ব্যোমকেশ হাবুলকে চেয়ারে বসাইয়া দিল
ব্যোমকেশ হাবুলকে হাত ধরিয়া একটা চেয়ারে বসাইয়া দিল। কিছুক্ষণ তাহাকে শান্ত করা গেল না, সে অসহায়ভাবে কাঁদিতেই লাগিল। বেচারার বয়স বেশি নয়, বালক বলিলেই হয়; তাহার উপর অকস্মাৎ এই দারুণ ঘটনায় একেবারে উদভ্ৰান্ত অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল।
হাবুলের যে বোন আছে, এ খবর আমরা জানিতাম না; তাহার পরিবারিক খুঁটিনাটি জানিবার কৌতুহল কোনও দিন হয় নাই। শুধু এইটুকু শুনিয়াছিলাম যে, হাবুলের মাতার মৃত্যুর পর দেবকুমারবাবু আবার বিবাহ করিয়াছিলেন। বিমাতাটি সপত্নী-পুত্রকে খুব স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন না, ইহাও আঁচে-আন্দাজে বুঝিয়েছিলাম।
মিনিট পাঁচেক পরে অপেক্ষাকৃত সুস্থির হইয়া হাবুল ব্যাপারটা খুলিয়া বলিল। দেবকুমারবাবু কয়েক দিন হইল দিল্লী গিয়াছেন; বাড়িতে হাবুল, তাহার অনূঢ়া ছোট বোন রেখা ও তাহাদের সৎমা আছেন। আজ সকালে উঠিয়া হাবুল যথারীতি নিজের তে-তলার নিভৃত ঘরে পড়িতে বসিয়াছিল; আটটা বাজিয়া যাইবার পর নীচে হঠাৎ সৎমার কণ্ঠে ভীষণ চীৎকার শুনিয়া তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিল; দেখিল, সৎমা রান্নাঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ঊর্ধ্বস্বরে প্রলাপ বকিতেছেন। তাঁহার প্রলাপের কোনও অর্থ বুঝিতে না পারিয়া হাবুল রান্নাঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, তাহার বোন রেখা উনানের সম্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া আছে। কি হইয়াছে জানিবার জন্য হাবুল তাঁহাকে প্রশ্ন করিল, কিন্তু রেখা উত্তর দিল না। তখন তাহার গায়ে হাত দিয়া নাড়া দিতেই হাবুল বুঝিল, রেখা নাই, তাহার গা বরফের মত ঠাণ্ডা, হাত-পা ক্রমশ শক্ত হইয়া আসিতেছে।
এই পর্যন্ত বলিয়া হাবুল আবার কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল, ‘আমি এখন কি করব, ব্যোমকেশদা? বাবা বাড়ি নেই, তাই আপনার কাছে ছুটে এলুম। রেখা মরে গিয়েছে-উঃ! কি করে এমন হল, ব্যোমকেশদা?’
হাবুলের এই শোক-বিহ্বল ব্যাকুলতা দেখিয়া আমার চক্ষুও সজল হইয়া উঠিল। ব্যোমকেশ হাবুলের পিঠে হাত দিয়া বলিল, ‘হাবুল, তুমি পুরুষমানুষ, বিপদে অধীর হয়ে না। কি হয়েছিল রেখার, বল দেখি–বুকের ব্যামো ছিল কি?’
‘তা তো জানি না।’
‘কত বয়স?’
‘ষোল বছর, আমার চেয়ে দু’বছরের ছোট।’
‘সম্প্রতি কোনও অসুখ-বিসুখ হয়েছিল? বেরিবেরি বা ঐ রকম কিছু?’
‘না।‘
ব্যোমকেশ ক্ষণকাল চিন্তা করিল, তারপর বলিল, ‘চল তোমার বাড়িতে। নিজের চোখে না দেখলে কিছুই ধারণা করা যাচ্ছে না। তোমার বাবাকে ‘তার করা দরকার, তিনি এসে পড়ুন। কিন্তু সে দুঘণ্টা পরে করলেও চলবে। আপাতত একজন ডাক্তার চাই। তোমার বাড়ির কাছেই ডাক্তার রুদ্র থাকেন না? বেশ–এস অজিত।’
কয়েক মিনিট পরে দেবকুমারবাবুর বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। বাড়িখানার সম্মুখভাগ সঙ্কীর্ণ যেন দুই দিকের বাড়ির চাপে চ্যাপ্টা হইয়া ঊর্ধ্বদিকে উঠিয়া গিয়াছে। নীচের তলায় কেবল একটি বসিবার ঘর, তা ছাড়া ভিতরদিকে কলঘর, রান্নাঘর ইত্যাদি আছে। আমরা দ্বারে উপস্থিত হইয়া দাঁড়াইতেই অন্দর হইতে একটা তীক্ষ্ণ স্ত্রীকণ্ঠের ছেদ-বিরামহীন আওয়াজ কনে আসিল। কণ্ঠস্বরে উদ্বেগ ও আশঙ্কার চিহ্ন পূর্ণমাত্রায় থাকিলেও শোকের লক্ষণ বিশেষ পাওয়া গেল না। বুঝিলাম, বিমাতা বিলাপ করিতেছেন।
একটা বৃদ্ধ গোছের ভূত্য কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত বাহিরে দাঁড়াইয়া ছিল। ব্যোমকেশ তাহাকে বলিল, ‘তুমি এ বাড়ির চাকর? যাও, ঐ বাড়ি থেকে ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে এস।’
চাকরিটা কিছু একটা করিবার সুযোগ পাইয়া ‘যে আজ্ঞে বলিয়া দ্রুত প্ৰস্থান করিল। তখন হাবুলকে অগ্রবর্তী করিয়া আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
যাঁহার কণ্ঠস্বর বাহির হইতে শুনিতে পাইয়াছিলাম, তিনি উপরে উঠিবার সিঁড়ির সম্মুখে দাঁড়াইয়া একাকী অনর্গল বকিয়া চলিয়াছিলেন, আমাদের পদশব্দে তাঁহার চমক ভাঙিলা; তিনি উচ্চকিতভাবে আমাদের পানে চাহিলেন। দুইজন অপরিচিত লোককে হাবুলের সঙ্গে দেখিয়া তিনি মাথার উপর আঁচলটা টানিয়া দিয়া ক্ষিপ্ৰপদে উপরে উঠিয়া গেলেন। আমি মুহুর্তের জন্য তাঁহার মুখখানা দেখিতে পাইয়াছিলাম। আমার মনে হইল, তাঁহার আরক্ত চোখের ভিতর একটা ত্ৰাস-মিশ্রিত বিরক্তির ছায়া দেখা দিয়াই অঞ্চলের আড়ালে ঢাকা পড়িয়া গেল।
হাবুল অফুটম্বরে বলিল, ‘আমার মা–”
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বুঝেছি। রান্নাঘর কোনটা?’
হাবুল অঙ্গুলি নির্দেশে দেখাইয়া দিল। অল্প-পরিসর চতুষ্কোণ উঠান ঘিরিয়া ছোট ছোট কয়েকটি কক্ষ; তাহার মধ্যে যেটি অপেক্ষাকৃত বড়, সেইটি রান্নাঘর। পাশে একটি জলের কল, তাহা হইতে ক্ষীণ ধারায় জল পড়িয়া দ্বারের সম্মুখভাগ পিচ্ছিল করিয়া রাখিয়াছে।
জুতা খুলিয়া আমরা রান্নাঘরে প্রবেশ করিলাম। ঘরটা প্রায় অন্ধকার, আলো-প্রবেশের কোনও পথ নাই। হাবুল দরজার পাশে হাত বাড়াইয়া সুইচ টিপিতেই একটা ধোঁয়াটে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলিয়া উঠিল। তখন ঘরের অভ্যন্তরভাগ ভাল করিয়া দেখিতে পাইলাম।
দ্বারের অপর দিকে দেয়ালে সংলগ্ন পাশাপাশি দুটি কয়লার উনান, তাহাতে ভাঙা পাথুরে কয়লা স্তুপীকৃত রহিয়াছে; কিন্তু আগুন নাই। এই অগ্নিহীন চুল্লীর সম্মুখে নতজানু হইয়া একটি মেয়ে বসিয়া আছে-যেন বেদীপ্রান্তে উপাসনারত একটি স্ত্রীমূর্তি। মেয়েটির দেহ সম্মুখদিকে ঝুঁকিয়া আছে, মাথাও বুকের উপর নামিয়া পড়িয়াছে; হাত দুটি লম্বিত দেখিয়া মনে হয় না যে, সে মৃত। ব্যোমকেশ সন্তৰ্পণে গিয়া তাহার নাড়ি টিপিল।
তাহার মুখ দেখিয়াই বুঝিলাম, নাড়ি নাই। ব্যোমকেশ হাত ছাড়িয়া দিয়া ধীরে ধীরে মেয়েটির চিবুক ধরিয়া মুখ তুলিল। প্রাণহীন দেহে মৃত্যুকাঠিন্য দেখা দিতে আরম্ভ করিয়াছে–মুখ অল্প একটু উঠিল।
মেয়েটি বেশ সুশ্রী, হাবুলের মত নয়। রং ফর্সা, মুখের গড়ন ধারালো, নীচের ঠোঁট অভিমানিনীর মত স্বভাবতই ঈষৎ স্ফুরিত। ষোলো বছর বয়সের অনুযায়ী দেহ-সৌষ্ঠবও বেশ পূর্ণতা লাভ করিয়াছে। মাথার দীর্ঘ চুলগুলি বোধ হয় স্নানের পূর্বে বিনুনি খুলিয়া পিঠে ছাড়াইয়া দিয়াছিল, সেই ভাবেই ছড়ানো আছে। পরিধানে একটি অর্ধ-মলিন গঙ্গা-যমুনা ডুরে; অলঙ্কারের মধ্যে হাতে তিনিগাছি করিয়া সোনার চুড়ি, কানে মিনা-করা হাল্কা ঝুমকা, গলায় একটি সরু হার।
ব্যোমকেশ নিকট হইতে তাহাকে ভাল করিয়া দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; তার পর দূর হইতে তাহার বসিবার ভঙ্গী ইত্যাদি সমগ্রভাবে দেখিবার জন্য কয়েক পা সরিয়া গিয়া দাঁড়াইল।
খানিকক্ষণ একাগ্র দৃষ্টিতে মেয়েটির পানে চাহিয়া থাকিয়া সে আবার নিকটে ফিরিয়া আসিল; মেয়েটির ডান হাতখানি তুলিয়া করতল পরীক্ষা করিয়া দেখিল। করতলে কয়লার কালি লাগিয়া আছে-সে নিজের হাতে উনানে কয়লা দিয়াছে, সহজেই অনুমান করা যায়। অঙ্গুলিগুলি ঈষৎ কুঞ্চিত, তর্জনী ও অঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাব পরস্পর সংলগ্ন হইয়া আছে। ব্যোমকেশ অঙ্গুলি দুটি সাবধানে পৃথক করিতেই একটি ক্ষুদ্র জিনিস খসিয়া মাটিতে পড়িল। ব্যোমকেশ সেটি মাটি হইতে তুলিয়া নিজের করতলে রাখিয়া আলোর দিকে পরীক্ষা করিল। আমিও ঝুঁকিয়া দেখিলাম—একটি দেশলাইকাঠির অতি ক্ষুদ্র দগ্ধাবশেষ, দেশলাইয়ের কাঠি জ্বলিয়া জ্বলিয়া আঙুল পর্যন্ত পৌঁছিলে যেটুকু বাকি থাকে, সেইটুকু।
গভীর মনঃসংযোগে কাঠিটা কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া ব্যোমকেশ সেটা ফেলিয়া দিল, তারপর মেয়েটির বাঁ হাত তুলিয়া দেখিল। বাঁ হাতটি মুষ্টিবদ্ধ ছিল, মুঠি খুলিতেই একটি দেশলাইয়ের বাক্স দেখা গেল। ব্যোমকেশ বাক্সটি খুলিয়া দেখিল, কয়েকটি কাঠি রহিয়াছে। ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘হঁ। আমিও তাই প্রত্যাশা করেছিলুম। দেশলাই জ্বেলে উনুনে আগুন দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় মৃত্যু হয়েছে।’
অতঃপর ব্যোমকেশ মৃতদেহ ছাড়িয়া ঘরের চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইল; মেঝের উপর সিক্ত পদচিহ্ন শুকাইয়া অস্পষ্ট দাগ হইয়াছিল, সেগুলি ভাল করিয়া পরীক্ষা করিল। শেষে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘না, মৃত্যুকালে ঘরে আর কেউ ছিল না। পরে একজন স্ত্রীলোক ঘরে ঢুকেছিলেন, তারপর হাবুল ঢুকেছিল।’
এই সময় বাহিরে শব্দ শুনা গেল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘বোধ হয় ডাক্তার রুদ্র এলেন। হাবুল, তাঁকে নিয়ে এস।’
হাবুল বাহিরে গেল। আমি এই অবসরে ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ব্যোমকেশ, কিছু বুঝলে?’
ব্যোমকেশ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া মাথা নাড়িল, ‘কিছু না। কেবল এইটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, মেয়েটি মৃত্যুর আগের মুহুর্ত পর্যন্ত জানত না যে, মৃত্যু এত নিকট।’
ডাক্তার রুদ্রকে লইয়া হাবুল ফিরিয়া আসিল। ডাক্তার রুদ্র বয়স্থ লোক; কলিকাতার একজন নামজাদা চিকিৎসক। কিন্তু অত্যন্ত রূঢ় ও কটুভাষী বলিয়া তাঁহার দুনাম ছিল। মেজাজ সর্বদাই সপ্তমে চড়িয়া থাকিত; এমন কি মুমূর্ষ রোগীর ঘরেও তিনি এমন ব্যবহার করিতেন যে, তিনি না হইয়া অন্য কোনও ডাক্তার হইলে তাঁহার পেশা চলা কঠিন হইয়া পড়িত। একমাত্র চিকিৎসা-শাস্ত্ৰে অসাধারণ প্ৰতিভার বলে তিনি পসার-প্রতিপত্তি বজায় রাখিয়াছিলেন; এছাড়া তাঁহার মধ্যে অন্য কোনও গুণ আজ পর্যন্ত কেহ দেখিতে পায় নাই।
ডাক্তার রুদ্রের চেহারা হইতেও তাঁহার চরিত্রের আভাস পাওয়া যাইত। নিকষ কৃষ্ণ গায়ের রং, ঘোড়ার মত লম্বা কদাকার মুখে রক্তবর্ণ দুটা চক্ষুর দৃষ্টি দুবিনীত আত্মম্ভরিতায় যেন মানুষকে মানুষ বলিয়াই গণ্য করে না। অধরোষ্ঠের গঠনেও ঐ সার্বজনীন অবস্থা ফুটিয়া উঠিতেছে। তিনি যখন ঘরে আসিয়া ঢুকিলেন, তখন মনে হইল, মূর্তিমান দম্ভ কোট-প্যান্টালুন ও জুতা সুদ্ধ ঘরের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইল।
হাবুল নীরবে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া ভগিনীর দেহ দেখাইয়া দিল। ডাক্তার রুদ্র স্বভাব-কর্কশ স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হয়েছে? মারা গেছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনিই দেখুন।’
ডাক্তার রুদ্র ব্যোমকেশের দিকে দম্ভ-কষায় নেত্ৰ তুলিয়া বলিলেন, ‘আপনি কে?’
‘আমি পারিবারিক বন্ধু।’
‘ও!’–ব্যোমকেশকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া ডাক্তার রুদ্র হাবুলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এটি কে-দেবকুমারবাবুর মেয়ে?’
হাবুল ঘাড় নাড়িল।
ডাক্তার রুদ্রের উত্থিত-ভ্রূ-ললাটে ঈষৎ কৌতুহল প্রকাশ পাইল। তিনি মৃতদেহের পানে তাকাইয়া বলিলেন, ‘এরই নাম রেখা?’
হাবুল আবার ঘাড় নাড়িল।
‘কি হয়েছিল?’
‘কিছু না–হঠাৎ–‘
ডাক্তার রুদ্র তখন হাঁটু গাড়িয়ে রেখার পাশে বসিলেন; মুহূর্তের জন্য একবার নাড়িতে হাত দিলেন, একবার চোখের পাতা টানিয়া চক্ষু-তারকা দেখিলেন। তারপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘মারা গেছে। প্রায় দুঘণ্টা আগে মৃত্যু হয়েছে। Rigor mortis set in করেছে।’ কথাগুলি তিনি এমন পরিতৃপ্তির সহিত বললেন—যেন অত্যন্ত সুসংবাদ শুনিবামাত্র শ্রোতারা খুশি হইয়া উঠিবে।
ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘কিসে মৃত্যু হয়েছে, বলতে পারেন কি?’
‘সেটা অটন্সি না করে বলা অসম্ভব। আমি চললুম–আমার ভিজিট বত্ৰিশ টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিও। আর, পুলিসে খবর দেওয়া দরকার, মৃত্যু সন্দেহজনক।’ বলিয়া ডাক্তার রুদ্র প্ৰস্থান করিলেন।