৩. ভাবা গিয়াছিল কিরীটী
ভাবা গিয়াছিল কিরীটী আর সহজে আসিবে না। যতই হোক মান-মর্যাদা বলিয়া একটা জিনিস তো আছে মানুষের! কিন্তু দু’জনের ধারণা উল্টাইয়া দিয়া পরদিনই নিতান্ত নির্লজ্জের মত আসিয়া হাজির হইল লোকটা। কি না, তাপসীর খোঁজ লইতে আসিয়াছে। তাপসীর মাথা ব্যথার চিন্তায় বোধকরি সারারাত ঘুমই হয় নাই তাহার। দৈবক্রমে আসামাত্রই তাপসীর দেখা পাওয়ায় প্রসন্ন হাসির আলোয় যেন ঝকমক করিয়া ওঠে কিরীটী, শরতের সোনালী সকালের সঙ্গে ওর মুখের হাসিটা ভারি মানানসই।–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!
পিঠের আঁচলটা টানিয়া হাতের উপর জড়াইয়া লইতে লইতে তাপসীও হাসিমুখে বলে– হঠাৎ ঈশ্বরের উপর এত অনুগ্রহ?
–তার অশেষ করুণার জন্যে। আশা করিনি, এসেই এভাবে আপনার দেখা পাওয়া যাবে, মানে ইয়ে–এমন সুস্থভাবে। হঠাৎ প্রকাশিত আবেগের ভাষাটাকে মোড় ঘুরাইয়া একটু সরল করিয়া লয় কিরীটী। যেন ধন্যবাদটা যদি ঈশ্বরের পাওনাই হয় তো সে কেবল তাপসীকে শারীরিক সুস্থ রাখার দরুন।
তাপসী মনে মনে হাসিয়া লইয়া বলে–তবে কি আশা করেছিলেন, মাথার যন্ত্রণায় ছটফট করছি, ডাক্তার-বদ্যিতে বাড়ী ভরে গেছে, যায় যায় অবস্থা!
–আঃ, কি যে বলেন! আপনাকে এক এক সময় ভারি বকতে ইচ্ছে করে সত্যি!
তাপসী হাসিয়া ফেলিয়া বলে–বকুন!
–বকব? নাঃ, এরকম ‘আপনি আজ্ঞে’ করে বকে সুখ হয় না।
–তবে নয় ‘তুই-তোকারি’ই করুন।
–হঠাৎ একেবারে ডবল প্রমোশন? অতটা কি পেরে উঠব? মাঝামাঝি একটা রফা করতে আপত্তি কি?
আপত্তি? আপত্তি আবার কোথায়? দূরত্বের সকল ব্যবধান ঘুচাইয়া সমস্ত হৃদয় যে ঝাপাইয়া পড়িতে চায় ওই উন্মুখ হৃদয়ের দরজায়। কিন্তু না না, তুমি’ সম্বোধনের নিকট-আবেষ্টনের মধ্যে তাপসী আপনাকে রক্ষা করিবে কিসের জোরে? আগুন লইয়া এই ভয়াবহ খেলায় হার মানিতে হয় যদি? কিরীটীকে দেখিলে নিজেকে বাঁধিয়া রাখা যে কত কঠিন সে কথা তো নিজের কাছে আর অজানা নাই আজ। গতরাত্রের কত প্রতিজ্ঞা কত সংকল্প কোথায় ভাসিয়া গেল এই খুশীতে ঝলমল মুখোনি দেখার সঙ্গে সঙ্গে। তবে? বরং কঠিন ব্যবহারের নিষ্ঠুর আঘাতে দূরে সরাইয়া রাখা সম্ভব, কিন্তু সম্প্রীতির সরসতার মধ্যে নয়।
হায় ঈশ্বর! তাপসী করিবে কি? অতীতের দুঃস্বপ্ন ভুলিয়া, কাল্পনিক অপরাধের বিভীষিকা ভুলিয়া শরতের এই নরম সোনালী আলোর মত নিজেকে সমর্পণ করিয়া দিবে? ন্যায়-অন্যায়ের বিচারই যদি করিতে হয়–এই আগ্রহে উন্মুখ হৃদয়টিকে ফিরাইয়া দেওয়াই কি ন্যায়? ওই হাস্যোজ্জ্বল মুখোনি স্নান করিয়া দেওয়াই কি সুবিচার? নিজের হৃদয় শতধা হোক, হয়তো সহ্য করা যায়, কিন্তু কিরীটী? কিরীটীকে ফিরাইয়া দিবার জোর যে আজ আর কোথাও খুঁজিয়া পাইতেছে না তাপসী! দূর অতীতের একখানি বিস্মৃত মুখ স্মরণ করিবার প্রাণপণ ব্যর্থ চেষ্টায় নয়, নয় নীতিধর্মের খুঁটি আঁকড়াইয়া থাকিবার প্রাণান্ত চেষ্টায়।
সকালের খোলা আলোয় মুখের লেখা পাঠ করা শক্ত নয়। ‘তুমি’ বলিতে চাওয়ার আবদারে তাপসীর মুখের আলোছায়ার খেলা কিরীটীর চোখে ধরা পড়ে সহজেই। তবু কি ভাবিয়া তুমিই বলে সে! ম্লান গম্ভীর মুখে বলে–আপত্তি আছে বুঝলাম, তবু মানলাম না তোমার আপত্তি! একটা কথা তোমাকে আমার জানাবার আছে তাপসী, শোনবার সময় হবে আজ?
কথা যে কি, সে কথা কি বুঝতে বাকি আছে তাপসীর? চিত্রলেখার বড় আকাঙ্ক্ষার সেই কথা! কিন্তু তাপসীর? তাপসীর সে কথা শুনিবার সময় কোথায়? আজ নয়, কাল নয়, কোনোদিনই নয়।
মনকে সে ঠিক করিয়াছে। তাই অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বলে–না।
–কিন্তু সে কথা যে আমায় বলতেই হবে, না বলে উপায় নেই। না বলতে পেয়ে–
–কি আশ্চর্য, আপনার দরকার আছে বলেই সকলের দরকার হবে, তার মানে কি? আপনার কথা হয়তো আমার কাছে অপ্রয়োজনীয়! তেমনি মুখ ফিরাইয়াই কথা বলে তাপসী।
কিরীটী কি প্রতিজ্ঞা করিয়াছে কোন অপমানেই টলিবে না? তা নয়তো এত অবহেলার পরেও এমন ব্যগ্রভাবে কথা কয়?”তুমি বুঝতে পারছ না তাপসী, শোনবার প্রয়োজন হয়তো তোমারও আছে। আরো আগেই বলা উচিত ছিল আমার, শুধু গুছিয়ে বলতে পারার ক্ষমতার অভাবেই পারিনিসাহস করিনি। কিন্তু এভাবে আর পারছি না আমি।
আর তাপসীই যেন পারিতেছে! প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে করিতে কত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে বেচারা, কে তাহার হিসাব রাখিতেছে? কে সন্ধান লইতেছে সে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হৃদয়ের?
কিরীটীকে দেখিবার আগে কী স্নিগ্ধ শান্তি ছিল জীবনে! সুখ না থাক–একটা ছায়াচ্ছন্ন শান্তি, নিশ্চিন্ত বিষাদ! অকালবৈধব্যের মত ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটা সকরুণ নির্লিপ্ততা! তখন এমন রারি ঘুম হরণ করিয়া নিঃশব্দ প্রেতের মত অতীত আসিয়া বর্তমানের উপর ছায়া ফেলিত না, ছদ্মবেশী শয়তানের মত ভবিষ্যৎ আসিয়া লোভ দেখাইত না!
কিরীটীকে দেখিবামাত্র মনের সেই স্থির প্রশান্তি এমন বিপর্যস্ত হইয়া গেল কেন? এই চব্বিশ বৎসর বয়সের মধ্যে কখনো কি কোন পুরুষকেই চোখে দেখে নাই তাপসী? চিত্রলেখারও তো এইটিই নূতন প্রচেষ্টা নয়। মেয়ের জন্য পাত্রের আমদানি তো অনেকদিন হইতেই করিতেছেন। তাছাড়া বাইরের জগতে ঘুরিয়া বেড়াইতে গেলে কত মানুষের সংস্পর্শে আসিতে হয়। তবু
ব্যর্থ যৌবনের কত বসন্তই তো অনায়াসে পার হইয়া গেল। আর কিরীটীর কণ্ঠস্বর শুনিলেই কেন শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় আসিয়া জমা হয়? মুখ দেখিলে কেন সমস্ত ভুল হইয়া যায়?
বন্ধুর বেশে এ পরম শত্রু!
কিরীটীর আবার না পারিবার আছে কি? নিজের সঙ্গে এমন যুদ্ধ করিতে হয় তাহাকে? বড় জোর আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব, তার বেশী নয়। নিজের হাতে নিজের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিবার যে যন্ত্রণা, সে যন্ত্রণার ধারণা কি কিরীটীর আছে?
হঠাৎ কেমন রুক্ষ শোনায় তাপসীর গলার স্বর। আমি পারছি না আর! দয়া করে রেহাই দিন আমায়!
–দয়া? রেহাই? আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না তাপসী!
–বুঝতেও হবে না কষ্ট করে! এইটুকু জেনে রাখুন আপনার সংস্রব আমার অসহ্য!
না, কিরীটীও আহত হয় তবে! ছাইয়ের মত সাদা দেখায় কেন তাহার মুখটা?
–জানলাম। এদিকটা সত্যিই ভেবে দেখিনি কোনদিন। নিছক ভদ্রতা রক্ষার দায়ে তরে কি দুর্ভোগই ভুগতে হয়েছে তোমাকে, আর তারই সুযোগে এতদিন অনর্থক বিরক্ত করে এসেছি আমি! যাক নির্বোধ লোক তো থাকবেই পৃথিবীতে, কি বলো? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে–যা বলবার ছিল সেটা বলে ফেলিনি! বললে হয়তো শুধু নির্বোধই বলতে না, পাগল বলতে!-আচ্ছা চলি।
সত্যই চলিয়া গেল।
তাপসীর মুখের কথাটাই সত্য বলিয়া জানিয়া গেল তবে? কিন্তু এ কি শুধু কথা? তীক্ষ্ণ তীর নয় কি? তীক্ষ্ণ আর বিষাক্ত?
.
আহারের টেবিলে গত সন্ধ্যার কথাটা পাড়িল সিদ্ধার্থ। দিদির ‘ঢং’ লইয়া দিদিকে দুই ভায়ে খানিকটা বাক্যযন্ত্রণা দেওয়ার শুভবুদ্ধির বশেই বোধ করি কথাটা পাড়িয়াছিল বেচারা, কিন্তু অমিতাভ ঘটনাটা শোনামাত্রই জ্বলিয়া উঠিয়া বলে–চলে এসে এমন কিছু বাহাদুরি হয়নি, উচিত ছিল না যাওয়া। কিন্তু সক্কালবেলাই আবার কি করতে এসেছিল ওটা? মান-অপমানের লেশ নেই?
সিদ্ধার্থ অবাক হইয়া বলে–ও কিরে দাদা, ভদ্রলোকের সম্বন্ধে হঠাৎ এরকম বেপরোয়া কথাবার্তা বলছিস যে?
–আরে যা যা, রেখে দে তোদের ভদ্রলোক! ভদ্রলোক হলে ভেতরে একটু আত্মসম্মান জ্ঞান থাকত!
সিদ্ধার্থ বরাবরই কিছুটা কিরীটীর দিকে ঘেঁষা, তাই তর্কের সুরে বলে–নেই তারই বা কি প্রমাণ পেলি হঠাৎ?
–চোখ থাকলেই দেখতে পেতিস। নেহাৎ মার আদরের অতিথি বলেই চুপচাপ থাকি, নইলে একদিন আচ্ছা করে এমন শুনিয়ে দিতাম যে ভদ্রলোককে আর এ বাড়ীর গেট পার হতে হত না!
সিদ্ধার্থর অবশ্য কিরীটীর উপর দাদার অকারণ এই তিক্তভাবের খবরটা কিছু কিছু জানা ছিল, কিন্তু এমন প্রকাশ্যে যুদ্ধ-ঘোষণায় সত্যই অবাক হইয়া যায় এবং অমিতাভর মন্তব্যটা দিদির মুখচ্ছবির উপর কতটা প্রভাব বিস্তার করিল, আড়নয়নে একবার দেখিয়া লইয়া বলে কি ব্যাপার বল্ তো দাদা? মিস্টার মুখার্জি তোর কাছে টাকা ধার করে শোধ দিতে ভুলে যাননি তো?
–যা যা, বাজে-মার্কা ইয়ার্কি করতে হবে না। আমি জানতে চাই, ও যখন-তখন এ বাড়িতে আসে কি করতে? কি দরকার ওর?
তাপসী এতক্ষণ নিরপেক্ষভাবেই মাছের কাটা বাছিতেছিল, এখন অমিতাভর কথা শেষ হইতেই সহসা আরক্তমুখে বলিয়া ওঠে–বাড়িটা আশা করি তোমার একলার নয়!
চশমার কোণ হইতে অবহেলাভরে একবার দিদির দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া অমিতাভ উত্তর দেয়–আজ্ঞে জানা আছে সে কথা, এবং সেই জন্যেই বেশী কিছু বলি না।
–ভদ্রলোক ভদ্রলোকের বাড়ীতে আসবে এতে বলবারই বা কি আছে রে বাপু তাও তো বুঝি না!
সালিশীর সুরে সিদ্ধার্থ আপন মতামত ব্যক্ত করে। কিন্তু অমিতাভ নিবৃত্ত হয় না, আরো তীক্ষ্ণস্বরে বলে–ভদ্রলোক যদি শুধু ভদ্রভাবে লোকের বাড়ী বেড়াতে আসে কিছুই বলার থাকে না, কিন্তু একটা মতলব নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে ঘৃণা করবই। শুধু তাকে নয়–যারা তাকে প্রশ্রয় দেয় তাদেরও।
অর্থাৎ মাকে দিদিকে সে আজকাল ঘৃণা করিতেই আরম্ভ করিয়াছে।
তাপসীকে উত্তেজিত হইতে বড় একটা দেখা যায় না, মা’র সঙ্গে কথা কয় এত ঠাণ্ডা মাথায় যে চিত্রলেখাই জ্বলিয়া যায়। কিন্তু অমিতাভর কথায় বড় বেশী উত্তেজিত দেখায় তাহাকে। উত্তেজনার মুখে তর্কের খাতিরে হয়তো বা নিজের মতবিরুদ্ধ কথাই বলে। কিংবা মতবিরুদ্ধ নয়ও–নিজের মনের আসল চেহারা নিজেরই জানা নাই তাহার, উত্তেজনার মুখে প্রকাশ হইয়া পড়ে। বলে–তাই যদি হয়, সেটা কি খুবই সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড হবে তুমি মনে করো অভি? এতই যখন বুঝতে শিখেছ–এটুকুও বোঝা উচিত ছিল-তোমার ভাষায়–’মতলব নিয়ে ঘোরাঘুরি করাটা’ অসম্ভব কিছুই নয়, অস্বাভাবিক নয়।
–হতো না–যদি বাড়ীর সকলের জীবনটাও ঠিক স্বাভাবিক হতো! বলিয়া চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়ায় অমিতাভ।
.
সন্দেহের অবকাশ আর থাকে না। বোঝা যায় চিত্রলেখার শিক্ষা সকল ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হইয়াছে। অতি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ অমিতাভর চিত্তবৃত্তিও শিকড় গাড়িয়া বসিয়া আছে পিতামহীর আমলের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধকার বনভূমিতে। তাপসীর সেই খেলাঘরের বিবাহটাকে ‘খেলা’ বলিয়া উড়াইয়া দিবার সাহস বা ইচ্ছা তাহারও নাই। তাই তাপসীর প্রণয়লাভেছু কিরীটীকে দেখিলে আপাদমস্তক জ্বলিয়া যায় তাহার, আর যদিও তাপসী ‘বড়ত্বের’ দাবী রাখে, তবু ‘দাদাগিরি’ ভাবটা বরাবর অমিতাভ ফলাইয়া আসিয়াছে বলিয়াই নিজের বিরক্তি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করিতে দ্বিধা করে না।
কিন্তু তাপসীই বা হঠাৎ এত জোর পাইল কোথায়? নিজের বিষয়ে সাহস করিয়া বলিবার মত জোর? অমিতাভর কাছে তো চিরদিনই কাঁদিয়া পরাজয় মানিয়া আসিয়াছে সে। অথচ যা বলে চিত্রলেখা শুনিলে অবাক বনিয়া যাইত।–স্বাভাবিক নয় বলে যে তাকে স্বাভাবিক করে নেবার চেষ্টামাত্র না করে ভাসিয়ে দিতে হবে, জীবন জিনিসটা কি এতই সস্তা অভী?
–তা বেশ তো, জীবনটা দামী করে ভোলো না! অমিতাভর সুরে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ, বরং মা’র মনে একটা সান্ত্বনা থাকবে যে একজনও মানুষ হল! তবে এও জেনো, এ বাড়ীর ভাত বেশী দিন বরখাস্ত করা আমার পক্ষে শক্ত।
–কি বাজে বাজে বকছিস দাদা? সিদ্ধার্থ কথাবার্তার সুর লঘু করিয়া আনিতে চেষ্টা করে।
অমিতাভ কিছু বলিবার আগেই রঙ্গস্থলে আসিয়া হাজির হয় চিত্রলেখা। মনে হয় যেন আগাগোড়া বর্মাবৃত অবস্থায় সাঁজোয়া গাড়ীতে চড়িয়া একেবারেই ফিল্ডে নামিয়াছে সে। রণং দেহি’র সুরেই বলে–দেখ বেবি, অভী তুমিও রয়েছ ভালই–আমি আজ সন্ধ্যায় একটা পার্টি দিতে চাই। মিস্টার মুখার্জি হবেন তার প্রধান অতিথি। বেবির এনগেজমেন্টটা আজ পাঁচজনের সামনে পাকাপাকি করিয়ে নিয়ে তবে আমার কাজ। এভাবে বেশীদিন সমাজের সকলের আলোচনার বস্তু হয়ে থাকা আমার রুচিবিরুদ্ধ।
চিত্রলেখার কপাল জোর, এইমাত্র অমিতাভর সঙ্গে ঝগড়ায় জিতিতে গিয়া এরকম কথা বলিয়া বসিয়াছে তাপসী, এখন অমিতাভর সামনেই বা মার কথার প্রতিবাদ করে কোন মুখে!
আড়চোখে একবার মেয়ের দিকে তাকাইয়া লয় চিত্রলেখা–না, কোনো প্রতিবাদ আসিল না। ভাগ্যিস! খুব ঝোঁপ বুঝিয়া কোপ মারা হইয়াছে! হুঁ বাবা, এইবার ধরা পড়িয়া গিয়াছ! যতই হোক, চিত্রলেখার বুদ্ধির কাছে তোদের বুদ্ধির গুমর!
অবশ্য বিধাতাপুরুষও এবার চিত্রলেখার সহায় হইয়াছেন। বেবির গতরাত্রের নাহোক ‘মাথাধরা’র পর ভোরবেলাই কিরীটীর হন্যে হইয়া ছুটিয়া আসা এবং তখন দিব্য সপ্রতিভ বেবির তাহার সঙ্গে সপ্ৰেম হাস্যপরিহাসের দৃশ্যটা দোতলার জানালা হইতে যা-ই চোখে পড়িয়াছিল তাহার, তাই না এত সাহস!
যা ভাবিয়াছিল সে তাছাড়া কিছুই নয় বাপু, বুঝিতে বাকি নাই তাহার। কালকের কিছু একটা বেয়াদবির জন্যই অপরাধী ব্যক্তিটি সকাল না হইতেই ছুটিয়া আসিয়াছিল মার্জনা ভিক্ষা করিতে।
আসিবেই তো–মেয়েদের চিনিতে যে এখনো অনেক দেরি আছে তাহার। শুধু তাহার কেন, গোটা পুরুষ জাতটারই। কিন্তু চিত্রলেখা তো আর পুরুষ নয় যে জানিতে বাকি থাকিবে তাহার-বেয়াদবিটাই পছন্দ করে মেয়েরা। বরং প্রার্থিত বেয়াদবির অভাব দেখিলেই অসহিষ্ণু নারীপ্রকৃতি খাপছাড়া ভাবে বিগড়াইয়া যায়। কিন্তু এমন মূল্যবান তথ্যটা তো আর ভাবী জামাতাকে শিখাইয়া দিবার বিষয় নয়, দিবার হইলে এতদিনে কিরীটীর ব্যাপারের সুরাহা হইয়া যাইত।
অমিতাভ মার দিকে ও বোনের দিকে এক সেকেন্ড তাকাইয়া লইয়া বলে–পার্টি দেবে– সেটা তোমার বিজনেস, তাতে আমাদের অনুমতির দরকার হবে না নিশ্চয়ই?
–অনুমতির দরকার হবে, এখনো এতটা দুর্ভাগ্য হয়নি বলেই বিশ্বাস, তবে কিছুটা সাহায্যের দাবি রাখি। আমি এখন যাদের যাদের বলবার বলতে বেরোচ্ছি–ঘুরে এসে নিমন্ত্রিতদের একটা লিস্ট তোমায় দেব, তুমি কয়েকটা জিনিস আমায় এনে দেবে, আর নিউমার্কেট থেকে কিছু ফুল। খাবার-টাবার সম্বন্ধে আমি নিজেই সমস্ত ব্যবস্থা করব, তোমাদের কোনো ভার দিতে চাই না।
–গাড়ী ঘুরিয়ে নিউমার্কেট থেকে ওই সামান্য জিনিস ক’টা আর ফুলও তুমি অনায়াসেই আনতে পার মা, ওর জন্যে আর আমাকে ভার দিয়ে খেলো হবে কেন? তাছাড়া আমি আজ বাড়ী থাকছি না–বলিয়া অমিতাভ ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া যায়।
–চমকার ভাগ্যটি আমার বটে! চিত্রলেখা উল্টানো দুই হাতের সাহায্যে ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া অমিতাভর পরিত্যক্ত চেয়ারটা টানিয়া বসিয়া পড়িয়া বলেসতীনের ছেলেমেয়েকে প্রতিপালন করলেও বোধহয় এর থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়া যেত তাদের কাছ থেকে।
.
ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাইলেও চিত্রলেখা অনুষ্ঠানের ত্রুটিমাত্র রাখিল না। এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন সৌষ্ঠবসম্পন্ন ভাবে কাজ করা যে একমাত্র চিত্রলেখার পক্ষেই সম্ভব সে কথা তাহার পরম শত্রুতেও অস্বীকার করিতে পারিবে না।
সম্ভব হইয়াছে কি আর অমনি? সমস্ত জীবনটাই চিত্রলেখা উৎসর্গ করিয়া দিয়াছে কাহার পায়ে? ওই সভ্যতা-সৌষ্ঠবের পায়েই নয় কি?
প্রতিনিয়ত পারিপার্শ্বিক সমস্ত প্রতিকূলতার সহিত সংগ্রাম করিতে করিতে ক্ষত-বিক্ষত হইয়াছে, স্বামী-সন্তান সকলের সহিত বিরোধ করিয়া আসিয়াছে, নিজে মুহূর্তের জন্য বিশ্রামের শান্তি উপভোগ করিতে পায় নাই, তবু হাল ছাড়ে নাই। তাই না আজ দশের একজন হইয়া সমাজে বিচরণ করিতেছে। তবু তো ছেলেদের মানুষ করিয়া তুলিবার জন্য কতই পরিকল্পনা ছিল, কিছুই প্রায় সফল হয় নাই, উপযুক্ত অর্থের অভাবে অনেক উচ্চ আদর্শকে খর্ব করিতে হইয়াছে।
হায়, ছেলেমেয়েরা চিত্রলেখার সে আত্মত্যাগের মর্ম কোনদিন বুঝিল না। কাহাদের জন্য চিত্রলেখার এই সংগ্রাম, এই সাধনা? কি নিরুপায় অবস্থার মাঝখানে ভাসাইয়া দিয়া স্বামী চলিয়া গেলেন, একদিনের জন্য কি সে অবস্থার আঁচ তাহাদের গায়ে লাগিতে দিয়াছে চিত্রলেখা? একা অসহায়া নারী সমস্ত দায়িত্ব বহন করিয়া লগি ঠেলিতে ঠেলিতে মাঝদরিয়া হইতে তীরের কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছিয়াছে আজ। কিন্তু বেচারা চিত্রলেখার ভাগ্যে যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর! ছেলেমেয়েরা এমন ভাব দেখায় যেন চিত্রলেখা আজীবন তাহাদের অনিষ্ট করিয়াই আসিতেছে! যেন সেই বুড়ী ঠাকুরমার কাছ হইতে গোবর-গঙ্গাজলের দীক্ষায় দীক্ষিত হইয়া জীবন কাটাইতে পারিলেই তাহাদের ছিল ভালো! কী নিষ্ফল জীবন চিত্রলেখার!
তবু তোকই ওদের হিতচেষ্টা হইতে নিবৃত্ত হইতে পারে না। বেবির কাছ হইতে শত লাঞ্ছনা গঞ্জনা খাইয়াও বেবির জন্যই অসাধ্য সাধনের সাধনা করিয়া মরিতেছে। তাহাকে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত না দেখা পর্যন্ত মরিয়াও যে শান্তি হইবে না চিত্রলেখার।
এই যে আজকের ব্যাপারটা, এর জন্য কত কাঠখড় পোড়াইতে হইয়াছে, হইতেছে এবং হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে–কে তাহার হিসাব রাখে? এর জন্য কতদিন কতদিকে যে কৃচ্ছসাধন করিতে হইবে! ইচ্ছামত অর্থব্যয় করিবার সামর্থ্যও যদি থাকিত আজ!
মণীন্দ্রর জন্য মন-কেমন না করিয়া হিংসাই হয়। যেন সব কিছু জ্বালা-যন্ত্রণা চিত্রলেখার ঘাড়ে চাপাইয়া টেক্কা মারিয়া চলিয়া গিয়াছেন মণীন্দ্র।
আজকের ব্যাপারে চিত্রলেখার পরিশ্রমের চাইতে উদ্বেগটাই ছিল প্রবল, যে মেয়ে শেষ পর্যন্ত সহজ থাকিলে হয়! নিজের সন্তানকে চিনিতে পারা যায় না, এর চাইতে দুর্দান্ত পরিহাস আর কি আছে জগতে!
নিমন্ত্রিতের সংখ্যা বিরাট কিছু নয়। নিতান্ত বন্ধুগোষ্ঠী কয়েকজন, যাঁহাদের কাছে সবকিছু দেখাইয়া তৃপ্তি নাই। আর চিত্রলেখার সেজকাকীমার পরিবার। অনেক ভাগ্যে এ সময়টা যখন কলিকাতায় রহিয়াছেন তাহারা। দেখিবার এবং দেখাইবার এমন সুযোগ ক’বার আসে? কিরীটীর মত জামাই সংগ্রহ করা যে সেজকাকীর স্বপ্নেরও বাহিরে, এ কি আর বলিয়া বুঝাইতে হইবে? তাহার মেয়ের তো সেই রূপ! কালো হাতী’ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। তার উপর আবার নাকি বার দুই আই.এ. ফেল করিয়া নামকাটা সেপাই হইয়া বসিয়া আছে।
কন্যার সৌন্দর্য-গর্বে নূতন করিয়া যেন বুকটা দশহাত হইয়া ওঠে।
তাছাড়া বিদ্যা? টকাটক করিয়া এম.এ. পর্যন্ত পাস করিয়া ফেলিল, হোঁচট খাইল না, ধাক্কা খাইল না–শুধু একটি জিনিসের নিতান্তই অভাব, যে অভাবটা চিত্রলেখার মনে একটা গহর রাখিয়া দিয়াছে।
মডার্ন কালচারের অভাব। বেশভূষার পারিপাট্য যে নাই মেয়ের তা নয়, তবু কেমন যেন সামঞ্জস্যহীন, অসম্পূর্ণ। হয়তো দশদিন খুব বাড়াবাড়ি করিল, আবার দশদিন যেমন তেমন করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে শুরু করিল। সেই মূর্তি লইয়া বাহিরের লোকের সামনে বাহির হইতেও আপত্তি নাই। এ আর শোধরানো গেল না। তাছাড়া নাচ-গানের দিকেও আজকাল আর যাইতে চাহে না, অকৃত্রিম সাধারণ গলায় কথা বলে, কথাবার্তা কোন কিছুরই কায়দা জানে না।
অথচ সেজকাকীমার মেয়ে লিলি, সেই পাটের গাঁটের মত দেহটা লইয়া কি নাচ নাচিয়াই বেড়ায়!…কথায়-বার্তায় চাল-চলনে একেবারে কায়দা-দুরস্ত!
.
পাঁচটা বাজিতেই লিলি আসিয়া হাজির হইল। মা আসিতে পারিবেন না, তাই একাই আসিয়াছে সে। চিত্রলেখার রোষক্ষুব্ধ প্রশ্নের উত্তরে মিহি মিহি আদুরে গলায় বলে–কি করব বলুন বড়দি, মা’র যে ভীষণ মাথা ধরে উঠল, আমারই আসা সম্ভব হচ্ছিল না, নেহাৎ আপনি দুঃখিত হবেন বলেই
–অসীম দয়া তোমার এবং তোমার মা’র–কিন্তু সেজকাকা?
–বাবার তো কদিন থেকেই প্রেসার বেড়েছে।
–ওঃ! টম জিম?
–তাদের যে আজ ম্যাচ রয়েছে।
–শুনে খুশী হলাম। এরকম মণিকাঞ্চন-যোগ হওয়াটা একটু আশ্চর্য এই যা! ভারী মুখে সরিয়া যায় চিত্রলেখা অন্য অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা করিতে। যা করিবে সবই তো একা। আজ বেবি বিয়ের কনে, তাকে কিছু আর এ ভার দেওয়া চলে না।…আর কিছুই নয়, এটি সেজকাকীমার ঈর্ষার ফল! দেখিলে বুক ফাটিয়া যাইবে তো!
লিলি ছুটিয়া আসিয়া বলে–এই বেবি, তোর বর কখন আসবে তাই ব! সত্যি বলতে, ওই জন্যই এলাম আরো!
তাপসী হাসিয়া বলে–ও কি, বরং বলো ‘জামাতা বাবাজী’! মাসী হও না তুমি আমার?
–ছেড়ে দে ওকথা। সত্যি বল না রে?
–কি করে জানব? এলেই দেখতে পাবে।
–ইস্, উনি জানেন না আবার! বলবি না তাই বল!…এই শাড়ীখানা কত দিয়ে কিনলি রে? ফাইন শাড়ীখানা!
তাপসী হাসিয়া বলে–আমি কোথায় কিনলাম, মা তো–মায়েরই পছন্দ।
–মা! মাই গড! এখনো তোর শাড়ী-ব্লাউজ বড়দি পছন্দ করে দেন? আছিস কোথায়? বরটিকে পছন্দ করার ভারটা নিজের ভাগে রেখেছিস কিছু, না সেও মা যা করবেন!
–নিশ্চয় তো, আমি ও নিয়ে মাথা ঘামাইনে।
–ইস্, ইনোসেন্ট গার্ল একেবারে! তবু যদি না সেদিন বড়দির মুখে শুনতাম, রুমাল মুখে– চাপিয়া খুক খুক’ করিয়া হাসিতে থাকে লিলি।
তাপসী সহসা গম্ভীর হইয়া বলে–কি শুনলে?
–এই–সে বেচারা প্রেমে সাঁতার-পাথার খাচ্ছে একেবারে, আর তুমি—
হঠাৎ যেন চকিতে শিহরিয়া ওঠে তাপসী–এই এই, রুমালে লেগে যায়নি তো?
হতচকিত লিলি বলে–লেগে যাবে? কি লেগে যাবে?
–রং! তোমার কোটিংটা বোধ হয় কাঁচা রয়েছে এখনো!
কথাটা মিথ্যা নয়, লিলিকে দেখিলে একটি সদ্য-রং করা কাঁচামাটির পুতুল বলিয়াই মনে হয়।
লিলি পরিহাসপ্রিয় বটে, কিন্তু নিজে পরিহাস করা এক, আর অপরের পরিহাস পরিপাক করা আর। তাই মুখ ফুলাইয়া উত্তর দেয়–কি করব বলল, তোমার মতন খাঁটি পাকা রং নিয়ে তো জন্মাইনি ভাই, আমাদের কাঁচা রং মাখা ভিন্ন উপায় কি!
তাপসী তাড়াতাড়ি বলে–আচ্ছা রোসো, কাঁচা-পাকার তর্ক এসে করব, একবার নীচের তলা থেকে ঘুরে আসি। মা একটা কাজ বলেছিলেন, দারুণ ভুলে গেছি।মাসীর হাত এড়াইবার এই সহজ কৌশলটা আবিষ্কার করিয়া বাঁচিয়া যায় যেন। এই ধরনের পচা পুরনো সস্তা রসিকতাগুলো সহ্য করা যে তাপসীর পক্ষে কত বিরক্তিকর, সে কথা কে বুঝিবে? নিতান্তই নাকি পরিহাসের উত্তরে হাস্য-পরিহাস না করিলে অভদ্রতা হয়, তাই নিজেরও তাহাতে যোগ দেওয়া। যাহা বলিতে হইয়াছে, তাহার জন্যই যেন তিক্ত হইয়া ওঠে মনটা।
দূর ছাই, এদের কবলমুক্ত হইয়া কোথাও সরিয়া পড়াই ভালো। বাগানের মধ্যে প্রিয় পরিচিত সেই জায়গাটিতে বরং বসা যাক খানিক একদা মণীন্দ্র যে জায়গাটিতে একটা সিমেন্টের বেদী গাঁথাইয়া রাখিয়াছিলেন, মাঝে মাঝে আসিয়া বসিবার জন্য। জায়গাটা তাপসীর একান্ত প্রিয়। আসিয়া বসিলেই যেন বাবার উপস্থিতি অনুভব করা যায়।
.
তাপসী চলিয়া গেলে লিলি রাগে ফুলিতে থাকে। বাস্তবিক, কাঁচা রং-এর উল্লেখে কোন মেয়েই বা অপমানের জ্বালায় ছটফট না করে! সত্যি বলিতে কি, তাপসীর উপর একটা আকর্ষণ অনুভব করিলেও, ওই যে ওর কেমন একটা স্বাতপ্রিয় আভিজাত্যের ভাব আছে, ওইটাই লিলির হাড়পিত্ত জ্বালাইয়া দেয়!
আর কিছু নয়, রূপের গরব! তেমনি একচোখো ভগবান! রূপ দিয়াছ, দিয়াছ স্বাস্থ্যটাও কি এমন অনবদ্য দিতে হয় যে, রোগা হইতে জানে না, মোটা হইয়া পড়ে না বরাবর এক রকম! যেন একটি নিটোল পাকা ফল! রসের প্রাচুর্য আছে–আধিক্য নাই! শাঁস আছে–ভার নাই!
আর লিলি? লিলির বিধাতা শৈশবাবধি এত শাঁসালো আর রসালো করিয়া গড়িয়াছেন। লিলিকে যে আধুনিক হইবার সমস্ত উপকরণই যেন তাহার দেহে উপহাস হইয়া দাঁড়ায়। অতএব সুমধ্যমা তন্বী রূপসীদের উপর যদি সে হাড়ে-চটা হয় তো দোষ দেওয়া যায় না! তাহার উপর আবার যদি সে রূপসী একটি কন্দর্পকান্তি বর যোগাড় করিয়া ফেলে!
.
হায়, শুধু কি লিলিই জুলিতে থাকে? তাপসীর ভিতর কি দুর্দমনীয় জ্বালা, সে কথা বুঝিবার সাধ্য লিলির আছে?
নিজেকে সমস্ত কোলাহল আর সমারোহের মাঝখান হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লইয়া বাগানের একপ্রান্তে গিয়া নিজেকে যেন ছাড়িয়া দেয় তাপসী। হে ঈশ্বর, এ কি করিতে বসিয়াছে সে? অমিতাভর উপর প্রতিশোধ লইতে গিয়া নিজেকে কোন্ অধঃপাতের পথে ঠেলিয়া দিবার আয়োজন শুরু করিয়াছে?
অধঃপাত ছাড়া আর কি বলা যায়? আর ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে এতগুলো লোককে সাক্ষী রাখিয়া কিরীটীর সঙ্গে বিবাহবন্ধন পাকা করিয়া ফেলিবার দলিলে সই করিতে হইবে তাহাকে! আত্মহত্যা ছাড়া আত্মরক্ষার আর কোন উপায় থাকিবে না তাহার!
বাবা বাবা! তুমি কেন তোমার আদরের বেবির জীবনের এই জটিল জটটা না ছাড়াইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া চলিয়া গেলে? নিঃসঙ্গ তাপসীর আশ্রয় কোথায়? কে তাহাকে সত্যকার উচিত অনুচিত শিক্ষা দিবে?
যখন নিজের হৃদয়ের সঙ্গে আপস ছিল, তখন তবু সহজ ছিল। সহজ ছিল চিত্রলেখার অসঙ্গত ইচ্ছাকে হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া। আজ যে দ্বন্দ্ব বাধিয়াছে আপন হৃদয়ে, একে উড়াইয়া দেওয়া আর সহজ কই!
অমিতাভ ছেলেমানুষ হইলেও উচিত কথাই বলিয়াছিল। সত্যই তো, কি প্রয়োজন ছিল কিরীটীকে এত প্রশ্রয় দিবার? দিনের পর দিন কিসের আশা দিয়া তাহাকে প্রলুব্ধ করিয়া আসিয়াছে তাপসী? নিজের মনের–নিজের অজানিত চাপা লোভের বশেই নয় কি? সেই লোভই ভদ্রতার ছদ্মবেশে পদে পদে প্রতারিত করিয়াছে তাপসীকে। কিরীটীকে প্রত্যাখ্যান করিবার মত সাহস যোগাইতে দেয় নাই। বিদ্রোহের একটা ভান করিয়া আসিয়াছে বটে বরাবর, কিন্তু আত্মসমর্পণে উন্মুক্ত চিত্র লইয়া বিদ্রোহের অভিনয় করার কি সত্যই কোনো মানে আছে? হয়তো বা–হয়তো বা এতদিন যে বিকাইয়া যায় নাই, সে শুধু কিরীটীর ভীরুতার জন্যই–দস্যর মত লুণ্ঠন করিয়া লইবার শক্তি কিরীটীর নাই। প্রার্থীর মত অপেক্ষা করে। অসতর্ক কোনো মুহূর্তে ওর এই নিশ্চেষ্ট সম্ভ্রমের ভঙ্গী কি অসহিষ্ণু করিয়া তুলে নাই তাপসীকে?
যদি কিরীটীর দিক হইতে সাহসের প্রাবল্য থাকিত, তাপসী কি খুঁটি আঁকড়াইয়া টিকিয়া থাকিতে পারিত? কে জানে, কোনোদিন তো এমন স্পষ্ট করিয়া মনকে প্রশ্ন করিয়া দেখে নাই। সভয়ে পাশ কাটাইয়া চলিতে চেষ্টা করিয়াছে মাত্র।
অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করিতে করিতে হঠাৎ এক সময়ে যেন কঠিন হইয়া ওঠে তাপসী। প্রশ্নে প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করিয়া তোলে নিজেকেই। কেন, কেনই বা সে চিরকাল এমন বঞ্চিত হইয়া থাকিবে? পাপের ভয়ে? না সেই খেলাঘরের বরের আশায়?
দু’টোই সমান অর্থহীন। যে কাজের জন্য সে নিজে এক বিন্দু দায়ী নয়, তাহার পাপ-পুণ্যের ফল ভুগিয়া মরিবার দায় কেন তাহার?…বোকামি? স্রেফ বোকামি–আশাহীন আনন্দহীন প্রেমস্পর্শহীন নিরর্থক জীবনটা জনশূন্য ঘরে নিরর্থক জ্বলিয়া যাওয়া মোমবাতির মত কেবলমাত্র জ্বলিয়া জ্বলিয়া নিঃশেষ হইতে থাকিবে?
প্রতিনিয়ত নিজেকে চাবুক মারিয়া মারিয়া ধর্ম বজায় রাখাই কি নারীধর্ম? চাবুক শুধু নিজেকে মারা নয়–আরো একখানি আগ্রহোম্মুখ প্রসাদ-ভিক্ষু হৃদয়কেও যে চাবুক মারিয়া ফিরাইতে হইতেছে!..বুলু বুলু! কোথায় সেই অপরিণতবয়স্ক বালক? সে কি আজও বাঁচিয়া আছে? স্বামীত্বের দাবী লইয়া কোন দিন কি উপস্থিত হইবে তাপসীর কাছে? স্বামী বলিয়া গ্রহণ করিতে পারা যায় এমন যোগ্যতা অর্জন করিয়াছে কি? তাপসী কি তাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইবে?
কিন্তু তাপসীর সহায় কে? মা প্রতিকূল, অভী নিতান্তই বিমুখ। বাবলু তো বালক মাত্র। তবে কে? নানি? নানিই তো তাহার জীবনের শনি।…নয়তো কি? মনে মনে সেই শনিকে উদ্দেশ করিয়াই প্রশ্নে জর্জর করিতে থাকে তাপসী।…কেন? কেন? অমন উদাসীন নিশ্চিন্ততায় কাশীবাস করিবারই বা প্রয়োজন কি ছিল তোমার? যে জট পাকাইয়া রাখিয়াছ, তাহার গ্রন্থি খুলিবার দায়িত্ব কি কিছুই নাই তোমার? একবার কি কুসুমপুরে যাওয়া যায় না? কাশীর মায়া কাটাইয়া দেশে আসিয়া একবার খোঁজখবর লওয়া উচিত ছিল না কি? তাপসীর ইহকাল পরকাল খাইয়া চিত্রলেখার উপর অভিমান করিয়া দিব্য আরামে বসিয়া আছ, বিকার মাত্র নাই?
নানির সঙ্গে একবার নিজেই যদি দেশে যাইতে পাইত তাপসী! খুঁজিয়া দেখিত–দেবমন্দিরের সেই উদার প্রাঙ্গণে সেই স্থলকমলের মত আরক্তিম দুখানি পায়ের ছাপ আজও আছে কিনা?
ধ্যেৎ! এ কি পাগলের মত ভাবনা শুরু করিয়া দিয়াছে তাপসী! বাঁচিয়াই যদি থাকে, সেই অগাধ ঐশ্বর্যের মালিক এখনো গৃহিণীশূন্য গৃহে নীরস জীবনযাপন করিতেছে নাকি? পাগল! তাও আবার পাড়াগাঁয়ের ছেলে! কলিকাতার হোস্টেলে থাকিয়া পড়ালেখা করিবার কথা ছিল। বলিয়াই যে করিয়াছে–তাহারই বা নিশ্চয়তা কি? অল্প বয়সে অনেক পয়সা হাতে পড়ায় কুসঙ্গে পড়িয়া বিগড়াইয়া বসিয়া আছে কিনা কে বলিতে পারে?
সকলের উপর কথা–বাঁচিয়া আছে কিনা! বাঁচিয়া থাকিলে–নিজেই কি এতদিনে একটা সন্ধান লইতে পারিত না? কিন্তু প্রয়োজনই বা কি তাহার? প্রয়োজন থাকিলে হয়তো লইত। অবশ্য প্রথমদিকে এখানের ব্যবহারটা ভদ্রজনোচিত হয় নাই, তবু শিক্ষা-দীক্ষা–যদি সব কিছু। পাইয়া থাকে– সভ্যতা-ভব্যতার একটা মূল্য আছে তো? বিবাহিতা পত্নীর পত্নীত্বকে উড়াইয়া দিয়া–
বিবাহিতা? আচ্ছা, বিবাহটা কি সত্যই শাস্ত্রসম্মত হইয়াছিল? ‘বিবাহ’ বলিয়া গণ্য করা যায় তাহাকে? বহুদিন বহুবার সেই কথাটাই ভাবিতে চেষ্টা করিয়াছে তাপসী, আজকে খোলা চোখে স্পষ্ট করিয়া ভাবিতে বসে। হয়তো যে বাধাটাকে সে দুর্লঙ্ মনে করিয়া এতদিন বিরাট একটা মূল্য দিয়া আসিতেছে, আসলে সেটা কিছুই নয়, বিরাট একটা ফাঁকি মাত্র! শখের যাত্রাদলের রাজারাণী সাজিয়া অভিনয় করার মত। সে অভিনয়ের অন্যতম অভিনেতা কোন্ কালে সেই অভিনয়-সজ্জা খুলিয়া স্বাভাবিক জীবনযাপন করিতেছে।
সেই খামখেয়ালী খেলার অভিনয়ের রাণীত্ব লইয়া, ভিখারিণীর মত নিজেই তাহার দুয়ারে গিয়া দাঁড়াইবে তাপসী? বলিবে–এই দেখ আমি তোমার জন্য দীর্ঘকাল শবরীর প্রতীক্ষা করিতেছিলাম, আজ আসিয়াছি তোমার চরণে শরণ লইয়া ধন্য হইতে!
চিনিতে না পারিয়া সে যদি হাসিয়া ওঠে? যদি পূর্ব অপমানের শোধ লইতে অপমান করিয়া তাড়াইয়া দেয়? নিজের সুশৃঙ্খল জীবনযাত্রার মাঝখানে আকস্মিক উপদ্রব ভাবিয়া অবজ্ঞা করে?
তবু যাইবে নাকি তাপসী? যাইবে সতীনের ঘরে অনধিকার প্রবেশের চেষ্টা করিতে?
ছি ছি!
চিত্রলেখাই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন সংসার-অভিজ্ঞ মানুষ। তাই উড়াইয়া দিবার বস্তুকে চিরদিন উড়াইয়া দিয়াই আসিতেছে। ঘরে বাহিরে কোথাও কোনোদিন সে কথাটুকু উচ্চারিত মাত্র হইতে দেয় নাই।
তাপসী মিথ্যা স্বপ্নের মোহে, মিথ্যা সংস্কারের দাসত্বে আজীবন নিজেও কষ্ট পাইল, মাকেও কম কষ্ট দিল না। চিত্রলেখার এই যে কাঙালপনা, এই যে রোষ ক্ষোভ অসহিষ্ণুতা, সব কিছুর মূল কারণই তো তাপসীর ভবিষ্যৎ সুখের আশা। হয়তো চিত্রলেখার ধারণাটা ভুল, কিন্তু সন্তানের সুখ-চিন্তায় তো ভুল নাই। তবে তাপসী সেই মাতৃহৃদয়কে অবহেলা করিবে কোন্ শ্রেয় বস্তুর আশায়?
আর–আর শুধুই কি মাতৃহৃদয়? আর একখানি উন্মুখ হৃদয়কে চাবুক মারিয়া মারিয়া দূরে সরাইয়া দিবার কঠোর যন্ত্রণা নিজের হৃদয়কেও কি অহরহ ক্ষতবিক্ষত করিয়া তুলিতেছে না?
যাক আর নয়। ঘটনার প্রবাহে নিজেকে এবার ছাড়িয়া দিবে সে। দেখা যাক বিবাহের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের বজ্ৰ ভাঙিয়া আসিয়া তাপসীর মাথায় পড়ে কিনা। স্থানভ্রষ্ট চুলের গোছা ও শাড়ীর আঁচল গুছাইয়া উঠিয়া দাঁড়ায় তাপসী। ছাড়িয়া দিবে নিজেকে আলোর বন্যায়, উৎসবের কলস্রোতে। ছাড়িয়া দিবে নিজেকে মায়ের হাতে। ছাড়াইয়া লইবে নিজেকে বহুদিন-বর্ধিত সংস্কারের কঠিন শিলাতল হইতে।–নিঃশেষে সমর্পণ করিয়া দিবে আপনাকে প্রেমাস্পদের উন্মুক্ত বক্ষে, বলিষ্ঠ বাহুবেষ্টনের মধ্যে। সেই ভালো। তাই হোক। সেইটাই স্বাভাবিক। আজীবন বালবিধবার উদাস-ভঙ্গী আর নিস্পৃহ মন লইয়া এই শোভাসম্পদময়ী ধরণীতে টিকিয়া থাকার কোনো অর্থই হয় না।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্তর নিশ্চিন্ত মনোভাব লইয়াই যেন এবার সে উৎসব সমারোহের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করিতে যায়। হাস্যলাস্যময়ী তাপসীকে দেখিয়া অবাক হোক কিরীটী, মুগ্ধ হোক, ধন্য হইয়া যাক।
চোখ জুড়াক চিত্রলেখার। জ্বলিয়া মরুক লিলি।
অমিতাভ বুঝুক তার পছন্দ-অপছন্দকে কেয়ারও করে না তাপসী। তার প্রিয় ব্যক্তিকে অপমান করিয়া বিতাড়িত করার সাধ্য কাহারও নাই–প্রেমের মর্যাদায় তাহার আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিয়াছে তাপসী।
.
চটিটা পায়ে গলাইতেছে–পিছন হইতে ডাক পড়িল।
না চিত্রলেখার নয়, লিলির নয়, বন্ধু-বান্ধবী কাহারও নয়, নিতান্তই প্রিয় ব্যক্তিটির। যাহার চিন্তায় তাপসীর এত সুখ, এত যন্ত্রণা। যে তাপসীর দিন-রাত্রির শান্তি অপহরণ করিয়া লইয়াও তাপসীর প্রিয়তম।
যে আসিয়াছিল–পিছন হইতে কাঁধের উপর আলগোছে একটু স্পর্শ দিয়া আবেগ-মধুর কণ্ঠে ডাকিল–”তাপসী!”
তাপসী! কিরীটীর এত বড় সাহস বাড়িল কখন? তাপসীর সিদ্ধান্ত জানিয়া ফেলিল নাকি মনে মনে? অথবা চিত্রলেখার সস্নেহ প্রশ্রয়ের জের? তাপসীর কাঁধে হাত রাখিবার মত দুঃসাহস তো গত সন্ধ্যাতেও ছিল না তাহার!
কম্পিত তাপসী ঘুরিয়া দাঁড়ায়। সহজ হইবার চেষ্টায় আরও ভাঙা গলায় বলে–আপনি কখন এলেন?
–এই তো আসছি। গেটটা পার হতেই চোখে পড়ল এই নির্জন কোণে তোমার ধ্যানমগ্ন মূর্তি।…আজকের তুমি, আমার নিজস্ব আবিষ্কার তাপসী।
হায় হায়! নিজেকে যে এতক্ষণ ধরিয়া প্রস্তুত করিল তাপসী, কোথায় গেল সে সব? কোথায় সেই হাস্যেলাস্যে চপলতায় কিরীটীকে বিভ্রান্ত করিয়া ফেলিবার মত নূতন রূপ? আগের মতই অস্বচ্ছন্দ ভাবে বলে–চলুন বাড়ীর ভেতরে যাই।
–না না, থাক। কিরীটী ব্যগ্রস্বরে বলে–বাড়ী তো আছেই, থাকবেওকতকগুলো ঝঞ্জাট, গোলমাল, আর চোখ-জ্বালা আলো নিয়ে।…এমন পরিবেশের মধ্যে তোমাকে পাওয়া দুর্লভ নয়। কি?…বোসো লক্ষ্মীটি!
সন্ধ্যার আভাসে আকাশে পড়িয়াছে ছায়া, মাটির বুকে গোধূলির সোনার ঢেউটা ম্লান হইয়া আসিতেছে…বাগানের এই নিভৃত কোণটিতে তো আরও তাড়াতাড়ি ঘনাইয়া আসিবে অন্ধকার…এখানে একা একা কিরীটীর সঙ্গে মুখোমুখি বসিয়া থাকিবে তাপসী? আশ্চর্য প্রস্তাব তো!
নাঃ, সমর্পণের মন্ত্র বৃথাই এতক্ষণ অভ্যাস করিয়াছে সে। অসঙ্কোচে পাশে আসিয়া বসিতে পারিতেছে কই? বসিতে পারে না, প্রতিবাদও করে না, অভিভূতের মত দাঁড়াইয়া থাকে।
হয়তো এই অসতর্ক মুহূর্তেযদি কিরীটীর বলিষ্ঠ বাহুবেষ্টনীর ভিতর ধরা পড়িতে হইত তাপসীকে সমস্ত সহজ হইয়া যাইত, মোড় ফিরিয়া যাইত তাপসীর বাকি জীবনের, কিন্তু তাহা হইল না। অত সাহস কিরীটীর নাই।
এমনই হয় মানুষের জীবনে। প্রতিনিয়ত এমনি কত সম্ভাবনাময় মুহূর্ত বৃথা নষ্ট হয়–সমস্যা মীমাংসার প্রান্তসীমায় আসিয়া ধাক্কা খাইয়া ফিরিয়া যায় জটিলতার পথে– হৃদয়াবেগের সহজ প্রকাশ আচ্ছন্ন করিয়া তোলে অকারণ কুণ্ঠার কুয়াশা।
দস্যুর মত লুঠ করিয়া লইবার সাহস সকলের থাকে না। কিরীটী তাপসীর মতই ভীরু, কুণ্ঠিত, লাজুক। তাই কাঁধের উপরকার আলগোছ স্পর্শটুকুও সরাইয়া লইয়া শুধু কণ্ঠস্বরে সমস্ত আগ্রহ ভরিয়া বলে–তাপসী শোনোপালিয়ে যেও না। আজ আমাকে কিছু বলতে দাও। যে কথা বলতে না পেরে আমার দিনরাত্রি শান্তিহীন, যে কথা বলবার জন্যে আমার সমস্ত হৃদয় অস্থির হয়ে থাকে, সাহসের অভাবে যা কোনোদিনই বলতে পারিনি, আজকের এই পরম মুহূর্তে বলতে দাও সেই কথাটি।
‘বলতে দাও!’ বলিতে দিবার প্রয়োজন আছে নাকি? তাপসী কি জানে না সেই কথাটি? সৃষ্টির আদিকাল হইতে নারীর উদ্দেশে যে কথা ধ্বনিত হইয়া আসিয়াছে পুরুষের বিহ্বল কণ্ঠে, সেই কথাটিই আর একবার ধ্বনিত হইবে নূতন ছন্দে, নূতন মহিমায়। কিন্তু নারীর কণ্ঠ ধ্বনিত হয় না বলিয়াই কি তাহার কথা অপ্রকাশিত থাকিয়া যায়? নারীর শিরায় শিরায় রক্তের উন্মাদ দোলায় ধ্বনিত হয় না সেই চিরন্তন বাণী? তার নির্বাক ভঙ্গিমায় উচ্চারিত হইতে থাকে না প্রেম নিবেদনের বিহ্বল ভাষা? উচ্চারণ করিবার প্রয়োজনই বা তবে কোথায়? দোক্ত কোমল দুখানি করতল বলিষ্ঠ তপ্ত দুই মুঠিতে চাপিয়া ধরিয়া শুধু পাশাপাশি বসিয়া থাকাই তো যথেষ্ট। বিশেষণ খুঁজিয়া খুঁজিয়া কথা সাজাইবার দুরূহ পরিশ্রম বাঁচিয়া যায়।
কিন্তু পরিশ্রম বাঁচাইবার কৌশল সকলে জানিলে তো! তাপসী এক নিমেষ চোখ তুলিয়া তাকাইয়া অস্ফুটস্বরে যা বলে–শুনিতে পাওয়া গেলে বোধ করি তার অর্থ এই দাঁড়াইত– ওদিকে হয়তো সকলে তাপসীর অনুপস্থিতিতে ব্যস্ত হইতেছে, খুঁজিতে আসিবে এখুনি, অতএব–
–খুঁজুক না, ক্ষতি কি? এই মুহূর্তটি নষ্ট হয়ে গেলে হয়তো আমিও খুঁজে পাব না আমার সাহসকে!
–এত ভয় কিসের?
–ভয়? ঠিক ভয় নয়, তবে ভরসার অভাব বলতে পারো। প্রতিদিন প্রস্তুত হয়ে আসি বলব বলে, কিন্তু ফিরে যাই। তবে আজ নিতান্ত প্রতিজ্ঞা করেই এসেছি…ওকি! তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
–না, কিচ্ছু না। কিন্তু আমি বলি কি–এতদিন যদি না বলেই কেটেছে, তবে আজও থাক।
–কিন্তু কেন? মেনে নাও না নাও–শুনতে তো তোমার ক্ষতি নেই তাপসী!
–ক্ষতি? হঠাৎ তাপসী কেমন অদ্ভুতভাবে হাসিয়া ওঠে–আমার ক্ষতি করার ভারটা স্বয়ং বিধাতাপুরুষ নিজের ঘাড়েই নিয়ে রেখেছেন–মানুষের জন্যে আর বাকি রাখেননি কিছু! তবু থাক।
–তবে থাক, হয়তো আজও সময় হয়নি। কিন্তু শুনতে পারলে বোধহয় ভালোই হত। কিংবা কি জানি, শোনাতে গেলে এটুকু সৌভাগ্যও আমার বজায় থাকবে কিনা! আচ্ছা থাক, আজকের গোলমালটা কেটেই যাক, চলো ভেতরে চলল।
–যাচ্ছি, আপনি যান।
.
এদিকে সত্যই তখন তাপসীকে ডাকাডাকি পড়িয়া গিয়াছে। অতিথি অভ্যাগত সকলেই যে তাপসীকে দেখিতে উৎসুক। চিত্রলেখা কিরীটীকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়াই সহর্যে বলিয়া ওঠে–এই যে এসে গেছ তুমি! বেবির সঙ্গে দেখা হয়েছে?
–হ্যাঁ, ওই যে বাগানের ওদিকটায় দেখলাম যে–
চিত্রলেখা মনে মনে হাসিয়া ভাবে–আহা মরে যাই, ইনোসেন্ট’ একবারে! নিভৃতে দেখা করিবার সুযোগ সৃষ্টি করিতে পূর্বাহ্নেই বাগানে গিয়া বসিয়া আছেন মেয়ে, এটুকু যেন চিত্রলেখা ধরিতে পারিবে না! দেখ দেখি–একটা অর্থহীন কুসংস্কারকে সার সত্য বলিয়া ধরিয়া লইয়া এই আগ্রহ-ব্যাকুল হৃদয়কে দাবাইয়া রাখিয়া কী বৃথা কষ্টই পাইয়াছ এতদিন! যাক, শেষ অবধি যে সুমতি হইল এই ঢের!
স্নেহমধুর কণ্ঠে গগদ ভঙ্গী আনিয়া চিত্রলেখা কিরীটীকে অনুযোগ করে–দেখে চলে এলে যে বড়! ডেকে আনতে হয় না?
–এখুনি আসবেন বোধ হয়।
–বোধ হয়? বাঃ, বেশ ছেলে তো বাপু! আজকের দিনে সে বেচারাকে ‘বোধ হয়’-এর উপর ছেড়ে দিয়ে চলে আসা কিন্তু উচিত হয়নি তোমার। এদিকে সকলে ওর জন্যে ব্যস্ত হচ্ছে। খাওয়ার আগে গান গাইবার, আর খাওয়ার পর গীটার বাজিয়ে শোনাবার প্রোগ্রাম রয়েছে–এদিকে মেয়ে নিরুদ্দেশ! বদ্ধ পাগল একটা! এবার থেকে বাপু আমি নিশ্চিন্ত, ওর পাগলামি সারাবার ভার তোমার!
কিরীটী মনে মনে হাসিয়া ভাবে–পাগলামি সারানোর ভার যে নেবে, সে বেচারাই যে পাগল হতে বসেছে।
অতঃপর চিত্রলেখা আমন্ত্রিতা মহিলাদের সঙ্গে কিরীটীর পরিচয় করাইয়া দিয়া প্রত্যক্ষে তাপসীর অসীম সৌভাগ্যের জন্য প্রশংসা এবং পরোক্ষে ঈর্ষা অর্জন করিতে থাকে। নিজেও বড় কম আত্মপ্রসাদ অনুভব করে না। রূপে-গুণে, বিদ্যায়-বুদ্ধিতে, অর্থে-স্বাস্থ্যে এমন অতুলনীয় জামাতা-রত্ন সংগ্রহ করা কি সোজা ব্যাপার! এই যে এতগুলি ভদ্রমহিলা সভা উজ্জ্বল করিয়া বসিয়া আছেন, ইহাদের মধ্যে কয়জন এমন রত্নের অধিকারিণী? অথবা অধিকারিণী হইবার আশা রাখেন? তাহার নিজের মেয়েটিও অবশ্য দুর্লভ রত্ন, তবু চিত্রলেখার ‘ক্যাপাসিটি’ও কম নয়।…কত কষ্টে, কত চেষ্টায়, কত যত্নে যে এই পরিস্থিতিটির সৃষ্টি করিতে হইয়াছে সে চিত্রলেখাই জানে।
পরিচয়-পর্ব শেষ হইলে চিত্রলেখা আর একবার স্নেহগদগদ কণ্ঠে বলে–নাঃ, বেবিটা দেখছি পাগল হয়ে গেছে! কি অদ্ভুত ছেলেমানুষ দেখেছ? তুমিই একবার যাও বাপু, ডেকে আনো গে। এত লাজুক মেয়ে–উঃ!
মেয়ের লজ্জার বহরে নিজেই যেন হাঁফাইতে থাকে চিত্রলেখা। তবে বেশীক্ষণ আর এই কৃত্রিম হাঁফানির প্রয়োজন হয় না, হাঁফাহাঁফি ছুটাছুটি করিবার উপযুক্ত একটা কারণ সৃষ্টি করিয়া দিয়াছে তাপসী। ডাকিতে গিয়ে আর খুঁজিয়া পাওয়া যায় না তাহাকে। বাগানে নয়, ঘরে নয়, সারা বাড়ীর কোথাও নয়। বাড়ীর খোঁজার পালা শেষ করিয়া বন্ধু-বান্ধবী, আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেকের বাড়ী এবং ক্লাব লাইব্রেরী সর্বত্র তোলপাড় করিয়া ফেলা হয়–দু’দশখানা মোটর লইয়া। একা চিত্রলেখাই নয়, গৃহস্থ আর নিমন্ত্রিত প্রত্যেকেরই ছুটাছুটি হাঁকাহাঁকির আর অন্ত থাকে না।
এমন অনাসৃষ্টি ব্যাপারের জন্য কেহই প্রস্তুত ছিল না, কাজে-কাজেই ইচ্ছামত জল্পনাকল্পনা করিতেও ত্রুটি রাখে না কেহই। পাকা দেখা’র দিন বিয়ের কনে হারাইয়া গেল, এমন মুখরোচক ব্যাপার কিছু আর সর্বদা ঘটে না, অতএব অনেক মন্তব্যই যে রসালো হইয়া উঠিবে এ আর বিচিত্র কি!
বেচারী ভাবী জামাতা কনের এমন অপ্রত্যাশিত ভাব-বিপর্যয়ে বিমূঢ়ভাবে গাড়ীখানা লইয়া বারকয়েক এদিক ওদিক করিয়া একসময়ে কোন্ ফাঁকে নিঃশব্দে চলিয়া যায়।
.
কান্তি মুখুজ্জের প্রতিষ্ঠিত “রাইবল্লভে”র বিগ্রহ ও মন্দিরের তত্ত্বাবধানের ভার শেষ পর্যন্ত রাজলক্ষ্মী দেবীর ঘাড়েই পড়িয়াছে। উপায় কি? আপনার বলিতে কে আর আছেই বা কান্তি মুখুজ্জের? অবশ্য মন্দির রক্ষার পাকা ব্যবস্থা হিসাবে–নিত্যসেবা ছাড়াও নিয়মসেবা, পালপার্বণ। ইত্যাদি বৈষ্ণব শাস্ত্রের তিনশো তেষট্টি রকম অনুষ্ঠানের জন্য সব কিছুই ব্যবস্থা আছে। পূজারী হইতে শুরু করিয়া ফুলতুলসী-যোগানদার মালীটি পর্যন্ত। তবু সবাই তো মাহিনা করা লোক, তাহাদের উপর তদারকি করিতে একজন বিনা মাহিনার লোক না থাকিলে সত্যকার সুশৃঙ্খলে । চলে কই? তাই রাজলক্ষ্মী স্বেচ্ছায় এই ভার মাথায় তুলিয়া লইয়াছেন। আর না লইয়াই বা করিতেন কি? তাঁহারও তো জীবনের একটা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে?
বুলুবাবু তো দীর্ঘকাল সাগরের ওপার হইতে চলিয়া আসিয়া এতদিনে কলিকাতায় কি যেন কাজে লাগিয়াছে। কিন্তু লাগিলেই বা কি? না বৌ, না ঘর-সংসার। বাউণ্ডুলে লক্ষ্মীছাড়ার মত থাকে ফ্ল্যাটে, খায় হোটেলে, অবসর সময়ে হাওয়া-গাড়ীখানাকে বাহন করিয়া গায়ে হাওয়া লাগাইয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। তাহার কাছে আর রাজলক্ষ্মী যাইবেনই বা কোন্ মুখে? একেই তো কলিকাতার নামে গা জ্বলিয়া যায় রাজলক্ষ্মীর–ওই নিজেই সে মাঝে মাঝে আসিয়া যে পিসিকে দেখা দিয়া যায় সেই ঢের!
কতকাল হইল মারা গিয়াছেন কান্তি মুখুজ্জে। তবু এখনো মামার কথা উঠিলে অনেক সময়েই রাগিয়া যা-তা বলিয়া বসেন রাজলক্ষ্মী। ভীমরতি ধরিয়াছিল মামার, তাই একমাত্র নাতিটা, সৃষ্টিধর–বংশধর, তাহাকে লইয়া পুতুল খেলিয়া গিয়াছেন। ছেলেও তেমনি জেদী একগুয়ে, তা নয়তো সেই ‘বেয়াকার’ বিবাহটাকে সত্য বলিয়া আঁকড়াইয়া বসিয়া আছে! এতদিনে একটা বিবাহ করিলে দুইটা ছেলে-মেয়ে হইয়া ঘর আলো করিত। পাত্রীরই কি অভাব? আর বুলুর মত ছেলের? যে বৌ বাঁচিয়া আছে কি মরিয়া গিয়াছে তার নাই ঠিক, ইচ্ছা করিয়া যে সকল সম্পর্ক ধুইয়া মুছিয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া দিয়াছে, সেই বৌয়ের আশায় চিরজীবনটা কাটাইয়া দিবার মতলব নাকি, তাই বা কে জানে? অথচ আশাই বা কিসের? নিজেও তো মুখে আনে না, চেষ্টা করিয়া খোঁজ করা দূরে থাক।
বলিয়া বলিয়া এবং বিবাহের স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করিয়া যখন রাজলক্ষ্মী চুপ করিয়াছেন, তখন হঠাৎ একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে বুলু আসিয়া হাজির।
রাজলক্ষ্মী পূজার ঘরের সলিতা পাকাইতেছিলেন এবং উৎকর্ণ হইয়া কি যেন শুনিতেছিলেন। মোটরের হর্ন শুনিতে পাওয়া গেল! বুলু ভিন্ন আর কে মোটরে চড়িয়া আসিবে এই অজ পাড়াগাঁয়ে? ট্রেনে চড়িতে ভালোবাসে না সে, টানা মোটরেই আসে কলিকাতা হইতে।
অনুমান মিথ্যা নয়, বুলুই বটে।–পিসিমা এলাম! একমুখ হাসি লইয়া সাড়ম্বরে এক প্রণাম।
–এসো বাবা আমার সোনামণি। তবু ভালো যে বুড়ী পিসিকে মনে পড়ল।
–বাঃ, মনে পড়ত না বুঝি! আসা হয় না এই যা। আজ এলাম তোমাকে নেমন্তন্ন করতে।
–আমাকে নেমন্তন্ন? রাজলক্ষ্মী অবাক হইয়া তাকান।
–হ্যাঁ গো পিসিবুড়ী। বৌ বরণ করবে না?
রাজলক্ষ্মী কৌতূহল দমন করিয়া নিস্পৃহ স্বরে বলে–এত ভাগ্যি আর আমার হয়েছে। বৌ বরণ!
–‘হুঁ’ নয়গো পিসিমা, সত্যি। তোমার কষ্ট আর দেখতে পারছি না বাপু।
রাজলক্ষ্মী হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–আমার কষ্টের ভাবনায় তো ঘুম হচ্ছে না তোর! তা যাক, ব্যাপারটা কি? সোন্দর মেয়ে-টেয়ে দেখেছিস বুঝি কোথাও? আহা, ভগবান সুমতি দিন।
–থামো পিসিমা, ভগবানের নাম আর কোরো না আমার সামনে। সেই ভদ্রলোকের দুর্মতির ফলে এই এত জ্বালা মানুষের, আবার তিনিই দেবেন সুমতি! তবেই হয়েছে! সত্যি কথা বললে তো বিশ্বাস করবে না তোমরা। বলছি তোমার কষ্ট দেখে একদিন প্রতিজ্ঞা করে বেরলাম বৌ এনে দেব তোমায়–তারপর এখন এই–বরণ করার খাটুনি তোমার।
–আহা, ওই খাটুনির ভয়েই হাতে পায়ে খিল ধরছে! কিন্তু মেয়ে কেমন তাই বল!
–আগে থেকে বলব কেন? বাঃ, তুমি দেখে বুঝবে পরে।
–তা বেশ, ঘর-টর কেমন খবর নিয়েছিস? সেই তাদের মতন ছোটলোক চামার না হয়।
–চামার-কামার বুঝি না বাপু, তোমার কাছে ধরে এনে দেব, তারপর দেখো।
রাজলক্ষ্মী আবার হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–বাবাঃ, ছেলের মন হয়েছে তো একেবারে মিলিটারী! আমি না হয় একেবারে দুধে-আলতার পাথরেই দেখলাম, কিন্তু ভটচায্যি মশাই, নায়েব মশাই–এঁদের তো একবার পাঠাতে হবে। পাত্রী আশীর্বাদ করা চাই। তাছাড়া বিয়ের হাঙ্গামা কি সোজা? কথায় বলে, লাখ কথা নইলে বিয়ে হয় না! সেবারে এক কথায় বিয়ে দিয়ে মামা তো যা নয় তাই করে গেছেন! আর আমি না দেখে, না শুনে বিয়ে দিচ্ছি না বাপু।
–তবেই হয়েছে! বুলু হতাশার ভান করিয়া বলে–তুমি আমার পাকা খুঁটিটি কাঁচাবে দেখছি! আচ্ছা বাপু, তোমার যা মনে হয় সব কোরো, কিন্তু তার আগে যদি হঠাৎ বৌ এনে হাজির করি, তাড়িয়ে দেবে না তো?
রাজলক্ষ্মী রাগিয়া উঠিয়া বলেন–হ্যাঁ, তাই তো! আমি তোর পাকা খুঁটি কাঁচাবো, বৌ আনলে তাড়িয়ে দেব–খুব বিশ্বাস রাখিস তো আমার ওপর! আমি বলে সাত দেবতার দোর ধরে, সিন্নি মেনে, হরির লুঠ মেনে বেড়াচ্ছি–কি করে তুই ঘরবাসী হবি! তাহলে নিশ্চয় এক বেটি মেম-ফেম বিয়ে করবি ঠিক করেছিস, তাই অত ভয়!
–নির্ভয় হও পিসিমা, সে সব কিছু নয়। যেখানে যা মানত করেছ সব শোধ কোরো বসে। বসে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, তুমি বৌ দেখে অখুশী হবে না। আচ্ছা এবারে কলকাতায় গিয়ে তোমাকে সব বিশদ খবর দিয়ে চিঠি দের, তারপর পাঠিয়ে তোমার নায়েব আর ভট্টচার্য, পাইক আর পেয়াদা।
.
অতঃপর রাজলক্ষ্মী দেবী তোড়জোড় করিয়া বিবাহের উদ্যোগ-আয়োজন করিয়া দেন আর মনে মনে হাসেন। হুঃ বাবা, পিসির কষ্টের জন্যে তো বুক ফাটিতেছে তোমার! আরে বাবা, যতই হোক বেটাছেলে, ভরা বয়েস, কত দিন আর বিধবা মেয়েমানুষের মত হেলায়ফেলায় জীবনটা কাটাইয়া দিবে! তবু যাই খুব ভালো ছেলে আমার বুলু, তাই অতদিন বিলেত ঘুরিয়া আসিয়াও গঙ্গাজলে ধোয়া মনটি। চাঁদের গায়ে কলঙ্ক আছে তো বুলুর গায়ে নেই। আর কিছু নয়–কলিকাতায় তো মেয়ে-পুরুষের মেশামেশি আছে, কোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব হইয়াছে। নিশ্চয়।
এক যুগ আগের দেখা সেই ফুলের মত মুখোনি এক-আধবার মনে পড়িয়া মনটা একটু কেমন করিয়া ওঠে, কিন্তু জোর করিয়া রাগ আনিয়া সে স্মৃতিটুকু চাপা দেন রাজলক্ষ্মী। হুঁ, সেই “গ্যাড-ম্যাড” মেয়ে এতদিনে একটা সাহেব-সুবোকে বিবাহ করিয়া বসিয়া আছে কিনা তাহার ঠিক কি! রুচি-ভক্তি থাকিলে আর এতকালেও একটা খোঁজ করে না!
বেশ করিবে বুলু–আবার বিবাহ করিবে।
জমিদারের বিবাহের উপযুক্ত সমারোহের আয়োজন করিতে থাকেন রাজলক্ষ্মী। দশ-বারোটা ঝিয়ের যোগাড় হয়–যাহারা রাতদিন থাকিয়া খাঁটিবে। বামুন-চাকরের অর্ডার হয় ডজন-দুই। বর্ধমানে বায়না যায় নহবৎ বাজনার। গহনা-কাপড়ের ফ্যাশান বুঝিতে সরকার মশাইয়ের কলিকাতা-ঘর করিতে জুতো হেঁড়ে। এদিকে বস্তা বস্তা মুড়ি-চিড়া-মুড়কি তৈরির ধুম লাগে, মণখানেক ডালের বড়ি পড়ে, সুপারি কাটানো, সলিতা পাকানো-প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় কাজের সীমাসংখ্যা নাই। গ্রামসুদ্ধ নিমন্ত্রণ হইবে নিঃসন্দেহ, সন্দেশের ছাঁদা’ দিবেন সরায় করিয়া–না হাঁড়ি ভর্তি করিয়া, এই লইয়া নায়েব মশায়ের সঙ্গে রীতিমত বাগ-বিতণ্ডাই হইয়া যায়।
নিত্য নূতন ফর্দ তৈয়ারী করিতে করিতে সরকার মশায় আর নায়েব মশায় নাজেহাল হইয়া ওঠেন।
ক্রমশ সবই সারা হইয়া আসে। কেবলমাত্র যখন শুধু সামিয়ানা খাটানো আর ভিয়েনের উনান পাতা বাকি–তখন হঠাৎ বজ্রাঘাতের মত বুলুর একখানি চিঠি আসিয়া রাজলক্ষ্মীর সমস্ত আয়োজন লণ্ডভণ্ড করিয়া দেয়। বুলু লিখিয়াছে–
পিসিমা, মনে হচ্ছে বৌ জিনিসটা বোধ হয় আমার ধাতে সইবার নয়। কাজে-কাজেই তোমারও কপালে নেই।…অফিসের কাজে পাটনায় যাচ্ছি, ঘুরে এসে তোমার কাছে যাব। প্রণাম নাও।
বুলু
.
কাশীবাস করিলে নাকি পরমায়ু বাড়ে।
কাশীর গঙ্গার ঘাটে কাশীবাসিনী বৃদ্ধা বিধবার মরশুম দেখিলে খুব বেশী অবিশ্বাসও করা চলে না কথাটা। এই অসংখ্য বৃদ্ধার দলের মধ্যে আর একটি সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া হেমপ্রভা আজও বাঁচিয়া আছেন। ছোটখাটো কৃশ দেহটি আরও একটু কৃশ হইয়াছে, চোখের দৃষ্টিটা নিষ্প্রভ হইয়াছে মাত্র, তাছাড়া প্রায় ঠিকই আছেন।
বাড়ীতে আশ্রিত পোষ্যের সংখ্যা বাড়িয়াছে বৈ কমে নাই। এই নতুন পাতানো সংসারের ভার চাপাইয়াছেন একটি পাতানো মেয়েরই ঘাড়ে। যেমন ভালোমানুষ, তেমনি পরিশ্রমী মেয়ে এই কমলা ।
নিত্যকার মত আজও হেমপ্রভা সকালবেলা হরিনামের মালাটি হাতে দশাশ্বমেধ ঘাটের নির্দিষ্ট আসরটিতে আসিয়া বসিয়াছেন। একটু পরেই কমলা হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত।
-–কি রে, কি হয়েছে?
কমলা হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলে–মাসীমা, শীগগির বাড়ী চলুন, একটি মেয়ে এসে আপনাকে খুঁজছে!
হেমপ্রভা অবাক হইয়া বলেন–আমাকে খুঁজছে? কেমনধারা মেয়ে?
–আহা, একেবারে যেন সরস্বতী প্রতিমের মত মেয়ে মাসীমা। দেখলে দু’দণ্ড তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। রেলে এসেছে তাই একটু শুকনো মতন
‘সরস্বতী প্রতিমার মত’ শুনিয়াই বুকটা ধড়াস করিয়া উঠিয়াছে হেমপ্রভার। কিন্তু অসম্ভব কি কখনো সম্ভব হয়?
ঝোলামালা গুছাইবার অবসরে হৃৎস্পন্দনকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনিতে আনিতে হেমপ্রভা প্রায় হাসির আভাস মুখে আনিয়া বলেন-মরালবাহন ছেড়ে রেলে চড়ে আবার কোন্ সরস্বতী এলেন? নাম-টাম বলেছে কিছু?
–না। আমি শুধাতেও সময় পাই নি। আপনার নাম করে বলল—’এই বাড়ীতে অমুক দেবী আছেন না?’–আমি শুধু একটু দাঁড়াতে বলেই ছুটে এসেছি আপনাকে খবর দিতে।
অর্থাৎ বোঝা যাইতেছে–মেয়েটিকে দেখিয়া কেন কে জানে, কমলা একটু বিচলিতই হইয়া পড়িয়াছে। অবশ্য সামান্য কারণে বিচলিত হওয়া তার প্রকৃতিও কতকটা।
কিন্তু হেমপ্রভার মত এমন অবিচল ধৈর্যই বা কয়জন মেয়েমানুষের আছে? চলিতে চলিতে শুধু একবার প্রশ্ন করেন–কত বড় মেয়ে?
–বড় মেয়ে। ঠিক ঠাহর করতে পারিনি কত বড়। বেথা হয়নি এখনো। পাস-টাস করা মেয়ের মতন লাগল।
–সঙ্গে কে আছে?
–কেউ নয়, একা। মুখটি কেমন শুকনো শুকনো, মনে হচ্ছে যেন কোনো বিপদে পড়ে–তাই তো ছুটে চলে এলাম।
–দেখি চল্। তুই যে হাঁপাচ্ছিস একেবারে! স্বাভাবিক সুরে কথা কহিবার চেষ্টা করেন হেমপ্রভা। কিন্তু হৃদয় যতই ছুটিয়া যাক, পা যেন চলিতে চায় না।
আবার কোন বিপদে পড়িয়া কে আসিল হেমপ্রভাকে স্মরণ করিতে? এক যুগ আগে আসিয়াছিল কলিকাতার বাড়ীর সরকার লালবিহারী। সেই দিন হইতেই তো গত জীবনের সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ শেষ হইয়া গিয়াছে। এই দীর্ঘকাল যাবৎ কি দুরপনেয় গ্লানি, কি দুর্বহ শোকভার একা একা বহন করিয়া আসিতেছেন তিনি, কে তাহার সন্ধান লইতেছে?
এখানের এরা জানে, কাশীবাসিনী আর পাঁচটা বিধবার মতই নিতান্ত নির্বান্ধব তিনি। অবস্থা খারাপ নয়, এই যা। কাশীর এই বাড়ীখানা নিজস্ব, তাছাড়া বর্ধমান জেলার কোন্ একটা গ্রাম হইতে যেন নিয়মিত একটা মোটাসোটা মনিঅর্ডার আসে। অবশ্য তার সবটাই প্রায় ব্যয় হয় আশ্রিত প্রতিপালনে। বিধবা বুড়ীর খরচ করিবার পথই বা কি আছে আর! নিজের বিগত জীবনের কোনো গল্পই কখনো করেন নাই কাহারও কাছে।
নিতান্ত প্রয়োজন হিসাবে নিজের জন্য যতটুকু যা রাখিয়াছিলেন, তাহারই উপস্বত্বে চলে হেমপ্রভার। দেশের বাড়ীর চিরদিনের বিশ্বাসী সরকার মশাইয়ের হাতে ভার দেওয়া আছে। তাছাড়া সব কিছু সম্পত্তির দায় তো তাহার উপরই চাপানো আছে। তাপসীর নামে দানপত্র করা বিষয়-সম্পত্তির আয়টা অনুগ্রহ করিয়া গ্রহণ করিলেও, সে সম্পত্তির দেখাশোনার কথা চিন্তাও করে না চিত্রলেখা। সরকার মশাইটি নিতান্ত সাধু ব্যক্তি বলিয়াই আজও সমস্ত যথাযথ বজায় আছে। বুক দিয়া আগলাইয়া পড়িয়া আছেন তিনি।
মণীন্দ্রর মৃত্যুর পর ছেলেমেয়েদের উপর এমন একটা কঠিন আদেশজারি করিয়া রাখিয়াছিল চিত্ৰলেখা যে তাহাদের একান্ত প্রিয় নানিকে একখানি চিঠি লেখারও উপায় ছিল না।
স্বামীর মৃত্যুর পর শাশুড়ীর সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিবার দৃঢ় সঙ্কল্প লইয়াই নূতন সাজে সংসারে নামিয়াছিল চিত্রলেখা। কেমন যেন একটা ধারণা হইয়াছিল তাহার, মণীন্দ্রর অমন আকস্মিক মৃত্যুর কারণই হইতেছেন হেমপ্রভা। তাহার সেই বিশ্রী বিদঘুঁটে কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজটার জন্যই না মাকে প্রায় বর্জন করিয়া বসিয়াছিলেন মণীন্দ্র। অবশ্য চিত্রলেখা জানিয়াছিল সেটা সাময়িক, নিতান্তই অস্থায়ী। হেমপ্রভা নিজে হইতে নির্বাসন দণ্ড গ্রহণ না করিলে পুত্র আবারও ‘মা’ বলিয়া ভক্তিতে গদগদ হইতেন।
এই একটিমাত্র উচিত কাজ করিয়াছেন হেমপ্রভা, চিত্রলেখার প্রতি এতটুকু অনুগ্রহ। কিন্তু ছেলে মায়ের প্রভাবে অত বেশী প্রভাবান্বিত ছিলেন বলিয়াই না মাতৃবিচ্ছেদ-দুঃখ অতটা বাজিয়াছিল। যেন অহোরাত্ৰ অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হইতেছিলেন। আশ্চর্য, মা বলিয়াই কি সাতখুন মাপ!
তাছাড়া বেবির ভবিষ্যৎ-চিন্তা। চিত্ৰলেখার মত মণীন্দ্রও যদি সেই বিশ্রী ঘটনাটাকে চিন্তাজগৎ হইতে ঝাড়িয়া ফেলিতেন তো ল্যাঠা চুকিয়া যাইত। তা নয়, সেইটা লইয়া অবিরত দুশ্চিন্তা। মনোকষ্টে ও চিন্তায় চিন্তায় ভিতরে ভিতরে জীর্ণ না হইলে কখনো অমন স্বাস্থ্য-সুন্দর দীর্ঘ দেহখানা মুহূর্তে কর্পূরের মত উবিয়া যায়।
সব কিছুর মূলই তো সেই হেমপ্রভা। দৈবক্রমে স্বামীর জননী বলিয়াই কি তাহার প্রতি ভক্তিতে শ্রদ্ধায় বিগলিত হইতে হইবে!
এই তো চিত্রলেখারও নিজের সন্তানরা রহিয়াছে, মায়ের উপর কার কতটা ভক্তিশ্রদ্ধা তা আর জানিতে বাকি নাই। এর উপর যদি আবার তাহাদের, চিত্রলেখার চিরশত্রু সেই বশীকরণ শক্তিশালিনী ‘নানি’র কবলে পড়িতে দেওয়া হয়, তবে আর রক্ষা আছে! অতএব কড়া শাসনের মাধ্যমে তাহাদের স্মৃতিজগৎ হইতে নানির মূর্তিটা মুছিয়া ফেলাই দরকার।
তাছাড়া যে কথাটা মনে আনিতেও ঘৃণা বোধ হয়, বেবির জীবনের সেই অবাঞ্ছিত ঘটনাটা–যেটাকে চিত্রলেখা বেমালুম অস্বীকার করিয়া ফেলিতে চায়, পিতামহীর সংস্পর্শে আসিতে দিলে সেটাকে জিয়াইয়া রাখার সহায়তা করা হইবে কিনা কে জানে! তার নিজের পছন্দের সাধের ঘটকালির অপরূপ বিবাহ, তিনি কি সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা না করিয়া ছাড়িবেন? একেই তো ওই জবুথুবু সেকেলে ধরনের মেয়ে, তাহার কানে যদি সীতা-সাবিত্রী’র আখ্যানের ছলে বিষয়মন্তর ঢালা হয়, তাহা হইলে তো চিত্রলেখার পক্ষে বিষ খাইয়া মরা ছাড়া অন্য উপায় থাকিবে না।
বরং সময় থাকিতে বিষবৃক্ষের মূলোচ্ছেদ করিয়া ফেলাই বুদ্ধির কাজ। তা বুদ্ধিটা যে একেবারে নিষ্ফল হইয়াছে, তাই বা বলা যায় কেমন করিয়া! যথেষ্টই কার্যকরী হইয়াছে বৈকি! স্নেহময় পিতার উদার প্রশ্রয়ের আশ্রয় হারাইয়া ভীত-সন্ত্রস্ত ছেলে-মেয়ে তিনটা দুর্দান্ত মায়ের কড়া শাসনে ছেলেবেলায় কোনো যোগসূত্র রাখিতে পায় নাই। হেমপ্রভার দিকটা সত্যই প্রায় বিস্মৃত হইয়া গিয়াছিল। বড় হইয়াও কেহ কখনো নূতন করিয়া যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করে নাই।
স্বাভাবিক অনুমানে হেমপ্রভা অবশ্য প্রকৃত অবস্থা বুঝিয়া লইয়াছিলেন, তবু সত্যিই কি । কখনো কোনোদিন একবিন্দু অভিমান হয় নাই? তাপসী না হয় তাহার জীবনের শনিকে চিরদিনের মত বর্জন করিয়া চলুক, কিন্তু অভী? বাবলু? এই বারো বৎসরে অবশ্যই যথেষ্ট সাবালক হইয়া উঠিয়াছে তাহারা–তবে?
দেখিতে না আসুক, একখানা চিঠিও কি আসিতে পারে না? ধরো, পরীক্ষা সাফল্যের সংবাদবাহী? কিংবা বিজয়াদশমীর প্রণাম সম্বলিত?
হেমপ্রভা পাগল, তাই সুন্দর একটা মেয়ের নাম শুনিয়াই অসম্ভবের আশায় বিচলিত হইয়া পড়িয়াছেন! তাছাড়া কমলার কথা তো! বেশ কিছু বাদ দিয়া ধরিতে হয়!
কিন্তু কে আসিতে পারে? হেমপ্রভাকে খোঁজ করে, নাম বলিয়া সন্ধান চায়, এমন কাহাকেও খুঁজিয়া পান না। ঘুরিয়া ফিরিয়া সেই একজনের কথাই মনে পড়িতে থাকে। তাপসী ভিন্ন
বালাই ষাট! তাপসীই বা অমন শুকনো মুখ লইয়া একা কলিকাতা হইতে কাশী ছুটিয়া আসিবে কেন? নাঃ, তার কথা উঠিতেই পারে না!
আচ্ছা এমনও তো হইতে পারে, মায়ের সঙ্গে মনান্তর হওয়ায় অভিমান করিয়া নানির কাছে পলাইয়া আসিয়াছে। হায় কপাল! হেমপ্রভার তেমন ভাগ্যই বটে! হেমপ্রভার স্নেহের, হেমপ্রভার আশ্রয়ের যদি কোনো মূল্য থাকিত, তবে কি সেই ভয়ঙ্কর দিনে অমন করিয়া মণীন্দ্র ছেলে-মেয়ে তিনটাকে–
হঠাৎ সমস্ত চিন্তাস্রোতের উপর পাথর চাপা দিয়া দ্রুত পা চালাইতে থাকেন। অত ভাবিবার। কি আছে? নিশ্চয় সম্পূর্ণ বাজে কেউ। কুমারী মেয়ে বলিল না? হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠানের বা কোনো স্কুলের
বাড়ী ঢুকিয়াই অবশ্য নিমেষে স্থাণু হইয়া যান। মিথ্যা কল্পনা নয়, অসম্ভবই সম্ভব হইয়াছে। তাপসীই বটে। বাহিরের দিকের ঘরটায় একটা বড় চৌকি পাতা ছিল, তাহারই উপর চুপচাপ বসিয়া আছে। সঙ্গে মোটঘাটের বালাই মাত্র নাই।
তাপসী! হ্যাঁ, তাপসী বৈকি! রোদের ঝকঝকে সকাল। আলোভরা ঘর। ভুল করিবার কিছু নাই। বারো বছরের বালিকার উপর আরো বারো বছর ধরিয়া সৃষ্টিকর্তা তাহার যতই শিল্প কৌশল প্রয়োগ করিয়া থাকুন, বার্ধক্যের স্তিমিত দৃষ্টি লইয়াও হেমপ্রভার চিনিতে ভুল হয় না।
সত্যই শুকনো শুকনো মুখ, এলোমেলো উসকোখুসকো চুল, চোখের নীচে কালির রেখা। বিপদের সংবাদ বহিয়া আনার মতই চেহারাটা বটে।
কিন্তু এমন কি বিপদ ঘটিতে পারে যে তাপসীকে আসিতে হয় সে সংবাদ বহন করিয়া? তবে কি চিত্রলেখাও মণীন্দ্রর পথ অনুসরণ করিল?
অসম্ভব কি? হেমপ্রভার মত এত বড় দুর্ভাগিনী জগতে আর কে আছে, যথাসময়ে মরিয়াও মুখরক্ষা করিতে পারে না?
–তাপসী! তুই! চৌকিটার উপরই বসিয়া পড়েন হেমপ্রভা।
তাপসী মৃদু হাসিয়া বলে–আমি নয়, আমার ভূত। সারাদিন বুঝি গঙ্গার ঘাটেই থাকো তুমি?
–থাকি বৈকি। ভাবি রোজ দেখতে দেখতে যদি দৈবাৎ মা-গঙ্গার দয়া হয় কোনোদিন। কিন্তু তুই হঠাৎ এরকম করে চলে এলি কেন তাই বল্ আমায়। এ যে বিশ্বাস হচ্ছে না। বুঝতে পারছি না আমি–আনন্দ করব না আতঙ্কিত হয়ে বসে থাকব!
তাপসী স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হাসির সঙ্গে বলে–সে কি গো নানি, কতদিন পরে দেখলে কোথায় আনন্দে অধীর হয়ে উঠবে, তা নয় ভেবেচিন্তে অঙ্ক কষে ঠিক করবে, কি করা কর্তব্য?
যাক, ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ কিছু নাই তবে! ঈষৎ ধাতস্থ হইয়া হেমপ্রভা বলেন—’আনন্দ’ কথার বানান ভুলে গেছি তাপস। তুই হঠাৎ এরকম একলা একবস্ত্রে এভাবে চলে এলি কেন না শুনে সুস্থির হতে পাচ্ছিনে।
–এমনি। তোমায় দেখতে ইচ্ছা হল, ভাবলাম কোন্ দিন কাশীলাভ করবে, দেখাই হবে আর। তা–
–ও কথা আর যাকে বোঝাবি বোঝাগে যা, আমায় বোঝাতে আসিস নি তাপস। আমার মন কেবল কু’ গাইছে। কি হয়েছে বল্! শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে–
–কি মুশকিল! তাপসী যেন বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলে–বুড়ী হলেই কি ভীমরতি হতে হয় গোয় একটা মানুষ সারারাত ট্রেনে চড়ে, খিদেয় তেষ্টায় কাতর হয়ে এসে পড়ল–তাকে কেন এসেছিস’ কি জন্যে এসেছিস’ এই নিয়ে কেবল জেরার ওপর জেরা! থাকতে না দাও তো। বলল, চলেই যাই!
–বালাই ষাট–দুগগা দুগগা! আমি যে দিবানিশি এই আশাটুকু বুকে নিয়েই দিন কাটাচ্ছি। এখনো–একবার তোদের চাঁদমুখগুলি দেখব। কিন্তু এমন আচমকা হঠাৎ এলি, ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। বল সবাই ভালো আছে তো?
–আছে আছে।
–কিন্তু তোকে তো ভালো দেখছি না। হেমপ্রভা সন্দিগ্ধভাবে বলেন–তুই আছিস কেমন?
–খুব ভালো। তোমায় যে এখনো প্রণাম করাই হয়নি গো–গাড়ীর কাপড়ে ছোঁবো নাকি?
বাল্যের শিক্ষা আজও বিস্মৃত হয় নাই দেখা গেল। অভিভূত হেমপ্রভা এতক্ষণে দুই বাহু, বাড়াইয়া বুকে জড়াইয়া ধরেন তাহার চির আদরের আদরিণীকে। অভী বাবলু যতই মূল্যবান হোক, তবু তাপসীর মূল্য আলাদা।
সংসারের প্রথম শিশু। মণীন্দ্রর প্রথম সন্তান। কমলার উপস্থিতির কথা আর স্মরণ থাকে না, চির-অবিচলিত হেমপ্রভা কাঁদিয়া ভাসাইয়া দেন।
কে জানে তাপসীর চোখের খবর কি! পিতামহীর বুকের আড়ালে ঢাকা পড়িয়াছে বলিয়াই হয়তো লোকচক্ষে মান-সম্রমটা বজায় রহিল।
স্নানাহারের পর হেমপ্রভা আবার তাহাকে লইয়া পড়েন। তাপসীর এই আসাটা যে কেবলমাত্র নানির কাশীপ্রাপ্তি হইবার ভয়ে দর্শনলাভের আশায় ছুটিয়া আসা নয়, সেটুকু বুঝিবার ক্ষমতা বিলক্ষণ আছে তাহার।
কিন্তু তাপসী কেবলই হাসিয়া উড়ায়। বলে–ভালো বিপদ হয়েছে দেখছি, এমন জানলে আসতাম না! নাবালক ছিলাম, একা আসবার সাহস হত না। এখন সাবালক হয়েছি, তাই এলাম একবার।
হেমপ্রভা হাসিয়া বলেন–হঠাৎ সাবালক হয়ে উঠলি কিসের জোরে? তোর মা’র কবল থেকে কারুর সাবালক হওয়া সোজা ক্ষমতা নয়!
–মাকে তুমি বড় চিনে ফেলেছ নানি, তাই না? সত্যিই অনেক ক্ষমতার দরকার–তাই তো পালিয়ে এলাম।
–সেই কথাটাই ব–”পালিয়ে এলি’! আচ্ছা এখন আর পীড়াপীড়ি করব না, সময়ে শুনব। তোদের আর সব খবর শুনি। অভী, বাবলু কতদূর কি পড়ল-টড়ল এতদিনে? তুই কি করছিস? সরকার মশায়ের চিঠিতে ভাসা-ভাসা একটা খবর কদাচ কখনো পাই মাত্র। হেমপ্রভার কেমন একটা ধারণা হয়–তাপসী বড় হইয়া বুদ্ধি-বিবেচনার অধিকারিণী হইয়া, এতদিনে নিজের জীবনের একটা সুব্যবস্থার চেষ্টায় হেমপ্রভার কাছে আসিয়াছে, সেই তাহার বিবাহ অভিনয়ের নায়কের তত্ত্ব লইতে।
গুরু রক্ষা করিয়াছেন যে চিত্রলেখা আক্রোশের বশে আর একটা বিবাহ দেবার চেষ্টা করে নাই! যতই হোক হিন্দুর মেয়ে তো! কিন্তু সত্যিই যদি প্রশ্ন করে তাপসী, কি সদুত্তর দিবেন হেমপ্রভা? বুলুর সন্ধান লইবার চেষ্টা কয়েকবারই তো করিয়াছিলেন তিনি, কিন্তু যোগাড় করিতে পারিয়াছেন কই? প্রত্যেকবারই সরকার মশাই লিখিয়াছেন–”শুনিতে পাওয়া যায় ছেলেটি লেখাপড়া শিখিবার জন্য বিলাতে গিয়াছে।
বিলাতে পড়িতে গেলে কতকাল লাগে? কি সে পড়া? ইদানীং আর চেষ্টা করেন নাই হেমপ্রভা। কি বা প্রয়োজন–তাহার দ্বারা আর কাহারও কিছু হইবার আশা যখন নাই! চিত্রলেখার ইচ্ছা হয় খোঁজখবর লইয়া মেয়ে পাঠাইবে। ইচ্ছা না হয়–তাপসীর ভাগ্য। অনেক ভাবিয়া ভাবিয়া নিজেকে ‘নিমিত্তের ভাগী’ মনে করাটাও ছাড়িয়া দিয়াছিলেন তিনি। আজ সহসা তাপসীকে দেখিয়া অপরাধ-বোধটা নূতন করিয়া মাথা চাড়া দেয়। দোষ যাহারই হোক, এমন মেয়েটা মাটি হইয়া গেল!
কি কুক্ষণেই নাম রেখেছিলেন “তাপসী”! তপস্যা করিয়াই জীবন যাইবে! নিজের সংস্কারের দৃষ্টি দিয়াই বিচার করেন হেমপ্রভা। এছাড়া আর কিছু হওয়া সম্ভব, সে চিন্তাও আসে না। বহুযুগসঞ্চিত পুরুষানুক্রমিক সংস্কার। যে সংস্কারের শাসনে লোকে বালবিধবাকে অনায়াসে মানিয়া লয়। পতি-পরিত্যক্তার ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়া নিশ্চিন্ত থাকে।
এত কথা ভাবিতে অবশ্য কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময় লাগিয়াছে।
তাপসী প্রায় কথার পিঠেই উত্তর দেয়–অভী ডাক্তারি পড়ছে, বাবলু ঢুকেছে ইঞ্জিনিয়ারিং এ। ওদের জন্যে অনেক কিছুই তো ইচ্ছে ছিল মা’র, হল আর কই? কত খরচ লাগে!
মণীন্দ্রের অভাবটা দু’জনেরই মনে বাজে, স্পষ্ট করিয়া উচ্চারণ করিতে ইচ্ছা হয় না। মিনিট খানেক নিঃশব্দ থাকিয়া হেমপ্রভা বলেন–আর তুই-তুই কি করছিস?
–আমি? তাপসী হাসিয়া বলে–আমি স্রেফ বেকার। কলেজের কবল থেকে বেরিয়ে পর্যন্ত একটা চাকরি-বাকরিতে ঢুকে পড়বার জন্যে ছটফট করছি, মা’র শাসনে হচ্ছে না। কাজেই খাচ্ছি-দাচ্ছি, শাড়ীগয়না পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
হেমপ্রভা ভূকুঞ্চিত করিয়া বলেন–চাকরিতে ঢুকবি বলে ছটফট করছিস! চাকরি করবি তুই?
–করব না কেন, তাই বল? দোষ কি? জীবনটা তো মাঠেই মারা গেল। গেরস্তদের এত এত টাকাকড়ি খরচা করে লেখাপড়াগুলো শিখলাম, সেটাও মাঠে মারা যাবে?
নাতনীর কথায় আর একবার ধৈর্যচ্যুত হন হেমপ্রভা। পরিহাসচ্ছলে নিতান্ত অবহেলায় উচ্চারিত তাপসীর নিজের জীবনের এই মর্মান্তিক সত্যটা যেন সহসা চাবুক মারিল তাহাকে। সত্যই তো, জীবনটা মাঠে মারা যাইবার এত প্রচণ্ড দৃষ্টান্ত একালে আর কবে কে দেখিয়াছে!
অবাধ্য চোখের জলকে খানিকটা ঝরিতে দিয়া হেমপ্রভা গভীর আক্ষেপের সুরে বলেন–তা তুই বলতে পারিস বটে! কিন্তু হারে, তোর মা কি সেই হতভাগা ছোঁড়াটার খোঁজখবর কিছু করে না?
তাপসী কথাটা বলিয়া ফেলিয়া যেটুকু অপ্রতিভ হইয়াছিল, সেটুকু সামলাইয়া লইবার সুযোগ পাইয়াই যেন সকৌতুকে হাসিয়া ওঠে। হাসিয়া ফেলিয়া বলে–কেন গো, কি দুঃখে? আমার মা অমন হতভাগা লোকদের খুঁজে বেড়াবার মেয়ে নয়। খুঁজে খুঁজে যত রাজ্যের ভাগ্যবন্তদেরই এনে হাজির করছে, যদি কিছু সুরাহা হয়। আমিই একটা রাবিশ!
কথাটা মিথ্যা নয়, মেয়ে থার্ড ইয়ারে পড়ার বছর হইতেই চিত্রলেখা মাঝে মাঝে এক-আধটি সম্ভাবিত পাত্র খুঁজিয়া আনিয়া মেয়ের চোখের নাগালে ধরিয়াছে। তবে তাপসীর মনের নাগাল পাইবার সৌভাগ্য কাহারও ঘটে নাই, এই যা দুঃখ। তাপসীর সহজ প্রসন্নতার কঠিন বর্মের আঘাতে লাগিয়া তাহাদের যত্নসঞ্চিত তূণের সব রকম অস্ত্রই ফিরিয়া গিয়াছে। অথচ মায়ের এই চেষ্টার জন্য মায়ের কাছে কোনদিন অনুযোগ করে নাই মেয়ে, সেইটাই তো আরও অসুবিধা। চিত্রলেখার। কথা কাটাকাটির পথে তবু যুক্তিতর্কগুলা বলিয়া লওয়া যায়। কিন্তু বেবির অদ্ভুত চাল যেন বুঝিতেই পারে না এমন ভাব। শুধু কিরীটীর বেলাতেই ঘটনার স্রোত পালটাইয়াছে আগাইয়াছে।
আত্মপ্রসাদ-প্রসন্ন চিত্রলেখা ভাবিয়া সন্তুষ্ট ছিল–যাক, এতদিনে মনের মতনটি আনিয়া সামনে ধরিয়া দিতে পারিয়াছে। মেয়ের পছন্দটি দিব্য রাজসই বটে। তাই এতদিন কাহাকেও মনে ধরে নাই। কিন্তু শেষরক্ষা হইল না।
.
তাপসীর কথা শুনিয়া মিনিটখানেক গুম হইয়া যান হেমপ্রভা। বধূ সম্বন্ধে ‘যতই হোক হিন্দুর মেয়ে’ বলিয়া নিজের মনকে তিনি যতই চোখ ঠারুন, এমনি একটা আশঙ্কা কি মনে মনে ছিল তাহার? তাপসীর সিন্দুরবিহীন সীমন্ত দেখিয়া সম্প্রতি কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়াছিলেন এই যা। সিন্দুরবিহীনতাটুকু চোখে বাজিলেও, নূতন প্রলেপ যে পড়ে নাই এই ঢের। ও সংস্কারটাকে উড়াইয়া দিয়া অস্বীকার করিতে চায় করুক, বিবাহটা অস্বীকার করে নাই তো!
এই নূতন সংবাদে খানিকটা চুপ করিয়া থাকার পর তীক্ষ্ণস্বরে প্রশ্ন করেন–তা সুরাহা কিছু হল না কেন? অর্থাৎ নাতনীর মনটাও জানিতে চান।
তাপসী ভালোমানুষ বলিয়া বোকা নয়। পিতামহীর মনোভাব বুঝিতে দেরি লাগে না তাহার। মুখের হাসি সমান বজায় রাখিয়াই বলে–হলো আর কই! ভাগ্যটাই যে মন্দ! আহা বেচারা, কত চেষ্টায় কত যত্নে বাজারের সেরা মানিকটি এনে গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছিলেন, আমারই বরদাস্ত হল না। পালিয়ে প্রাণ বাঁচালাম।
ওঃ, তাই বটে! আহা-হা, এ মেয়েকেও আবার সন্দেহ করিতেছিলেন তিনি! সতী মেয়ে মায়ের অন্যায় উৎপীড়নে শেষ পর্যন্ত বাড়ী ছাড়িতে বাধ্য হইয়াছে। বাছা রে! বিগলিত স্নেহে হেমপ্রভা তাহাকে প্রায় কোলে টানিয়া লইয়া বলেন–বাছা রে! কত কষ্ট পেয়েছ, মরে যাই! জানি তো তোর মাকে, এই ভয়ই ছিল আমার। দেখছি ভগবান আবার আমাকে সংসারের পাকে জড়াতে চান। মস্ত কর্তব্যের ত্রুটি রেখে এসে নিশ্চিন্ত হয়ে তাকে ডাকতে বসলেও তো উচিত কাজ হয় না। যাকগে, তুই যে পালিয়ে এসে এখানে এসে পড়েছিস, ভালোই করেছিস। দেখি আমার দ্বারা কি হয়–
–দোহাই নানি, আর কিছু হওয়াবার চেষ্টা কোরো না তুমি। একটা কাজকর্ম খুঁজে নেওয়া। পর্যন্ত তোমার এখানে থাকতে দাও শুধু, তাহলেই হবে।
–আমার ওপর তোর বড় অবিশ্বাস, না? তা হতে অবিশ্যি পারে। কিন্তু ভুলকে শোধরাবার সুযোগও একবার দিতে হয়। চাকরির কথা মুখে আনিসনি আমার সামনে। এখন দয়া করে তোর মা আমার কাছে দুদিন থাকতে দেয়, তবে তো! থানা-পুলিস করে কেড়ে নিয়ে না যায়!
–বাঃ, মা কি করে জানবেন এখানে আছি?
হেমপ্রভা সচকিতে বলেন–একেবারে কিছুই জানিয়ে আসিসনি নাকি?
–না তো!
ছি ছি! এ কাজটা তো তোমার ভালো হয়নি তাপস। আমি বলি বুঝি মায়ের ওপর রাগ করে চলে এসেছিস। চুপি চুপি পালিয়ে এসেছিস তাহলে? বড় নির্বুদ্ধির কাজ হয়েছে।
তাপসী ম্লান হাসির সঙ্গে বলে–আমার অবস্থায় যদি পড়তে, দেখতাম তোমারই বা কত বুদ্ধি খুলত!
–বুঝেছি। অনেক যন্ত্রণা না পেলে এমন কাজ করতে না তুমি। শুনব, সব শুনব রাত্তিরে। কিন্তু এখুনি তো একখানা তার করে দিতে হয় কলকাতায়।
–বা রে, বেশ তো! আমি বলে কত কষ্ট করে লুকিয়ে পালিয়ে এলাম, এখনই তাড়াতাড়ি বলে পাঠাব-টু! আমি এখানে লুকিয়েছি!
হেমপ্রভা হাসিয়া ফেলিয়া বলেন–আচ্ছা তোকে বলতে হবে না, আমিই কাউকে দিয়ে অভীর নামে তার পাঠিয়ে দিচ্ছি। মেয়েমানুষ জাত যে বড় সর্বনেশে পরাধীন জাত। রাগ করে বাড়ী ছেড়ে পালাবার স্বাধীনতাই কি আছে তার? ঘরে পরে সকলে সন্দেহ করবে। কেউ বিশ্বাস করবে না একলা পালিয়ে এসেছিস। আমার কাছে এসে পড়েছিস এই মস্ত রক্ষে, যত তাড়াতাড়ি খবর দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।…যাই দেখি রাজেন বাড়ী আছে কিনা!
.
রাত্রে বিছানায় শুইয়া দুইজনেরই প্রায় জাগিয়া রাত ভোর হইয়া যায়। খুঁটিয়া খুঁটিয়া নানা প্রশ্নের সাহায্যে অনেক তথ্যই আবিষ্কার করেন হেমপ্রভা। মনটা যে খুব প্রসন্ন থাকে, এমন বলা যায় না। নিজের অবস্থা এবং ঘটনার বর্ণনা করিতে মিস্টার মুখার্জি নামধারী ব্যক্তিটির সম্বন্ধে যতই অগাধ উদাসীনতা দেখাক তাপসী, যতই মায়ের “সেই পরম অমূল্য রত্নটি” বলিয়া উল্লেখ করুক, তীক্ষ্ণবুদ্ধিশালিনী পিতামহীর দৃষ্টির সামনে তাহার প্রকৃত মনের চেহারা ধরা পড়িতে দেরি হয় না। এই পলায়ন তাহার তবে মায়ের জবরদস্তির কাছে অসহায় হইয়া নয়, আপন হৃদয়ের কাছেই অসহায়তা! মুখোমুখি সত্যের সন্মুখ হইতে আত্মরক্ষায় অক্ষম হৃদয় লইয়া ভীরু পলায়নে অপ্রসন্ন হইলেও একেবারে ধিক্কার দিতে পারেন না।
আরো কঠিন আরো দৃঢ় হইলেই অবশ্য ভাল ছিল, কিন্তু এই শোভাসম্পদময়ী ধরণীতে, জগতের যাবতীয় ভোগের উপকরণের মাঝখানে বসিয়া এই অপরূপ রূপযৌবনের ডালিখানি অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করিয়া দেবী’ বনিয়া থাকা কি এতই সহজ! বাল-বিধবার তবু তো কৃচ্ছসাধন বরাদ্দ!
কয়েক দিন কাটে।
.
চিত্রলেখার নিকট হইতে টেলিগ্রামেই সংক্ষিপ্ত জবাব আসিয়াছে–’ধন্যবাদ। নিশ্চিন্ত।‘ কন্যার প্রচণ্ড দুর্ব্যবহারে চিত্রলেখা কিরূপ পাষাণ বনিয়া গিয়াছেন, ভাষাটা তাহারই নিদর্শন।
তবু পিতামহীর সঙ্গে সমস্ত কাশী শহরটা প্রদক্ষিণ করিয়া এবং অসংখ্য দেবমূর্তি দর্শন করিয়া বেড়াইতে মন্দ লাগে না। অনাস্বাদিত বৈচিত্র্য। কাশীর বাজার হইতে কেনা সাদাসিধে কয়েকটা শাড়ী জামা–চিত্রলেখার কাছে যাহা একান্ত দীনবেশ, তাই পরিয়া অক্লেশে ঘুরিয়া বেড়ায় তাপসী। যে মূল্যবান নূতন রেশমী শাড়ীখানা বিবাহের ‘পাকা দেখা হিসাবে আসিবার কালে পরনে ছিল, সেখানা নিতান্ত অনাদরে দড়ির আলনায় ঝুলিয়া ধূলা খাইতে থাকে।
এত ঘোরায় অনভ্যস্ত ক্লান্ত হেমপ্রভা রাত্রে বিছানায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মড়ার মত ঘুমাইয়া পড়েন, জানিতেও পারেন না পার্শ্ববর্তিনীর কুসুম-সুকুমার হাল্কা দেহখানির মধ্যে কি উত্তাল সমুদ্র ততালপাড় করিতে থাকে, কি দুরন্ত কালবৈশাখীর ঝড় বয়! বিনিদ্র রজনীর সাক্ষ্য থাকে শুধু বিনিদ্র নক্ষত্রের দল। কোটিকল্পকাল ধরিয়া যাহারা বহুঁকোটি মানবের বিনিদ্র রজনীর হিসাব রাখিয়া আসিতেছে।
.
দিন কয়েক পরে।
গঙ্গাস্নানে যাইবার আগে হেমপ্রভা সুদৃশ্য একখানি ভারী খাম হাতে করিয়া বেজার মুখে নাতনীকে উদ্দেশ করিয়া বলেন–এই নাও, তোমার চিঠি!
ঠিকানাটা টাইপ করা, হাতের লেখা দেখিয়া বুঝিবার উপায় নাই, তবু কি একটা আশার আশঙ্কায় বুকটা থরথর করিয়া ওঠে তাপসীর, হাত বাড়াইয়া লইবার ক্ষমতা পর্যন্ত থাকে না।
–কই, খোল তো দেখি কি লিখেছে! কার চিঠি?
-বুঝতে পারছি না–বলিয়া তাপসী বন্ধ খামখানাই নাড়াচাড়া করিতে থাকে। খুলিবার লক্ষণ দেখায় না।
–খুলেই দে না–’হাতে পাঁজি মঙ্গলবারের দরকার কি? এ বোধ করি তোমার মা’র সেই অমূল্যরত্ন ‘মিস্টার মুখুজ্জে’ না কে যেন তারই হবে! আস্পদ্দাকে বলিহারি দিই বাবা, বেচারা এই দূরদূরান্তরে এসে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে, তাও নিস্তার নেই! চিঠি লিখে উৎখাত করতে এসেছে গো!.তুই খোল তো, দেখি আমি কি লিখেছে সে? কড়া করে উত্তর দিয়ে দিবি, বুঝলি? লিখবি–‘তোমার সঙ্গে কোনো সংস্রব রাখবার ইচ্ছে আমার নেই।‘
তাপসী উত্তর দেয় না, হয়তো দিতে পারেই না–ঘামে ভেজা ‘থরথর কম্পিত’ মুঠির মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া খামখানার অবস্থা শোচনীয় করিয়া তোলে।
হেমপ্রভা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার নাতনীর মুখের চেহারাটা দেখিয়া লইয়া বলেন– অবিশ্যি তোমার নিজের মন বুঝে কথা। দেহটা নিয়ে পালিয়ে আসা যায়, মন নিয়ে তো পালানো যায় না। তুমি যদি তোমার ধিঙ্গি মায়ের মতলব মত ওই ছোঁড়াকেই দুর্গা দুর্গা! থাকবলবার আমার কিছু নেই। নিজের বিবেচনায় কাজ করবার সাহসও আর নেই। যা ভাল বুঝবে করবে।
অন্যমনস্ক তাপসী বোধ করি ঠাকুমার শ্লেষটা বুঝিলেও কারণটা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে না, অসহায় অন্যমনস্ক সুরে বলে–আমার জন্যে কেউ তো কোনদিন কোনো বিবেচনাই করলে না নানি! তুমি পালিয়ে এলে কাশী, বাবা চিরদিনের মত পালালেন, পড়ে রইলাম মা’র হাতে! স্বপ্নের বর স্বপ্ন হয়েই রইল, আমি কি করি বলল তো!
হেমপ্রভা আহত অপ্রতিভ ভাবে বলেন-জানি দিদি, বুঝি তোর ওপর সবাই অবিচার করেছে। দারুণ অভিমানে পালিয়ে এসেছিলাম, কর্তব্য ঠিক করতে পারিনি। মণি যখন চলে গেল, তখন আমারই উচিত ছিল যেমন করে তোক তোর আখেরের ব্যবস্থা করা। দেরি হয়ে গেছে, তবু পাপের প্রায়শ্চিত্ত এবার করব আমি। একেবারে তোকে নিয়েই যাব কুসুমপুর। কেউ না থাক, কান্তি মুখুজ্জের প্রতিষ্ঠিত ‘রাইবল্লভের’ মন্দির তো আছেই, সেখানে গিয়ে খোঁজ করব। দেখি সে ছোঁড়া কি করে অবহেলা করে তোকে! শুনেছিলাম বিলেত-মিলেত গেছে নাকি? ভগবান জানেন, মেম বিয়ে করে বসে আছে কিনা! তাহলেও আমি সহজে ছাড়ব না।
তাপসী মৃদু হাসির সঙ্গে বলে–মানুষ তো অমর নয় নানি। তোমার দেওয়া শাস্তিভোগ করতে আসামী টিকে থাকলে তো!
হেমপ্রভা শিহরিয়া ওঠেন। ঠিক এই ধরনের একটা আশঙ্কা কি তাহার নিজেরই নাই? ভাল করিয়া তলাইয়া দেখিলে হয়তো এত নিস্পৃহ হইয়া থাকিবার কারণও তাহাই। কুমারীর মত আছে থাক–কেঁচো খুঁড়িতে গিয়া কি শেষটা সাপ বাহির করিয়া বসিবেন! কিন্তু এ অবস্থাও আর সহনীয় নয়। যা থাকে কপালে, দেশে একবার যাইবেনই তিনি এবার। আর যাই হোক– পিসশাশুড়ী বুড়ীটা নিশ্চয়ই ঠিক খাড়া আছে। বিধবা মেয়েমানুষের কাঠপ্রাণ, ও আর যাইবার নয়। কিছু সুরাহা যদি নাই হয়–আচ্ছা করিয়া একবার দশকথা শুনাইয়া দেওয়ার সুযোগ না হয় তোক।
কেন? দোষ কি শুধু এ পক্ষেরই? কান্তি মুখুজ্জের অবিমৃষ্যকারিতাই কি তাপসীর জীবনটা মাটি করিয়া দিবার যথার্থ কারণ নয়? সে ভুল শোধরানোর চেষ্টা করা উচিত ছিল তাহাদেরই।
রাজলক্ষ্মী যে চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই, সেটা না হেমপ্রভা, না তাপসী কাহারও জানা নাই।
যাই হোক–ভিতরে ভিতরে যত আশঙ্কাই থাক, মুখে দমেন না হেমপ্রভা। যাই যাই করিয়া ওঠেন–অলুক্ষুণে কথা মুখে আনিসনে তাপস। দুর্গা দুর্গা। মেম মায়ের কাছে এই শিক্ষাটাই হয়েছে বুঝি! যা নয় তাই মুখে আনা! মনে রাখিস সাবিত্রীর দেশের মেয়ে তুই। যমের বাবার সাধ্যি হবে না তোর আশার জিনিস কেড়ে নিতে!
তাপসী অবিশ্বাসের হাসি হাসে। হাতের খামখানা খুলিয়া দেখিবার আগ্রহও যেন শিথিল হইয়া যায়। সাবিত্রীর দেশের মেয়ে সে? তাই তো! এ কথাটা এত স্পষ্ট করিয়া কেউ তো কোনোদিন বলিয়া দেয় নাই!
খামখানা হাতের মধ্যে নিপীড়িত হইতে থাকে। না পড়িয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিবার মত মনের জোর থাকিতে পারে না তাপসীর? সাবিত্রীর দেশের মেয়ে হইয়াও না?
গঙ্গাস্নানের দেরি হইয়া যায় দেখিয়া হেমপ্রভা তখনকার মত আর চিঠির বিষয়বস্তু দেখিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন না, ঝোলামাল লইয়া বাহির হইয়া যান।
আর তাপসী? চিঠিখানার বিষয়বস্তু জানিবার প্রয়োজন কি তাহারও নাই আর?
জ্ঞান অবধি যে সংগ্রাম জীবনের সাথী, স্পষ্ট করিয়া আবার একবার তাহার মুখোমুখি দাঁড়াইতে হইতেছে তাপসীকে। লোভের সঙ্গে সতোর সংগ্রাম, বাস্তবের সঙ্গে সংস্কারের। তাপসী কি হার মানিবে? হৃদয়ের সমস্ত শক্তি এক মুহূর্তের জন্য আঙুলের ডগায় কেন্দ্রীভূত করিয়া খামটা একবার ছিঁড়িয়া ফেলিতে পারিলেই তো সব চুকিয়া যায়!
আচ্ছা এমনও হইতে পারে, সব সন্দেহই অমূলক–নেহাৎ কোনো বাজে লোকের চিঠি! লিলির হইতেই বা বাধা কি? বন্ধু বলিতে অবশ্য কেহই নাই তাপসীর, তবু আত্মীয়তার সূত্র ধরিয়া লিলিও তো জিজ্ঞাসা করিতে পারে–তাপসীর অমন সৃষ্টিছাড়া ভাবে পলাইয়া আসার কারণ কি?
অভীও পারে না প্রকাণ্ড এক চিঠি লিখিতে?
তাপসীর পলাইয়া আসার অর্থ জানিতে চাওয়ার অধিকার তাহারও থাকিতে পারে।
কিংবা মা?
তাপসী কিভাবে তাঁহার মুখে চুনকালি লেপিয়াছে, উঁচু মাথাটা হেঁট করিয়া দিয়াছে–সেইটাই শুনাইয়া দিবার মত উপযুক্ত ভাষা হয়তো এতদিনে সংগ্রহ করিয়াছেন তিনি।
টাইপ-মেশিনের নিপ্রাণ অক্ষরগুলো নিতান্তই নীরব দৃষ্টি মেলিয়া তাকাইয়া থাকে, কোনো উত্তর দেয় না।
বোকার মত আগেই ছিঁড়িয়া ফেলার তো মানে হয় না কিছু। তবু হঠাৎ সমস্ত শক্তি একত্রীভূত করিয়া খাম-সমেত চিঠিখানা খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ছড়াইয়া দেয় তাপসী।
না, হেমপ্রভার কাছে খেলো হইতে রাজী নয় সে। বুঝুন তিনি, কাহারও উপর কোনো মোহ নাই তাপসীর। সাবিত্রীর দেশের মেয়ে শুধু যে নিজের ‘এয়োতি রক্ষা করিতেই জানে তা নয়, আপন সম্মান রক্ষা করিতেও জানে।