Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অগ্নিবান – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

অগ্নিবান – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

খবরের কাগজখানা হতাশ হস্ত-সঞ্চালনে আমার কোলের উপর ফেলিয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘নাঃ–কোথাও কিছু নেই‌, একেবারে ফাঁক। এর চেয়ে কাগজওয়ালারা সাদা কাগজ বের করলেই পারে। তাতে ছাপার খরচটা অন্তত বেঁচে যায়।’

আমি খোঁচা দিয়া বলিলাম‌, ‘বিজ্ঞাপনেও কিছু পেলে না? বল কি? তোমার মতে তো দুনিয়ার যত কিছু খবর সব ঐ বিজ্ঞাপন-স্তম্ভের মধ্যেই ঠাসা আছে।’

বিমর্ষ মুখে চুরুট ধরাইয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না‌, বিজ্ঞাপনেও কিছু নেই। একটা লোক বিধবা বিয়ে করতে চায় বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। কুমারী ছেড়ে বিধবা বিয়ে করবার জন্যেই গোঁ ধরেছে। কেন‌, ঠিক বোঝা গেল না। নিশ্চয় কোনও বদ মতলব আছে।’

‘তা তো বটেই। আর কিছু?’

‘আর একটা বীমা কোম্পানি মহা ঘটা করে বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে‌, তারা স্বামী-স্ত্রীর জীবন একসঙ্গে বীমা করবে‌, এবং জোড়ার মধ্যে একটাকে কোনও রকমে পটল তোলাতে পারলেই অন্য জন টাকা পাবে। এইসব বীমা কোম্পানি এমন করে তুলেছে যে‌, মরেও সুখ নেই।’

‘কেন‌, এর মধ্যেও বাদ মতলব আছে নাকি?’

‘বীমা কোম্পানির নিজের স্বাৰ্থ না থাকতে পারে‌, কিন্তু অন্যের মনে দুবুদ্ধি জাগিয়ে তোলাও সৎকার্য নয়।’

‘অর্থাৎ? মানে হল কি?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিল না‌, হৃদয়ভারাক্রান্ত একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া টেবিলের উপর পা তুলিয়া দিল‌, তারপর কড়িকাঠের দিকে অনুযোগপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাইয়া নীরবে ধূম উদগিরণ করিতে লাগিল।

শীতকাল; বড়দিনের ছুটি চলিতেছিল। কলিকাতার লোক বাহিরে গিয়া ও বাহিরের লোক কলিকাতায় আসিয়া মহা সমারোহে ছুটি উদযাপন করিতেছিল। কয়েক বছর আগেকার কথা‌, তখন ব্যোমকেশের বিবাহ হয় নাই।

আমরা দুইজনে চিরন্তন অভ্যাসমত সকালে উঠিয়া একত্র চা-পান ও সংবাদপত্রের ব্যবচ্ছেদ করিতেছিলাম। গত তিন মাস একেবারে বেকারভাবে বসিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশের ধৈর্যের লৌহ-শৃঙ্খলও বোধ করি ছিড়িবার উপক্ৰম করিয়াছিল। দিনের পর দিন সংবাদপত্রের নিম্প্রাণ ও বৈচিত্র্যহীন পৃষ্ঠা হইতে অপদাৰ্থ খবর সংগ্ৰহ করিয়া সময় আর কাটিতে চাহিতেছিল না। আমার নিজের মনের অবস্থা যেরূপ শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছিল‌, তাহা হইতেই বুঝিতেছিলাম‌, ব্যোমকেশের মস্তিষ্কের ক্ষুধা ইন্ধন অভাবে কিরূপ উগ্র ও দুর্বাহ হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তবু সমবেদনা প্রকাশ করিয়া তাহাকে শান্ত করিবার চেষ্টা করি নাই; বরঞ্চ এই অনীন্সিত নৈষ্কর্মের জন্য যেন সে-ই মূলতঃ দায়ী্‌্‌, এমনিভাবে তাহাকে ব্যঙ্গ-বিদ্যুপ করিয়াছি।

আজ প্রভাতে তাহার এই হতাশাপূর্ণ ভাব দেখিয়া আমার একটু অনুশোচনা হইল। মস্তিষ্কের খোরাক সহসা বন্ধ হইয়া গেলে সুস্থ বলবান মস্তিষ্কের কিরূপ দুৰ্দশা হয়‌, তাহা তো জানিই‌, উপরন্তু আবার বন্ধুর খোঁচা খাইতে হইলে ব্যাপারটা নিতান্তই নিষ্কারুশি হইয়া পড়ে।

আমি আর তাহাকে প্রশ্ন না করিয়া অনুতপ্ত চিত্তে খবরের কাগজখানা খুলিলাম।

এই সময়ে চারিদিকে সভা সমিতি ও অধিবেশনের ধুম পড়িয়া যায়‌, এবারেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। সংবাদ-ব্যবসায়ীরা সরসতর সংবাদের অভাবে এইসব সভার মামুলি বিবরণ ছাপিয়া পৃষ্ঠা পূর্ণ করিয়াছে। তাহার ফাঁকে ফাঁকে সিনেমা ও থিয়েটার-সাকাসের বিজ্ঞাপন সচিত্র ও বিচিত্ররূপে আমোদ-লোলুপ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করিতেছে।

দেখিলাম‌, কলিকাতাতেই গোটা পাঁচেক বড় বড় সভা চলিতেছে। তা ছাড়া দিল্লীতে নিখিল ভারতীয় বিজ্ঞান-সভার অধিবেশন বসিয়াছে। ভারতের নানা দিগদেশ হইতে অনেক হোমরা-চোমরা বৈজ্ঞানিক পণ্ডিত একজোট হইয়াছেন এবং বাক্যধুমে বোধ করি দিল্লীর আকাশ বিষাক্ত করিয়া তুলিয়াছেন। সংবাদপত্রের মারফত যতটুকু ধুম চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে তাহারই ঠেলায় মস্তিষ্ক কোটরে কুল পড়িবার উপক্রম হইয়াছে।

আমি সময় সময় ভাবি‌, আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিকরা কাজ না করিয়া এত বাগবিস্তার করেন কেন? দেখিতে পাই‌, যিনি যত বড় বৈজ্ঞানিক‌, তিনি তার চতুৰ্ত্তণ বাগ্মী। বেশি কিছু নয়‌, স্টীম এঞ্জিন বা এরোপ্লেনের মত একটা যন্ত্রও যদি ইহারা আবিষ্কার করিতে পারিতেন‌, তাহা হইলেও তাঁহাদের বাচালতা ধৈর্য ধরিয়া শুনিতাম। কিন্তু ও সব দূরে থাক‌, মশা মারিবার একটা বিষও তাঁহারা আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। বুজরুকি আর কাহাকে বলে!

নিরুৎসুকিভাবে বিজ্ঞান-কংগ্রেসের বিবরণ পড়িতে পড়িতে একটা নাম দৃষ্টি আকর্ষণ করিলইনি কলিকাতার একজন খ্যাতনামা প্রফেসর ও বিজ্ঞান-গবেষক-নাম দেবকুমার সরকার। বিজ্ঞান-সভায় ইনি সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়াছেন। অবশ্য ইনি ছাড়া অন্য কোনও বাঙালী যে বক্তৃতা দেন নাই‌, এমন নয়‌, অনেকেই দিয়াছেন; কিন্তু বিশেষ করিয়া দেবকুমারবাবুর নামটা চোখে পড়িবার কারণ, কলিকাতায় তিনি আমাদের প্রতিবেশী, আমাদের বাসার কয়েকখানা বাড়ির পরে গলির মুখে তাঁহার বাসা। তাঁহার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ আলাপ ছিল না‌, কিন্তু তাঁহার পুত্ৰ হাবুলের সম্পর্কে আমরা তাঁহার সহিত নেপথ্য হইতেই ঘনিষ্ঠ হইয়া পড়িয়ছিলাম।

দেবকুমারবাবুর ছেলে হাবুল কিছুদিন হইতে ব্যোমকেশের ভক্ত হইয়া পড়িয়ছিল। ছোকরার বয়স আঠারো-উনিশ‌, কলেজের দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে পড়িত। ভালমানুষ ছেলে‌, আমাদের সম্মুখে বেশি কথা বলিতে পারিত না‌, তদগতভাবে ব্যোমকেশের মুখের পানে চাহিয়া থাকিত। ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া এই অস্ফুটবাক ভক্তের পূজা গ্ৰহণ করিত; কখনও চা খাইবার নিমন্ত্ৰণ করিত। হাবুল একেবারে কৃতাৰ্থ হইয়া যাইত।

এই হাবুলের পিতা কিরূপ বক্তৃতা দিয়াছেন‌, জানিবার জন্য একটু কৌতুহল হইল। পড়িয়া দেখিলাম‌, দেশী বৈজ্ঞানিকদের অভাব অসুবিধার সম্বন্ধে ভদ্রলোক যাহা বলিয়াছেন‌, তাহা নেহাত মিথ্যা নয়। ব্যোমকেশকে পড়িয়া শুনাইলে তাহার মনটা বিষয়াস্তরে সঞ্চারিত হইয়া হয়তো একটু প্ৰফুল্ল হইতে পারে‌, তাই বলিলাম‌, ‘ওহে‌, হাবুলের বাবা দেবকুমারবাবু বক্তৃতা দিয়েছেন‌, শোনো।‘

ব্যোমকেশ কড়িকাঠ হইতে চক্ষু নামাইল না‌, বিশেষ ঔৎসুক্যও প্রকাশ করিল না। আমি্‌্‌, পড়িতে আরম্ভ করিলাম–

‘এ কথা সত্য যে‌, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাহায্য ব্যতীত কোনও জাতি বড় হইতে পারে নাই। অনেকের ধারণা এইরূপ যে‌, ভারতবাসী বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পরাভূখ এবং তাহাদের উদ্ভাবনী শক্তি নাই—এই জন্যই ভারত পরনির্ভর ও পরাধীন হইয়া আছে। এই ধারণা যে সম্পূর্ণ ভ্ৰমাত্মক‌, ভারতের গরিমাময় অতীত তাহার প্রমাণ। নব্য-বিজ্ঞানের যাহা বীজমন্ত্র, তাহা যে ভারতেই প্রথম আবিষ্কৃত হইয়াছিল ও পরে কাশপুষ্পের বীজের ন্যায় বায়ুতাড়িত হইয়া দূর-দূরান্তরে ছড়াইয়া পড়িয়াছে‌, তাহা সুধীসমাজে উল্লেখ করা বাহুল্যমাত্র। গণিত‌, জ্যোতিষ‌, নিদান‌, স্থাপত্য-এই চতুস্তম্ভের উপর আধুনিক বিজ্ঞান ও তৎপ্রসূত সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত‌, অথচ ঐ চারিটি বিজ্ঞানেরই জন্মভূমি ভারতবর্ষ।

‘কিন্তু এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে‌, বর্তমানে আমাদের এই অসামান্য উদ্ভাবনী প্রতিভা নিস্তেজ ও ম্ৰিয়মাণ হইয়া পড়িয়াছে। ইহার কারণ কি? আমরা কি মানসিক বলে পূর্বাপেক্ষা হীন হইয়া পড়িয়াছি? না–তাহা নহে। আমাদের প্রতিভা অ-ফলপ্রসূ হইবার অন্য কারণ আছে।

‘পুরাকালে আচার্য ও ঋষিগণ-যাঁহাদের বর্তমানকালে আমরা savant বলিয়া থাকি–রাজ-অনুগ্রহের আওতায় বসিয়া সাধনা করিতেন। অর্থচিন্তা তাঁহাদের ছিল না‌, অর্থের প্রয়োজন হইলে রাজা সে অর্থ যোগাইতেন; সাধনার সাফল্যের জন্য যাহা কিছু প্রয়োজন হইত‌, রাজকোষের অসীম ঐশ্বর্য তৎক্ষণাৎ তাহা যোগাইয়া দিত। আচার্যগণ অভাবমুক্ত হইয়া কুষ্ঠাহীন-চিত্তে সাধনা করিতেন এবং অস্তিমে সিদ্ধি লাভ করিতেন।

‘কিন্তু বর্তমান ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের অবস্থা কিরূপ? রাজা বৈজ্ঞানিক-গবেষণার পরিপোষক নহেন-ধনী ব্যক্তিরাও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য অর্থব্যয় করিতে কুষ্ঠিত। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমিত আয়োজনের উপর নির্ভর করিয়া উদ্ধৃবৃত্তির সাহায্যে আমাদের সাধনায় প্রবৃত্ত হইতে হয়; ফলে আমাদের সিদ্ধিও তদুপযুক্ত হইয়া থাকে। মুষিক যেমন প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও হস্তীকে পৃষ্ঠে বহন করিতে পারে না‌, আমরাও তেমনই বড় বড় আবিক্রিয়ায় সফল হইতে পারি না; ক্ষুধাক্ষীণ মস্তিষ্ক বৃহতের ধারণা করিতে পারে না।

‘তবু আমি গর্ব করিয়া বলিতে পারি‌, যদি আমরা অর্থের অভাবে পীড়িত না হইয়া অকুণ্ঠ-চিত্তে সাধনা করিতে পারিতাম‌, তাহা হইলে আমরা জগতের কোনও জাতির নিকটেই নূ্যন হইয়া থাকিতাম না। কিন্তু হায়! অর্থ নাই-কমলার কৃপার অভাবে আমাদের বাণীর সাধনা ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে। তবু্‌, এই দৈন্য-নির্জিত অবস্থাতেও আমরা যাহা করিয়াছি‌, তাহ নিন্দার বিষয় নহে–শ্লাঘার বিষয়। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ল্যাবরেটরিতে যে সকল আবিস্ক্রিয়া মাঝে মাঝে অতর্কিতে আবির্ভূত হইয়া আবিষ্কতাঁকে বিস্ময়ে অভিভূত করিয়া ফেলিতেছে‌, কে তাহার সংবাদ রাখে। আবিষ্কারক নিজের গোপন আবিষ্কার সযত্নে বুকে লুকাইয়া নীরবে আরও অধিক জ্ঞানের সন্ধানে ঘুরিতেছে; কিন্তু সে একাকী‌, তাহাকে সাহায্য করিবার কেহ নাই; বরঞ্চ সর্বদাই ভয়‌, অন্য কেহ তাহার আবিষ্কার-কণিকার সন্ধান পাইলে তৎক্ষণাৎ তাহা আত্মসাৎ করিবে। লোলুপ‌, পরস্বগৃধ্নু চোরের দল চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।

‘তই বলিতেছি—অর্থ চাই‌, সহানুভূতি চাই‌, গবেষণা করিবার অবাধ অফুরন্ত উপকরণ চাই‌, সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিলে নিষ্কণ্টকে যশোলাভের নিশ্চিন্ত সম্ভাবনা চাই। অর্থ চাই—‘

‘থামো।’

প্রফেসর মহাশয়ের ভাষাটি বেশ গাল-ভরা‌, তাই শব্দপ্রবাহে গা ভাসাইয়া পড়িয়া চলিয়াছিলাম। হঠাৎ ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল‌, ‘থামো।’

‘কি হল?’

‘চাই—চাই–চাই। আর আস্ফালন ভাল লাগে না। বিষের সঙ্গে খোঁজ নেই‌, কুলোপনা চক্কর।‘

আমি বলিলাম‌, ‘ঐ তো মজা। মানুষ নিজের অক্ষমতার একটা-না-একটা সাফাই সর্বদাই তৈরি করে রাখে। আমাদের দেশের আচার্যরাও যে তার ব্যতিক্রম নয়‌, দেবকুমারবাবুর লেকচার পড়লেই তা বোঝা যায়।’

ব্যোমকেশের মুখের বিরক্তি ও অবসাদ ভেদ করিয়া একটা ব্যঙ্গ-বঙ্কিম হাসি ফুটিয়া উঠিল। সে বলিল‌, ‘হাবুল ছোকরা দেখতে হাবাগোবা ভালমানুষ হলেও ভেতরে ভেতরে বেশ বুদ্ধিমান। তার বাবা হয়ে দেবকুমারবাবু এমন ইয়ের মত আদি-অন্তহীন বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান কেন‌, এই আশ্চর্য!’

আমি বলিলাম‌, ‘বুদ্ধিমান ছেলের বাবা হলেই বুদ্ধিমান হতে হবে‌, এমন কোনও কথা নেই। দেবকুমারবাবুকে তুমি দেখেছ?’

‘ঠিক বলতে পারি না। তাঁকে দেখবার দুৰ্নিবার আকাঙ্ক্ষা কখনও প্ৰাণে জাগেনি। তবে শুনেছি‌, তিনি দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ করেছেন। নিবুদ্ধিতার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি থাকতে পারে?’ বলিয়া ব্যোমকেশ ক্লান্তভাবে চক্ষু মুদিল।

ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজিল। বসিয়া বসিয়া আর কি করিব ভাবিয়া না পাইয়া শেষে পুটরামকে আর এক দফা চা ফরমাস দিব মনে করিতেছি‌, এমন সময় ব্যোমকেশ হঠাৎ সোজা উঠিয়া বসিয়া বলিল‌, ‘সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।’ কিছুক্ষণ উৎকৰ্ণ হইয়া থাকিয়া আবার ঠেসান দিয়া বসিয়া বিরস স্বরে বলিল‌, ‘হাবুল। তার আবার কি হল? বডড তাড়াতাড়ি আসছে।’

মুহুর্ত পরেই হাবুল সজোরে দরজা ঠেলিয়া ঘরে ঢুকিয়া পড়িল। তাহার চুল উস্কো খুস্কো‌, চোখ দুটা যেন ভয়ে ও অভাবনীয় আকস্মিক দুর্ঘটনার আঘাতে ঠিকরাইয়া বাহির হইয়া আসিতেছে। এমনিতেই তাহার চেহারাখানা খুব সুদৰ্শন নয়‌, একটু মোটাসোটা ধরনের গড়ন‌, মুখ গোলাকার‌, চিবুক ও গণ্ডে নবজাত দাড়ির অন্ধকার ছায়া-তাহার উপর এই পাগলের মত আবির্ভাব; আমি ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলাম‌, ‘কি হে হাবুল! কি হয়েছে?’

হাবুলের পাগলের মত দৃষ্টি কিন্তু ব্যোমকেশের উপর নিবদ্ধ ছিল; আমার প্রশ্ন বোধ করি সে শুনিতেই পাইল না‌, টলিতে টলিতে ব্যোমকেশের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল‌, বলিল‌, ‘ব্যোমকেশদা‌, সৰ্ব্বনাশ হয়েছে। আমার বোন রেখা হঠাৎ মরে গেছে।’ বলিয়া হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 1 of 7 ): 1 23 ... 7পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress