রান্নাঘর হইতে বাহিরে আসিয়া
রান্নাঘর হইতে বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘পুলিশে খবর পাঠানোই উচিত, নইলে আরও অনেক হাঙ্গামা হতে পারে। আমাদের থানার দারোগা বীরেনবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ আছে, আমি তাঁকে খবর দিচ্ছি।’
এক টুকরা কাগজে তাড়াতাড়ি কয়েক ছত্র লিখিয়া ব্যোমকেশ চাকরের হাতে দিয়া থানায় পাঠাইয়া দিল। তারপর বলিল, ‘মৃতদেহ এখন নাড়াচাড়া করে কাজ নেই, পুলিস এসে যা হয় করবে।’ দরজায় শিকল তুলিয়া দিয়া কহিল, ‘হাবুল, একবার রেখার ঘরটা দেখতে গেলে ভাল হত।’
ভারী গলায় ‘আসুন বলিয়া হাবুল আমাদিগকে উপরে লইয়া চলিল। প্রথম খানিকটা কান্নাকাটি করিবার পর সে কেমন যেন আচ্ছন্নের মত হইয়া পড়িয়ছিল; যে যাহা বলিতেছিল, কলের পুতুলের মত তাঁহাই পালন করিতেছিল।
দ্বিতলে গোটা তিনেক ঘর, তাহার সর্বশেষেরটি রেখার; বাকী দুইটি বোধ করি দেবকুমারবাবু ও তাঁহার গৃহিণীর শয়নকক্ষ। রেখার ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, ঘরটি আয়তনে ক্ষুদ্র হইলেও পরিপাটীভাবে গোছানো। আসবাব বেশি নাই, যে কয়টি আছে, বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এক ধারে একখানি ছোট খাটের উপর বিছানা; অপর দিকে জানালার ধারে লিখিবার টেবিল। পাশে ক্ষুদ্র সেলফে দুই সারি বাঙ্গালা বই সাজানো। দেয়ালে ব্র্যাকেটের উপর একটা আয়না, তাহার পদমূলে চিরুণী, চুলের ফিতা, কাঁটা ইত্যাদি রহিয়াছে। ঘরটির সর্বত্র গৃহকর্মে সুনিপুণা ও শিক্ষিতা মেয়ের হাতের চিহ্ন যেন আঁকা রহিয়াছে।
ব্যোমকেশ ঘরের এটা-ওটা নাড়িয়া একবার চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইল, চুলের ফিতা ও কাঁটা লইয়া পরীক্ষা করিল; তারপর জানালার ধারে গিয়া দাঁড়াইল। জানালাটা ঠিক গলির উপরেই; গলির অপর দিকে একটু পাশে ডাক্তার রুদ্রের প্রকাণ্ড বাড়ি ও ডাক্তারখানা। বাড়ির খোলা ছাদ জানালা দিয়া স্পষ্ট দেখা যায়। ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ বাহিরের দিকে তাকাইয়া রহিল; তারপর ফিরিয়া টেবিলের দেরাজ ধরিয়া টানিল।
দেরাজে চাবি ছিল না, টান দিতেই খুলিয়া গেল। দেখিলাম, তাহাতে বিশেষ কিছু নাই; দু’ একটা খাতা, চিঠি লেখার প্যাড, গন্ধদ্রব্যের শিশি, ছুচ-সূতা ইত্যাদি রহিয়াছে। একটা শিশি তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ দেখিল, ভিতরে কয়েকটা সাদা ট্যাবলয়েড রহিয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘অ্যাসপিরিন। রেখা কি অ্যাসপিরিন খেত?
হাবুল বলিল, ‘হ্যাঁ-মাঝে মাঝে তার মাথা ধরত—’
সম্মুখে আসিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইল। বিছানায় শয়নের চিহ্ন বিদ্যমান, লেপটা এলোমেলোভাবে পায়ের দিকে পড়িয়া আছে, মাথার বালিশ মাথার চাপের দাগ। কিছুক্ষণের জন্য শ্মশান-বৈরাগ্যের মত একটা ভাব মনকে বিষগ্ন করিয়া দিল-এই তো মানুষের জীবন-যাহার শয়নের দাগ এখনও মুখ্য ভূমিলাইয়া যায় নাই, সে প্রভাতে উঠিয়াই কোন অনন্তের পথে যাত্রা করিয়াছে তাহার ঠিকানা নাই।
ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে মাথার বালিশটা তুলিল; এক খণ্ড ফিকা সবুজ রঙের কাগজ বালিশের তলায় চাপা ছিল, বালিশ সরাইতেই সেটা প্ৰকাশ হইয়া পড়িল। ব্যোমকেশ সচকিতে কাগজখানা তুলিয়া লইয়া উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিল, ভাঁজকরা চিঠির কাগজ। সে একবার একটু ইতস্তত করিল, তারপর চিঠির ভাঁজ খুলিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল।
আমিও গলা বাড়াইয়া চিঠিখানি পড়িলাম। মেয়েলী ছাঁদের অক্ষরে তাহাতে লেখা ছিল—
নস্তুদা,
আমাদের বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে গেল। তোমার বাবা দশ হাজার টাকা চান, অত টকা বাবা দিতে পারবেন না।
আর কাউকে আমি বিয়ে করতে পারব না, এ বোধ হয় তুমি জানো। কিন্তু এ বাড়িতে থাকাও আর অসহ্য হয়ে উঠেছে। আমাকে একটু বিষ দিতে পার? তোমাদের ডাক্তারখানায় তো অনেক রকম বিষ পাওয়া যায়। দিও; যদি না দাও, অন্য যে-কোনও উপায়ে আমি মরব। তুমি তো জানো, আমার কথার নড়াচড় হয় না। ইতি–
তোমার রেখা।
চিঠিখানা পড়িয়ে ব্যোমকেশ নীরবে হাবুলের হাত দিল। হাবুল পড়িয়া আবার ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল, অশ্রু উদ্গলিত কণ্ঠে বলিল, ‘আমি জানতুম এই হবে, রেখা আত্মহত্যা করবে—’
‘নস্তু কে?’
‘নস্তুদা ডাক্তার রুদ্র’র ছেলে। রেখার সঙ্গে ওর বিয়ের সম্বন্ধও হয়েছিল। নস্তুদা বড় ভাল, কিন্তু ঐ চামারটা দশ হাজার টাকা চেয়ে বাবাকে রাগিয়ে দিলে—’
ব্যোমকেশ নিজের মুখের উপর দিয়া একবার হাত চালাইয়া বলিল, ‘কিন্তু—; যাক।‘ তারপর হাবুলের হাত ধরিয়া বিছানায় বসাইয়া স্নিগ্ধস্বরে তাহাকে সান্ত্বনা দিতে লাগিল। হাবুল রুদ্ধস্বরে বলিল, ‘ব্যোমকেশদা, নিজের বলতে আমার ঐ বোনটি ছাড়া আর কেউ ছিল না। মা নেই–বাবাও আমাদের কথা ভাববার সময় পান না–বলিয়া সে মুখে কাপড় দিয়া ফুঁপাইতে লাগিল।
যা হোক, ব্যোমকেশের স্নিগ্ধ সান্ত্বনাবাক্যে কিছুক্ষণ পরে সে অনেকটা শান্ত হইল। তখন ব্যোমকেশ বলিল, ‘চল, এখনই পুলিস আসবে। তার আগে তোমার মাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে।’
হাবুলের বিমাতা নিজের ঘরে ছিলেন। হাবুল গিয়া ব্যোমকেশের আবেদন জানাইল, তিনি আড়ঘোমটা টানিয়া দ্বারের পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন। ইতিপূর্বে তাঁহাকে এক নজর মাত্র দেখিয়াছিলাম, এখন আরও ভাল করিয়া দেখিলাম।
তাঁহার বয়স বোধ হয় সাতাশ-আটাশ বছর; রোগা লম্বা ধরনের চেহারা, রং বেশ ফস, মুখের গড়নও সুন্দর। কিন্তু তবু তাঁহাকে দেখিয়া সুন্দরী বলা তো দূরের কথা, চলনসই বলিতেও দ্বিধা হয়। চোখের দৃষ্টিতে একটা স্থায়ী প্রখরতা ভুযুগলের মধ্যে দুইটি ছেদরেখা টানিয়া দিয়াছে; পাৎলা সুগঠিত ঠোঁট এমনভাবে ঈষৎ বাঁকা হইয়া আছে, যেন সর্বদাই অন্যের দোষ-ত্রুটি দেখিয়া শ্লেষ করিতেছে। তাঁহার অসন্তোষ-চিহ্নিত মুখ দেখিয়া আমার মনে হইল, বিবাহের পর হইতে ইনি এক দিনের জন্যও সুখী হন নাই। মানসিক উদারতার অভাবে সপত্নী-সন্তানদের কখনও মেহের দৃষ্টিতে দেখেন নাই, নিজেরও সন্তান হয় নাই; তাই তাঁহার স্নেহহীন চিত্ত মরুভূমির মত উষর ও শুষ্ক রহিয়া গিয়াছে।
আর একটা জিনিস লক্ষ্য করিলাম–তাঁহার বোধহয় শুচিবাই আছে। তিনি যেরূপ ভঙ্গীতে দ্বারের পাশে আসিয়া দাঁড়াইলেন, তাহাতে মনে হইল, তিনি নিজেকে ও নিজের ঘরটিকে সর্বপ্রকার অশুদ্ধি হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেছেন। পাছে আমরা তাঁহার ঘরে পদাৰ্পণ করিয়া ঘরের নিষ্কলুষ পবিত্রতা নষ্ট করিয়া দিই, তিনি দ্বার আগুলিয়া দাঁড়াইয়াছেন।
আমরা অবশ্য ঘরে প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিলাম না, বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিলাম।
ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘আজ সকালে রেখার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?’
প্রত্যুত্তরে মহিলাটি একগঙ্গা কথা বলিয়া গেলেন। দেখিলাম, অন্যান্য নারীসুলভ সদগুণের মধ্যে বাচালতাও বাদ যায় নাই–একবার কথা কহিবার অবকাশ পাইলে আর থামিতে পারেন না। ব্যোমকেশের স্বল্পাক্ষর প্রশ্নের উত্তরে তিনি তাঁহার মনের ও সংসারের অধিকাংশ কথাই বলিয়া ফেলিলেন। আজ সকালে ঝি আসে নাই দেখিয়া তিনি রেখাকে রান্নাঘর নিকাইয়া উনানে আগুন দিতে বলিয়াছিলেন। অবশ্য সপত্নী-সস্তানদের তিনি কখনও আঙুল নাড়িয়াও সংসারের কোনও কাজ করিতে বলেন না-নিজের গতির যতদিন আছে, নিজেই সব করেন। কিন্তু তবু সংসারের উন্নকুটি-চৌষট্টি কাজ তো আর একা মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়, তাই তিনি রেখাকে উনান ধরাইতে বলিয়া স্বয়ং নিজের শয়নকক্ষের জঞ্জাল মুক্ত করিয়া স্নান করিতে গিয়াছিলেন। স্নান সারিয়া উপরে চলিয়া আসিয়াছিলেন, রান্নাঘরে কি হইতেছে না হইতেছে, দেখেন নাই। তারপর কাপড় ছাড়িয়া চুল মুছিয়া দশবার ইষ্ট-মন্ত্র জপ করিয়া নীচে গিয়া দেখেন—ঐ কাণ্ড। সপত্নী-সন্তানদের কোনও কথায় তিনি থাকেন না, অথচ এমনই তাঁহার দুৰ্দৈব যে, যত ঝঞ্ঝাট তাঁহাকেই পোহাইতে হয়। এখন যে ব্যাপার ঘটিয়াছে, তাহাতে সকলে হয়তো তাঁহাকেই দৃষিবে, বিশেষত কতা ফিরিয়া আসিয়া যে কি মহামারী কাণ্ড বাধাইবেন, তাহা কল্পনা করাও দুষ্কর। একে তো। তিনি কর্তার চক্ষুঃশূল, তিনি মরিলেই কর্তা বাঁচেন।
বাক্যস্রোত কিঞ্চিৎ প্রশমিত হইলে ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘আজ সকালে আপনি রেখাকে কি কোনও রূঢ় কথা বলেছিলেন?’
এবার মহিলাটি একবারে ঝাঁকিয়া উঠিলেন, ‘রূঢ় কথা আমার মুখ দিয়ে বেরোয় না তেমন ভদ্রলোকের মেয়ে আমি নই। এ বাড়িতে ঢুকে অবধি সতীন-পো সতীন-ঝি নিয়ে ঘর করছি, কিন্তু কেউ বলুক দেখি যে, একটা কড়া কথা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়েছে। তবে আজ সকালে রেখাকে উনুন ধরাতে পাঠালুম, সে রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে বললে, ‘দেশলাই খুঁজে পাচ্ছি। না।’-বলে ঘরে ঢুকে ব্র্যাকেটের উপর থেকে দেশলাই নিলে। আমি তখন মেঝে মুছছিলুম, বললুম, ‘বাসি কাপড় ঘরে ঢুকলে? এতবড় মেয়ে হয়েছ, এটুকু হুঁস নেই? দেশলাইয়ের দরকার ছিল, দোকান থেকে একটা আনিয়ে নিলেই পারতে।’ এইটুকু বলেছি, এ ছাড়া আর একটি কথার আমার মুখ দিয়ে বেরোয়নি। এতে যদি অপরাধ হয়ে থাকে তো ঘাট মানছি।’
ব্যোমকেশ শাস্তভাবে বলিল, ‘অপরাধের কথা নয়; কিন্তু দেশলাই নিতে রেখা আপনার ঘরে এল কেন? আপনার ঘরেই কি দেশলাই থাকে?’
গৃহিণী বলিলেন, ‘হ্যাঁ। রাত্তিরে আমি অন্ধকারে ঘুমতে পারি না, তেলের ল্যাম্প জেলে শুই–তাই ঘরে দেশলাই রাখতে হয়। ঐ ব্র্যাকেটের উপর ল্যাম্প আর দেশলাই থাকে। সবাই জানে, রেখাও জানত।’
ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া দেখিলাম, খাটের শিয়রের দিকে দেয়ালে একটি ক্ষুদ্র কাঠের ব্র্যাকেট, তাহার উপর ছোট একটি ল্যাম্প রহিয়াছে। ঘরের অন্যান্য অংশও এই সুযোগে দেখিয়া লইলাম। পরিচ্ছন্নতার আতিশয্যে ঘরের আসবাবপত্ৰ যেন আড়ষ্ট হইয়া আছে। এমন কি দেয়ালে লম্বিত মা কালীর ছবিখানিও যেন ঘরের শুচিন্তা-ভঙ্গের ভয়ে সন্ত্রস্তভাবে জিভ বাহির করিয়া আছেন।
চিন্তাকুঞ্চিত ললাটে ব্যোমকেশ বলিল, ‘ও—তাহলে এই সময় রেখাকে আপনি শেষ দেখেন? তারপর আর তাকে জীবিত দেখেননি?’
‘না’–বলিয়া গৃহিণী বোধ করি আবার একপ্রস্থ বক্তৃতা শুরু করিতে যাইতেছিলেন, এমন সময় নীচে হইতে চাকর জানাইল যে, দারোগাবাবু আসিয়াছেন।
আমরা নীচে নামিয়া গেলাম।
দারোগা বীরেনবাবুর সহিত ব্যোমকেশের ঘনিষ্ঠতা ছিল, দু’জনেই দুজনের কদর বুঝিতেন। বীরেনবাবু মধ্যবয়স্ক লোক, হৃষ্টপুষ্ট মজবুত চেহারা-বিচক্ষণ ও চতুর কর্মচারী বলিয়া তাঁহার সুনাম ছিল। বিশেষত তাঁহার মধ্যে পুলিস-সুলভ আত্মম্ভরিতা বা অন্যের কৃতিত্ব লঘু করিয়া দেখিবার প্রবৃত্তি ছিল না বলিয়া ব্যোমকেশ তাঁহাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করিত। কয়েকটা জটিল ব্যাপারে ব্যোমকেশকে তাঁহার সাহায্য লইতেও দেখিয়াছি। শহরের নিম্নশ্রেণীর গাঁটকোটা ও গুণ্ডাদের চালচলন সম্বন্ধে তাঁহার অগাধ অভিজ্ঞতা ছিল।
ব্যোমকেশের সহিত মুখোমুখি হইতেই বীরেনবাবু বলিলেন, ‘কি খবর, ব্যোমকেশবাবু! গুরুতর কিছু না কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি নিজেই তার বিচার করুন।’ বলিয়া তাঁহাকে ভিতরে লইয়া চলিল।