Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অগ্নিবান – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 4

অগ্নিবান – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদের জন্য রওনা করিয়া দিয়া‌, দেবকুমারবাবুকে ‘তার’ পাঠাইয়া এই শোচনীয় ব্যাপারের যথাসম্ভব সুব্যবস্থা করিতে বেলা দুটা বাজিয়া গেল। বাসায় ফিরিয়া আমরা যখন আহারাদি সম্পন্ন করিয়া উঠিলাম‌, তখন শীতের বেলা পড়িয়া আসিতেছে।

ব্যোমকেশ বিমনা ও নীরব হইয়া রহিল। আমিও মনের মধ্যে অনুতাপের মত একটা অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করিতে লাগিলাম। মস্তিষ্কের যে খোরাকের জন্য আমরা ব্যাকুল হইয়া উঠিয়ছিলাম‌, তাহা এমন নির্মমভাবে দেখা দিবে‌, কে ভাবিয়াছিল? বেচারা হাবুলের কথা বার বার মনে পড়িয়া মনটা ব্যথা-পীড়িত হইয়া উঠিতে লাগিল।

ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া গেল‌, ব্যোমকেশ দৃষ্টিহীন চক্ষে জানালার বাহিরে তাকাইয়া নীরব হইয়াই রহিল। তখন আমি জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘আত্মহত্যা তাহলে? কি বল?’

ব্যোমকেশ চমকিয়া উঠিল‌, ‘অ্যাঁ! ও—রেখার কথা বলছ? তোমার কি মনে হয়?’

যদিও মন সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত ছিল না‌, তবু বলিলাম‌, ‘আত্মহত্যা ছাড়া আর কি হতে পারে? চিঠি থেকে তো ওর অভিপ্ৰায় বেশ বোঝাই যাচ্ছে।’

‘তা যাচ্ছে। কি উপায়ে আত্মহত্যা করেছে‌, তুমি মনে করা?’

‘বিষ খেয়ে। সে কথাও তো চিঠিতে–’

‘আছে। কিন্তু বিষ পাবার আগেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা কি করে হতে পারে‌, আমি ভেবে পাচ্ছি না। চিঠিতে রেখা বিষ চেয়েছিল‌, কিন্তু চিঠি যখন যথাস্থানে পৌঁছায়নি লেখিকার বালিশের তলাতেই থেকে গিয়েছিল‌, তখন বিষ এল কোত্থেকে?’

আমি বলিলাম‌, ‘চিঠিতে আছে‌, সে বিষ না পেলে অন্য যে কোনও উপায়ে–’

‘কিন্তু চিঠি পাঠাবার আগেই সে অন্য উপায় অবলম্বন করবে‌, এটা তুমি সম্ভব মনে করা?’

আমি নিরুত্তর হইলাম।

কিয়ৎকাল পরে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তা ছাড়া উনুন জ্বালতে জ্বালতে কেউ আত্মহত্যা করে না। রেখার মৃত্যু এসেছিল। অকস্মাৎ-নির্মেঘ আকাশ থেকে বিদ্যুতের মত। এত ক্ষিপ্ত এমন অমোঘ এই মৃত্যুবাণ যে‌, সে একটু নড়বার অবকাশ পায়নি‌, দেশলাইয়ের কাঠি হাতেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

‘কি করে এমন মৃত্যু সম্ভব হল?’

‘সেইটেই বুঝতে পারছি না। জানি তো বিষের মধ্যে এক হাইড্রোসায়েনিক অ্যাসিড ছাড়া এত ভয়ঙ্কর শক্তি আর কারুর নেই। কিন্তু—’ ব্যোমকেশের অসমাপ্ত কথা চিন্তার মধ্যে নির্বাণ লাভ করিল।

আমি একটু সঙ্কুচিতভাবে বলিলাম‌, ‘আমি ডাক্তারি সম্বন্ধে কিছু জানি না‌, কিন্তু হঠাৎ হার্টফেল করে মৃত্যু সম্ভব নয় কি?’

ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল‌, ‘ঐ সম্ভাবনাটাই দেখেছি ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে। রেখা মাথাধরার জন্যে অ্যাসপিরিন খেত‌, হয়তো ভেতরে ভেতরে হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়েছিল-কিন্তু না‌, কোথায় যেন বেধে যাচ্ছে‌, হার্টফেলের সম্ভাবনাটা নিশ্চিতভাবে গ্ৰহণ করতে পারছি না‌, যদিও যুক্তি-প্রমাণ সব ঐ দিকেই নির্দেশ করছে। ‘ ব্যোমকেশ অপ্রতিভভাবে হাসিল—’বুদ্ধির সঙ্গে মনের আপোস করতে পারছি না; কেবলই মনে হচ্ছে‌, মৃত্যুটা সহজ নয়‌, সাধারণ নয়‌, কোথায় এর একটা মস্ত গলদ আছে। কিন্তু যাক‌, এখন মিথ্যে মাথা গরম করে লাভ নেই। কাল ডাক্তারের রিপোর্ট পেলেই সব বোঝা যাবে।’

ঘর অন্ধকার হইয়া গিয়াছিল‌, ব্যোমকেশ উঠিয়া আলো জ্বলিল। এই সময় বহিদ্বারে আস্তে আস্তে টোকা মারার শব্দ হইল। সিঁড়িতে পদশব্দ শোনা যায় নাই‌, ব্যোমকেশ বিস্মিতভাবে ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, ‘কে? ভেতরে এস!’

একটি অপরিচিত যুবক নিঃশব্দে প্রবেশ করিল। স্বাস্থ্যপূর্ণ বলিষ্ঠ দেহ‌, সুশ্ৰী চেহারা–কিন্তু শুষ্ক বিবৰ্ণ মুখে ট্র্যাজেডির ছায়া পড়িয়াছে। পায়ে রবার-সোল জুতা ছিল বলিয়া তাহার পদধ্বনি শুনিতে পাই নাই। সে কয়েক পা অগ্রসর হইয়া অনিশ্চিতভাবে দাঁড়াইয়া বলিল‌, ‘আমার নাম মন্মথনাথ রুদ্র—’

ব্যোমকেশ ক্ষিপ্ৰদৃষ্টিতে তাহার। আপাদমস্তক দেখিয়া লইয়া বলিল‌, ‘আপনিই নন্তুবাবু? আসুন।’—বলিয়া একটা চেয়ার দেখাইয়া দিল।

চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া যুবক থামিয়া থামিয়া বলিল‌, ‘আপনি আমাকে চেনেন?’

ব্যোমকেশ টেবিলের সম্মুখে বসিয়া বলিল‌, ‘সম্প্রতি আপনার নাম জানবার সুযোগ হয়েছে। আপনি রেখার মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু জানতে চান?’

যুবকের কণ্ঠস্বর ঈষৎ কাঁপিয়া গেল‌, সে বলিল‌, ‘হ্যাঁ। কি করে তার মৃত্যু হল‌, ব্যোমকেশবাবু?’

‘তা এখনও জানা যায়নি।’

অস্বাভাবিক উজ্জ্বল চক্ষু ব্যোমকেশের মুখের উপর রাখিয়া মন্মথ বলিল‌, ‘আপনার কি সন্দেহ সে আত্মহত্যা করেছে?’

‘সম্ভব নয়।‘

‘তবে কি কেউ তাকে–’

‘এখনও জোর করে কিছু বলা যায় না।’

দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া মন্মথ কিছুক্ষণ বসিয়া রহিল‌, তারপর মুখ তুলিয়া অস্পষ্টস্বরে বলিল‌, ‘আপনারা হয়তো শুনেছেন‌, রেখার সঙ্গে আমার—‘

‘শুনেছি।’

মন্মথ এতক্ষণ জোর করিয়া সংযম রক্ষা করিতেছিল‌, এবার ভাঙিয়া পড়িল‌, অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলিতে লাগিল‌, ‘ছেলেবেলা থেকে ভালবাসতুম; যখন রেখার ছ’বছর বয়স‌, আমি ওদের বাড়িতে খেলা করতে যেতুম‌, তখন থেকে। তারপর যখন বিয়ের সম্বন্ধ হল‌, তখন বাবা এমন এক শর্ত দিলেন যে‌, বিয়ে ভেঙে গেল। তবু আমি ঠিক করেছিলুম‌, বাবার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করব। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়ে গেল। বাবা বললেন বাড়ি থেকে দূর করে দেবেন। তবু আমি—‘

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘বাবার সঙ্গে আপনার কখন ঝগড়া হয়েছিল?’

‘কাল দুপুরবেলা। আমি বলেছিলুম‌, রেখাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না। তখন কে জানত যে রেখা—কিন্তু কেন এমন হল‌, ব্যোমকেশবাবু? রেখাকে প্ৰাণে মেরে কার কি লাভ হল?’

ব্যোমকেশ একটা পেন্সিল লইয়া টেবিলের উপর হিজিবিজি কাটিতেছিল‌, মুখ না তুলিয়া বলিল‌, ‘আপনার বাবার কিছু লাভ হতে পারে।’

মন্মথ চমকিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল‌, ‘বাবা! না না–এ আপনি কি বলছেন? বাবা—‘

ত্ৰাস-বিস্ফারিত নেত্ৰে শূন্যের পানে কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিয়া‌, মন্মথ আর কোনও কথা না বলিয়া স্বলিত পদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

ব্যোমকেশের দিকে ফিরিয়া দেখিলাম‌, সে গাঢ় মনঃসংযোগে টেবিলের উপর হিজিবিজি কাটিতেছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress