Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অচিন্ত্য পূর্ণিমা || Syed Shamsul Haque » Page 3

অচিন্ত্য পূর্ণিমা || Syed Shamsul Haque

ডিস্পোরীটা পছন্দ হয়েছে ইদ্রিসের

ডিস্পোরীটা পছন্দ হয়েছে ইদ্রিসের। কাছারির পাশে জামরুল গাছের নিচে ছোট্ট একটা ঘর ভোলা হয়েছে উঁচু ভিটের পরে। এই ডিস্পেন্সরী। নতুন আলমারি, চেয়ার, টেবিল এসেছে। কাঁঠাল কাঠের গন্ধটা ভারী মিষ্টি। তার ওপরে রং করা হয়েছে কাঁচা সোনার।

ঘরের মাঝখানে রোগী দেখবার টেবিল। এক পাশে ডিসপেনসিং টেবিল। পরিষ্কার শাদা কাপড় বিছানো। মাঝখানে নিকেলেছ নিক্তি রাখা ওষুধ মাপবার জন্যে। পাশে এক কৌটো চুন। চুন আবার কেন? শিশিতে ওষুধ ঢেলে গায়ে চুনের দাগ দিয়ে কাঠি টেনে মাত্রাভাগ দেখানো হয়।

থরে থরে ওষুধ সাজানো আলমারিতে। আছে ডাক্তারী বইপত্র, স্টেথসকোপ, সুগার অব মিলক। আর ডিস্পেন্সরীর রেজিস্টার, রিপোর্ট বুক। ইদ্রিসের তোরঙ্গে কবে থেকে মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু আর কায়কোবাদের অমিয় ধারা ছিল। সে বই দুটোর গায়ে নতুন মলাট চড়েছে। ঠাই পেয়েছে আলমারিতে।

প্রথম দিন পাত্রমিত্র নিয়ে হাজি সাহেব এসেছিলেন ডিস্পেন্সারীতে। বসতে দেয় কোথায়? তবে ভাবনা কী? হুকুম বরদার পেছনে পেছনে চেয়ার আনছে। হেলনা বেঞ্চ আসছে আর দুজনের মাথায়।

হাজি সাহেবকে দেখেই ইদ্রিস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল।

আপনি বসুন এখানে।

আরে না, ও হলো ডাক্তারের চেয়ার। এ ধরগে তোমার কাছারি। তোমার গদিতে আমি বসতে পারি। তা আজ রোগী আমিই! নাড়িটা দেখোত ডাক্তার।

হাজি জয়েনউদ্দিন তুমি বলতে শুরু করে দিয়েছেন ইদ্রিসকে। সেটা লক্ষ্য করে খুব খুশি হতে পারল না ইদ্রিস। চেষ্টা করল মুখভাব স্বাভাবিক রাখতে। চাকরি করি বলেই একেবারে কেনা হয়ে গেছি নাকি?

ইদ্রিস বলে, নাড়ি দেখব, বুক দেখতে হলে বুক।

একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন হাজি জয়েনউদ্দিন। আচমকা আবছা হেসে বললেন, ঠিক ঠিক। পার্শ্ববর্তীকে শুনিয়ে বললেন, এই না হলে ডাক্তার? তারপর ইদ্রিসকে আবার বললেন, তুমিও তো তেমনি। ঠাট্টা করছিলাম। তাও বোঝে না। এরা ধরেছে আমাকে দিয়েই নাকি ডিস্পেন্সারীর কাজ শুরু করতে হবে। তা দ্যাখোই না নাড়িটা।

ও এই কথা। আমি ভাবলাম সত্যি কিছু হয়েছে বুঝি।

যদি চেপে ধরো, তাহলে অসুখ যে একেবারে নেই তা বলব না।

কী রকম?

পারবে তার ওষুধ দিতে?

বিবরণ বললে সাধ্যমতো চেষ্টা করব। বাকি আল্লাহর হাতে।

ঠিক বলেছ। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন হাজি জয়েনউদ্দিন। বলেন, ঠিকই বলেছ। বাকি আল্লাহর হাতে। বাকিই বা বলছ কেন, সবটাই তাঁর। সেই গল্প শোনোনি? তোমরাও শোনো হে।

পাত্রমিত্র ঘন হয়ে বসে।

হাজি সাহেব বলেন, একবার এক লোক এসেছে বড়পীর সাহেবের কাছে। সে বললে বাকিটুকু আল্লাহর হাতে তা আমাকে বুঝিয়ে দিন। বড়পীর সাহেব তখন বললেন, তোমার ডান পাটা ওঠাও তো বাপু। ওঠালো লোকটা। বড়পীর সাহেব বললেন, এবার বা পা ওঠাও। তাও হলো। লোকটা বলল, এবার? বড়পীর সাহেব তখন হেসে বললেন, এবার দুটো পাই একসঙ্গে ওঠাও দেখি। লোকটা বলল, বাহ্ তা কী করে হয়? দুপা এক সঙ্গে কেউ ওঠাতে পারে নাকি? লোকটা শুনে বেকুব। মাথা নিচু করল। হুজুর বললেন, ঐটুকু আল্লাহর হাতে।

মারহাবা, মারহাবা।

পাত্রমিত্রেরা সমস্বরে বলে উঠল। ইদ্রিস তাদের সঙ্গে ঠিক যোগ দিতে পারল না। সে নিজে আল্লাহকে বিশ্বাস করে। কোরান রসুল মানে। নামাজ পড়ে। কিন্তু তাই বলে আল্লাহর। অস্তিত্বের প্রমাণ এভাবে গ্রহণ করতে সে রাজি নয়। চমকা গল্প দিয়ে কি আল্লাহকে ব্যাখ্যা করা যায়! কিন্তু গল্পটার সঙ্গে বড়পীর সাহেবের নাম জড়িত রয়েছে বলে সে কিছু বলল না। হাজি জয়েনউদ্দিন রহস্যময়ভাবে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।

ইদ্রিস জিজ্ঞেস করল, কই রোগের কথা বললেন না?

বলব, আরেকদিন বলব। আজ নয়। বলতেও হবে না। তুমি নিজেই বুঝে নিতে পারবে। দাওয়াইপত্র অনেক করেছি। তুমি যদি একবার চেষ্টা করতে চাও, দেখতে পারো। ফল হবে আশা নেই।

হঠাৎ গা মোড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

যাক চলি। বাইরে কজন রোগী এসেছে দেখছি। কাল বিকেলে হাটে ঢোল সহরৎ করে দেয়া হয়েছিল?

পার্শ্ববর্তী একজন বলল, হ্যাঁ হুজুর হয়েছিল।

তা লোক এত কম দেখছি যে!

ইদ্রিস হেসে বলল, সে কী কথা! দেশে রোগ না থাকা তো খুশির কথা।

হে না, তুমি জানে না। এখানে ঘরে ঘরে রোগী। ডাক্তার কোন দিন ছিল না বলে চাড় বোঝে না। এছাড়া বিলেতি ওষুধ, কলকাতার ডাক্তার, ভাটির মানুষ—-ম্যালা গেরো আছে। এদের মনে একটু বিশ্বাস এনে দাও, ওষুধে একটু ফল হোক, দেখবে তোমার বারান্দা থইথই করবে রোগীতে।

হাজি সাহেব চলে গেলেন। পাত্রমিত্রের দল পেছনে গেল। রোগী দেখতে বসল ইদ্রিস। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের কথা একবার মনে করল। মনে মনে বলল, নাম যেন থাকে। আল্লাহু শাফি, আল্লাহু কাফি। রোগী হয়েছিল কুল্যে পাঁচজন। সবারই এক ব্যামো। ম্যালেরিয়া। ভারী মুশকিলে পড়ল ইদ্রিস। হোমিওপ্যাথিতে ম্যালেরিয়া চট করে সারে না। সময় লাগে। কিন্তু সময় নিলে তার বদনাম হবে। বলবে, এ কেমন ডাক্তার? ওষধ দিল, জ্বর গেল না। সে রকম জ্বর ধামাচাপা দিতে পারে কাঁচা সিঙ্কোনা, কুইনিন। মরে গেলেও সে নীতিভ্রষ্ট হতে। পারবে না; কুইনিন দিতে পারবে না।

পানিতে গুলে ওষুধ দিল সবাইকে সে। বলল, কাল আবার আসবে। আর এর পর যারাই। আসবে বলে দিও খালি শিশি ভালো করে গরম পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে যেন আনে। শিশি তো আর জমিদার সাহেব মাগনা দিবেন না।

দুপুর পর্যন্ত রোগী দেখার সময়। বিকেলে ডাক্তারকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারো। চার আনা ভিজিট। আর যাতায়াতের ব্যবস্থা তোমাদের। হাটবারে বিকেল বেলাতেও ডিস্পোরী থাকবে বিনি পয়সায় ওষুধ দেয়া হবে।

এসব নিয়মকানুন হাজি সাহেবই বেঁধে দিয়েছিলেন।

সেদিন দুপুরে ডিস্পেন্সারী বন্ধ করে কাছারিতে গেল ইদ্রিস। হাজি সাহেব দরবার নিয়ে ছিলেন তখনো। এক পাশে চুপ করে বসল ইদ্রিস। বসে বসে বিচার–আচার দেখতে লাগল। মহাল থেকে পাইক প্রজা দর্শনপ্রার্থীরা এসেছে। তাদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। সে আলাপের কিছুই সে মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না। সব আবেদন নিবেদনের পেছনে পূর্ব ইতিহাস রয়েছে, সেটা জানা না থাকলে উটকো শুনে কিছু ঠাহর করা মুশকিল।

একে একে বিদায় নিল সবাই। বেলা তখন মাথার পর থেকে চলতে শুরু করেছে। একটু পরেই জোহরের আজান পড়বে।

কী ডাক্তার, কথা ছিল কিছু?

জি।

আজ যা দেখলাম সবই ম্যালেরিয়ার রোগী।

হুঁ।

হোমিওপ্যাথি তো সঙ্গে সঙ্গে জ্বর কমায় না। সময় লাগে। রোগীরা যদি তা না বুঝতে চায়? একদিনে ফল না পেয়ে আর ওষুধ নিতে না আসে?

কোনো উপায় নেই?

আছে। কুইনিন দিতে হয়।

দাও কুইনিন। মানা করছে কে? না থাকলে আনিয়ে নাও!

জি, কুইনিন তো দেয়া যায় না।

কেন?

হোমিওপ্যাথি শাস্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা সেটা।

চুপ করে গেলেন হাজি সাহেব। ভ্রু গভীরভাবে কুঞ্চিত হলো তাঁর।

চোখ তীক্ষ্ণ করে শুধালেন, কী রকম?

সে এক কথায় বলা যাবে না। পুরো অর্গানস পড়তে হবে।

অর্গানস আবার কী?

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সংজ্ঞা পদ্ধতি তাতে লেখা আছে।

একটু রুক্ষ মেজাজেই হাজি সাহেব বললে, সে বই পড়ে আমি কী করব? আর তুমিও বেশ কথা বলছ দেখি। রোগী মারা যাচ্ছে, তবু যে ওষুধে কাজ হয় সে ওষুধ দেবে না। থাকবে তোমার অর্গানস নিয়ে?

জি, কুইনিনে কাজ হয় ওপরে ওপরে। ভেতরে রোগ যেমনকার তেমনি থাকে। হোমিওপ্যাথিতে সময় লাগলেও সমূলে রোগ দূর হয়।

তা হোক। এরা বহুদিন ভুগছে। তুমি কুইনিন দাও।

বললাম তো, সেটা আমি পারি না।

তাহলে এসেছ কেন?

যদি আপনি নিজে একটু বলে কয়ে দিতেন! এ চিকিৎসায় ধৈর্য ধরতে হয়।

তুমি বলতে পারো না?

আমি বলেছি, কিন্তু ওরা শুনবে বলে মনে হলো না। কাল একজনও ফেরৎ আসবে বলে ভরসা পাচ্ছি না।

বেশ তো। কুইনিনই দাও না। ডিস্পেশারী খুলে যদি কারো উপকারই না হলো, তাহলে আর খোলা কেন? যাও, যা ভালো বোঝো করো গে। মনে রেখো, মরহুম আব্বাজানের নামে এ ডিস্পেন্সরী দিয়েছি। একেকটা রোগী ভালো হলে দোয়া পৌঁছুবে তার রুহে। বেলা অনেক হয়েছে, গোসল খাওয়ায় অনিয়ম করে কাজ করবে সেটা আমার পছন্দ নয়।

ভীষণ ক্ষুব্ধ মন নিয়ে ইদ্রিস তার ঘরে ফিরে এলো।

ঘর বলতে, কাছারির লাগোয়া মসজিদের পেছনে মাঠ, সেই মাঠ পারে অতিথ–পথিকের জন্যে চারচালা টিনের ঘর। মাঝখানে বেড়ার পার্টিশন করা। একটা কামরা ইদ্রিস ব্যবহার করছে।

বিছানায় এসে চিৎ হয়ে শুয়ে রইলো সে। কিছুতেই সে বুঝতে পারছে না, হাজি সাহেবের সঙ্গে সেই তিস্তা থেকে কথায় কথায় তার বিরোধ হচ্ছে কেন? তার নিজের দোষ? সে কি একগুয়ে? তাও তো নয়। সে যা ভালো মনে করেছে, যুক্তি দিয়ে যা সঙ্গত মনে করেছে, তাই বলেছে সব সময়। তাতে যদি কেউ ক্ষুণ্ণ হন, রুষ্ট হন, তাহলে কী করতে পারে?

অনেকক্ষণ কড়িকাঠের দিকে গুম হয়ে তাকিয়ে রইল ইদ্রিস ডাক্তার। অন্দরমহল থেকে চাকর এসে তাড়া দিল গোসলের জন্যে। ইদ্রিস তাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিল। বলল, শরীর ভালো নেই। খাবো না এবেলা।

না, কাজটা বোধহয় ভালো হচ্ছে না। নতুন জায়গায় নতুন কাজে এসেই মনিবের সঙ্গে বিরোধ হলে লোকে তারই নিন্দে করবে। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব শুনলেই বা কী মনে করবেন? বড় মুখ করে তাকে পাঠিয়েছেন তিনি। আজ রাতেই প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে একটা চিঠি দেবে সে। হ্যাঁ তাই ভালো। তার কাছে পরামর্শ চাইবে ইদ্রিস। তিনি যদি কুইনিন ব্যবস্থা করতে বলেন তো হোক শাস্ত্র বিরুদ্ধ ওস্তাদের কথা শিরোধার্য করে সেকুইনিনই দেবে।

আর মাকেও চিঠি দেয়া হয় নি। তাকেও আজ লিখবে ইদ্রিস। বরং এখনই বসা যাক। সকালের রিপোর্ট লেখাও পড়ে আছে। ও বেলা যদি কেউ কল দিয়ে বসে তো আর সময়ই পাওয়া যাবে না।

এমন সময় জোহরের আজান পড়ল। দুপুরের তপ্ত মাঠ পেরিয়ে ভেসে আসা সেই আজানের ধ্বনিটাকে মনে হলো মড়ক লাগা গ্রামে কেউ আল্লাহর করুণা ভিক্ষা করে বুকফাটা আর্তনাদ করছে। ধড়াস্ করে উঠলো ইদ্রিসের বুকের ভেতরটা। তওবা, তওবা। এ সব কী ভাবছে সে? অমঙ্গল ভাবতে নেই। অমঙ্গল ভাবলে নিজের অমঙ্গল হয়।

গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে পুকুরে নাইতে গেল ইদ্রিস। ফিরতি পথে নামাজটাও সেরে নিল সে। জামাত তখন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কাছারির কর্মচারীরাই জামাতের সামিল। নোয়াখালীর এক গাঢ় সুরমা পড়া মৌলবি ইমামতি করেন মসজিদে। তিনি ততক্ষণে হাত বেধে ফেলেছেন। ইদ্রিস প্রায় দৌড়ে এসে জামাতে সামিল হয়েছিল।

নামাজ শেষে মৌলবি সাহেব বললেন, আঁরে দয়াই দিবেন আপনে।

কাল আসবেন ডিস্পেন্সারীতে। সকালে।

আঁর লাইন। আঁর বিবি সাব হায়েজ লই বহুৎ তকলিফ পায় তারি।

খ্যা খ্যা করে মৌলবি সাহেব হাসলেন খানিক। আরো কী বলবার জন্যে ঘনিষ্ঠ হতেই ইদ্রিস বলল, আচ্ছা কাল শুনব।

নাহ, আজ সত্যি সত্যি মেজাজটা তার ভালো নেই। নইলে যে যা বলছে তা–ই অসহ্য লাগছে। কেন? হতেও তো পারে, মৌলবি সাহেব তার স্ত্রীর অসুখের জন্যে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ইদ্রিসের যেন মনে হলো, অসুখের কথাটা গৌণ, আসলে লোকটা রোগ বর্ণনার ছলে নিজের ক্ষুধার্ত কামচেতনায় সুড়সুড়ি দিতে চাইছে।

ফিরে এসে দেখে, অন্দর মহলের চাকরটা কাসার ঢাকা জামবাটি নিয়ে তার অপেক্ষা করছে। এ আবার কী?

তোমরা খাবার নন শুনি বুবুজান মোর হাতোৎ দুধ পাঠেয়া দিল। জামবাটিটা মেলে ধরল বছির।

ন্যান, টপাটপ পান করি ন্যান।

ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল ইদ্রিসের। যেন এক ঝলক আনন্দ বহুদূর থেকে এসেই ঝাপটা দিয়ে চলে গেল।

বাটিটা হাতে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, বুবজান কেরে বছির?

তাও জানেন না?

বল্ না শুনি?

হুজুরের বড় বইনের মাইয়া। তাই মরি যাবার পর একে যে মাইয়া তা আনি আইখছেন হুজুর।

ও।

দুষ্কের কথা কী কমো তোমরার আগেৎ। হুজুরের ছাওয়া–পোয়া নাই। ইয়া আপন হতে আপন মাইয়া বুলি পালেন ওমরায়।

দুদিনেই এদেশের কথা বেশ শিখে ফেলেছে ইদ্রিস। সে যে আজ দুপুরে খাবে না, এই কথাটা নিশ্চয়ই হাজি সাহেবের ভাগনির কানে গেছে। বড়লোকের হঠাৎ এই প্রীতিটা তাকে কৌতূহলি করে তুলল। এদের ভাষাতেই সে কথা বলতে চেষ্টা করল।

ডাঙর হইছে তোর বুবু?

হয় নাই বলে? কন্ কী তোমরা? ছাওয়া–পোয়ার জননী হয়্যা যাইত এতখনে।

কেনে, বিয়াও হয় নাই কেনে?

না কন সে কথা। বেচেয়া খাইছলো তা তার বাপোমায়। সে ঘর ভাঙ্গি গেইছে। বজ্জাতের ঝাড় আছিল সে মানুষকোনা।

তাই নাকি?

মুই অ্যালায় যাও।

বছির যাবার জন্যে পা বাড়ায়। ইদ্রিস পিছু ডাকে, শোন শোন। তুই আবার তাকে বলেছিস কেন, কিছু খাবো না।

পুছ কইরেলে যে।

কাঁই?

এদের ভাষা অজান্তেই বেরিয়ে পড়ে ইদ্রিসের আবার।

কাঁই পুছ কইরলে রে!

কাঁই আবার? কাঁই দুধ পাঠাইলে। নিদ্রা যান তোমরা। মোর মেলা কাম পড়ি আছে। বছির চলে গেল।

চৌকির ওপর চুপ করে বসে রইলো সে। অবাক হয়ে দেখল কুইনিন নিয়ে মনের মধ্যে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল তার লেশমাত্র আর নেই। এ রকম কেন হলো, বুঝতে পারল না সে। দুপুরে খাবে না বলেছিল তখন সে রাগ করে। এখন এক বাটি দুধ খেয়ে খিদেটা যেন আরো চাগিয়ে উঠল।

হাসল ইদ্রিস। রাগ করে ভারী লাভ হলো তো?

আরে, রাগ সে করেছিলই বা কার ওপর?

এখানে সে চাকরি করতে এসেছে। কাজ নিয়ে কি রাগ করতে আছে? না সে রাগ চাকরি যে করে তার পোষায়?

হঠাৎ মনে পড়ল হাজি সাহেব তার কী এক অসুখের কথা একসময়ে বলবেন বলেছিলেন। বছিরের কথায় চোখ খুলে দিয়ে গেল তার। ছেলেপুলে হয় না—- এই অসুখ। সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিলো হয়ত হাজি সাহেব।

কিন্তু সে তো এরকম কেস এর আগে কখনো হাতে পায় নি। তার বইতেও কিছু লেখা নেই। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে লিখলে হয়। হাজি সাহেবের জন্যে মনটা তার সহানুভূতিতে ভরে। উঠল। ইদ্রিস যখন বিয়ে করবে না বলে গো ধরেছিল তখন মা প্রায়ই বোঝাতেন, দ্যাখরে, ছাওয়াল না থাইকলে ঘরের আন্ধার যায় না।

ইদ্রিস তখনি কাগজ টেনে চার ভাঁজ করে ছিঁড়ে নিল। তারপর আসবার সময় শখ করে কেনা রাজা কলমটা বের করে চিঠি লিখতে বসল প্রিন্সিপ্যাল সাহেবকে।

কুইনিন নিয়ে যে বিরোধটা হয়েছিল তার আভাস দেবার ইচ্ছে ছিল চিঠিতে। এখন ভাবল, সে কথা থাক। শুধু জিগ্যেস করলেই হবে, কুইনিন তিনি অনুমোদন করেন কিনা। আর জিগ্যেস করবে—-নিঃসন্তান হাজি সাহেবের রৌদ্রতপ্ত চেহারাটা তার সামনে ভেসে উঠল।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress