ভুবন রায়ের বয়স পঁচাশি
ভুবন রায়ের বয়স পঁচাশি বটে, কিন্তু তাঁকে বুড়োমানুষ বললে অপমানই করা হবে। ভুবন রায় ওলিম্পিকে দেশের হয়ে ওয়েটলিফটিং করে এসেছেন যৌবন কালে। একটা মেডেল পেলেও পেয়ে যেতে পারতেন। পারলেন না কেবল খাওয়ার প্রতি তাঁর সাঙ্ঘাতিক লোভের জন্য। প্রতিযোগিতার দিন সকালবেলায় তিনি একরাশ মাংস আর ডিম খেয়ে অ্যায়সা ওজন বাড়িয়ে ফেলেছিলেন যে, তাঁকে লাইট-হেভি গ্রুপের প্রতিযোগিতায় নামতে দেওয়া হল না। কর্মকর্তারা বললেন, “তোমাকে হেভিওয়েটে কমপিট করতে হবে।” তবে ভুবন রায় দমবার পাত্র নন। কোমর বেঁধে হেভিওয়েট গ্রুপের দৈত্য-দানবদের সঙ্গেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লেন। আশ্চর্যের বিষয়, তিনি ষষ্ঠ স্থান দখল করেছিলেন। লাইট-হেভি গ্রুপে হলে যে সোনার মেডেল জয় করা তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন হত না, এ কথা সবাই স্বীকার করেছিল। তা ভুবন রায়ের জীবনটাই এমনি। মিলিটারিতে বেশ উঁচু পর্যায়ের অফিসার ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভালরকম লড়াই করেছেন। কিন্তু যুদ্ধ যেই থামল, অমনি তাঁর জীবনটা আলুনি হয়ে গেল। মিলিটারিতে চাকরি করবেন, অথচ যুদ্ধ করবেন না, এটা তাঁর কাছে এক অসহ্য ব্যাপার। দেশের জন্য যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেবেন, এটা তাঁর অনেক দিনের সাধ। কিন্তু যুদ্ধ থামবার পর দেশ স্বাধীন হয়ে গেল এবং সবাই শান্তির বাণী কপচাতে লাগল দেখে তিনি ভারি চটে গেলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখলেন, “ভারতবাসীরা যুদ্ধ করেনি বলেই মানুষ হয়ে উঠতে পারছে না। যুদ্ধ বাধালে দেশের যুবশক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে, জাতীয় চরিত্র গঠিত হবে না। যুদ্ধই জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করে। অতএব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি একটা যুদ্ধ ঘোষণা করুন।” বলাই বাহুল্য, এ চিঠির প্রতি প্রধানমন্ত্রী তেমন গুরুত্ব দেননি, তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে চিঠিটা পাঠিয়ে দেন। আর প্রধানমন্ত্রীকে ওই চিঠি লেখার দরুন ভুবন রায়ের কোর্ট মাশাল হওয়ার জোগাড়। ভুবন রায় তাতেই কী খুশি। কোর্ট মার্শাল হয়ে যদি গুলি খেয়ে মরতে হয়, তা হলেও একরকম দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার শামিল হবে ব্যাপারটা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা হল না। নতুন সরকার দয়ার অবতার, শান্তির বাণী ছাড়া মুখে কথা নেই। তাই তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া হল। ভুবন রায় ঘেন্নায় নাক সিঁটকে মিলিটারির চাকরি ছেড়ে দিলেন। তারপর এই গঞ্জে এসে গ্যাঁট হয়ে বসে দুধের ব্যবসা শুরু করলেন। মেলা গোরু কিনে ফেললেন এবং দুধ, মাখন, ঘি তৈরি করে বাড়ি বাড়ি ফিরি করে বেড়াতে লাগলেন। খাঁটি ঘি-দুধের অভাবেই যে বাঙালির স্বাস্থ্যের এত অবনতি, তাতে সন্দেহ কী? কিন্তু গঞ্জের মানুষের তেমন পয়সা নেই। সবাই ধারবাকিতে ঘি দুধ- কেনে, কিন্তু পরে আর ধার শোধ করতে পারে না। ভুবন রায়ের ব্যবসা লাটে উঠল। এরপর তিনি জুতোর দোকান খুললেন। তাতেও বিশেষ সুবিধে হল না। অবশেষে চাষবাস শুরু করার পর তাঁর কপাল খুলে গেল।
ভুবন রায়কে ভয় পায় না, এমন লোক গোটা পরগনায় নেই। ছেলেরা কেউ তাঁর চোখের দিকে চেয়ে কথা বলতে সাহস পায় না। শুধু তাই নয়, এখনও প্রত্যেকদিন রাত্রিবেলা তিনি তাঁর চার ছেলেকে ডেকে সামনে দাঁড় করিয়ে প্রায়ই বকাঝকা করেন। বড় ছেলেন বয়স পঞ্চাশের ওপর। সবচেয়ে ছোটটির বয়স পঁচিশ। সবাই প্রাপ্তবয়স্ক কিন্তু ভুবন রায় তাঁদের নাবালক ছাড়া কিছুই মনে করেন না।
ইদানীং ভুবন রায়ের মাথায় বিজ্ঞান ভর করেছে। একদিন ছাদে বেড়াতে বেড়াতে তিনি হঠাৎ দেখতে পেলেন, গোটা দুনিয়াটাই জ্যামিতিতে ভরা। ছাদটা একটা আয়তক্ষেত্র, চাঁদটা একটা বৃত্ত, সুপুরি গাছগুলো সরলরেখা এবং চারদিকে আর যা-যা আছে, সব কিছুই জটিল জ্যামিতিক নকশা ছাড়া আর কিছুই নয়। জ্যামিতি ও ঘন জ্যামিতি।
আর একদিন তিনি দুধ, কলা আর খই মেখে ফলার খেতে গিয়ে হঠাৎ বোধ করলেন, এ তো রসায়ন। দুধ, কলা আর খই মেশানো এই যে পদার্থটি একে রাসায়নিক সংমিশ্রণ বলা যায় না কি? এই যে জল খাচ্ছেন, এও তো এইচ টু-ও! চারদিকেই ভুবন রায় তখন রাসায়নিক বিক্রিয়া দেখতে লাগলেন।
একদিন তাঁর নাতনি বাবলি ফিজিক্স পড়ছিল। পাশের ঘর থেকে ভুবন রায় আলোর প্রতিসরণের অত্যাশ্চর্য ব্যাপারটা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাই তো! পদার্থবিদ্যাই তো আসল বিদ্যা।
আবার আড়াই টাকা করে সের সাতাশ পো দুধের দাম কত, এটা একদিন গয়লাকে বোঝাতে গিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছেন, তখন গয়লা অনায়াসে দামটা বলে দেওয়ায় ভুবন রায় নিজের অঙ্কবোধের অভাবে ভীষণ মুষড়ে পড়লেন। তারপর থেকেই দুপুরবেলা নাতি-নাতনিদের অঙ্কের বই নিয়ে চুপিচুপি আঁক কষা শুরু করেন।
ভুবন রায়ের বড় ছেলে রামলাল কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। অতিশয় নিরীহ মানুষ। ভুবন রায় একদিন সন্ধেবেলা তাঁকে ডেকে পাঠালেন।
‘‘আজ্ঞে?”
“তুমি তো একজন বিজ্ঞানী, না কি?”
রামলাল মাথা চুলকে বললেন, “আজ্ঞে, বিজ্ঞানী বললে বাড়াবাড়ি হবে। তবে বিজ্ঞানের অধ্যাপক বটে।
“ওই হল। নিজেকে ছোট ভাবতে নেই হে, বিনয়বশেও না। তুমি তো বি এস-সি আর এম এস-সি’তে সোনার মেডেলও পেয়েছিলে।”
“যে আজ্ঞে।”
“আর তারপরেই তোমার দম গেল ফুরিয়ে। সোনার মেডেল পাওয়া ছেলেদের যদি এই হাল হয়, তবে দেশের বিজ্ঞান কোথায় পড়ে আছে! ওদিকে জাপানিরা, মার্কিনিরা বিজ্ঞানে ধড়াধ্বড় এগিয়ে যাচ্ছে, আকাশে মানুষ পাঠাচ্ছে, যন্ত্রকে দিয়ে কথা কওয়াচ্ছে, আর তুমি মুখের ফেকো তুলো বিজ্ঞানের বক্তৃতা দিয়ে মাসে মাসে দু-পাঁচশো টাকা রোজগার করেই আহ্লাদে আটখানা! ছ্যা ছ্যা।”
রামলাল লজ্জায় দীনতায় মাথা নামিয়ে রইলেন।
ভুবন রায় অতিশয় কঠোর দৃষ্টিতে ছেলে দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “আমি লক্ষ্য করেছি, তোমার কোন নিজস্ব ল্যাবরেটরি নেই। কলেজের ল্যাবরেটরিতেও তুমি কদাচিৎ যাও। অর্থাৎ হাতে কলমে বিজ্ঞানচর্চার পাট তোমার উঠেই গেছে।”
“আজ্ঞে, তা-ই বটে।”
“সেই জন্যই তো বলছিলাম, ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার। যে বিজ্ঞানীর পরীক্ষাগার নেই, সে আবার কিসের বিজ্ঞানী?”
“যে আজ্ঞে।”
ভুবন রায় আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, “তোমার বয়স অল্প, সুতরাং এগুলো নতুন করে সবই শুরু করা যায়। আমি ঠিক করেছি, আমাদের পুরনো গোয়ালঘরটা একটু সারিয়ে নিয়ে একটা পুরোদস্তুর ল্যাবরেটরি বানিয়ে ফেলব। গোয়ালটা বেশ লম্বা আর বড়। কাজের পক্ষে চমৎকার হবে।”
রামলাল ভারি অবাক হলেন। কিন্তু প্রতিবাদ করার মতো বুকের বল খুঁজে না পেয়ে মিনমিন করে বললেন, “তার যে অনেক খরচ!”
ভুবন রায় অবিকল বন্দুকের আওয়াজ বের করলেন গলা দিয়ে, “খরচ! ভুবন রায় কবে খরচকে ভয় পেয়েছে শুনি! বিজ্ঞান-চেতনার অভাবে দেশটা উৎসন্নে যাচ্ছে। তুমি একটা গোল্ড মেডালিস্ট হয়েও দিন-দিন হাবাগে!বা হয়ে যাচ্ছ, আর আমি খরচের ভয়ে হাত গুটিয়ে থাকব?”
“আজ্ঞে, তা বটে।”
“বিজ্ঞান শিখেছিলে কি মুখস্থবিদ্যা জাহির করে মাসের শেষে দু’চারশো টাকা আয় করে উঞ্ছবৃত্তিতে জীবন কাটাবে বলে? আবিষ্কারকই যদি না হলে, তা হলে শিখে লাভটা হল কী?”
“যে আজ্ঞে।”
“তুমি কাল থেকেই লেগে পড়ো। কলকাতায় চলে যাও, যা-যা যন্ত্রপাতি লাগে, সব কিনে নিয়ে এসো। কাজে লেগে পড়ো। আমারও খানিকটা বিজ্ঞান পড়া আছে। তোমার অ্যাডভাইসার হিসেবে আমিও থাকব, হাতে-কলমে কাজ করব। এখনও কত কী আবিষ্কার করার আছে। এই ধরো না কেন, তোমার মায়ের তো খুব পান খাওয়ার নেশা, রোজ রাশি রাশি সুপুরি কুচোতে হয়। সুপুরি কুচোনোর একটা যন্ত্র যদি বানিয়ে ফেলতে পারো তো কত উপকার হয়। আমাদের হারু নাপতের চোখে ছানি আসছে, সেদিন ও আমার কানের ডগাটা প্রায় হেঁটে ফেলেছিল কাঁচি দিয়ে। ভাবছিলাম যদি চুল ছাঁটার একটা যন্ত্র তৈরি করা যায় তো মন্দ হয় না। জিনিসটা হবে অনেকটা হেলমেটের মতো, মাথায় পরে কিছুক্ষণ বসে থাকলেই চুল চমৎকার কাটা হয়ে যাবে। তারপর এরকম আরও কত কী বের করে ফেলা যায়। নিত্যি নতুন জিনিস আবিষ্কার করার আনন্দই আলাদা।”
“যে আজ্ঞে।”
“যাও, কাল থেকেই কাজে লেগে পড়ো। আর শোনো, ফিজিক্স, কেমিস্ত্রি, বায়োলজি সব রকম এক্সপেরিমেন্টের জন্যই যন্ত্রপাতি চাই। বুঝলে?”
“যে আজ্ঞে।” সুতরাং রামলালকে কলকাতায় যেতে হল। কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে মেলা যন্ত্রপাতি এসে পড়ল। রামলাল মাসখানেক ভূতের মতো খেটে ল্যাবরেটরি সাজিয়ে ফেললেন।
ভুবন রায় ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা দেখে খুশি হয়ে বললেন, “শোনো হে রামলাল, প্রতি সপ্তাহে একটা করে নতুন জিনিস আবিষ্কার করতে হবে, এইরকম একটা প্রতিজ্ঞা করে কাজে লেগে পড়ো। পিছনে আমিও আছি।”
রামলাল বেজার মুখ করে বললেন, “যে আজ্ঞে।”
কিন্তু কী আবিষ্কার করবেন তা ভেবে ভেবে কূল পেলেন না। ভুবন রায় কিন্তু মহা উৎসাহে যন্ত্রপাতি নিয়ে তুমুল কাজে লেগে গেলেন।
একদিন হাতে একটা কাঁচের বাটি নিয়ে ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এলেন ভুবন রায়। সবাইকে বাটির মধ্যে একটা কাদার মতো থকথকে জিনিস দেখাতে লাগলেন।
সবাই জিজ্ঞেস করল, “জিনিসটা কী?”
ভুবন রায় মাথা নেড়ে বললেন, “এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে আর দুটো এক্সপেরিমেন্টের পরেই বোঝা যাবে।”
সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
পরদিনই ভুবন রায় ফের ‘ইউরেকা! ইউরেকা!’ করে বেরিয়ে এলেন। হাতে একটা টেস্ট টিউবের মধ্যে সবুজ তরল পদার্থ।
সবাই জানতে চাইল, জিনিসটা কী?
ভুবন রায় মৃদু হেসে বললেন, “বুঝতে পারবে হে, কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবে।”
কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, ভুবন রায় অনেকগুলো জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছেন। একটা কাঁচের গোলকের মধ্যে তিনটে কাঁচের গুলি, একটা দেশলাইয়ের বাক্সের মতো দেখতে যন্ত্র, বেশ কয়েকটা কেমিক্যাল। কিন্তু এগুলো দিয়ে কী হবে, তা আর কেউ জিজ্ঞেস করতে সাহস পেল না।
বিজ্ঞানীরা অনেক সময়ে এমন সব জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেন, যা বস্তুত মানুষের কোন কাজেই লাগে না। এরকম একটা অর্থহীন বিখ্যাত আবিষ্কার হল জলিপাট্টি। জলিপাট্টি একটা পুডিং এর মতো জিনিস। কিন্তু মেঝেয় ফেলে দিলে কাঁচের মতোই ভেঙে যায়। আবার কোনও পাত্রে রেখে দিলে কিছুক্ষণ পর তা তরল হয়ে গড়িয়ে যেতে থাকে। বিজ্ঞানীরা আজ অবধি একে কোনও কাজে লাগাতে পারেননি। আর একটা জটিল যন্ত্রও আবিষ্কার করা হয়েছিল, যার মধ্যে চালিত সমস্ত বিদ্যুৎ-প্রবাহই শূন্যে পর্যবসিত হয়। যন্ত্রটা আজও কোন কাজে লাগানো যায়নি। কিন্তু এইসব আবিষ্কার বিজ্ঞানচর্চার অবশ্যম্ভাবী কিছু লেজুড়।
আবিষ্কারগুলো কেমন হল, তা ভুবন রায় একদিন রামলালের কাছে জানতে চাওয়ায় রামলাল বিজ্ঞানের এইসব নিষ্ফল আবিষ্কারের কিছু ঘটনার কথা মনের ভুলে বলে ফেলেছিলেন। ভুবন রায় ছেলের ওপর এমন খাপ্পা হয়ে গেলেন যে, রাত্রে সেদিন জলস্পর্শ করলেন না, এবং সারারাত ল্যাবরেটরিতে জেগে কালজয়ী কিছু একটা আবিষ্কার করার জন্য উঠেপড়ে লেগে রইলেন। তিন-চারদিন তাঁর নাওয়া-খাওয়ার হুঁশ রইল না।
তারপর একদিন একটা দূরবীনের মতো যন্ত্র নিয়ে বেরিয়ে এসে সগর্বে সবাইকে বললেন, “ইউরেকা! ভুত দেখার যন্ত্র আবিষ্কার করেছি।”
শুনে সবাই আঁতকে উঠল।
কিন্তু সমস্যা হল, যন্ত্রটা চোখে দিয়ে ভুবন রায় নানা আকৃতির অজস্র ভূত দেখতে পান বটে, এবং তার ধারাবিবরণীও দিতে থাকেন, “ওই যে একটা শুটকো ভুত পান্তা ভাত খাচ্ছে… ওই যে একটা পেত্নি আকাশে চুল ছড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছে… ওই তো শিবচন্দ্র কামারের ভূত হরিহর পালের ভূতকে ধরে ঠ্যাঙাচ্ছে…” ইত্যাদি, কিন্তু সেই যন্ত্র দিয়ে আর কেউ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। কিন্তু সে কথা ভুবন রায়কে বলে, এমন সাহস কার?
রামলালকেও স্বীকার করতে হল যে, যন্ত্রটা দিয়ে আবছা আবছা ভৌতিক কিছু দেখা যায় বটে।
ভুবন রায় চটে উঠে বললেন, “আবছা-আবছা মানে, স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ভাল করে দ্যাখো।”
রামলাল আমতা-আমতা করে বললেন, “আজ্ঞে স্পষ্টই।”
“কী দেখছ বলো।”
অগত্যা রামলাল বানিয়ে বলতে লাগলেন, “আজ্ঞে একটা রোগা আর একটা মোটা ভুত কুস্তি করছে… আর একটা পেত্নি ডালের বড়ি দিচ্ছে…”
“তবে?” বলে খুব হাসলেন ভুবন রায়। তারপর ছেলেকে বললেন, “কিন্তু তুমি কী করছ? এখনও তো একটাও কিছু আবিষ্কার করতে পারলে না।”
“আজ্ঞে না।”
“সাত দিন সময় দিলাম। কিছু একটা করে দেখাও। দীর্ঘদিন মাস্টারি করে মাথার বারোটা বাজিয়েছে। মাথাটা এবার খাটাও।”
“যে আজ্ঞে।”
সুতরাং রামলালকে কাজে লাগতে হল। কী করবেন, তা তিনি ভেবেই পাচ্ছিলেন না।
একদিন তিনি বসে বসে ভুবন রায়ের আবিষ্কৃত জিনিসগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ল্যাবরেটরির মধ্যে একটা যেন কিছু ঘটছে।
.
ল্যাবরেটরিতে কী ঘটেছে তা রামলাল বুঝতে পারলেন না বটে, কিন্তু তাঁর মনে হল, বিশাল গোয়াল ঘরটার কোনও একটা প্রান্তে কেউ একজন নড়াচাড়া করছে।
রামলাল খুবই ভিতু মানুষ। তিনি সভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কে ওখানে?”
কেউ থাকার কথাও নয়। ল্যাবরেটরির একটামাত্র দরজা। রামলাল ঢুকেছেন এবং নিজের হাতে ছিটকিনি বন্ধ করেছেন। সুতরাং কে হতে পারে?
রামলালের প্রশ্নের জবাব অবশ্য কেউ দিল না। কিন্তু রামলাল সুস্পষ্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ পেলেন। তারপর শুনলেন, ক্যাবিনেট খুলে কে যেন একটা টেস্টটিউব বের করল। তারপর একটা টিউবের মধ্যে একটা তরল জিনিস পড়ার শব্দ হল।
রামলাল শিউরে উঠলেন। তারপরই তারস্বরে “রাম… রাম… রাম… বাবা রেমা রে ….”, বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দড়াম করে এসে দরজায় ধাক্কা খেলেন। ছিটকিনিটা কোনওরকমে খুলে এক লাফে উঠোনে পড়ে দৌড়তে গিয়ে আছাড় খেলেন। গোড়ালি মচকে গেল। তা সত্ত্বেও উঠে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে ছুটতে লাগলেন। মুখে “বাঁচাও… বাঁচাও…” চিৎকার।
কিন্তু মুশকিল হল, ল্যাবরেটরিটা বাড়ির পিছন দিকে এবং অনেকটা দূরে। এদিকটায় অনেকটা ফাঁকা জমি, বাগান। কেউ তাঁর চেঁচানি শুনতে পেল না। বকুলগাছের তলায় রামলাল আবার বড় ঘাসে পা আটকে পড়ে গেলেন এবং সেখান থেকে সভয়ে ল্যাবরেটরির দিকে একবার চেয়ে দেখতে গিয়ে তিনি একেবারে হাঁ।
প্রকাণ্ড দরজাটা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, ল্যাবরেটরির মধ্যে কে যেন দিব্যি আলোগুলো নিভিয়ে দিয়েছে। অন্ধকারে একটা বুনসেন বানারের আগুন দেখতে পেলেন রামলাল।
এরপর মচকানো পা নিয়েই যে দৌড়টা দিলেন রামলাল, তেমন দৌড় বোধহয় কার্ল লিউসও ওলিম্পিকের একশো মিটারে দৌড়তে পারেনি।
ভুবন রায় ক্রু কুঁচকে রামলালের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “দৌড়ে এলে মনে হচ্ছে! বাঃ, খুব ভাল। এতদিনে যে নিজের শরীরের দিকে নজর দিয়েছ, এতে আমি খুব খুশি। তবে এখন রাত ন’টা বাজে। এ সময়টায় দৌড়নোই ভাল।”
রামলাল হ্যাঁ-হ্যাঁ করে ফাঁফাচ্ছিলেন যে, কথার জবাব দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না!
ভুবন রায় তাকে উদ্দেশ করে বললেন “সকালে উঠে দৌড়নোই ভাল। মাইলটাক দৌড়লেই দেখবে তোমার মতো নীরেট মাথাও কেমন চনমন করে উঠছে।”
হ্যাঁ-ত্যা করতে করতেই রামলাল মাথা নেড়ে জানালেন যে, যথা আজ্ঞে।
ভুবন রায় ছেলের দিকে চেয়ে হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় বললেন, “ওঃ হো, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। আমি একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট পেয়েছি। বুড়ো মানুষ। তুমিও তাঁকে চিনবে। হাইস্কুলের সায়েন্সের টিচার ছিলেন। নাম দুলাল সেন। তিন কুলে কেউ নেই, অভাবেও পড়েছিলেন খুব। তার ওপর আবার কানে একদম শুনতে পান না। আজ থেকে তিনি আমাদের ল্যাবরেটরিতেই রয়েছেন। একেবারে কোণের দিকে একটা চৌকি পেতে দিয়েছি, সেখানেই থাকছেন আর একটু-আধটু কাজকর্মও করছেন। ল্যাবরেটরিতে গেলেই তাঁকে দেখতে পাবে।”
এ কথায় রামলাল ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন বটে, কিন্তু কিছু বলার জো নেই। হাঁফাতে-হাঁফাতে করুণ নয়নে চেয়ে রইলেন বাবার দিকে। তারপর ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বেরিয়ে ঠাকুমার কাছে গিয়ে বসলেন।
রামলালের ঠাকুমা, অর্থাৎ ভুবন রায়ের মা হরমোহিনী দেবীর বয়স একশো এক বছর। তাঁর হাঁকেডাকে সবাই অস্থির। ডাকসাইটে ভুবন রায় এই দুনিয়ায় একমাত্র মাকেই ডরান। হরমোহিনীর বকাবকির চোটে এ-বাড়িতে ঝি-চাকর থাকতে চায় না, কাকপক্ষী আসতে চায় না, এমনকী কুকুর-বিড়াল অবধি এ বাড়িকে এড়িয়ে চলে। শুধু বুড়ি দাসী মোক্ষদাই হরমোহিনীকে ভয় খায় না। আর তার সঙ্গেই রোজ সন্ধেবেলা হরমোহিনীর তুলকালাম ঝগড়া হয়। আজও হচ্ছিল।
হরমোহিনীর পায়ে বাতের ব্যথা। তাতে গরম রসুনতেল মালিশ করতে বসেছে মোক্ষদা। কিছুক্ষণ মালিশ চলার পর হরমোহিনী হঠাৎ বললেন, “হ্যাঁ রে মোক্ষদা, ব্যথা আমার বাঁ হাঁটুতে, আর তুই কোন্ আক্কেলে আমার ডান হাঁটুতে মালিশ করতে লেগেছিস?”
মোক্ষদা সপাটে বলল, “হাঁটু তো তুমিই এগিয়ে দিল বাপু। আমি কি হাঁটু বেছে নিয়েছি? আমি তেমন বাপের মেয়ে নই যে, পরের হাঁটু নিয়ে বাছাবাছি করব। আর এও বলি বাপু, এটা তোমার বাঁ হাঁটুই।”
হরমোহিনী উঁচুতে গলা তুলে বললেন, “বড় মুখ বেড়েছে তোর মোক্ষা, এটা যদি আমার বাঁ হাঁটুই হবে তা হলে ব্যথাটা আমার ডান হাঁটুতে হচ্ছে কী করে?”
তা তোমার যদি ব্যাথা নিত্যি নিত্যি হাঁটু বদল করে তা হলে আমার আর কী করার আছে? তোমার খিটখিটে স্বভাব, কেবল ঝগড়া করবে বলে গলা চুলকোয়। নইলে ঠিকই বুঝতে পারতে যে, ব্যথা তোমার বাঁ হাটুতেই।”
“ওলো ভালমানুষের বেটি লো, আমাকে উনি হাঁটু চেনাতে এলেন। পাঁচ কুড়ি এক বয়সে কত হাঁটু দেখেছি তা জানিস? হাঁটুর তুই কী জানিস লা? আমার হাঁটু, আমার ব্যথা, আর উনি এলেন আমাকে হাঁটু চেনাতে!”
“তা বেশ বাপু, ঘাট মানছি। স্বীকার করছি হাঁটুও তোমার, ব্যথাও তোমার। কিন্তু কোন্ আকেলে তুমি তোমার বাঁ হাটুকে ডান হাঁটু বলে চালানোর চেষ্টা করছ বলো তো! তুমি যে দেখছি দিনকে রাত করতে পারো।”
“কখন আবার বাঁ হাঁটুকে ডান হাঁটু বললুম বল তো! ওম্মা, কী মিথ্যেবাদী রে! আমি তোকে বলিনি, ব্যথা আমার বাঁ হাঁটুতে। আর তুই মালিশ করছিস ডান হাঁটুতে?”
“বলেছ। আমিও কানে কালা নই যে শুনিনি। তুমি হাঁটুটা লেপের তলা থেকে ঠেলে বের করে দিলে, আমিও মালিশ করতে লাগলুম। এটা তোমার বাঁ হাঁটু ডান, তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথাটা শুনি! তোমার হাঁটু তুমি বুঝবে, আমার মালিশ করার কাজ মালিশ করে যাব।”
“তাই যদি হবে তা হলে বড় গলা করে আমাকে আমার হাঁটু চেনাচ্ছিস কেন?”
“নিজের হাঁটু যদি নিজেই না চেনো তা হলে লোকে আর কী করবে? তাও বলি বাপু, ভীমরতি ধরেছে সে কথা স্বীকার করলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।”
“ভীমরতি আমাকে ধরবে কেন র্যা, ভীমরতি ধরেছে তোকে। নইলে কি আর ডান হাঁটুতে মালিশ করিস? আজ বেশ বুঝতে পারছি, কেন রসুন তেল নিত্যি মালিশ করেও আমার বাঁ হাঁটুর ব্যথাটা কমছে না। কী বুদ্ধিই না তোকে ভগবান দিয়েছেন! রোজ সন্ধেবেলা আমি একটু ঝিমোই, আর তুই মুখপুড়ি, এসে বাঁ হাঁটুর বদলে চুপিচুপি আমার ডান হাঁটুতে মালিশ করে যাস!”
“ভীমরতি নয় গো, তোমার মাথায় জিন-পরি কিছু ভর করেছে। তখন থেকে বলছি, এ-তোমার ডান হাঁটু নয়, এটা বাঁ হাঁটুহ, তাও কেন যে টিকির-টিকির করে যাচ্ছ?”
“ওরে আবাগির বেটি, এটা বাঁ হলে, আমার অন্য হাঁটুটা তা হলে কী? সেটাও কি বাঁ হাঁটু? তুই কি তা হলে বলতে চাস, বিধাতা আমাকে দু-দুটো হাঁটু দিলেন। আর দুটোই বাঁ হাঁটু? আর তাই যদি হবে তা হলে এতকাল আমি সেটা জানতে পারতুম না? তুই আমাকে বুঝিয়ে বল দেখি, এটা বাঁ হলে আমার অন্য হাঁটুটা কী হয়?”
“এ তো কানা মানুষও জানে গো, একটা বাঁ হলে অন্যটা ডান হবেই। কিন্তু তোমার মতো মানুষকে ভগবান যদি দুটো বাঁ হাঁটুহ দিয়ে থাকেন তাহলে আশ্চর্যের কিছু নেই। তোমার সবই তো অশৈলী কাণ্ড।”
“কী এমন তোকে বললুম বল তো মোক্ষদা যে, আমার হাঁটু নিয়ে খুঁড়ছিস! তখন থেকে পইপই করে বোঝাচ্ছি, ওরে মোক্ষদা, ভালোমানুষের মেয়ে, যদি এই হাঁটুটা আমার বাঁ হাঁটুই হবে তা হলে আমার অন্য হাঁটুটায় ব্যথা হচ্ছে কেন? তুই কি বলতে চাস ব্যথাটা আমার ডান হাঁটুতে? বাঁ হাঁটুতে নয়? এতকাল ধরে কি তবে আমি লোককে মিথ্যে করে বানিয়ে বলে আসছি যে, ব্যথাটা আমার বাঁ হাঁটুতে?”
“তাই তো বলছি গো, নিজের হাঁটু যে নিজে চেনে না তার কি মাথার ঠিক আছে। একশো বছর পার করলে বু এতদিনে ডান বাঁ চিনলে না, কেমন মানুষ তুমি বলে তো! পরের জিনিস তো আর নয়, একেবারে নিজের সহোদর দুটো হাঁটু। পাঁচটা-দশটাও নয়, মাত্র দু’খানা। একখানা ডান, একখানা বাঁ। তাও যদি চিনতে তোমার একশো বছরে না কুলোয়, তবে আর এ জন্মে তোমার হাঁটুজ্ঞান হবে না।”
“খুব যে গলা তুলে ঝগড়া করছিস, ডাক দেখি পাঁচজনকে। যা, গিয়ে মোড়ল মাতব্বর-মুরুব্বিদের ধরে নিয়ে আয়। সালিশ করুক। তারাই ঠিক করুক কোন্টা আমার বাঁ হাঁটু, আর কোন্টা ডান। তারপর তোমার মুখের মতো জবাব দেব। ভুবনটাকে ডাক তো, যা…”
‘আর সালিশ বসাতে হবে না। মোড়ল-মাতব্বরদের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তাঁরা আসবেন তোমার হাঁটুর বিচার করতে! সালিশ বসলে লজ্জার আর বাকি থাকবে না কিছু। সারা শহরে টিটি পড়ে যাবে। সবাই বলে বেড়াবে, ভুবন রায়ের মা হরমোহিনী নিজের দু’খানা হাঁটু একশো বছরেও চিনে উঠতে পারেনি। ছিঃ ছিঃ।”
দু’জনের ঝগড়া চরমে উঠেছে। হরমোহিনী লেপটেপ সরিয়ে ফেলে রীতিমত টানটান হয়ে বসেছেন তাঁর প্রকাণ্ড খাটের বিছানার ওপর। মোক্ষদাও আংরা জ্বালা মেটে হাঁড়িটা সরিয়ে সেঁক দেওয়ার ফ্লানেলের ভাঁজ করা কাপড়গুলো ফেলে তৈরি হয়ে বসেছে।
এমন সময় ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে রামলাল ঘরে ঢুকে পড়লেন। “ঠাকুমা!”
নাতিপুতিদের কাছে হরমোহিনী ভারি নরম। দেখলেই মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। একগাল হেসে বললেন, “আয় দাদা, আয়। হাঁফাচ্ছিস কেন ভাই?”
“সে অনেক কথা ঠাকুমা। শুধু হাঁফাচ্ছিই না গো, ল্যাংচাচ্ছিও। দেখছ না, পায়ের পাতায় কেমন রগ টানা দিয়েছে!”
“ওম্মা গো, মচকালি কী করে? নিশ্চয়ই ইস্কুলে দুষ্টু ছেলেগুলোর সঙ্গে হুটোপাটি করতে গিয়েছিলি!”
রামলাল করুণ একটু হাসলেন। ঠাকুমার ভীমরতির কথা তাঁর অজানা নয়। তবে রামলালকে ইস্কুলের ছেলে মনে করাটা বড় বাড়াবাড়ি।
রামলাল বললেন, “তাই গো ঠাকুমা। এবার দাও তো তোমার সেই চুনা হলুদের পট্টি বেঁধে।”
হরমোহিনীর নিজের হাতের চুন-হলুদের গরম পট্টি বহুঁকাল ধরে এই বাড়ির ছেলেপুলেদের ব্যথা-বেদনার পরম ওষুধ। হরমোহিনী তাড়াতাড়ি উঠে বললেন, “ওরে ও মোক্ষদা, যা তো মা, একটু চুন-হলুদ মিশিয়ে নিয়ে আয়, আংরায় গরম করে লাগিয়ে দিই।”
মোক্ষদা গজগজ করতে লাগল, “ডান হাঁটু বাঁ হাঁটুর জ্ঞান নেই, ছেলে বুড়োর জ্ঞান নেই, উনি আবার আমাকে হাঁটু চেনাতে লেগেছিলেন!”
এই কথাতে হরমোহিনী ফের জো পেয়ে নাতিকে সাক্ষী মেনে বললেন, “বল তো ভাই, এটা আমার কোন্ হাঁটু, ডান না বাঁ?”
রামলাল মাথাটাথা চুলকে বললেন, “ঠাকুমা, এ তো তোমার বাঁ হাঁটু বলেই সন্দেহ হচ্ছে।”
‘তবেই বল ভাই, মোক্ষদা হারামজাদি কিছুতেই মানছে না যে, এটা আমার বাঁ হাঁটু। তখন থেকে বলেই যাচ্ছে, আমি নাকি আমার হাঁটু চিনি না! কলিকাল কি আর সাধে বলে রে ভাই, হাঁটুর বয়সী মেয়ে সে এল আমাকে হাঁটু চেনাতে!”
মোক্ষদা ফোঁস করে উঠে বলল, “দুনিয়াসুদু লোক জানে যে, ওটা তোমার বাঁ হাঁটু। শুধু তুমিই জানতে না। তখন থেকে বলে যাচ্ছ যে, ওটা তোমার ডান হাঁটু।”
হরমোহিনী কপালে হাত দিয়ে বললেন, “কোথায় যাব মা, আবাগির বেটি বলে কী? কখন তোকে বললাম রে যে, এটা আমার ডান হাঁটু?”
আবার একটা ঝগড়া পাকিয়ে উঠছিল। রামলাল বিপদ দেখে তাড়াতাড়ি ঠাকুমার পাশে বসে পড়ে বললেন, “আমার যে খিদে পেয়েছে গো ঠাকুমা, কিছু খেতেটেতে দেবে নাকি?”
খাওয়ার কথায় হরমোহিনীকে যত বশ করা যায়, তত আর কিছুতে নয়। তিনি মনে করেন, ছেলেপুলেরা যত খাবে তত তাদের বুদ্ধি খুলবে, তত উন্নতি হবে।”
“খাবি ভাই?” বলে একগাল হাসলেন হরমোহিনী। তারপর উঠে জালের আলমারি খুলে একটি সর বের করে তাতে মিছরির গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেন।
“খা দেখি বসে বসে। সবটা খা।”
রামলালের খিদে নেই। তবু খেতে লাগলেন। সেই দৃশ্য দেখে ফোকলা মুখে খুব আহ্লাদের হাসি হাসতে লাগলেন হরমোহিনী।
ঠিক এই সময়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে নন্দবাবু ঘরে ঢুকলেন।
হরমোহিনী তাঁকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “নন্দ না কি রে?”
“হ্যাঁ ঠাকুমা।”
“তা তুই কোত্থেকে এলি ভাই? সবাই যে বলে তুই সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গেছিস!”
“এখনও যাইনি ঠাকুমা।”
“তা হলে তোর দেখা পাই না কেন? তুইও কি পা মচকেছিস? কে তোকে ল্যাং মারল?”