

পাঁচু খুব হাসল। হাসতে হাসতেই বলল, “আজ্ঞে, ভূতের কোনও অভাব নেই। চারদিকে মেলা ভূত।

নন্দবাবু সোজা হয়ে বসে বললেন, “বলো কী।”

পাঁচু গম্ভীর হয়ে বলল, “আমরা হলুম তো রাতচরা মানুষ। নিশুতি রাতেই আমাদের কাজ কারবার শুরু হয় কি না, আমরা তো বিস্তর ভূত দেখতে পাই।”

নন্দবাবু সাগ্রহে বললেন, “কেমন?”

“এই তো পরশু দিনই নিস্তারিণী ঠাকুমাকে দেখলুম। কদমতলার বেলগাছ থেকে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছেন। গতকালও বগলা দত্তের সঙ্গে দেখা, পুকুরে নেমে চান করছিলেন। তারপর ধরুন, কুমোরপাড়ার মোড়ে যদি যান, দেখবেন নাথু মুচি বসে বসে জুতো সেলাই করছে, তার একটু দূরেই হারা নাপতে চুল ছাঁটছে। তারপর ধরুন, এই ভৌত-ক্লাবের পিছনেই তো গত তিনশো বছর ধরে হরিহর মিত্রমশাই বসবাস করে যাচ্ছেন। সেই চুনোট ধুতি, গোঁফে সেই তুরতুরে আতর, গিলে কলা পাঞ্জাবি, পাঁচ আঙুলে পাঁচখানা আংটি, তেমনি দাপুটে মেজাজ। এখনও কথায় কথায় মোহর বখশিশ করেন, চটে গেলে চাবুক।”

‘অ্যাঁ! তা দেখাতে পারো?”

“সে আর শক্ত কী? তবে কিনা…”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress