অতীতের আয়নায়
অনিরুদ্ধ নিজেই ড্রাইভ করে ফিরছে অফিস থেকে।বয়স হলেও এখনো বেশ স্মার্ট।
অবিবাহিত জীবন যাপন।
ময়দানের পাশদিয়ে ওর গাড়ি এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখলো, একটি মেয়ে ল্যাম পোষ্টের নীচে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ওর গাড়িটা সামনে আসতেই দুহাতে থামবার চেষ্টা করছে।
অনিরুদ্ধ গাড়ি থামিয়ে জানালার কাচ নামিয়ে জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে মেয়েটির দিকে তাকালো।
মেয়েটি উত্তেজিত হয়ে বললো, আমাকে একটা লিফ্ট দিন প্লিজ! আমি খুব বিপদে পড়েছিঅনিরুদ্ধ একটু ভেবে, মেয়েটিকে দরজা খুলে গাড়িতে তুলে নিল।
নির্জন রাস্তা, শুধু দুই একটা গাড়ি পাশদিয়ে চলে যাচ্ছে।
মেয়েটি নিজের থেকেই বললো একটা গাড়ি পাচ্ছিলাম না তাই… আমাকে রাসবিহারীর কাছে নামিয়ে দিলেই হবে।অনিরুদ্ধ মেয়েটিকে একবার পাশ ফিরে দেখলো, বয়স উনিশ কুড়ি হবে। পরণে লাল রঙের চুরিদার। দেখতে… এক কথায় অপূর্ব।
অনিরুদ্ধ জিজ্ঞাসা করলো, এখানে একা দাঁড়িয়েছিলে কেন?
মেয়েটি বললো, একা ছিলাম না…
বলে একটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললো, রাতের বন্ধুরা চলে গেল আমাকে ছুঁড়ে ফেলে।
তাই একটা গাড়ি পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।
অনিরূদ্ধ একটু ভেবে বললো, এই জীবন তোমার ভাল লাগে?
মেয়েটি হেসে বললো, পেটের দায়ে করতে হয়। আমার মায়ের অসুখ, বাবা অনেক আগেই ছেড়ে চলে গেছে। তাই আমিই সংসার চালাই। খানিক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। একটু ব্যাঙ্গের হাসি দিয়ে মেয়েটি একটা উক্তি করলো নিজের মনে। বিবাহিত পুরুষেরও এতো চাহিদা হুঁঃ!
অনিরুদ্ধ বিস্ময় ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটিকে পরখ করার চেষ্টা করলো। ইতিমধ্যে রাসবিহারীর মোড় এসে গেছে। মেয়েটি নেমে গেল ধন্যবাদ জানিয়ে শ্লথ ভঙ্গিতে।
অনিরূদ্ধ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে হঠাৎ নিজের অতীত জীবনের কথা মনে পরলো !!
স্টিয়ারিঙে হাত রেখে সামনের রাস্তায় চোখ। ফিরে গেল বছর কুড়ি আগে এক
অবিস্মরনীয় একটি ঘটনার অন্তরে।
তখন জীবনের সাফল্যের দিকেই উৎসাহ ছিল অমোঘ। মা… অনেকবার বিয়ের কথা বলেও কোনো সুরাহা করতে পারেনি। বাবার ব্যাবসাটাকেই আরো উন্নত করাই একমাত্র লক্ষ ছিল। বরাবর সোনার চামচ মুখে দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল।অভাবের সঙ্গে কখনও সাক্ষাৎ হয়নি।
একবার অফিসের কাজে কোলকাতা বাইরে বোলপুরে গিয়েছিল। একটি দামী হোটেলে উঠেছিল।
সেখানে ওর সাথে একটি মেয়ের পরিচয় হয়। মেয়েটি ছিল ওই হোটেলের কাজের লোক। ওখানকারের বাসিন্দা। ওর ঘর মুছে দিত, খাবার দিয়ে যেত, বিছানা পরিস্কার করে দিত। কয়েকদিন এমন চলায়, মেয়েটির সাথে একটা সখ্যতা হয়েছিল।
মেয়েটির শরীর লাবন্যের বন্যা ওকে আকৃষ্ট করতো। অনিরূদ্ধ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতো প্রাণপনে। কিন্তু কুড়ি বছরের মেয়েটির আকর্ষণ ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করতেই থাকে।
তখন ওর বয়স ত্রিশের ওপর। যৌবনের কিনারে। মেয়েটি সাবলীল ভাবে ওর দিকে টানা চোখে তাকালে ওর শরীরে রক্ত দ্রুত বইতো।
একদিন সন্ধ্যায় মেয়েটি ওর ঘরে চা দিতে এসে বললো এই সোন্দর বাবু! তু সবসময় লিখাপড়া করিস ক্যানে? ইত্ত পড়ালিখা করে মাথা খারাপ হবে যে বটে। বলেই হিহিহি করে হাসিতে ঘরের আবহাওয়া বদলে দিল।
অনিরুদ্ধর প্রানে যেন অকাল বসন্তের বাতাস এসে দরজা জানালা খুলে দিল। উন্মুক্ত হদয়ে হঠাৎ ঝড় বইতে লাগলো। মেয়েটির লাবন্য ভরা যৌবন ওকে অস্থির করে দেয়। হঠাৎ মেয়েটিকে কাছে টেনে নিয়ে, ওর মুখের ওপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ঠিক বলেছ তুমি।
সারাজীবন শুধু লেখাপড়া করেই সময় কেটে গেল। জীবনের অন্য দিকটা শূন্যই থেকে গেল।
মেয়েটির মুখে হাত বোলাতে মেয়েটি কোনো প্রতিবাদ করেনি।
অনিরুদ্ধ বললো তুমি খুব সুন্দর। তোমার স্বাবলীল ভঙ্গি আমার খুব ভালো লাগে। শহরের মেয়েদের চেয়ে অনেক সহজ। মেয়েটিও হয়তো, এতো সুন্দর একটি পুরুষের সান্নিধ্যে আপ্লুত।
অনিরুদ্ধ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা। মেয়েটির আর্কষণের কাছে হার মানল।
মেয়েটিও কোনো বাধা দেয়নি অনিরুদ্ধর দুর্বলতায়।
এরপর আরো ঘনিষ্ঠ হতে লাগলো ক্রমশঃ। মেয়েটিও সমস্ত উম্মুক্ত করে প্রেমের জোয়ারে ভেসে গেল অনিরুদ্ধর সাথে।
অশিক্ষিত আঞ্চলিক মেয়েটি বুঝি ভাবতেই পারেনি শহরের শিক্ষিত বাবুর ক্ষণস্থায়ী ভালবাসা। মেয়েটির বয়স তখন উনিশ কুড়ি হবে। চঞ্চল হরিণির মতো উচ্ছলতা প্রাণ-মন ভরা।
সহজ সরলতায় ভরা দেহের প্রতিটি স্তর।
হরিণি নয়নের বড় ফাঁদে আকৃষ্ট করে, কিন্তু ছলনা করতে জানেনা।
অনিরুদ্ধ সেটা বুঝেছিল। তাই ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল নিজের অবচেতন মনে।
যেদিন খেলা সাঙ্গ হলো, বিদায়ের সুর বাজলো বাঁশিতে, সেদিন অনিরুদ্ধ অনেক টাকা দিয়ে বলেছিল, এগুলো রাখো। আমি আবার আসবো, তখনও তোমাকে এমনি করেই ভালবাসবো।
‘চৈতালি’ সেদিন বুঝেছিল তার সর্বনাশের কথা। চৈত্রের বসন্ত পবনে ভেসে গিয়েছে ক্ষণিক হৃদয় দেওয়া নেওয়া। চৈত্রের ঝরা পাতা পথের ধুলোয় পরে থাকবে এবার। টাকা ফেরত দিয়ে বলেছিল, হামিতো ইজ্জত বেচিনাই তুকে, টাকা কেন দিছিসরে বাবু। হামি যা কুছু করেছি তুকে ভালবেসেই। তুর মনে যদি হামার জন্য একটুকু ভালবাসা থাকে, তবে জানবো তু মরদ আছিস। নয়তো তু কা-পুরুষ আছিস বটে।
অনিরুদ্ধর বাক্যহারা দৃষ্টি অবাক হয়ে দেখলো, একটি দৃঢ় প্রেমের প্রস্ফুটিত পদ্ম। যাকে কিনা অ-পবিত্র করা যায়না। অনিরুদ্ধ চলে এসেছিল কোলকাতায়। এরপর প্রায় দু বছর পর আবার গিয়েছিল সেই একই হোটেলে, কিন্তু চৈতালীর দেখা পায়নি। এমনকি কেউ ওর সন্ধান দিতে পারেনি।
ক্রমশ কাজের চাপে দেশে বিদেশে ঘুরতে ঘুরতে কোনো একদিন ভুলেই গিয়ছিল তার কথা।
আজ আবার এই কুড়ি বছরের মেয়েটিকে এইভাবে দেখে চৈতালির মুখটা যেন মনের দর্পণে ভেসে উঠলো।
কোথায় যেন একটা মিল আছে সেই হোটেলের মেয়েটির সাথে!
সারারাত ঘুমতে পাড়লো না।
শুধু মেয়েটির মুখটা মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠছে। বিশেষ করে চোখ দুটো।
যেন চকিত চাহনি চঞ্চল হরিনীর মতো।
পরের দিন রবিবার ছিল, তবুও কেন জানি মনটা খুব টেনে নিয়ে গেল আবার গতরাতের সেই জায়গায়।
ময়দানের পাশে গাড়িটা রেখে প্রায় আধ ঘন্টা শুধু সিগারেট উড়িয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এলো।
এরপর প্রতিদিনই ওখান থেকে আসে, আর এদিক ওদিক খোঁজে অনিরুদ্ধর দৃষ্টি।
কিন্তু নাহ্ বিফল মনোরথ।
আবার প্রায় ভুলেই গেল সেদিনের কথা।
হঠাৎই একদিন আবার, রাত প্রায় দশটা নাগাদ দেখতে পেল মেয়েটিকে রাসবিহারী এ্যভিনিউতে।
অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন প্যাসেঞ্জারও দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু রাস্তা প্রায় শুনশান। অনিরুদ্ধ চিনতে ভুল করেনি।
গাড়ির কাচ নামিয়ে মেয়েটিকে ডাকলো হাত নেড়ে। ফাঁকা রাস্তায় সহজে নজরে পড়লো মেয়েটির।
এগিয়ে এসে বললো, আমাকে ডাকছেন?
অনিরুদ্ধ ইতস্তত করে বললো, হ্যাঁ তোমাকেই ডাকছি!
অটোর জন্য দাঁড়িয়ে আছো?
মেয়েটি মুচকি হেসে বললো হ্যাঁ।
অনিরুদ্ধ বললো, উঠে এসো আমার গাড়িতে।
মেয়েটি প্রতিবাদ না করেই উঠে পড়লো অনিরুদ্ধর পাশেই।
গাড়ি স্টার্ট করলো অনিরুদ্ধ।
কিছুটা যেতেই মেয়েটি বললো, আপনি কদিন আগে আমাকে উপকার করেছিলেন।
আমি প্রতিদান দিইনি। আজ আবার আমাকে উপকার করলেন প্রতিদান নিশ্চয়ই দেব।
এই বলে হাসতে হাসতে কটাক্ষ করে বললো, কোথায় যাবেন চলুন আমি রাজি আছি।
অনিরুদ্ধ গম্ভীর দৃষ্টিতে মেয়েটিকে নিরীক্ষণ করে সামনের রাস্তায় দৃষ্টি রেখেই বললো, যদি বলি আজ আমার বাড়িতে যেতে! মেয়েটি হেসে বললো, এটা আপনি কখনই বলতে পারবেন না। কেউ বাড়িতে যেতে বলেনা। আপনি কি অবোধ ?
বাড়িতে আপনার অসুস্থ স্ত্রী আছে না!! অনিরুদ্ধ একটু অবাক হয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক দেখেই আবার সামনের রাস্তায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো, ‘আমার স্ত্রীই নেই তাছাড়া অসুস্থ বললে কেন?
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বললো, নাহ্ আপনাদের মতো বয়স্ক লোকেরা তাইই বলেতো; বলে মুখ ভঙ্গি করে বললো, বাপ- কাকাদের বয়সী লোকগুলো বলে, সারাজীবন অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে নাজেহাল হয়ে গেলাম। একটুও সুখ পেলাম না তাইতো তোমাদের কাছে আসি একটু সুখের আশায় ডার্লিং! এই বলে আবার হাসি। আপনার তো স্ত্রীই নেই তবে তো ঝামেলা মিটেই গেল।
অনিরুদ্ধ বললো, তোমার বাড়িতে কেউ চিন্তা করবে না রাতে না ফিরলে? মেয়েটি আবার সেই একই রকম হাসিতে পরিবেশ মুখর করে বললো, আমার বাড়িতে কেউ নেই চিন্তা করার মতো।অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে বললো, সেদিন যে বললে মায়ের অসুখ?
মা.. চিন্তা করবেনা?
মেয়েটি হাসতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো, খানিক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললো, মা.. আর নেই।
অনিরুদ্ধ চমকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো, সেকি!
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বললোনা।
নিঃশব্দে গাড়ি চলছে সামনের পথে। প্রায় নির্জন রাস্তা, পথ চলতি মানুষের সংখ্যা খুব কম। তবে গাড়ির ভীড় আছে মোটামুটি।
সামনের লাল সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল কয়েকটা গাড়ির পেছনে।
শ্রাবণের আকাশ মেঘের ঘনঘটা। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি। সাথে গুরুগম্ভীর আওয়াজ। অনিরুদ্ধ সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো, তোমার বাড়ি কোথায় ? মেয়েটি তার বাড়ির ঠিকানা বললো, এবং সেটা কাছাকাছি একটি বস্তির।
অনিরুদ্ধ বললো, এইতো মাস খানিক আগে বললে, মায়ের অসুখ।
এরই মধ্যে… কি হয়েছিল তোমার মায়ের?
মেয়েটি অশ্রুত চোখে অনিরুদ্ধর দিকে চেয়ে বললো হার্টের অসুখ ছিল। মাস খানিক আগে হঠাৎ ভোরে চলে গেছে।
বহু বছর ধরে একটা আশায় পথ চেয়ে চেয়ে অবশেষে হার্টের অসুখে ভুগছিল।
গাড়ি আবার সবুজ বাতির ইঙ্গিতে স্টার্ট নিল।
পথে আর কোনো কথা হয়নি। মেয়েটির ঠিকানায় এসে অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করলো, এখানে নামবে?
মেয়েটি ভারাক্রান্ত চোখে অনিরুদ্ধর দিকে অপলক চেয়ে বললো, হ্যাঁ এটাই আমার ঠিকানা। অনিরুদ্ধ বললো, কেউ আছে তোমার অপেক্ষায়? চপল, চঞ্চল মেয়েটি চোখের পাতা ভিজিয়ে বললো, নাহ্ আজ আমার পথ চেয়ে কেউ অসুস্থ শরীরে অপেক্ষা করেনা।
আমি এখন একাই থাকি। এই বলে গাড়ির দরজা খুলে উদ্যত ভঙ্গিতে বেরতে গিয়ে বাধা পেল।
অনিরুদ্ধ ওর হাতের কব্জিটা ধরে রেখেছে; মেয়েটি তাই দেখে অশ্রুত চোখ, এবং ঠোঁটে ব্যাঙ্গের হাসিতে বললো, ওহ্ আপনার প্রতিদান দেওয়া হয়নি চলুন আপনার বাড়িতেই যাবো এই বলে গাড়ির দরজাটা টেনে বন্ধ করেদিল।
ঠিক তখনই আকাশ ফাটানো বাজের আওয়াজ এবং প্রবল বৃষ্টির বড়বড় ফোঁটা ঝরতে লাগলো।
এরপর অনিরুদ্ধ মেয়েটিকে নিউআআলিপুরে নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো।
মেয়েটিকে বললো, তুমি দোতলায় চলে যাও ওখানে টয়লেট আছে ঘরের লাগোয়া সেখানে ফ্রেশ হয়ে নীচে এসো।
আমি নিচের ঘরে আছি।
মেয়েটি হতভম্বের মতো অনিরুদ্ধর দিকে চেয়ে আছে।
অনিরুদ্ধ ভ্রূ কুঁচকে বললো, কি হলো?
মেয়েটি বললো, আমি ফ্রেশ হয়ে কি পড়বো? জামা কাপড় কোথায়? এই বলে খিলখিল করে, হেসে গড়িয়ে পড়লো। অনিরুদ্ধর আবার বিভ্রান্তি লাগলো মেয়েটির সহজ হাসিতে।
কিছু খুঁজজে যেন মনে মনে মেয়েটির মধ্যে।
একটা সরল নিস্পাপ মুখ উঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।
অনিরুদ্ধ বিচলিত হয়ে বললো, হ্যাঁ ঠিকই তো!
তোমার তো পোশাক দরকার; আচ্ছা চলো আমার সাথে ওপরে মায়ের ঘরে।
আলমারীতে অনেক কাপড় আছে। যেটা পছন্দ হবে সেটাই পড়বে।
এই বলে, অনিরুদ্ধ মেয়েটিকে ওপরের ঘরে নিয়ে এলো।
মেয়েটি অবাক হয়ে দেখলো, বাড়িটা কি সুন্দর। ঘরের ভেতরটা সুন্দর সাজানো গোছানো।
মায়ের আলমারী খুলে দিয়ে বললো, যেটা পছন্দ সেটাই নিয়ে পড়। ঘরের ভিতরে বাথরুম আছে ওখানে ফ্রেশ হয়ে নাও। এই বলে অনিরুদ্ধ চলে গেল ঘর থেকে।
কঙ্কনা খানিক্ষণ স্তব্ধ হয়ে উদাস হয়ে ভাবছে এরকম মানুষ হয়! কেউ তো আজ পর্যন্ত এতো কাছের করে আপন ভাবেনি! এরপর কঙ্কনা বাথরুমে শাওয়ারের নীচে নিজেকে উন্মুক্ত করলো নিঃসন্দেহে।
অনিরুদ্ধ নিচে ড্রইংরুমে সোফায় বসেছিল।
কঙ্কনা একটা হাল্কা পিঙ্ক রঙের শাড়ি পরে খোলা চুলে সদ্যস্নাত প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো এসে দাঁড়ালো।
অনিরুদ্ধর নজর আটকে গেল যেন, মুগ্ধ নয়নে কঙ্কনার দিকে চেয়ে।
কতক্ষণ পরে হুঁশ হলো কঙ্কনার কথায়। কঙ্কনা বললো, সারারাত থাকতে হবে?
অনিরুদ্ধ চমকে উঠে বললো, হ্যাঁ—
এমন দৃঢ় ভাবে কথাটা উচ্চারণ করলো, কঙ্কনা একটু তটস্থ হয়ে ঘাবড়ে গেল।
কটাক্ষ দৃষ্টি মেলতে গিয়েও ভ্রু সোজা হয়ে গেল স্বাভাবিকভাবেই।
অনিরুদ্ধ এরপর খাবার টেবিলে এসে বসলো এবং কঙ্কনাকেও বসতে বললো।
এতক্ষণে অনিরুদ্ধর ফ্রীজ থেকে খাবার বার করে গরম করা হয়ে গেছে।
কঙ্কনা দেখলো ভাত মাছ আরো রান্না একেবারে প্লেটে সাজানো। অনিরুদ্ধ খেতে খেতে বললো,
তোমার খাওয়া হয়ে গেলে কথা হবে।
এরপর কঙ্কনার চোখ ছলছল করে উঠলো। দু ফোঁটা মুক্তোর দানা যেন নিজের অজান্তেই গাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে। তাই দেখে অনিরূদ্ধ জিজ্ঞেস করলো কি হলো,
কপট দৃষ্টিতে শিশির বিন্দু?
তোমার চোখে তো সবসময় আগুন ঝরে! কঙ্কনা যেন সত্যিই অন্য জগত থেকে অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে অনিরুদ্ধর দিকে চেয়ে কৃতজ্ঞতার সুরে বললো,
আজ পর্যন্ত এমন যত্ম করে কেউ এতো খাবার খাওয়ায়নি আপনার মতো।
দুটো ভাতের জন্য অনেক নীচে নেমেছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।
আপনাকে আমি সারারাত খুশি করে দেব যতক্ষণ আপনার ইচ্ছে। অনিরুদ্ধ চোয়াল শক্ত করে মৃদু ধমকের সুরে বললো, চুপ একদম’!
কঙ্কনা অবাক হয়ে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে দু চোখের পাতা ভিজিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
সত্যি কতদিন কাঁদেনি যত কষ্ট বুকে জমা ছিল উজার কাঁদছে।
ততক্ষণে অনিরুদ্ধ কঙ্কনাকে সোফায় এনে বসিয়ে দিয়েছে। শ্রাবণের ধারা অনবরত ঝরছে বাইরে।
কঙ্কনা একটু বিচলিত ভঙ্গিতে অনিরুদ্ধকে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করছে। কিন্ত অনিরুদ্ধর মনে একটা কাঁটা যেন বিঁধতেই থাকছে যতবার মেয়েটির চোখের দিকে তাকাচ্ছে!! অনিরুদ্ধ একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। শ্রাবণ বরষার রাত। অঝোরে বৃষ্টির ধারা। কঙ্কনা সোফায় বসে আছে চুপ করে। অনিরুদ্ধ ফিরে আসে সোফায় কঙ্কনাকে বলে, তোমাকে আজকে একটা গল্প বলবো তাই তোমাকে এনেছি। কঙ্কনার চোখে তির্যক দৃষ্টি ঘুরছে অনিরুদ্ধর দিকে। মনে মনে ভাবছে এরকম অদ্ভুত মানুষ তো কখনো দেখিনি! উনি কি দিদ্ধাগ্ৰস্থ হয়ে পড়েছেন; কঙ্কনা নিজেই গায়ের কাপড় শিথিল করে অনিরুদ্ধর কাছ ঘেঁষে এগিয়ে গেল।
অনিরুদ্ধ দুহাতে কঙ্কনার কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললো, তুমি আমার মেয়ের মতো এসব করার জন্য তোমাকে আমি ডাকিনি! শোনো, আজকে আমার জীবনের একটা অধ্যায় তোমাকে বলতে চাই।
কঙ্কনা একটু বিচলিত হয়ে সরে বসলো। অনিরুদ্ধ কোনো ভুমিকা না করেই বললো জানো কঙ্কনা, আমার এই ব্যাচেলার লাইফে একজন এসেছিল ক্ষনিকের জন্য। তখন আমি বোলপুরে একটা কাজে গিয়েছিলাম।
একটা হোটেলের রুমে কদিন ছিলাম তখনই একটি মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম অকস্মাৎ। তার ডাগর চোখে কি ছিল জানিনা শ্যামাঙ্গী চৈতালীর মধ্যে! ওর আকর্ষণীয় লাবন্য ভরা যৌবন, আর হরিণ নয়নী চঞ্চলা কলাবতী আমায় পাগল করে দিয়েছিল।
আমি ওর ওই আকর্ষণ কে উপেক্ষা করতে পারিনি। মন প্রাণ সবকিছু ওকে নিমজ্জিত করেছিলাম।
লাল মাটির গ্ৰাম্য হরিণ নয়নী যুবতী আমাকে হয়তো ভালবেসে নিজেকে উজার করে সঁপে দিয়েছিল সেদিন চৈত্রের চৈতালী রাতে। এই পর্যন্ত বলে কঙ্কনার দিকে উদাস দৃষ্টিতে দেখতে গিয়ে দেখলো, কঙ্কনার দু চোখে মুক্তোর মতো দু ফোঁটা জল চিকচিক করছে।
অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে কঙ্কনার দিকে চেয়ে কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেল। কঙ্কনা ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললো, আর কিছু বলবেন না… এরপর চৈতালীর কি হয়েছিল; এই বলে বললো বাকিটা আমার জানা আছে। অনিরুদ্ধ সোজাসুজি কঙ্কনার দিকে চেয়ে বললো, তূমি জানো মানে!
চৈতালীকে তুমি চেন?
কঙ্কনা খানিকটা তফাতে সরে বসলো। এবং অনিরুদ্ধর দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বললো, তাহলে আপনিই সেই সোন্দর বাবু আমার মায়ের! অনিরুদ্ধ অপরাধীর মতো কঙ্কনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, তুমি ঠিকই বলেছ, আমিই সেই।
কঙ্কনার কান্না জড়িত কন্ঠে বললো, আর কটা দিন আগে যদি বলতেন, হতভাগী মা-টা একটু শান্তি পেয়ে মরতে পারতো। অনিরুদ্ধ পলকহীন দৃষ্টিতে কঙ্কনাকে বললো, চৈতালি তোমার মা?
জানো, আমি তোমার মধ্যে গ্ৰাম্য সরল চৈতালীকে দেখতে পেয়েছিলাম।
তোমার চোখে মুখে আমি চৈতালিকে খুঁজেছি আমার অবচেতন মনে। এই বলে অনিরুদ্ধর অবাক দৃষ্টি কঙ্কনার দিকে অসহায় হয়ে চেয়ে আছে।
কঙ্কনা অশ্রুসিক্ত চোখে অনিরুদ্ধর দিকে চেয়ে বললো, আপনার অধ্যায় শেষ হয়েছে নিশ্চয়ই ? কিন্তু চৈতালীর তখন থেকেই জীবনের অধ্যায় শুরু হয়েছিল।
কান্না ভেজা গলায় বললো, বোকা চৈতালী ক্রমশঃ সংসার এবং সমাজের কাছে লাঞ্ছিত হতে লাগলো।
ওই সময় চরিত্রহীন এক মাতাল লম্পট চৈতালীকে বিয়ে করে, উদ্ধার করেছিল।
এবং কোলকাতায় নিয়ে এসে, এক পতিতালয় বেচে দেয়। এই বলে, আবার খিলখিল করে হেসে বললো, জানেন সোন্দর বাবু, ওখানেই আমার জন্ম হয়। এই বলে, কাঁদতে কাঁদতে বললো, মা আমাকে বলেছিল তুই পবিত্র মানুষের সন্তান। তখন থেকেই আমি সেই পবিত্র মানুষটিকে খুঁজতে শুরু করেছিলাম মনে মনে। মায়ের বিশ্বাসকে একবার চোখে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।
একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বললো, কিন্তু আমি তো পবিত্র হতে পারলাম না..
কলুষিত সমাজ আমাকে যৌবনের আগে থেকেই ছোবলাতে লাগলো। মা চেষ্টা করেছিল বাঁচাতে, কিন্তু নিরুপায়, অসহায় হয়ে অসময় বিছানায় পরে গেল। এরপর আমি মাকে নিয়ে আলাদা ওই বস্তিতে উঠে আসি। লেখাপড়া তেমন শিখতে পারিনি। অসুস্থ মায়ের জন্য বাড়িতে কাউকে ডাকতাম না। যে যেখানে যেতে বলে, চলে যাই। এই বলে, ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে।
অনিরুদ্ধ খানিক্ষণ ইতস্তত করে কঙ্কনাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে বুকের কাছে টেনে নিল। বললো, না নাহ্ তুমি তেমন মেয়ে নও। তুমি আমার মেয়ে। আমি তোমার মধ্যে আমার চৈতালীকে খুঁজে পেয়েছি। আমার অবচেতন মনে চৈতালীর সরল নিষ্পাপ চৈতালী চিরদিন রয়ে গেছে। আজ থেকে তোমাকে কোথাও যেতে হবেনা।
আজ থেকে তোমার ঠিকানা এখানে।
এই বাড়িতে, আমার মেয়ের পরিচয়। আমি তোমাকে আইনত দত্তক নেব।
কঙ্কনা আর একটা কথাও বললো না। শুধু অনিরুদ্ধর বুকের জামা চোখের জলে ভিজিয়ে দিল। বাইরে শ্রাবণের বৃষ্টি অঝোরে ঝরছে, যেন আজ পৃথিবীর কোনো এক মলিনতা ধুইয়ে দিয়ে সচ্ছতায় ভরিয়ে দেবে, এক পিতা, পুত্রির পবিত্র মিলনে।