Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হীরের নেকলেস || Syed Mustafa Siraj

হীরের নেকলেস || Syed Mustafa Siraj

ইদানীং কর্নেল নীলাদ্রি সরকার অপরাধ রহস্য ছেড়ে পতঙ্গ রহস্য নিয়ে পড়েছেন। কোত্থেকে অদ্ভুত-অদ্ভুত চেহারার উড়ুক্কু পোকামাকড় যোগাড় করেছেন। সেগুলো প্রকাণ্ড কাঁচের বয়াম আর তারের জাল দিয়ে তৈরি খাঁচায় পুরে রেখেছেন। শোবার ঘরের একটা দিক আস্ত ল্যাবরেটরি হয়ে উঠেছে। যখনই যাই, দেখি কর্নেল চোখে একটা অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়ে কী সব দেখছেন, আর খাতায় লিখছেন। আমি কোন প্রশ্ন না করলেও প্রশ্ন করছি ধরে নিয়ে উনি অনর্গল জবাব দিয়ে যাবেন এবং সবটাই ওই কীটপতঙ্গ সংক্রান্ত।

আমার এ এক মুশকিল! ওঁর সঙ্গে আলাপের পর থেকেই আজ এতগুলো বছর ধরে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী এবং বন্ধু হয়ে কাটালাম-বয়সের তফাত দুজনের মধ্যে যতই থাক। ওঁর ব্যক্তিত্বের জাদু এমনই যে আর আমার কোন বন্ধু বান্ধব রইল না–অন্য কারুর সঙ্গ বা বন্ধুত্ব আমার পছন্দও হল না। ফলে আজ আমার একমাত্র বন্ধু বলতে উনিই। একদিন না দেখা হলে মনে-মনে কী যে ছটফট করি!

অথচ সেই একমাত্র বন্ধু যদি এমন পাগলামি শুরু করেন এবং সবসময় শুধু পোকামাকড় ঘাঁটাঘাঁটি করে বিশাল জ্ঞান বিতরণের পাত্র হিসেবেই আমাকে ধরে নেন, তাহলে এমন বন্ধুতা আর রাখতে ইচ্ছে করে না।

তাই সেদিন যেন একটা হেস্তনেস্ত করতেই হাজির হয়েছিলাম ওঁর ফ্ল্যাটে। কর্নেল আমাকে দেখামাত্র ষষ্ঠীচরণকে কফি আনতে বললেন।

কফি খেতে খেতে কর্নেল পোকামাকড় নিয়ে পড়েছেন এবং আমি কর্মেলকে চরম কথাটা বলার জন্যে তৈরি হচ্ছি, সেইসময় দরজার ঘন্টি বাজল। একটু পরে ষষ্ঠীচরণ এসে বলল, বাবামশাই! এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বিরক্ত মুখে বললেন, বসতে বলোযাচ্ছি। ইয়ে জয়ন্ত, তাহলে বুঝতেই পারছ, দুটো পোকা দেখতে প্রায় একরকম হলেও স্বভাবে আচরণে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুটোকেই মনে হচ্ছে মড়ার মতো চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু আসলে তা নয়। নীল পোকাটার পেটে…

বাধা দিয়ে বললাম, কর্নেল, অতিথিকে বসিয়ে রেখেছেন। আগে তাকে বিদায় দিয়ে আসুন। তারপর যা হবার হবে।

কর্নেল বললেন, স্যরি।

উনি তক্ষুনি উঠে গেলেন। আমি পাশের টেবিল থেকে ইংরেজি খবরের কাগজ নিয়ে চোখ বুলাতে থাকলাম। একটু পরেই কর্নেলের চড়া গলার কথা শোনা গেল ড্রয়িংরুমে। না, না! দিস ইজ কোয়াইট অ্যাবসার্ড! আপনি কি বলছেন, আমি তার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না।

অপর পক্ষে মিনতি করলেন, প্লিজ কর্নেল! আগে আমায় শেষ করতে দিন।

তখন কর্নেল একটু নরম হয়ে বললেন, আমি এ ধরনের কাজে কোন উৎসাহ পাইনে মিঃ রায়। আমি আপাতত অন্য কাজে ব্যস্ত। আপনি বরং কোন সখের গোয়েন্দা নয়তো কোন অভিনেতার কাছে যান!

মিঃ রায় অর্থাৎ অন্যপক্ষ বললেন, শেষটা না শুনলে আপনি ঠিক বুঝতে পারবেন না! তাই বলছি, আগে আমার কথাগুলো শুনুন প্লিজ!

কর্নেল বললেন, দেখুন মিঃ রায়। কোথাও কোনরকম হত্যাকাণ্ড ঘটলে বা ঘটার সম্ভাবনা থাকলে সচরাচর আমি আগ্রহী হই। কিংবা ধরুন, কোন বড় রকমের রহস্যজনক চুরিটুরি ঘটলেও তাতে আমার আগ্রহের অভাব হয় না। কিন্তু আপনার প্রস্তাবটা একেবারেই ছেলেমানুষি। তাছাড়া সবেচেয়ে আপত্তির ব্যাপার এটাই যে আমি তথাকথিত গোয়েন্দাদের মতো ছদ্মবেশ ধরা খুবই অপছন্দ করি স্রেফ যা আমি তাই কর্নেল নীলাদ্রি সরকার হয়েই তদন্তে হাত দিই। আপনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী উদ্ভট! কোন মার্ডার বা রজনক চুরির ঘটনা নেই। ঘটনা বলতেই কিছু নেই। অথচ আমার সাহায্য আপনি চান। কী সাহয্য? না আমাকে আপনি সেজে একটা বিয়ের পার্টিতে যেতে হবে। না মিঃ রায়, এ আমার দ্বারা হবে না!

বুঝলাম কর্নেল উঠে দাঁড়িয়েছেন। ভদ্রলোক বললেন, কর্নেল! প্লিজ আপনি আগে উদ্দেশ্যটা…

বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, উদ্দেশ্যটা যাই থাক। এটা খুবই বেআইনি ব্যাপার হবে বুঝতে পারছেন না? ভারতীয় পেনাল কোডে রংরুল পার্সোনিফিকেশনের একটা ধারা আছে।

কিন্তু কর্নেল, আপনি তো ধরা পড়ছেন না।

না পড়ারই বা গ্যারান্টি কোথায়, বলুন। আপনাকে ওঁরা নেমতন্ন করেছেন যখন; তখন নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে আপনাকে ওঁরা কখনও না কখনও দেখে। থাকতে পারেন। অন্তত আপনার সবিশেষ খবর রাখতে অসুবিধে নেই। কিংবা এমন হতে পারে, পার্টিতে আমার বা আপনার কোন চেনা লোক এসেছে। সে…

বাধা দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমি প্রায় তিরিশ বছর আমেরিকায় কাটিয়ে আজই ফিরেছি। ওঁরা বাবাকে চিনতেন–আমাকে কখনও দেখেননি। নেমন্তন্নের কার্ড আমাকে ওঁরা আমেরিকার ঠিকানাতেই পাঠিয়ে ছিলেন। কাজেই আমাকে এখানে চেনার সম্ভাবনা কারও নেই। এমনকি কার্ড পাঠানোও নেহাত ভদ্রতা রক্ষা। আমি যে সত্যি সত্যি অতদূর থেকে এসে পড়ব, ওঁদের পক্ষে কল্পনাতীত।

এবার কর্নেলকে অবাক হয়ে বলতে শুনলুম, স্ট্রেঞ্জ!

ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর এবার চাপা হল। একটুও বুঝতে পারলাম না। মাঝে মাঝে কর্নেলের বিস্ময়সূচক অস্ফুট আওয়াজ শোনা যেতে থাকল।

আধঘণ্টা পরে কর্নেল ফিরে এলেন। মুখের এই গাম্ভীর্য আমার চেনা। একপলক তাকিয়েই বুঝলুম মিঃ রায় নামে আমেরিকা প্রবাসী এবং কলকাতায় সদ্য আগন্তুক এক ভদ্রলোকের ‘কেস’ নিয়েছেন–অর্থাৎ কোন এক বিয়ের পার্টিতে মিঃ রায় সেজে নেমন্তন্ন খেতে যাবেন। বলা বাহুল্য, আমি মনে মনে খুশি হলুম। যেটুকু বুঝেছি, তাতে রহস্যের গন্ধ বেশ কড়া। কর্নেল আপাতত লালপোকা নীলপোকা ছেড়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে মেতে উঠবেন, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

কর্নেল বসে চুপচাপ চুরুট ধরালেন। নিঃশব্দে টানতে থাকলেন। আমি তার এই গাম্ভীর্য ভাঙা সঙ্গত মনে করলাম না। খবরের কাগজটার দিকেই চোখ রাখলাম। কয়েক মিনিট পরে কর্নেলের ডাক শুনলাম, জয়ন্ত!

আমিও গম্ভীর গলায় সাড়া দিলাম, বলুন কর্নেল।

তুমি তো রিপোটার!

তাতে কি সন্দেহবোগ্য কিছু ঘটেছে?

না ডার্লিং। যেহেতু তুমি একজন বিখ্যাত রিপোর্টার, কলকাতার অনেক নামী পরিবারের খোঁজ-খবর তোমার রাখা উচিত। আচ্ছা জয়ন্ত, তুমি কি নিউ আলিপুরের বসু পরিবারের খবর রাখো?

কাগজে চোখ রেখেই জবাব দিলাম, অল্পস্বল্প রাখি। স্যার খেতাবধারী জগদীন্দলাল বসুর গোটাসাতেক খনি ছিল। তার ছেলে শচীন্দ্রলাল এম.পি. ছিলেন। শচীন্দ্রলালের ছেলে অতীন্দ্রলাল অবশ্য রাজনীতি করেন না, নামকরা ছবি আঁকিয়ে। মাঝে মাঝে ছবি প্রদর্শনী করেন। বিদেশেও দু’তিনবার প্রদর্শনী করেছেন। আমার সঙ্গে শচীন্দ্রলালের অবশ্য কিছু চেনা ছিল এক সময়। এখন হয়ত ভুলেই গেছেন সেকথা। কিন্তু ব্যাপারটা কী?

কর্নেল বললেন, খবরের কাগজটা রেখে দাও। আমি আপাতত অগাধ জলে পড়ে গেছি। উদ্ধার করো।

কাগজ রেখে বললাম, সে তো ইচ্ছে করে পড়েছেন। এবং আমার উদ্ধারের। ভরসা রাখেননি কারণ নিজেই উদ্ধার হবেন, এ বিশ্বাস আপনার আছে।

না জয়ন্ত, আমি তোমার সাহায্য চাই।

হাসতে হাসতে বললাম, হ্যালো মাই ডিয়ার ওল্ডম্যান! আপনি জানেন যে আপনার কথায় এই জয়ন্ত নরক ডিঙিয়ে যেতেও রাজি। তাই আর কালক্ষয় না করে সোজা বলুন, কী করতে হবে? আমাকে কি মিঃ রায় সেজে অতীন্দ্রলাল বসুর বিয়ের পার্টিতে যেতে হবে? খুবই পারব। কারণ, সুযোগ পেলেই আমি ছদ্মবেশ ধরি। তবে সেটা সখের থিয়েটারের স্টেজে! এই কথাটা মনে রেখে এবার আদেশ করুন।

কর্নেল আমার রসিকতা গায়ে মাখলেন না। গম্ভীর হয়েই বললেন, জয়ন্ত। তোমায় ছদ্মবেশ ধরতে আমি বলিনি। প্রথম কথা, তোমার বয়েসে মিঃ রায় সাজার পক্ষে খুবই কম। ওঁকে তুমি দেখনি–হয়ত কণ্ঠস্বর শুনেছ। ভদ্রলোক আমার চেয়েও বুড়ো। আর এটাই খুব আশ্চর্য ব্যাপার যে ওঁকে অনায়াসে আমার দাদা বলে চালানো যায়–একই শারীরিক গঠন এবং উচ্চতা। মাথায় হুবহু একই টাক। তফাতের মধ্যে শুধু ওঁর দাড়ি নেই। উনি নিউইয়র্কে থাকতেই নাকি আমার একটা প্রবন্ধ পড়েন এবং ছবি দেখেন। তারপর

বাধা দিয়ে বললাম, হু। নিউইয়র্কের পত্রিকায়। গত সেপ্টেম্বরে প্রজাপতির রূপান্তর নামে সেই প্রবন্ধটা।

কর্নেল নড়ে বসলেন, মাই গুডনেস! মনে পড়েছে বটে। পরে ওদের প্রতিনিধি এসে আমার ইন্টারভিউ নিয়ে গিয়েছিল। কী কাণ্ড দেখছ? তাতে আমার অন্য পরিচয় দেওয়া হয়েছিল। অপরাধবিজ্ঞানী। ভদ্রলোক সেই কথা উল্লেখ করলে বরং আমার সন্দেহ কেমন বেড়ে গিয়েছিল। ওঁকে প্রতারক ভেবে বসেছিলাম। কিছুতেই মনে পড়েনি নিউইয়রকারের কথা। নাঃ জয়ন্ত, আজকাল আমার স্মরণশক্তি একেবারে ফেঁসে গেছে। খামোকা বেচারাকে প্রতারক ভেবে বসলাম!

বললাম, যাক গে, এবার বলুন–ব্যাপারটা কী?

এর জবাবে কর্নেল আমাকে যা জানালেন, তা মোটামুটি এই :

অরিন্দম রায় নামে এ ভদ্রলোক স্যার জগদীন্দ্রলাল বসুর বাল্যবন্ধু। দুজনেই বিহার প্রদেশের মুঙ্গের শহরের মানুষ। পরে নানারকম ঘটনা পরম্পরায় দুজনে ছাড়াছাড়ি হয়। অরিন্দম রায়ের বাবা ছিলেন রাজা খেতাবধারী জমিদার। অরিন্দমকে রাজা প্রতাপনারায়ণ ত্যাজ্যপুত্র করেন। অরিন্দম নানা জায়গায় ঘুরে ঘা খেতে খেতে অবশেষে আমেরিকায় পাড়ি জমায়। তার একবছর পরেই রাজা প্রতাপনারায়ণ মারা যান। তাঁর আর কোন ছেলে বা মেয়েও ছিল না। উইলে সব সম্পত্তি গৃহদেবতার নামে দেওয়া ছিল। ওদিকে জগদীন্দ্র সাধারণ ধনী পরিবারের ছেলে। তিনি বুদ্ধি ও কর্মক্ষমতায় পরবর্তীকালে আও বিত্তশালী হন এবং ইংরেজ সরকারের কাছে স্যার খেতাব পান। বিয়ে করেন অনেক দেরিতে। ফলে তাঁর ছেলে শচীন্দ্র অরিন্দমকেও কখনও দেখেননি। পরে জগদীন্দ্র কলকাতায় চলে যান। মুঙ্গেরের বাড়ি ও সম্পত্তি বেচে দেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অরিন্দমের সঙ্গে চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্রে শচীন্দ্রও তার পিতৃবন্ধুকে মধ্যে মধ্যে চিঠিপত্র লেখেন এবং কখনও দেশে ফিরলে তাদের আতিথ্য গ্রহণের অনুরোধ করেন। ছেলে অতীন্দ্রের বিয়েতে তাই যথারীতি কার্ড পেয়েছিলেন। কার্ড পেয়ে অরিন্দম খুশি হয়ে টেলিগ্রাম করেন যে তিনি বিশেষ কাজে কলকাতা যাবার কথা ভাবছিলেন। এই সুবাদে অবশ্যই যাচ্ছেন! কিন্তু কোন নির্দিষ্ট তারিখ বা সময়ের কথা বলেননি। শুধু বলেছেন যে তাকে রিসিভ করার জন্য এয়ারপোর্টে যেতে হবে না কিংবা বাড়িতে কোন ব্যবস্থা রাখতেও হবে না। তিনি নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেবেন এবং সোজা বিয়ের পার্টিতে গিয়ে যোগ দেবেন। কারণ, কলকাতায় পৌঁছেই তাকে কয়েকটি জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। …কিন্তু কলকাতায় গত রাতে পৌঁছে অরিন্দম এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়েছেন। একটা বড় হোটেলে তিনি উঠেছেন। রাতের খাওয়া শেষ করে শুতে যাচ্ছেন, হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। হোটেলের অপারেটর বলেন, কোন এক পি. মৈত্র আপনাকে চাইছেন। কথা বলুন। ফোন ধরে হতভম্ব হয়ে যান অরিন্দম। অচেনা গলায় তাকে কেউ শাসিয়ে বলছে, যদি আগামী সন্ধ্যায় শচীন্দ্র বোসের বাড়ি বিয়ের পার্টিতে আপনি যান, আর জ্যান্ত ফিরতে হবে না। অরিন্দম কথা বলার চেষ্টা করতেই লাইন কেটে যায়। তিরিশ বছর পরে দেশে ফিরেছেন। দেশের হালহদিস লোকচরিত্র সবই জটিল ঠেকছে। হঠাৎ এমন অদ্ভুত শাসানি শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন অরিন্দম। একবার ভাবেন, পুলিশে জানাবেন। পরে মনে হয়, ফোনে কে শাসাল তা নিয়ে অকারণ হইচই করার মানে হয় না। কিন্তু আজ সকালে ফের আবার সেই ভুতুড়ে ফোন আসে! একই শাসানি। অতীন্দ্রের বিয়ের পার্টিতে গেলে প্রাণে মারা পড়বেন। হতবুদ্ধি হয়ে যান অরিন্দম। তারপর কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের কথা মনে পড়ে। নিউইয়রকারে কর্নেলের বাড়ির একটা বিবরণ রাস্তার নাম ইত্যাদির উল্লেখ ছিল। বিশেষ করে বাড়ি দক্ষিণে প্রকাণ্ড নিমগাছে এবং কয়েক হাজার কাকের কথাও ছিল। তাই এখানে পৌঁছতে কোন অসুবিধে হয়নি।

এই বিবরণ শোনার পর বললুম, হা, কিন্তু অরিন্দম কলকাতা পৌঁছে বোস বাড়িতে একবারও ফোন করেননি কেন? এই একটা মারাত্মক গোলমেলে পয়েন্ট এই বিবরণে রয়েছে। দুনম্বর পয়েন্টই বা কম গোলমেলে নয় কেন? অরিন্দম কোন বিয়ের পার্টিতে গেলেই খুন হয়ে যাবেন–একথাই বা বিশ্বাস করে বসলেন কোন্ যুক্তিতে যদি না তেমন কোন কারণ পেছনে থাকে? কী সেই কারণ, অরিন্দমের নিশ্চয় জানার কথা। না জানলে ভয় পেতেন না।

কর্নেল বললেন, বোস বাড়িতে অরিন্দম ফোন করেছিলেন। একবার নয় অনেকবার। কিন্তু কোনবারই লাইন পাননি। একশো নিরানব্বই ডায়াল করেও একই এনগেজড টোন! বলবে, বেশ। তাহলে ওঁদের ওখানে সোজা ট্যাক্সি করে চলে যেতে পারতেন।

বললুম, নিশ্চয়ই!

ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করো, জয়ন্ত। উনি এখন বস্তুত এদেশে বিদেশী মানুষ। একেই ওই ভুতুড়ে ফোনের শাসানি শুনে ভীষণ ঘাবড়ে গেছেন। বোস বাড়িতে যেতে আর একটুও সাহস পাচ্ছেন না। এবার দ্বিতীয় পয়েন্টের জবাব দিচ্ছি। ভয় পাবার কারণ একটা অবশ্যই আছে। অরিন্দম একটা নামী কোম্পানির নিউইয়র্কহেড অফিসে খুব দায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন। কলকাতার একটা ইমপোর্ট কোম্পানির সঙ্গে খারাপ কোয়ালিটির মাল পাঠানো নিয়ে ওঁর কোম্পানির সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল গত বছর। এখানকার কোম্পানির ধারণা, বদবুদ্ধি হাড়ে হারামজাদা এক বাঙালিই মার্কিন কোম্পানিতে থেকে কাণ্ডটি বাধিয়েছে। এর ফলে কলকাতার কোম্পানিটির কয়েক লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

বললাম, বোঝা গেল, যে অরিন্দমের এদেশে শত্রু আছে। কিন্তু তাই বলে বিয়ের পার্টিতে গেলে তাকে প্রাণে মারা হবে কেন? অন্য কোথাও কি মারার সুযোগ নেই?

কর্নেল বললেন, প্রশ্নটা যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু অরিন্দম এর জবাবটাও দিয়েছেন। যুক্তিপূর্ণ জবাব।

কী জবাব?

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ফের ধরিয়ে বললেন, তুমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছ না। আগে সেটা লক্ষ্য করো। তাহলে জবাবটা তুমি নিজেই পেয়ে যাবে।

একটু ভেবে বললাম, হুঁ। কেউ বা কারা চায় না যে অরিন্দম বিয়ের পার্টিতে যান। তাই না কর্নেল?

কর্নেল আমার কাঁধে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে বললেন, রাইট রাইট! কাজেই বুঝতে পারছ, আসলে অরিন্দম এই রহস্য নিয়েই বিব্রত এবং উদ্বিগ্ন। তিনি বিয়ের পার্টিতে গেলে নিশ্চয় কারও মারাত্মক ধরনের ক্ষতি হবে। এছাড়া ওই শাসানির আর কোনও কারণ থাকতে পারে না। অতএব জয়ন্ত, অরিন্দম আপাতত শত্রুভয় কিংবা মৃত্যুভয়ের তাগিদে আমার দ্বারস্থ হননি। হয়েছেন ওই রহস্যের একটা কিনারা করতে।

বললাম, বুঝেছি বুঝেছি। আপনার ঘাড়ে রহস্য উন্মোচনের দায়টাও চাপানো গেল এবং সেই সঙ্গে খুন হয়ে যাবার আশঙ্কা থেকে নিরাপদে থাকা গেল। বাঃ! অরিন্দমবাবুর বুদ্ধি আছে। কিন্তু কর্নেল, জেনেশুনে আপনি নিজের মুণ্ডুটি হাড়িকাঠে গলাতে যাচ্ছেন–এই সহজ সত্যটা টের পাচ্ছেন তো?

মাথা নেড়ে কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন, অবশ্যই পাচ্ছি ডার্লিং!

পার্টিটা হচ্ছে কোথায়? বোস বাড়িতেই তো?

হ্যাঁ, জয়ন্ত।

তাহলে আগে খোঁজ নেওয়া দরকার, কোন্ কোন্ রথীমহারথীর ওখানে নেমন্তন্ন হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের অতীত ইতিহাস জানা দরকার। অরিন্দমের সঙ্গে কারও কোন ব্যাপারে চেনাজানা ছিল কি না। তারপর…..

হাত তুলে কর্নেল বললেন, এনাফ জয়ন্ত, যথেষ্ট! তোমার পদ্ধতির প্রশংসা করছি। তো আপাতত প্রথম কাজ, বোস বাড়িতে ফোন করা। ফোন সত্যি খারাপ কি না তাও জানা যাবে। আর আমি ফোন করলে ওঁরা এক্ষুনি হুলুস্থূল বাধিয়ে বসবেন। তোমার অনেক স্কোপ রয়েছে।

আমি ফোনের দিকে হাত বাড়ালে কর্নেল বললেন, এক মিনিট জয়ন্ত। তুমি ওদের জানাবে না যে অরিন্দম কলকাতা পৌঁছেছেন। তাঁর সম্পর্কে কোন কথা তুলবে না। তুমি দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার মাত্র। স্যার জগদিন্দ্রর নাতি প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী। তার বিয়ের পার্টির খবর একটা ছাপার যোগ্য আইটেম। ওঁরা দেখবে, ভীষণ খুশি হবেন এবং তোমাকেও নেমন্তন্ন করে বসবেন।

শচীন্দ্রলালের ফোন নম্বর আমার মুখস্থ। এটা অভ্যাস। বিশেষ করে রাজনীতিকদের ফোন নাম্বার সারাজীবন মনে রাখার ক্ষমতা রিপোটারদের আছে। ডায়াল করলাম। কিন্তু এনগেজড টোন। আবার ডায়াল করলাম, আবার একই অবস্থা। বারপাঁচেক চেষ্টার পর একশো নিরানব্বইয়ের সাহায্য চাইলুম! ফলটা একই হল। তখন হাল ছেড়ে দিয়ে বললুম, তাহলে অরিন্দম মিথ্যে কথা বলেননি। লাইনে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।

কর্নেল বললেন, আমারও তাই ধারণা। অরিন্দম মিথ্যাবাদী নন। রহস্যটা ফাস হওয়ার আগে উনি বোসবাড়িতে যেতে চান না।

হঠাৎ নড়ে বসলুম। কিন্তু কর্নেল! বিয়ের পার্টিতে যদি আপনার চেনা-জানা কেউ এসে পড়ে?

কর্নেল বললেন, আজ রাতে আটটায় পার্টি শুরু। তার আগে জানা দরকার কে কে আমন্ত্রিত হয়েছেন। এবং কথাটা তুমিই যখন তুলেছ, তখন তুমিই সেটা যোগাড় করে তানো। রিপোর্টারের স্কোপটা কাজে লাগাও। কেমন?

চিন্তিত মুখে বললাম, চেষ্টা করে দেখি। কিন্তু যদি সত্যি আপনার চেনাজানা কেউ আমন্ত্রিত হন?

কর্নেলের মুখে একটা দৃঢ় সংকল্প ফুটে উঠল। বললেন, যেভাবে হোক কথা যখন দিয়েছি, তখন সব রিস্ক আমি নেবই। শুধু তুমি আমাকে সাহায্য করো, ব্যস!

আমি তৈরি, কর্নেল। এখনই বেরোচ্ছি।

এসো! সব সময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলো।

অবশ্যই! …বলে বেরিয়ে এলাম। কর্নেল পোকামাকড় ভুলে মুখে দাড়ি খামচে ধরলেন এবং যথারীতি টাকে হাত বুলোতে শুরু করলেন। গুরুতর কোন ব্যাপারে ইদানীং ওঁর এই বিচ্ছিবি অভ্যেস গজিয়ে উঠেছে।

কর্নেলের বাড়ির গেটে বেরিয়ে রাস্তার ওধারে পানের দোকানের দিকে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি ফেলেছিলাম এক পলক। একজন মস্তান ধরনের লোকের সঙ্গে চোখাচোখি হল। সে অবশ্য তখন মুখ ঘুরিয়ে আয়নায় চুল আঁচড়াতে থাকল। কিন্তু কেন যেন মনে হল, লোকটা কর্নেলের বাড়ির দিকেই সম্ভবত নজর রেখেছিল। সম্ভবত এই মনে হওয়ার ব্যাপারটা গভীর এক সহজাতবোধ। এর মধ্যে কোন যুক্তি থাকে না। লোকটাকে কস্মিনকালে দেখিনি। অথচ তার ওই একপলক চানিতেই যেন রহস্য থমথম করছে। নাকি স্রেফ মনের ভুল?

অস্বস্তিটা রয়ে গেল। আমার ফিয়াট গাড়িটা শেক্সপিয়ার সরণি হয়ে চৌরঙ্গি পৌঁছানো পর্যন্ত সতর্কভাবে পিছনে লক্ষ্য রাখলাম, কেউ আমায় অনুসরণ করছে কি না। আলিপুর চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে যাবার সময় শেষ পর্যন্ত অস্বস্তিটা কেটে গেল। এতদিন তো কর্নেল নিজের রহস্যের জট খুলেছেন, আমি অলসভাবে বসে থেকে সব দেখেছি। এবার আমি ওঁর সহকারীর ভূমিকা নিয়ে ফেলেছি। অস্বস্তিটা সেখানেই।

অনেকদিন পরে শচীন্দ্রলালের বসুনিবাসে আবার এলাম। দুদিন আগে বিয়ের উৎসব গেছে। আজ রাতে বিয়ের পার্টি। তাই বিশাল বাড়িটার সাজগোজ এখনও জমকালো। তবে মাইকে একঘেয়ে সানাই বাজছে না, এটা আমার পক্ষে খুশির কারণ। আমার বড় মাইক-অ্যালার্জি আছে। গেটে ঢোকার মুখে আমার আইডেন্টিটি কার্ড দেখাতে হল। এত কড়াকড়ি কেন বুঝলাম না। লনে গাড়ি রেখে নেমে দেখি, এদিকে-ওদিকে আরও চার-পাঁচটা গাড়ি রয়েছে। সেটা স্বাভাবিক। সেকেলে ড্রয়িংরুমের দরজায় যেতেই শচীন্দ্রলালের প্রাইভেট সেক্রেটারি সত্যহরিবাবুর সঙ্গে দেখা হল। সত্যহরিহরবাবু অবাক হয়ে বললে, জয়ন্তবাবু যে! কী ব্যাপার? কর্তা তো আর দেশের কোন ঘোরপ্যাঁচে নেই। ইলেকশানেও দাঁড়াচ্ছেন না। …আমাকে চুপ দেখে একগাল হেসে ফের বললেন, সরি! আসুন, আসুন। আগে আসন গ্রহণ করুন, তারপর কথা।

নিঃশব্দে ভেতরে গিয়ে বসলাম ড্রয়িংরুমে নয়, পাশেই সত্যহরিবাবুর অফিস ঘরে। ড্রয়িংরুমে জনাতিন ঢনঢনিয়া গোছের অবাঙালি বসে আছেন দেখলাম।

সত্যহরি মিটিমিটি হেসে বললেন, নির্বাক যে! রাগ হয়েছে নাকি? তবে যে বলতেন, রিপোর্টারদের রাগ ঘেন্না ভয়, তিন থাকতে নয়!

ততক্ষণে বুঝেছি, বিয়ের পার্টিতে কারা আমন্ত্রিত তার খবর এঁর কাছেই পাওয়া যাবে। এবং আমি যে আমন্ত্রিত হইনি, তাও সত্যহরি জানেন। সিগারেট ধরিয়ে বললুম, আপনি ঠিকই বলেছেন সত্যবাবু।

সত্যহরি হাসতে হাসতে বললেন, আগে আপনি আমাকে সত্যদা বলতেন।

তখন আমিও হাসলুম। উনি ঘণ্টা বাজিয়ে চা সন্দেশের ফরমাশ করলেন। নানা ব্যাপারে কথা হতে লাগল। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, ভুলেও বিয়ের পার্টির প্রসঙ্গে আসছেন না। এমন কি আমার উদ্দেশ্য নিয়েও আর প্রশ্ন তুলছেন না। অগত্যা আমাকেই তুলতে হল। বললাম, সত্যদা, আমি কিন্তু একটা বিশেষ উদ্দেশ্যেই এসেছি। খবরের কাগজ মহলে জোর গুজব রটেছে যে…

এইটুকু শুনেই সত্যহরি আঁতকে উঠে বললেন, সর্বনাশ! বলেন কী মশাই?

হ্যাঁ, দাদা। তবে গুজব ইজ গুজব। নেহাত খবরের কাগজের ব্যাপার–তাই একটুখানি খোঁজ-খবর নিতে হয়। …বলে আমি অমায়িক মুখভঙ্গি করলুম।

সত্যহরি উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, কিন্তু ব্যাপারটা তো বাইরের কারও জানার কথা না। জানার মধ্যে শুধু বড়কর্তা, ছোটকর্তা, ছোটকর্তার বউ আর আমি। এ ছাড়া বাকি রইল শুধু পুলিশ। তাহলে কি পুলিশমহল থেকেই রটেছে? আপনি কোত্থেকে শুনলেন বলুন তো?

মড়ার গন্ধে শেয়াল কুকুর চনমন করে ওঠে, তেমনি আমি। কিন্তু বুদ্ধিমানের মতো ব্যাপারটা নাড়াচাড়া করতে হবে। বললুম, সোর্স বলাটা আমাদের এথিকসের বাইরে–তা তো ভালই জানেন সত্যাদা।

হুম্। উদ্বিগ্ন সত্যহরি বললেন, দেখুন এবার সত্যি কথাটা বলি। আজ দুদিন থেকে আমরা কোন ফোন অ্যাকসেপ্ট করছি না। লাইন বন্ধ রাখা হয়েছে। মিঃ বোসও কারো সঙ্গে দেখা করছেন না। জুনিয়র মিঃ বোস মানে অতীন্দ্রও সেইভাবে আছেন। এদিকে বিয়ের পার্টির নেমন্তন্ন যাদের করার, সব করা হয়েছে। হঠাৎ তাদের বারণ করলেই বা কী ভাববেন? এদিকে বলছেন, গুজব ছড়িয়েছে। এ অবস্থায় আর তত বারণ করাই অসম্ভব। তাহলে সবাই বুঝবেন। গুজবটা সত্যি এবং আরও কেলেঙ্কারি রটে যাবে। অতএব এরপর আর বিয়ের পার্টি বন্ধ করার কথা ভাবাও যায় না।

বললুম, অবশ্যই যায় না। আমন্ত্রিতরা মান্যগণ্য লোক। স্যার জগদিন্দ্রর বাড়ি নেমন্তন্ন উপলক্ষে আসতে তারা সবাই উদগ্রীব। একটা ঐতিহ্যসম্পন্ন ফ্যামিলি বলে কথা।

সত্যহরি সায় দিয়ে বললেন, তাহলেই বুঝুন।

বললুম, অবশ্য অনেক কড়াকড়ির ব্যবস্থা আপনারা রেখেছেন।

তা তো রাখতেই হয়েছে। সত্যহরি চাপা গলায় বললেন। আপনি আমার। চেনাজানা বহুদিনের। একমাত্র আপনাকেই সব বলা যায়। অনেক সিকিউরিটি সাদা পোশাকে রয়েছে। আপনি খবরের কাগজের লোক বলেই ঢুকতে পেরেছেন। তবে এখনই বলে দিচ্ছি, আর কোন রিপোর্টার যেন ঢুকতে না পায়। …বলে উনি উঠে গেলেন।

আকাশ-পাতাল ভাবছি, এমন সময় সত্যহরি ফিরে এলেন। বসে বললেন, মিঃ বোসকে খবরটা দেওয়া দরকার যে গুজব ছড়িয়েছে। কিন্তু প্লিজ জয়ন্তবাবু, আপনি যেন গুজবকে প্রশ্রয় দেবেন না। এক্সক্লসিভ স্টোরির লোভে যেন আমায় ডোবাবেন না। কারণ আপনি এসেছিলেন–আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এবং কাগজে পরে কিছু বেরোলে আমাকে স্যাক করা হবে। বুঝছেন তো?

আপনি খেপেছেন সত্যদা? জাস্ট নিউজ এডিটরের হুকুম–আসতে হয়। তাই এলাম। …বলে সিগারেট দিলুম ওঁকে। ফের বললুম, এতকাল কি আপনাকে কখনও ডুবিয়েছি?

সত্যহরি সিগারেট ধরিয়ে চাপা গলায় বললেন, বুঝলেন? অতীন্দ্রকে আমি নিষেধ করেছিলাম–অজ্ঞাতকুলশীল মেয়েকে বিয়ে করা ঠিক নয়। তার আগে মিঃ বোস তো বলে বলে ব্যর্থ হয়েছেন। আমি এ বাড়িতে তিনপুরুষ ধরে কাটিয়ে বুড়ো হলাম। মিঃ বোস আমাকে বাবার মতো মানে। অতীন্দ্র আমায় পাত্তাই দিল না। এ কালের ছেলে, কী আর বলব বলুন!

আন্দাজে বললুম, হ্যাঁ, অতীন্দ্র কাজটা ভাল করেননি।

তা তো করেইনি। আরে বাবা, আমেরিকায় ছবির এগজিবিশন করতে গেলি, নাম হল। ব্যস। ঘরের ছেলে সোজা ঘরে ফিরবি। তা নয়, একটা অচেনা মেম সঙ্গে এনে বললি–বিয়ে করব। সত্যহরি ফিসফিস করে বলতে লাগলেন। …ছ্যা ছ্যা। বংশের নাম ডোবালে।

বললুম, আজকালকার যা রীতি। যাক গে, বিয়ে তো হয়ে গেছে।

তা হয়েছে। কিন্তু ওই বউ নিয়ে ঘর করতে পারবে? বিয়ের আগে থেকেই চিঠি আসা শুরু। এখনও আঁকে ঝাঁকে আসছে। আজ সকালেও একটা এসেছে ডাকে।

বলেন কী!

হ্যাঁ। গুজব তো এমনি রটেনি। নিশ্চয় ডাক অফিসে কেউ খুলে পড়ে ফেলেছে।

কিন্তু গুজব যা, তা গুজব।

সত্যহরি গলা আরও চাপা করে বললেন, না মশাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, উড়োচিঠির শাসানি মিথ্যে নয়। আজ রাতের পার্টিতেই মেয়েটিকে কেউ বা কারা কিডন্যাপ করবেই। আমার কী ধারণা জানেন? এই মেয়েটি–মানে অতীন্দ্রের মেমবউ কোন দুষ্টচক্রের মক্ষিরানী ছিল। দল ছেড়ে পালিয়ে অতীন্দ্রের গলা ধরে মরিয়া হয়ে ঝুলে পড়েছে। ভেবেছে, দেশান্তরে গিয়ে বেঁচে যাবে। কিন্তু আজকাল সব গ্যাংয়েরই তো ইন্টারন্যাশনাল কারবার রয়েছে। তাই বলছি, দেখবেন–আজ রাতে বিয়ের পার্টি থেকে ওকে কিডন্যাপ করবে বলছে, ঠিক তাই করবে। মশাই, লক্ষ্মীন্দরের লোহার বাসরেও ছিদ্র ছিল!

সব বুঝলুম! চাঞ্চল্য চেপে বললুম, মেমসায়েবের নাম কী?

জিনা হেওয়ার্থ। সত্যহরি বললেন। দেখে বয়েস আন্দাজ করা মুশকিল। পঁচিশ হতে পারে। অতীন্দ্রের চেয়ে বয়সে অনেক বড়।

একটু হেসে বললুম, এমন হতে পারে, জিনার কোন প্রেমিক নিছক ভয় দেখাচ্ছে!

সত্যহরি বললেন, মোটেও তা নয়। জিনা নাকি এই প্রথম এদেশে এসেছে। অথচ শাসানি আসছে কলকাতার ডাকঘরের মারফত। তার মানে কলকাতাতে চিঠি ডাকবক্সে ফেলা হচ্ছে। সবই জি.পি.ও.র ছাপ। কাগজ, টাইপ, কালি–সব ইন্ডিয়ান। পুলিশ তাই বলছে। এমন কি ভাষাও আমেরিকান বা কোন সাহেবের নয়। দিশি ইংরেজিতে লেখা টাইপ করা চিঠি। বলেই সত্যহরিবাবু লাফিয়ে উঠলেন। …এইরে! সাড়ে দশটা হয়ে গেল যে। কর্তার ডাক আছে, জয়ন্তবাবু। ওপরে যেতে হবে। কিন্তু প্লিজ ব্রাদার, এই বুড়োর মুখের দিকে চেয়ে যেন কাগজে কিছু লিখবেন না।

যদি সত্যি কিডন্যাপ হয়?

সত্যিহরি বললেন, তাহলে তো নরম্যালি খবরের কাগজে যা বেরোয়, বেরোতে পারে অস্বীকার করছি না। কিন্তু দোহাই ভাই, আমার নাম যেন বাদ থাকে। পুলিশ রিপোর্টে যা পাবেন, লিখবেন।

এক মিনিট দাদা। আমন্ত্রিত হয়েছেন কারা, দয়া করে বলবেন?

সত্যহরি ব্যস্তভাবে টেবিলের দেরাজ খুলে একটা টাইপকরা লিস্ট বের করলেন। দ্রুত ভাজ করে আমার হাতে গুঁজে ফিসফিস করে বললেন, লুকিয়ে ফেলুন এক্ষুনি।

দুজনে বাইরে এলুম। সত্যহরি আবার আমাকে ওঁর নিজের ব্যাপারে সাবধান করে দিতে ভুললেন না। গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। এইসময় বললুম, সত্যদা, একটা কথা বলি। আজ রাতে বিয়ের পার্টিতে যদি দৈবাৎ আমাকে দেখতে পান, অচেনা হয়ে এড়িয়ে থাকবেন। প্লিজ!!

সত্যহরি চমকে উঠলেন। তারপর ফিক করে হেসে বললেন, আপনার এসব ব্যাপারে উৎসাহ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু আসবেন কীভাবে? কোন চান্স তো দেখছি না। লিস্টের নাম মিলিয়ে ঢুকতে দেওয়া হবে। শচীন্দ্রবাবু নিজে দরজায়। সবাইকে আপ্যায়ন করতে দাঁড়িয়ে থাকবেন। কড়াকড়িটা বুঝতে পারছেন না?

যে ভাবে হোক, আমি ঢুকতে চেষ্টা করব।…দৃঢ়স্বরে বললুম।

সত্যহরি চোখ নাচিয়ে বললেন, পাঁচিল টপকে নয়তো? গুলি খাবেন– সাবধান। তাছাড়া, শচীন্দ্রবাবুও তো আপনাকে রীতিমতো চেনেন! অতীন্দ্রও সম্ভবত চেনে।

বললুম, শচীন্দ্রবাবু চোখ এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করব। আর অতীন্দ্র আমাকে তার এগজিবিশনে বার দুইতিন দেখেছেন–বিশেষ আলাপ হয়নি। তাই মনে থাকার কথাই নয়।

সত্যহরি একটু নার্ভাস হয়ে বললেন, সব আপনার রিস্ক মশাই! কিন্তু যাই খুন, দোহাই ব্রাদার–আমায় যেন ফাসাবেন না। …

আগে বরাবর ঠিক এভাবেই এই সরল বৃদ্ধ লোকটির কাছে শচীন্দ্রের রাজনৈতিক খবর আদায় করেছি।

কর্নেল সব শুনে বললেন, মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যাচ্ছে না, জয়ন্ত! শুধু একটা ব্যাপার স্পষ্ট হচ্ছে যে কেউ বা কারা বিয়ের পার্টি হওয়াটা একেবারেই পছন্দ করছে না! কিডন্যাপ সত্যিসত্যি করার মতলব থাকলে আগেভাগে কেউ ওভাবে জানায় নাকি? এই গেল এক নম্বর। দুনম্বর হচ্ছে, যদি বা বিয়ের পার্টি হয়, সেখানে যেন অরিন্দম রায় না যান।

বললাম, কিন্তু কেন?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, একটা অনুমান মাথায় আসছে এবার। ওই জিনা হেওয়ার্থকে যদি তোমার সত্যহরিবাবুর বিশ্বাসমতো কোন দুষ্টচক্রের মক্ষিরানী ধরে নিই, তাহলে বলতে হয়–অরিন্দম জিনাকে চেনেন এবং তিনি বিয়ের পার্টিতে গেলে জিনাকে দেখতে পাবেন, এটা হয়তো জিনা নিজে কিংবা তার লোকেরা চায় না।

বললাম, কিন্তু বিয়ের পার্টি কেন? অরিন্দম ততো বোসবাড়িতে যে কোন সময় গিয়েও জিনাকে দেখতে পাবেন। কাজেই অরিন্দমকে শাসানি এবং জিনাকে কিডন্যাপের শাসানির মধ্যে কোন যোগসূত্র নেই।

কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কথায় যুক্তি আছে। বিয়ের পার্টি ব্যাপারটাই একটা ধাঁধা।..বলে তিনি সত্যহরির দেওয়া তালিকাটা দেখতে থাকলেন। একটু পরে বললেন, মাত্র পাঁচটি দম্পতি আমন্ত্রিত। তার মধ্যে অরিন্দমের নাম নেই। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। উনি ওদের ঘরের লোক বলা যায়। হুম, পাঁচজন পুরুষ এবং পাঁচজন মহিলা! এদের কেউ আমার চেনাজানা নন। ভালই। কিন্তু স্যার জগদিন্দ্রের নাতনির বিয়ের পার্টিতে মোটে পাঁচজন মানে স্বামী-স্ত্রী মিলে দশজন আমন্ত্রিত? কেন বল তো?

বললুম, মেমসাহেব বউ। তাই সম্ভবত বেছে ওই ধরনের উদার প্রগতিশীল মনোভাবসম্পন্ন লোকেদের ডাকা হয়েছে। এ তো কোন তথাকথিত সামাজিক অনুষ্ঠান নয়। নিছক মুখরক্ষা।

ঠিক বলেছা। কর্নেল আবার নামগুলো খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন। একটু পরে বললেন, চলো–দুজনে একবার বেরোই। জাস্ট আধঘণ্টার জন্যে। অরিন্দমবাবুকে আগে ফোনে জানাই, ওঁর হোটেলে নয়–অন্য কোথাও বসে এই লিস্টটা দেখাব। কাকেও চেনেন নাকি দেখা যাবে।…

ডায়াল করে বললেন, হোটেল ইন্দ্রপুরী? প্লিজ, রুম নাম্বার ৭২৭ — অরিন্দম রায়। আচ্ছা, ধরছি। …কী বললেন? ঘরে নেই? কখন ফিরবেন? আচ্ছা ধন্যবাদ। ফোন রেখে কর্নেল বললেন, সকাল সাতটায় বেরিয়েছেন। এখনও ফেরেননি। কিছু বলে যাননি। তার মানে, আমার এখান থেকে হোটেলে এখনও ফেরেননি।

বললুম, ভদ্রলোকের ব্যাপারটা বুঝতে পারছিনে। সোজা বোসবাড়িতে গিয়ে উঠলেই পারেন। কিংবা গিয়ে জানাতে পারেন যে এসে পৌঁছেছেন! তা নয়– কী এক গণ্ডগোল সৃষ্টি করে বসেছেন। উদ্দেশ্যটা কী?

কর্নেল অস্পষ্টভাবে শুধু বললেন, ওখানে যেতেই ভয় পেয়েছেন বেচারী।

কিসের এত ভয়?

কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে পোকামাকড়ের জারের দিকে এগোলেন। অমনি উঠে দাঁড়ালুম। বললুম, আমি গেলুম কর্নেল। ওবেলা আসছি জাস্ট ছটার মধ্যে।

কর্নেল গলার ভেতরে কী বললেন, বোঝা গেল না। আমি বেরিয়ে গেলুম। নিচে নেমে গেট থেকে বেরোচ্ছি, সেই পানের দোকানটার দিকে তাকালুম। ফের চমকে উঠলুম। সেই মাস্তান টাইপ লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার চোখে চোখ পড়ামাত্র মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমি তীব্র দৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম দুমিনিট। কিন্তু সে আর মুখ ঘোরাল না। উদাস ভঙ্গিতে আকাশ দেখতে থাকল। বোসবাড়ি থেকে এখানে ফেরার সময় এর কথা ভুলে গিয়েছিলুম বলে আর লক্ষ্য করিনি। লোকটা কি সারাদিন এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? কে ও?

আবার অস্বস্তি জেগে উঠল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ওর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলুম। একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইচ্ছে হল, গিয়ে ওর কলার খামচে ধরে জিগ্যেস করি কে এবং কী উদ্দেশ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানের দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে আছে? কিন্তু সেটা হঠকারিতা হবে। তাই ইচ্ছে দমন করতে হল।

একটু পরে মাথায় চিন্তাভাবনা এসে গেল। অরিন্দমের কলকাতা আসা এবং কর্নেলের বাড়ি আসা পর্যন্ত, সবটাই কেউ বা কারা নজরে রেখেছে। উনি কোন হোটেলে উঠেছেন, তাও কারও বা কাদের জানা। তার মানে নিউইয়র্ক থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটা জাল ছাড়ানো রয়েছে। অরিন্দমকে সম্ভবত চোখে-চোখে রাখা হয়েছে। এমন কি কর্নেলকেও চোখে-চোখে রাখা হয়েছে। ভুল হল। কর্নেলকে কথাটা বলে আসা উচিত ছিল যে একজন লোক পানের দোকান থেকে তার গতিবিধির ওপর নজর রাখছে।

বাসায় ফিরে তক্ষুনি ফোন করলুম। কর্নেল বললেন, নতুন কিছু?

হ্যাঁ, কর্নেল। আপনার বাড়ির সামনে পানের দোকানে একটা লোক সকাল থেকে..

আমার বাড়ির দিকে নজর রেখেছে বলছ?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে হচ্ছে, অরিন্দমকে ফলো করে এসে আপনার এখানে..

আবার বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, ছেড়ে দাও।

তারপর ফোন রাখবার শব্দ হল। সম্ভবত বুড়ো এখন ফের পতঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বিরক্ত হয়ে ভাবলুম, এই কেসটার শেষ পর্যন্ত কিস্যু ফয়সালা হবে না।

খাওয়ার পর দৈনিক সত্যসেবক আফিসে একবার না গেলেই নয়। ছুটি নেওয়া যেত। বিকেলের শিফটে ডিউটি চলছে এ সপ্তাহে। কিন্তু বোসবাড়ির ব্যাপারটা নিয়ে কাগজে একটা চমকপ্রদ খাদ্য পরিবেশনের সুযোগ আছে এবং সেটা বার্তা সম্পাদক আর চিফ রিপোর্টারকে জানালেই অন ডিউটিতে বেরিয়ে পড়া যায়। খামোকা একটা ছুটি নষ্ট করি কেন? তাই তিনটে নাগাদ সেখানে গেলুম।

গিয়ে পড়ে গেলুম এক ফ্যাসাদে। রিপোটার তারকবাবু আমাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন, এস, এস, জয়ন্ত। বহুকাল বাঁচবে। এইমাত্র ভাবছিলাম তোমার বাড়িতে ফোন করব। বলা যায় না, কোন বেখেয়ালে অফিস কামাই করে না বসো। যাক গে, সুখবর যে তুমি এলে।

বললুম, ব্যাপার কী তারকদা?

তারকবাবু বললেন, লালবাজার ক্রাইম ব্রাঞ্চের প্রশান্তবাবু ঘণ্টাখানেক আগে ফোন করছিলেন। খুব হট ব্যাপার। এক্ষুনি গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করো। জব্বর কেক খেয়ে এসো।

বোসবাড়ির প্রসঙ্গ তুলে এই অ্যাসাইনমেন্ট অন্য কারু কাঁধে চাপাবার জন্য অনুরোধ করব ভাবছি, তারকবাবু ফের বললেন, হাঁ করে দেখছ কী? বেরিয়ে পড়ো। হোটেল ইন্দ্রপুরীতে একটা খুনখারাবি না কী হয়েছে। কী সব গোলমেলে সূত্র পাওয়া গেছে। ইন্টারন্যাশনাল গ্যাং-ট্যাং-এর কারবার নাকি। শিগগির যাও! না–না। হোটেলে নয়, লালবাজারে। প্রশান্তবাবু সব কাগজের লোককেই ডেকেছেন।

আমার মাথা ঘুরে গেল। বুকের মধ্যে হাতুড়ি পড়ল। তক্ষুণি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে লিফটে চাপলুম। নিচে রিসেপশনে এসে মনে হল, কর্নেলকে ফোন করা উচিত। ডায়াল করার একটু পরে কর্নেলের পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, হ্যালো। কর্নেল সরকার বলছি।

চাপা গলায় বললুম, কর্নেল! জয়ন্ত বলছি। হোটেল ইন্দ্রপুরীতে…

বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, অরিন্দম রায় খুন হয়েছেন।

চমকে উঠে বললুম আপনি কী ভাবে জানলেন?

জবাব এল; ঘণ্টাখানেক আগে আমি ওখানে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি হইচই চলছে। রুম নাম্বার ৭২৭–এ কে এক অরিন্দম রায় রক্তাক্ত শরীরে বাথরুমে পড়ে আছেন। পুলিশ এসে গেছে। কিন্তু আমি তাজ্জব হয়েছি জয়ন্ত? এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। বুদ্ধি গুলিয়ে গেছে। কারণ…

কী কর্নেল? কী?

নিহত লোকটি আমার অচেনা।

সর্বনাশ! বলেন কী!

হা জয়ন্ত। আজ সকালে যিনি নিজেকে অরিন্দম রায় বলে আমার কাছে। এসেছিলেন, তিনি নন। অথচ ঘর হাতড়ে পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি যা পাওয়া গেছে, তাতে বোঝা যায়, নিহত লোকটিই প্রকৃতপক্ষে আসল অরিন্দম রায়। তাঁকে খুন কার হয়েছে অন্তত চোদ্দ ঘণ্টা আগে। তার মানে গতরাতে দমদম থেকে পৌঁছে হোটেলে ঢোকার পরই উনি খুন হয়েছেন। রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। রাইগর মরটিসের স্টেজ পেরিয়ে বডি—জয়ন্ত, ফোনে সব বলা সম্ভব নয়। তুমি চলে এস। তোমার বাড়িতে ফোন করে জানলাম, তুমি বেরিয়েছ। যাই হোক, চলে এস।

কর্নেল, লালবাজারে প্রশান্তবাবু রিপোটারদের ডেকেছেন। উপলক্ষ–হোটেল ইন্দ্রপুরীর হত্যাকাণ্ড আমি সেখান হয়েই যাচ্ছি।

বেশ। কিন্তু বেশি দেরি করো না।..

ফোন রেখে বেরিয়ে গেলুম। লালবাজার পৌঁছে ক্রাইম ফিতরে প্রশান্তবাবুর ঘরে ঢুকে দেখি অনেকগুলো চেয়ার এবং চেয়ারগুলো একটা করে সরানো হচ্ছে। তার মানে, সাংবাদিক বৈঠক শেষ। প্রশান্তবাবু মুখে হতাশার ভঙ্গি ফুটিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, মানুষের জীবনে একটা পর্যায় থাকে আরোহণের। তারপর শুরু হয় অবরোহণ পর্ব। আশা করি, খ্যাতিমান জয়ন্ত চৌধুরীর সেই নিম্নমখ গমনপর্ব অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে।

কাচুমাচু মুখে বললুম, দাদা! এই দেরির বিবিধ কারণ আছে।

কিন্তু ভাই, আর তোমায় সময় দেওয়া কঠিন। আমাকে বেরোতে হবে।

প্লিজ দাদা, জাস্ট কয়েকটা কথা।

হঠাৎ প্রশান্তবাবু ফিক করে হেসে বললেন, মাই গুডনেস! তোমার তো জয়ন্ত বিরাট সোর্স রয়েছে। তুমি আমাদের প্রত্যাশী হও কেন, মাঝে মাঝে ভেবে অবাক লাগে। সোজা সেখানেই চলে যাও। আমার চেয়ে বেশি খবর জানতে পারবে।

হেসে বললাম, কর্নেল সরকারের কথা বলছেন তো? উনি কি এই কেসে নাক গলিয়েছেন?

প্রশান্তবাবু ক্রাইম ব্রাঞ্চের চার্জ নিয়েছেন মাত্র মাসখানেক আগে। উনি কেন কে জানে কর্নেলকে আদপে পছন্দ করেন না। পুলিস এত মগজ ও রক্ত খরচ করবে আর উনি শুধু ঘরে বসে আঁক কষে সব ক্রেডিট কুড়োবেন–প্রশান্তবাবু এটা যেন চান না। কিন্তু হলেও প্রশান্তবাবু কর্নেলকে এড়িয়েও থাকতে পারেন না। কারণ, কর্নেলের প্রতি নির্ভরতা আরও ওপরতলা থেকে এসেছে। খোদ কেন্দ্রেই কর্নেলের প্রতিপত্তি প্রচুর।

প্রশান্তবাবু আমার কথার জবাবে বললেন, সে আর বলতে? দুটোয় হোটেল ইন্দ্রপুরী থেকে ফোন পেয়ে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের লোকজনসহ গেলাম। গিয়েই দেখি ভাগড়ে মড়ার গন্ধ পেয়ে শকুনির মাথায় টনক নড়েছে এবং আপনার টাক দাড়িওয়ালা লোকটি যথারীতি হাজির হয়েছেন। মাই গুডনেস! করছি কী? আমাকে বেরোতে হবে। ঠিক আছে ভাই, আসুন তাহলে।…

লালবাজার থেকে বেরিয়ে সোজা কর্নেলের বাড়ি হাজির হলাম। এবার কিন্তু পানের দোকানে লোকটিকে দেখতে পেলাম না।

ঘরে ঢুকে দেখি কর্নেল সেই লাল পোকা নিয়ে ব্যস্ত। আমাকে দেখেই বললেন, অসম্ভব সম্ভব করেছি জয়ন্ত। নীল পোকাটাকে লাল করে ফেলেছি। দেখে যাও এবার। কী অপূর্ব সৌন্দর্য প্রকৃতি সঞ্চষ্টি করেছেন!

বাঁকা মুখে বললুম, পোকা দেখতেই কি আসতে বললেন তখন?

কর্নেল হেসে বললেন, সরি ডার্লিং। এক সেকেন্ড। আসছি।

উনি বাথরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে আমার মুখোমুখি বসলেন। বললেন, অরিন্দম রায় প্লেনে দমদম পৌঁছান গত রাতে এগারোটা নাগাদ। নিউইয়র্ক থেকেই অগ্রিম বুক করা ছিল একটা সিঙ্গল সুইট। হোটেলে পৌঁছান রাত সাড়ে এগারোটায়। ডেডবডি দেখে ডাক্তারের ধারণা খুন হয়েছেন রাত বারোটা থেকে একটার মধ্যে। বাথরুমেই ভোতা কোন জিনিস দিয়ে মাথার পিছনে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করা হয়েছে। এক আঘাতেই মৃত্যু। পায়খানায় কোমাডের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। বড়িতে হত্যাকারী হাত ছোঁয়ায়নি। মোটা হাতুড়ি দিয়েই আঘাত করা হয়েছে সম্ভবত। সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। বাথরুমের মধ্যে পায়খানার পাশটায় আলাদা পাঁচিল এবং দরজা আছে। দরজা খোলা। কোন হাতের ছাপ নেই। দরজার মাথার ওপর কোন চৌকাঠ নেই। তার মানে কোমোডে বসতে যাচ্ছিলেন এবং সবে ঘুরেছেন, অতর্কিতে বাথরুমে ঢুকে হত্যাকারী পায়খানার ওই দরজায় দাঁড়িয়ে হাতুড়ি বা কিছুর আঘাত করে। মাথার পিছনে লাগে। হত্যাকারীর পায়ের ছাপ সেখানে পাওয়া গেছে। আর পাওয়া গেছে শোবার ঘরের মেঝেয়বলা বাহুল্য, জুতোর ছাপ। রবারের সোল। মজার কথা, হত্যাকারীর জুতো দুটো পাওয়া গেছে করিডোরের কোণে আবর্জনার ঝুড়িতে।

কর্নেল থামলে বললুম, আরও মজার কথা। হত্যাকারী অরিন্দমকে খুন করে নিজেই অরিন্দম সেজে হোটেলে থেকেছে এবং সকালে বেরিয়ে সম্ভবত আপনার কাছে এসেছে।

কর্নেল বললেন, ঠিক বলেছ, জয়ন্ত। হোটেলের লোকেরা বলছে, রাতে অরিন্দম ডিনার খাননি। এমনকি সকালে ব্রেকফাস্টও খাননি। হোটেলের এক গ্লাস জল খেয়েছেন কি না সন্দেহ। যে বেয়ারা রাতে এঁকে রুমে পৌঁছে দিয়েছিল, সকালে তার ডিউটি ছিল না। রিসেপশনিস্টও সকালের শিফটে অন্যজন। ম্যানেজার অবশ্য রাতে অরিন্দমকে একবার দেখেছিলেন। সকালে বেরোবার সময় দেখেননি। বড় হোটেল। সবাইকে চিনে রাখাও সম্ভব নয়। কাজেই হত্যাকারীর অঢেল সুবিধা ছিল।

বললুম, কিন্তু হত্যাকারী হোটেলে ঢুকল কীভাবে?

কর্নেল বললেন, আন্তর্জাতিক ধরনের হোটেল। অজস্র লোক সব সময় আসছে-যাচ্ছে। ঢোকাটা একটুও কঠিন নয়। কিন্তু অরিন্দমের সুইটে ঢুকল কীভাবে, সেটাই প্রশ্ন। আমার ধারণা, সে অরিন্দমের খুবই চেনা লোক। খুব চেনা লোক বলেই তাকে অত রাতে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে দিয়েছিলেন। কথাবার্তাও হয়ে থাকবে। তারপর অরিন্দম বাথরুমে ঢোকেন। তখন হত্যাকারী সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ফেলে। কিন্তু এসবের চেয়েও ইন্টাররেস্টিং পয়েন্ট, তা কী জানো? নিহত অরিন্দম রায়ের কাছে যেসব কাগজপত্র পাওয়া গেছে, তাতে পুলিশ স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই ভদ্রলোকই কুখ্যাত এক আন্তর্জাতিক চোরাচালানী দলের নেতা রিচার্ড ওরফে শোভারাম ওরফে প্রিন্স ফরিদ!

চমকে উঠে বললুম, বলেন কী! এই তো সেদিন ব্রিটেনের একটা পত্রিকায় প্রিন্স ফরিদের কীর্তিকলাপ নিয়ে লেখা হয়েছে। সে নাকি আসলে একজন উদ্বাস্তু প্যালেস্টাইনি। কিছুকাল প্যালেস্টাইনি গেরিলা হয়ে প্লেন হাইজ্যাক করে বেড়াত। এক সময় বিশ্ববিখ্যাত বা কুখ্যাত মাফিয়া দলের সঙ্গেও যোগাযোগ

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, না জয়ন্ত! অরিন্দম রায়ই ওর আসল নাম মুঙ্গেরের এক বাঙালি রাজা-জমিদারের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। নকল অরিন্দম যা সব বিবরণ দিয়েছিল আজ সকালে, সবই ঠিক। নিউইয়র্কের ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কোম্পানির বড় পোস্টে চাকরি জুটিয়েছিল, তাও ঠিক। বোসবাড়ির সঙ্গে চিঠি লেখালেখি ছিল, বিয়ের পার্টিতে আসার কথা ছিল–সবই ঠিক। গোপন পুলিশ রিপোর্টটি আমি একটু আগে দেখার সুযোগ পেয়েছি। লালবাজার থেকে মুত্রত রায় এসেছিল। ওকে তো জানো, আমাকে কী প্রচণ্ড মানে গোনে।

বললুম, ভারি অবাক কাণ্ড তো! কিন্তু হঠাৎ এখানে এসেই খুন হয়ে গেল কেন অরিন্দম রায়?

কর্নেল বললেন, আপাতদৃষ্টে মনে হবে, দলের ভেতরকার শত্রুতা অর্থাৎ দলাদলি। কিন্তু আমার মাথায় সত্যি কিছু আসছে না। বোসবাড়ির বিয়ের পার্টিটাই সব জট পাকিয়ে দিচ্ছে। অরিন্দমের হত্যাকারীই যে কাল অরিন্দম সেজে আমার কাছে এসেছিল, তাতে কোন ভুল আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু সে বোসদের বিয়ের পার্টিতে অরিন্দম রায় সেজে আমাকে পাঠাতে চাইছিল কেন? এটা এখনও বুঝতে পারছিনে। যাইহোক কফিটফি খেয়ে তৈরি থাকি। যথা সময়ে বেরুবো।

বললাম, শচীন্দ্রলালকে ব্যাপারটা জানানো হয়েছে নিশ্চয়? পুলিশ–

কথা কেড়ে কর্নেল বললেন, না। পুলিশকে আমি আমার যা কিছু জানা সব বলেছি। ওঁরা আমার পরামর্শমতো কাজ করবেন। আগামীকাল সকালের কাগজে না পড়া পর্যন্ত বোসবাড়ির কেউ ব্যাপারটা টের পাচ্ছেন না। অতএব আমি জাল অরিন্দমের কথামতো আরেক জাল অরিন্দম সেজে বিয়ের পার্টিতে যাব।

উদ্বিগ্ন মুখে বললাম, সর্বনাশ! না কর্নেল। থাক। আর ঝামেলায় জড়িয়ে কাজ নেই। কিসে কী বিপদ বেধে যাবে, কে জানে? আপনি বরং আপনার লালপোকা নীলপোকা নিয়েই ব্যস্ত থাকুন। আমি আবার চেষ্টা করে দেখি, লালবাজারে নতুন কিছু খবর পাই নাকি!

কর্নেল দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, জয়ন্ত–আমি যে কেস হাতে নিই, তার শেষটুকু খুঁটিয়ে না দেখে কখনও ছাড়ি না। আশা করি তুমি তা ভালই জানো। বোস বাড়িতে আমি যাচ্ছি এবং তুমিও যাচ্ছ।

বললাম, কিন্তু আমার তো নেমন্তন্ন নেই?

তুমি..বলে কয়েক সেকেন্ড কী ভেবে কর্নেল একটু হাসলেন। হুম! তুমি অরিন্দম রায়ের ছেলে হয়ে যাবে। না না। কোন ঝামেলা নেই। তুমি আমার পুত্রের বয়সী। অরিন্দম রায় তিরিশ বছর বিদেশে প্রবাসী। তিনি চিরকাল ব্যাচেলার থাকবেন নাকি?

ভড়কে গিয়ে বললাম, কিন্তু আমাকে তো সাহেব দেখাবে না। স্রেফ ভেতো বাঙালি দেখাবে।

কী কাণ্ড! অরিন্দম কি বাঙালি বিয়ে করতে পারেন না? আমেরিকায় বিস্তর বাঙালি মেয়ে আছেন। …বলে কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন। আর বোসবাড়িতে সত্যহরিবাবুকে তো ম্যানেজ করে রেখেছে। শচীন্দ্রবাবুকে আমি গিয়েই ম্যানেজ করেই দেবো। শুধু চাই তোমার খানিকটা বুদ্ধি!

ঘড়িতে তখন পাঁচটা। এরই মধ্যে শীতের সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। ষষ্ঠীচরণ কড়া কফি দিয়ে গেল। কর্নেল কোনার ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজছেন মাঝে মাঝে এবং নেহাত কফির পেয়ালায় চুমুক দেবার জন্যই চোখ খুলছেন। পোকামাকড় না অরিন্দম রায় এবং বোসবাড়ির পার্টির রহস্য নিয়ে ভাবছেন টের পাচ্ছি না। আমিও প্রচুর মাথা ঘামাচ্ছি। হাতে আর দুঘণ্টা সময়। সাতটায় বিয়ের পার্টি শুরু হবে। সেখানে কী ঘটতে পারে আঁচ করার চেষ্টা করছি। সেই সময় ফোন বেজে উঠল। কর্নেল হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, কর্নেল সরকার বলছি। …কে? ও আচ্ছা! তাই নাকি। …তারপর অনেকক্ষণ ধরে ওপক্ষের কথা শুনলেন এবং যথারীতি হুম হাম করে গেলেন। শেষে বললেন, ঠিক আছে। ভাববেন না। তারপর ফোন রেখে গুম হয়ে বসে রইলেন কর্নেল। তখন বললাম, কী ব্যাপার?

কর্নেল আনমনে জবাব দিলেন, নতুন কিছু নয়। তবু ইন্টারেস্টিং।

ইন্টারেস্টিং তো সবই।

আমার গলার স্বরে অভিমান টের পেয়েই অনুভূতিশীল বৃদ্ধের আনমনা ভাব কেটে গেল। হেসে বললেন, সরি জয়ন্ত! সকালের সেই জাল অরিন্দম ফোন করছিলেন।

শুনেই লাফিয়ে উঠলাম। ..বলেন কী! লোকটার অদ্ভুত সাহস তো। খুন খারাপি করেও এতটুকু ভয় নেই? আপনাকে ফোন করতে পারছে?

কর্নেল বললেন, ফোন করতে পারছে বৈকি!

কী বলছে?

বিয়ের পার্টিতে যাচ্ছি কি না জিজ্ঞেস করছে!

যাচ্ছেন বললেন কি?

হ্যাঁ।

কোথায় আছে ও?

বলল না।

আহা, বলল কী বলবেন তো?

কর্নেল আবার আনমনে জবাব দিলেন, পার্টিতে গিয়েই সব হবে, জয়ন্ত! বু

ঝলাম, গোয়েন্দাপ্রবর এখন কিছু ভাঙতে চান না। আমি আর ঘাটালাম না। মিনিট পাঁচেক দুজনে চুপচাপ রইলাম। তারপর ফের ফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে বললেন, কর্নেল সরকার বলছি। কে? ও–আচ্ছা। …হ্যাঁ হ্যাঁ। এক মিনিট–আমি নোট করে নিই।

কর্নেল ফোন ধরে আমার দিকে ঘুরলেন বললেন, জয়ন্ত, প্লিজ আমাকে টেবিল থেকে কাগজ কলম দাও।

কাগজ আর ডটপেন এগিয়ে দিলাম। উনি ফোনে সাড়া দিলেন, বলো সুব্রত!…

লালবাজার ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর সুব্রত তরফদার ছাড়া কেউ নন। কর্নেল অনেকক্ষণ ধরে কী সব লিখে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে। যথাসময়ে দেখা হবে সুব্রত! …উ? জয়ন্ত? জয়ন্ত যাচ্ছে। হাঃ হাঃ হাঃ! আচ্ছা রাখলাম ডার্লিং।

কর্নেল কাগজটা আমাকে নিঃশব্দে দিলেন। পড়ে দেখি বিয়ের পার্টির লিস্টের সেই পাঁচ দম্পতির পরিচয়। দেখেই বোকা বনে গেলাম। আরে! এঁদের নামগুলো দেখেই তো তার চেনা উচিত ছিল। পাঁচজনই খ্যাতিমান নিজ-নিজ গুণে। তবে এদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত চেনাজানা নেই। আমাদের কাগজের অন্য রিপোর্টারের সঙ্গে থাকা সম্ভব, কিন্তু আমার সঙ্গে নেই।

কর্নেল লিখেছেন :

শ্ৰীঅনিরুদ্ধ গুপ্ত চলচ্চিত্র পরিচালক (বাঙালি)

শ্ৰীমতী মালবিকা গুপ্ত–ঐ স্ত্রী। হাউসওয়াইফ।

শ্রীপ্রভাকর তেণ্ডুলকর—চিত্রশিল্পী। (মারাঠী)

শ্ৰীমতী শবরী তেণ্ডুলকর–ঐ স্ত্রী। হাউসওয়াইফ।

শ্রীঅশনি ব্যানার্জি-অ্যাথলেট (বাঙালি)

শ্ৰীমতী সীমা ব্যানার্জি হাউসওয়াইফ (ফরাসি মেয়ে। আগের নাম লিজা মোআর্তে)

শ্রীসুরঞ্জন ঘোষ দস্তিদার রাজনীতিক (বাঙালি)

শ্ৰীমতী রমা ঘোষ দস্তিদার হাউসওয়াইফ।

শ্রীআশোক মজুমদার রাজনীতিক (বাঙালি)

শ্ৰীমতী শ্যামলী মজুমদার-হাউসওয়াইফ।

এর তলায় টুকরো লেখাঃ অশনি মাস দুই আগে ইউরোপে যান। লিজার সঙ্গে বিয়ে। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কলকাতার পুলিশ রেকর্ডে কিছুই নেই। পরিষ্কার। প্রথম তিনজন পুরুষ অতীন্দ্র বোসের বন্ধু। শেষ দুজন শচীন্দ্রের বন্ধু। প্রভাকর শান্তিনিকেতনে শিক্ষিত শিল্পী। কলকাতায় ছেলেবেলা থেকেই ওর ফ্যামিলি। শরীও। শবরীর সঙ্গে শান্তিনিকেতনে পরিচয় এবং পরে বিয়ে!…

আরও কিছু কথা লেখা আছে। কিন্তু অস্পষ্ট-কারণ দ্রুত লেখা হয়েছে। দেখে ওঁর হাতে কাগজটা ফেরত দিয়ে বললাম, একটা আনন্দের কথা যে এঁদের কারুর সঙ্গে আমার মুখোমুখি চেনা-পরিচয় হয়নি।

কর্নেল গম্ভীর হয়ে বসেছিলেন। আনমনে বললেন, হু।

আমরা যখন নিউ আলিপুরে বসু নিবাসে পৌঁছলাম, তখন কাটায় কাঁটায় সন্ধ্যা সাতটা। সন্ধ্যা বলা ঠিক নয়। শীতকাল, তাই কুয়াশা এবং শীতে পথঘাট ওখানে প্রায় খাঁ খাঁ করছিল। মনে হল, রাত হয়েছে। গেটে সত্যহরিবাবুকে দেখলাম। অনেক সাদা পোশাকের পুলিশও দেখতে পেলাম। কর্নেল সান্ধ্য বিলিতি পোশাকে এসেছেন। মুখে পাইপ, হাতে একটা সুদৃশ্য প্যাকেট বন্ধুর নাতির বিয়েতে উপহার। আসার পথে নিউ মার্কেটে কিনেছে। কিন্তু কী চিনেছেন, দেখিনি কারণ গাড়িতে আমাকে বসিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। স্যার জগদিন্দ্রের বন্ধু আমেরিকা থেকে খুবই দামী উপহার আনবেন–এটাই সঙ্গত এবং স্বাভাবিক ছিল। গাড়িতে কথাটা তুললে কর্নেল কানে নেননি।

আমি ও কর্নেল গেটে এগিয়ে গেলাম। সত্যহরিবাবু প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলেন আর কী! চোখ টিপতেই কেমন হেসে চেপে গেলেন। কর্নেল অকুতোভয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, অরিন্দম রায়। এ আমার ছেলে রণি। আমার স্ত্রী আসতে পারেননি। শচীন্দ্র কোথায়? তার অসুখবিসুখ হয়নি তো?

সত্যহরিবাবুর হাতে লিস্ট। লিস্টের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ছিলেন। এবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিন্তু

কর্নেল ধমক দিয়ে বললেন, আমি শচীন্দ্রের বাবার বন্ধু অরিন্দম রায়। নিউ ইয়র্ক থেকে গত রাতে এসেছি। শচীন্দ্র কোথায়?

সত্যহরিবাবুর এতক্ষণে যেন স্মরণ হল হাত জোড় করে বললেন, সরি স্যার, ভেরিসরি। আপনার কথা শুনেছি বটে। আসুন, আসুন! মিঃ বোস ওখানে রয়েছেন। হ্যাঁ স্যার! আপনার কথা বলছিলেন স্যার! আসুন, আসুন।

কর্নেল গটগট করে এগিয়ে গেলেন। সত্যহরি আমার দিকে চোখ নাচিয়ে বিস্ময়সূচক কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু আমি পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সত্যহরি হতভম্ব হয়ে তকিয়ে রইলেন।

লনের শেষে গাড়িবারন্দার সিঁড়িতে কার্পেট বিছানো হয়েছে। সেখানে শচীন্দ্র দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা করছেন। কর্নেল আমাকে ফিসফিস করে বললেন, তুমি একটু পরে সুযোগমতো ঢুকবে। এখানে পায়চারি করো–ফুলটুল দেখ।

উনি চলে গেলেন। দূর থেকে দেখলাম দৃশ্যটা। শচীন্দ্র হেঁট হয়ে কর্নেলের পায়ের ধুলো নিলেন। কর্নেল ওঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেলেন। অমনি আমি সপ্রতিভ হেঁটে সোজা কার্পেট বিছোনো সিঁড়ি বেয়ে বিশাল ড্রয়িংরুমে ঢুকলাম। ওই ঘর থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। ঘরে জনাদুই বেয়ারা গোছের লোক রয়েছে। তারা আমাকে সেলাম দিল। মৃদু হাসিতে তাদের খুশি করে ছবি ও ভাস্কর্য দেখতে ব্যস্ত হলুম। এ সময় কয়েকজন পুরুষ ও মহিলা এলেন। বেয়ারারা সিঁড়ির দিকে তাদেরকে। যাবার অনুরোধ করল। তারা উঠে গেলেন। একজন বেয়ারাকে বললাম, সবাই এসে গেলেন তাহলে? লোকটা বিনীতভাবে মাথা দুলিয়ে বলল, নেহী সাব। আ। যায় গা আভি।

তারপর ঢুকলেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। চেহারা দেখে মনে হল এঁরাই তাহলে তেণ্ডুলকর দম্পতি।

তারপর ঢুকলেন লালবাজারের সেই সুব্রতবাবু–সঙ্গে দুজন সাদা পোশাকের অফিসার। সুব্রতবাবু সটান এসে হাত ধরলেন। বললেন, এসে গেছেন দেখছি। ভালো ভালো।

ফিসফিস করে বললাম, স্পিকটি নট দাদা। আমি অরিন্দম রায়ের পুত্র রণি রায়।

এই মরেছে! বলে সুব্রতবাবু আমাকে ড্রয়িংরুমের কোনায় নিয়ে গেলেন। দুজনে বসলাম। উনি সঙ্গের অফিসার দুজনকে বললেন, আপনারা ওপরে যান। আমি একটু পরে যাচ্ছি।

ওঁরা চলে গেলেন। সুব্রতবাবু হাসতে হাসতে বললেন, বুড়ো এবার আপনাকে ফাসাবার মতলব করেছে। বি ভেরি কেয়ারফুল জয়ন্তবাবু।

উদ্বিগ্নভাবে বললাম, হ্যাঁ। শচীন্দ্র আমাকে চেনেন। কাগজের লোক ঢুকেছে। দেখলেই তো তাড়া করবেন। অথচ কর্নেল আমাকে ছাড়লেন না। কী করি এখন বলুন তো?

সুব্রতবাবু একটু ভেবে বললেন, ওপরের হলঘরে পার্টি হচ্ছে। জাস্ট খাওয়া দাওয়া আলাপ-প্রলাপ ছাড়া আর কিছু হচ্ছে না। দুপাশের দুটো ঘরে আমাদের থাকার কথা। আপনি বরং আমার সঙ্গে থাকুন।

বাঁচা গেল। বলে সিগারেট দিলাম সুব্রতবাবুকে। উনি সিগারেট টানতে টানতে আপন মনে হাসলেন। বললাম, বুড়ো কথা মতো শচীন্দ্রকে নিশ্চয় বলেছেন যে তার ছেলে রণি এসেছে। শচীন্দ্র এখন…।

থামতে হল। মুখ ঘুরিয়ে কাছে বেয়ারাটাকে বললাম বাথরুম! সে দেখিয়ে দিল। তখনই বাথরুমে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। সিঁড়িতে শচীন্দ্র নামছিলেন!

বাথরুমের দরজা ফাঁক করে দেখি, উনি সুব্রতবাবুর সঙ্গ কথা বলছেন। কথা শেষ হলে শচীন্দ্র ব্যস্তভাবে বেরোলেন। সুব্রতবাবু আমাকে ইশারা করলেন। তারপর দুজনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেলুম। চওড়া করিডরের একপাশে হলঘর। বাইরে থেকে দেখলাম, লম্বা টেবিলের দুপাশে চেয়ার সাজানো রয়েছে। ফুলে ফুলে ছয়লাপ। মদ্যপানের আয়োজন রয়েছে। এক ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে অতীন্দ্র আর নববধূ জিনা। জিনার সৌন্দর্য দেখে তাক লেগে গেল। বাঙালি বধূর মতো শাড়ি পরেছে সে। দুকানে মুক্তোর দুল আর গলায় ঝুলছে, একটা জড়োয়া নেকলেস। সেটা শাড়ির ওপর বের করে রেখেছে। অনুমান করলাম, ওটার দাম না জানি কয়েক লক্ষই বা! জহুরী নই–তবে এ নেকলেস হীরের, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এরা মস্ত বড়লোক। ইমিটেশান পরবে কোন দুঃখে? ছোট ছোট উজ্জ্বল টুকরো-টুকরো হীরের ছড়া দুধারে এবং তলায় একটা প্রকাণ্ড লকেটে যে বিশাল হীরে বসানো, তা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে।

সম্ভবত আমার ভ্যাবাকান্ত অবস্থা দেখেই কর্নেল এগিয়ে এলেন। ফিসফিস করে বললেন, সুব্রতর সঙ্গে পাশের ঘরে চলে যাও।

বললাম, শচীন্দ্রবাবুকে বলেছেন কি রণির কথা?

কর্নেল বললেন, না। তুমি ঝটপট এগোও।

সুব্রতবাবু একটু তফাতে ছিলেন। হাসছিলেন। কর্নেল হলঘরে গিয়ে ঢুকলে আমি সুব্রতবাবুর সঙ্গে করিডর ঘুরে একটা ঘরে ঢুকলাম। সেখানে জনা ছয় সাত পুলিশ অফিসার রয়েছেন। কেউ পুলিশি পোশাকে, কেউ সিভিলিয়ান বেশে। সুব্রতবাবু এবং জনা তিন অফিসার জানালার পর্দার ফাঁকে চোখ রাখলেন। আমি সুব্রতবাবুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। এ ঘরে আলো খুবই কম। একটা মিটমিটে টেবিলবাতি জ্বলছে।

পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে দেখি, শচীন্দ্র এসে গেছেন। গল্পগুজব হচ্ছে। পাঁচ দম্পতিই এসে জুটেছেন। হাতে হাতে গ্লাস–মহিলাদেরও। অবশ্য মহিলারা সম্ভবত রঙিন সরবৎ পান করছেন। লিজাকে দেখলাম! জিনার চেয়েও ঢ্যাঙা। বলিষ্ঠ গড়ন। জিনার চেয়ে বয়সটা বেশি মনে হল। লিজা কিন্তু শাড়ি পরেনি। স্বদেশী পোশাকে এসেছে। একটা নীলাভ লম্বা কোট চড়িয়েছে গায়ে।

দেখতে দেখতে হঠাৎ যেন ধারণা হল, জিনা লিজার প্রতি সন্তুষ্ট নয়। ওরা পরস্পর কথা বলছে না। অবশ্য আমার চোখের ভুলও হতে পারে। দেখলাম, কর্নেল জিনাকে কী বলতেই সে সলজ্জ হাসল।

কেউ চেয়ারে বসে নেই। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে। অতীন্দ্র লিজার দিকে এগিয়ে এল। জিনার চোখে যেন জ্বালা দেখলাম। তারপর জিনা কর্নেলের কাছে এল।

তারপরই আচমকা আলো নিভে গেল। এ ঘরেরও। লোডশেডিং নিশ্চয়।

কিন্তু পরক্ষণে মেয়েলি গলার অস্পষ্ট আর্তনাদ শুনলাম।

এ ঘর থেকে জানালা দিয়ে কয়েকটা টর্চের আলো পড়ল হলঘরে। পুলিশ অফিসাররা কেউ কেউ দৌড়ে গেলেন। টর্চের আলোয় তখনই এক ভীষণ দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছি।

অ্যাথলেট অশনি ব্যানার্জির ফরাসি বউ সীমা ওরফে লিজা মোআর্তের এক হাতে একটা অদ্ভুত গড়নের ছোট বন্দুকসম্ভবত এক ধরনের স্টেগান, অন্য হাতে সে জিনাকে চেপে ধরেছে পিছন থেকে এবং ইংরেজিতে চেঁচিয়ে উঠেছে–কেউ বাধা দিলেই মরবে!

জিনা ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছে। হলঘরের সবাই পাথরের মতো নিশ্চল। তারপর লিজা মোআর্তে ফের চেঁচাল, টর্চ বন্ধ করো! নয়তো খুলি উড়ে যাবে।

টর্চগুলো নিভে গেল। বুঝলাম উপায় নেই। এরা গুলি করলে অতীন্দ্রের বউ বেচারা আগে মারা পড়বে। আর ওই ডাকাত মেয়েটা তো নিজের প্রাণের ধার ধারে বলে মনে হয় না।

এক মিনিট সব চুপচাপ। তারপর সিঁড়ির দিকে আবার লিজার চিৎকার শোনা গেল।

আবার নীরবতা। আর এক মিনিট পরে, আশ্চর্য! কর্নেলের হাসির শব্দ শুনলাম। তখন টর্চ জ্বলল। কর্মল হো হো করে হাসছেন।

আবার দৌড়ে করিডর ঘুরে হলঘরে ঢুকলাম। আলো বলতে কয়েকটা টর্চের। সুব্রতবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, কর্নেল!

কর্নেল বললেন, আপনার অফিসারদের বলুন, যেন মরীচিৎকার পেছনে কেউ না দৌড়ান।

শচীন্দ্র আর্তস্বরে বললেন, কিন্তু বউমাকে যে ধরে নিয়ে গেল!

অতীন্দ্র টেবিলে দুহাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে চেয়ারে বসে রয়েছে। কর্নেল বললেন, শচীন্দ্রবাবু! আপনার লোকেদের বলুন অন্তত মোমবাতি জ্বালুক।

শচীন্দ্র চেঁচিয়ে ডাকাডাকি শুরু করলেন।

এই সময় বাইরে কোথাও বন্দুকের শব্দ হল কয়েকবার। সুব্রতবাবু এবং কয়েকজন অফিসার এতক্ষণে বেরোলেন। আমি কর্নেলের মরীচিকা শব্দটা নিয়ে আকাশ-পাতাল হাতড়াচ্ছি। মিনিট দুতিন পরে মোমবাতি এল। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে সত্যহরি এলেন। …স্যার! স্যার! এ কী সর্বনাশ হল স্যার!

শচীন্দ্র ভাঙা গলায় বললেন, অপদার্থ! পুলিশের ওপর আর আমার এতটুকু বিশ্বাস রইল না। সত্যি সত্যি বউমাকে ওরা কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল।

কর্নেল ঘুরে হলঘরের কাঠপুতুল দম্পতিদের দেখে নিয়ে একটু হাসলেন। বললেন, অশনিবাবু প্লিজ নার্ভাস হবেন না। আসুন, চাঙ্গা হয়ে এখানে বসুন।

ঘুরে দেখে অশনিবাবু বিবর্ণ মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ঠোঁট কাঁপছে। কর্নেল এগিয়ে তার হাত ধরে বললেন, আপনি তো চিনতেন না ওকে। আপনার কী দোষ! ও নিয়ে ভাববেন না।

সেই সময় সুব্রতবাবু হন্তদন্ত হয়ে বললেন, শচীন্দ্রবাবু! আপনার বউমাকে নিয়ে যেতে পারেনি। গেটের কাছে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন! কিডন্যাপার। মেয়েটি শেষঅব্দি ওঁকে ফেলে রেখে পালিয়েছে। শিগগির নিচে আসুন!

আমরা মোমবাতি ও টর্চের সাহায্যে নিচে এলাম। অতীন্দ্র তার মেমসাহেব বউয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। জিনাকে সোফায় শুইয়ে রাখা হয়েছে।

তারপর শচীন্দ্র আর্তনাদ করে উঠলেন, এ কী! নেকলেস! বউমার নেকলেস কই? হায় হায়! আমাদের বংশের সেরা সম্পদ ছিনিয়ে পালাল!

সুব্রতবাবু বললেন, নেকলেস!

হা হা মশাই, নেকলেস। শচীন্দ্রবাবু ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে থাকলেন আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। হায় হায়! এ কী হল!

একজন অফিসার ঘরে ঢুকে বললেন, স্যার! বাড়ির ইলেকট্রিক লাইন ঠিক আছে। বাইরে কোথাও কেটে দিয়েছে লাইনটা। খোঁজ করা হচ্ছে। আশেপাশের বাড়িও অন্ধকার স্যার।

সূব্রতবাবু বললেন, আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে কেটেছে তাহলে। বাগনের ওপাশের রাস্তায় খোঁজ করুন! ইলেকট্রিসিটি অফিসেও খবর দিন।

দেখছি স্যার। বলে উনি ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন।

এক ঘণ্টা পরে।

আমরা নিচের ড্রইং রুমে বসে আছি। আলো জ্বলেছে আবার। বাগানের ওপাশে রাস্তায় আজ সকাল থেকে টেলিফোন দপ্তরের লোকেরা খোঁড়াখুড়ি করছিল, জানা গেল। এবং বোঝা গেল, তারা টেলেফোন দপ্তরের লোকই নয় আসলে। তেরপল ঢাকা দিয়ে এসব কাজ চলে সচরাচর। দুতিন দিন ওভাবে কাজ চলে। এক্ষেত্রে তারা ইলেকট্রিক লাইন নিয়ে কারচুপি করছিল। সময়মতো কেটে দিয়েছিল কেবলটা। তাড়াহুড়ো করে অস্থায়ীভাবে জোড়া দেওয়া হয়েছে। কাল পাকাপাকিভাবে কাজ হবে।

জিনা সুস্থ হয়ে স্বামীর সঙ্গে ওপরে চলে গেছে। শচীন্দ্র হীরের নেকলেসটার জন্যে সমানে হাহাকার করে চলেছেন এবং কর্নেলের প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছেন।

ততক্ষণে লালবাজারে ব্যস্ততা পড়েছে নিশ্চয়। অশনিবাবুর ফরাসি বউকে খোঁজা হচ্ছে। সে অশনিবাবুর গাড়িটা নেয়নি অবশ্য। নিয়েছে তেণ্ডুলকর সাহেবের গাড়ি। তেণ্ডুলকর দম্পতি বিমর্ষ মুখে বসে আছেন।

তারপর কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তাহলে চলি বাবা শচীন্দ্র, কাল আবার আসব। আমি দুদিন আছি কলকাতায়। তারপর হংকং হয়ে নিউইয়র্ক ফিরব।

শচীন্দ্র তাঁকে এগিয়ে দিতে উঠলেন। আম সুব্রতবাবুর আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম। এতক্ষণে শচীন্দ্র আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। বিকৃত মুখে বললেন আপনি কখন এলেন? কে আপনাকে খবর দিল এরি মধ্যে? লালবাজারের এই সহেবরা?

কাঁচুমাচু হেসে বললাম, না স্যার। হঠাৎ–মানে…

আঙুল তুলে শচীন্দ্র বললেন, বেরিয়ে যান! কাগজে যদি কোন খবর দেখি, আপনার নামে ভিফামেশান সট করব! গেট আউট।

অপমানিত বোধ করে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়লাম। দরজার কাছে সত্যহরি দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে দেখেই কেটে পড়লেন কোথায়।

গেটে বেরিয়ে গাড়িতে ঢুকলাম। রাগে দুঃখে কান ভোঁ ভোঁ করছে। একটু পরে কর্নেল একা গেট পেরিয়ে এলেন তারপর গাড়িতে ঢুকে একগাল হেসে বললেন, রিপোর্টারদের ব্যাপারে কী যেন প্রবাদ আছে? রাগ ঘেন্না ভয় তিন থাকতে নয়। তাই না জয়ন্ত?

কোন জবাব দিলাম না। গাড়ি স্টার্ট দিলাম।

কর্নেলকে পৌঁছে দিয়ে যাব ভেবে যে পথে এসেছি, সে পথেই গাড়ি ঘোরাচ্ছিলাম, কর্নেল ব্যস্তভাবে বললেন, ডার্লিং! ওপথে নয়! আমরা এখন প্রচণ্ড বিপদের মধ্যে আছি। গাড়ি সামনে ডান দিকের গলিতে ঢোকাও। আমাদের পেছনে একটা গাড়ি আসছে দেখতে পাচ্ছ কি? তুমি খুব জোরে আচমকা গলিতে ঢুকে পড়বে। তারপর রাস্তা আমিই বাৎলাব।

চমকে উঠে আয়নায় দেখলাম, আন্দাজ কুড়ি মিটার দূরে একটা কালো অ্যাম্বাসাডার পিছু পিছু আসছে। অমনি জোরে ডাইনের গলিতে ঢুকে পড়লাম। তারপর কর্নেল দ্রুত বললেন, বাঁ দিকের লেনে ঢোক। তারপর ডানদিকে। স্পিড আরও বাড়াও।

পিছু ফিরে কিংবা আয়নার দিকেও তাকাতে সাহস হচ্ছিল না। কারা আমাদের ফলো করছে? কেনই বা ফলো করছে? বিপদের মধ্যে আছি কেন? কিছু বুঝতে পারছি না। প্রশ্ন করাও ঠিক নয়। নিঃশব্দে ওঁর কথামতো ডাইনে বাঁয়ে করে অলি-গলি ঘুরে ঘুরে জোরে এগাতে থাকলাম। কর্নেল একঘেয়ে স্বরে কখনও বলছেন, বাঁয়ে কখনও ডাইনে–কখনও সোজা। এ যেন গোলক ধাঁধার খেলা চলছে।

শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড পেরিয়ে গেলে কর্নেল বললেন, ব্যস! কাটানো গেছে। ওরা ভেবেছিল, আমি কিস্য টের পাব না এবং ওরা নির্বাধায় হামলা করতে পারবে। ওরা আমাকে কী ভেবেছিল? অ্যাঁ?

কর্নেল খিক খিক করে হেসে উঠলেন। আমি কোন প্রশ্ন করলাম না। একটু পরে কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! আমরা কিন্তু এবার ক্যামাক স্ট্রিট হয়ে পার্ক স্ট্রিট ক্রস করে ফ্রি-স্কুল ধরে যাব এবং লক্ষ্য হবে লালবাজার।

এবার বলালম, কেন?

দেখবেখন। একটা অত্যদ্ভুত ম্যাজিকের জন্যে অপেক্ষা করো, ব্যস।…

লালবাজার পুলিশ হেডকোয়াটারে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি, সুব্রতবাবুও সবে পৌঁছেছেন। কর্নেলকে দেখে বললেন, কী মুশকিল! তখন আপনাকে জিগ্যেস করলাম আমার সঙ্গে আসবেন নাকি, বললেন না।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, আমার থিওরির সত্যতা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলাম। চলো, তোমার ঘরেই যাই।

সুব্রতবাবুর চেম্বারে ঢুকে আমরা বসলাম। তারপর ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হল। হঠাৎ কর্নেল কোটের ভেতর পকেটে হাত ভরে বললেন, এবার তাহলে ম্যাজিক দেখ সুব্রত!

আমরা হতবাক হয়ে দেখলাম, কর্নেলের হাতে জিনার গলার সেই হীরের নেকলেস! সুব্রতবাবু বললেন, সর্বনাশ! ব্যাপারটা কী বলুন তো?

কর্নেল বললেন, যতটা জটিল ভেবেছিলাম, ততটা কিছু নয়। আপাতত তোমাকে একটা জরুরি কাজ এখনই করতে হবে। শ্রীমান অতীন্দ্রের বউ জিনা হেওয়ার্থকে এখনই গ্রেফতার করতে হবে।

সুব্রতবাবু সবিনয়ে বললেন, সে কী?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। কারণ, জিনাই আলো নেভার সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠার ফলে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল এবং আমার কোটের ভেতর পকেটে নেকলেসটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল।

সুব্রতবাবু বললেন, কেন?

কর্নেল বললেন, প্রিন্স ফরিদ অর্থাৎ অরিন্দম জিনার নেতা। কথা ছিল অরিন্দম বিয়ের পার্টিতে থাকবে। তার পকেটেই ওটা ঢোকাতে হবে।

কিন্তু জিনা আপনার পকেটে ওটা ঢুকিয়ে দিল–অথচ আপনি অরিন্দম নন!

সেটাই আশ্চর্য! কিন্তু আমার থিওরি শোন। আমার মক্কেল অর্থাৎ জাল অরিন্দমের সঙ্গে পরে জিনা ও লিজার একটা পাল্টা ষড়যন্ত্র হয়ে থাকবে। প্রিন্স ফরিদকে খুন করে ওরা তিনজনে ওটা হাতাতে চেয়েছিল।

লিজা নেকলেস নিয়ে পালাতে পারত!

পারত। কিন্তু সেটার রিস্ক ছিল। তোমাদের গুলি খেয়ে মরার চান্স ছিল লিজার। তাই রিস্কে না গিয়ে আমার পকেটে আমার অজান্তে ওটা রয়ে যাবে এবং পথে একা পেয়ে আমার ওপর আমার মক্কেল হামলা করবে, সেটাই যুক্তিসঙ্গত এবং নিরাপদ।

তাহলে আগে কিডন্যাপ রটাল কেন ওরা?

সে থিওরি আছে। বলছি। প্রিন্স ফরিদ যাতে নেকলেস বাগাতে না পারে, তাই সম্ভবত আমার মক্কেলই বেনামী চিঠি লিখেছিল। পরে যখন দেখল, পার্টি হবেই–তখন অন্য রাস্তা ধরল। অরিন্দমকে খুন করল এবং আমার কাছেজাল অরিন্দম সেজে ওই মজার প্রস্তাব নিয়ে গেল। মরিয়া হয়ে সে শেষ চেষ্টা করতে চেয়েছিল।

নিজে গেল না কেন পার্টিতে?

তা পরে বোঝা যাবে–লিজার কনফেশন আদায় করো। আমার মক্কেলকে আগে ধরো। তখন সব জানতে পারব আমরা।

সুব্রতবাবু একটু ভেবে বললেন, জিনা বোস বাড়ি বউ হয়ে এসেছে। ইচ্ছে করলে যে কোন সময় নেকলেস হাতাতে পারত!

নিশ্চয় পারত না। তাহলে এত সব কাণ্ড কেন? তবে এর জাবাব পাওয়া। যাবে শচীন্দ্রের কাছে। কিন্তু আর দেরি নয়। এক্ষুনি জিনাকে গ্রেফতার করো। সে আজ রাতেই পালাতে চাইবে।

সুব্রত ফোন তুলে দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললেন, পালাতে চাইলে তো লিজার সঙ্গে পালাত!

যখন পালায়নি, তখন বোঝা যাচ্ছে–পারেনি পালাতে। লিজা কোন রকমে একা পালিয়েছে। তোমাদের লোকেরা ঘুলি ছুঁড়েছিল–মাইন্ড দ্যাট।

সুব্রত ফোনে কাকে চাপা স্বরে কী আদেশ দিলেন।

কর্নেল বললেন, এবার ফোনে শচীন্দ্রকে ডাকো। এক্ষুনি যেন চলে আসেন। …বরং আমাকেই লাইনটা দাও।

সুব্রত ডায়াল করে বললেন, লাইন বন্ধ ছিল। দেখা যাক খুলেছেন নাকি। হ্যাঁ রিং হচ্ছে। ধরুন।

কর্নেল ফোন নিয়ে কথা শুরু করলেন। এ ঘরে অনেক ফোন আছে। সেগুলো সক্রিয়। মাঝে মাঝে কোন-কোনটা বেজে উঠছে! সুব্রতবাবু কী সব বলছেন এবং শুনছেন। একটা ফোন ধরে কিছুক্ষণ শোনার পর আমাদের দিকে হাসি মুখে ঘুরলেন। তারপর ফোন রেখে বললেন, অশনিবাবুর স্ত্রী সীমা ওরফে লিজা ধরা পড়েছে। দমদম এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিল। প্লেনে অন্য নামে সিট বুক করা ছিল। জাল পাসপোর্ট-ভিসার কারবার। কিন্তু আপনার মক্কেলের আর তো পাত্তা নেই কর্নেল!

কর্নেল বললেন, তোমাদের কার্যক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে, সুব্রত!

সুব্রতবাবু আত্মবিশ্বাসের হাসি হেসে বললেন, যাবে কোথায়? অবিকল আপনার মতো চেহারা। অবশ্য ছদ্মবেশ ধরতেও পারে। দেখা যাক। আমাদের মেশিনারি সচল রয়েছ।…

আমরা কফি খেতে খেতে খবর এল শচীন্দ্রলাল বোস এসেছেন। আমি মুষড়ে পড়লাম। ভদ্রলোক এসে আমাকে এখানে দেখে আবার খেপে যাবেন কি না কে জানে! কর্নেল আমার মুখ দেখে সেটা অনুমান করে হেসে বললেন, আফটার অল এটা একটা সরকারি অফিস। বোসবাড়ি নয়। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, জয়ন্ত!

ব্যাপারটা বুঝে সুব্রতবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন। একটু পরেই শচীন্দ্র হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন এবং কর্নেলকে দেখে দারুণ অবাক হয়ে বললেন, কাকামশাই! আপনি!

সুব্রতবাবু বললেন, বসু মিঃ বোস।

শচীন্দ্র বসলেন। তারপর বললেন, কর্নেল সরকার কই সুব্রতবাবু?

সুব্রতবাবু বললেন, আপনি যাকে কাকামশাই বলছেন, উনিই প্রখ্যাত কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, মিঃ বোস!

শচীন্দ্র চেয়ার ঝাঁপিয়ে সশব্দে ঘুরে কর্নেলের দিকে তাকালেন!

কর্নেল একটু হেসে বললেন, এই রংফুল পার্সোনিফিকেশনের ব্যাপারটা না ঘটলে আপনি হীরের নেকলেসটা ফিরে পেতেন না, মিঃ বোস। ভাগ্যিস, আমি অরিন্দম রায় সেজে আপনার বাড়ি বিয়ের পার্টিতে গিয়েছিলাম। যাই হোক, এবার বলুন, এই নেকলেসটাই আপনার পুত্রবধূর গলায় ছিল?

শচীন্দ্র লাফিয়ে উঠে হাত বাড়ালেন। বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওটাই বটে।

কর্নেল নেকলেসটা সুব্রতবাবুকে দিয়ে বললেন, এখনই ওটা ফেরত পেতে অসুবিধে আছে মিঃ বোস। আইনকানুন ঘটিত অসুবিধে আছে। ওটা এখন সরকারি হেফাজতে যাচ্ছে। যথাসময়ে ফেতর পাবেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এবার দয়া করে আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিন।

শচীন্দ্র ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন, বেশ। বলুন, কী জানতে চান।

কর্নেল বললেন, নেকলেসটার গড়ন দেখে মনে হচ্ছে, খুবই প্রাচীন। সরকারী জাদুঘর, মহাফেজখানা এবং অন্যান্য সংরক্ষণাগারে প্রাচীন বহুমূল্য জিনিসপত্র দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এই নেকলেস আপনি কোথায়। পেয়েছেন?

শচীন্দ্র বললেন, সংক্ষেপেই বলছি। নেকলেসটি আমার বাবা স্যার জগদিন্দ্র কিনেছিলেন। মুঙ্গেরে থাকার সময় তাঁর বন্ধুর কাছে! বন্ধুটি ছিলেন রাজপরিবারের লোক। কাজেই নেকলেসটা ঐতিহাসিক জিনিস। শুনেছি, এই নেকলেসের লকেটে যে বড় হীরেটা রয়েছে, তার বয়স প্রায় চারশো বছর। ওটা নাকি সৌভাগ্যের প্রতীক। আমার বাবার সেই বন্ধু নেকলেসটা নাকি পৈতৃক কোষাগার। থেকে চুরি করে বাবাকে বেচেছিলেন। খুব উচ্ছল টাইপ ছিলেন উনি। টাকার অভাবেই চুরি করে বেচে দেন। তারপর নাকি জানাজানিও হয়। আমার বাবার বন্ধুকে…

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, অরিন্দম রায় বলুন।

শচীন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, আপনি জানেন তাহলে! হ্যাঁ, কুমার অরিন্দম রায় ছিলেন বাবার বন্ধু। অরিন্দম কাকার বাবা রাজাবাহাদুর সন্দেহ করেন যে। বহুমূল্য ঐতিহাসিক নেকলেস হারানোর জন্য তাঁর ছেলেই দায়ী। খেপে গিয়ে তাকে তিনি ত্যাজ্যপুত্র করেন। অরিন্দম নেকলেস বেচা টাকা নিয়ে আমেরিকা চলে যান। চল্লিশ বছর আগের কথা। ওঁর সম্পর্কে আমার স্মৃতি বলতে তেমন। কিছুই নেই।

কর্নেল বললেন, নেকলেসটা আপনার পুত্রবধূর গলায় কবে পরিয়ে দেন?

শচীন্দ্র বললেন, আমাদের সৌভাগ্য-লক্ষ্মী এই নেকলেস। এটা কেনার পরই বাবার ভাগ্য খুলে গিয়েছিল। তাই এটা বাড়ির কোন মেয়েকেই পরতে দেওয়া হত না। আমার মা কিংবা স্ত্রী যতদিন বেঁচেছিলেন, তাদের গলায় ওঠেনি। অতীন্দ্র সম্প্রতি বিদেশে গিয়ে বিয়ে করে বসল। ফিরে এসে বলল, বাবা! আপনার বউমার গলায় নেকলেসটা অন্তত একবার পরিয়ে দিন। আমি তখন কিছুতেই রাজি হলাম না। কিন্তু বুঝলাম, আসলে বউমাকে সে আমাদের পারিবারিক ঐশ্বর্য এবং সৌভাগ্য-লক্ষ্মীর এই নেকলেসের কথা বলেছে। এটা স্বাভাবিক। সে যে বড় বংশের ছেলে স্ত্রীর কাছে তা নানাভাবে গল্প করেছে। নেকলেসের কথাও বলেছে নিশ্চয়। তাই পরে আমার মনটা নরম হল। বললাম, ঠিক আছে খোকা। বিয়ের পার্টির দিন কিছুক্ষণের জন্যে বউমার গলায় পরিয়ে দেব–অসন্তুষ্ট হয়ো না। পার্টি শেষ হলে খুলে দিতে হবে কিন্তু।

সুব্রতবাবু প্রশ্ন করলেন, নেকলেসটা কোথায় রাখতেন?

শচীন্দ্র জবাব দিলেন, একটা গোপন সেলফে। সেই সেলফের খবর একমাত্র আমি ছাড়া কেউ জানত না! অতীন্দ্রও না।

কর্নেল বললেন, সব বোঝা গেল। এবার দয়া করে আরেকটা প্রশ্নের জবাব দিন। মুঙ্গেরের সেই রাজাবাহাদুর একমাত্র ছেলে অরিন্দমকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। কিন্তু পরে কি উনি কোন পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন? জাস্ট একটা আনুমানিক প্রশ্ন।

শচীন্দ্র বললেন, বাবা যখন কলকাতা আসেন, তখন আমার বয়স বছর বারো হবে। স্মৃতি অস্পষ্ট। তবে আবছা মনে পড়ে। ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, রাজাবাহাদুর নাকি ওঁর দেওয়ানের ছেলেকে পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন। ছেলেবেলায় হয়তো দুজনকেই দেখেছি মনে পড়ে না।

কর্নেল নড়ে বসলেন। বললেন, সুব্রত! আমার থিওরি নির্ভুল তাহলে।

সুব্রতবাবু বললেন, আপনার মক্কেলটি তাহলে সেই পোষ্যপুত্র ভদ্রলোক?

অবশ্যই। …কর্নেল কী যেন ভাবলেন। তারপর ফের বললেন, ঠিক আছে। আমি উঠি। তুমি মিঃ বোসকে আর হেঁয়ালির মধ্যে না রেখে আগাগোড়া। নেকলেস চক্রান্তটা শুনিয়ে দাও। আর ইয়ে, আমার মক্কেলের খবর প্লিজ তক্ষুনি যেন জানাবে। দিস ইজ ভেরি ইমপর্ট্যান্ট! আচ্ছা চলি মিঃ বোস। এস জয়ন্ত।

বলে কর্নেল আর পিছুও ফিরলেন না। গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। আমি ওঁর পেছন-পেছন বেরোলাম। বেরোবার সময় একবার একটু ঘুরতেই শচীন্দ্রের চোখে চোখ পড়ল। কটমট করে তাকিয়ে আমাকে দেখছেন।….

ফেরার পথে আয়নায় লক্ষ্য রেখেছি দেখে কর্নেল ঠাট্টা করে বললেন, আর কেউ আমাদের ফলো করবে না, জয়ন্ত। নির্ভয়ে চলো।

বললাম, রাগে প্রতিহিংসায় গুলি ছুঁড়বে না তার গ্যারান্টিও নেই।

কর্নেল শুধু হাসলেন।

একটু পরে বললাম, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আমার কিন্তু একা ফিরতে ভয় করবে।

কর্নেল বললেন, তুমি তো দৈনিক সত্যসেবক যাবে। কালকের জব্বর খবর লিখতে হবে না?

তা আর বলতে? বলে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম।

কর্নেল বললেন, এরই মধ্যে রাস্তাঘাট জনশূন্য! আশ্চর্য জয়ন্ত! কলকাতায় এমন কুয়াশার মধ্যে ব্যাপারটা ভারি বিপজ্জনক।

বলার সঙ্গে সঙ্গে সামনে থেকে একটা ট্রাক এসে প্রায় গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। তখন স্পিড কমালাম।

কর্নেলের বাড়ির কাছে গিয়ে প্রথমে পানের দোকানটা দেখে নিলাম। নাঃ– সেই লোকটা নেই। কর্নেল বুঝতে পেরে বললেন, আর আমার ওপর নজর রাখার দরকার হচ্ছে না। চলো ডার্লিং, এই শীতে আবার কড়া কফি খেয়ে নেবে। নাকি অন্য কোন পানীয়? এ বুড়োর ভাণ্ডারে অতিথিদের জন্যে পানীয় মজুত থাকে…

কর্নেল মদ্যপান করেন না বললেই হয়। নেহাত শিষ্টাচার রাখার জন্যে কদাচিৎ চুমুক দেন দুএক পেগ। ঘরে বসে দুজনে দুটো গেলাসে উৎকৃষ্ট বিদেশী হুইস্কি–যা কর্নেলের এক কাপ্তেন বন্ধু উপহার দিয়েছেন সম্প্রতি, তারিয়ে-তারিয়ে খেতে থাকলাম। এই সময় ফোন এল। কর্নেল ফোন ধরলেন। যথারীতি হুম হাম করে গেলেন। তারপর ফোন রেখে বললেন, অতীন্দ্রের বউ শ্ৰীমতী জিনা হেওয়ার্থকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ যাবার আগে কেটে পড়েছে। আর আমার মক্কেল ভদ্রলোক অর্থাৎ জাল অরিন্দম রায় অর্থাৎ মুঙ্গেরের সেই রাজবাহদুরের পোষ্যপুত্র ধরা পড়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ ইন্দ্রপুরীর সামনাসামনি আরেকটা হোটেল পূর্বশ্রীতে ওকে ধরেছে।

বললাম, কী ভাবে ধরল বলুন তো?

কর্নেল বললেন, কুকুরের সাহায্যে। আজকাল লালবাজার কুকুর দিয়ে খুনী ধরায় ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। যাই হোক, ভদ্রলোকের নাম পরিতোষ রায়–পূর্ব উপাধি মিত্র। উনি সকালে আমাকে ফোনে এক পি. মিত্রের শাসানির কথা বলছিলেন, আশাকরি মনে আছে। সেই পি. মিত্র উনি নিজেই।

গেলাসে চুমুক দিয়ে বললাম, পরিতোষ অরিন্দমের গতিবিধির খবর রাখতেন বোঝা যাচ্ছে।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। অরিন্দম রায় ওরফে প্রিন্স ফরিদ বিক্রি করে দেওয়া নেকলেস হাতাবার ফিকিরে বিশাল জাল পেতেছিল। জিনা হেওয়ার্থ আর লিজা তার দলের মেয়ে। আমেরিকায় অতীন্দ্র যায় ছবির একজিবিশান করতে। ওই সময় অশনি বিখ্যাত খেলোয়াড়–সেও যায় খেলা উপলক্ষে। ব্যস, দুজনেই– অর্থাৎ দুই বন্ধুতেই জালে জড়িয়ে পড়ে। সুন্দরী বিদেশিনী দেখে মাথা ঘুরে যায়।… গেলাসে চুমুক দিয়ে কর্নেল ফের বলতে থাকলেন, জিনাই অতীন্দ্রকে কোন ছলে নেকলেস প্রসঙ্গ নিয়ে সম্ভবত পীড়াপীড়ি করেছিল। সরলমনা শিল্পী ছেলে। সে অতটা বোঝেনি। এবার আসছি আমার মক্কেলের কথায়। তবে পরিতোষের স্বীকারোক্তি পেলে সব জানা যাবে। আমার ধারণা, সেও এক পুরনো পাপী। প্রিন্স ফরিদের দলবল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। পরিতোষ সম্ভবত এই দলের স্থানীয় নেতা। অরিন্দমের তাকে চেনার কথা নয়। তাই নেকলেস চক্রান্ত তাকেও জানানো হয়েছিল। কিন্তু সে চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে চেয়েছিল। তাই অরিন্দমকে খুন না করে উপায় ছিল না। শুধু এটাই বোঝা যাচ্ছে না, খুন করে লাশটা ফেলে রেখে উধাও হল কেন? লাশ সামলাবার চেষ্টা করল না! হোটেলেও আর ফিরল না এবং আমার দ্বারস্থই বা হল কেন? যাক গে, কাল নিশ্চয় বোঝা যাবে। পুলিশ ওর স্বীকারোক্তি আদায় না করে ছাড়বে না!

রাত তখন সাড়ে বারোটা। দৈনিক সত্যসেবক অফিসে ঘটনাটা দ্রুত লিখছি। সেই সময় আরেক রিপোর্টার শতদ্রু বলল, তোমার ফোন, জয়ন্ত!

কর্নেলের ফোন। বললেন, জয়ন্ত! তোমার লিড স্টোরির বাকি তথ্যটা নাও। অশনির বউ সীমা ওরফে লিজা এবং পরিতোষ দুজনেই কনফেস করেছে। হোটেল ইন্দ্রপুরীতে ফোন করে অরিন্দমের সঙ্গে তার যোগাযোগ রাখার কথা ছিল। অরিন্দমের কণ্ঠস্বর শুনে তার সন্দেহ হয়। সকালে সে হোটেল এসেছিল অরিন্দমের খোঁজে। রিসেপশনিস্টের সাক্ষ্যও রয়েছে। এদিকে পরিতোষ দলের প্রতীকচিহ্ন দেখিয়ে লিজার সঙ্গে রফা করে। বলে, যা হবার হয়েছে–আমরা বরং নেকলেসটার তিনজনেই মালিক হব। তুমি জিনাকে ম্যানেজ করো। লিজা জিনাকে ব্যাপারটা জানায়–ফোন বন্ধ ছিল। বোসবাড়িতে, তাই একেবারে বিয়ের পার্টিতে গিয়ে সেটা জানায়। দুজনে কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করে। তাই আমরা বুঝতে পারিনি কিছু। যাই হোক, লিজা পরিতোষকে পরামর্শ দেয়, অবিলম্বে ইন্দ্রপুরী ছাড়তে। কারণ প্রিন্স ফরিদের অন্যান্য অনুচর এসে পড়বে এবং অরিন্দমের বদলে পরিতোষকে দেখে গণ্ডগোল করে ফেলবে। দুজনকে ম্যানেজ করা যায়–দলের একগাদা লোককে ম্যানেজ করা কঠিন। তাছাড়া নেকলেসের অংশীদার বাড়িয়েও লাভ নেই। পরিতোষ বলে, সে ছদ্মবেশে বিয়ের পার্টিতে যাবে। মুখে দাড়ি রাখবে, মাথায় টাক থাকবে। নিউইয়র্কারে নয়, পরিতোষ কলকাতাবাসী বলেই স্থানীয় কাগজে আমার ছবি দেখেছিল। ভেবেছিল, এই সুযোগে প্রখ্যাত এই বুড়ো ঘুঘুকে টেক্কা দেওয়া যাবে। এটা গর্বের বিষয়। হবে তার কাছে। অপরাধীদের এই মনস্তত্ত্ব আশাকরি তুমি বিলক্ষণ জ্ঞাত আছে, জয়ন্ত!

বললাম, হ্যাঁ। সেবারে কুখ্যাত দাগী হরনাথ আপনাকে নিয়ে খেলা করতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়েছিল। কিন্তু অরিন্দম পরিতোষকে না চিনলে দরজা খুললেন কেন?

কর্নেল বললেন, দলের কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করেছিল। আর কোন প্রশ্ন আছে? আমি এবার ঘুমোতে যাব কিন্তু। আর ডাকাডাকি করে পাবে না।

হেসে বললাম, তাহলে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত আপনার লালপোকা-নীলপোকা হয়ে দাঁড়াল!

কর্নেলের হাসি শোনা গেল। …এগজ্যাক্টলি, ডার্লিং! পরিতোষ আর অরিন্দম কিংবা অরিন্দম এবং পরিতোষ! তবে এক্ষেত্রে রংটা নিরামিষ নয় রক্তের। তফাত এইটুকু। আচ্ছা ছাড়ি।

ব্যস্ত হয়ে বললাম, একমিনিট–একমিনিট কর্নেল! ভাইটাল প্রশ্নটা বাকি। পরিতোষ আপনাকে পার্টিতে পাঠিয়ে নিজে গেল না কেন? সেটাই তো তার পক্ষে সহজ ছিল।

কর্নেল জবাব দিলেন, তুমি তো এসব অপরাধীদের হালহদিস ভালই জানো, জয়ন্ত। একদলের লোক হয়েও এরা পরস্পর পরস্পরকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়। পরিতোষ লিজার সঙ্গে রফা করেছিল–কিন্তু সাবধান হতে ভোলেনি। যদি লিজা আর জিনা তাকে কোনভাবে ফাঁসিয়ে দেয় কিংবা লিজা তাকেই গুলি করে বসে! কিংবা যদি প্ল্যান বদলে অন্য প্ল্যানে নিজেরা নেকলেসটা হাতাবার চেষ্টা করে ফেলে! দলের নেতা মৃত। কিন্তু সে লিজা ও জিনাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি। অতএব কিছু ঘটলে কর্নেলের ওপর দিয়েই ঘটুক। যদি সত্যি এমন হত যে নিজাই নেকলেসটা নিয়ে পালিয়ে গেল, অর্থাৎ আমার পকেটে ওটা পরিতোষ পেল না–তাকে দৌড়তে হত লিজার পেছনে। সে প্ল্যানমতো আমার ওপর পথে হামলা করতে চেয়েছিল। পারল না। তাই তখন এয়ারপোর্টে লিজার কাছে ব্যাপারটা জানতে ছুটে গিয়েছিল। পরিতোষ সেটা বলেছে। এয়ারপোর্টে স্বচক্ষে লিজাকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে দেখেই সে পূর্বশ্রী হোটেলে চলে আসে। কেটে পড়ার তালে ছিল। পারল না। আশাকরি, সব পরিষ্কার হয়েছে জয়ন্ত!

বললাম, কর্নেল। কালকের দৈনিক সত্যসেবকে যে রোমাঞ্চকর খবর বেরোবে, তার লাস্ট লাইনে লিখে দেব–বিদেশে গিয়ে মেমসাহেব সম্পর্কে ভারতীয়রা এবার সাবধান হবেন কি?

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ছাড়ি। আবার দেখা হবে ডার্লিং!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress